রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নির্বাচন : অনিশ্চয়তা থাকলই


শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নির্বাচনে বুথফেরত জরিপই সত্য হলো। প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মের কনজারভেটিভ পার্টি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে।
এককভাবে সরকার গঠন করার জন্য যে ৩২৬টি আসনের প্রয়োজন ছিল, তা কনজারভেটিভরা নিশ্চিত করতে পারেনি। নির্বাচনী ফলাফলে দেখা গেছে, কনজারভেটিভদের আসন কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৩১৯টিতে। আবার লেবার পার্টির আসন বেড়েছে। এ সংখ্যা ২৬২। কিন্তু এ আসন নিয়ে সরকার গঠন করাও সম্ভব নয়। ফলে এক জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বর্তমান পার্লামেন্ট, হাল হতে যাচ্ছে ঝুলন্ত পার্লামেন্টের। আগামী ১৯ জুন রানির ভাষণের মধ্য দিয়েই পার্লামেন্টের অধিবেশন বসছে। কিন্তু অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে নয়া পার্লামেন্টকে। প্রথমত, টেরেসা মে এককভাবে সরকার গঠন করতে পারবেন না। তাঁকে সরকার গঠন করতে হলে তৃতীয় একটি পার্টির সঙ্গে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হবে। ২০১০ সালের নির্বাচনের পরেও কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়েছিল। এখন লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের দিকেই তাকাতে হবে টেরেসা মেকে। বিষয়টি খুব সহজ নয়। তৃতীয় পার্টি স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি টেরেসা মের সরকারে যোগ দেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। আর লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা প্রো-ইউরোপীয় ধারণায় বিশ্বাসী। অন্যদিকে কনজারভেটিভরা ইউরোপীয় ইউনিয়নবিরোধী। ফলে কোয়ালিশনের ধারণা আদৌ আলোচিত হবে কি না, বলা মুশকিল। একটি ঝুলন্ত পার্লামেন্টের জন্ম হলো। বলা ভালো, ২০১৫ সালের সর্বশেষ নির্বাচনে কনজারভেটিভরা পেয়েছিল ৩৩০ আসন, অর্থাৎ ৩৬.৯ শতাংশ ভোট। অন্যদিকে লেবার পার্টি পেয়েছিল ২৩২ আসন, অর্থাৎ ৩০.৪০ শতাংশ ভোট নিশ্চিত করেছিল লেবার পার্টি। ৪.৭ শতাংশ ভোট আর ৫৬টি আসন নিশ্চিত করেছিল স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি। আর লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের আসন ছিল ৮ শতাংশ, অর্থাৎ ৭.৯ শতাংশ ভোট। দ্বিতীয়ত, এই নির্বাচন প্রমাণ করল ব্রিটিশ জনগণ টেরেসা মের ওপর পূর্ণ আস্থা  রাখতে পারছে না। তিনি সম্ভবত একটি সংখ্যালঘু সরকার গঠন করবেন। তবে তাঁর নেতৃত্ব এখন প্রশ্নের মুখে থাকল। ২০১৬ সালের ১১ জুলাই থেকে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এর আগে ডেভিড ক্যামেরন পদত্যাগ (২৩ জুন ২০১৬) করেছিলেন। ডেভিড ক্যামেরনের নেতৃত্বে কনজারভেটিভ পার্টি ২০১৫ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু গণভোটে (ব্রেক্সিট প্রশ্নে) হেরে গিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। এখন নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেল, ব্রেক্সিট প্রশ্নে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনায় ভোটাররা টেরেসা মের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। তাঁর আগাম নির্বাচনে আসার সিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তিনি ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে পারতেন। এখন একটি ঝুলন্ত পার্লামেন্টে তিনি কোনো সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করতে পারবেন না, যদি না লেবার পার্টি তাঁকে সহযোগিতা করে। এর মধ্যেই তাঁর ‘ভুল সিদ্ধান্তের’ কারণে তাঁর পদত্যাগেরও