পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের সাম্প্রতিক রাজনীতি তিনটি কারণে ব্যাপক গুরুত্ব
পেয়েছে। এই তিনটি কারণ হচ্ছে এক. সৌদি আরব ও কাতারের মধ্যকার দ্বন্দ্ব এবং
মুসলিমবিশ্বে এর প্রভাব। দুই. তেহরান পার্লামেন্ট ও ইমাম খোমেনির মাজারে
সন্ত্রাসী কর্মকা- এবং আইএসের দায় স্বীকার। তিন. সৌদি আরবের নেতৃত্বে যে
সামরিক জোট গঠিত হয়েছিল, তার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন এবং সৌদি আরবের
সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ১১ হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রয় চুক্তি স্বাক্ষর।
এ তিনটি ঘটনার একটির সঙ্গে অপরটির সরাসরি কোনো যোগসূত্র আছে কিনা, এ
মুহূর্তে বলা খুব কঠিন। তবে ইরানে সন্ত্রাসী ঘটনা এ অঞ্চলের রাজনীতির
দৃশ্যপটকে সম্পূর্ণভাবে বদলে দিতে পারে। কেননা ইরান শিয়াপ্রধান একটি দেশ
এবং সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে এক ধরনের স্থিতিশীলতা বজায় আছে। সম্প্রতি
সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে; কিন্তু কোনো বড় ধরনের
সন্ত্রাসী কর্মকা-ের খবর আমরা পাইনি। এ রকম একটি সময়ে আইএসের জঙ্গিরা
সেখানে হামলা চালাবে, তা অকল্পনীয় এবং তার বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নের মুখে।
কেননা আইএস মূলত সুন্নিপ্রধান একটি সংগঠন। সুন্নিশাসিত এলাকাগুলো নিয়ে আইএস
তার তথাকথিত ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। অতীতে আইএস ইরান সম্পর্কে কোনো
মন্তব্য করেনি এবং ইরানের কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে আইএসের সম্পর্ক
আছে, এমনটিও জানা যায় না। এখন জানা গেল আইএসের ‘ইরানি যোদ্ধারা’ এ
সন্ত্রাসী কর্মকা- সংঘটিত করেছে। যদিও ইরানের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে,
সৌদি আরব এ সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত! মনে রাখতে হবে, ইরানে এ
সন্ত্রাসী হামলা হলো মে মাসে ট্রাম্পের সৌদি আরব সফরের পর যেখানে তিনি
প্রকাশ্যে ইরান সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন করেছে, এমন অভিযোগ করেছিলেন। তার ওই
বক্তব্য এ অঞ্চলের ঐতিহাসিক বিরোধ অর্থাৎ শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বকে উসকে
দিয়েছিল। এখন সন্ত্রাসী কর্মকা- ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে
আবারও সামনে নিয়ে এলো। এখানে ইসরাইলও একটি ফ্যাক্টর। ইরানের পারমাণবিক
কর্মসূচির ব্যাপারে ইসরাইলের একটা বড় ভয় রয়েছে। সম্প্রতি কাতার-ইরান
সমঝোতাকে ভালো চোখে নেয়নি ইসরাইল। ট্রাম্প প্রশাসনও এ সমঝোতাকে নেতিবাচক
দৃষ্টিতে দেখেছে। ফলে কাতার-ইরান সমঝোতাকে ভ-ুল করতে ইরানে সন্ত্রাসী হামলা
হতে পারে, এমন সম্ভাবনাও নাকচ করে দেয়া যায় না।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে সৌদি আরবকে বেছে নিয়েছিলেন। রিয়াদে ২১ মে তিনি আরব ইসলামিক-আমেরিকান (এআইএ) সম্মেলনে ভাষণও দেন। ওই সম্মেলনে মুসলমানপ্রধান ৫৬ দেশের রাষ্ট্র তথা সরকারপ্রধানরা অংশ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও ওই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সম্মেলনে শেখ হাসিনা বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ দমনে চার দফা প্রস্তাবও পেশ করেছিলেন। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিয়াদ সফর ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে এ সম্মেলনে তিনি ইরানবিরোধী যে বক্তব্য দেন, তা নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের সঙ্গে যে ১১ হাজার কোটি ডলারের এটি অস্ত্র চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, তা এখন এ অঞ্চলের উত্তেজনার মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দেবে। প্রশ্ন হচ্ছে এ অস্ত্র বিক্রিতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ কী? যুক্তরাষ্ট্র যে অস্ত্র বিক্রি করবে, তা নিঃসন্দেহে সৌদি আরবের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করবে। কিন্তু একই সঙ্গে সুন্নি-শিয়া দ্বন্দ্ব আবারও বেড়ে যেতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়া সংকটের যখন সমাধান হয়নি কিংবা ইসলামিক স্টেটকে যখন পরিপূর্ণভাবে উৎখাত করা সম্ভব হয়নি, ঠিক তখনই ১১ হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র এ অঞ্চলে নতুন একটি ‘ফ্রন্ট’ ওপেন করবে এবং এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়াবে। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, ২০১৫ সালে সৌদি আরবের নেতৃত্বে সন্ত্রাসবাদবিরোধী একটি জোট গঠিত হয়েছিল, যার নাম ছিল ‘ইসলামিক মিলিটারি অ্যালায়েন্স টু ফাইট টেরোরিজম’। বাংলাদেশ ওই জোটে আছে। প্রায় ৩৩টি মুসলমানপ্রধান দেশের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে এ জোটে। এ জোটকে অভিহিত করা হয়েছে ‘আরব ন্যাটো’ হিসেবে। সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। সুন্নি-শিয়া দ্বন্দ্বের রেশ ধরে সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। এখন সৌদি আরব একটি সামরিক জোট গঠন করল এবং অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হলো। যদিও প্রথম থেকেই বলা হচ্ছে, ‘জোটটি’ শুধু সন্ত্রাসবিরোধী একটি কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে এবং জোট কার্যত একটি তথ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু বাস্তবে এটি শুধু একটি তথ্য বিনিময় কেন্দ্র হিসেবেই থাকবে, নাকি সত্যিকার অর্থে একটি সামরিক জোট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেÑ এ প্রশ্ন থাকলই। কেননা আরব ইসলামিক-আমেরিকান সম্মেলনের পর যে রিয়াদ ঘোষণা স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতে বেশকটি দেশের অংশগ্রহণে ৩৪ হাজার সেনার অতিরিক্ত বাহিনী গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। ওই ঘোষণায় আরও বলা হয়েছে, ইরাক ও সিরিয়ায় সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে অভিযানে সহযোগিতার জন্যই এ সেনাবাহিনী ব্যবহৃত হবে। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। বিশেষ করে সৌদি শিয়া নেতা নিমর আল নিমরের মৃত্যুদ- কার্যকর করার পর (জানুয়ারি ২০১৬) এখন একটি সুন্নিপ্রধান সামরিক জোট গঠন এ অঞ্চলে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব ও বিভেদকে উপসাগরের অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে দেবে। এখানে একটা কথা বলা দরকার, পারস্য উপসাগরভুক্ত অঞ্চলে সুন্নিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ অঞ্চলের জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ সুন্নি সম্প্রদায়ভুক্ত আর ৩৬ ভাগ মানুষ হচ্ছেন শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। এ অঞ্চলের মাঝে ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন আর বাহরাইনে শিয়া সম্প্রদায়ের লোক বেশি বাস করে। যেমন বলা যেতে পারে, ইরানে যেখানে ৮৫ শতাংশ লোক শিয়া সাম্প্রদায়ভুক্ত, সেখানে সুন্নিদের সংখ্যা শতকরা মাত্র ১৫ ভাগ। ইরাকের ৬৩ শতাংশ যেখানে শিয়া, ৩২ শতাংশ সেখানে সুন্নি। সিরিয়ায় ১৫ শতাংশ শিয়া আর ৭৩ শতাংশ সুন্নি। বাহরাইনে ৭৫ শতাংশ শিয়া, ২৫ শতাংশ সুন্নি। ইয়েমেনে ৪৪ শতাংশ শিয়া, ৫৬ শতাংশ সুন্নি। মজার ব্যাপার হলো, বাহরাইনে শিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের কোনো ভূমিকা নেই। সুন্নি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে খলিফা হামাদ ও তার পরিবার সেখানে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায়। সিরিয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ আলাউট সম্প্রদায়ের লোক। আলাউট সম্প্রদায় শিয়াদের একটি উপশাখা। একটি গোত্র। এই গোত্র সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। বাসার আল আসাদের বাবা হাফিজ আল আসাদও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সিরিয়া ও ইরাকে একসময় বাম-মনা বার্থ পার্টি গঠিত হয়েছিল। হাফিজ আল আসাদ সেনাবাহিনীর লোক হয়েও বার্থ পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তার স্বাভাবিক মৃত্যুর পর ২০০০ সালে ছেলে বাসার আল আসাদকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। ইরাকে সাদ্দাম-পরবর্তী জমানায় শিয়ারা ক্ষমতা পরিচালনা করলেও সাদ্দামের (সুন্নি) সময় শিয়ারা ছিলেন উপেক্ষিত। এখন ইরাকে শিয়ারা ক্ষমতায়। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। সৌদি শিয়া নেতা নিমর আল নিমরের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছিল এমন একটি সময়, যখন এ অঞ্চলে সৌদি আরবের নেতৃত্বে ২০১৫ সালেই একটি সামরিক জোট গঠিত হয়েছিল। এ জোট গঠনকে ইরান ভালো চোখে দেখেনি। খুব সংগত কারণেই এ সামরিক জোটটি গঠনের প্রেক্ষাপট আলোচনার দাবি রাখে।
তাহলে পরিস্থিতি এখন কোনদিকে যাচ্ছে? কুয়েত সৌদি আরব ও কাতারের মধ্যে বিরোধের মধ্যস্থতা করছে। দুইটি ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের মধ্যে যদি বিরোধ থাকে এবং যদি তা দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে ইসরাইল এ থেকে ফায়দা নেবে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে কতকগুলো মন্তব্য করা যায়। নিশ্চয়ই সৌদি ও ইরানের নেতারা এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেবেন। সৌদি আরবের নেতৃত্বে যে সামরিক জোট গঠিত হয়েছিল, তাতে ইরান আতঙ্কিত ছিল। এখন সৌদি আরবের বিরুদ্ধে ইরান যে অভিযোগ এনেছে, তা হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। একই সঙ্গে ট্রাম্প তার সৌদি আরব সফরের সময় ইরানের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসীদের অর্থায়নের’ অভিযোগ এনেছিলেন। এখন ইরানে সন্ত্রাসী হামলা হলো। কেউ এর সঙ্গে কোনো মিল খুঁজতে পারেন। কাতারের ব্যাপারে সৌদি আরব ও আরব আমিরাত সুস্পষ্ট অভিযোগ এনেছিল। এ দেশ দুইটির অভিযোগ ছিল, কাতার আইএসসংশ্লিষ্ট জঙ্গিগোষ্ঠীকে অর্থ জোগাচ্ছে। কাতার কর্তৃক জঙ্গিদের ১ মিলিয়ন ডলার অর্থায়নের একটি অভিযোগ পাওয়া যায়। ট্রাম্পও অনেকটা কাতারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। কাতারের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক সাম্প্রতিককালে বেশ ভালো। এই কাতার-ইরান ঐক্যে ফাটল ধরাতে ইরানে সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে এবং ইরানকে নিবৃত্ত করার ‘কোনো পক্ষের’ কোনো উদ্যোগ হতে পারে। উপসাগরীয় অঞ্চলের রাজনীতিতে ইসরাইলের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে না। এসব সন্ত্রাসী ঘটনার সঙ্গে একজন কট্টরপন্থী ওদেদ ইনন (ড়ফবফ ুরহড়হ) ১৯৮২ সালে যে বৃহত্তর একটি ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন, তার সঙ্গে কোনো যোগসূত্র আছে কিনা, তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
সিরিয়া সংকটকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি যখন এমনিতেই উত্তপ্ত, ঠিক তখনই সৌদি-কাতার দ্বন্দ্ব এবং তেহরানে সন্ত্রাসী হামলা নতুন একটি মাত্রা এনে দিয়েছে। ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের উপপ্রধান রেজা সেইফুল্লাহ ‘প্রতিশোধ’ নেয়ার কথা বলেছেন। এখন দেখতে হবে, ইরান এ হামলার প্রতিক্রিয়ায় কী সিদ্ধান্ত নেয়। তবে স্পষ্টতই মধ্যপ্রাচ্য তথা পারস্য অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়ল। এ উত্তেজনা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে তা বিশ্ব রাজনীতিতে একটি পরিবর্তন ডেকে আনতে পারে। সৌদি আরবের দুইটি মসজিদ (মসজিদ আল হারামÑ মক্কা শরিফ ও মসজিদ আল নববিÑ মদিনা শরিফ) এর জিম্মাদার হচ্ছেন সৌদি বাদশা। ধর্মীয়ভাবে এ মসজিদ দুইটি মুসলমানদের জন্য পবিত্র স্থান। সুতরাং বাংলাদেশের মানুষ সবসময় সৌদি আরবের পাশে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে ইরানের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ‘স্ট্রেট অব হরমুজ’, যে প্রণালি দিয়ে পারস্য উপসাগরের তেল বহির্বিশ্বে যায়। বিশ্বে সমুদ্রপথে যে পরিমাণ তেল পরিবহন করা হয, তার ২০ ভাগ এ পথে পরিবাহিত হয়, যার পরিমাণ ১৫ দশমিক ৭ মিলিয়ন ব্যারেল (প্রতিদিন)। সুতরাং এ অঞ্চলে যে কোনো দ্বন্দ্বে ওই জ্বালানি তেল সরবরাহে বিঘœ ঘটবে। অন্যদিকে কাতারে রয়েছে বিশ্বের বড় গ্যাস রিজার্ভ। প্রতি মাসে বিশ্বে যে পরিমাণ তরল গ্যাস (এলএনজি) রফতানি হয়, তার মাঝে কাতার একাই সরবরাহ করে ৮ দশমিক ৭৭ মিলিয়ন কিউসেক মিটার। কাতারের এলএনজি ও পাইপলাইনে সরবরাহকৃত গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল আরব আমিরাত। যে কোনো সংকটে এ সরবরাহে বিঘœ ঘটবে। পারস্য অঞ্চলে তাই কোনো ধরনের উত্তেজনা, যুদ্ধ কিংবা বিবাদ কাম্য নয়। সৌদি, কাতার ও ইরানের জাতীয় নেতারা নিশ্চয়ই এটা উপলব্ধি করবেন আমাদের প্রত্যাশা এটাই।
Daily Alokito Bangladesh
11.06.2017
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে সৌদি আরবকে বেছে নিয়েছিলেন। রিয়াদে ২১ মে তিনি আরব ইসলামিক-আমেরিকান (এআইএ) সম্মেলনে ভাষণও দেন। ওই সম্মেলনে মুসলমানপ্রধান ৫৬ দেশের রাষ্ট্র তথা সরকারপ্রধানরা অংশ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও ওই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সম্মেলনে শেখ হাসিনা বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ দমনে চার দফা প্রস্তাবও পেশ করেছিলেন। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিয়াদ সফর ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে এ সম্মেলনে তিনি ইরানবিরোধী যে বক্তব্য দেন, তা নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের সঙ্গে যে ১১ হাজার কোটি ডলারের এটি অস্ত্র চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, তা এখন এ অঞ্চলের উত্তেজনার মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দেবে। প্রশ্ন হচ্ছে এ অস্ত্র বিক্রিতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ কী? যুক্তরাষ্ট্র যে অস্ত্র বিক্রি করবে, তা নিঃসন্দেহে সৌদি আরবের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করবে। কিন্তু একই সঙ্গে সুন্নি-শিয়া দ্বন্দ্ব আবারও বেড়ে যেতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়া সংকটের যখন সমাধান হয়নি কিংবা ইসলামিক স্টেটকে যখন পরিপূর্ণভাবে উৎখাত করা সম্ভব হয়নি, ঠিক তখনই ১১ হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র এ অঞ্চলে নতুন একটি ‘ফ্রন্ট’ ওপেন করবে এবং এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়াবে। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, ২০১৫ সালে সৌদি আরবের নেতৃত্বে সন্ত্রাসবাদবিরোধী একটি জোট গঠিত হয়েছিল, যার নাম ছিল ‘ইসলামিক মিলিটারি অ্যালায়েন্স টু ফাইট টেরোরিজম’। বাংলাদেশ ওই জোটে আছে। প্রায় ৩৩টি মুসলমানপ্রধান দেশের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে এ জোটে। এ জোটকে অভিহিত করা হয়েছে ‘আরব ন্যাটো’ হিসেবে। সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। সুন্নি-শিয়া দ্বন্দ্বের রেশ ধরে সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। এখন সৌদি আরব একটি সামরিক জোট গঠন করল এবং অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হলো। যদিও প্রথম থেকেই বলা হচ্ছে, ‘জোটটি’ শুধু সন্ত্রাসবিরোধী একটি কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে এবং জোট কার্যত একটি তথ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু বাস্তবে এটি শুধু একটি তথ্য বিনিময় কেন্দ্র হিসেবেই থাকবে, নাকি সত্যিকার অর্থে একটি সামরিক জোট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেÑ এ প্রশ্ন থাকলই। কেননা আরব ইসলামিক-আমেরিকান সম্মেলনের পর যে রিয়াদ ঘোষণা স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতে বেশকটি দেশের অংশগ্রহণে ৩৪ হাজার সেনার অতিরিক্ত বাহিনী গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। ওই ঘোষণায় আরও বলা হয়েছে, ইরাক ও সিরিয়ায় সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে অভিযানে সহযোগিতার জন্যই এ সেনাবাহিনী ব্যবহৃত হবে। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। বিশেষ করে সৌদি শিয়া নেতা নিমর আল নিমরের মৃত্যুদ- কার্যকর করার পর (জানুয়ারি ২০১৬) এখন একটি সুন্নিপ্রধান সামরিক জোট গঠন এ অঞ্চলে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব ও বিভেদকে উপসাগরের অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে দেবে। এখানে একটা কথা বলা দরকার, পারস্য উপসাগরভুক্ত অঞ্চলে সুন্নিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ অঞ্চলের জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ সুন্নি সম্প্রদায়ভুক্ত আর ৩৬ ভাগ মানুষ হচ্ছেন শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। এ অঞ্চলের মাঝে ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন আর বাহরাইনে শিয়া সম্প্রদায়ের লোক বেশি বাস করে। যেমন বলা যেতে পারে, ইরানে যেখানে ৮৫ শতাংশ লোক শিয়া সাম্প্রদায়ভুক্ত, সেখানে সুন্নিদের সংখ্যা শতকরা মাত্র ১৫ ভাগ। ইরাকের ৬৩ শতাংশ যেখানে শিয়া, ৩২ শতাংশ সেখানে সুন্নি। সিরিয়ায় ১৫ শতাংশ শিয়া আর ৭৩ শতাংশ সুন্নি। বাহরাইনে ৭৫ শতাংশ শিয়া, ২৫ শতাংশ সুন্নি। ইয়েমেনে ৪৪ শতাংশ শিয়া, ৫৬ শতাংশ সুন্নি। মজার ব্যাপার হলো, বাহরাইনে শিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের কোনো ভূমিকা নেই। সুন্নি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে খলিফা হামাদ ও তার পরিবার সেখানে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায়। সিরিয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ আলাউট সম্প্রদায়ের লোক। আলাউট সম্প্রদায় শিয়াদের একটি উপশাখা। একটি গোত্র। এই গোত্র সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। বাসার আল আসাদের বাবা হাফিজ আল আসাদও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সিরিয়া ও ইরাকে একসময় বাম-মনা বার্থ পার্টি গঠিত হয়েছিল। হাফিজ আল আসাদ সেনাবাহিনীর লোক হয়েও বার্থ পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তার স্বাভাবিক মৃত্যুর পর ২০০০ সালে ছেলে বাসার আল আসাদকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। ইরাকে সাদ্দাম-পরবর্তী জমানায় শিয়ারা ক্ষমতা পরিচালনা করলেও সাদ্দামের (সুন্নি) সময় শিয়ারা ছিলেন উপেক্ষিত। এখন ইরাকে শিয়ারা ক্ষমতায়। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। সৌদি শিয়া নেতা নিমর আল নিমরের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছিল এমন একটি সময়, যখন এ অঞ্চলে সৌদি আরবের নেতৃত্বে ২০১৫ সালেই একটি সামরিক জোট গঠিত হয়েছিল। এ জোট গঠনকে ইরান ভালো চোখে দেখেনি। খুব সংগত কারণেই এ সামরিক জোটটি গঠনের প্রেক্ষাপট আলোচনার দাবি রাখে।
