রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে যুদ্ধ কি আসন্ন?


পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে আরেকটি যুদ্ধ কি আসন্ন? সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থার কয়েকটি দেশ ও সেই সঙ্গে মিসর, ইয়েমেন, মালদ্বীপ কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার পর পরিস্থিতি সেখানে ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। এ সংকটে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও তুরস্কের জড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে।
এমনকি ইরানের ভূমিকাকেও ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। ইরানে প্রথমবারের মতো ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিগোষ্ঠীর হামলা হয়েছে। সুরক্ষিত পার্লামেন্ট ভবনে এবং ইমাম খোমেনির মাজারে হামলা হয়েছে। বিষয়টি যে ইরান খুব সহজভাবে নেবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। তাহলে পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে? যদি একটি ‘যুদ্ধ’ হয়, তাহলে এই ‘যুদ্ধ’ শুধু সৌদি আরব কর্তৃক সম্ভাব্য কাতার হামলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং এ যুদ্ধ পারস্যীয় অঞ্চলের সর্বত্র ছড়িয়ে যাবে। এবং আঞ্চলিক শক্তির পাশাপাশি বৃহৎ শক্তিগুলো এ ‘যুদ্ধে’ জড়িয়ে যাবে। সে কারণেই হয়তো ‘যুদ্ধ’ হবে না। কিন্তু উত্তেজনা থাকবে। যে ভুলটি সাদ্দাম হোসেন করেছিলেন ১৯৯০ সালে কুয়েত দখল করে, সেই ভুলটি সৌদি রাজপরিবার করবে না। বিশেষ করে বাদশাহ সালমানের ছেলে প্রিন্স সালমান, যিনিই মূলত পর্দার অন্তরালে থেকে নীতি নির্ধারণে বড় ভূমিকা পালন করছেন এবং আঞ্চলিক রাজনীতিতে সৌদি ভূমিকাকে নিশ্চিত করতে চান, তিনি বোধ হয় এ যুদ্ধে যাওয়ার কোনো ঝুঁকি গ্রহণ করবেন না। তবে সৌদি-কাতার দ্বন্দ্বে বেশ কতগুলো সম্ভাবনা রয়েছে। এক. সৌদি আরব-যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল লবি একসঙ্গে মিলে কাতারে ‘রেজিম চেঞ্জ’-এর একটি উদ্যোগ নিতে পারে। অর্থাৎ তারা ক্ষমতাসীন আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল খলিফাকে অপসারণ করতে পারে। এ ধরনের একটি সম্ভাবনা আমি কোনো কোনো মার্কিন গণমাধ্যমে দেখেছি (ইনফরমেশন ক্লিয়ারিং হাউস, ১১ জুন)। সম্ভবত আমির নিজে এটা বোঝেন। তাই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন তাঁকে আলাপ-আলোচনার জন্য ওয়াশিংটনে ডেকেছিলেন, তিনি যাননি। তাঁর ভয় রয়েছে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার। অতীতেও এমনটি হয়েছে। ক্ষমতাসীন থানি পরিবারে ‘প্রাসাদ ষড়যন্ত্র’ নতুন কিছু নয়। বর্তমান আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি ২০১৩ সালের ২৫ জুনের পর থেকে ক্ষমতায় আছেন। ৩৭ বছর বয়সী আমির তাঁর বাবা হামাদ বিন খলিফা আল থানিকে ‘প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের’ মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন। আমিরের বাবা হামাদ বিন খলিফা আল থানিও একইভাবে ‘প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের’ মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন তাঁর বাবা (অর্থাৎ বর্তমান আমিরের দাদা) শেখ খলিফা বিন হামাদ বিন আবদুল্লাহ আল থানিকে উত্খাত করে ১৯৯৫ সালে। থানি পরিবারই কাতার নামের রাষ্ট্রটি জন্ম দিয়েছিল এবং তারাই ১৯৭২ সালের পর থেকে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। বলা হয় থানি পরিবারভুক্ত প্রায় এক হাজার ৫০০ সদস্য এই রাজবংশকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এ ক্ষেত্রে বর্তমান আমির যদি ক্ষমতাচ্যুত হন, তাহলে তাঁর জ্যেষ্ঠ সন্তানের (হামাদ বিন তামিম বিন হামাদ আল থানি, জন্ম ২০০৮) ক্ষমতা পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাঁর বয়স কম। তাঁর তিন স্ত্রীর সন্তান মোট ৯ জন। তাঁর বড় সন্তান মেয়ে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সৌদি-কাতার দ্বন্দ্বে ট্রাম্প সৌদি আরবের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন। তিনি নিজেও সৌদি আরবের সুরে কথা বলেছেন—কাতার তথাকথিত সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন করে। এই অর্থায়ন বন্ধে তিনি এরই মধ্যে কাতারে অবস্থিত ‘আল আইদিদ বেজ’-এ বা সামরিক ঘাঁটিতে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ডে কর্মরত জেনারেলদের ডেকেছিলেন। এখন দেখার বিষয় তিনি কোনো ‘মেসেজ’ দিয়েছেন কি না?
