চলতি ডিসেম্বরে বাংলাদেশ তার বিজয় অর্জনের ৪৫ বছর পার করেছে। একটি রাষ্ট্রের জন্য এই ৪৫ বছর একেবারে কম সময় নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ একটি শক্ত অবস্থানে আছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে ধরে রাখা, পরবর্তী শিল্পোন্নত ১১টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম থাকা, বিশ্বের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবস্থান ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশ তার অবস্থান শীর্ষে ধরে রাখতে পেরেছে। এই ৪৫ বছরের বৈদেশিক নীতি যদি পর্যালোচনা করা যায়, তাহলে মূলত তিনটি ধারা আমরা লক্ষ করব। এক. স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত একটি ধারা। দ্বিতীয় ধারার সূচনা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের আগস্টের পর, যা অব্যাহত থাকে ২০০৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। তৃতীয় ধারার সূচনা হয়েছে পুনরায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে। এই তিনটি ধারায় কিছু কিছু উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আমরা লক্ষ করি। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ যে বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করেছিল, তা ছিল স্বাভাবিক; বিশেষ করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের সঙ্গে ‘বিশেষ সম্পর্ক’ ছিল আমাদের বৈদেশিক নীতির উল্লেখযোগ্য দিক। আন্তর্জাতিক আসরে চীনের বিরোধিতা ও নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থেই বৃহৎ শক্তি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ‘ভালো সম্পর্ক’ স্থাপন করেছিল বাংলাদেশ। একই সঙ্গে ১৯৭২ সালে ভারতের সঙ্গে একটি ২৫ বছর মেয়াদি মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশ যে তার জোট নিরাপত্তা (যা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল) ও ইসলামিক বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায়, তার প্রমাণ হিসেবেই ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু আলজিয়ার্সে ন্যাম সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন এবং ১৯৭৪ সালে লাহোরে ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরপরই চীন দু-দুবার জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করলেও বঙ্গবন্ধু চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে বড় পরিবর্তন আসে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। চীন ও সৌদি আরব ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ওই সময় বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে চীন ও সৌদি আরবের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায় এবং সেই সঙ্গে ভারতের সঙ্গেও সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এই প্রবণতা জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে শেখ হাসিনার প্রথম শাসনকাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। অর্থাৎ সম্পর্কের প্রশ্নে চীন ও সৌদি আরবকে গুরুত্ব দেওয়া। জিয়া মনে করতেন বাংলদেশ হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে ইসলামের ব্রিজস্বরূপ। জিয়ার শাসনামলে বাংলাদেশ ইসলামিক সলিডারিটি ফান্ডের স্থায়ী কাউন্সিলের সদস্য পদ লাভ করে। আল-কুদ কমিটি, ইরান-ইরাক যুদ্ধের মধ্যস্থতাকারী কমিটির (১৯৮১) সদস্যও ছিল বাংলাদেশ। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য পদে বিজয়ী হয়। চীনের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী এক ‘সামরিক সম্পর্কে’ বাংলাদেশ জড়িয়ে যায় ওই সময়। গঙ্গায় পানি প্রত্যাহার নিয়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের কিছুটা অবনতি হলেও ১৯৭৭ সালেই বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানিবণ্টনের প্রশ্নে একটি চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল। এই সময় (১৯৭৮) সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক আফগান আগ্রাসনের ব্যাপারে কঠোর হয়েছিল বাংলাদেশ। এমনকি প্রায় একই সময় ভিয়েতনাম কর্তৃক কম্পুচিয়া ‘দখলের’ও সমর্থন দেয়নি বাংলাদেশ, বরং কম্পুচিয়ার প্রবাসী সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল। এরশাদের সময়সীমায় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং ঢাকায় অবস্থিত ১৪ সোভিয়েত কূটনীতিককে বাংলাদেশে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের উদ্যোগেই ১৯৮৫ সালে সার্ক আত্মপ্রকাশ করে। চীনের ওপর ‘সামরিক নির্ভরতা’ (প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র ক্রয়) এরশাদের আমলেও অব্যাহত থাকে।
