রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কোন পথে কিউবা




ফিদেল কাস্ত্রোর মৃত্যুর পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে কোন পথে এখন যাবে কিউবা? আরো অনেক প্রশ্ন এখন আছে কিউবাকে ঘিরে। প্রতিটি প্রশ্নের সঙ্গে কিউবার ভবিষ্যৎ রাজনীতি জড়িত।
প্রথমত, ফিদেলের অবর্তমানে রাউল কাস্ত্রো কত দিন ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন? যদিও রাউল কাস্ত্রো বলেছেন, তিনি ২০১৮ সালে পার্টির পরবর্তী কংগ্রেসে ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন। একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল দিয়াজ ক্যালেনকে তাঁর উত্তরসূরি ভাবা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি কি পার্টির ভেতরকার অন্তর্দ্বন্দ্ব এখন থামাতে পারবেন? বিপ্লবের ওল্ড গার্ডরা এখন ধীরে ধীরে পর্দার অন্তরালে চলে যাচ্ছেন। বিপ্লব হয়েছে সেই ১৯৫৯ সালে। আজ ২০১৬ যাই যাই করছে। বিপ্লবীদের অনেকেই নেই। রাউল কাস্ত্রোর বয়সও ৮৫। এই বয়সে তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে কতটুকু সুস্থ—সেটাও একটা প্রশ্ন। তবে মিগুয়েল দিয়াজ ক্যানেলের বয়স কম। মাত্র ৫৯ বছর। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁকে সবাই মানবে কি না? দুই বছরের মতো রাউল ক্ষমতায় থাকবেন। এই দুই বছরে ছেলে আলেজান্দ্রো কাস্ত্রো এসপিন ও মেয়ের স্বামী (যিনি একজন জেনারেলও বটে) লুইস আলবার্টো রডরিগেজের ভূমিকা কী হয়, সেটা দেখার বিষয়। পার্টির হাইকমান্ডে দু-একজন বিপ্লবী এখনো আছেন বটে, কিন্তু বয়সের ভারে সবাই ন্যুব্জ। নয়া নেতৃত্বের জন্য তৈরি হচ্ছে কিউবা। প্রশ্নটা সেখানেই, নয়া নেতৃত্বের মধ্যে ঐক্য কতটুকু বজায় থাকবে? দ্বিতীয়ত, ফিদেল কাস্ত্রোপরবর্তী কিউবার নেতৃত্ব কি দেশটিকে ‘উন্মুক্ত’ করে দেবে? বর্তমান নেতৃত্ব কি সংস্কার কর্মসূচি নিয়ে আরো এগিয়ে যাবে? কিউবার ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য এটি একটি মৌলিক প্রশ্ন এখন। কিউবার বিপ্লবের ‘ওল্ড গার্ড’রা এখনো ক্ষমতায়। তাঁরা যেকোনো ধরনের সংস্কারের বিরোধী। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারেও আপত্তি রয়েছে ‘ওল্ড গার্ড’দের। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, সংস্কার ছাড়া কিউবার সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংস্কার নয়, অর্থনৈতিক সংস্কার আসবে। এরই মধ্যে অর্থনৈতিক সংস্কার এসেছে। গর্বাচেভ উভয় ক্ষেত্রে সংস্কার আনতে গিয়ে বড় ‘ভুল’ করেছিলেন। তাঁর ‘পেরেস্ত্রোইকা’কে অনেকে সমর্থন করলেও ‘গ্লাসনস্ত’কে সমর্থন করেননি।
চীনে রাজনৈতিক সংস্কার তথা রুশ ভাষায় ‘গ্লাসনস্ত’ আসেনি। এসেছে ‘পেরেস্ত্রোইকা’, অর্থাৎ অর্থনৈতিক সংস্কার। ভিয়েতনামেও এসেছে অর্থনৈতিক সংস্কার। ওরা যাকে বলছে ‘দই মই’।
বাকি ছিল কিউবা। এখানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংস্কার এসেছে। ভবিষ্যতেও আসবে। কিউবা ঠিক সংস্কার বলছে না। বলছে ‘আপডেট’, আর স্প্যানিশ ভাষায় বলা হচ্ছে Lineamientos। এর মাধ্যমে কিউবা বোঝাতে চাইছে, তারা অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কিছুটা ‘পরিবর্তন’ আনতে চাইছে। তারা কয়েকটি ক্ষেত্রে সংস্কারে এনেছে এবং আরো সংস্কারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যেমন সরকারের কাছে যেসব অব্যবহৃত জমি রয়েছে, তা ‘লিজ’ দেওয়া হচ্ছে এবং ১০ বছর পর ওই জমির মালিকানা চলে যাচ্ছে তার কাছে। যিনি ‘লিজ’ নিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত খাত উন্মুক্ত করা হচ্ছে অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে; ট্যুরিজম, হোটেল ব্যবসায় ব্যক্তিগত পুঁজি বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। তিনটি প্রদেশের (হাভানা, মায়ালেক, আর্টেমিসা) ৭০ শতাংশ কৃষিজমি বাজারদর অনুযায়ী বিক্রি করা হচ্ছে। ২০১৪ সালে কৃষিপণ্যের জন্য ‘হোলসেল