এটা সত্য, ওবামা ঐতিহাসিক কিউবা সফর শেষ করেছিলেন এ বছরের মার্চে। তিনি ভিয়েতনামের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের উন্নতি করেছিলেন এবং ভিয়েতনাম সফরে গিয়েছিলেন। ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কখনও ভালো ছিল না। যে দেশটি আজ থেকে ৪৫ বছর আগেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘যুদ্ধ’ করেছে, তারাই আজ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র। ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পোশাকের যে বিশাল চাহিদা, তার একটা বড় অংশ সরবরাহ করছে ভিয়েতনাম। এ ক্ষেত্রে রাজনীতি অগ্রাধিকার পায়নি। পেয়েছে বাণিজ্য। এখন কিউবা কী প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাও দেখার বিষয়। তবে হুট করে দু’দেশের সম্পর্কে কোনো বড় পরিবর্তন আসবে না। প্রেসিডেন্ট রাউল কাস্ত্রো ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, ওবামার প্রস্তাবের ভিত্তিতে কিউবার রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আসবে না।
কিউবার জনগণ এখনও সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। তবে এটাও ঠিক বিশ্বায়নের এ যুগে কিউবা ‘একা’ চলতে পারবে না। দেশটিকে ‘দুয়ার উন্মুক্ত’ করে দিতে হবেই। দেশের অর্থনীতির ৮০ ভাগ এখনও সরকার নিয়ন্ত্রিত। কিছু কিছু ক্ষুদ্র ব্যবসা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সারা দেশে এ সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার। বেসরকারি খাত সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে পর্যটন খাত। এ খাত কিছুটা উন্মুক্ত করা হয়েছে। আরও উন্মুক্ত করা হলে যুক্তরাষ্ট্রের হোটেল চেন ব্যবসায়ীরা এ খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। কিউবায় সীমিত আকারে ‘ডলার বাণিজ্য’ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত কিউবান-আমেরিকানদের পাঠানো অর্থ এখন নিয়মিত কিউবায় যাচ্ছে। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে একটা সমস্যা রয়েছে। কিউবা প্রতিদিন এক লাখ ব্যারেল তেল ‘অত্যন্ত কম মূল্যে’ ভেনিজুয়েলা থেকে পেয়ে আসছে। এর বিনিময়ে কিউবা ডাক্তার, নার্স, শিক্ষক দিচ্ছে ভেনিজুয়েলাকে। এসব ডাক্তার, নার্স আর শিক্ষক এখন ভেনিজুয়েলার হয়ে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে কাজ করছেন। এর পুরো ব্যয়ভার বহন করছে ভেনিজুয়েলা। প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজ এ পরিকল্পনা শুরু করলেও বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাদুরো এ পরিকল্পনা কতদিন টিকিয়ে রাখতে পারবেন, সেই প্রশ্ন ইতিমধ্যে উঠেছে। কেননা ভেনিজুয়েলার রমরমা তেল ব্যবসার দিন শেষ। অর্থনীতি আগের মতো আর শক্তিশালী নয়। রাজধানী কারাকাসে বিশাল বিশাল ভবন খালি পড়ে আছে। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আসছেন না। রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে। এরই মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভেনিজুয়েলার সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। ভেনিজুয়েলার ওপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। যখন ওবামা কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ নেন, তার ঠিক একদিন পর ১০ ডিসেম্বর (২০১৫) এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। নিষেধাজ্ঞা আরোপের এ ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর মেনডেজ ‘ভেনিজুয়েলার জনগণের বিজয়’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। গত এপ্রিল থেকেই সেখানে অসন্তোষ চলছে।
যুক্তরাষ্ট্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে ভেনিজুয়েলার বেশ কয়েকজন ভিআইপির ব্যাপারে। এ ক্ষেত্রে সম্পদ আটক থেকে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ রয়েছে ভেনিজুয়েলার মারাত্মক মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতির বিরুদ্ধেও। এটা সত্য, হুগো শাভেজের মৃত্যুর পর ভেনিজুয়েলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। কিন্তু এর চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি বিরাজ করছে কলম্বিয়া ও মেক্সিকোয়। মেক্সিকোয় ২০১৪ সালে ৪৩ স্কুল শিক্ষার্থীকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে কোনো বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। ভেনিজুয়েলার বিষয়টি যে পুরোপুরি রাজনৈতিক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন খুব সঙ্গত কারণেই ভেনিজুয়েলার ওপর মার্কিন ‘চাপ’ যদি বাড়ে, তাহলে কিউবাকে দেয়া তাদের আর্থিক সহযোগিতা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে তা কিউবার অর্থনীতিকে আঘাত করবে।
কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করে খোদ যুক্তরাষ্ট্রও উপকৃত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য খাত মারাত্মক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তারা পর্যাপ্ত ডাক্তার, নার্স কিংবা স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি করতে পারছে না। স্বাস্থ্যকর্মীদের একটা বড় অংশ আসছে বাইরে থেকে। অন্যদিকে কিউবার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা জগদ্বিখ্যাত। তারা যুক্তরাষ্ট্রের এ চাহিদা পূরণ করতে পারে। ২০০২ সালে ফিদেল কাস্ত্রো এ ধরনের একটি প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়েছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা গ্রহণ করেনি। ২০১৪ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় মারাত্মক ইবোলা রোগ ছড়িয়ে পড়ায় কিউবার স্বাস্থ্যকর্মীরা সেখানে গিয়েছিলেন। এখন কিউবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের উন্নতি হলে যুক্তরাষ্ট্র স্বাস্থ্য খাতে উপকৃত হতে পারে। কিন্তু ট্রাম্প এদিকে দৃষ্টি দেবেন বলে মনে হয় না।
মূল সমস্যাটি হচ্ছে মানসিকতার। যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রণেতাদের মানসিকতায় কী পরিবর্তন আসে, সেটাই দেখার বিষয় এখন। গত ১৪ আগস্ট (২০১৫) হাভানায় মার্কিন দূতাবাসে পতাকা উত্তোলনকালে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বলেছিলেন, কিউবা এখন আর শত্রু নয়, বন্ধু। বাস্তব ক্ষেত্রে এ ‘বন্ধুত্বের’ কতটুকু প্রতিফলন ঘটে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। ওবামা কি মনে করেন রাউল কাস্ত্রোর নেতৃত্বাধীন কিউবায় পরিবর্তন এসেছে? কিউবা কি আসলেই সব ‘উন্মুক্ত’ করে দিয়েছে? আমার তা মনে হয় না। দেশটির অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় কমান্ড এখনও বজায় রয়েছে। এখানে ভিয়েতনামের ‘দই মই’ স্টাইলে কিছু পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে, এটা সত্য। বিনিয়োগকে স্বাগত জানানো হচ্ছে। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে বিনিয়োগ উন্মুক্ত নয়।
এ প্রসঙ্গে নবনিযুক্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কিছু মন্তব্য উল্লেখ করা প্রয়োজন। প্রয়াত ফিদেল কাস্ত্রোকে ট্রাম্প ‘নিষ্ঠুর একনায়ক’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ওবামা এ ধরনের কোনো মন্তব্য করেননি। ফিদেল কাস্ত্রোর মূল্যায়নের ভার তিনি ইতিহাসের কাছে ছেড়ে দিয়েছেন। ট্রাম্প গত ২৮ নভেম্বর অপর এক টুইট বার্তায় বলেছেন, ‘কিউবা তার দেশের জনগণ, কিউবান-আমেরিকান নাগরিক, সর্বোপরি গোটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আরও একটি চুক্তি করতে আগ্রহী না হলে আমি যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা চুক্তির সমাপ্তি টানব।’ ট্রাম্পের এ বক্তব্য স্পষ্ট। তার মতো কট্টরপন্থীরা চান কিউবার আরও বেশি সংস্কার। বিশেষ করে রাজনৈতিক সংস্কারের পক্ষপাতী রিপাবলিকানরা। একদলীয় শাসনের অবসান, অর্থনীতি আরও বাজারমুখী করা, বৈদেশিক বিনিয়োগ আরও উন্মুক্ত করে দেয়া- এসব ট্রাম্পের ‘এজেন্ডায়’ থাকবে। তবে রাউল কাস্ত্রো এসব দাবি মেনে নেবেন, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। ফলে ওবামা প্রশাসনের আমলে কিউবা-যুক্তরাষ্ট্র একটি ‘নয়া উদ্যোগের’ সূচনা ঘটালেও সেই ‘উদ্যোগে’ এখন ভাটা পড়তে পারে। ট্রাম্প ব্যবসায়ী। তিনি জানেন ও বোঝেন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা এখন কিউবায় বিনিয়োগের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। ওবামা তাদের জন্য এ সুযোগটি তৈরি করে দিয়েছেন। ১ ডিসেম্বর থেকে আমেরিকান এয়ারলাইন্স তাদের হাভানা ফ্লাইট চালু করেছে। ভ্রমণকারীদের জন্য একটি ‘স্বর্গরাজ্য’ হতে পারে কিউবা। এখন এ ‘সম্ভাবনাকে’ ট্রাম্প অস্বীকার করবেন কীভাবে?
