রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

রাষ্ট্রপতির উদ্যোগ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন


আজ ইসি পুনর্গঠন প্রশ্নে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনায় বসছে বিএনপি। এর আগে দলটির পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশন গঠন ও শক্তিশালীকরণে ১৩ দফাসংবলিত একটি প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে পৌঁছে দেয়া হয়েছিল। ধারণা করা স্বাভাবিক, ওই ১৩ দফাকে কেন্দ্র করেই আলোচনাটি অনুষ্ঠিত হবে। তবে একটি ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ নিয়েও বিএনপি কোনো প্রস্তাব দিতে পারে। রাষ্ট্রপতি পর্যায়ক্রমে জাতীয় পার্টিসহ অন্য দলগুলোর সঙ্গেও ‘সংলাপ’ করবেন। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগও যাবে রাষ্ট্রপতির কাছে। মূল বিষয়টি হচ্ছে ইসি পুনর্গঠন। অতীতে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানও ইসি পুনর্গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমান রাষ্ট্রপতিও ‘সংলাপে’ বসছেন। কিন্তু তাতে কি আদৌ কোনো ফল পাওয়া যাবে? এখানে দুটি বিষয় আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। এক. রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ক্ষমতা, দুই. সরকারপ্রধানের দৃষ্টিভঙ্গি।

নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন জরুরি। কারণ এ কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে ফেব্রুয়ারিতে। নতুন একটি কমিশন আসছে, যারা ২০১৯ সালের সম্ভাব্য নির্বাচন পরিচালনা করবে। নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়টি পরিপূর্ণভাবে একটি প্রশাসনিক বিষয়। তবে এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে কিছুটা দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।’ সমস্যাটা এখানেই। এই যে ‘নিয়োগদান করিবেন’ কথাটা বলা হয়েছে, এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ‘স্বাধীন’ তথা ‘নিরপেক্ষ’ ক্ষমতা কতটুকু? রাষ্ট্রপতি কি এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন? আমরা যদি আবারও সংবিধানের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব এর ৪৮(৩) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।’ এর ব্যাখ্যা হচ্ছে এরকম : রাষ্ট্রপতি নিজে শুধু পারেন প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দিতে। এর বাইরে তিনি যেসব কাজ করেন (যেমন- প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনার নিয়োগ), সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেবেন। এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। কিন্তু তারপরও রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্রপতির দিকে তাকিয়ে থাকে। ভুলে যায় তার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। তবে এটাও সত্য, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান এমনই এক পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন প্রশ্নে একটি ‘সার্চ কমিটি’ গঠন করেছিলেন। এবং ওই সার্চ কমিটি কাজী রকিবউদ্দীনকে সিইসি পদে মনোনয়ন দিয়েছিল। কিন্তু সার্চ কমিটির সাংবিধানিক কোনো বৈধতা নেই। কোনো সচেতন নাগরিক এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতে গেলে আদালত ‘সার্চ কমিটির সাংবিধানিক বৈধতা’ নিয়ে একটা রায় দিতে পারতেন। কেউ উচ্চ আদালতে তখন যাননি। কেননা সবার প্রত্যাশা ছিল একজন ‘নিরপেক্ষ’ ব্যক্তিকে খুঁজে বের করার জন্য সার্চ কমিটিই উত্তম। কিন্তু সার্চ কমিটি যাকে খুঁজে বের করেছিল, তিনি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি। কাজী রকিবউদ্দীন সাবেক আমলা। ডাকসাইটে আমলা। আমলা মানসিকতার বাইরে তিনি যেতে পারেননি। যে প্রত্যাশার জন্ম হয়েছিল, সেই প্রত্যাশা তিনি পূরণ করতে পারেননি। এখন একরাশ কলংকের বোঝা মাথায় নিয়ে কাজী রকিবউদ্দীন ও তার সহকর্মীরা বিদায় নিচ্ছেন। ২০১২ সালের পর ২০১৬ সালে এসেও জাতি একই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। আবারও প্রশ্ন ও দাবি উঠেছে, ইসি পুনর্গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতি সব নিবন্ধিত দলের সঙ্গে কথা বলবেন! প্রশ্ন হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে কি একটি নিরপেক্ষ ও সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন আমরা পাব?