মার্কেট’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এর মধ্যেই ৩৭ লাখ একর জমি ব্যক্তিগত খাতে বিক্রি হয়েছে। কৃষকদের কাছে এই জমি বিক্রি করার কথা বলা হলেও, দেখা গেছে যারা কিনেছে, তাদের মধ্যে ৭৭ শতাংশের কৃষিকাজে কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। সমাজতান্ত্রিক সমাজেও বেকার আছে। ছদ্মবেকার আছে, যা সরকারিভাবে স্বীকার করা হয় না। বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার সেখানে ‘নিজ উদ্যোগে কর্মসংস্থান’-এর একটি  পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এটাকে তারা বলছে Cuentapropistas। এর মধ্য দিয়ে ১৮ লাখ লোকের (২০১৫) কর্মসংস্থান হয়েছে। ৪৯৮টি সমবায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। ভবিষ্যতে এটা আরো তিন গুণ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিউবায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা ‘ফ্রি’। কর্মক্ষম মানুষ (পুরুষ ৬০, মহিলা ৫৫) অবসর নিতে পারে। লাতিন আমেরিকায় মানুষ যত দিন বেশি বাঁচে, তুলনামূলক বিচারে কিউবায় তার অবস্থান দ্বিতীয়। সামাজিক খাতে বরাদ্দ থাকে জাতীয় বাজেটের  ৫৫ শতাংশ (এখন ৫১ শতাংশ) ও জিডিপির ৩৭ শতাংশ। মাসের নির্দিষ্ট দিনে রেশনেরও ব্যবস্থা আছে; যদিও এখন কিউবা এ রেশনের পরিবর্তে অন্যভাবে মানুষকে রাষ্ট্রীয় সেবা দিতে চাইছে। সরকার প্রতিটি পরিবারকে একটি বাড়ি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ২০ বছর একটি বাড়িতে বসবাসের পর ওই বাড়ির মালিকানা তার হয়ে যায়। তবে বাড়ির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। প্রায় ১০ লাখ ইউনিট বাড়ি করার কথা বলছে সরকার। বিদেশি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতে চাইছে কিউবা। এ জন্য বিশেষ বিশেষ শিল্প এলাকাও প্রতিষ্ঠা করছে সরকার। একজন বিনিয়োগকারী আট বছর ট্যাক্স সুবিধা পাবেন। এখানে কিছুটা সমস্যা আছে। কর্মীদের এখানে বেতন দেবে সরকার। অর্থাৎ কিউবান ‘পেসো’ দিয়ে তাদের মজুরি পরিশোধ করা হবে। কিন্তু সরকার ওই বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ‘হার্ড কারেন্সি’তে, অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রায় মজুরি গ্রহণ করবে। কিউবার অর্থব্যবস্থায় দুই ধরনের অর্থের প্রচলন আছে। ‘ন্যাশনাল পেসো’ ও ‘কনভার্টিবেল পেসো’। দুই ধরনের মুদ্রার মানেরও পার্থক্য রয়েছে। ‘কনভার্টিবেল পেসো’র মান কমিয়ে রাখা হয় বলে অভিযোগ আছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুই মুদ্রারই মান এক। তবে ২৫ ‘ন্যাশনাল পেসোর’ বিনিময়ে এক ‘কনভার্টিবেল পেসো’ পাওয়া যায়, যা বিনিময়যোগ্য। অদ্ভুত এ ‘ব্যবস্থা’ একটি জটিলতা সৃষ্টি করেছে। এসব ক্ষেত্রে সংস্কার আনতে হবে। বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানো যায়। সীমিত আকারে ক্রেডিট কার্ডও চালু রয়েছে। অবকাঠামো ক্ষেত্রে তেমন কোনো উন্নয়নও চোখে পড়ে না।
কিউবার বৈদেশিক আয়ের একটা বড় অংশ আসে ভেনিজুয়েলা থেকে। ভেনিজুয়েলা ‘বার্টার ট্রেডে’র মাধ্যমে অত্যন্ত কম মূল্যে কিউবাকে জ্বালানি তেল দেয়। বিনিময়ে কিউবা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে তা পরিশোধ করে। ভেনিজুয়েলার প্রয়াত নেতা হুগো শাভেজ ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নতির জন্য একটি প্রকল্প চালু করেছিলেন অনেক আগে। সেখানে বিপুল পরিমাণ কর্মী দিয়ে কিউবা সাহায্য করছে। তবে ভেনিজুয়েলার অবস্থা বর্তমানে খারাপ। ফলে কিউবাকে দেওয়া সেই আর্থিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