দাবি উঠেছে। এমনকি লেবার লিডার জেরেমি করবিনও তাঁকে সরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তৃতীয়ত, বিতর্কিত দক্ষিণপন্থী নেতা নাইজেল ফারাজ ব্রেক্সিট প্রশ্নে দ্বিতীয় আরেকটি রেফারেন্ডামের আহ্বান জানিয়েছেন। ব্রেক্সিট অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার ব্যাপারে ফারাজ সোচ্চার ছিলেন বেশি। ব্রেক্সিটের ব্যাপারে গণভোটে সিদ্ধান্ত হওয়ায় ফারাজ তখন জানিয়েছিলেন, তাঁর দায়িত্ব শেষ। তিনি রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফলের পর তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, তিনি রাজনীতিতে আবার ফিরে আসছেন। চতুর্থত, আরো একটি নির্বাচনের কথা কোনো কোনো মহল থেকে উচ্চারিত হচ্ছে। কিন্তু Fixed term parliament Act 2011 অনুযায়ী আগাম নির্বাচনের কোনো সুযোগ নেই। নিয়ম অনুযায়ী ২০২২ সালে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে পার্লামেন্টের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য চাইলে আগাম নির্বাচন সম্ভব। ২০১৫ সালে নির্বাচন হলেও ২০১৭ সালের ৮ জুন নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হয়েছিল পার্লামেন্টের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য চেয়েছিলেন বলেই। এখন লেবার পার্টি আবারও একটি নির্বাচন চাইবে, এটা মনে হয় না। ফলে একটি সংখ্যালঘু সরকার গঠিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
পঞ্চমত, এই নির্বাচন ছিল লেবার পার্টির লিডার জেরেমি করবিনের জন্য ব্যক্তিগতভাবে একটি বড় বিজয়। তাঁর ‘বাম চিন্তাধারা’ তাঁকে দলের ভেতরে ও বাইরে বিতর্কিত করলেও এটা প্রমাণিত হয়েছে, মানুষ তাঁর ওপর আস্থা রেখেছে। তিনি ভালো বক্তা। সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করার এক অসাধারণ সম্মোহনী শক্তি রয়েছে তাঁর। একুশ শতকে এসেও সারা বিশ্ব যেখানে পুঁজিবাদের দিকে, বিশ্বায়নের দিকে ঝুঁকছে, সেখানে করবিন সেই পুরনো ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেসি’র ধারণা নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে গেছেন। জনগণের জীবনযাত্রার মান বাড়ানো, রেল, পোস্ট অফিস ও তার কার্যক্রম, পানি ব্যবস্থাপনা জাতীয় করা, ধনী ব্যবসায়ীদের ওপর ট্যাক্স আরোপ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ‘ফ্রি’ করে দেওয়া ইত্যাদি জনপ্রিয় কিছু কর্মসূচি নিয়ে মানুষের কাছে গেছেন। সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের সমর্থন তিনি পেয়েছেন। অনেক দিন পর লেবার পার্টি এমন একজন নেতা পেল, যিনি তাঁর ব্যক্তিত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অনেক দিন দলকে নেতৃত্ব দিতে পারবেন। তিনি ‘নতুন এক লেবার পার্টির’ জন্ম দিতে যাচ্ছেন, যেখানে পুরনো ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেসি’র ধারণা আবার ফিরে এসেছে।
ষষ্ঠত, নয়া সরকারের জন্য দুটি বিষয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অভিবাসননীতিতে কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপ করা এবং ব্রেক্সিট আলোচনায় ব্রিটেনের শক্ত অবস্থানে যাওয়া। এমনকি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও গুরুত্ব পাবে। ধারণা করা হয়েছিল, ম্যানচেস্টার ও লন্ডন ব্রিজে সন্ত্রাসী হামলার পর মানুষ কনজারভেটিভদের আরো বেশি করে ভোট দেবে, যাতে কনজারভেটিভরা তথাকথিত ‘জঙ্গি কার্যক্রম’ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে পারে। টেরেসা মে এটাকে ইস্যু করতে চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল, তিনি জঙ্গিদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিলে মানুষ তাঁর দলকে আবার ক্ষমতায় বসাবে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে।