ফিদেল কাস্ত্রো তার দীর্ঘ শাসনামলে কিউবায় এমন একটি সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, যে ব্যবস্থা হঠাৎ করে ভেঙে যাবে না। তবে পরিবর্তন আসাটা স্বাভাবিক। আর পরিবর্তনটা আসবে অর্থনীতিতে। চীন ও ভিয়েতনাম এতে সফল হয়েছে। কিউবাও সফল হবে। এটাকে তারা বলছে ‘খরহবধসরবহঃড়ং’, অর্থাৎ ‘আপডেট’ করা, অর্থনীতিকে ‘আপডেট’ করা। এখানে অনেক বিষয়ে তারা হাত দিয়েছে। যেমন, সরকারের কাছে থাকা অব্যবহৃত জমি কৃষকদের কাছে ‘লিজ’ দেয়া, এর পরিমাণ বাড়ানো। টুরিজম, হোটেল ব্যবসা (ব্যক্তিগত খাতে) উন্মুক্ত করা এবং ব্যাংকিং খাত আরও সহজলভ্য করা, যে কোনো ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করা ইত্যাদি। বেকার সমস্যা সমাধানেরও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। একটি পরিবার যে বাড়িতে থাকবে, ২০ বছর পর যাতে সেই বাড়ির মালিক হতে পারে, তেমন উদ্যোগও আছে সরকারের। বিদেশী বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতে চাচ্ছে সরকার। এ জন্য ৮ বছরের ‘ট্যাক্স ফ্রি’র সুবিধাও আছে। তবে এ ক্ষেত্রে সমস্যা আছে। বিশেষ অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠা করে বিদেশী বিনিয়োগের চেষ্টা চললেও সেসব প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করবেন, তাদের বেতন দেবে সরকার। আর সরকার ওইসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় কর্মচারীদের জন্য বেতন নেবে। স্থানীয় মুদ্রা ‘পেসো’তে কর্মীরা বেতন পাবেন। এক ধরনের দ্বৈত মুদ্রাও বহাল আছে কিউবায়- জাতীয় পেসো (সিইউপি) ও বিনিময়যোগ্য পেসো (সিইউসি)। দুই মুদ্রামানের মধ্যে পার্থক্যও আছে (এক সিইউসির মান ২৫ সিইউপির সমান। অবশ্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে এর মান সমান সমান। এটা একটা জটিলতা তৈরি করেছে। এ ক্ষেত্রে সংস্কারটা জরুরি।
রাউল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘সংস্কারটা হবে ধীরে ধীরে। তবে থেমে থাকবে না।’ এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। ধ্রুপদী মার্কসবাদ এখন আর কোনো দেশেই বহাল নেই। যুগের সঙ্গে তালমিলিয়ে পরিবর্তন এসেছে। এটা প্রমাণিত যে, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে রাজনৈতিক সংস্কার সম্ভব নয়। গর্বাচেভ তার ‘পেরেস্ত্রয়কা’ কর্মসূচির মাধ্যমে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতিতে পরিবর্তন এনেছিলেন। তার ‘গ্লাসনস্ত’ বা খোলা দুয়ার নীতি ছিল অনেকটা রাজনৈতিক সংস্কার। বিপত্তিটা ঘটেছিল সেখানেই। চীন রাজনৈতিক সংস্কার বা গ্লাসনস্তের ওপর গুরুত্ব দেয়নি। দিয়েছিল পেরেস্ত্রয়কার ওপর। অর্থাৎ অর্থনৈতিক সংস্কার। ভিয়েতনামেও এসেছে অর্থনৈতিক সংস্কার। তাই অর্থনৈতিক সংস্কার বা ‘economica reformationis’ কিউবায় আসবে। এবং সেটা ধীরে ধীরে। এটা বলাই যায়, কিউবা ধীরে ধীরে এক ‘নয়া তরুণ নেতৃত্বের’ জন্য তৈরি হচ্ছে। বিপ্লবের ‘ওল্ড গার্ড’রা ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছেন। পরিণত বয়সে ফিদেল কাস্ত্রো বিদায় নিলেন। রাউল কাস্ত্রো ক্ষমতা ছাড়বেন দু’বছর পর। ফলে এক নয়া নেতৃত্বের জন্য তৈরি হচ্ছে কিউবা। এখন দেখতে হবে এ নয়া তরুণ নেতৃত্ব কীভাবে একুশ শতকে কিউবার নেতৃত্ব দেন।
Daily Jugantor
04.12.2016
0 comments:
Post a Comment