রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

'আরব বসন্ত' তৃতীয় ধাপ অতিক্রম করছে

'আরব বসন্ত' এখন তৃতীয় ধাপ অতিক্রম করছে। তিউনেসিয়ার এক সাধারণ ফল বিক্রেতা বওয়াকুজিজি নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়ে যে 'বিপ্লব'-এর সূচনা করেছিলেন ২০১১ সালে, তা সমগ্র আরব বিশ্বে একটি বড় পরিবর্তন ডেকে আনলেও ২০১৩ সালের ৩ জুলাই মিসরে মুরসির উৎখাতের মধ্য দিয়ে সেই 'বিপ্লব'-এর নতুন একটি ধারা তৈরি হলো। 'আরব বসন্ত' এখন তৃতীয় ধাপে প্রবেশ করেছে। মিসরের এই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন তিউনেসিয়া কিংবা ইয়েমেনের চলমান রাজনীতিকে কতটুকু প্রভাবান্বিত করবে, বলা মুশকিল। তবে এটা সত্য, মিসরের এই পরিবর্তনে তিউনেসিয়া ও ইয়েমেনে ইসলামবিরোধী শক্তি আরো উৎসাহিত হবে। 'আরব বসন্ত' গোটা আরব বিশ্বে একটা পরিবর্তন ডেকে এনেছিল। আর তা হচ্ছে, স্বৈরাচারী সরকারের উৎখাত। বেন আলি, আলি সালেহ, হোসনি মুবারক, যাঁরা দীর্ঘদিন যাবত অবৈধভাবে ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন, তাঁদের পতন ঘটেছিল। এর মধ্যে শুধু হোসনি মুবারকেরই বিচার শুরু হয়েছিল। বাকিদের কারো বিচার হয়নি, বলা যেতে পারে বিচার আদৌ শুরুই হয়নি। তাঁদের পাশাপাশি বাকি ছিলেন আসাদ। সিরিয়ায় আসাদের পতন এক সময় আসন্ন মনে হলেও, এখন মনে হচ্ছে, এ পতন এখন অনিশ্চিত। আন্তর্জাতিক 'অ্যাক্টরগুলো' এখন সিরিয়ার ব্যাপারে সক্রিয়। তাই আসাদের পতন প্রলম্বিত হচ্ছে। 'আরব বসন্ত' সেখানে ইসলামিক শক্তির ক্ষমতা গ্রহণের পথ প্রশস্ত করেছিল। মিসরে ইসলামপন্থীরা বিজয়ী হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ও সংসদ নির্বাচনে ইসলামপন্থী দল, বিশেষ করে মুসলিম ব্রাদারহুড ও আল নূর পার্টির বিজয় 'আরব বসন্ত'-এর দ্বিতীয় ধারার সূচনা করেছিল। একই ঘটনা ঘটেছিল তিউনেসিয়ায়। কিন্তু এ ধারা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মুরসির পতনের মধ্য দিয়ে তৃতীয় ধারার সূচনা হলো। এ ধারার মূলশক্তি এখন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা, যাদের পেছনে সমর্থন রয়েছে পশ্চিমা শক্তিগুলোর। এখন দেখার পালা, এই তৃতীয় ধারায় তিউনেসিয়া শরিক হয় কি না।
যুক্তরাষ্ট্রের একাডেমিক সার্কেলে প্রশ্ন উঠেছে, মিসরের পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? মুরসিকে উৎখাত করার পর থেকে তাঁর সমর্থকরা কায়রোতে প্রতিদিনই বিক্ষোভ করছে। আফ্রিকান ইউনিয়ন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, মিসর ধীরে ধীরে গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আফ্রিকান ইউনিয়নের এ বক্তব্যকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। কেননা সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করার পর এখন অব্দি রাজনীতি তাদের নিয়ন্ত্রণে, এটা বলা যাবে না। বরং দিনে দিনে দুই শক্তির মধ্যে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেছে। মিসরের সমাজ বলতে গেলে এখন দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে রয়েছে ইসলামপন্থী দলগুলো, অন্যদিকে রয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ, লিবারেল তথা ডেমোক্র্যাটরা। এটা স্পষ্ট যে ধর্মনিরপেক্ষ তথা লিবারেলরা মুরসির উৎখাতকে সমর্থন জানিয়েছে। সমস্যাটা তৈরি হয়েছে সেখান থেকেই। কেননা যেখানে প্রয়োজন ছিল একটি জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করা, সেখানে ইসলামপন্থীরা হাজেম এল বেবলাওয়ের নেতৃত্বাধীন সরকারে যোগ দেয়নি। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইসলামপন্থীদের সরকারে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এখন ইসলামপন্থী তথা মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির সরকারে যোগ না দেওয়ায়, সরকার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। তাই প্রশ্নটা থাকবে, কোন পথে এখন মিসর? মিসর আলজেরিয়ার মতো পরিস্থিতি বরণ করে কি না সেটাই এখন দেখার বিষয়। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, ১৯৯১ সালে আলজেরিয়ায় কী ঘটেছিল। এর আগে সাধারণ নির্বাচনে ইসলামপন্থীরা বিজয়ী হলে তাদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া হয়নি। ফলে ১৯৯১-পরবর্তী সময়ে যে গৃহযুদ্ধ হয়, তাতে প্রায় এক লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর সেনাবাহিনীই আলজেরিয়ার রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি। যার সঙ্গে মিসরের রাজনীতির একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। স্বাধীনতার পর ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (এনএলএফ) আলজেরিয়ার ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। আর এনএলএফের ক্ষমতা পরিচালনার পেছনে রয়েছে সেনাবাহিনী। সেখানে সেনাবাহিনীকে বলা হয় Le Paivoir। ফরাসি ভাষায় এর অর্থ 'শক্তি'। সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা 'ডিপার্টমেন্ট অব ইনটেলিজেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি' মূলত আলজেরিয়ার মূল 'রাজনৈতিক শক্তি'। প্রেসিডেন্ট বুতেফ্লিকা (১৯৯৯ সাল থেকে) গোয়েন্দা সংস্থার দ্বারাই চালিত হন। ইসলামপন্থীদের মূলধারায় না নিয়ে আসায় তারা এখনো সেখানে একটি শক্তি। সেখানে এরই মধ্যে জন্ম হয়েছে আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু জঙ্গি সংগঠনের, যারা সেখানে আত্মঘাতী বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত। এসব জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতা শুধু আলজেরিয়ায়ই সীমাবদ্ধ নেই, বরং তাদের তৎপরতা লিবিয়া ও সিরিয়াতেও লক্ষ করা গেছে।
'আরব বসন্ত' আরব বিশ্বে একটি সম্ভাবনা তৈরি করেছিল; আর তা হচ্ছে স্বৈরাচারী সরকারগুলোর উৎখাতের মধ্য দিয়ে একটি জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করা। এ ক্ষেত্রে তিউনেসিয়া একটি মডেল হতে পারত। মুসলিম ব্রাহারহুডের মতো এন্মাহ্দাও তিউনেসিয়ার অন্যতম ইসলামিক শক্তি। এন্মাহ্দার নেতা দীর্ঘদিন লন্ডনে নির্বাসিত জীবনযাপন করেছেন। ২০১১ সালে বেন আলির পতনের পর সে বছরের অক্টোবরেই প্রথমবারের মতো যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে এন্মাহ্দা সংসদের নিম্নকক্ষে অন্যতম শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। ৩৭ শতাংশ ভোট তারা পেয়েছিল। ইচ্ছে করলে এন্মাহ্দা এককভাবে সরকার গঠন করতে পারত। কিন্তু তারা তা করেনি। সেখানে তিন শক্তির একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়েছে। এন্মাহ্দা নেতা হামাদি জেবালি প্রধানমন্ত্রী হলেও সর্বজন গ্রহণযোগ্য মনসোয়া মাজুকিকে তারা প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিয়েছিল। মাজুকি বামমনা 'কংগ্রেস অব দ্য রিপাবলিক পার্টি'র নেতা। অন্যদিকে সোস্যাল ডেমোক্রেটিক ধারার দল (ডেমোক্রেটিক ফোরাম ফর লেবার অ্যান্ড লিবারটিজ বা এত্ত্বাকাতল) সরকারে যোগ দিয়েছিল। এত্ত্বাকাতল নেতা আবদের রাহমান লাদঘাম ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। লাদঘামের সঙ্গে আরো দুজন ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী রয়েছেন, যাঁদের একজন এন্মাহ্দান ও অন্যজন নিরপেক্ষ। মন্ত্রিসভায় দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিরাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। এ কারণে দেখা যায়, তিউনেসিয়ায় বিপ্লবপরবর্তী তেমন কোনো অসন্তোষ সংঘটিত হয়নি। সেখানে যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, মিসর এই মডেল অনুসরণ করতে পারত। কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতাদের হিসাবে ভুল ছিল। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা রয়েছে দলটির। ১৯২৫ সালে যে সংগঠনটির জন্ম, তাদের বিশাল জনপ্রিয়তা রয়েছে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু ব্রাদারহুড নেতারা যেটা বুঝতে পারেননি, তা হচ্ছে মিসরে একটি ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি রয়েছে। যাদের প্রশাসনে, সেনাবাহিনীতে, অর্থনীতিতে অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী। তাহ্‌রির স্কোয়ারের ১৭ দিনের অবস্থান হোসনি মুবারকের পতন ঘটলেও সেদিন ধর্মনিরপেক্ষ তথা লিবারেল ও নারীবাদীরা ইসলামপন্থীদের সঙ্গে আন্দোলন করেছিল। মুবারকের পতনের পর সেখানে নতুন যে সংস্কৃতির জন্ম হয়েছিল, তাতে খুব দ্রুত এগোতে চাচ্ছিলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি। তিনি শরিয়াহভিত্তিক একটি সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন। তাঁর দ্রুত ইসলামীকরণ প্রক্রিয়ায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল ধর্মনিরপেক্ষ ও নারীবাদীরা। হোসনি মুবারকবিরোধী আন্দোলনের মূল স্পিরিট ছিল reedom, social justice, অর্থাৎ 'রুটি, স্বাধীনতা ও সাম্য' প্রতিষ্ঠা। সাধারণ মানুষ চেয়েছিল, তাদের অর্থনৈতিক দুরবস্থা লাঘব হবে, সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, বৈষম্য দূর হবে, তরুণরা পাবে চাকরি। কিন্তু তা হয়নি। মুরসি এদিকে দৃষ্টি দেননি। তিনি বেশিমাত্রায় ইসলামীকরণের দিকে ঝুঁকে পড়ায় সামাজিক খাত উপেক্ষিত হয়েছিল। আইএমএফ থেকে যে ঋণ পাওয়ার কথা, তা তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি। ফলে ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র এক বছরের মাথায় মানুষের অসন্তোষ বাড়ছিল। মুরসি যদি তিউনেসিয়ার মডেল অনুসরণ করতেন, আমার ধারণা, এত তাড়াতাড়ি তাঁর পতন ঘটত না। তবে সেনাসমর্থিত আদলি মনসুরও ভুল করবেন, যদি তিনি ইসলামপন্থীদের মূলধারায় না আনেন। সেনাবাহিনীর সমর্থন থাকায় তিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন বটে, কিন্তু অসন্তোষ দমন করতে পারবেন না। অসন্তোষ থাকবে এবং তা জঙ্গিবাদের জন্ম দেবে। এরই মধ্যে মিসরে আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গি সংগঠনের সীমিত তৎপরতা লক্ষ করা গেছে। তারা আরো শক্তিশালী হবে।
'আরব বসন্ত' যে প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছিল, তা ফিকে হয়ে আসছে। তিউনেসিয়া ও ইয়েমেনে এক ধরনের স্থিতিশীলতা থাকলেও মিসর, সিরিয়া কিংবা লিবিয়ায় অস্থিরতা 'আরব বসন্ত'কে একটি বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। 'আরব বসন্ত' জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। যে তরুণ প্রজন্ম এক সময় আরব বসন্তের জন্ম দিয়েছিল, সেই তরুণ প্রজন্ম এখন হতাশ। তাদের চাকরি নেই। বেকার সমস্যা বেড়েছে। এ চিত্র তিউনেসিয়া থেকে শুরু করে মিসর পর্যন্ত সর্বত্র। মিসরে মুরসি কেন উৎখাত হলেন, এটা নিয়ে নানা 'তত্ত্ব' থাকলেও একটা বিষয় স্পষ্ট তা হচ্ছে তিনি মিসরের অর্থনীতিকে বাগে আনতে পারেননি। যে কারণে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হতাশা বাড়ছিল। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মিসরে আরব বসন্তের আগে (২০০৮) যেখানে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ শতাংশ, ২০১৩ সালে তা ২ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। বেকারত্বের হার এখন সর্বোচ্চ ১৩ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি বাড়ছে। ২০০৯ সালে যেখানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩০ বিলিয়ন ডলার, ২০১৩ সালের মাঝামাঝি তা এসে দাঁড়িয়েছে ৫ বিলিয়নে। ডলারের সঙ্গে মিসরের মুদ্রা পাউন্ডের বিনিময় হারের মারাত্মক পতন ঘটেছে। ২০০৯ সালে এক ডলারে পাওয়া যেত ৫ দশমিক ৬ পাউন্ড। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ পাউন্ডে। অর্থাৎ মুদ্রার (পাউন্ড) ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। এ চিত্র তিউনেসিয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দ্বিতীয় আরেকটি সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছে, তা হচ্ছে আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গি সংগঠনের উত্থান। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, ইরাক-সিরিয়া সীমান্তে জঙ্গিবাদী সংগঠন 'জাবহাত আল নুসরা' ও 'ইসলামিক স্টেট অব ইরাক' মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠা করেছে। মিসরে ইসলামিক গ্রুপগুলোর মধ্যে জঙ্গিবাদীরা তৎপর হয়েছে। লিবিয়াতে তারা শক্তিশালী। গোটা আরব বিশ্বে যদি জাতীয় ইস্যুতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে ইসলামিক জঙ্গিবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। তাই একটি 'তিউনেসিয়ান মডেল' হতে পারে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার একমাত্র সমাধান। মিসরের সামরিক জান্তা যদি এটা উপলব্ধি করে, তাহলে তারা ভালো করবে। মুরসিকে অন্তরীণ অবস্থা থেকে মুক্তি এবং সেই সঙ্গে মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে একটি 'সমঝোতা' সেখানে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে। ক্যাবিনেটে মুরসির সমর্থকদের অন্তর্ভুক্তি ও প্রধানমন্ত্রী অথবা ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর একটি পদ দেওয়া, দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করা, আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সংবিধানে সংশোধনী আনা ইত্যাদির মাধ্যমে মিসরে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। সিরিয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আসাদকে উৎখাত নয়, বরং সেখানে সব দলের সমন্বয়ে একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা, দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ বন্ধ করতে সাহায্য করতে পারে। 'আরব বসন্ত' গোটা আরব বিশ্বে একটি গণতান্ত্রিক সমাজ, আইনের শাসন, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনার জন্ম দিলেও সমাজে বড় বিভক্তি ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবে আরব বসন্ত তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। (নিউ ইয়র্ক থেকে)
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
দৈনিক কালের কন্ঠ, ২৫ জুলাই ২০১৩।