খালেদা জিয়া দু-দুবার সরকার পরিচালনা করেন (১৯৯১-১৯৯৬, ২০০১-২০০৬)। তিনি মূলত জিয়া-এরশাদের সময়সীমায় অনুসৃত বৈদেশিক নীতির ধারাবাহিকতা (চীনের সঙ্গে সম্পর্ক, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে উন্নতি, সার্ককে গুরুত্ব দেওয়া, সৌদি আরবের সঙ্গে ‘বিশেষ সম্পর্ক’ ইত্যাদি) অনুসরণ করেন। তিনি ‘নিবারক কূটনীতি’ প্রয়োগ করে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ নেন। তাঁর আমলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ব্যাপকভাবে অংশ নেয়। তিনি তাঁর দ্বিতীয় টার্মে ‘পূর্বমুখী বৈদেশিক’ নীতি গ্রহণ করেন। তাঁর শাসনামলেই চীনের ‘কুনমিং উদ্যোগ’ (যার পরিবর্তিত নাম বিসিআইএম)-এর কথা শোনা যায়। মিয়ানমার আমাদের সীমান্তবর্তী একটি দেশ। আমাদের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে মিয়ানমারে। ১৯৭২ সালেই মিয়ানমার আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমার আমাদের বৈদেশিক নীতিতে উপেক্ষিত ছিল। খালেদা জিয়ার শাসনামলে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
শেখ হাসিনা তিন টার্মের জন্য ক্ষমতাসীন হয়েছেন। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষমতাসীন হয়ে তিনি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারটিকে বেশ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানিবণ্টনের ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি হয়েছিল; যদিও তাঁর আমলে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তিটি তিনি আর নবায়ন করেননি। ভারতে আশ্রিত পাহাড়ি শরণার্থীদের তিনি দেশে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর আমলে সার্কের ভেতরে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার সিদ্ধান্ত (SAGQ) গৃহীত হয়েছিল; যদিও তা কার্যকর হয়নি। শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য আমদানি বাড়ে তিন গুণ। ১৯৯৮ সালে ভারত ও পাকিস্তান পর পর কয়েকটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে তিনি শান্তি স্থাপনের একটি উদ্যোগ নেন, যা প্রশংসিত হয়। তাঁর সময় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে আসেন। তাঁর শাসনামলে বাংলাদেশ সিটিপিটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। একই সঙ্গে ‘হানা’ চুক্তিও (হিউম্যানিটোরিয়ান অ্যাসিস্ট্যান্স নিডস অ্যাসেসমেন্ট) স্বাক্ষর করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। তিনি ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব ক্ষুদ্রঋণ শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে চীনকে বেছে নিলেও সামরিক ক্ষেত্রে চীনের ওপর থেকে পরিপূর্ণ নির্ভরশীলতা তিনি কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর আমলে ঢাকায় রাশিয়ার অস্ত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ওই সময় চীনের বদলে রাশিয়া থেকে আটটি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয় করেছিল (মূল্য ১২৪ মিলিয়ন ডলার)। চীন মিগ-২৯ বিমান সরবরাহ করতে রাজি হলেও বাংলাদেশ ওই বিমান রাশিয়া থেকে সংগ্রহ করেছিল। শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশ দুটি আঞ্চলিক জোট ডি-৮ ও বিমসটেকে যোগ দেয়। তিনি ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনে (ইসলামাবাদ, মার্চ ১৯৯৭) যোগ দিয়ে ইসলামিক বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদার করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ওই সময় তিনি একটি অভিন্ন বাজার প্রতিষ্ঠারও দাবি জানিয়েছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এবং ২০১৪ সালের সব শেষে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি এখনো সরকার পরিচালনা করছেন।
তাঁর সরকারের সময় অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি উন্নত হয়েছে। ট্রানজিট (ট্রান্সশিপমেন্ট অথবা করিডর) নিয়ে বাংলাদেশে বড় বিতর্ক থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর প্রথম ভারত সফরের সময় এ-সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং ইতিমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে তা কার্যকরও হয়েছে; যদিও ট্রানজিট ‘ফি’ নিয়ে একটি বিতর্ক আছে। বলা হচ্ছে ট্রানজিটের বিষয়টি বহুপক্ষীয়তার আলোকে দেখা হবে। কিন্তু দেখা গেছে ভারত একপক্ষীয়ভাবে তা ব্যবহার করেছে, ভুটান বা নেপাল এখনো ট্রানজিট পায়নি। ভারতের এ দুটি দেশকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার কথা। কিন্তু ইতিমধ্যে এই সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে—এ তথ্য আমাদের জানা নেই। এমনকি ভারতের ‘সাতবোন’ রাজ্যগুলো কর্তৃক চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা-ও বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশি পণ্য খালাস করতেই হিমশিম খাবে। এ ক্ষেত্রে ‘সাতবোন’ রাজ্যের পণ্য বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। ভারত অবকাঠামো খাতে যে ঋণ দিয়েছে তা-ও বাংলাদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর ঋণের মতোই এ ঋণ দিয়ে ভারতীয় পণ্য ও সেবা কিনতে আমরা বাধ্য। মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় যে উন্নয়ন ও সহযোগিতাসংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। ওই চুক্তিতে যে ‘ভাষা’ ব্যবহার করা হয়েছিল, তাতে ভারতীয় স্বার্থই রক্ষিত হয়েছে বেশি করে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। গত সাত বছর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফর (২০১৫) করে দুই দেশের সম্পর্ককে অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তাঁর আমলে ঐতিহাসিক ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়িত হয়েছে। ছিটমহলগুলোতে বসবাসরত (ভারতের ১১১টি, বাংলাদেশের ৫১টি) নাগরিকরা তাদের স্ব-ইচ্ছায় নিজ নিজ দেশে ফিরে গেছে। কিন্তু তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে যে সমস্যা তা রয়ে গেছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আগ্রহ থাকলেও শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারণে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হচ্ছে না। সীমান্ত হত্যাও বন্ধ হয়নি। মোদির ঢাকা সফরের সময় নতুন আঞ্চলিক জোট বিবিআইএন (বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল) আত্মপ্রকাশ করলেও নানা প্রশ্ন আছে। সার্ক অকার্যকর হয়ে গেছে। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমছে না। ট্যারিফ-প্যারাট্যারিফ কমানোর কোনো উদ্যোগ নেই। ভারত থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া গেছে বটে; কিন্তু আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না।
মহাজোট সরকারের আমলে হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির আলোকে ওই সফর গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাংলাদেশের প্রাপ্তি ছিল কম। যৌথ অংশীদারি সংলাপ নামের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তিতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই, সহিংস চরমপন্থা, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান এবং জলদস্যুতার মতো আন্তর্দেশীয় অপরাধবোধ ও নিরাপত্তা সহযোগিতার কথা বলা হয়েছিল। তবে ধারণা করা হচ্ছে এবং বিভিন্ন বিশ্লেষকের লেখনীতে এটা বেরিয়ে এসেছে যে এ ধরনের চুক্তি ভবিষ্যতে চীনের বিরুদ্ধে একটি জোট গড়ে তোলার কাজে ব্যবহৃত হতে পারে! দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান মার্কিন প্রভাব, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ গড়ে ওঠার আলোকেই হিলারির ওই সফরকে বিশ্লেষণ করা যায়; যদিও হিলারির ওই সফরে বাংলাদেশের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বাংলাদেশ তার সব পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের যে দাবি, তা এখন বাতিল হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ‘টিফা’র বদলে এখন ‘টিকফা’ চুক্তি (ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট) করেছে। এতে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশ ‘মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন’ (এমসিসি) থেকে ভবিষ্যতে সাহায্য পাবে—এমন কোনো প্রতিশ্রুতিও আমরা পাইনি। তবে হিলারি ক্লিনটনের ঢাকা সফরে তাঁর একটি বক্তব্যে আমি আশাবাদী। তরুণদের সঙ্গে এক আড্ডায় তিনি বাংলাদেশকে একটি Soft power হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। যেকোনো বিবেচনায় এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য। বিশ্ব শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়ে কিংবা আরএমজি সেক্টরে বিশ্ব আসরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে একটি ‘শক্তি’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। আমাদের নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে বাংলাদেশের এই অর্জনকে ধরে রাখা, বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের সঙ্গে দ্রুত একটা সম্পর্ক স্থাপন জরুরি। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত ভারতীয় ‘লবি’ আমাদের সাহায্য করতে পারে। শেখ হাসিনার সরকারের একটি বড় প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচন নিয়ে বহির্বিশ্বে যে নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছিল, তা তিনি কাটিয়ে উঠেছেন। বড় শক্তিগুলো তাঁর সরকারের ওপর আস্থা রেখেছে। তিনি চীন ও জাপান সফর করেছেন। চীনের প্রেসিডেন্ট ঐতিহাসিক সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন, এমনকি প্রধানমন্ত্রী গোয়ায় ব্রিকস-বিমসটেক আউটরিচ সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন (২০১৬)। এর মধ্য দিয়ে তাঁর সরকারের প্রতি এবং তাঁর বৈদেশিক নীতির প্রতি বহিঃসমর্থন আরো বাড়ল। বাংলাদেশকে এখন উঠতি শিল্পোন্নত ১১টি দেশের একটি হিসাবে ধরা হচ্ছে। এটা তাঁর জন্য একটি প্লাস পয়েন্ট। তাঁর চীন ও জাপান সফর আমাদের অর্থনৈতিক কূটনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জাপান ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক মূলত আর্থিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট। জাপানের কাছ থেকে আমরা বড় ধরনের সাহায্য পেয়ে থাকি এবং প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের সময়ও এই সাহায্যের ধারা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। চীনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। চীনের পররাষ্ট্রনীতি এখন ব্যবসানির্ভর। ‘আইডোলজি’ এখানে প্রাধান্য পায় না। ফলে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ বাড়ানো কিংবা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহ সব কিছুই আবর্তিত হচ্ছে চীনের ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণের আলোকে। বাংলাদেশ উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বিসিআইএমের (বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার) ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহী এবং এ লক্ষ্যে একটি টিম কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আরো একধাপ এগিয়ে যাবে এবং অদূর ভবিষ্যতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যে বিশাল মুক্তবাণিজ্য এলাকা গড়ে উঠছে, সেই বাজারে প্রবেশ করতে পারবে।
৪৫ বছর একটি রাষ্ট্রের জন্য কম সময় নয়। এই সময়সীমায় বৈদেশিক নীতিতে যেমন সফলতা এসেছে, ঠিক তেমনি ব্যর্থতাও একেবারে কম নয়। তবে বাংলাদেশকে এখন তাকাতে হবে ২০৫০ সালের দিকে। সনাতন বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। অর্থনৈতিক কূটনীতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। দক্ষ কূটনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তি বাড়াতে হবে। আমাদের জাতীয় স্বার্থকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলেই বৈদেশিক নীতিতে সফলতা আসবে।
Daily Kalerkontho
20.12.2016
সাম্প্রতিক সময়ে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ একটি শক্ত অবস্থানে আছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে ধরে রাখা, পরবর্তী শিল্পোন্নত ১১টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম থাকা, বিশ্বের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবস্থান ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশ তার অবস্থান শীর্ষে ধরে রাখতে পেরেছে। এই ৪৫ বছরের বৈদেশিক নীতি যদি পর্যালোচনা করা যায়, তাহলে মূলত তিনটি ধারা আমরা লক্ষ করব। এক. স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত একটি ধারা। দ্বিতীয় ধারার সূচনা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের আগস্টের পর, যা অব্যাহত থাকে ২০০৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। তৃতীয় ধারার সূচনা হয়েছে পুনরায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে। এই তিনটি ধারায় কিছু কিছু উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আমরা লক্ষ করি। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ যে বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করেছিল, তা ছিল স্বাভাবিক; বিশেষ করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের সঙ্গে ‘বিশেষ সম্পর্ক’ ছিল আমাদের বৈদেশিক নীতির উল্লেখযোগ্য দিক। আন্তর্জাতিক আসরে চীনের বিরোধিতা ও নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থেই বৃহৎ শক্তি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ‘ভালো সম্পর্ক’ স্থাপন করেছিল বাংলাদেশ। একই সঙ্গে ১৯৭২ সালে ভারতের সঙ্গে একটি ২৫ বছর মেয়াদি মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশ যে তার জোট নিরাপত্তা (যা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল) ও ইসলামিক বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায়, তার প্রমাণ হিসেবেই ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু আলজিয়ার্সে ন্যাম সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন এবং ১৯৭৪ সালে লাহোরে ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরপরই চীন দু-দুবার জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করলেও বঙ্গবন্ধু চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে বড় পরিবর্তন আসে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। চীন ও সৌদি আরব ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ওই সময় বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে চীন ও সৌদি আরবের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায় এবং সেই সঙ্গে ভারতের সঙ্গেও সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এই প্রবণতা জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে শেখ হাসিনার প্রথম শাসনকাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। অর্থাৎ সম্পর্কের প্রশ্নে চীন ও সৌদি আরবকে গুরুত্ব দেওয়া। জিয়া মনে করতেন বাংলদেশ হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে ইসলামের ব্রিজস্বরূপ। জিয়ার শাসনামলে বাংলাদেশ ইসলামিক সলিডারিটি ফান্ডের স্থায়ী কাউন্সিলের সদস্য পদ লাভ করে। আল-কুদ কমিটি, ইরান-ইরাক যুদ্ধের মধ্যস্থতাকারী কমিটির (১৯৮১) সদস্যও ছিল বাংলাদেশ। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য পদে বিজয়ী হয়। চীনের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী এক ‘সামরিক সম্পর্কে’ বাংলাদেশ জড়িয়ে যায় ওই সময়। গঙ্গায় পানি প্রত্যাহার নিয়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের কিছুটা অবনতি হলেও ১৯৭৭ সালেই বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানিবণ্টনের প্রশ্নে একটি চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল। এই সময় (১৯৭৮) সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক আফগান আগ্রাসনের ব্যাপারে কঠোর হয়েছিল বাংলাদেশ। এমনকি প্রায় একই সময় ভিয়েতনাম কর্তৃক কম্পুচিয়া ‘দখলের’ও সমর্থন দেয়নি বাংলাদেশ, বরং কম্পুচিয়ার প্রবাসী সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল। এরশাদের সময়সীমায় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং ঢাকায় অবস্থিত ১৪ সোভিয়েত কূটনীতিককে বাংলাদেশে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের উদ্যোগেই ১৯৮৫ সালে সার্ক আত্মপ্রকাশ করে। চীনের ওপর ‘সামরিক নির্ভরতা’ (প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র ক্রয়) এরশাদের আমলেও অব্যাহত থাকে।
খালেদা জিয়া দু-দুবার সরকার পরিচালনা করেন (১৯৯১-১৯৯৬, ২০০১-২০০৬)। তিনি মূলত জিয়া-এরশাদের সময়সীমায় অনুসৃত বৈদেশিক নীতির ধারাবাহিকতা (চীনের সঙ্গে সম্পর্ক, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে উন্নতি, সার্ককে গুরুত্ব দেওয়া, সৌদি আরবের সঙ্গে ‘বিশেষ সম্পর্ক’ ইত্যাদি) অনুসরণ করেন। তিনি ‘নিবারক কূটনীতি’ প্রয়োগ করে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ নেন। তাঁর আমলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ব্যাপকভাবে অংশ নেয়। তিনি তাঁর দ্বিতীয় টার্মে ‘পূর্বমুখী বৈদেশিক’ নীতি গ্রহণ করেন। তাঁর শাসনামলেই চীনের ‘কুনমিং উদ্যোগ’ (যার পরিবর্তিত নাম বিসিআইএম)-এর কথা শোনা যায়। মিয়ানমার আমাদের সীমান্তবর্তী একটি দেশ। আমাদের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে মিয়ানমারে। ১৯৭২ সালেই মিয়ানমার আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমার আমাদের বৈদেশিক নীতিতে উপেক্ষিত ছিল। খালেদা জিয়ার শাসনামলে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
শেখ হাসিনা তিন টার্মের জন্য ক্ষমতাসীন হয়েছেন। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষমতাসীন হয়ে তিনি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারটিকে বেশ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানিবণ্টনের ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি হয়েছিল; যদিও তাঁর আমলে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তিটি তিনি আর নবায়ন করেননি। ভারতে আশ্রিত পাহাড়ি শরণার্থীদের তিনি দেশে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর আমলে সার্কের ভেতরে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার সিদ্ধান্ত (SAGQ) গৃহীত হয়েছিল; যদিও তা কার্যকর হয়নি। শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য আমদানি বাড়ে তিন গুণ। ১৯৯৮ সালে ভারত ও পাকিস্তান পর পর কয়েকটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে তিনি শান্তি স্থাপনের একটি উদ্যোগ নেন, যা প্রশংসিত হয়। তাঁর সময় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে আসেন। তাঁর শাসনামলে বাংলাদেশ সিটিপিটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। একই সঙ্গে ‘হানা’ চুক্তিও (হিউম্যানিটোরিয়ান অ্যাসিস্ট্যান্স নিডস অ্যাসেসমেন্ট) স্বাক্ষর করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। তিনি ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব ক্ষুদ্রঋণ শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে চীনকে বেছে নিলেও সামরিক ক্ষেত্রে চীনের ওপর থেকে পরিপূর্ণ নির্ভরশীলতা তিনি কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর আমলে ঢাকায় রাশিয়ার অস্ত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ওই সময় চীনের বদলে রাশিয়া থেকে আটটি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয় করেছিল (মূল্য ১২৪ মিলিয়ন ডলার)। চীন মিগ-২৯ বিমান সরবরাহ করতে রাজি হলেও বাংলাদেশ ওই বিমান রাশিয়া থেকে সংগ্রহ করেছিল। শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশ দুটি আঞ্চলিক জোট ডি-৮ ও বিমসটেকে যোগ দেয়। তিনি ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনে (ইসলামাবাদ, মার্চ ১৯৯৭) যোগ দিয়ে ইসলামিক বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদার করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ওই সময় তিনি একটি অভিন্ন বাজার প্রতিষ্ঠারও দাবি জানিয়েছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এবং ২০১৪ সালের সব শেষে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি এখনো সরকার পরিচালনা করছেন।
তাঁর সরকারের সময় অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি উন্নত হয়েছে। ট্রানজিট (ট্রান্সশিপমেন্ট অথবা করিডর) নিয়ে বাংলাদেশে বড় বিতর্ক থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর প্রথম ভারত সফরের সময় এ-সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং ইতিমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে তা কার্যকরও হয়েছে; যদিও ট্রানজিট ‘ফি’ নিয়ে একটি বিতর্ক আছে। বলা হচ্ছে ট্রানজিটের বিষয়টি বহুপক্ষীয়তার আলোকে দেখা হবে। কিন্তু দেখা গেছে ভারত একপক্ষীয়ভাবে তা ব্যবহার করেছে, ভুটান বা নেপাল এখনো ট্রানজিট পায়নি। ভারতের এ দুটি দেশকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার কথা। কিন্তু ইতিমধ্যে এই সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে—এ তথ্য আমাদের জানা নেই। এমনকি ভারতের ‘সাতবোন’ রাজ্যগুলো কর্তৃক চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা-ও বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশি পণ্য খালাস করতেই হিমশিম খাবে। এ ক্ষেত্রে ‘সাতবোন’ রাজ্যের পণ্য বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। ভারত অবকাঠামো খাতে যে ঋণ দিয়েছে তা-ও বাংলাদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর ঋণের মতোই এ ঋণ দিয়ে ভারতীয় পণ্য ও সেবা কিনতে আমরা বাধ্য। মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় যে উন্নয়ন ও সহযোগিতাসংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। ওই চুক্তিতে যে ‘ভাষা’ ব্যবহার করা হয়েছিল, তাতে ভারতীয় স্বার্থই রক্ষিত হয়েছে বেশি করে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। গত সাত বছর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফর (২০১৫) করে দুই দেশের সম্পর্ককে অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তাঁর আমলে ঐতিহাসিক ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়িত হয়েছে। ছিটমহলগুলোতে বসবাসরত (ভারতের ১১১টি, বাংলাদেশের ৫১টি) নাগরিকরা তাদের স্ব-ইচ্ছায় নিজ নিজ দেশে ফিরে গেছে। কিন্তু তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে যে সমস্যা তা রয়ে গেছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আগ্রহ থাকলেও শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারণে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হচ্ছে না। সীমান্ত হত্যাও বন্ধ হয়নি। মোদির ঢাকা সফরের সময় নতুন আঞ্চলিক জোট বিবিআইএন (বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল) আত্মপ্রকাশ করলেও নানা প্রশ্ন আছে। সার্ক অকার্যকর হয়ে গেছে। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমছে না। ট্যারিফ-প্যারাট্যারিফ কমানোর কোনো উদ্যোগ নেই। ভারত থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া গেছে বটে; কিন্তু আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না।