একসময় প্রশ্ন ছিল সমাজতান্ত্রিক সমাজে আদৌ পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। এ ধারণা ভেঙে দিয়েছেন চীনের প্রয়াত নেতা জেং জিয়াও পিং। তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘বিড়াল সাদা কি কালো সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা বিড়াল ইঁদুর মারে কি না?’ অর্থনীতি সমাজতান্ত্রিক, নাকি বাজারনির্ভর সেটা মুখ্য নয়। মুখ্য হচ্ছে উন্নয়ন। তাই রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব বজায় রেখেই চীনে অর্থনীতিতে পরিবর্তন এসেছিল। চীনা নেতারা এর সফলতাও পেয়েছিলেন। চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বড় অর্থনীতি। জিডিপি প্রবৃদ্ধি চীন এখন কমিয়ে আনছে। আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় চীনের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। চীনের এই আর্থিক ভিত্তির জন্ম দিয়েছিলেন দেং জিয়াও পিং। চীনকে অনুসরণ করে ভিয়েতনামও ‘দই মই’ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এখানে সংস্কার হচ্ছে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। রাজনৈতিক কাঠামোয় (চীন ও ভিয়েতনাম) একদলীয় শাসন বজায় রয়েছে। তবে একটা পরিবর্তন এনেছে চীন, তা হচ্ছে সিনিয়র নেতাদের অবসর। সিনিয়র নেতারা আজীবন তাঁদের নিজ নিজ ‘পদ’ ধরে রাখতে পারবেন না। রাষ্ট্রপ্রধানরা দুই টার্মের বেশি থাকতে পারবেন না। এখন কিউবাও এ পদ্ধতি অনুসরণ করছে। চীন ও ভিয়েতনামে সেনাবাহিনী এখনো পার্টির নিয়ন্ত্রণাধীনে। পার্টির ‘মিলিটারি কমিশন’ সেনাবাহিনীকে পরিচালনা করে। চীনা সেনাবাহিনী পার্টির প্রতি অনুগত্য আছে বিধায় চীন এখনো ভেঙে যায়নি। কিউবায় সেনাবাহিনী এখনো কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি দায়বদ্ধ। কিন্তু ফিদেল তথা রাউল কাস্ত্রোপরবর্তী সেনাবাহিনী কতটুকু দায়বদ্ধ থাকবে তা নিয়ে প্রশ্ন আছেই। কিউবায় দুর্নীতির খবর আমরা তেমন একটা পাই না। তবে সমাজতান্ত্রিক সমাজে একটা ‘হিডেন দুর্নীতি’ আছে। পার্টি ব্যুরোক্রেসি সেখানে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। আমি পূর্ব ইউরোপে ‘ভেলভেট রেভল্যুশন’-এর আগে (১৯৮৯ সালে) এ দুর্নীতি দেখেছি। গবেষণার কাজে যখন রাশিয়ায় গিয়েছি, সেখানেও পরোক্ষ দুর্নীতি আমি দেখেছি। ফলে কিউবায় একদমই দুর্নীতি নেই, এটা বলা যাবে না। নয়া নেতৃত্বকে এখন এই দুর্নীতির বিষয়টিকে ‘অ্যাড্রেস’ করতে হবে।
কিউবার জন্য একটি খারাপ খবর হচ্ছে, নয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মনোভাব। যেখানে ফিদেল কাস্ত্রোর ব্যাপারে ওবামা একটি ‘নরম মনোভাব’ নিয়েছেন, সেখানে ট্রাম্প মন্তব্য করেছেন ‘নিষ্ঠুর একনায়ক’ হিসেবে। এ মন্তব্যের মধ্য দিয়েই তিনি বুঝিয়ে দিলেন কিউবার ব্যাপারে তাঁর প্রশাসনের ভূমিকা কী হবে। ওবামার সময় দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের একটা সম্ভাবনার জন্ম হয়েছিল। ওবামা নিজে হাভানায় ছুটে গেছেন। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এখন নতুন একজন প্রেসিডেন্ট পেয়েছে। কিউবার ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বন্ধুসুলভ নয়। গত ২৮ নভেম্বর ট্রাম্প এক টুইট বার্তায় বলেছেন, ‘কিউবা তার দেশের জনগণ, কিউবান-আমেরিকান নাগরিক ও সর্বোপরি গোটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আরো একটি চুক্তি করতে আগ্রহী না হলে আমি যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা চুক্তির সমাপ্তি টানব। ’ ট্রাম্পের এ বক্তব্য স্পষ্ট। অর্থাৎ আরো রিফর্ম, আরো সংস্কার! আরো ‘ওপেন’ করে দেওয়া। আবারও এক ধরনের ‘চাপ’-এর মুখে পড়ল কিউবা। এ ‘চাপ’ কিউবা কিভাবে কাটিয়ে উঠবে সেটাই দেখার বিষয়। ফিদেল কাস্ত্রো জীবিতকালে এ ‘চাপ’ কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘বন্ধুত্ব’ নিশ্চিত করে তিনি তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলেন। এখন বিশ্বরাজনীতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো একটি শক্তির অভাব ও একই সঙ্গে ট্রাম্প-পুতিন ‘সখ্য’ কিউবার নিরাপত্তাকে অনিশ্চিত করে তুলবে। ফলে কিউবার ভবিষ্যৎ একটা প্রশ্নের মুখে থাকলই।
Daily Kaler Kontho
05.12.2016

0 comments:

Post a Comment