টেরেসা মে নির্বাচনের আগে কতগুলো বিষয় স্পষ্ট করেছিলেন। ১. সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের মোকাবেলায় মানবাধিকার আইনে তিনি পরিবর্তন আনবেন; ২. ‘বিদেশি সন্ত্রাসী’ সন্দেহভাজনদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাবেন; ৩. হুমকি সৃষ্টিকারী ব্যক্তিদের চলাফেরায় তিনি নিয়ন্ত্রণ আনবেন। কিন্তু ভোটের ফলাফলে দেখা গেল মানুষ তাঁর কথায় আস্থা রাখতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার আগে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। অভিযোগ আছে ম্যানচেস্টারে সন্ত্রাসী হামলায়, যাতে মারা গিয়েছিল ২২ ব্যক্তি (অ্যারিয়ানা গ্রানডের কনসার্টে), সেই হামলায় জড়িত ছিলেন সালমান আবেদি, তাঁর গতিবিধি সম্পর্কে ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের ধারণা ছিল। লিবিয়ার একটি সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল। টেরেসা মে যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখন আবেদি ও তাঁর সমর্থকরা একাধিকবার ব্রিটেন থেকে লিবিয়ায় গেছে। গোয়েন্দারা তাঁর তত্পরতা সম্পর্কে অবগত ছিল। ফলে টেরেসা মে তাঁর দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেননি, এমন একটা অভিযোগ ছিল।
সপ্তমত, ২০১৫ সালের নির্বাচনে স্কটল্যান্ডের ন্যাশনালিস্ট পার্টি (এসএনপি) অনেক বেশি আসন পেয়েছিল। স্কটল্যান্ডের জন্য নির্ধারিত ৫৯টি আসনের মধ্যে এসএনপি পেয়েছিল ৫৬ আসন। কিন্তু এবার তাঁর আসন কমেছে। এসএনপির কিছু আসন চলে গেছে লেবার ও কনজারভেটিভদের হাতে। অষ্টমত, ২০১৫ সালের নির্বাচনে লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের অবস্থান খুব ভালো ছিল না। মাত্র আটটি আসন তারা পেয়েছিল। এবার তাদের আসন বেড়েছে। তারা প্রো-ইউরোপপন্থী। এবার আসন ১৩টি।
একটি ‘ঝুলন্ত পার্লামেন্ট’ ব্রিটেনের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আলোচনাকে আরো জটিল করে দিতে পারে। ব্রেক্সিট কার্যকর (২০১৯ সালের মার্চে এ প্রক্রিয়া শেষ হবে) করতে ব্রিটেনকে ১০০ বিলিয়ন ইউরো অথবা ১১২ বিলিয়ন ডলার ‘ডাইভোর্স বিল’ পরিশোধ করতে হবে। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্রিটেন কিভাবে পরিশোধ করবে, আদৌ পরিশোধ করতে পারবে কি না, এটা নিয়ে এখন রয়েছে নানা প্রশ্ন। কাজটি খুব সহজ নয়। এর বাইরে প্রায় ৬০০ থেকে ৭০০ চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭টি দেশের সঙ্গে। এসব চুক্তির ধরন আলাদা আলাদা। পার্লামেন্টে তাঁর সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় তিনি বারবার বাধার সম্মুখীন হবেন। তিনি কোনো ভালো চুক্তি করতে পারবেন না। ফলে ২০১৯ সালের মার্চ মাসের ‘ডেটলাইন’টি একটি বড় ধরনের প্রশ্নের মধ্যে থাকল এখন। একটি দুর্বল সরকার এখন ব্রিটেন পাবে। টেরেসা মে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য হয়তো প্রধানমন্ত্রী থেকে যাবেন। কিন্তু কনজারভেটিভদের পক্ষ থেকেও নয়া নেতা নির্বাচনের দাবি উঠবে।
বাংলাদেশের সঙ্গে ব্রিটেনের যে সম্পর্ক তাতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে না। তবে অভিবাসনের ক্ষেত্রে কিছুটা কড়াকড়ি থাকবে। প্রায় পাঁচ লাখ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এখন ব্রিটেনে বসবাস করে। আমাদের আশার কথা, ২০১৫ সালে যে তিনজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নারী লেবার পার্টির পক্ষ থেকে বিজয়ী হয়েছিলেন, এবারও তাঁরা বিজয়ী হয়েছেন।
Daily Kalerkontho
 10.06.2017

0 comments:

Post a Comment