তবে বিষয়টি খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। কেননা তুরস্ক কাতারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং সেখানে পাঁচ হাজার সেনা পাঠাচ্ছে। তারা কাতারের আমিরকে যে নিরাপত্তা দেবে, এটিই স্বাভাবিক। দ্বিতীয়ত, এই ‘রেজিম চেঞ্জ’ অর্থাৎ ক্ষমতাসীনদের উত্খাতের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ‘মহাপরিকল্পনা’ অতি সম্প্রতি ফাঁস হয়েছে। ২০১১ সালে পুরো আরব বিশ্বে যে গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল (আরব বসন্ত) তার পেছনে কলকাঠি নেড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের ও ইসরায়েলি সহযোগিতায় পুরো আরব বিশ্বে পরিবর্তন এসেছিল, যাতে আন্দোলনকারীরা কেউই ক্ষমতায় যেতে পারেনি; বরং আন্দোলন অন্যদিকে পরিচালিত হয়েছিল। এমনকি ইরাক ও সিরিয়ার একটি অংশে যে আইএসের জন্ম হয়েছিল, সেই জন্মের পেছনে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, ন্যাটো ও সৌদি আরব। ডিআইএর (ইউএস ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি) একটি ডকুমেন্ট থেকে আমাদের এ তথ্যটি দিয়েছেন স্টেফান লোডম্যান গ্লোবাল রিসার্চে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধ (১৩ জুন ২০১৭) Dirty open secret : US Criated and supports ISIL-এ। ওই প্রবন্ধে জেমস ফিটজারের একটি প্রবন্ধ উল্লেখ করা হয়েছে (ইরান রিভিউ, জানুয়ারি ২০১৬), যেখানে বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র আইএসের জন্মদাতা। বর্তমানে মসুলে যে যুদ্ধ চলছে, সেখান থেকে আইএসের জঙ্গিদেরও পালাতে সাহায্য করছে যুক্তরাষ্ট্র। পাঠকদের ‘ইনন প্লান’ (Yinon Plan) সম্পর্কে একটি ধারণা দিই। কট্টরপন্থী ওদেদ ইনন (Oded Yinon) ১৯৮২ সালে বিশ্ব ইহুদি কংগ্রেসে ইসরায়েলের নিরাপত্তার স্বার্থে একটি বৃহত্তর ইসরায়েলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন। এ পরিকল্পনায় বৃহত্তর ইসরায়েলি রাষ্ট্রটি হবে একদিকে নীল নদ, অন্যদিকে ইউফ্রেটিস নদী পর্যন্ত বিস্তৃত। সেই সঙ্গে বর্তমানে এ অঞ্চলে যেসব রাষ্ট্র রয়েছে তা ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিভিত্তিক ও নৃ-তাত্ত্বিকভিত্তিক একাধিক রাষ্ট্র হবে। এই রাষ্ট্রগুলো তাদের স্বার্থে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলবে। বর্তমান পরিস্থিতি কি সেদিকেই যাচ্ছে?