একটি মন্তব্য ও কিছু প্রশ্ন

নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. ডেভিড লুডেনের একটি বক্তব্য ছাপা হয়েছে নিউইয়র্কের বাংলা পত্রিকাগুলোতে গত ১৭ জুলাই। যুক্তরাষ্ট্রের মওলানা ভাসানী ফাউন্ডেশন আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে (নিউইয়র্কে) তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ শেখ হাসিনা চালান না, বাংলাদেশ চালান মাল্টিন্যাশনাল পুঁজির প্রতিনিধি ইউরোপের রাষ্ট্রদূত ও রাষ্ট্রদূতদের ট্যিউস ডে ক্লাব ও ঢাকায় আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা। তারাই বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন। তারাই দায়ী বাংলাদেশের আর্থ-রাজনৈতিক অবস্থার জন্য’ (সাপ্তাহিক পরিচয়, ১৭ জুলাই ২০১৩)। তার বক্তব্য এভাবেই ছাপা হয়েছে। অধ্যাপক লুডেনের এই বক্তব্য কমিউনিটির মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। স্থানীয় বাঙালিদের মাঝে অধ্যাপক লুডেন খুব একটা পরিচিত ব্যক্তি না হলেও যারা শিক্ষা জগতের সঙ্গে জড়িত, এখানে পড়াশোনা করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন, তাদের কাছে অধ্যাপক লুডেন একটি পরিচিত নাম। সুতরাং অধ্যাপক লুডেনের বক্তব্যকে হাল্কাভাবে উড়িয়ে দেয়া যায় না। উপরোক্ত আরো একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে লুডেন মওলানা ভাসানীর ওপর গবেষণা করছেন। অনুষ্ঠানে মওলানার রাজনীতি নিয়েও তিনি কথা বলেছেন।
মূলত বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের কাছে অধ্যাপক লুডেনের বক্তব্যটি অমূলক নয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের প্রভাব বাড়ছে। বিদেশিরা প্রকাশ্যেই বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে মন্তব্য করছেন। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা বলতে গেলে প্রতি সপ্তাহেই একটি মন্তব্য করছেন, যা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হচ্ছে বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোতে। তার এই মন্তব্য কারো কারো কাছে অনাকাক্সিক্ষত হলেও অনেক সময় তিনি ‘সত্য’ কথাটাই বলছেন। অনেকেরই মনে থাকার কথা, বেগম জিয়ার শাসনামালের (২০০১-২০০৬) শেষের দিকে এই ‘ট্যিউস ডে ক্লাব’-এর জন্ম হয়েছিল। মূলত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতের নেতৃত্বেই জন্ম হয়েছিল এই ‘ট্যিউস ডে ক্লাব’। এই ক্লাবের সদস্য ছিলেন বেশক’টি পশ্চিমা দাতাগোষ্ঠীর রাষ্ট্রদূতরা; যদিও কাগজে-কলমে এই ক্লাবের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। রাষ্ট্রদূতরা প্রতি মঙ্গলবার মিলিত হতেন বিধায়, সংবাদপত্রে এর নামকরণ করা হয়েছিল ‘ট্যিউস ডে ক্লাব’। বেগম জিয়ার শাসনামলে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মাঝে দ্বন্দ্বের ফলেই জন্ম হয়েছিল ‘ট্যিউস ডে ক্লাব’-এর। আজকের পরিস্থিতির সঙ্গে সেদিনের পরিস্থিতির তেমন কোনো পার্থক্য নেই; বরং পরিস্থিতির গভীরতা আরো বেশি। ফলে বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর তৎপরতা বেড়েছে। সম্ভবত অধ্যাপক লুডেন সে কথাটাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এই নিউইয়র্ক শহরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে সচেতন। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ঢাকা থেকে কেউ না কেউ আসছেন, মিটিং করছেন। মিটিংগুলোতে উপস্থিতির হারও কম নয়। নির্বাচন হবে কি, হবে না, আরেকটি ‘ওয়ান-ইলেভেন’-এর জন্ম হবে কি-না, এটা এখন এই নিউইয়র্ক শহরের বাংলাদেশিদের মাঝে আলোচনার অন্যতম বিষয়। ‘ওয়ান-ইলেভেন’-এর অভিজ্ঞতা সাধারণ মানুষের কাছে যেমন তিক্ত, রাজনীতিকদের কাছে আরো বেশি তিক্ত। নিশ্চয়ই রাজনীতিকরা সেই অধ্যায়ের কথা ভুলে যাননি।
বাংলাদেশের রাজনীতি যেভাবে চলছে, সেভাবে চলতে দেয়া উচিত নয় বলেও প্রায় সবার অভিমত। প্রবাসীরা মনে করেন যেহেতু নির্বাচন সামনে, সেহেতু বিএনপির উচিত হবে নির্বাচনে অংশ নেয়া। নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপিরই ক্ষতি-এটাও মনে করেন অনেকে। আর নির্বাচন কোন্ প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হবে, সেটা নিয়েও সরকারের উচিত বিএনপির সঙ্গে কথাবার্তা বলা। জরুরি একটা সংলাপ হওয়া উচিত। না হলে দেশ আরো গভীর সংকটে পড়বে। রাজনীতিবিদরা আরো ‘ম্যাচুরিটির’ পরিচয় দেবেন, এটাও প্রত্যাশা করেন অনেকে। তবে কোনো অসাংবিধানিক শক্তির ক্ষমতা গ্রহণকেও তারা পছন্দ করছেন না। মুরসির ক্ষমতাচ্যুতির বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। মিসর আর বাংলাদেশ এক নয়। মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো কট্টর ইসলামপন্থিরা বাংলাদেশে ক্ষমতায় নেই। যারা ক্ষমতায়, তারা অসাম্প্রদায়িক একটি দল। আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র আজকের নয়; বরং অনেক পুরনো। অন্যদিকে বিএনপিকেও একটি ইসলামপন্থি দল হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। ইসলামকে দলটি ধারণ করে বটে, কিন্তু তারা কট্টরপন্থি নয়। এই দলটিতে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিরও উপস্থিতি রয়েছে। এমন অনেকেই দলটিতে আছেন, যারা একাত্তরে জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন। দলটির প্রতিষ্ঠাতাও মুক্তিযুদ্ধের একজন বীর সমর নায়ক। সুতরাং বাংলাদেশের সঙ্গে মিসরের পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে না। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিসরের সেনাবাহিনীরও কোনো তুলনা চলবে না। ১৯৫২ সাল থেকেই মিসর সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সেদেশের ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। মিসরের অর্থনীতিতে সেখানকার সেনাবাহিনীর বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সেনবাহিনী এই মুহূর্তে ‘টোটাল প্রফেশনাল’। রাজনীতির প্রতি তাদের আদৌ কোনো আগ্রহ নেই। তাই মিসরের পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে না।
অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, মিসরের সেনাবাহিনীর ভূমিকা বাংলাদেশে কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে? বলেছি, মিসরের সেনাবাহিনীর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অনেক বেশি। এই সেনা অভ্যুত্থানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের একটা ‘ভূমিকা’ রয়েছে। ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দেয় যুক্তরাষ্ট্র শুধু মিসরের সেনাবাহিনীকে। সেনাবাহিনীর নিজস্ব একটা অর্থনৈতিক ভিত্তি রয়েছে মিসরে। প্রায় প্রতিটি বড় বড় শিল্পে বিনিয়োগ রয়েছে সেনাবাহিনীর। কোনো সরকারের পক্ষেই এই ‘অর্থনৈতিক ভিত্তি’কে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। ইসরাইলের নিজস্ব স্বার্থ রয়েছে মিসরে। ১৯৭৮ সালে মিসর ও ইসরাইল একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, যার মধ্য দিয়ে ইসরাইল তার পার্শ্ববর্তী দেশের কাছ থেকে ‘নিরাপত্তা হুমকি’কে অনেকটাই ‘শূন্য পর্যায়ে’ নামিয়ে এনেছিল। কিন্তু ইসরাইলবিরোধী মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থান শঙ্কিত করেছিল ইসরাইলকে। তাই একটা সামরিক অভ্যুত্থান সেখানে অবশ্যম্ভাবী ছিল। কোন পথে এখন মিসর এ ব্যাপারে বাংলাদেশিদের অনেক আগ্রহ দেখেছি। জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ এলসিসির ভূমিকাই-বা কি হবে এখন এটিও আলোচনায় আছে। তিনি একটি ‘নির্বাচন’ (২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা) দিয়ে আবার ব্যারাকে ফিরে যাবেন, এটা কেউই বিশ্বাস করেন না। বাস্তবতাও তাই বলে। সাবেক মন্ত্রী ও একজন অর্থনীতিবিদ হাজেম এল বেবলাউই প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এটা তত্ত্বের কথা। সেনা অভ্যুত্থানকারীরা তত্ত্বগতভাবেই টেকনোক্রেটদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলেন। মিসরেও তা-ই হয়েছে। মিসরের রাজনীতি বাংলাদেশিদের স্পর্শ করেছে। তারা ‘ইফতার মাহফিল’-এর একটা অনুষ্ঠানে এ প্রসঙ্গে আমাকে আরো নানা প্রশ্ন করেছেন। বলেছি, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এখন যথেষ্ট ‘প্রফেশনাল।’ অনেকেরই প্রশ্ন, নির্বাচন কি আদৌ হবে? বলেছি, আওয়ামী লীগ যদি বিএনপিকে বাদ দিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যায়, তাহলে তা দলটির অস্তিত্বকেও একটা হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারে। অনেকেই বিশ্বাস করেন, যারা প্রধানমন্ত্রীকে উপদেশ দিচ্ছেন, তারা তাকে সঠিক উপদেশটি দিচ্ছেন না। দলের ভেতরে কট্টরপন্থিদের দ্বারা তিনি বেশিমাত্রায় প্রভাবান্বিত। এক সময় যারা মস্কোপন্থি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তারা বেশিমাত্রায় দলের নীতি-নির্ধারণীতে প্রভাব ফেলছেন। এমন কথাও অনেকের মুখ থেকে শুনেছি এদের ‘ভুলের’ কারণেই দলকে আজ কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে।
ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণে এসে আওয়ামী লীগ দাঁড়িয়েছে। একদিকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, অন্যদিকে সর্বমহলে নির্বাচনের একটা গ্রহণযোগ্যতা কোন্ পথে এখন আওয়ামী লীগ যাবে? আওয়ামী লীগ কি এতটুকু নমনীয় হবে? ঈদের পর বড় ধরনের সংকটের মুখে থাকবে দেশ। এই যুক্তরাষ্ট্রে নীতি-নির্ধারকদের কাছে এখন বাংলাদেশ একটি জনপ্রিয় নাম নয়। জিএসপি সুবিধা বাতিল হয়েছে। সিনেটে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ড. ইউনূস ইস্যুতে অসন্তুষ্ট সবাই। তাই সরকারকে তাদের দূরদর্শিতা প্রমাণ করতে হবে। ওয়াশিংটনে আমাদের দূতাবাসে যারা কাজ করেন, তারা বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু দেখছেন এ প্রশ্নও করেছেন অনেকে। তারা সঠিকভাবে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারছেন না এমন মন্তব্য প্রায় সবার।
তাই অধ্যাপক লুডেনের বক্তব্যকে হাল্কাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের কথা দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা বারবার বলে আসছেন। এখন মহাজোট সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে বিএনপিকে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান করে নির্বাচনকালীন সরকারের কোনো ফর্মুলাই কাজ করবে না। বেগম জিয়া ইতোমধ্যে এ বিষয়ে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। পরিষ্কার বলেছেন, এমনটি হলে তিনি নির্বাচনে যাবেন না। তাহলে ‘সকল দলের অংশগ্রহণ’ নিশ্চিত হবে কিভাবে? তাই প্রধানমন্ত্রীকে এবং আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকদের একটা ‘ফর্মুলা’ বের করতে হবে। যদি গ্রহণযোগ্য একটি ফর্মুলা বের করা না যায়, তাহলে দেশ একটি গভীর সংকটে পড়বে। আর সমঝোতা যদি না হয়, তাহলে ‘নতুন একটি ওয়ান-ইলেভেন’-এর সম্ভাবনা আরো উজ্জ্বল হবে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র ইতোমধ্যে অনেক কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। এই গণতন্ত্রের জন্য বাংলাদেশে অনেক মানুষের প্রাণ গেছে, রক্ত ঝরেছে, রাজনীতিকরাও অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই রাজনীতিকরাই আবার পরিস্থিতি জটিলও করে তুলেছেন। এর থেকে উত্তরণের পথ তাদেরই সন্ধান করতে হবে।
রাজনীতিতে ‘রিয়েল পলিটিকস’-এর একটি বিষয় রয়েছে। অর্থাৎ প্রয়োজনে বাস্তবমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা। পাকিস্তানে সর্বশেষ নির্বাচনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা দেশে ও বিদেশে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। নেপালেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। ইউরোপে ও গ্রিসে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। বুলগেরিয়াও একই পথ অবলম্বন করেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও এ ধরনের একটি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা প্রয়োজন। এটাই ‘রিয়েল পলিটিকস’-এর মূল কথা। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে মজবুত করার জন্যই প্রশ্নমুক্ত নির্বাচনী ব্যবস্থা নিশ্চিত করা বড় বেশি জরুরি। সরকারকে কখনো কখনো জাতীয় স্বার্থের কথা বিবেচনায় নিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আজ বাংলাদেশের পরিস্থিতি সে রকমই। জাতির বৃহত্তম স্বার্থের খাতিরেই নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে ঐকমত্য প্রয়োজন। ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হলে দাতাগোষ্ঠীর অপতৎপরতা আরো বাড়বে। বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। ইতোপূর্বে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। এর জন্য আমাদের ক্ষতিও হয়েছে যথেষ্ট। এ জন্য সব বিষয়ে আমাদের রাজনীতিকরা যে সচেতন নন সে কথাও বলা যাবে না। কিন্তু তাদের কাছে সব কিছু ছাপিয়ে দলীয় স্বার্থটাই বড় হয়ে উঠেছে, যা জনকল্যাণ এবং দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির জন্য অশনিসংকেত। রাজনীতিবিদরা বৈরী পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থের কথা বিবেচনা করে আরো বেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে সক্ষম হবেন এ প্রত্যাশা শান্তিপ্রিয় সবার। ইতোমধ্যে সরকারের ওপর চাপ বেড়েছে এবং এই চাপ শুধুই রাজনৈতিক নয়, আন্তর্জাতিক চাপও রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে ঈদের পর পরই সরকার আরো নানামুখী চাপে পড়বে এবং রাজনীতির মাঠ অধিকতর উত্তপ্ত হয়ে উঠবে, যা শান্তিপ্রিয় কারোরই কাম্য নয়। জাতীয় স্বার্থে সবাইকে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে অবস্থান নিতে না পারলে শান্তি আসবে না। আর অধ্যাপক লুডেনের মতো ব্যক্তিদের আমরা কথা বলার সুযোগ করে দেব। তাই আমাদের প্রত্যাশা, রাজনীতিবিদরা দূরদর্শিতার পরিচয় দেবেন। ‘রিয়েল পলিটিকস’ বাংলাদেশে বিকশিত হবে আমরা এটাই প্রত্যাশা করি।
নিউইয়র্ক, ১৮ জুলাই ২০১৩
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক - See more at: http://www.manobkantha.com/2013/07/25/131535.html#sthash.Qpd1yrM4.EkpfZBQM.dpuf


নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. ডেভিড লুডেনের একটি বক্তব্য ছাপা হয়েছে নিউইয়র্কের বাংলা পত্রিকাগুলোতে গত ১৭ জুলাই। যুক্তরাষ্ট্রের মওলানা ভাসানী ফাউন্ডেশন আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে (নিউইয়র্কে) তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ শেখ হাসিনা চালান না, বাংলাদেশ চালান মাল্টিন্যাশনাল পুঁজির প্রতিনিধি ইউরোপের রাষ্ট্রদূত ও রাষ্ট্রদূতদের ট্যিউস ডে ক্লাব ও ঢাকায় আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা। তারাই বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন। তারাই দায়ী বাংলাদেশের আর্থ-রাজনৈতিক অবস্থার জন্য’ (সাপ্তাহিক পরিচয়, ১৭ জুলাই ২০১৩)। তার বক্তব্য এভাবেই ছাপা হয়েছে। অধ্যাপক লুডেনের এই বক্তব্য কমিউনিটির মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। স্থানীয় বাঙালিদের মাঝে অধ্যাপক লুডেন খুব একটা পরিচিত ব্যক্তি না হলেও যারা শিক্ষা জগতের সঙ্গে জড়িত, এখানে পড়াশোনা করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন, তাদের কাছে অধ্যাপক লুডেন একটি পরিচিত নাম। সুতরাং অধ্যাপক লুডেনের বক্তব্যকে হাল্কাভাবে উড়িয়ে দেয়া যায় না। উপরোক্ত আরো একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে লুডেন মওলানা ভাসানীর ওপর গবেষণা করছেন। অনুষ্ঠানে মওলানার রাজনীতি নিয়েও তিনি কথা বলেছেন।
মূলত বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের কাছে অধ্যাপক লুডেনের বক্তব্যটি অমূলক নয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের প্রভাব বাড়ছে। বিদেশিরা প্রকাশ্যেই বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে মন্তব্য করছেন। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা বলতে গেলে প্রতি সপ্তাহেই একটি মন্তব্য করছেন, যা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হচ্ছে বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোতে। তার এই মন্তব্য কারো কারো কাছে অনাকাক্সিক্ষত হলেও অনেক সময় তিনি ‘সত্য’ কথাটাই বলছেন। অনেকেরই মনে থাকার কথা, বেগম জিয়ার শাসনামালের (২০০১-২০০৬) শেষের দিকে এই ‘ট্যিউস ডে ক্লাব’-এর জন্ম হয়েছিল। মূলত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতের নেতৃত্বেই জন্ম হয়েছিল এই ‘ট্যিউস ডে ক্লাব’। এই ক্লাবের সদস্য ছিলেন বেশক’টি পশ্চিমা দাতাগোষ্ঠীর রাষ্ট্রদূতরা; যদিও কাগজে-কলমে এই ক্লাবের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। রাষ্ট্রদূতরা প্রতি মঙ্গলবার মিলিত হতেন বিধায়, সংবাদপত্রে এর নামকরণ করা হয়েছিল ‘ট্যিউস ডে ক্লাব’। বেগম জিয়ার শাসনামলে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মাঝে দ্বন্দ্বের ফলেই জন্ম হয়েছিল ‘ট্যিউস ডে ক্লাব’-এর। আজকের পরিস্থিতির সঙ্গে সেদিনের পরিস্থিতির তেমন কোনো পার্থক্য নেই; বরং পরিস্থিতির গভীরতা আরো বেশি। ফলে বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর তৎপরতা বেড়েছে। সম্ভবত অধ্যাপক লুডেন সে কথাটাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এই নিউইয়র্ক শহরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে সচেতন। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ঢাকা থেকে কেউ না কেউ আসছেন, মিটিং করছেন। মিটিংগুলোতে উপস্থিতির হারও কম নয়। নির্বাচন হবে কি, হবে না, আরেকটি ‘ওয়ান-ইলেভেন’-এর জন্ম হবে কি-না, এটা এখন এই নিউইয়র্ক শহরের বাংলাদেশিদের মাঝে আলোচনার অন্যতম বিষয়। ‘ওয়ান-ইলেভেন’-এর অভিজ্ঞতা সাধারণ মানুষের কাছে যেমন তিক্ত, রাজনীতিকদের কাছে আরো বেশি তিক্ত। নিশ্চয়ই রাজনীতিকরা সেই অধ্যায়ের কথা ভুলে যাননি।
বাংলাদেশের রাজনীতি যেভাবে চলছে, সেভাবে চলতে দেয়া উচিত নয় বলেও প্রায় সবার অভিমত। প্রবাসীরা মনে করেন যেহেতু নির্বাচন সামনে, সেহেতু বিএনপির উচিত হবে নির্বাচনে অংশ নেয়া। নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপিরই ক্ষতি-এটাও মনে করেন অনেকে। আর নির্বাচন কোন্ প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হবে, সেটা নিয়েও সরকারের উচিত বিএনপির সঙ্গে কথাবার্তা বলা। জরুরি একটা সংলাপ হওয়া উচিত। না হলে দেশ আরো গভীর সংকটে পড়বে। রাজনীতিবিদরা আরো ‘ম্যাচুরিটির’ পরিচয় দেবেন, এটাও প্রত্যাশা করেন অনেকে। তবে কোনো অসাংবিধানিক শক্তির ক্ষমতা গ্রহণকেও তারা পছন্দ করছেন না। মুরসির ক্ষমতাচ্যুতির বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। মিসর আর বাংলাদেশ এক নয়। মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো কট্টর ইসলামপন্থিরা বাংলাদেশে ক্ষমতায় নেই। যারা ক্ষমতায়, তারা অসাম্প্রদায়িক একটি দল। আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র আজকের নয়; বরং অনেক পুরনো। অন্যদিকে বিএনপিকেও একটি ইসলামপন্থি দল হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। ইসলামকে দলটি ধারণ করে বটে, কিন্তু তারা কট্টরপন্থি নয়। এই দলটিতে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিরও উপস্থিতি রয়েছে। এমন অনেকেই দলটিতে আছেন, যারা একাত্তরে জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন। দলটির প্রতিষ্ঠাতাও মুক্তিযুদ্ধের একজন বীর সমর নায়ক। সুতরাং বাংলাদেশের সঙ্গে মিসরের পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে না। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিসরের সেনাবাহিনীরও কোনো তুলনা চলবে না। ১৯৫২ সাল থেকেই মিসর সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সেদেশের ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। মিসরের অর্থনীতিতে সেখানকার সেনাবাহিনীর বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সেনবাহিনী এই মুহূর্তে ‘টোটাল প্রফেশনাল’। রাজনীতির প্রতি তাদের আদৌ কোনো আগ্রহ নেই। তাই মিসরের পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে না।
অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, মিসরের সেনাবাহিনীর ভূমিকা বাংলাদেশে কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে? বলেছি, মিসরের সেনাবাহিনীর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অনেক বেশি। এই সেনা অভ্যুত্থানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের একটা ‘ভূমিকা’ রয়েছে। ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দেয় যুক্তরাষ্ট্র শুধু মিসরের সেনাবাহিনীকে। সেনাবাহিনীর নিজস্ব একটা অর্থনৈতিক ভিত্তি রয়েছে মিসরে। প্রায় প্রতিটি বড় বড় শিল্পে বিনিয়োগ রয়েছে সেনাবাহিনীর। কোনো সরকারের পক্ষেই এই ‘অর্থনৈতিক ভিত্তি’কে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। ইসরাইলের নিজস্ব স্বার্থ রয়েছে মিসরে। ১৯৭৮ সালে মিসর ও ইসরাইল একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, যার মধ্য দিয়ে ইসরাইল তার পার্শ্ববর্তী দেশের কাছ থেকে ‘নিরাপত্তা হুমকি’কে অনেকটাই ‘শূন্য পর্যায়ে’ নামিয়ে এনেছিল। কিন্তু ইসরাইলবিরোধী মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থান শঙ্কিত করেছিল ইসরাইলকে। তাই একটা সামরিক অভ্যুত্থান সেখানে অবশ্যম্ভাবী ছিল। কোন পথে এখন মিসর এ ব্যাপারে বাংলাদেশিদের অনেক আগ্রহ দেখেছি। জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ এলসিসির ভূমিকাই-বা কি হবে এখন এটিও আলোচনায় আছে। তিনি একটি ‘নির্বাচন’ (২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা) দিয়ে আবার ব্যারাকে ফিরে যাবেন, এটা কেউই বিশ্বাস করেন না। বাস্তবতাও তাই বলে। সাবেক মন্ত্রী ও একজন অর্থনীতিবিদ হাজেম এল বেবলাউই প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এটা তত্ত্বের কথা। সেনা অভ্যুত্থানকারীরা তত্ত্বগতভাবেই টেকনোক্রেটদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলেন। মিসরেও তা-ই হয়েছে। মিসরের রাজনীতি বাংলাদেশিদের স্পর্শ করেছে। তারা ‘ইফতার মাহফিল’-এর একটা অনুষ্ঠানে এ প্রসঙ্গে আমাকে আরো নানা প্রশ্ন করেছেন। বলেছি, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এখন যথেষ্ট ‘প্রফেশনাল।’ অনেকেরই প্রশ্ন, নির্বাচন কি আদৌ হবে? বলেছি, আওয়ামী লীগ যদি বিএনপিকে বাদ দিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যায়, তাহলে তা দলটির অস্তিত্বকেও একটা হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারে। অনেকেই বিশ্বাস করেন, যারা প্রধানমন্ত্রীকে উপদেশ দিচ্ছেন, তারা তাকে সঠিক উপদেশটি দিচ্ছেন না। দলের ভেতরে কট্টরপন্থিদের দ্বারা তিনি বেশিমাত্রায় প্রভাবান্বিত। এক সময় যারা মস্কোপন্থি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তারা বেশিমাত্রায় দলের নীতি-নির্ধারণীতে প্রভাব ফেলছেন। এমন কথাও অনেকের মুখ থেকে শুনেছি এদের ‘ভুলের’ কারণেই দলকে আজ কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে।
ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণে এসে আওয়ামী লীগ দাঁড়িয়েছে। একদিকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, অন্যদিকে সর্বমহলে নির্বাচনের একটা গ্রহণযোগ্যতা কোন্ পথে এখন আওয়ামী লীগ যাবে? আওয়ামী লীগ কি এতটুকু নমনীয় হবে? ঈদের পর বড় ধরনের সংকটের মুখে থাকবে দেশ। এই যুক্তরাষ্ট্রে নীতি-নির্ধারকদের কাছে এখন বাংলাদেশ একটি জনপ্রিয় নাম নয়। জিএসপি সুবিধা বাতিল হয়েছে। সিনেটে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ড. ইউনূস ইস্যুতে অসন্তুষ্ট সবাই। তাই সরকারকে তাদের দূরদর্শিতা প্রমাণ করতে হবে। ওয়াশিংটনে আমাদের দূতাবাসে যারা কাজ করেন, তারা বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু দেখছেন এ প্রশ্নও করেছেন অনেকে। তারা সঠিকভাবে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারছেন না এমন মন্তব্য প্রায় সবার।
তাই অধ্যাপক লুডেনের বক্তব্যকে হাল্কাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের কথা দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা বারবার বলে আসছেন। এখন মহাজোট সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে বিএনপিকে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান করে নির্বাচনকালীন সরকারের কোনো ফর্মুলাই কাজ করবে না। বেগম জিয়া ইতোমধ্যে এ বিষয়ে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। পরিষ্কার বলেছেন, এমনটি হলে তিনি নির্বাচনে যাবেন না। তাহলে ‘সকল দলের অংশগ্রহণ’ নিশ্চিত হবে কিভাবে? তাই প্রধানমন্ত্রীকে এবং আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকদের একটা ‘ফর্মুলা’ বের করতে হবে। যদি গ্রহণযোগ্য একটি ফর্মুলা বের করা না যায়, তাহলে দেশ একটি গভীর সংকটে পড়বে। আর সমঝোতা যদি না হয়, তাহলে ‘নতুন একটি ওয়ান-ইলেভেন’-এর সম্ভাবনা আরো উজ্জ্বল হবে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র ইতোমধ্যে অনেক কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। এই গণতন্ত্রের জন্য বাংলাদেশে অনেক মানুষের প্রাণ গেছে, রক্ত ঝরেছে, রাজনীতিকরাও অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই রাজনীতিকরাই আবার পরিস্থিতি জটিলও করে তুলেছেন। এর থেকে উত্তরণের পথ তাদেরই সন্ধান করতে হবে।
রাজনীতিতে ‘রিয়েল পলিটিকস’-এর একটি বিষয় রয়েছে। অর্থাৎ প্রয়োজনে বাস্তবমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা। পাকিস্তানে সর্বশেষ নির্বাচনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা দেশে ও বিদেশে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। নেপালেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। ইউরোপে ও গ্রিসে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। বুলগেরিয়াও একই পথ অবলম্বন করেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও এ ধরনের একটি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা প্রয়োজন। এটাই ‘রিয়েল পলিটিকস’-এর মূল কথা। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে মজবুত করার জন্যই প্রশ্নমুক্ত নির্বাচনী ব্যবস্থা নিশ্চিত করা বড় বেশি জরুরি। সরকারকে কখনো কখনো জাতীয় স্বার্থের কথা বিবেচনায় নিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আজ বাংলাদেশের পরিস্থিতি সে রকমই। জাতির বৃহত্তম স্বার্থের খাতিরেই নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে ঐকমত্য প্রয়োজন। ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হলে দাতাগোষ্ঠীর অপতৎপরতা আরো বাড়বে। বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। ইতোপূর্বে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। এর জন্য আমাদের ক্ষতিও হয়েছে যথেষ্ট। এ জন্য সব বিষয়ে আমাদের রাজনীতিকরা যে সচেতন নন সে কথাও বলা যাবে না। কিন্তু তাদের কাছে সব কিছু ছাপিয়ে দলীয় স্বার্থটাই বড় হয়ে উঠেছে, যা জনকল্যাণ এবং দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির জন্য অশনিসংকেত। রাজনীতিবিদরা বৈরী পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থের কথা বিবেচনা করে আরো বেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে সক্ষম হবেন এ প্রত্যাশা শান্তিপ্রিয় সবার। ইতোমধ্যে সরকারের ওপর চাপ বেড়েছে এবং এই চাপ শুধুই রাজনৈতিক নয়, আন্তর্জাতিক চাপও রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে ঈদের পর পরই সরকার আরো নানামুখী চাপে পড়বে এবং রাজনীতির মাঠ অধিকতর উত্তপ্ত হয়ে উঠবে, যা শান্তিপ্রিয় কারোরই কাম্য নয়। জাতীয় স্বার্থে সবাইকে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে অবস্থান নিতে না পারলে শান্তি আসবে না। আর অধ্যাপক লুডেনের মতো ব্যক্তিদের আমরা কথা বলার সুযোগ করে দেব। তাই আমাদের প্রত্যাশা, রাজনীতিবিদরা দূরদর্শিতার পরিচয় দেবেন। ‘রিয়েল পলিটিকস’ বাংলাদেশে বিকশিত হবে আমরা এটাই প্রত্যাশা করি।
নিউইয়র্ক, ১৮ জুলাই ২০১৩
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
দৈনিক মানবকন্ঠ ২৫ জুলাই ২০১৩।

এক টুকরো বাংলাদেশ

নিউইয়র্ক যেন এক টুকরো বাংলাদেশ। জ্যাকসন হাইটসের আশপাশে অনেক দোকান। মালিকানা বাংলাদেশিদের। মুক্তধারার সাইনবোর্ড বাংলায় লেখা। কবির বেকারি, মালিকানা যেমনি বাংলাদেশিদের ঠিক তেমনি যারা কাজ করেন, তারাও বাংলাদেশি। এই জ্যাকসন হাইটসে বাংলাদেশি সাপ্তাহিক আজকাল। আজকাল চালাচ্ছেন মুসা, সাঈদ, আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত। মুসা ঢাকায় সাংবাদিকতা করেছেন অনেক দিন। রাজনীতিও করেছেন কিছুদিন। এখন আজকাল চালান, সম্পাদক। আজকাল অফিসে এ বিষয়টি নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল একদিন। সেদিন বোধ হয় খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন নিউইয়র্কের বাংলা পত্রিকা নিয়ে গবেষণা হবে। কীভাবে পত্রিকাগুলো এ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, গবেষণা হবে। চাই কি একটি পিএইচডির গবেষণার বিষয়বস্তুও হতে পারে নিউইয়র্কের বাংলা পত্রিকা। হাজার মাইল দূরে বসে বাঙালিরা কম বেতনে পত্রিকায় কাজ করছেন। এটা কি কম গর্বের? এখানে ঠিকানা পত্রিকার নাম উল্লেখ না করলেই নয়। নিউইয়র্কের বাংলা পত্রিকার প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন দুই ভাই, রব ও শাহীন। শাহীন রাজনীতি করেন। কুলাউড়া থেকে এমপিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর রব রাজনীতি করেন না। এক সময়ের কৃতী অ্যাথলেট। এখানে এসে জড়িয়ে গেছেন প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে। আজ তিনি ঠিকানাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একটি প্রতিষ্ঠানে। সংবাদপত্র শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন আবু তাহের, কৌশিক আহমেদ, নাজমুল আশরাফ, ফজলুর রহমান কিংবা লাভলু আনসারদের নাম। বাংলা ভাষার জন্য এটা কি কম পাওয়া? বাংলাকে আমরা রাষ্ট্রভাষা করেছি। বাংলাতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই। পিএইচডি অভিসন্দর্ভ হচ্ছে বাংলাতে। হাজার হাজার মাইল দূরে এসে এই বাংলা একটি স্থান দখল করে নিয়েছে। আমি নিশ্চিত, একদিন এই বাংলা জাতিসংঘের অন্যতম ভাষা হবে। জ্যাকসন হাইটস এলাকায় হাঁটতে গিয়ে, কেনাকাটা করতে গিয়ে কিংবা 'কাবাব কিং'-এ দুপুরে খেতে গিয়ে আমরা বাংলাতেই কথা বলেছি। এটা কি অবাক করার বিষয় নয়? ট্যাক্সিক্যাবে যিনি জেএফকে বিমানবন্দর থেকে জ্যামাইকা এলাকায় পেঁৗছে দিলেন আমাকে অবাক করে দিয়ে, তিনি একজন মহিলা এবং বাঙালি। এই মহিলা যিনি বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন তাও আবার ঢাকা শহর থেকে নয়, তিনি এখন নিউইয়র্কে ক্যাব চালান। আমাদের প্রাপ্তিটা কি একেবারে কম?
বাংলাদেশ একটা 'সফ্ট' পাওয়ার। বিশ্বকে দেওয়ার অনেক কিছুই আছে আমাদের। শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ, বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প, গার্মেন্ট_ সবকিছুতে বাংলাদেশ বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে। রানা প্লাজায় 'হত্যাকাণ্ড' সাময়িকভাবে বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেললেও পোশাকশিল্পের কদর বহির্বিশ্বে থাকবেই। তাই রফতানিমুখী পোশাকশিল্পের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা ক্ষীণ। অভিযোগ আছে, বাংলাদেশে পোশাকশিল্পে কর্মরতদের কম মজুরি দেওয়া হয়। ১২ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর আমেরিকান প্রোগ্রেস বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গার্মেন্ট রফতানিকারক দেশগুলোর পোশাকশিল্পের অবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে (এষড়নধষ ডধমব ঞৎবহফং ভড়ৎ অঢ়ঢ়ধৎবষ ডড়ৎশবৎং, ২০০১-২০১১)। তাতে দেখা যায়, শুধু বাংলাদেশই নয়, প্রায় প্রতিটি শীর্ষস্থানীয় রফতানিকারক দেশে গার্মেন্ট সেক্টরে মজুরি কমেছে। বাংলাদেশ, মেক্সিকো, হন্ডুরাস, কম্বোডিয়া ও এল সালভাদরে শ্রমিক মজুরি কমেছে শতকরা ১৪ দশমিক ৬ ভাগ হারে। জীবনযাত্রার মানের চেয়ে শতকরা ৩৬ ভাগ হারে কম বেতন দেওয়া হয় চীনে, ২২ ভাগ হারে কম বেতন ভিয়েতনামে। বাংলাদেশে এর পরিমাণ ১৪ ভাগ। এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শ্রমিকদের (তৈরি পোশাক) বেতন কমেছে প্রায় সবক'টি দেশে। ডমিনিকান রিপাবলিক থেকে শুরু করে ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডেও। সবচেয়ে বেশি কমেছে মেক্সিকোতে, শতকরা ২৮ দশমিক ৯ ভাগ। মোট ১০টি দেশ নিয়ে গবেষণা চালানো হয়, যে দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি তৈরি পোশাক রফতানি করে। রানা প্লাজার ঘটনায় বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ব্যাপারে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম হলেও পৃথিবীর অনেক দেশেই তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের চেয়েও খারাপ নজির রয়েছে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ থেকে দু'জন নারী শ্রমিক (আদৌ কি এরা শ্রমিক?) এসেছিলেন এখানে। উদ্দেশ্য অর্থ সংগ্রহ করা ও বাংলাদেশের পোশাকশিল্প সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম দেওয়া! এরা কত অর্থ সংগ্রহ করেছেন, কোন কাজে এ অর্থ ব্যবহৃত হচ্ছে, এর একটা হিসাব নেওয়া প্রয়োজন। শ্রমিক কল্যাণে যদি অর্থ সংগ্রহ করা হয়ে থাকে তাহলে শ্রমিক স্বার্থেই তা ব্যয় করা উচিত।
বাংলাদেশ নিয়ে নিউইয়র্কে গবেষণা হচ্ছে। বেশ ক'জন অধ্যাপক এ কাজে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন। একজন মার্কিন অধ্যাপক মওলানা ভাসানীকে নিয়ে গবেষণা করছেন। ওই গবেষণায় বেরিয়ে আসবে অজানা অনেক কথা। বাংলাদেশে শ্রমিক, বিশেষ করে তৈরি পোশাকের কর্মীদের নিয়ে কাজ করতে চান কেউ কেউ। আমি নিজেও করতে পারি। সুযোগ পেয়েছি। যদিও এটা আমার ফিল্ড নয়। তবুও সুযোগ আছে। বাংলাদেশের সম্মানটা আরও উজ্জ্বল করতে পারি। ড. ইউনূসকে নিয়ে যা হয়েছে, তা হওয়া উচিত ছিল না। তাকে আমরা ব্যবহার করতে পারতাম। পশ্চিমা বিশ্ব এখন আর দারিদ্র্য কমানোর কথা বলছে না। বলছে চিরতরে দারিদ্র্য দূর করার। অর্থাৎ দারিদ্র্য আর থাকবে না। ড. ইউনূস দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাতে চেয়েছিলেন। ড. ইউনূসের এই ধারণা পশ্চিমা বিশ্ব গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ দিয়েই শুরু হতে পারত এই পরীক্ষা! ড. ইউনূসকে কাজ করতে দিলে ক্ষতির কী ছিল? বাংলাদেশকে উঠতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দরকার। এই স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে। পাঁচ-পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়ে গেল। বিএনপি নির্বাচনে জিতেছে। এক অর্থে জিতেছে আওয়ামী লীগও! কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে যে নির্বাচন সম্ভব, তা সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়_ এই ধারণা দেখলাম এই যুক্তরাষ্ট্রেও শক্তিশালী। এই ধারণার বিপক্ষে শক্তিশালী জনমত গড়ে তুলতে পারেনি সরকার। সরকারের ব্যর্থতা এখানেই। সরকার যেভাবে নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামোর কথা বলছে, এর পক্ষেও জনমত শক্তিশালী নয়। বিএনপিকে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসতে না পারলে সেটা হবে সরকারের ব্যর্থতা। প্রবাসী বাঙালিদের ধারণাটা তাই_ একটা সমঝোতা হোক, যাতে নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করে তোলা যায়। না হলে সংঘাত যদি বেড়ে যায়, তা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধিতে বড় ধরনের অন্তরায় হয়ে দেখা দেবে।
এই নিউইয়র্ক শহরে বাংলাও ধীরে ধীরে অন্যতম ভাষা হয়ে উঠছে। বাঙালি ডাক্তারের সংখ্যা একেবারে কম নয়। মহিলা ডাক্তারও আছেন। এ রকম একজন ডা. মমিন রহমানের চেম্বারে যারা তার সহকর্মী সবাই প্রায় বাঙালি। বাঙালি রোগীরাই আসেন, বাংলাতেই কথা বলেন। বাঙালিরা তার কাছে যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। অমায়িক ডা. রহমান গল্পের ছলেই রোগী দেখেন। আমিও দেখিয়ে আসলাম তাকে। জ্যামাইকার ১৬১ নং স্ট্রিটের যেখানে তার চেম্বার, সেখানে গড়ে উঠেছে হাইরাইজ টাওয়ার, নাম 'আফতাব টাওয়ার'। মালিকানা বাংলাদেশিদের। ঢাকায় আফতাব পণ্যের সঙ্গে যারা পরিচিত (ইসলাম গ্রুপ), তারাই তৈরি করেছেন এই ভবন। এ ধরনের একাধিক ভবন রয়েছে এই নিউইয়র্ক শহরে। যাদের মালিকানা এই ইসলাম গ্রুপের কাছে। বাংলাদেশিরা আজ বহুজাতীয় সংস্থার জন্ম দিয়েছেন। এটা একটা বড় পাওয়া আমাদের জন্য।
হলিকস্ এলাকায় আমার বোন নীনা রশীদের বাড়ির পেছনের আঙ্গিনাও যেন এক টুকরো বাংলাদেশ। লাউশাক, নিজের হাতে লাগানো আমাকে মনে করিয়ে দিল মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ। লাল শাক, লাউ, কুমড়ো সবই চাষ হচ্ছে। মাত্র ২৪ বছরে ফার্মাসিস্ট হওয়া আমার বোনের মেয়েরও আগ্রহ বাগান করায়। সবাই মিলে কাজ করেন। মাটি কিনে আনেন দশ ডলারে, গাছে দিতে হয় ভিটামিন (অর্থাৎ আমাদের সার)। এক টুকরো বাংলাদেশ এই নিউইয়র্কের সব জায়গায়।
নিউইয়র্ক
স ড. তারেক শামসুর রেহমান :অধ্যাপক
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পথে মিশর।

মসিররে অর্ন্তর্বতীকালীন প্রসেডিন্টে আদলি মনসুর র্কতৃক সংসদ ও প্রসেডিন্টে নর্বিাচনরে ঘোষণা এবং মুসলমি ব্রাদারহুডরে তা প্রত্যাখ্যানরে মধ্য দয়িে মসিররে রাজনীতি নয়িে বড় ধরনরে অনশ্চিয়তা সৃষ্টি হয়ছে।ে এ অনশ্চিয়তা সখোনে সনোশাসন র্দীঘায়তি করব।ে আদলি মনসুর যে রোডম্যাপ উপস্থাপন করছেনে, তাতে আগামী চার মাসরে মধ্যে একটি গণভোট, ২০১৪ সালরে প্রথম দকিে সংসদ নর্বিাচন, এরপর প্রসেডিন্টে নর্বিাচনরে কথা উল্লখে রয়ছে।ে আগামী ১৫ দনিরে মধ্যে একটি প্যানলেরে নাম তনিি ঘোষণা করবনে, যারা সংবধিানে কছিু পরর্বিতন ও সংশোধন আনবনে। এ সংশোধনীর ওপর গণভোট অনুষ্ঠতি হব।ে এরপর সংশোধতি সংবধিানরে আলোকে দশেে সাধারণ নর্বিাচন অনুষ্ঠতি হব।ে এখন মুসলমি ব্রাদারহুডরে এ র্কমসূচি প্রত্যাখ্যান রাজনীততিে শুধু অনশ্চিয়তাই বাড়াল না, বরং নানা জটলিতা তরৈি করল। এরই মধ্যে র্অথনীতবিদি হাজমে এল ববেলউেকে প্রধানমন্ত্রী হসিবেে নয়িোগ দয়ো হয়ছে।ে তাকওে প্রত্যাখ্যান করছেে মুসলমি ব্রাদারহুড র্পাট।ি
মসিররে নর্বিাচতি প্রসেডিন্টে ড. মোহম্মদ মুরসরি অপসারণরে পর যে প্রশ্নটি পশ্চমিা বশ্বিে আলোচতি হচ্ছে বশেি কর,ে তা হচ্ছে মুরসি কি আসলে র্ব্যথ হয়ছেলিনে? জনগণরে ভোটে তনিি নর্বিাচতি হয়ছেনে মাত্র এক বছর আগ।ে তনিি তার র্টাম শষে করতে পারনেন।ি কন্তিু তার আগইে সনোবাহনিী তাকে অপসারণ করল। এ ক্ষত্রেে সনোবাহনিী স্পষ্টই গণতান্ত্রকি সংস্কৃতরি বরিুদ্ধাচরণ করছে।ে তবে স্পষ্টতই মুরসি একটি ভুল করছেলিনে। আর তা হচ্ছে সনোবাহনিীর শক্তকিে তনিি কছিুটা ‘আন্ডারমাইন’ করছেলিনে। সাম্প্রতকি সময়গুলোতে সনোবাহনিী খুব একটা ক্ষমতা দখল করে না। সনোবাহনিীর ক্ষমতা দখল আর্ন্তজাতকি র্পযায়ে কোথাও গ্রহণযোগ্যতা পায় না। এ ক্ষত্রেে মসিররে সামরকি অভ্যুত্থান নয়িে প্রশ্ন থাকবইে। গত প্রায় ৬২ বছর ধরে মসিররে সনোবাহনিী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভবে ক্ষমতা পরচিালনা করে আসছ।ে সাধারণত সনোবাহনিী দু’ধরনরে ভূমকিা পালন করে থাক।ে প্রথমত আরবট্রিটের এবং দ্বতিীয়ত রুলার। আরবট্রিটের মডলেরে বড় র্দুবলতা হচ্ছ,ে এক্ষত্রেে সনোবাহনিী রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়নে ও পরচিালনায় পুরো দায়ত্বি নতিে পারে না। র্অথাৎ সনোবাহনিীর হাতে রাষ্ট্র পরচিালনার যন্ত্রটি থাকে না। দ্বতিীয় মডলেে সনোবাহনিী সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল কর।ে র্কনলে আদবি সশিাকলি ১৯৫২ সালে সরিয়িার সনোবাহনিীকে আরবট্রিটেররে ভূমকিা থকেে রুলাররে ভূমকিায় নয়িে গয়িছেলিনে। মসিরে সনোবাহনিী আরবট্রিটের নয়, বরং সরাসরি রুলার র্পযায়ে চলে গয়িছেলি। র্কনলে নাসরেরে নতেৃত্বে সনোবাহনিীর (১৯৫৩-১৯৬১) ভূমকিা ছলি এমনই।
আজকে মসিরে সনোবাহনিীর ক্ষমতা দখলরে ভত্তিি গড়ে দয়িে গয়িছেলিনে র্কনলে নাসরে। নাসরে সনোবাহনিীর মধ্যে ফ্রি অফসর্িাস ক্লাব গঠন করছেলিনে ১৯৪৯ সাল।ে এ ফ্রি অফসর্িাস ক্লাবরে উদ্যোগইে ১৯৫৩ সালে সামরকি অভ্যুত্থান পরচিালতি হয় এবং কমান্ড কাউন্সলি গঠনে তারা একটি ভূমকিা পালন করনে। এ কমান্ড কাউন্সলি পরে একটি রাজনতৈকি সংগঠনরে ভূমকিায় অবর্তীণ হয়ছেলি। মসিররে ক্ষত্রেে দখো গছে,ে এ রুলার মডলেরে উদ্যোক্তারা একটি রাজনতৈকি সংগঠনরে জš§ দনে। তাই সঙ্গত কারণইে দৃষ্টি থাকবে জনোরলে আবদলে ফাত্তাহ এল সসিরি দকি।ে তনিি কি র্পূবসূরদিরে অনুসরণ করবনে?
জনোরলে এল সসিরি র্পূবসূররিা দল গঠন করে ক্ষমতা করায়ত্ত করছেলিনে। ১৯৫৩-৫৬ সালে নাসরে গঠন করছেলিনে ‘লবিারশেন র‌্যাল’ি। ১৯৫৭-৭০ সময়সীমায় গঠতি হয়ছেলি ‘ন্যাশনাল ইউনয়িন’। উভয় ক্ষত্রেইে লবিারশেন র‌্যালি ও ন্যাশনাল ইউনয়িন একটি পরপিক্ব রাজনতৈকি দল হসিবেে গড়ে উঠতে পারনে।ি ১৯৭১ সালে প্রয়াত প্রসেডিন্টে সাদাত গঠন করছেলিনে আরব সোশ্যালস্টি ইউনয়িন। আর ১৯৭৯ সালে সাদাত এটাকে ভঙেে গঠন করছেলিনে নউি ডমেোক্রটেকি ইউনয়িন। হোসনি মোবারকও একই পথ অনুসরণ করে গছেনে। সুতরাং জনোরলে সসিি যে ক্ষমতা একজন সম্ভাব্য প্রসেডিন্টেরে হাতে তুলে দয়িে ব্যারাকে ফরিে যাবনে, এটা আমার মনে হয় না। সম্প্রতি জনোরলে সুসি প্রথম উপপ্রধানমন্ত্রীর পদে অধষ্ঠিতি হওয়ায় তা আরও স্পষ্ট হয়ছে।ে তাহলে কোন পথে যাচ্ছে মসির? মসির থকেে যসেব খবরাখবর আসছে তা কোনো আশার কথা বলছে না। মুরসরি পক্ষওে বশিষে দুটি জনমত রয়ছে।ে মুরসরি সর্মথক মুসলমি ব্রাদারহুড লাখ লাখ লোকরে জমায়তে করলে সনোবাহনিী তাতে গুলি চালায়। এতে মারা যায় ৫২ জন। এর ফলে একটি বষিয় স্পষ্ট হয়ছে-ে সনোবাহনিী কোনোমতইে আর মুরসকিে ক্ষমতায় ফরিয়িে আনছে না। যদওি তার সর্মথকদরে দাবি এটাই। এক্ষত্রেে সনোবাহনিীর ভূমকিা এখনও স্পষ্ট নয়। সনোবাহনিী কি এককভাবে কোনো একটি দল গঠন কংিবা পুর্নগঠতি করে নজিরো ক্ষমতা পরচিালনা করব,ে যমেনটি করছেলিনে আনোয়ার সাদাত কংিবা হোসনি মোবারক? বকিল্প হসিবেে সনোবাহনিীর তত্ত্বাবধানে ইসলামপন্থী, লবিারলে ও পশ্চমিা গণতান্ত্রকি সংস্কৃতি ধারণ করা কছিু দলরে সমন্বয়ে একটি জোট গঠন করা হতে পার,ে যারা অর্ন্তর্বতীকালীন সময়রে জন্য ক্ষমতা পরচিালনা করবনে। এমন সম্ভাবনাও রয়ছে,ে সামরকি অভ্যুত্থানরে পর যে অর্ন্তর্বতীকালীন প্রশাসন গঠতি হয়ছে,ে তারাই ক্ষমতা পরচিালনা করবে আরও কছিুদনিরে জন্য। তারপর সামরকি জান্তা প্রসেডিন্টে লর্বিাচন দবেে এবং নজিদেরে একজন র্প্রাথীকে বজিয়ী করে নয়িে আসব।ে এগুলো সবই ক্লাসকিাল থওির।ি সামরকি শাসকরা এভাবইে ক্ষমতা ধরে রাখে ও পরচিালনা কর।ে
প্রথম দকিে মনে হয়ছেলি, সনোশাসকরা দ্বতিীয় সম্ভাবনার দকিে এগয়িে যাচ্ছনে। তারা নোবলে পুরস্কার বজিয়ী আল বারাদকিে প্রধানমন্ত্রী হসিবেে নয়িোগ করতে চয়েছেলিনে। কন্তিু শষে র্পযন্ত সনো অভ্যুত্থানকারীরা এটা করনে।ি সম্ভবত যাদরে নয়িে ‘ঐক্য’ করতে চয়েছেলি সনোবাহনিী, আল বারাদরি ব্যাপারে তাদরে আপত্তি ছলি। বশিষে করে প্রথমদকিে আল নূর র্পাটি সনো অভ্যুত্থানকে সর্মথন করলওে আল বারাদরি ব্যাপারে তাদরে ‘রজর্িাভশেন’ আছ।ে শষে র্পযন্ত নতুন মন্ত্রসিভায় বারাদকিে অর্ন্তর্বতীকালীন ভাইস প্রসেডিন্টে হসিবেে নয়িোগ দয়ো হয়ছে।ে নতুন মন্ত্রসিভায় ইসলামপন্থীদরে অর্ন্তভুক্ত করা হয়ন।ি আল নূর ইসলামপন্থী দল হসিবেে পরচিতি। পশ্চমিা বশ্বিে তাদরে সালাফস্টি হসিবেে চহ্নিতি করা হয়। র্অথাৎ এরা আদি ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় বশ্বিাসী। এদরে সঙ্গে মুসলমি ব্রাদারহুডরে রাজনতৈকিভাবে র্পাথক্য রয়ছে।ে ব্রাদারহুড যভোবে মসিরে ইসলাম প্রতষ্ঠিা করতে চায়, আল নূর সভোবে চায় না। আল নূর বশে কনজারভটেভি। সে তুলনায় ব্রাদারহুড অনকেটা লবিারলে। মাত্র দু’বছর আগে গঠতি আল নূর র্পাটরি মসিরে জনপ্রয়িতা একবোরে কম নয়। বগিত সংসদ নর্বিাচনে ব্রাদারহুডরে পরইে ছলি তাদরে স্থান। সংবধিানে নারী-পুরুষ সমতা বধিান করার উদ্যোগ নয়িছেলি ব্রাদারগুড। কন্তিু আল নূররে তাতে আপত্তি ছলি। মজার ব্যাপার হচ্ছে এখানইে- সামরকি বাহনিী যখন ক্ষমতা দখল করল, তখন আল নূর র্পাটি মুসলমি ব্রাদারহুডকে সর্মথন না করে সর্মথন করে বসল সনোবাহনিীক।ে এতে করে এটা স্পষ্ট য,ে আল নূর পরর্বিততি পরস্থিতিতিে রাজনতৈকি সুবধিা নতিে চায়। তাদরে এ অবস্থান তাদরে একটি সুবধিাবাদী রাজনতৈকি দল হসিবেে পরচিতি করতে পার।ে উপরন্তু আল নূররে রাজনতৈকি মতার্দশ পশ্চমিা বশ্বিে কখনোই গ্রহণযোগ্য হবে না। পশ্চমিা বশ্বি, বশিষে করে র্মাকনি যুক্তরাষ্ট্র কখনোই চাইবে না কট্টরপন্থী অপর একটি ইসলামী দল মসিরে নতুন রাজনতৈকি প্রক্রয়িায় বড় ভূমকিা পালন করুক। মুরসকিে উৎখাতরে পছেনে যুক্তরাষ্ট্ররে একটা প্রচ্ছন্ন সর্মথন রয়ছে।ে সুতরাং আরকেটি কট্টরপন্থী ইসলামী দল মসিরে রাষ্ট্রক্ষমতা পরচিালনা করব,ে এটা যুক্তরাষ্ট্র চাইবে না। আল নূর অভ্যুত্থান পরর্বতী মসিরে রাজনতৈকি সুবধিা নতিে চাইলওে তাতে তারা র্ব্যথই হব।ে মনে রাখতে হব,ে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্ররে বড় র্স্বাথ রয়ছে।ে
‘আরব বসন্ত’ গোটা আরব বশ্বিে পরর্বিতন ডকেে আনলওে এর মধ্য দয়িে গণতান্ত্রকি সংস্কৃতি সখোনে পরপর্িূণভাবে বকিশতি হয়ছে,ে তা বলা যাবে না। বলা যতেে পার,ে একটি ইসলামী শক্তরি উত্থান ঘটছেে আরব বশ্বি।ে আরব বসন্তরে মধ্য দয়িে আধুনকি মনস্ক গণতান্ত্রকি, লবিারলে শক্তরি উত্থান ঘটছে,ে তাও কন্তিু বলা যাবে না। তউিনসিয়িায় এ শক্তরি কছিুটা অবস্থান থাকলওে মসির, লবিয়িা কংিবা সরিয়িায় লবিারলেপন্থীদরে আদৌ কোনো ভূমকিা নইে। বরং দখো গছেে আল-কায়দার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়তি সংগঠনগুলোর প্রতপিত্তি বাড়ছ।ে আল-কায়দার স্থানীয় সংগঠন সরিয়িা ও লবিয়িায় যথষ্টে শক্তশিালী। ইয়মেনেে অনকে আগে থকেইে তাদরে ঘাঁটি রয়ছে।ে মসিরে তারা ঘাঁটি গড়েছে।ে ইরাকওে তারা শক্তশিালী। সুতরাং মসিরে আল-কায়দার সঙ্গে সংশ্লষ্টি শক্তগিুলো রাজনতৈকিভাবে শক্তশিালী হোক- এটা পশ্চমিা বশ্বি কোনো দনি চাইবে না। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যে র্মাকনি স্ট্রাটজে,ি তাতে কট্টরপন্থী কোনো ইসলামকি গ্র“পকে সর্মথন করবে না যুক্তরাষ্ট্র।
প্রথমদকিে মনে হয়ছেলি যুক্তরাষ্ট্র মুরসকিে সামনে রখেে তাদরে র্স্বাথ আদায় করে নতিে চায়। মুরসি নজিে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করছেনে। যুক্তরাষ্ট্ররে একটি বশ্বিবদ্যিালয়ে অধ্যাপনাও করছেনে। কন্তিু মুরসি যখন ধীরে ধীরে মসিরকে একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরণিত করতে চাইলনে, তখন শুধু সর্মথন প্রত্যাহারই নয়, বরং মুরসরি বরিুদ্ধে সামরকি অভ্যুত্থানকে প্ররোচতি করছেলি যুক্তরাষ্ট্র। এখানইে র্মাকনি নীতরি বপৈরীত্ব। যুক্তরাষ্ট্র কোনো গণতান্ত্রকি দশেে সামরকি অভ্যুত্থান সর্মথন করে না। এটা তাদরে ভাষায় গণতান্ত্রকি চন্তিা-চতেনার পরপিন্থী। যে কারণে দখো যায় ষাটরে দশকে পৃথবিীর কোনো কোনো দশেে সনো অভ্যুত্থানকে যুক্তরাষ্ট্র সর্মথন করলওে এখন আর সর্মথন করে না। এখন গণতান্ত্রকি শক্তকিে ‘প্রমোট’ করে যুক্তরাষ্ট্র। কন্তিু দখো গলে, মসিরে একটি নর্বিাচতি সরকারকে যখন সনোবাহনিী উৎখাত করল, তখন যুক্তরাষ্ট্র সনোশাসকদরে বরিুদ্ধে কঠোর হুশয়িারি উচ্চারণ করনে।ি এমনকি ১ দশমকি ২ মলিয়িন ডলাররে যে সনো সহযোগতিা, তাও বন্ধ করনেি যুক্তরাষ্ট্র। কারণ মসিরে যুক্তরাষ্ট্ররে মত্রি হচ্ছে সনোবাহনিী। কোনো রাজনতৈকি দলকে তারা মত্রি হসিবেে বছেে নয়েন।ি
মুরসরি এক বছররে শাসনামলকে ‘র্ব্যথ’ হসিবেে চহ্নিতি করা যাবে না। তবে এটা সত্য, তনিি প্রশাসনে দক্ষতা দখোতে পারনেন।ি তনিি র্অথনতৈকি সমস্যাগুলোকে আদৌ গুরুত্ব দনেন।ি বকোরত্ব হ্রাসরে ব্যাপারে কোনো র্কাযকর ব্যবস্থা ননেন।ি তরুণ প্রজš§ের যে প্রত্যাশা, তা তনিি পূরণ করতে পারনেন।ি তনিি বকোর সমস্যার সমাধান, র্অথনীতকিে সচল করার ব্যাপারে কোনো র্কাযকর ব্যবস্থা না নয়িে বশেি মাত্রায় ইসলামীকরণরে দকিে ঝুঁকছেলিনে। এ সুযোগটাকইে কাজে লাগয়িছেে তার বরিোধী পক্ষ। তারপরও মাত্র এক বছররে সময়সীমা দয়িে তাকে বচিার করা যাবে না। জনগণকইে সুযোগ দয়ো উচতি ছলি ব্যালটরে সাহায্যে তাকে অপসারণ করার। কন্তিু তা হল না। এতে করে উন্নয়নশীল বশ্বিরে অগণতান্ত্রকি শক্তগিুলো আরও উৎসাহতি হব।ে মসিরে গণতন্ত্র বকিাশরে যে সম্ভাবনা ছলি, সনো অভ্যুত্থান তাকে রুদ্ধ করে দলি। গণতান্ত্রকি শক্তগিুলোও পারল না ঐক্যবদ্ধভাবে সনো অভ্যুত্থানরে বরিুদ্ধে দাঁড়াত।ে সনোবাহনিীর সাফল্য এখানইে। এক অনশ্চিয়তার মধ্য দয়িে চলছে মসির। তবে ব্রাদারহুডরে শক্তকিে খাটো করা যাবে না। র্দীঘস্থায়ী এক রাজনতৈকি অনশ্চিয়তার দকিে ধাবতি হল মসির।
নউিইর্য়ক, জুলাই ২০১৩
দৈনিক যুগান্তর,২০ জুলাই ২০১৩

জুলাই ২০, ২০১৩, শনিবার : শ্রাবণ ৫, ১৪২০






জুলাই ২০, ২০১৩, শনিবার : শ্রাবণ ৫, ১৪২০

বাংলাদেশের রাজনীতি ও প্রবাস ভাবনা

নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস যেন মিনি বাংলাদেশ। বাংলাদেশী দোকান, বাংলা পত্রিকা, বিকিকিনির ভাষাÑ তাও বাংলা। বাংলাদেশের রাষ্ট্র গঠনে যারা অবদান রেখে গেছেন, তারা কী কোনোদিন চিন্তা করেছিলেন, একদিন নিউইয়র্কের এ এলাকায় বাংলা ভাষায় দোকানের নাম লেখা থাকবে। তারা কী চিন্তা করেছিলেন, এখান থেকে বাংলা পত্রিকা বের হবে। আজকাল পত্রিকা কিংবা মুক্তধারার ব্যানার দেখে আমার মনে হয়েছে, সেদিন বোধ হয় আর বেশি দূরে নয়, যে দিন বাংলা ভাষা চীনা ভাষার মতোই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে। তবে চীনাদের সঙ্গে বাংলাদেশীদের, এমনকি পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের পার্থক্য এখানেই যে, তারা তাদের নিজ দেশ নিয়ে তেমন একটা চিন্তা করেন না। তাদের ধ্যান-ধারণা ‘নিজ দেশ’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়েই।

বাংলাদেশীরা এ থেকে অনেক এগিয়ে আছে। বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের রাজনীতি তাদের নিত্যদিনের চর্চার একটা অংশ। যেখানেই গেছি, সেখানেই প্রশ্ন একটাইÑ বাংলাদেশের রাজনীতি কোন পথে যাচ্ছে? গাজীপুরে আওয়ামী লীগ যে হারল, তার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? আবার কী ‘ওয়ান-ইলেভেন’ আসবে? কিংবা মিসরের মতো পরিস্থিতি কী বাংলাদেশ বরণ করবে?

নিউইয়র্ক শহরে বাংলাদেশীদের সংখ্যা অনেক। অনেকে অনেক শক্ত কাজ করেন। ভোর ৬টায় যখন নিউইয়র্ক শহর ঘুমিয়ে থাকে, সবাই কাজে যান। তাই দুপুরে কারও বাসায় যদি ফোন করেন, তাকে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। যোগাযোগের মাধ্যম ওই মোবাইল। ল্যান্ডফোন মানুষ খুব একটা ব্যবহার করে না। কিন্তু বিকাল বেলা কিংবা সন্ধ্যে বেলায় ছুটে যান জ্যাকসন হাইটসে। আড্ডা দেন। গল্প করেন। একটা পত্রিকা কিনে বাড়ি ফিরে যান। নিউইয়র্কের এই বাংলাদেশী সমাজে রাজনীতি, তাও আবার দেশীয় রাজনীতির আলোচনাটা বেশি। সাপ্তাহিক আজকাল আমার যে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করল, তাতেও প্রধান্য পেয়েছে এই রাজনীতি। রাতে ফোন করেও হাজারটা প্রশ্ন, এখন কী হবে বাংলাদেশে? অনেকেরই সোজা জবাব আওয়ামী লীগ বড় ধরনের ‘ইমেজ সঙ্কট’-এর মুখে পড়েছে। তাদের অভিমত, দুর্নীতিবাজদের মন্ত্রিসভায় স্থান দেয়া ঠিক হয়নি। দল ও মন্ত্রিসভায় যদি যোগ্য ব্যক্তিদের স্থান দেয়া যেত, তাহলে আজকের পরিস্থিতি এ পর্যায়ে উন্নীত হতো না। অনেকেই মন্ত্রীদের দুর্নীতি, ছাত্রলীগের সন্ত্রাস ও টেন্ডারবাজি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বলেছেন, একটি সভ্য দেশে এসব অকল্পনীয়। অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, প্রধানমন্ত্রী কেন এসব লোকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারলেন না? তাদের প্রায় সবারই ধারণা, বাংলাদেশের একটা বিশাল সম্ভাবনা ছিল। আমাদের রাজনীতিবিদরা বাংলাদেশের সেই সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে যারা বসবাস করেন, তারা সবচেয়ে বেশি আহত হয়েছেন সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি হতে দেখে। তাদের মতে, এতে করে যেসব বাঙালি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এরই মধ্যে বাঙালিদের সম্পর্কে খারাপ একটা ধারণার জন্ম হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশ সরকার ড. ইউনূসের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে, তা করা উচিত হয়নি। ড. ইউনূস বিশ্বব্যাপী পরিচিত ব্যক্তি। তার গ্রামীণ ব্যাংক খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও কোনো কোনো স্টেটে মডেল হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু দেশের স্বার্থে তাকে ব্যবহার না করে দেশেরই ক্ষতি করা হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি যেভাবে চলছে, সেভাবে চলতে দেয়া উচিত নয় বলেও প্রায় সবার অভিমত।

প্রবাসীরা মনে করেন, যেহেতু নির্বাচন সামনে, সেহেতু বিএনপির উচিত হবে নির্বাচনে অংশ নেয়া। নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপিরই ক্ষতিÑ এটাও মনে করেন অনেকে। আর নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হবে, সেটা নিয়েও সরকারের উচিত বিএনপির সঙ্গে কথাবার্তা বলা। জরুরি একটা সংলাপ হওয়া উচিত। না হলে দেশ আরও গভীর সঙ্কটে পড়বে। রাজনীতিবিদরা আরও ‘ম্যাচিওরিটি’র পরিচয় দেবেন, এটাও প্রত্যাশা করেন অনেকে। তবে কোনো অসাংবিধানিক শক্তির ক্ষমতা গ্রহণকেও তারা পছন্দ করছেন না।

মুরসির ক্ষমতাচ্যুতির বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। মিসর আর বাংলাদেশ এক নয়। মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো কট্টর ইসলামপন্থীরা বাংলাদেশে ক্ষমতায় নেই। যারা ক্ষমতায়, তারা অসাম্প্রদায়িক একটি দল। আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র আজকের নয়, বরং অনেক পুরনো। অন্যদিকে বিএনপিকেও একটি ইসলামপন্থী দল হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। ইসলামকে দলটি ধারণ করে বটে। কিন্তু তারা আদৌ কট্টরপন্থী নন। সুতরাং বাংলাদেশের সঙ্গে মিসরের পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে না। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিসরের সেনাবাহিনীরও কোনো তুলনা চলবে না। ১৯৫২ সাল থেকেই সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মিসরের ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। মিসরের অর্থনীতিতে সেখানকার সেনাবাহিনীর বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এই মুহূর্তে ‘টোটাল প্রফেশনাল’। রাজনীতির প্রতি তাদের আদৌ আগ্রহ নেই। তাই মিসরের পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে না।

অনেককেই বলতে শুনেছি, মিসরের সেনাবাহিনীর ভূমিকা বাংলাদেশে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। বলেছি, মিসরের সেনাবাহিনীর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অনেক বেশি। এই সেনা অভ্যুত্থানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের একটা ‘ভূমিকা’ রয়েছে। ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দেয় যুক্তরাষ্ট্র শুধু মিসরের সেনাবাহিনীকেই। সেনাবাহিনীর নিজস্ব একটা অর্থনৈতিক ভিত্তি রয়েছে মিসরে। প্রায় প্রতিটি বড় বড় শিল্পে বিনিয়োগ রয়েছে সেনাবাহিনীর। কোনো সরকারের পক্ষেই এই ‘অর্থনৈতিক ভিত্তি’কে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। ইসরাইলের নিজস্ব স্বার্থ রয়েছে মিসরে। ১৯৭৮ সালে মিসর ও ইসরাইল একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, যার মধ্যে দিয়ে ইসরাইল তার পার্শ্ববর্তী দেশের কাছ থেকে ‘নিরাপত্তা হুমকি’ অনেকটাই ‘শূন্য পর্যায়ে’ নামিয়ে এনেছিল। কিন্তু ইসরাইলবিরোধী মুসলিম ব্রাদারহুডের উন্মাদনা শঙ্কিত করেছিল ইসরাইলকে। তাই একটা সামরিক অভ্যুত্থান সেখানে অবশ্যম্ভাবী ছিল। কোন পথে এখন মিসরÑ এ ব্যাপারে বাংলাদেশীদের অনেক আগ্রহ দেখেছি। জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ এল সিসির ভূমিকাই বা কী হবে এখন? তিনি একটি ‘নির্বাচন’ (২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা) দিয়ে আবার ব্যারাকে ফিরে যাবেন, এটা কেউই বিশ্বাস করেন না। বাস্তবতাও তাই বলে। সাবেক মন্ত্রী ও একজন অর্থনীতিবিদ হাজেম এল দেবলাউই প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এটা তত্ত্বের কথা। অভ্যুত্থানকারীরা তত্ত্বগতভাবেই টেকনোক্রেটদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলেন। মিসরেও তাই হয়েছে।

মিসরের রাজনীতি বাংলাদেশীদের স্পর্শ করেছে। তারা বার বার এমনকি ‘ইফতার মাহফিলে’ও আমাকে প্রশ্ন করেছেন বাংলাদেশের সেনাবাহিনী নিয়ে। বলেছি, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এখন যথেষ্ট ‘প্রফেশনাল’। অনেকেরই প্রশ্ন নির্বাচন কী আদৌ হবে? বলেছি, আওয়ামী লীগ যদি বিএনপিকে বাদ দিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যায়, তাহলে তা দলটির অস্তিত্বকেও একটা হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারে। অনেকেই বিশ্বাস করেন, যারা প্রধানমন্ত্রীকে উপদেশ দিচ্ছেন, তারা তাকে সঠিক উপদেশটি দিচ্ছেন না। দলের ভেতরে কট্টরপন্থীদের দ্বারা তিনি বেশি মাত্রায় প্রভাবান্বিত। এক সময় যারা মস্কোপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তারা বেশি মাত্রায় দলের নীতিনির্ধারণীতে প্রভাব ফেলছেন, এমন কথাও অনেকের মুখ থেকে শুনেছি। তাদের ‘ভুলের’ কারণেই দলকে আজ এ পরিস্থিতি বরণ করতে হয়েছে।

ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণে এসে আওয়ামী লীগ দাঁড়িয়েছে। একদিকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, অন্যদিকে সর্বমহলে নির্বাচনের একটা গ্রহণযোগ্যতাÑ কোন পথে এখন যাবে আওয়ামী লীগ? আওয়ামী লীগ কী এতটুকু নমনীয় হবে? ঈদের পর বড় ধরনের সঙ্কটের মুখে থাকবে দেশ। যুক্তরাষ্ট্রে নীতিনির্ধারকদের কাছে এখন বাংলাদেশ একটি জনপ্রিয় নাম নয়। জিএসপি সুবিধা বাতিল হয়েছে। সিনেটে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ড. ইউনূস ইস্যুতে অসন্তুষ্ট সবাই। তাই সরকারকে তার দূরদর্শিতা প্রমাণ করতে হবে। ওয়াশিংটনে আমাদের দূতাবাসে যারা কাজ করেন, তারা বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু দেখছেনÑ এ প্রশ্নও করেছেন অনেকে। তারা সঠিকভাবে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারছেন নাÑ এমন মন্তব্য প্রায় সবার।

আমাদের একটা বড় দুর্ভাগ্য হচ্ছে, প্রবাসী বাংলাদেশীরা দ্বিধাবিভক্ত। এখানে দলীয় আনুগত্য এত বেশি যে, দলীয় আনুগত্যের কারণে জাতীয় স্বার্থ ম্লান হয়ে গেছে। ভারত এখানে একটা দৃষ্টান্ত। তারা এক। তারা ভারতীয়। তাদের মাঝে অঞ্চল ভিত্তিতে কোনো ঐক্য গড়ে ওঠেনি। যে কারণে ভারতীয় অ্যাসোসিয়েশন বিলিয়ন ডলারের ফান্ড জোগাড় করেছে। এই ফান্ড তারা তাদের জাতীয় স্বার্থে ব্যবহার করে। জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে ক্যাপিটাল হিলে লবিস্ট নিয়োগ করে। মার্কিন সিনেট সদস্য তথা কংগ্রেস সদস্যরা লবিস্ট নিয়োগের কারণে ভারতীয় স্বার্থে কাজ করে। বাংলাদেশীরা দ্বিধাবিভক্ত থাকায়, ঐক্যবদ্ধভাবে কোনো সমিতি গঠিত হয়নি। ফলে ঐক্যবদ্ধভাবে কোনো কর্মসূচিও নিতে পারে না তারা। এখানেই আমাদের বড় ব্যর্থতা। ঐক্যবদ্ধভাবে অনেক কর্মসূচিই নেয়া সম্ভব। কিন্তু আমাদের জাতীয় নেতারা কখনও প্রবাসী বাংলাদেশীদের ঐক্যবদ্ধ করার কোনো উদ্যোগ নেননি। বরং তারা সব সময় দলীয় আনুগত্য ও দলীয় রাজনীতিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন বেশি। তাই ক্যাপিটাল হিলে বাংলাদেশবিরোধী যে একটা জনমত গড়ে উঠেছে, সে ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি বাংলাদেশ। এই ব্যর্থতা সমগ্র বাংলাদেশের।
দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ।
২১ জুলাই ২০১৩

গাজীপুরের নির্বাচন ও প্রবাসীদের ভাবনা


গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ঢাকাতে যেভাবে প্রভাব ফেলেছে, ঠিক তেমনি প্রভাব ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী বাঙালিদের মধ্যেও। নিউ ইয়র্কে বাস করেন বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি। জ্যাকসন হাইটস, যা বাঙালিপাড়া হিসেবে পরিচিত, সেখানে বিপুলসংখ্যক মানুষের মধ্যে এই নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহ দেখেছি। এখানেও বাঙালিরা রাজনৈতিকভাবে দুটি বড় দলের মধ্যে বিভক্ত। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের আগের দিন কী হয়, না হয়, সে ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহ দেখেছি বাঙালিদের মধ্যে। একটা জিনিস আমাকে খুব অবাক করেছে, আর তা হচ্ছে এখানে যাঁরা বসবাস করেন, তাঁরা বাংলাদেশের রাজনীতির বাইরে থাকতে চান না। তাঁরা খুব আগ্রহসহকারেই রাজনীতির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেন। অনেকে আমাকে এমন প্রশ্নও করেছেন যে এরপর কী? বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোট কি শেষ পর্যন্ত এ বছরের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে? অনেকে আমাকে এ প্রশ্নও করেছেন যে যদি বিএনপি সংবিধান বর্ণিত 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের' আওতায় নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
প্রবাসীদের মধ্যে যাঁরা আওয়ামী লীগের সমর্থক, তাঁদেরও বলতে শুনেছি, গত সাড়ে চার বছরের শাসনামলে আওয়ামী লীগের বড় সমস্যা ছিল সুশাসনের অভাব। পরপর পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হেরে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ ছিল একটাই- সুশাসনের অভাব। দলটিতে যথেষ্ট অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতা রয়েছেন। কিন্তু অনেকেই ছিলেন নিষ্ক্রিয়। অথবা প্রধানমন্ত্রী তাঁদের 'ব্যবহার' করতে পারেননি। অনেকে আমাকে এমন কথাও বলেছেন যে তোফায়েল আহমেদের মতো লোকদের 'সার্ভিস' থেকে দল বঞ্চিত হয়েছে। তোফায়েলকে যদি আগে থেকে মূল রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় আনা যেত, আওয়ামী লীগ আজকের মতো ইমেজ সংকটে পড়ত না। বিতর্কিত নেতা তথা মন্ত্রীদের মন্ত্রিসভায় রেখে দেওয়া আওয়ামী লীগের 'ইমেজ সংকট'-এ এতটুকু সাহায্য করেনি। বরং দল পরিচালনায় ও মন্ত্রিসভায় যদি যোগ্য ব্যক্তিদের স্থান দেওয়া যেত, তাহলে আজকের পরিস্থিতি এ পর্যায়ে উন্নীত হতো না। অনেকেই মন্ত্রীদের দুর্নীতি, ছাত্রলীগের সন্ত্রাস ও টেন্ডারবাজি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বলেছেন, একটি সভ্য দেশে এসব অকল্পনীয়। অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, প্রধানমন্ত্রী কেন এসব লোকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারলেন না? এদের প্রায় সবারই ধারণা, বাংলাদেশের একটা বিশাল সম্ভাবনা ছিল। আমাদের রাজনীতিবিদরা বাংলাদেশের সেই সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে যাঁরা বাস করেন, তাঁরা সবচেয়ে বেশি আহত হয়েছেন সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি হতে দেখে। তাঁদের মতে, এতে করে যেসব বাঙালি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন, তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এরই মধ্যে বাঙালিদের সম্পর্কে খারাপ একটা ধারণা জন্ম হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশ সরকার ড. ইউনূসের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে, তা করা উচিত হয়নি। ড. ইউনূস বিশ্বব্যাপী পরিচিত ব্যক্তি। তাঁর গ্রামীণ ব্যাংক খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও কোনো কোনো স্টেটে মডেল হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু দেশের স্বার্থে তাঁকে ব্যবহার না করে দেশেরই ক্ষতি হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি যেভাবে চলছে, সেভাবে চলতে দেওয়া উচিত না বলেও প্রায় সবার অভিমত। প্রবাসীরা মনে করেন, যেহেতু নির্বাচন সামনে, সেহেতু বিএনপির উচিত হবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া। নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপিরই ক্ষতি- এটিও মনে করেন অনেকে। আর নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হবে, সেটা নিয়েও সরকারের উচিত বিএনপির সঙ্গে কথাবার্তা বলা। জরুরি একটা সংলাপ হওয়া উচিত। না হলে দেশ আরো গভীর সংকটে পড়বে। রাজনীতিবিদরা আরো 'ম্যাচিওরিটি'র পরিচয় দেবেন, এটাও প্রত্যাশা করেন অনেকে। তবে কোনো অসাংবিধানিক শক্তির ক্ষমতা গ্রহণকেও তাঁরা পছন্দ করছেন না। মুরসির ক্ষমতাচ্যুতির বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। মিসর আর বাংলাদেশ এক নয়। মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো কট্টর ইসলামপন্থীরা বাংলাদেশে ক্ষমতায় নেই। যারা ক্ষমতায়, তারা অসাম্প্রদায়িক একটি দল। আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র আজকের নয়, বরং অনেক পুরনো। অন্যদিকে বিএনপিকে একটি ইসলামপন্থী দল হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। ইসলামকে দলটি ধারণ করে বটে; কিন্তু তারা আদৌ কট্টরপন্থী নয়। সুতরাং বাংলাদেশের সঙ্গে মিসরের পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে না। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিসরের সেনাবাহিনীরও কোনো তুলনা চলবে না। ১৯৫২ সাল থেকেই সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মিসরের ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। মিসরের অর্থনীতিতে সেখানকার সেনাবাহিনীর বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এ মুহূর্তে 'টোটালি প্রফেশনাল'। রাজনীতির প্রতি তাদের আদৌ আগ্রহ নেই। তাই মিসরের পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে না।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি জাতীয় নির্বাচনের আবহ ফিরে এসেছে। এ নির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগ কতটুকু শিখবে, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। নির্বাচনের পর পরই প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগত সফরে লন্ডন ও পরে বেলারুশ গেছেন। এই নিউ ইয়র্কে অনেককে আক্ষেপ করতে শুনেছি যে এ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর দেশে থাকা উচিত ছিল। গাজীপুর পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে শীর্ষস্থানীয় দলীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করা উচিত ছিল। তা না করে বেলারুশের সফরকে গুরুত্ব দেওয়ায় অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতে বেলারুশ কোনো গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর নয়। এ মুহূর্তে বেলারুশের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি আমাদের জাতীয় স্বার্থেও কোনো বড় অবদান রাখতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রী গাজীপুরের নির্বাচনের ফলকেও খুব বেশি গুরুত্ব দেননি।
এটা সত্য, স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনের কোনো তুলনা করা যাবে না। কিন্তু এটা আওয়ামী লীগের জন্য একটা 'ওয়েক-আপ' ফল। সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল ও খুলনা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফলের ধারাবাহিকতায় গাজীপুরেও একই ফল বয়ে আনল বিএনপির জন্য। এতে করে বিএনপি আরো উৎসাহিত হবে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু বিএনপির জন্যও সামনের দিনগুলো খুব সহজ নয়। সংবিধান আওয়ামী লীগকে একটা সুবিধাজনক অবস্থানে এনে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ এখন অব্দি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে এতটুকু ছাড় দিতে রাজি নয়। অন্যদিকে বিএনপির দাবি- তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিতে হবে। এখন একদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, অন্যদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার- এই দুইয়ের মধ্যে একটা সমন্বয় প্রয়োজন। এটা কিভাবে সম্ভব- তা নির্ধারণ করতে হবে রাজনীতিবিদদেরই। এখানে অনেকেই আমাকে বলেছেন, শেষ মুহূর্তে হয়তো একটা সমঝোতা হবে। কেননা আওয়ামী লীগ ভালো করেই জানে বিএনপিকে বাদ দিয়ে যে নির্বাচন, সে নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। আর আওয়ামী লীগ যদি সত্যি সত্যিই বিএনপিকে বাদ দিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যায়, তাহলে তা দলটির অস্তিত্বকেও একটা হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারে। অনেকেই বিশ্বাস করেন, যাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে উপদেশ দিচ্ছেন, তাঁরা তাঁকে সঠিক উপদেশটি দিচ্ছেন না। দলের ভেতরে কট্টরপন্থীদের দ্বারা তিনি বেশি মাত্রায় প্রভাবান্বিত। এক সময় যাঁরা মস্কোপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁরা বেশি মাত্রায় দলের নীতি-নির্ধারণীতে প্রভাব ফেলেছেন, এমন কথাও অনেকের মুখ থেকে শুনেছি। তাঁদের 'ভুলের' কারণে দলকে আজ এ পরিস্থিতি বরণ করতে হয়েছে।
সর্বশেষ গাজীপুর নির্বাচন সরকারকে একটি 'সিগন্যাল' দিয়েছে- এ থেকে সরকার কতটুকু শিখবে, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু সরকারের কঠোর অবস্থান বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে যে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। ক্যাপিটল হিলে বাংলাদেশ একটি আলোচিত নাম। বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছে। গার্মেন্টে শ্রমমান, হাজার শ্রমিকের মৃত্যু, সুশাসনের অভাব, র‌্যাবের মানবতাবিরোধী অপরাধ, শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়া, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি, শেয়ারবাজার, ড. ইউনূস ইত্যাদি কারণে ক্যাপিটল হিলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি খুব উজ্জ্বল নয়। এখন যদি আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচন করে, সেটাও দেশটির ভাবমূর্তির জন্য কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না। দাতা সংস্থা ও দেশগুলোর সাহায্য প্রতিশ্রুতিও ঝুঁকির মুখে থাকবে। তাই পরাজয়ের একটা ঝুঁকির মুখে থাকলেও আওয়ামী লীগ তথা সরকারকে 'সব দলের অংশগ্রহণের' একটি নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এতে বরং আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হবে। প্রবাসীরা চান, দেশে একটা স্থিতিশীলতা বিরাজ করুক। সুশাসন নিশ্চিত হোক। জনগণ তাদের অধিকার প্রয়োগ করুক। সিলেট থেকে সর্বশেষ গাজীপুর, সাধারণ জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমনটিই ঘটুক- এটাই প্রত্যাশা প্রবাসীদের।
দৈনিক কালের কন্ঠ১৮ জুলাই, ২০১৩ ০১:১৭:২১

মিশরের মতো সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা বাংলাদেশে নেই

আজকালের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে ড. তারেক শামসুর রেহমান

কাউসার মুমিন: ড. তারেক শামসুর রেহমান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক। অধ্যাপনার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীর একজন বস্তুনিষ্ট কলামিস্ট এবং টেলিভিশন টকশো আলোচক হিসেবেও সুপরিচিত তিনি। রাষ্ট্র বিজ্ঞানের সর্বশেষ বিষয়-আশয়, রাজনৈতিক উত্তরণ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা, অপ্রচলিত নিরাপত্তা, পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষণ এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি তার আলোচনা ও আগ্রহের বিষয়। এক সময় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সদস্য হিসেবেও দায়িত্বপালন করেছেন তিনি। সমকালীন আন্তর্জাতিক রাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষক ড. তারেক বর্তমানে তাঁর যুক্তরাষ্ট্র সফর উপলক্ষে নিউইয়র্ক অবস্থান করছেন। গত মঙ্গলবার তিনি সাপ্তাহিক আজকাল অফিসে এলে তাঁর সাথে সমকালীন পরিস্থিতি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়। আলোচনায় ড. তারেক জোর দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক
উত্তরণের স্বার্থে সরকারী দলকে অবশ্যই নির্বাচন পদ্ধতি বিষয়ে বিরোধী দলের সাথে আলোচনায় বসতে হবে। এ ছাড়া তিনি আরও মনে করেন, সাম্প্রতিক সময়ের মিশরের মতো বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনা হস্তক্ষেপের কোনো সম্ভাবনা নেই। ড. তারেক শামসুর রেহমানের সাথে আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো আজকালের পাঠকদের উদ্দেশ্যে এখানে তুলে ধরা হলো:Ñ
প্রশ্ন: আপনি আন্তর্জাতিক বিষয়ের একজন শিক্ষাবিদ। আপনার সাথে আলোচনা প্রথমেই একটু একাডেমিক বিষয় দিয়ে শুরু করবো। জাতীয়তাবাদ গণতন্ত্রের জন্য আসলেই কতটা সহায়ক? অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলে থাকেন, জাতীয়তাবাদ প্রায়শই ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয়। এমনকি আজকের বিশ্বের অনেক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মূলে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির চর্চা ও বিকাশকে দায়ী করে থাকেন কেউ কেউ। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্য বা উপাদানগুলো সম্পর্কে আপনার নিকট জানতে চাই।
ড. তারেক শামসুর রেহমান: প্রথমত আজকের বিশ্বের অনেক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মূলে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির চর্চা দায়ী এ মতের সাথে আমি একমত নই। জাতীয়তাবাদ থেকে ফ্যসিবাদের জন্ম হয় এই কথা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আংশিক সত্য হলেও তা ইউনিভার্সাল নয়। বরং জাতীয়তাবাদ আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম অনুসঙ্গ। জাতীয়তাবোধ থেকেই জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি। কোনো নির্দিষ্ট ভুখন্ডের মানুষ যখন ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় মূল্যবোধ, ইতিহাস ঐতিহ্য এবং আকাক্সক্ষার দিক থেকে পারস্পরিক নৈকট্য ও একাত্মতাবোধ করে তখনই তাদের মধ্যে একটি জাতীয়তাবোধের জন্ম নেয়। এভাবেই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদও বাংলাদেশ নামক ভুখন্ডের সকল মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় মূল্যবোধ, ইতিহাস ঐতিহ্য এবং আকাক্সক্ষার প্রতিফলন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ একটি ইনক্লুসিভ আইডিয়া -এখানে সকল ভাষা ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের বিশ্বাস, ঐতিহ্য ও আকাক্সক্ষাকে ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশের বেশীরভাগ মানুষের ধর্ম ইসলাম তাই ইসলাম ধর্ম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের অন্যতম গুরত্বপূর্ণ উপাদান। পাশাপাশি অন্যান্য ধর্ম বর্ণ ভাষা ও সংস্কৃতির সমচর্চা, বিকাশ ও সুরক্ষার নিশ্চয়তা রয়েছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে।
বাঙালী জাতীয়তাবাদ সমগ্র বাংলাদেশকে ধারণ করে না। শুধুমাত্র ভাষাভিত্তিক এই জাতীয়তাবাদ একটি সংকীর্ণ আইডিয়ার (এই ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার) উপর দাঁড়িয়ে, জাতীয়তাবোধের সবগুলো উপাদান এখানে অনুপস্থিত। বাংলাদেশের সকল ভাষা সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব বাঙালী জাতীয়তাবাদে নেই। বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষীরাও বাংলাদেশের বাংলাভাষীদের সাথে মিলে একটি জাতি। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালীরা বাংলা ভাষায় কথা বললেও তাদের ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, আকাক্সক্ষা আলাদা। এই যেমন ধরুন কবি নজরুলের চর্চার দিকটি যদি খেয়েল করেন তবে দেখবেন পশ্চিমবঙ্গ শুধু নজরুলের হিন্দু সংস্কৃতির লেখাগুলো পাঠ করে চর্চা করে, কিন্তু আমরা এখানে বাংলাদেশে সমগ্র নজরুলক চর্চা করি, তাঁর হিন্দু মুসলিম সংস্কৃতির সকল সৃষ্টি নির্বিশেষে আমরা তাঁকে ধারণ করি, কিন্তু সংস্কৃতিগত কারণেই পশ্চিমবঙ্গে সেটা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের মতো তাদের একটি স্বাধীন ভুখন্ড নেই, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত কোনো ঐতিহ্য তাদের নেই, তারা বাংলাদেশের মতো একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের আকাক্সক্ষা করেননি। সুতরাং তারা জাতীয়তাবোধের দিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা একটি জাতি। বাঙালী জাতীয়তাবাদের সাথে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূল পার্থক্য হলো প্রথমটি শুধু মাত্র ভাষাভিত্তিক, আর দ্বিতীয়টি জাতীয়তাবোধের সকল উপাদানকে ধারণ করে। এছাড়া বাংলাদেশের বেশীরভাগ মানুষের ধর্মবিশ্বাস ইসলাম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রধান উপাদান। তবে হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রীস্টান নির্বিশেষে সকল ধর্ম বর্ণ ও সংস্কৃতির চর্চার মাধ্যমেই আমরা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে এগিয়ে নিয়ে গেছি। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ কখনো ধর্মীয় উগ্রবাদকে প্রশ্রয় দেয় না।
প্রশ্ন: প্রেসিডেন্ট জিয়ার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারণা বর্তমান বিএনপির রাজনীতিতে কতটা প্রতিফলিত হচ্ছে বলে আপনি মনে করেন? অনেক রাষ্ট্র বিজ্ঞানী বলছেন, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ক্রমশ ইসলামের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আপনি কি মনে করেন যে বর্তমান বিএনপি প্রেসিডেন্ট জিয়ার জাতীয়তাবাদী আদর্শকে সম্পূর্ণভাবে ধারণ করতে পারছে?
ড. তারেক শামসুর রেহমান: প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো যে, না, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ক্রমশ ইসলামের দিকে ধাবিত হচ্ছে না। আমি আগেই বলেছি, ইসলাম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের একটি অন্যতম প্রধান উপাদান। বাংলাদেশের বেশীরভাগ মানুষের ধর্ম ইসলাম, আপনি নিজে ধর্ম পালন করেন কি না বা মসজিদে যান কি না, সেটা অন্য বিষয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাজনীতির স্বার্থে বেশীরভাগ মানুষের বিশ্বাসের প্রতিফলন রাষ্ট্রনীতিতে ঘটতে হবে। আর প্রেসিডেন্ট জিয়ার জাতীয়তাবাদী রাজনীতি থেকে বর্তমান বিএনপি সরে এসেছে বলেও আমি মনে করি না। জিয়ার জাতীয়তাবাদী রাজনীতির শুরু আজ থেকে অনেক বছর আগে। ইতিমধ্যে বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপট অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু বিএনপি এখনো জিয়ার আদর্শে অটুট আছে বলে আমি মনে করি। অতি সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী ইসলামিক রিভাইভালিজমের প্রভাব কিছুটা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উপর পড়েছে। এটা সময়ের প্রয়োজনে ঘটেছে, যুগের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে বিএনপিকেও সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। কিন্তু একে আমি কিছুতেই জিয়ার জাতীয়তাবাদী আদর্শ থেকে সরে আসা বলে মনে করি না। এটি বিএনপির আদর্শগত পরিবর্তন নয়, বরং কৌশলগত পদক্ষেপ বলে আমি মনে করি।
প্রশ্ন: গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধর্মের ভূমিকা কি হওয়া উচিত? গণতন্ত্র ও ধর্ম একসাথে চলতে পারে কি? বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে ইসলামপন্থী দলগুলোর ভূমিকা নিয়ে কিছু বলুন। বাংলাদেশে উগ্রপন্থী ইসলাম উত্থানের সম্ভাবনা কতটুকু?
ড. তারেক শামসুর রেহমান: গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধর্মের ভূমিকা ইতিবাচক। ধর্ম ও গণতন্ত্র পরস্পরের পরিপূরক। আধুনিক গনতন্ত্রের সুতিকাগার ইউরোপের রাজনীতিতে ধর্মের অবস্থান সুস্পষ্ট। জার্মানীতে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি নামে রাজনৈতিক দল রয়েছে। প্রায় সমগ্র ইউরোপেই ক্রিশ্চিয়ান নাম দিয়ে রাজনৈতিক দলের নাম রয়েছে, তার গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করছে। এ বিষয়ে বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, সুইডেনের উদাহরণ আমি দিতে পারি। তবে তারা নিজ ধর্মকে যেমন সম্মান করে, তেমনি অন্যের ধর্মের চর্চার অধিকারের সুরক্ষা দেয়। এরা ধর্ম বিষয়ে কখনো কট্টর নয়, ধর্ম চর্চা বিষয়ে জোর প্রয়োগ করে না, কখনো বলে না যে প্রতি রোববার আপনাকে চার্চে যেতেই হবে। কিন্তু তারপরও ধর্মের নামে ইউরোপের রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলের নামকরণ করেছে। সুতরাং বলা যায় বিগত দুশ বছর যাবত গণতন্ত্র চর্চাকারী ইউরোপের রাজনীতিতে ধর্ম একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং রাজনীতিতে অবশ্যই ধর্মের প্রযোজনীয়তা বা অবস্থান আছে এবং থাকা উচিত।
সুতরাং বাংলাদেশের মতো সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমানের দেশে রাজনীতিতে ধর্মের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে না। বরং ধর্ম বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চর্চার একটি অন্যতম উপাদান। গণতন্ত্র বিকাশে, গণতান্ত্রিক উত্তরণে ধর্মীয় রাজনৈতিক দল এবং মানুষের ধর্মবিশ্বাস সম্পুরক ভূমিকা পালন করছে। শুধু বাংলাদেশ নয় এখানে আমরা ইন্দোনেশিয়া, তিউনিশিয়া এবং মিশরের কথাও বলতে পারি। এই দেশগুলোর প্রত্যেকটিতেই দেশের সাধারণ জনগণ ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোট দিয়েছে। মিশরের বেলায় ধর্মীয় রাজনৈতিক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করছিলো। যদিও এখন সেনাবাহিনী সেখানে হস্তক্ষেপ করেছে কিন্তু সেটা ভিন্ন প্রেক্ষাপট। অর্থাত, আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হলো, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশগুলোতে এই যে গণতান্ত্রিক উত্তরণ সেখানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোরও ভূমিকা রয়েছে। সুতরাং ধর্ম ও গণতন্ত্র একসাথে চলতে পারে এবং তারা পরস্পরের পরিপূরক।
প্রশ্ন: একটু আগে আপনি মিশরের রাজনীতিতে ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের ভূমিকার কথা বলছিলেন। আমরা জানি ইতিমধ্যেই সেনাবহিনী দেশটির নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র এই সেনা হস্তক্ষেপকে ক্যু বলতে নারাজ। মিশরের বর্তমান পরিস্থিতিতে আপনার পর্যবেক্ষণ কি? বাংলাদেশের রাজনীতিতে মিশরের মতো অবস্থার কোনো আশংকা আছে কি?
ড. তারেক শামসুর রেহমান: মিশরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে খুব সরলভাবে দেখার সুযোগ নেই। এর সাথে মিশরের জাতীয় রাজনীতি, এ অঞ্চলের আঞ্চলিক রাজনীতি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্বশক্তিগুলোর জাতীয় স্বাথর্কেও মিলিয়ে দেখতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের ৫ ম নৌবহর এ অঞ্চলে (বাহরাইনে) অবস্থিত। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই চাইবে না এ অঞ্চলে তার স্বার্থবিরোধী কোনো শক্তি ক্ষমতায় আসুক। এ ছাড়াও মিশরের প্রেসিডেন্ট হিসেবে মুরসীর বেশকিছু ভুল সিদ্ধান্ত মিশরের রাজনীতিকে ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়েছে। আধুনিক মিশরের ৬০ বছরের সেক্যুলার রাষ্ট্রব্যবস্থায় দেশটির সমাজ কাঠামোতে সেক্যুলার শক্তির অবস্থান অনেক শক্তিশালী হয়েছে। মুরসী তা হিসেব করতে ভুল করেছেন। তিনি খুব দ্রুত ইসলামের শাসন ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চেয়েছেন। ইসলামী শরীয়ার বেশ কিছু আইন বাস্তবায়ন ঘোষণার আগে আরও সময় নিতে পারতেন তিনি। এ ছাড়া এ বিষয়ে একটি জাতীয় সমঝোতার দিকেও যেতে পারতেন তিনি। বিশেষ করে ক্ষমতা ভাগাভাগি করার বিষয়ে মুরসীর নেতিবাচক অবস্থান অগণতান্ত্রিক ছিলো। এখানে আমি মুরসীর চেয়ে ব্রাদারহুড দলের নেতৃবৃন্দকেই বেশী দোষ দেবো। তারা মুরসীকে সামনে রেখে মিশরে ক্ষুব দ্রুত ইসলামী শরীয়া আইন বাস্তবায়নের দিকে মনোযোগী ছিলেন।
আর বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবার ওয়ান-ইলেভেন কিংবা মিশরের মতো সেনা হস্তক্ষেপের কোনো আশংকা নেই। কেননা বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং মিশরের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সম্প্রতি বিভিন্ন নামে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির চর্চা দেখা গেলেও বাস্তবে জাতীয় সংসদে তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। ভোটাভুটির রাজনীতিতে তাদের নিজস্ব কোনো বড় দলও নেই। তারা দুটি বিরোধী বড় রাজনৈতিক দলকে ভোট দিয়ে থাকে। হিসেব করলে দেখা যাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামপন্থীদের ভোট ৩-৪ শতাংশের মতো। সুতরাং ইসলামপন্থীরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো ফ্যাক্টর নয় এবং বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদ মাথাছাড়া দিয়ে উঠার কোনো সুযোগও নেই। তবে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সিটি কর্পরেশনগুলোর নির্বাচনী ফলাফলের রায়ে জনগণ দেখিয়ে দিয়েছে যে বর্তমান সরকার অনুসৃত নীতিমালার প্রতি তাদের কোনো সমর্থন নেই। তাই গণতন্ত্রের স্বার্থে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের উচিত নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে বিরোধী দলের সাথে আলোচন অপূর্বক একটি সমঝোতায় আসা। নইলে নির্বাচনাকালীন রাজনৈতিক সংকট আবারও দেখা দিতে পারে এবং বিশ্ববাসীর নিকট একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ইমেজ আমরা হারাতে পারি।

বর্তমানে যা গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাড়িয়েছে

আসল কথাটি বলে ফেলেছেন মনমোহন সিং, ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, রাহুল গান্ধীই ভারতের প্রধানমন্ত্রী। রাহুল গান্ধী কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর বড় সন্তান ও কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক। রাহুল গান্ধী প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সন্তান। ভারতে রাহুল গান্ধীকে নিয়ে বিতর্ক অনেক দিনের। মনমোহন সিং একাধিকার তাকে মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানালেও সেই আমন্ত্রণ তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। এখন মনমোহন সিংয়ের ঘোষণার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, কংগ্রেস বা ইউপিএ জোট যদি আগামীতে সরকার গঠন করতে পারে, তাহলে রাহুল গান্ধীই হবেন সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী। ২০১৪ সালে সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।

ভারতের রাজনীতিতে নেহরু পরিবার যে ধারা সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন তারই ধারাবাহিকতায় এখন রাহুল গান্ধীর জন্য ‘ক্ষেত্র’ প্রস্তুত হচ্ছে। এই পরিবারের মূল ব্যক্তি ছিলেন মতিলাল নেহরু, যিনি ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর দাদা। মতিলাল অসহযোগ আন্দোলনের সময় ১৯২১ সালে কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার বড় সন্তান জওহর লাল নেহরু কংগ্রেসের সভাপতি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন (১৯৪৭-১৯৬৪)। জওহর লাল নেহরু জীবদ্দশায় কন্যা ইন্ধিরা গান্ধীকে কংগ্রেসের সভানেত্রী বানিয়েছিলেন ১৯৬৪ সালে। নেহরু মন্ত্রিসভায় তিনি মন্ত্রীও ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী তার নিজ দেহরক্ষীদের হাতে নিহত হলে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে হয়েছিল ইন্দিরার বড় সন্দান রাজীব গান্ধীকে (১৯৮৪-১৯৯১)। তবে ইন্দিরা গান্ধী দ্বিতীয়বার ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার আগে কংগ্রেসের বাইরে মোরারজি দেশাই (১৯৭৭-৭৯), চরন সিং (১৯৭৯-৮০) ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। নেহরু পরিবার ১৯৯১ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন ছিল। এরপর নেহরু পরিবার আর প্রধানমন্ত্রীর পদ পায়নি। এতদিন পর সম্ভবত রাহুল গান্ধীই হতে যাচ্ছেন ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী! যদিও এখন অবদি মন্ত্রী পদে তার অভিষেক হয়নি। উপমহাদেশে এটা রাজনৈতিক সংস্কৃতি। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সন্তানরা রাজনীতিতে আসেন এবং এক সময় প্রধানমন্ত্রী হন। পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের কন্যা কুলসুমের রাজনীতিতে অভিষেক ঘটেছে। বাংলাদেশে অনেক আগেই তারেক রহমানের রাজনীতিতে অভিষেক হয়েছে। তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। অতি সম্প্রতি তাকে নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে।
তারেক জিয়া প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বড় সন্তান। মা বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপার্সন। পারিবারিক রাজনীতির ধারাই তাকে রাজনীতিতে টেনে নিয়ে এসেছে। যেমনি এনেছিল শেখ হাসিনাকে। আমরা ভারতে নেহরু-গান্ধী পরিবারের দৃষ্টান্ত দিয়েছি। পাকিস্তানে ভুট্টো পরিবারের কথা বলি। পারিবারিক রাজনীতির ধারায় তারা রাজনীতিতে এসেছেন। কিন্তু আমরা কি জানি ভারতে এই পারিবারিক রাজনীতির ধারা শুধু নেহরু-গান্ধী পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। ভারতে এ ধরনের বেশকিছু পরিবারের জন্ম হয়েছে, যারা পারিবারিক রাজনীতির ধারা অনুসরণ করে রাজনীতি করে যাচ্ছেন। প্রাচীন ভারতীয় একটি শ্লোক হচ্ছে Vasudua Kutumbikam। এর ইংরেজি করা হয়েছে এভাবে ‘all the universe is a family। অর্থাৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই হচ্ছে একটি পরিবার। রাজনীতিতে পারিবারিকরণের পেছনে ভারতে এই সংস্কৃতির শ্লোকটি আদর্শ হিসেবে কাজ করে। তাই ভারতে রাজনীতিতে পারিবারিকরণের বিষয়টি স্বাভাবিক একটি বিষয়। কেউ এটা নিয়ে কথাও বলে না। প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় এসব রাজনীতি পরিবারের সন্তানরা উচ্চশিক্ষিত, বিদেশ থেকে ডিগ্রিধারী। এই তরুণ প্রজšে§র কারণেই ভারত অর্থনীতিতে জাপানকেও অতিক্রম করল। কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিই। এক সময় ভারতে সীমিত সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী ছিলেন চরন সিং। তার ছেলে অজিত সিং এখন বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করছে। দেবগৌড়াও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তার ছেলে এখন কর্নাটক রাজ্যর মুখ্যমন্ত্রী। সারদ পাওয়ার ভারতের কৃষিমন্ত্রী। তার মেয়ে সুপ্রিয়া সুলে এখন সংসদ সদস্য। মন্ত্রী ফারুক আব্দুল্লাহর ছেলে ওমর আবদুল্লাহ এখন কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী। তার জামাই শচীন পাইলট রাহুল গান্ধীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শচীনের বাবা রাজেশ পাইলটকে রাজীব গান্ধী রাজনীতিতে নিয়ে এসেছিলেন। বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ মুলায়ম সিং যাদবের ছেলে অখিলেশ যাদব এখন এমপি এবং ভবিষ্যৎ উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। তামিলনাড়–তে করুণানিধি পরিবার রাজনীতিতে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। ৮২ বছর বয়সেও তিনি মুখ্যমন্ত্রী। ছেলে স্ট্যালিন উপ-মুখ্যমন্ত্রী। আরেক ছেলে আজহাগিরি কেন্দ্রে কোয়ালিশনের কোটায় মন্ত্রী। ভাইয়ের ছেলে দয়ানিধ মারানও কেন্দ্রের মন্ত্রী। স্ত্রী ও মেয়ে কানিমাধা রাজনীতিতে সক্রিয় ও এমপি। পাঞ্জাবে বাদল পরিবার, বিহারে যাদব পরিবার, মধ্য প্রদেশে পাওয়ার পরিবার, অন্ধ্র প্রদেশে রেড্ডি পরিবার যুগের পর যুগ রাজ্য রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এক সময়ের দক্ষিণের ছবির নায়ক বামারাও সেখানকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। স্ত্রী, উপপতিœ আর সন্তানরা এক ধরনের প্রভাব বলয় তৈরি করেছেন সেখানে। অনেকটা কর্পোরেট হাউসের মতো তারা রাজ্য চালান। আরো দৃষ্টান্ত দেয়া যায়। মনিপুরের পিএ সংমার মেয়ে অগাথা সাংমা মাত্র ৩০ বছর হওয়ার আগই কেন্দ্রের মন্ত্রী। রাজস্থানে সিন্ধিয়া রাজপরিবার আবার বিভক্ত। রাজমাতা সিন্ধিয়া করেন বিজেপি। ছেলে মাধব রাও কংগ্রেস সদস্য। বোন বসুন্ধরা রাজে রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী (বিজেপি)। সাবেক মন্ত্রী (দলিত) জগজীবন রামের মেয়ে মিরা কুমারী এখন লোকসভার স্পিকার। উড়িষ্যাতে পাটনায়েক পরিবার ছাড়া অন্য কিছু চিন্তা করাও যায় না। তার নিজের নামেই এখন একটি দল। রাজনীতিতে পারিবারিকরণ ভারতীয় গণতন্ত্রের একটি অন্যতম দিক।
শুধুই কি পাক-ভারত-বাংলাদেশেই এই রাজনীতি! ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট কোরাজান আকিন্যের ছেলে সে দেশের প্রেসিডেন্ট এখন। ২৩ জন সিনেটারের মধ্যে ১৫ জন এসেছেন পারিবারিক ধারায়। আফ্রিকার দেশ এঙ্গোলার প্রেসিডেন্ট জোসে এদোয়র্দো ডস সানটস (১৯৭৯ সাল থেকে) এর কাজিন ফানানদো দা পিদাদে দায়াসা ডস সানটস সে দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট। মেয়ে ইসাবেল সানটস এঙ্গোলার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি এবং মন্ত্রী। আর্জেন্টিনার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট নেসতার কিরচনার (২০০৩-২০০৭) স্ত্রী ক্রিস্টিনা কিরচনার এখন সে দেশের প্রেসিডেন্ট। সেনা কর্মকর্তা ইয়ান পেরেন (১৯৪৬-৫৫, ১৯৭৩-৭৪) প্রেসিডেন্ট হয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় তার স্ত্রী মারিয়া পেরেনও প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন (১৯৭৪-৭৬)। আজারবাইজানে (হায়দার আলিয়েভের ছেলে ইলহাম আলিয়েভ), বতসোয়ানায় (সেরেটসের খামা ও স্ত্রী রুথ খামা এবং ছেলে ইয়ান খামা), মিয়ানমারে (অং সান-এর মেয়ে অং সান সুকি), কঙ্গোতে (ল’রা কাবিলা ও তার ছেলে জোসেফ কাবিলা), জায়ারের (সেসে সেকো মবুতুর ছেলে নাজাঙ্গা মবুতু) দৃষ্টান্তও আমরা দিতে পারি। এই তালিকা আরো বাড়ানো যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও (বুশ পরিবার) এই প্রবণতা রয়ে গেছে। সুতরাং তারেক রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে আসবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। এই ধারাবাহিকতায় প্রধামন্ত্রীর পুত্র ও বঙ্গবন্ধুর নাতি সজীব ওয়াজেদ জয়ও রাজনীতিতে আসবেন, সেটা আজ অথবা কাল। রাজনীতিতে তাকে আসতে হবেই। তবে যত দ্রুত তিনি রাজনীতিতে আসবেন, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। জয় ইতোমধ্যে রংপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত হয়েছেন। প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণ করেছেন। তবে সক্রিয় নন। ধারণা করছি আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে আমরা তাকে সক্রিয় হতে দেখব। অন্যদিকে তারেক রহমান অনেক আগেই সক্রিয় হয়েছেন। জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনি গ্রাম থেকে গ্রামে গেছেন, যেটা এক সময় তার বাবা শহীদ জিয়া করতেন। রাজনীতিতে থাকলে অভিযোগ উঠবেই। তার বিরুদ্ধেও উঠেছে। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ২০টি, যার মধ্যে রয়েছে সিঙ্গাপুরে ২০ কোটি টাকার বেশি অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অভিযোগ, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা ইত্যাদি। তার মধ্যে আয়কর ফাঁকির অভিযোগও রয়েছে। এর মাঝে কতগুলোর সত্যতা রয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সরকার মামলাগুলো সক্রিয় করেছে। শিগগিরই শুনানির তালিকায় মামলাগুলো দেখা যাবে। আর বিএনপির ভাষ্য হচ্ছে, ‘সরকারের এ ধরনের উদ্যোগ তারেক রহমানকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার জন্যই। সরকার এভাবে দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’ লন্ডনে তারেক রহমানের একটি বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক মন্ত্রী যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন তাতে করে বিএনপির ভাষ্যকেই সত্য বলে ধরে নিতে পারেন অনেকে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তারেক রহমান মন্ত্রী বা এমপি ছিলেন না। তিনি ‘ক্ষমতাবান’ ছিলেন এটা সত্য। যদি তিনি অন্যায় করে থাকেন, অবশ্যই আইন তা দেখবে। কিন্তু যেভাবে এবং যে ভাষায় তাকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখা হয়েছিল তা অশোভন ও রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত। রাজনীতিবিদদের মধ্যে ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত। আমরা যদি অপর পক্ষকে সম্মান জানাতে না পারি, তাহলে নিজেও সম্মান পাব না। রাজনীতিবিদদের মধ্যে আস্থা, বিশ্বাস ও সৌহার্দ্য না থাকলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হবে না। গণতন্ত্রকে আমরা উচ্চতর পর্যায়েও নিয়ে যেতে পারব না।
একুশ শতকে এসে এই পারিবারিক রাজনীতির ধারা আমরা অস্বীকার করতে পারব না। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে পারিবারিক রাজনীতির ধারা গণতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নেহরু ভারতকে গোটা বিশ্বের কাছে পরিচিত করেছিলেন। সুকর্নো ছিলেন জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা, যা ইন্দোনেশিয়াকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে চিনত বাংলাদেশ। আর জিয়াউর রহমান মুসলিম বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিলেন নতুন এক বাংলাদেশকে। তাই পারিবারিক রাজনীতি নিয়ে যারাই প্রশ্ন তোলেন, তারা ভুল করেন। এই পারিবারিক রাজনীতি বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা কিংবা নেপালের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অংশ। এটাকে উপেক্ষা করা যাবে না। বাংলাদেশে যে তরুণ নেতৃত্ব একুশ শতকে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে তা আসবে এই পারিবারিক রাজনীতির কাছ থেকেই। এখন শুধু অপেক্ষার পালা।

জিএসপি: দেশের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের প্রশ্ন

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুটো ঘটনার কথা উল্লেখ করতে পারি, যাতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। প্রথমটি. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেস (জিএসপি) সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্ত আর দ্বিতীয়টি জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনকে লিখিত এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের একটি চিঠি; যেখানে কমিশন স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশের পুলিশ ‘নির্যাতনবান্ধব’ ও ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’। দুটি ঘটনাই বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্টের জন্য যথেষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা স্থগিত করায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না এটা সত্য, কিন্তু যা চিন্তার কারণ তা হচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নও একই পথ অবলম্বন করতে পারে। এমনিতেই বাংলাদেশের গার্মেন্টশিল্প নানা ধরনের প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখন যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা স্থগিত করার অর্থ— আগামীতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধার দাবিটি একটি বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ল। তৈরি পোশাকে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগ পায় না। এ নিয়ে দীর্ঘদিন বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে আসছিল। ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের একটা বাজার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে তথাকথিত ৫ হাজার পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগ দিলেও এর মধ্যে খুব কম আইটেমই বাংলাদেশ সরবরাহ করে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে যে ৫০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য, তাতে মাত্র এক শতাংশ শুল্কমুক্তের সুবিধা নেয় বাংলাদেশ। সুতরাং জিএসপি সুবিধা বাতিল হলেও বাংলাদেশ তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কিন্তু বহির্বিশ্বে বিভিন্ন দেশে একটা ভুল বার্তা পৌঁছে দিতে পারে এটি। আর এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের চিঠিও আমাদের জন্য একটি খারাপ সংবাদ। এতে করে আমাদের ভাবমূর্তি ঝুঁকির মুখে থাকল। আমাদের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি নিয়ে কতটুকু ভাবেন আমি জানি না, কিন্তু আমাদের জন্য এগুলো খারাপ খবর। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের উষ্ণতা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। বেশকিছু ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। দুর্নীতির ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন অ্যাকাউন্ট থেকে কোনো সাহায্য পাচ্ছে না। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন না হওয়ার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন খুব ভালো চোখে দেখেনি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যু। ড. ইউনূসের সঙ্গে সরকার যে ‘ব্যবহার’ করেছে, তাতে মার্কিন প্রশাসনের অনেকেই খুশি হতে পারেননি। এর সঙ্গে অতিসম্প্রতি যোগ হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংককে ‘ভেঙে ফেলা’র একটি উদ্যোগ। এসব ক্ষেত্রে মার্কিন কংগ্রেসের আইন প্রণেতাদের মধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে এক বিরূপ ধারণার জন্ম হয়েছে। জন কেরির বাংলাদেশে না আসা এর একটি অন্যতম কারণ। গত ২৫ জুন এই সফর নির্ধারিত থাকলেও শেষ মুহূর্তে তা বাতিল করা হয়। তিন দিনের সফরে জন কেরি ভারতে এসেছিলেন ২৩ জুন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে এটি একটা ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত হতে বাধ্য। জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন ছিল, তা নিতে নীতিনির্ধারকরা ব্যর্থ হয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আমাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এক্ষেত্রে আমাদের নীতিনির্ধারকরা আরো একটু যতœবান হলে ভালো করতেন। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশ সফর ভালোবাসেন। এখন তার ঘন ঘন বিদেশ সফরের মধ্য দিয়ে জাতীয় স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হয়েছে, তা শুধু আগামীতে বলা সম্ভব। শুধু শুধু বিদেশ সফরের মধ্য দিয়ে জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হবে না। জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত খাতগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে এবং সে অনুযায়ী পররাষ্টনীতি পরিচালনা করতে হবে। মাত্র ৫ ঘণ্টার নিউইয়র্ক সফর করে মন্ত্রী তার নামের সুবিচার করতে পারেননি। একুশ শতকে বাংলাদেশের লক্ষ্য কী, অর্জন কী, ‘সফট পাওয়ার’ হিসেবে বাংলাদেশ কীভাবে তার পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করবে— এসবের কোনো দিকনির্দেশনা নেই আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে। ভারতের সঙ্গে আমাদের বেশকিছু বিষয় ঝুলে আছে। এ ব্যাপারে সরকারের ভূমিকা যথেষ্ট নয়। তিস্তা চুক্তি নিয়ে যে ধ্রুম্রজাল, তার অবসান হয়নি। আমাদের স্বার্থে তিস্তা চুক্তি অত্যন্ত প্রয়োজন। কিন্তু পশ্চিম বঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে এ চুক্তিটি এখন পর্যন্ত হচ্ছে না। চুক্তিটি না হওয়ার কারণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরই ঝুলে গেল। আগামী সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লি যাওয়ার কথা। বাস্তবতা হচ্ছে, তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। আগামীতে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন। এরপর ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচন। এক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জি তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টিকে তার স্বার্থে ব্যবহার করবেন। তাকে উপেক্ষা করে কেন্দ্র কোনো চুক্তি করতে পারবে না। দ্বিতীয়ত. মমতা এখন আর কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোটে নেই। ফলে কেন্দ্র তার ওপর কোনো প্রভাব খাটাতে পারবে না। তৃতীয়ত. তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাইরে আরো একটি পক্ষ আছে। আর তা হচ্ছে সিকিম। সিকিম হয়ে ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ার্সের সমভূমি দিয়ে চিলাহাটি থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলায় উত্তর খড়িবাড়ির কাছে ডিমলা উপজেলার ছাতনাই দিয়ে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। সিকিম মূল প্রবাহে ছোট ছোট বাঁধ দিয়ে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সিকিম তিস্তার উজানে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। দীর্ঘ দুই যুগেও তিস্তা নদীর পানির হিস্যা না পাওয়ায় প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পটি এখন অকার্যকর হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তিস্তা চুক্তিটির গুরুত্ব অনেক বেশি। এটা এখন ঝুলে গেল। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও অস্পষ্টতা আছে। ভারত বারবার বলছে, তারা টিপাইমুখে এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। কিন্তু সংবাদপত্রে (ভারতীয়) প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ভারত এ প্রকল্প নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। খোদ মণিপুরেই প্রস্তাবিত এই বাঁধের ব্যাপারে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। টিপাইমুখ হাইড্রোইলেকট্রিক প্রজেক্টে যে হাইড্যাম নির্মিত হবে, তাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা হবে ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। এটি নির্মিত হওয়ার কথা বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষে আসামের করিমগঞ্জে বরাক নদের ওপর। প্রস্তাবিত টিপাইমুখ হাইড্যামের অবস্থান বাংলাদেশের সীমানার খুবই কাছে। ফলে এ থেকে সৃষ্ট সব ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া বা প্রভাব যেমন— নদীগর্ভে অতিরিক্ত বালুর সঞ্চালন ও সঞ্চয়ন, হঠাৎ বন্যা, অতিবন্যা ইত্যাদির প্রভাব সম্পূর্ণটাই পড়বে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে সম্পূর্ণ হাওর জনপদের ওপর। আনুমানিক ১০-১৫ বছরের মধ্যে এ অঞ্চলের হাওর, বিল-ঝিল, বাঁওড়, নদী-নালা বালুতে প্রায় ভরে যাবে। যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি)-এর সভা না হওয়ায় বাংলাদেশ টিপাইমুখ নিয়ে আলোচনার সুযোগ হারাল।
বাংলাদেশ তার বন্ধুকে সম্মান জানাতে জানে। মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য ভারতীয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় সম্মানে সম্মানিত করেছিল। কিন্তু ভারত বাংলাদেশের ব্যাপারে আরো একটু উদার হতে পারত। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ব্যাপারে যেসব জটিলতা রয়েছে, সেসব জটিলতা কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারে ভারতের কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ লক্ষ করা যায় না। ভারতের রাষ্ট্রপতির ঢাকা সফরের সময় সীমান্ত হত্যা বন্ধ হবে বলে তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু সে আশ্বাস পুরো রক্ষিত হয়নি। ছিটমহল নিয়ে সমস্যা, আজো রয়ে গেছে। বর্তমান বাংলাদেশের ভূখণ্ডে আছে ১৭ হাজার ১৪৯ একর ভারতীয় ভূমি।
আর ভারতের ভূখণ্ডে রয়েছে ৭ হাজার ১১১ একর বাংলাদেশের ভূমি। এসব অঞ্চলের মানুষ এক মানবেতর জীবনযাপন করছে। ভারত বড় দেশ। আগামী ৩০ বছরের মধ্যে ভারতের অর্থনীতি হবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। সঙ্গত কারণেই ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন থেকে আমরাও উপকৃত হতে পারি। এজন্য প্রয়োজন ভারতের উদার মনোভাব। ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য ভারতের অনুকূলে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি দিনে দিনে বাড়ছেই। অশুল্ক বাধা দূর করার প্রতিশ্রুতিও রক্ষিত হয়নি। ভারত-বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহের পর খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ কোনো ট্রানজিট সুবিধা পায়নি। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির একটা কথা বলা হয়েছিল। সেখানেও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।
জিএসপি সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্তটি যখন পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে, ঠিক তখনই ছাপা হয়েছিল (২৭ জুন) খবরটি— এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনকে একটি চিঠিতে উল্লেখ করেছে যে, বাংলাদেশের পুলিশ ‘নির্যাতনবান্ধব’ ও ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’। কমিশনের ওয়েবসাইটে এ চিঠিটি প্রকাশ করা হয়েছে। কমিশনের অভিযোগ, দেশের সংবিধান ও আইনে সুস্পষ্টভাবে মানবাধিকার ও নাগরিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতার বিষয়টি উল্লেখ থাকার পরও ব্যাপকভাবে নির্যাতন চালানোর চর্চা রয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর। কমিশনের ভাষ্য, পুলিশ ও নির্যাতন এখন সমার্থক হয়ে উঠেছে। ক্ষমতাসীন দলও বিরোধীদের দমনে পুলিশকে ব্যবহার করছে। চিঠিতে আরো বলা হয়, পুলিশ বাহিনীতে ঘুষ নেয়ার প্রবণতাও প্রচণ্ড। প্রায় সবার কাছ থেকেই ঘুষ নেয় পুলিশ। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের ওই চিঠিতে বাংলাদেশ পুলিশ প্রশাসনের সংস্কারের জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। অনেকেই স্বীকার করবেন, সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ বিরোধী দলের নেতা ও কর্মীদের দমনে বেপরোয়া আচরণের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। প্রকাশ্যে বিএনপির জনসভা ভেঙে দেয়া, সিনিয়র নেতাদের গুলিতে আহত করা, হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের ওপর রাতের আঁধারে গুলি করে হত্যা করার ঘটনা পুলিশ তথা নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকাকে সামনে নিয়ে এসেছে। এ ঘটনা আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দিত হয়েছে। একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসারের এক কোটি টাকা ঘুষ নেয়ার ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও পুলিশ প্রশাসন তাকে শুধু বদলি করেছে মাত্র। তাকে চাকরিচ্যুত করেনি। আজ বিষয়টি জাতিসংঘের নজরে আনল এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন। এসব ঘটনায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আজ কোথায় গিয়ে ঠেকল, তা সহজেই অনুমেয়। সুতরাং বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। আগামীতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও একটি বড় প্রশ্ন আছে। প্রধান বিরোধী দল যদি নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আবারো নষ্ট হবে। আমাদের নীতিনির্ধারকরা কোনো বিষয়কেই গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন না। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতিকে তারা হালকাভাবে নিয়েছেন। ঠিক তেমনি রানা প্লাজার ঘটনাটিকেও খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন, তা মনে হয় না। শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চমহল থেকে বলা হলেও সরকার খুব একটা ‘গা’ করেনি। আজো হত্যাকারীদের খুঁজে বের করা যায়নি। গার্মেন্টশিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার, শ্রম মান বাড়ানো, কমপ্লায়েন্স বাধ্যতামূলক করা— এসব ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ আশাপ্রদ নয়। তাই জিএসপি সুবিধা স্থগিত হলো। এখন দেখতে হবে সরকার এরপর কী ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে নিঃসন্দেহে জিএসপি সুবিধা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য একটি ‘ওয়েক-আপ কল’।

বনিকবার্তা ১৩ জুলাই ২০১৩ 

দোষারোপের রাজনীতি গনতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত

২৯ জুন জাতীয় সংসদে দুই নেত্রীর ভাষণের মধ্য দিয়ে দোষারোপের সেই রাজনীতির আবার পুনরাবৃত্তি ঘটল। আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের যেখানে বাকি আছে মাত্র পাঁচ থেকে ছ’মাস, সেখানে দোষারোপের এই রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসতে পারলেন না দুই নেত্রীও। আমরা এরই মধ্যে ৪২ বছর পার করে এসেছি। সময়টা একেবারে কম নয়। কিন্তু পরস্পরকে আক্রমণ করে বক্তব্য দেয়া ও নিজের সাফাই গাওয়ার যে রাজনীতি, তা থেকে বের হয়ে আসতে পারলেন না দুই নেত্রী। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে আগামী দিনের জন্য যে দিকনির্দেশনা থাকা উচিত ছিল, তা আমরা পাইনি। বরং প্রায় প্রতিটি লাইনে তিনি বিএনপির সমালোচনা করেছেন আপত্তিকর ভাষায়। তিনি অবশ্যই তার সরকারের অবস্থানকে সমর্থন করবেন। কিন্তু বাস্তবতা অস্বীকার করে নয় নিশ্চয়ই? বাস্তবতাই বলে, এই সরকারের বেশ কিছু ব্যর্থতা রয়েছে। এই ব্যর্থতা যদি প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে স্বীকার করতেন, তাতে কোনো ক্ষতি ছিল না। বরং আমার বিবেচনায় তাতে সরকারের অবস্থান আরও শক্তিশালী হতো। বিদেশে প্রতিটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে আমরা এটা প্রত্যক্ষ করি। সেখানে সরকারের ব্যর্থতা চেপে রাখা যায় না। মিডিয়া, গণমাধ্যম সেখানে যথেষ্ট শক্তিশালী। তাই সরকারপ্রধান কোনো কিছু লুকাতে পারেন না। সব ক্ষেত্রেই সরকারের ব্যর্থতা বেশি, এটা আমি বলব না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য তো আছেই।

খাদ্যঘাটতি নেই। সাধারণ মানুষ না খেয়ে থাকছে না। যে কারণে খাদ্য আমদানির শঙ্কায় আমরা থাকছি না। যদিও খাদ্য উৎপাদনের মূল কৃতিত্ব আমাদের কৃষকদের। তাদের কীভাবে আরও উৎসাহিত করা যায়, এটা দেখার দায়িত্ব অবশ্য সরকারের। বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর কৃষকবান্ধব অনেক নীতি গ্রহণ করতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সিদ্ধান্ত তার। এটা কৃষকদের উৎসাহিত করেছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগীরা এখনও তৎপর। কৃষকরা উৎপাদিত পণ্যের প্রকৃত দাম পাচ্ছেন নাÑ এ ধরনের অভিযোগ আছে। এটি দেখার ও মনিটরিং করার দায়িত্ব সরকারের। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর এর কৃতিত্ব নিতেই পারেন। কিন্তু পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি, হলমার্ক, ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের দুর্নীতি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, ছাত্রলীগের তা-বÑ এসব ‘ঘটনা’ সরকারের বড় অর্জনের পথে ছিল প্রধান অন্তরায়। পদ্মা সেতু নিয়ে যা ঘটল, তার ব্যাখ্যা প্রধানমন্ত্রী যেভাবেই দিন না কেন, বিদেশে এ ঘটনায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট বিনষ্ট হয়েছে। পদ্মা সেতুতে কোনো দুর্নীতি হয়নি, এ ধরনের বক্তব্য কী সত্যের অপলাপ নয়? যদি আদৌ ‘কিছু’ না হয়ে থাকে, তাহলে বিশ্বব্যাংক কেন এত কঠোর হলো, কেন তদন্ত করল, কেনই বা কানাডায় মামলা হলো? আমরা তা অস্বীকার করতেই পারি। কিন্তু বাস্তবতা কিন্তু তা বলে না। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে হলমার্ক-ডেসটিনির অনিয়মের কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু মানুষ প্রত্যাশা করে, যারাই এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। একজন ব্যাংক উপ-মহাব্যবস্থাপকের পক্ষে হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়া সম্ভব নয়। সুতরাং প্রভাবশালী যারাই নেপথ্যে থেকে এই ‘কমিটি’ করেছেন, তাদের শাস্তি হোক।

প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই বিদেশের গণতান্ত্রিক সমাজের কথা বলেন। কিন্তু ইউরোপের কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে কী এ ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারিতে অপরাধীরা পার পেয়ে যেতে পারেন? ব্রিটেনে ক্ষমতাসীন এক মন্ত্রীকে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করায় জরিমানা দিতে হয়েছিল। জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর (প্রধানমন্ত্রী, তিন-তিনবার) হেলমুট কোহল ঘুষ গ্রহণ করার অপরাধে অপরাধী স্বাব্যস্ত হওয়ায় দলের কর্তৃত্ব হারিয়েছিলেন। আমরা বাংলাদেশে কী এ ধরনের ঘটনা চিন্তাও করতে পারি?

প্রধানমন্ত্রী ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন, মাগুরা উপ-নির্বাচনের কথা বলেছেন। এটা মিথ্যা নয়। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে ভোলায় উপ-নির্বাচনে কী হয়েছিল, তার সাক্ষী সংবাদপত্রগুলো। আসলে এই সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসা প্রয়োজন, যা আমরা পারছি না। প্রধানমন্ত্রী শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে দুই ব্যক্তির যোগসাজশের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, ওই দুই ব্যক্তি যদি সত্যি সত্যিই জড়িত থাকনে, তাহলে সরকার তাদের গ্রেফতার করছে না কেন? একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। ওই রিপোর্টে যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছিল, তাদের কী আইনের আওতায় আনা হয়েছিল? আর যদি আইনের আওতায় আনা না হয়, তাহলে আমরা বিদেশের গণতন্ত্রের দৃষ্টান্ত দিতে পারব কী? বিদেশে যেভাবে নির্বাচন হয়, সেভাবেই নির্বাচন হবেÑ এটাই প্রত্যাশিত। প্রধানমন্ত্রী মিথ্যা বলেননি। কিন্তু বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তার সঙ্গে কী আমরা বিদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কোনো মিল খুঁজে পাব? আমাদের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, তা পৃথিবীর কোনো সংবিধানে এভাবে দেয়া হয়নি। এখানে প্রধানমন্ত্রীর কথাই আইন।

আমি জানি না, প্রধানমন্ত্রী এটা স্বীকার করবেন কিনা যে, বাংলাদেশ এক কঠিন সময় পার করছে। সমঝোতা যেখানে প্রয়োজন, সেখানে সমঝোতা একটি কৃষ্ণগহ্বরে পতিত হয়েছে। আর দশম নির্বাচনকে ঘিরে যদি কোনো সমঝোতা না হয়, তাহলে আমরা নিশ্চিতভাবেই ‘১৫ ফেব্রুয়ারি’ প্রত্যক্ষ করব! সরকার এককভাবেই নির্বাচন করবে, যা সঙ্কটকে আরও গভীরতর করবে।

সংসদে ২৯ ফেব্রুয়ারি বিরোধীদলীয় নেতা যে বক্তব্য রেখেছেন, সে ব্যাপারেও কিছু কথা বলা প্রয়োজন। বেগম জিয়া সংবিধানে নির্দলীয় সরকার বিধান সংযোজন করা, সংলাপ আহ্বান করা, ড. ইউনূসকে অসম্মানিত করা, জাতীয় নেতাদের সম্মান দেয়া, সাগর-রুনী হত্যাকা-, ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। বাজেট নিয়েও তিনি মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, উচ্চ সুদের হার, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি, চাঁদাবাজি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বিনিয়োগে পরিস্থিতিকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। তিনি হেফাজতে ইসলামের প্রসঙ্গও টেনেছেন। তুলনামূলক বিচারে শেখ হাসিনা যতটা আক্রমণাত্মক ছিলেন, বেগম জিয়া ততটা আক্রমণাত্মক ছিলেন না। কিন্তু আমরা যারা আমজনতা, আমাদের কাছে দুই নেত্রীর ভাষণের মধ্য দিয়ে কোনো সমাধান বা দিকনির্দেশনার পথ আমরা খুঁজে পাইনি।

প্রথমত, বাজেট বাস্তবায়নে যেসব সমস্যার সম্মুখীন আমরা হব, তার সমাধান কীভাবে হবে, তার কোনো দিকনির্দেশনা নেই। সরকার যে প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা বলেছে, বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া সেই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে না। অর্থমন্ত্রীর মুখের কথায় প্রবৃদ্ধির টার্গেট অর্জিত হবে না। এর জন্য দরকার বিনিয়োগকারীদের আস্থা, শিল্পোৎপাদন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। যার কোনো একটিও এই মুহূর্তে নেই। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত হয়ে যাওয়ার ফলে আমাদের রফতানি খাত যে শুধু বাধাগ্রস্ত হবে তা নয়, বরং বাংলাদেশ বড় ধরনের ভাবমূর্তির সঙ্কটে পড়েছে। এই ভাবমূর্তি কীভাবে আমরা ফিরিয়ে আনব, তার কোনো দিকনির্দেশনা নেই। শুধু শুধু বিএনপিকে দায়ী করে, দোষারোপের রাজনীতিটা আরও প্রলম্বিত হবে মাত্র, তাতে কাজের কাজ হবে না। সরকার জনৈক মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি কমিটি করেছে মাত্র। তাতে কতটুকু কাজ হবে, আমি নিশ্চিত নই। এটা জাতীয় ইস্যু। প্রয়োজনে জাপাসহ বিএনপির প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত ছিল। সরকারের ‘একলা চল নীতি’ এই সঙ্কট থেকে বাংলাদেশকে কতটুকু বের করে আনতে পারবে, সেটাই দেখার বিষয়। তৃতীয়ত, ড. ইউনূসকে নিয়ে সরকারপ্রধান আবার বিষোদ্গার করেছেন। এই বিষয়টি নিয়ে যত কম কথা বলা যায়, ততই সরকারের জন্য মঙ্গল। কিন্তু বারে বারে ড. ইউনূস তথা গ্রামীণ ব্যাংক প্রসঙ্গ আসছে। আমরা ভুলে যাই, সারা বিশ্বের মানুষ ড. ইউনূসকে চেনে। তাকে দিয়ে বাংলাদেশের পরিচিতি ব্যাপক। অথচ তিনি নিজ বাসভূমেই বারে বারে অসম্মানিত হয়েছেন। অতি সম্প্রতি ড. ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘ইউএস কংগ্রেসনাল অ্যাওয়ার্ড’-এ ভূষিত হয়েছেন। এটা আমাদের গর্বের। কিন্তু আমরা বিষয়টি ভুলে যাই। চতুর্থত, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনটা হবে কীভাবে? সরকারপ্রধান ভালো করেই জানেন, তিনি যতই বিদেশের দৃষ্টান্ত দিন না কেন, একটি নির্দলীয় সরকার ছাড়া বিএনপি এবং সম্ভবত জাতীয় পার্টিকেও নির্বাচনে আনা সম্ভব হবে না। তাহলে তিনি যখন ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের সমালোচনা করেন (যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ এই সংসদ নির্বাচন বয়কট করেছিল), তখন কি তিনি নিজেই আরেকটি ‘১৫ ফেব্রুয়ারির’ মতো নির্বাচনের জন্ম দিতে যাচ্ছেন না? অনির্বাচিত কাউকে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান করা যাবে নাÑ প্রধানমন্ত্রীর এই উক্তিকে সমর্থন করেও একজন নির্বাচিত ব্যক্তিকে প্রধান করে একটি সরকার গঠন করা যায়। প্রয়োজন শুধু আন্তরিকতার। আমরা সামনে তাকাতে চাই। পেছনে নয়। কিন্তু শেখ হাসিনা এখনও আওয়ামী লীগের প্রধান। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে গেলে (অন্তর্র্বতীকালীন), নির্বাচন যে সুষ্ঠু হবে, তার গ্যারান্টি তিনি নিজেও দিতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রীর ওপর আজ নির্ভর করে সবকিছু। ইতিহাস তাকে কীভাবে স্মরণ করবে, তা শুধু ইতিহাসই জানাতে পারবে। আমরা শুধু প্রত্যাশা করব, একটা সমঝোতা হোক।

দোষারোপের এই রাজনীতি আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অন্যতম একটা বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এভাবে বিরোধী দলের ওপর আক্রমণ, বিশেষ করে ব্যক্তি পর্যায়ে আক্রমণ হয় কিনা, তা আমার জানা নেই। বিরোধী দলের ওপর আক্রমণ হতে হবে রাজনৈতিক। রাজনৈতিকভাবেই তাদের সমালোচনা করতে হবে। আমাদের দুঃখ এটাই যে, স্বাধীনতার ৪২ বছর পার করার পরও আমাদের শুনতে হয়Ñ ‘বিরোধী দল বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাতে চায়।’ পাকিস্তান আজ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। পাকিস্তান এই মুহূর্তে আমাদের জন্য কোনো মডেল নয়। বিরোধী দল এ দেশটিকে ‘পাকিস্তান বানাবে’, শুনতেও খারাপ লাগে। কিন্তু বাস্তবতা এটাই যে, দোষারোপের যে রাজনীতি, তা আমাদের আজ এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা যতই পরস্পর পরস্পরকে অভিযুক্ত করব, ততই সঙ্কট ঘনীভূত হবে। সঙ্কটের মাত্রা বাড়বে। আমাদের জাতীয় নেতারা এ কথাটা যদি উপলব্ধি করে থাকেন, তাহলেই তা আমাদের জন্য মঙ্গল।
আলোকিত বাংলাদেশ ১০ জুলাই ২০১৩