রাষ্ট্রপতি আপাতত ৫ দলকে ডেকেছেন। বিএনপি, জাতীয় পার্টি, এলডিপি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও জাসদ এ লিস্টে আছে। এর বাইরে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অনেক আছে। রাষ্ট্রপতি সবার সঙ্গেই তাহলে কথা বলবেন! এলডিপি বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলের শরিক। আবার জাসদ ১৪ দলীয় জোটে আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এলডিপি কি বিএনপির প্রস্তাবের বাইরে গিয়ে কোনো প্রস্তাব রাখতে পারবে? একই কথা প্রযোজ্য জাসদের ক্ষেত্রেও। জাসদ কি আওয়ামী লীগের বাইরে গিয়ে নিজস্ব কোনো প্রস্তাব রাখতে পারবে, যা ১৪ দলের স্বার্থ ক্ষুণœ করে? কিংবা দুই বড় জোটের বাইরে থাকা সিপিবি যদি এমন কোনো প্রস্তাব রাখে, তা কি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাছে গ্রহণযোগ্য হবে? পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এখন এসব প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। আবার জাতীয় পার্টি নিয়েও একটা প্রশ্ন রয়েছে। পার্টিপ্রধান এইচএম এরশাদ কি এমন কোনো প্রস্তাব রাখতে পারবেন, যা বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না? জাতীয় পার্টি সরকারে আছে। সুতরাং সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কি জাতীয় পার্টি আদৌ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে?

বাস্তবতা হল, পুরো বিষয়টিই আবর্তিত হচ্ছে সরকারের চিন্তাভাবনা ও বিএনপির প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে। যদিও প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে স্পষ্ট করেছেন, রাষ্ট্রপতি যে সিদ্ধান্ত নেবেন, তাতে তার নিজের ও দলের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৪৮(৩) ধারার বাধ্যবাধকতা অস্বীকার করবেন কীভাবে? তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ‘পরামর্শ’ করবেন, এটাই স্বাভাবিক। রাষ্ট্রপতি মূলত ইসি গঠন নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। এর বাইরে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে তিনি আলোচনা করবেন বলে আমার মনে হয় না এবং কোনো দল এটা করতে চইলে রাষ্ট্রপতির সহকারীরা তাদের নিরুৎসাহিত করবেন।

তবে ইসি গঠন প্রশ্নে বিএনপির মতামত আমরা জানি। নির্বাচনকালীন সরকার গঠন নিয়ে বিএনপি কথা বলতে পারে। তাতে রাষ্ট্রপতি সম্মতি দেবেন কিনা, তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। নির্বাচন কমিশন গঠন এবং নির্বাচন কমিশন শক্তিশালীকরণের ব্যাপারে খালেদা জিয়ার একটি রূপরেখা ইতিমধ্যে উত্থাপিত হয়েছে। আমার ধারণা, রাষ্ট্রপতি যেহেতু নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আলোচনা করবেন, সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালীকরণসংক্রান্ত খালেদা জিয়ার ১৩ দফা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হবে না। এটি একটি ভিন্ন বিষয়। এ নিয়ে রাষ্ট্রপতি নন, বরং নবনিযুক্ত সিইসি আলোচনা শুরু করতে পারেন।