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মে মাসে রিয়াদে আরব-আমেরিকান সম্মেলনে যোগদান, সৌদি আরবের সঙ্গে ১১ হাজার ডলারের অস্ত্র চুক্তি স্বাক্ষর, তাঁর ইসরায়েল সফর, কাতারের সঙ্গে কয়েকটি আরব রাষ্ট্রের সম্পর্কচ্ছেদ, কায়রোয় গোপনে সিসি-নেতানিয়াহু সাক্ষাৎ মূলত সবই এক সূত্রে গাঁথা। কাতারে ক্ষমতার পরিবর্তন এবং কাতারের বিশাল গ্যাস রিজার্ভের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকেও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশ্বের তৃতীয় বড় গ্যাস রিজার্ভ রয়েছে কাতারে (রাশিয়া ও ইরানের পর)। কাতারের ডলফিন পাইপলাইন দিয়ে প্রতিদিন ১ দশমিক ৮ মিলিয়ন কিউবিক ফিট গ্যাস আরব আমিরাতে সরবরাহ করা হয়। এই গ্যাস দিয়ে আরব আমিরাত বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। আরব আমিরাত চায় কম মূল্যে এই গ্যাস। ইউরোপেও যায় কাতারের গ্যাস। কাতার তার গ্যাস দিয়ে এলএনজি তৈরি করে, যা বিশ্বে রপ্তানি করা হয়। বাংলাদেশ ২০১৩ সালে কাতার থেকে এলএনজি কেনার জন্য একটি চুক্তি করেছিল। এখন সমুদ্রেও কাতারি গ্যাস রপ্তানিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই—কাতারের অর্থনীতিতে ধস নামানো। মাত্র ২৬ লাখ লোকের দেশ এই কাতার, যে লোকসংখ্যার একটা বড় অংশ আবার পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশ থেকে যাওয়া। আদি কাতারিরা মূলত সরকারি কাজ করে। আধাদক্ষ জনগোষ্ঠী কাজ করে কনস্ট্রাকশন সেক্টরে, যার ১০০ শতাংশ উপমহাদেশের মানুষ। অথচ কাতারের জিডিপির পরিমাণ ৩৫৩ দশমিক ১৪৩ মিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয় এক লাখ ৪৫ হাজার ৮৯৪ ডলার, যা কিনা সৌদি আরবের চেয়ে বেশি (৫৫ হাজার ২২৯ ডলার)। এ সংকটের পেছনে কাতারের জ্বালানি সম্পদ ও কাতারের বিশাল অর্থনীতি একটা ফ্যাক্টর। তৃতীয়ত, বর্তমান সংকটকে কেন্দ্র করে কাতারের ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ করে নিজেদের স্বার্থ (বিশেষ করে ইসরায়েলি স্বার্থ) আদায় করার একটি ‘উদ্যোগ’ আমরা ভবিষ্যতে লক্ষ করব। যুক্তরাষ্ট্র কাতারের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করতে পারে এবং জাতিসংঘকেও বাধ্য করতে পারে এ ধরনের একটি উদ্যোগ গ্রহণ করতে। এর পেছনে কলকাঠি নাড়াচ্ছে ইসরায়েল। এক তথ্যে দেখা গেছে, মার্কিন কংগ্রেসে কাতারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা সংক্রান্ত একটি বিল জমা দেওয়া হয়েছে। ১০ জন কংগ্রেস সদস্য এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। ইসরায়েলের পাশাপাশি সৌদি আরব ও আরব আমিরাত কাতারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের উদ্যোগী হয়েছে। গত ২৫ মে এসংক্রান্ত একটি বিল হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভসের কমিটিতে জমা দেওয়া হয়েছে।
একটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রেসপনসিভ পলিটিকসের (ওয়াশিংটন) তথ্য অনুযায়ী যেসব কংগ্রেস সদস্য এই বিল উত্থাপনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, তাঁরা ২০১৬ সালের মার্কিন কংগ্রেস নির্বাচনের সময় প্রত্যেকে ইসরায়েলি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মোট ১০ লাখ ৯ হাজার ৭৯৬ ডলার সাহায্য পেয়েছেন। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত ‘ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসির পক্ষ থেকেও এসব কংগ্রেসম্যানকে আর্থিক সাহায্য দেওয়া হয়েছে। ক্রিড নিউটন ইনফরমেশন ক্লিয়ারিং হাউসে যে প্রবন্ধটি লেখেন (১২ জুন ২০১৭) তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভসের ফরেন রিলেশনস কমিটির সদস্য কংগ্রেসম্যান এড রয়েস ও এলিয়ট অ্যাঙ্গেল একেকজন প্রায় দুই লাখ বা তার ওপরে অর্থ গ্রহণ করেছেন। এর অর্থ পরিষ্কার, একটি সৌদি-ইসরায়েল-আরব আমিরাত লবি চাচ্ছে কাতারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হোক। ’ তারা এ জন্য ওয়াশিংটনে ‘লবিজ ফার্ম’ও নিয়োগ করেছে।
চতুর্থত, কাতারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগটি আনা হয়েছে, অর্থাৎ কাতার সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন করেছে, তার পেছনে সত্যতা কতটুকু, এটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কাতার ইসলামিক ব্রাদারহুড, হামাস কিংবা হিজবুল্লাহ গ্রুপকে সমর্থন করছে—এর পেছনে সত্যতা আছে। এখানে সমস্যাটা মূলত ইসলামিক বিশ্বের নেতৃত্ব কার হাতে থাকবে—সৌদি আরব, না কাতারের হাতে, সমস্যাটা মূলত সেখান থেকেই শুরু।