তাহলে পরিস্থিতি এখন কোনদিকে যাচ্ছে? কুয়েত সৌদি আরব ও কাতারের মধ্যে বিরোধের মধ্যস্থতা করছে। দুইটি ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের মধ্যে যদি বিরোধ থাকে এবং যদি তা দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে ইসরাইল এ থেকে ফায়দা নেবে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে কতকগুলো মন্তব্য করা যায়। নিশ্চয়ই সৌদি ও ইরানের নেতারা এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেবেন। সৌদি আরবের নেতৃত্বে যে সামরিক জোট গঠিত হয়েছিল, তাতে ইরান আতঙ্কিত ছিল। এখন সৌদি আরবের বিরুদ্ধে ইরান যে অভিযোগ এনেছে, তা হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। একই সঙ্গে ট্রাম্প তার সৌদি আরব সফরের সময় ইরানের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসীদের অর্থায়নের’ অভিযোগ এনেছিলেন। এখন ইরানে সন্ত্রাসী হামলা হলো। কেউ এর সঙ্গে কোনো মিল খুঁজতে পারেন। কাতারের ব্যাপারে সৌদি আরব ও আরব আমিরাত সুস্পষ্ট অভিযোগ এনেছিল। এ দেশ দুইটির অভিযোগ ছিল, কাতার আইএসসংশ্লিষ্ট জঙ্গিগোষ্ঠীকে অর্থ জোগাচ্ছে। কাতার কর্তৃক জঙ্গিদের ১ মিলিয়ন ডলার অর্থায়নের একটি অভিযোগ পাওয়া যায়। ট্রাম্পও অনেকটা কাতারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। কাতারের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক সাম্প্রতিককালে বেশ ভালো। এই কাতার-ইরান ঐক্যে ফাটল ধরাতে ইরানে সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে এবং ইরানকে নিবৃত্ত করার ‘কোনো পক্ষের’ কোনো উদ্যোগ হতে পারে। উপসাগরীয় অঞ্চলের রাজনীতিতে ইসরাইলের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে না। এসব সন্ত্রাসী ঘটনার সঙ্গে একজন কট্টরপন্থী ওদেদ ইনন (ড়ফবফ ুরহড়হ) ১৯৮২ সালে যে বৃহত্তর একটি ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন, তার সঙ্গে কোনো যোগসূত্র আছে কিনা, তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
সিরিয়া সংকটকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি যখন এমনিতেই উত্তপ্ত, ঠিক তখনই সৌদি-কাতার দ্বন্দ্ব এবং তেহরানে সন্ত্রাসী হামলা নতুন একটি মাত্রা এনে দিয়েছে। ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের উপপ্রধান রেজা সেইফুল্লাহ ‘প্রতিশোধ’ নেয়ার কথা বলেছেন। এখন দেখতে হবে, ইরান এ হামলার প্রতিক্রিয়ায় কী সিদ্ধান্ত নেয়। তবে স্পষ্টতই মধ্যপ্রাচ্য তথা পারস্য অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়ল। এ উত্তেজনা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে তা বিশ্ব রাজনীতিতে একটি পরিবর্তন ডেকে আনতে পারে। সৌদি আরবের দুইটি মসজিদ (মসজিদ আল হারামÑ মক্কা শরিফ ও মসজিদ আল নববিÑ মদিনা শরিফ) এর জিম্মাদার হচ্ছেন সৌদি বাদশা। ধর্মীয়ভাবে এ মসজিদ দুইটি মুসলমানদের জন্য পবিত্র স্থান। সুতরাং বাংলাদেশের মানুষ সবসময় সৌদি আরবের পাশে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে ইরানের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ‘স্ট্রেট অব হরমুজ’, যে প্রণালি দিয়ে পারস্য উপসাগরের তেল বহির্বিশ্বে যায়। বিশ্বে সমুদ্রপথে যে পরিমাণ তেল পরিবহন করা হয, তার ২০ ভাগ এ পথে পরিবাহিত হয়, যার পরিমাণ ১৫ দশমিক ৭ মিলিয়ন ব্যারেল (প্রতিদিন)। সুতরাং এ অঞ্চলে যে কোনো দ্বন্দ্বে ওই জ্বালানি তেল সরবরাহে বিঘœ ঘটবে। অন্যদিকে কাতারে রয়েছে বিশ্বের বড় গ্যাস রিজার্ভ। প্রতি মাসে বিশ্বে যে পরিমাণ তরল গ্যাস (এলএনজি) রফতানি হয়, তার মাঝে কাতার একাই সরবরাহ করে ৮ দশমিক ৭৭ মিলিয়ন কিউসেক মিটার। কাতারের এলএনজি ও পাইপলাইনে সরবরাহকৃত গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল আরব আমিরাত। যে কোনো সংকটে এ সরবরাহে বিঘœ ঘটবে। পারস্য অঞ্চলে তাই কোনো ধরনের উত্তেজনা, যুদ্ধ কিংবা বিবাদ কাম্য নয়। সৌদি, কাতার ও ইরানের জাতীয় নেতারা নিশ্চয়ই এটা উপলব্ধি করবেন আমাদের প্রত্যাশা এটাই।
Daily Alokito Bangladesh
11.06.2017
0 comments:
Post a Comment