মহাজোট সরকারের আমলে হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির আলোকে ওই সফর গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাংলাদেশের প্রাপ্তি ছিল কম। যৌথ অংশীদারি সংলাপ নামের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তিতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই, সহিংস চরমপন্থা, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান এবং জলদস্যুতার মতো আন্তর্দেশীয় অপরাধবোধ ও নিরাপত্তা সহযোগিতার কথা বলা হয়েছিল। তবে ধারণা করা হচ্ছে এবং বিভিন্ন বিশ্লেষকের লেখনীতে এটা বেরিয়ে এসেছে যে এ ধরনের চুক্তি ভবিষ্যতে চীনের বিরুদ্ধে একটি জোট গড়ে তোলার কাজে ব্যবহৃত হতে পারে! দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান মার্কিন প্রভাব, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ গড়ে ওঠার আলোকেই হিলারির ওই সফরকে বিশ্লেষণ করা যায়; যদিও হিলারির ওই সফরে বাংলাদেশের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বাংলাদেশ তার সব পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের যে দাবি, তা এখন বাতিল হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ‘টিফা’র বদলে এখন ‘টিকফা’ চুক্তি (ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট) করেছে। এতে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশ ‘মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন’ (এমসিসি) থেকে ভবিষ্যতে সাহায্য পাবে—এমন কোনো প্রতিশ্রুতিও আমরা পাইনি। তবে হিলারি ক্লিনটনের ঢাকা সফরে তাঁর একটি বক্তব্যে আমি আশাবাদী। তরুণদের সঙ্গে এক আড্ডায় তিনি বাংলাদেশকে একটি Soft power হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। যেকোনো বিবেচনায় এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য। বিশ্ব শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়ে কিংবা আরএমজি সেক্টরে বিশ্ব আসরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে একটি ‘শক্তি’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। আমাদের নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে বাংলাদেশের এই অর্জনকে ধরে রাখা, বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের সঙ্গে দ্রুত একটা সম্পর্ক স্থাপন জরুরি। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত ভারতীয় ‘লবি’ আমাদের সাহায্য করতে পারে। শেখ হাসিনার সরকারের একটি বড় প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচন নিয়ে বহির্বিশ্বে যে নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছিল, তা তিনি কাটিয়ে উঠেছেন। বড় শক্তিগুলো তাঁর সরকারের ওপর আস্থা রেখেছে। তিনি চীন ও জাপান সফর করেছেন। চীনের প্রেসিডেন্ট ঐতিহাসিক সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন, এমনকি প্রধানমন্ত্রী গোয়ায় ব্রিকস-বিমসটেক আউটরিচ সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন (২০১৬)। এর মধ্য দিয়ে তাঁর সরকারের প্রতি এবং তাঁর বৈদেশিক নীতির প্রতি বহিঃসমর্থন আরো বাড়ল। বাংলাদেশকে এখন উঠতি শিল্পোন্নত ১১টি দেশের একটি হিসাবে ধরা হচ্ছে। এটা তাঁর জন্য একটি প্লাস পয়েন্ট। তাঁর চীন ও জাপান সফর আমাদের অর্থনৈতিক কূটনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জাপান ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক মূলত আর্থিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট। জাপানের কাছ থেকে আমরা বড় ধরনের সাহায্য পেয়ে থাকি এবং প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের সময়ও এই সাহায্যের ধারা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। চীনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। চীনের পররাষ্ট্রনীতি এখন ব্যবসানির্ভর। ‘আইডোলজি’ এখানে প্রাধান্য পায় না। ফলে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ বাড়ানো কিংবা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহ সব কিছুই আবর্তিত হচ্ছে চীনের ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণের আলোকে। বাংলাদেশ উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বিসিআইএমের (বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার) ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহী এবং এ লক্ষ্যে একটি টিম কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আরো একধাপ এগিয়ে যাবে এবং অদূর ভবিষ্যতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যে বিশাল মুক্তবাণিজ্য এলাকা গড়ে উঠছে, সেই বাজারে প্রবেশ করতে পারবে।
৪৫ বছর একটি রাষ্ট্রের জন্য কম সময় নয়। এই সময়সীমায় বৈদেশিক নীতিতে যেমন সফলতা এসেছে, ঠিক তেমনি ব্যর্থতাও একেবারে কম নয়। তবে বাংলাদেশকে এখন তাকাতে হবে ২০৫০ সালের দিকে। সনাতন বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। অর্থনৈতিক কূটনীতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। দক্ষ কূটনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তি বাড়াতে হবে। আমাদের জাতীয় স্বার্থকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলেই বৈদেশিক নীতিতে সফলতা আসবে।
Daily Kalerkontho
20.12.2016
0 comments:
Post a Comment