খালেদা জিয়া নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে আলোচনার দাবি রাখে। মোটা দাগে খালেদা জিয়ার প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে : ১. ঐকমত্যের ভিত্তিতে ইসি গঠন; ২. একটি বাছাই কমিটি গঠন (৫ সদস্যবিশিষ্ট); ৩. বাছাই কমিটির আহ্বায়ক হবেন একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, যিনি সরকারের কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন না; ৪. বাছাই কমিটির সদস্যরা হবেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, সাবেক সচিব, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও একজন জ্যেষ্ঠ নারী; ৫. প্রতি পদের বিপরীতে ২ জনের নাম প্রস্তাব করা হবে এবং রাষ্ট্রপতি ৫ জনকে (সিইসিসহ) মনোনয়ন দেবেন। তত্ত্বগতভাবে এ ধরনের প্রস্তাব ভালো। কিন্তু সমস্যা রয়েছে অন্যত্র। জাতি হিসেবে আমরা এত ‘বিভক্ত’ যে কোনো সিনিয়র সিটিজেন এ ধরনের পদে নিয়োগ লাভে আদৌ উৎসাহিত হবেন না। তিনি দ্রুত বিতর্কিত হয়ে যেতে পারেন- এ আশংকায় কেউই দায়িত্ব নিতে রাজি হবেন না। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমনই যে, কোনো সিদ্ধান্ত যদি আমাদের মনঃপুত না হয়, তাহলে দ্রুত তাকে বিতর্কিত করে ফেলি। অনেক সময় দলের শীর্ষপদ থেকে যখন মন্তব্য করা হয়, তখন দলের প্রতিটি স্তরের নেতাকর্মীরা ওই ব্যক্তির সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন। দেশে বেশ কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রয়েছেন, যারা এখনও কর্মক্ষম। তাদের গ্রহণযোগ্যতাও আছে। কিন্তু চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে কেউই রাজি হবেন না দায়িত্ব গ্রহণ করতে।

ইসি গঠনে একটি জাতীয় ঐকমত্যের কথা বলেছেন খালেদা জিয়া। তত্ত্বগতভাবে এটিও ভালো। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। আমাদের মধ্যে ‘বিভক্তি’ এত বেশি এবং একদল অপর দলকে বিতর্কিত করতে এত বেশি পারঙ্গম যে ঐকমত্যের প্রশ্নটি অবান্তর। আমরা বারবার বলে আসছি একটি ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস’ বা আস্থার সম্পর্ক স্থাপন ছাড়া কোনোদিনই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে না। বিজয়ের ৪৫ বছর যখন পার করতে যাচ্ছি, তখনও আমরা অতীত নিয়ে অনেক বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করছি। রাজনীতির চেয়ে ব্যক্তি আক্রমণ প্রধান্য পাচ্ছে বেশি। এ মানসিকতা যতদিন না আমরা পরিত্যাগ করতে পারব, ততদিন ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ক্ষীণ। রাজনীতিকদের কিছু অলিখিত ‘কোড অব কনডাক্ট’ অনুসরণ করা উচিত। জাতীয় ইস্যুতে, জাতীয় নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে ন্যূনতম একটা ঐকমত্য থাকা জরুরি। তা না হলে বিভক্তি, তিক্ততা শুধু বাড়বেই। আর এতে করে জাতি ‘বিভক্ত’ হয়ে থাকবেই। রাজনীতিতে মতপার্থক্য থাকে। এ মতপার্থক্য যেন শুধু রাজনীতি আর কর্মসূচির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। নির্বাচন কমিশন গঠন ও শক্তিশালীকরণের প্রশ্নে বিএনপির প্রস্তাব থাকতেই পারে। আওয়ামী লীগও এ ধরনের প্রস্তাব দিতে পারে। এখন অব্দি আওয়ামী লীগ এ ধরনের প্রস্তাব দেয়নি। আমার ধারণা আওয়ামী লীগ কোনো প্রস্তাব দেবে না। বরং বিষয়টি ছেড়ে দেবে রাষ্ট্রপতির ওপর। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকের পর কার্যবিবরণী প্রকাশ এবং আলোচনায় দুটি বড় জোটের (১৪ ও ২০ দলীয় জোট) প্রতিনিধির উপস্থিতির যে কথা বলা হয়েছে, তাও বিতর্ক বাড়াতে পারে। একটি কার্যবিবরণী প্রকাশ রাষ্ট্রপতিকে অস্বীকার করার শামিল। রাষ্ট্রপতির ওপর আস্থা রেখেই তো বিএনপি আলোচনায় যাচ্ছে। তাহলে কার্যবিবরণী প্রকাশ কেন?

বাছাই কমিটির অভিজ্ঞতা আমাদের ভালো নয়। বাছাই কমিটির মাধ্যমেই কাজী রকিবউদ্দীন মনোনীত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। একজন সাবেক আমলা যে গ্রহণযোগ্য হবেন, তার কোনো মানে নেই। বরং দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় রাষ্ট্রপতি স্ব-উদ্যোগে সিইসি ও কমিশনারদের একটি তালিকা চাইতে পারেন প্রতিটি দলের কাছে। এর মধ্যে কোনো নাম যদি ‘কমন’ হয়ে যায়, রাষ্ট্রপতি ওই নামগুলো বেছে নিতে পারেন। এর মধ্য দিয়ে এক ধরনের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

আমরা এক কঠিন সময় পার করছি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) অভিজ্ঞতা আমাদের ভালো নয়। একদিকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, অন্যদিকে নির্বাচন বয়কট এবং নির্বাচন বয়কটকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংসতা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি ‘কালো’ দিক। ‘ভোটারবিহীন’ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রক্ষা করা গেছে বটে, কিন্তু দেশে নির্বাচনী সংস্কৃতির মৃত্যু ঘটেছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য শক্তিশালী একটি বিরোধী দল থাকা দরকার। যে যুক্তিতে বিএনপি ওই নির্বাচন বয়কট করেছিল, তার পেছনে ‘যুক্তি’ যাই থাকুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে আমরা একটি শক্তিশালী সংসদ পাইনি গত ৩ বছরে। সংসদ ও রাজনীতি এককেন্দ্রিক ও একদলীয় হয়ে গেছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা হতে দেখিনি। সরকারকে এক ধরনের ‘দায়বদ্ধতার’ মধ্যে আনা যায়নি। সরকার যা চেয়েছে তা-ই পাস করিয়ে নিয়েছে সংসদে। সরকারকে ‘প্রশ্ন’ করা যায়নি। কেউ প্রশ্ন করেনি। আমার বিশ্বাস, সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরাও গত ৩ বছরে তাদের কর্মকাণ্ডে স্বস্তিতে ছিলেন না। দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা বারবার বলেছেন, ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ ও ‘গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের’ কথা। এটাও একটি খারাপ দিক। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিদেশীরা হস্তক্ষেপ করবে কেন? আমাদের রাজনৈতিক সমস্যা আমরাই সমাধান করব। বৈরিতা থাকবে, মতের অমিল থাকবে। কিন্তু সমস্যার সমাধান করতে হবে আলোচনা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে।

রাষ্ট্রপতি আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি জাতির অভিভাবক। অভিভাবক হিসেবে তার যে ‘ভূমিকা’ রাখার কথা, তিনি তা-ই রাখবেন। তিনি তার ‘সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা’ সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা রাখেন। তিনি একজন আইনজীবী ও অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান। আজ এক কঠিন সংকটের মুখোমুখি জাতি। একটি সিদ্ধান্ত তিনি দেবেন বটে, কিন্তু তাতে বিএনপিসহ সব দল ‘সন্তুষ্ট’ হবে, এটা নাও হতে পারে। কিন্তু আমাদের উচিত হবে না রাষ্ট্রপতিকে বিতর্কিত করা। রাষ্ট্রপতি ইসি গঠনে একটি সার্চ কমিটি গঠন করুন আর নাই করুন, বড় দুটি দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলাটা জরুরি। এ আস্থার সম্পর্ক বিএনপিকে ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে অংশ নিতে উৎসাহিত করবে। বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসার ব্যাপারে সরকারের বড় দায়িত্ব রয়েছে। সরকারের কঠোর মনোভাব, আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলায় ব্যর্থতা আবারও ৫ জানুয়ারির মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। আমরা তা চাই না। ৫ জানুয়ারি অতীত। একটি ‘দ্বিতীয় ৫ জানুয়ারি’ কারও জন্যই মঙ্গলজনক নয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য তো নয়ই। সুতরাং রাষ্ট্রপতি যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছেন, তা সফল করার দায়িত্ব আজ সবার। সবার আস্থাভাজন একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হোক, রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ কমিশনে যুক্ত হবেন না, এ প্রত্যাশাই রইল। কারণ নিরপেক্ষতার স্বার্থে একটি ‘অরাজনৈতিক’ ইসি আমাদের দরকার।
Daily Jugantor
18.12.2016

0 comments:

Post a Comment