সাম্প্রতিককালে মুসলিম বিশ্বের যে সংকট, সেই সংকটের ব্যাপারে সৌদি আরব কোনো ভূমিকা পালন করতে পারেনি। হামাস ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল এবং তাদের নেতৃত্বে একটি সরকারও গঠিত হয়েছিল, যা ইসরায়েলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। গাজা নিয়ন্ত্রণ করে হামাস। আর ইসরায়েলি ট্যাংক ও বিমান যখন গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল তখন এগিয়ে এসেছিল কাতার। এমনকি সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া সংকটেও কোনো সৌদি ভূমিকা ছিল না। আফ্রিকার মুসলমানপ্রধান দেশগুলোর দারিদ্র্য (সুদান, দারফুর, সাদ, সোমালিয়া, নাইজেরিয়া) দূরীকরণে সৌদি আরবের কোনো আর্থিক সহযোগিতা নেই। অথচ সৌদি আরবের অর্থনীতি ১ দশমিক ৮০৩ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি। এই অর্থ সৌদি রাজপরিবারের শত শত প্রিন্স ও প্রিন্সেস নিজেদের ব্যক্তিগত বিলাস ও কাজে ব্যবহার করেন। অন্যদিকে কাতারের তরুণ আমিরের নিজস্ব একটি চিন্তাভাবনা আছে। ২০১২ সালে কাতার প্রায় ১০০টি দেশে, যার মাঝে মুসলমানপ্রধান দেশ বেশি, ৫২৪ মিলিয়ন পাউন্ড আর্থিক সহায়তা দিয়েছিল, যাতে এই গরিব দেশগুলো এসডিজি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে। কাতার একটি ছোট্ট দেশ হওয়া সত্ত্বেও (আয়তন ১১ হাজার ৫৮৬ বর্গকিলোমিটার) সুদান-সাদ দ্বন্দ্বে, সুদানের দারফুর সংকটে, জিবুতি-ইরিত্রিয়া দ্বন্দ্বে এবং আফগানিস্তানের তালেবান সংকটে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে, যা সৌদি আরবের নীতিনির্ধারক, বিশেষ করে যুবরাজ প্রিন্স সুলতানের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এবং এতে মুসলিম বিশ্বে সৌদি আরবের গ্রহণযোগ্যতা ছিল প্রশ্নের মুখে। আর এভাবেই ধীরে ধীরে সংকটের গভীরতা বেড়েছিল। এখানে বলা ভালো, সৌদি আরবের সঙ্গে কাতারের দ্বন্দ্ব এই প্রথম নয়। এর আগেও ১৯৯২, ২০০২ ও ২০১৪ সালে সৌদি আরব কাতারের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে গিয়েছিল এবং দোহা থেকে তার রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। তবে এবারের প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন।
তাহলে যুদ্ধ কি আসন্ন? সৌদি আরব এরই মধ্যে ইয়েমেনের হুতি গোষ্ঠী, যা শিয়া তথা ইরান সমর্থিত, নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বোমাবর্ষণ করে সেখানে একটি ফ্রন্ট ওপেন করেছে। এখন কুয়েতে আগ্রাসন চালিয়ে দ্বিতীয় আরেকটি ফ্রন্ট ‘ওপেন’ করতে চাইবে না খুব সহজেই। কিন্তু ইসরায়েলি ও আমেরিকান লবির চাপে সৌদি আরব শেষ পর্যন্ত কী করে বলা মুশকিল। সৌদি আরব এরই মধ্যে মুসলমানপ্রধান দেশগুলোকে নিয়ে একটি সামরিক জোট গঠন করেছে (বাংলাদেশ এর সদস্য)। মজার ব্যাপার, কাতার ও তুরস্ক ওই জোটের সদস্য। অথচ এ সংকটে তুরস্কের অবস্থান কাতারের পক্ষে। সৌদি-কাতার দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে বৃহৎ শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সৌদি আরবের পক্ষে। অন্যদিকে রাশিয়া সমর্থন করছে কাতারকে। আর আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ইরানের অবস্থান কাতারের পক্ষে। ফলে একটি যুদ্ধ যদি শুরু হয়ে যায়, তাহলে ইরান জড়িয়ে পড়তে পারে। ইরান ‘স্ট্রেইট অব হরমুজ’ প্রণালি বন্ধ করে দিতে পারে, যেখান থেকে প্রতিদিন ১৫ দশমিক ৭ মিলিয়ন জ্বালানি তেল পরিবাহিত হয়। বিশ্বে যে জ্বালানি তেল সমুদ্রপথে পরিবাহিত হয় তার ২০ শতাংশ এই স্ট্রেইট অব হরমুজ থেকে পরিবাহিত হয়। এখন ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড যদি এই প্রণালিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তা বিশ্বে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। সুতরাং একটা প্রশ্ন থাকলই যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধের অনুমোদন দেবে কি না? যুদ্ধ না হলেও এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়ছে। একদিকে সিরিয়া সংকটের যখন কোনো সমাধান হয়নি তখন সৌদি-কাতার দ্বন্দ্ব নতুন আরেকটি ফ্রন্ট ‘ওপেন’ হলো।
Daily Kalerkontho
18.06.2017

2 comments: