নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস যেন মিনি বাংলাদেশ। বাংলাদেশী দোকান, বাংলা পত্রিকা, বিকিকিনির ভাষাÑ তাও বাংলা। বাংলাদেশের রাষ্ট্র গঠনে যারা অবদান রেখে গেছেন, তারা কী কোনোদিন চিন্তা করেছিলেন, একদিন নিউইয়র্কের এ এলাকায় বাংলা ভাষায় দোকানের নাম লেখা থাকবে। তারা কী চিন্তা করেছিলেন, এখান থেকে বাংলা পত্রিকা বের হবে। আজকাল পত্রিকা কিংবা মুক্তধারার ব্যানার দেখে আমার মনে হয়েছে, সেদিন বোধ হয় আর বেশি দূরে নয়, যে দিন বাংলা ভাষা চীনা ভাষার মতোই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে। তবে চীনাদের সঙ্গে বাংলাদেশীদের, এমনকি পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের পার্থক্য এখানেই যে, তারা তাদের নিজ দেশ নিয়ে তেমন একটা চিন্তা করেন না। তাদের ধ্যান-ধারণা ‘নিজ দেশ’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়েই।
বাংলাদেশীরা এ থেকে অনেক এগিয়ে আছে। বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের রাজনীতি তাদের নিত্যদিনের চর্চার একটা অংশ। যেখানেই গেছি, সেখানেই প্রশ্ন একটাইÑ বাংলাদেশের রাজনীতি কোন পথে যাচ্ছে? গাজীপুরে আওয়ামী লীগ যে হারল, তার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? আবার কী ‘ওয়ান-ইলেভেন’ আসবে? কিংবা মিসরের মতো পরিস্থিতি কী বাংলাদেশ বরণ করবে?
নিউইয়র্ক শহরে বাংলাদেশীদের সংখ্যা অনেক। অনেকে অনেক শক্ত কাজ করেন। ভোর ৬টায় যখন নিউইয়র্ক শহর ঘুমিয়ে থাকে, সবাই কাজে যান। তাই দুপুরে কারও বাসায় যদি ফোন করেন, তাকে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। যোগাযোগের মাধ্যম ওই মোবাইল। ল্যান্ডফোন মানুষ খুব একটা ব্যবহার করে না। কিন্তু বিকাল বেলা কিংবা সন্ধ্যে বেলায় ছুটে যান জ্যাকসন হাইটসে। আড্ডা দেন। গল্প করেন। একটা পত্রিকা কিনে বাড়ি ফিরে যান। নিউইয়র্কের এই বাংলাদেশী সমাজে রাজনীতি, তাও আবার দেশীয় রাজনীতির আলোচনাটা বেশি। সাপ্তাহিক আজকাল আমার যে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করল, তাতেও প্রধান্য পেয়েছে এই রাজনীতি। রাতে ফোন করেও হাজারটা প্রশ্ন, এখন কী হবে বাংলাদেশে? অনেকেরই সোজা জবাব আওয়ামী লীগ বড় ধরনের ‘ইমেজ সঙ্কট’-এর মুখে পড়েছে। তাদের অভিমত, দুর্নীতিবাজদের মন্ত্রিসভায় স্থান দেয়া ঠিক হয়নি। দল ও মন্ত্রিসভায় যদি যোগ্য ব্যক্তিদের স্থান দেয়া যেত, তাহলে আজকের পরিস্থিতি এ পর্যায়ে উন্নীত হতো না। অনেকেই মন্ত্রীদের দুর্নীতি, ছাত্রলীগের সন্ত্রাস ও টেন্ডারবাজি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বলেছেন, একটি সভ্য দেশে এসব অকল্পনীয়। অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, প্রধানমন্ত্রী কেন এসব লোকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারলেন না? তাদের প্রায় সবারই ধারণা, বাংলাদেশের একটা বিশাল সম্ভাবনা ছিল। আমাদের রাজনীতিবিদরা বাংলাদেশের সেই সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে যারা বসবাস করেন, তারা সবচেয়ে বেশি আহত হয়েছেন সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি হতে দেখে। তাদের মতে, এতে করে যেসব বাঙালি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এরই মধ্যে বাঙালিদের সম্পর্কে খারাপ একটা ধারণার জন্ম হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশ সরকার ড. ইউনূসের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে, তা করা উচিত হয়নি। ড. ইউনূস বিশ্বব্যাপী পরিচিত ব্যক্তি। তার গ্রামীণ ব্যাংক খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও কোনো কোনো স্টেটে মডেল হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু দেশের স্বার্থে তাকে ব্যবহার না করে দেশেরই ক্ষতি করা হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি যেভাবে চলছে, সেভাবে চলতে দেয়া উচিত নয় বলেও প্রায় সবার অভিমত।
প্রবাসীরা মনে করেন, যেহেতু নির্বাচন সামনে, সেহেতু বিএনপির উচিত হবে নির্বাচনে অংশ নেয়া। নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপিরই ক্ষতিÑ এটাও মনে করেন অনেকে। আর নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হবে, সেটা নিয়েও সরকারের উচিত বিএনপির সঙ্গে কথাবার্তা বলা। জরুরি একটা সংলাপ হওয়া উচিত। না হলে দেশ আরও গভীর সঙ্কটে পড়বে। রাজনীতিবিদরা আরও ‘ম্যাচিওরিটি’র পরিচয় দেবেন, এটাও প্রত্যাশা করেন অনেকে। তবে কোনো অসাংবিধানিক শক্তির ক্ষমতা গ্রহণকেও তারা পছন্দ করছেন না।
মুরসির ক্ষমতাচ্যুতির বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। মিসর আর বাংলাদেশ এক নয়। মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো কট্টর ইসলামপন্থীরা বাংলাদেশে ক্ষমতায় নেই। যারা ক্ষমতায়, তারা অসাম্প্রদায়িক একটি দল। আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র আজকের নয়, বরং অনেক পুরনো। অন্যদিকে বিএনপিকেও একটি ইসলামপন্থী দল হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। ইসলামকে দলটি ধারণ করে বটে। কিন্তু তারা আদৌ কট্টরপন্থী নন। সুতরাং বাংলাদেশের সঙ্গে মিসরের পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে না। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিসরের সেনাবাহিনীরও কোনো তুলনা চলবে না। ১৯৫২ সাল থেকেই সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মিসরের ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। মিসরের অর্থনীতিতে সেখানকার সেনাবাহিনীর বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এই মুহূর্তে ‘টোটাল প্রফেশনাল’। রাজনীতির প্রতি তাদের আদৌ আগ্রহ নেই। তাই মিসরের পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে না।
অনেককেই বলতে শুনেছি, মিসরের সেনাবাহিনীর ভূমিকা বাংলাদেশে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। বলেছি, মিসরের সেনাবাহিনীর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অনেক বেশি। এই সেনা অভ্যুত্থানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের একটা ‘ভূমিকা’ রয়েছে। ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দেয় যুক্তরাষ্ট্র শুধু মিসরের সেনাবাহিনীকেই। সেনাবাহিনীর নিজস্ব একটা অর্থনৈতিক ভিত্তি রয়েছে মিসরে। প্রায় প্রতিটি বড় বড় শিল্পে বিনিয়োগ রয়েছে সেনাবাহিনীর। কোনো সরকারের পক্ষেই এই ‘অর্থনৈতিক ভিত্তি’কে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। ইসরাইলের নিজস্ব স্বার্থ রয়েছে মিসরে। ১৯৭৮ সালে মিসর ও ইসরাইল একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, যার মধ্যে দিয়ে ইসরাইল তার পার্শ্ববর্তী দেশের কাছ থেকে ‘নিরাপত্তা হুমকি’ অনেকটাই ‘শূন্য পর্যায়ে’ নামিয়ে এনেছিল। কিন্তু ইসরাইলবিরোধী মুসলিম ব্রাদারহুডের উন্মাদনা শঙ্কিত করেছিল ইসরাইলকে। তাই একটা সামরিক অভ্যুত্থান সেখানে অবশ্যম্ভাবী ছিল। কোন পথে এখন মিসরÑ এ ব্যাপারে বাংলাদেশীদের অনেক আগ্রহ দেখেছি। জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ এল সিসির ভূমিকাই বা কী হবে এখন? তিনি একটি ‘নির্বাচন’ (২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা) দিয়ে আবার ব্যারাকে ফিরে যাবেন, এটা কেউই বিশ্বাস করেন না। বাস্তবতাও তাই বলে। সাবেক মন্ত্রী ও একজন অর্থনীতিবিদ হাজেম এল দেবলাউই প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এটা তত্ত্বের কথা। অভ্যুত্থানকারীরা তত্ত্বগতভাবেই টেকনোক্রেটদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলেন। মিসরেও তাই হয়েছে।
মিসরের রাজনীতি বাংলাদেশীদের স্পর্শ করেছে। তারা বার বার এমনকি ‘ইফতার মাহফিলে’ও আমাকে প্রশ্ন করেছেন বাংলাদেশের সেনাবাহিনী নিয়ে। বলেছি, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এখন যথেষ্ট ‘প্রফেশনাল’। অনেকেরই প্রশ্ন নির্বাচন কী আদৌ হবে? বলেছি, আওয়ামী লীগ যদি বিএনপিকে বাদ দিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যায়, তাহলে তা দলটির অস্তিত্বকেও একটা হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারে। অনেকেই বিশ্বাস করেন, যারা প্রধানমন্ত্রীকে উপদেশ দিচ্ছেন, তারা তাকে সঠিক উপদেশটি দিচ্ছেন না। দলের ভেতরে কট্টরপন্থীদের দ্বারা তিনি বেশি মাত্রায় প্রভাবান্বিত। এক সময় যারা মস্কোপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তারা বেশি মাত্রায় দলের নীতিনির্ধারণীতে প্রভাব ফেলছেন, এমন কথাও অনেকের মুখ থেকে শুনেছি। তাদের ‘ভুলের’ কারণেই দলকে আজ এ পরিস্থিতি বরণ করতে হয়েছে।
ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণে এসে আওয়ামী লীগ দাঁড়িয়েছে। একদিকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, অন্যদিকে সর্বমহলে নির্বাচনের একটা গ্রহণযোগ্যতাÑ কোন পথে এখন যাবে আওয়ামী লীগ? আওয়ামী লীগ কী এতটুকু নমনীয় হবে? ঈদের পর বড় ধরনের সঙ্কটের মুখে থাকবে দেশ। যুক্তরাষ্ট্রে নীতিনির্ধারকদের কাছে এখন বাংলাদেশ একটি জনপ্রিয় নাম নয়। জিএসপি সুবিধা বাতিল হয়েছে। সিনেটে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ড. ইউনূস ইস্যুতে অসন্তুষ্ট সবাই। তাই সরকারকে তার দূরদর্শিতা প্রমাণ করতে হবে। ওয়াশিংটনে আমাদের দূতাবাসে যারা কাজ করেন, তারা বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু দেখছেনÑ এ প্রশ্নও করেছেন অনেকে। তারা সঠিকভাবে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারছেন নাÑ এমন মন্তব্য প্রায় সবার।
আমাদের একটা বড় দুর্ভাগ্য হচ্ছে, প্রবাসী বাংলাদেশীরা দ্বিধাবিভক্ত। এখানে দলীয় আনুগত্য এত বেশি যে, দলীয় আনুগত্যের কারণে জাতীয় স্বার্থ ম্লান হয়ে গেছে। ভারত এখানে একটা দৃষ্টান্ত। তারা এক। তারা ভারতীয়। তাদের মাঝে অঞ্চল ভিত্তিতে কোনো ঐক্য গড়ে ওঠেনি। যে কারণে ভারতীয় অ্যাসোসিয়েশন বিলিয়ন ডলারের ফান্ড জোগাড় করেছে। এই ফান্ড তারা তাদের জাতীয় স্বার্থে ব্যবহার করে। জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে ক্যাপিটাল হিলে লবিস্ট নিয়োগ করে। মার্কিন সিনেট সদস্য তথা কংগ্রেস সদস্যরা লবিস্ট নিয়োগের কারণে ভারতীয় স্বার্থে কাজ করে। বাংলাদেশীরা দ্বিধাবিভক্ত থাকায়, ঐক্যবদ্ধভাবে কোনো সমিতি গঠিত হয়নি। ফলে ঐক্যবদ্ধভাবে কোনো কর্মসূচিও নিতে পারে না তারা। এখানেই আমাদের বড় ব্যর্থতা। ঐক্যবদ্ধভাবে অনেক কর্মসূচিই নেয়া সম্ভব। কিন্তু আমাদের জাতীয় নেতারা কখনও প্রবাসী বাংলাদেশীদের ঐক্যবদ্ধ করার কোনো উদ্যোগ নেননি। বরং তারা সব সময় দলীয় আনুগত্য ও দলীয় রাজনীতিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন বেশি। তাই ক্যাপিটাল হিলে বাংলাদেশবিরোধী যে একটা জনমত গড়ে উঠেছে, সে ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি বাংলাদেশ। এই ব্যর্থতা সমগ্র বাংলাদেশের।
বাংলাদেশীরা এ থেকে অনেক এগিয়ে আছে। বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের রাজনীতি তাদের নিত্যদিনের চর্চার একটা অংশ। যেখানেই গেছি, সেখানেই প্রশ্ন একটাইÑ বাংলাদেশের রাজনীতি কোন পথে যাচ্ছে? গাজীপুরে আওয়ামী লীগ যে হারল, তার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? আবার কী ‘ওয়ান-ইলেভেন’ আসবে? কিংবা মিসরের মতো পরিস্থিতি কী বাংলাদেশ বরণ করবে?
নিউইয়র্ক শহরে বাংলাদেশীদের সংখ্যা অনেক। অনেকে অনেক শক্ত কাজ করেন। ভোর ৬টায় যখন নিউইয়র্ক শহর ঘুমিয়ে থাকে, সবাই কাজে যান। তাই দুপুরে কারও বাসায় যদি ফোন করেন, তাকে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। যোগাযোগের মাধ্যম ওই মোবাইল। ল্যান্ডফোন মানুষ খুব একটা ব্যবহার করে না। কিন্তু বিকাল বেলা কিংবা সন্ধ্যে বেলায় ছুটে যান জ্যাকসন হাইটসে। আড্ডা দেন। গল্প করেন। একটা পত্রিকা কিনে বাড়ি ফিরে যান। নিউইয়র্কের এই বাংলাদেশী সমাজে রাজনীতি, তাও আবার দেশীয় রাজনীতির আলোচনাটা বেশি। সাপ্তাহিক আজকাল আমার যে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করল, তাতেও প্রধান্য পেয়েছে এই রাজনীতি। রাতে ফোন করেও হাজারটা প্রশ্ন, এখন কী হবে বাংলাদেশে? অনেকেরই সোজা জবাব আওয়ামী লীগ বড় ধরনের ‘ইমেজ সঙ্কট’-এর মুখে পড়েছে। তাদের অভিমত, দুর্নীতিবাজদের মন্ত্রিসভায় স্থান দেয়া ঠিক হয়নি। দল ও মন্ত্রিসভায় যদি যোগ্য ব্যক্তিদের স্থান দেয়া যেত, তাহলে আজকের পরিস্থিতি এ পর্যায়ে উন্নীত হতো না। অনেকেই মন্ত্রীদের দুর্নীতি, ছাত্রলীগের সন্ত্রাস ও টেন্ডারবাজি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বলেছেন, একটি সভ্য দেশে এসব অকল্পনীয়। অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, প্রধানমন্ত্রী কেন এসব লোকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারলেন না? তাদের প্রায় সবারই ধারণা, বাংলাদেশের একটা বিশাল সম্ভাবনা ছিল। আমাদের রাজনীতিবিদরা বাংলাদেশের সেই সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে যারা বসবাস করেন, তারা সবচেয়ে বেশি আহত হয়েছেন সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি হতে দেখে। তাদের মতে, এতে করে যেসব বাঙালি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এরই মধ্যে বাঙালিদের সম্পর্কে খারাপ একটা ধারণার জন্ম হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশ সরকার ড. ইউনূসের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে, তা করা উচিত হয়নি। ড. ইউনূস বিশ্বব্যাপী পরিচিত ব্যক্তি। তার গ্রামীণ ব্যাংক খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও কোনো কোনো স্টেটে মডেল হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু দেশের স্বার্থে তাকে ব্যবহার না করে দেশেরই ক্ষতি করা হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি যেভাবে চলছে, সেভাবে চলতে দেয়া উচিত নয় বলেও প্রায় সবার অভিমত।
প্রবাসীরা মনে করেন, যেহেতু নির্বাচন সামনে, সেহেতু বিএনপির উচিত হবে নির্বাচনে অংশ নেয়া। নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপিরই ক্ষতিÑ এটাও মনে করেন অনেকে। আর নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হবে, সেটা নিয়েও সরকারের উচিত বিএনপির সঙ্গে কথাবার্তা বলা। জরুরি একটা সংলাপ হওয়া উচিত। না হলে দেশ আরও গভীর সঙ্কটে পড়বে। রাজনীতিবিদরা আরও ‘ম্যাচিওরিটি’র পরিচয় দেবেন, এটাও প্রত্যাশা করেন অনেকে। তবে কোনো অসাংবিধানিক শক্তির ক্ষমতা গ্রহণকেও তারা পছন্দ করছেন না।
মুরসির ক্ষমতাচ্যুতির বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। মিসর আর বাংলাদেশ এক নয়। মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো কট্টর ইসলামপন্থীরা বাংলাদেশে ক্ষমতায় নেই। যারা ক্ষমতায়, তারা অসাম্প্রদায়িক একটি দল। আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র আজকের নয়, বরং অনেক পুরনো। অন্যদিকে বিএনপিকেও একটি ইসলামপন্থী দল হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। ইসলামকে দলটি ধারণ করে বটে। কিন্তু তারা আদৌ কট্টরপন্থী নন। সুতরাং বাংলাদেশের সঙ্গে মিসরের পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে না। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিসরের সেনাবাহিনীরও কোনো তুলনা চলবে না। ১৯৫২ সাল থেকেই সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মিসরের ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। মিসরের অর্থনীতিতে সেখানকার সেনাবাহিনীর বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এই মুহূর্তে ‘টোটাল প্রফেশনাল’। রাজনীতির প্রতি তাদের আদৌ আগ্রহ নেই। তাই মিসরের পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে না।
অনেককেই বলতে শুনেছি, মিসরের সেনাবাহিনীর ভূমিকা বাংলাদেশে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। বলেছি, মিসরের সেনাবাহিনীর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অনেক বেশি। এই সেনা অভ্যুত্থানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের একটা ‘ভূমিকা’ রয়েছে। ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দেয় যুক্তরাষ্ট্র শুধু মিসরের সেনাবাহিনীকেই। সেনাবাহিনীর নিজস্ব একটা অর্থনৈতিক ভিত্তি রয়েছে মিসরে। প্রায় প্রতিটি বড় বড় শিল্পে বিনিয়োগ রয়েছে সেনাবাহিনীর। কোনো সরকারের পক্ষেই এই ‘অর্থনৈতিক ভিত্তি’কে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। ইসরাইলের নিজস্ব স্বার্থ রয়েছে মিসরে। ১৯৭৮ সালে মিসর ও ইসরাইল একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, যার মধ্যে দিয়ে ইসরাইল তার পার্শ্ববর্তী দেশের কাছ থেকে ‘নিরাপত্তা হুমকি’ অনেকটাই ‘শূন্য পর্যায়ে’ নামিয়ে এনেছিল। কিন্তু ইসরাইলবিরোধী মুসলিম ব্রাদারহুডের উন্মাদনা শঙ্কিত করেছিল ইসরাইলকে। তাই একটা সামরিক অভ্যুত্থান সেখানে অবশ্যম্ভাবী ছিল। কোন পথে এখন মিসরÑ এ ব্যাপারে বাংলাদেশীদের অনেক আগ্রহ দেখেছি। জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ এল সিসির ভূমিকাই বা কী হবে এখন? তিনি একটি ‘নির্বাচন’ (২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা) দিয়ে আবার ব্যারাকে ফিরে যাবেন, এটা কেউই বিশ্বাস করেন না। বাস্তবতাও তাই বলে। সাবেক মন্ত্রী ও একজন অর্থনীতিবিদ হাজেম এল দেবলাউই প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এটা তত্ত্বের কথা। অভ্যুত্থানকারীরা তত্ত্বগতভাবেই টেকনোক্রেটদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলেন। মিসরেও তাই হয়েছে।
মিসরের রাজনীতি বাংলাদেশীদের স্পর্শ করেছে। তারা বার বার এমনকি ‘ইফতার মাহফিলে’ও আমাকে প্রশ্ন করেছেন বাংলাদেশের সেনাবাহিনী নিয়ে। বলেছি, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এখন যথেষ্ট ‘প্রফেশনাল’। অনেকেরই প্রশ্ন নির্বাচন কী আদৌ হবে? বলেছি, আওয়ামী লীগ যদি বিএনপিকে বাদ দিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যায়, তাহলে তা দলটির অস্তিত্বকেও একটা হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারে। অনেকেই বিশ্বাস করেন, যারা প্রধানমন্ত্রীকে উপদেশ দিচ্ছেন, তারা তাকে সঠিক উপদেশটি দিচ্ছেন না। দলের ভেতরে কট্টরপন্থীদের দ্বারা তিনি বেশি মাত্রায় প্রভাবান্বিত। এক সময় যারা মস্কোপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তারা বেশি মাত্রায় দলের নীতিনির্ধারণীতে প্রভাব ফেলছেন, এমন কথাও অনেকের মুখ থেকে শুনেছি। তাদের ‘ভুলের’ কারণেই দলকে আজ এ পরিস্থিতি বরণ করতে হয়েছে।
ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণে এসে আওয়ামী লীগ দাঁড়িয়েছে। একদিকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, অন্যদিকে সর্বমহলে নির্বাচনের একটা গ্রহণযোগ্যতাÑ কোন পথে এখন যাবে আওয়ামী লীগ? আওয়ামী লীগ কী এতটুকু নমনীয় হবে? ঈদের পর বড় ধরনের সঙ্কটের মুখে থাকবে দেশ। যুক্তরাষ্ট্রে নীতিনির্ধারকদের কাছে এখন বাংলাদেশ একটি জনপ্রিয় নাম নয়। জিএসপি সুবিধা বাতিল হয়েছে। সিনেটে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ড. ইউনূস ইস্যুতে অসন্তুষ্ট সবাই। তাই সরকারকে তার দূরদর্শিতা প্রমাণ করতে হবে। ওয়াশিংটনে আমাদের দূতাবাসে যারা কাজ করেন, তারা বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু দেখছেনÑ এ প্রশ্নও করেছেন অনেকে। তারা সঠিকভাবে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারছেন নাÑ এমন মন্তব্য প্রায় সবার।
আমাদের একটা বড় দুর্ভাগ্য হচ্ছে, প্রবাসী বাংলাদেশীরা দ্বিধাবিভক্ত। এখানে দলীয় আনুগত্য এত বেশি যে, দলীয় আনুগত্যের কারণে জাতীয় স্বার্থ ম্লান হয়ে গেছে। ভারত এখানে একটা দৃষ্টান্ত। তারা এক। তারা ভারতীয়। তাদের মাঝে অঞ্চল ভিত্তিতে কোনো ঐক্য গড়ে ওঠেনি। যে কারণে ভারতীয় অ্যাসোসিয়েশন বিলিয়ন ডলারের ফান্ড জোগাড় করেছে। এই ফান্ড তারা তাদের জাতীয় স্বার্থে ব্যবহার করে। জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে ক্যাপিটাল হিলে লবিস্ট নিয়োগ করে। মার্কিন সিনেট সদস্য তথা কংগ্রেস সদস্যরা লবিস্ট নিয়োগের কারণে ভারতীয় স্বার্থে কাজ করে। বাংলাদেশীরা দ্বিধাবিভক্ত থাকায়, ঐক্যবদ্ধভাবে কোনো সমিতি গঠিত হয়নি। ফলে ঐক্যবদ্ধভাবে কোনো কর্মসূচিও নিতে পারে না তারা। এখানেই আমাদের বড় ব্যর্থতা। ঐক্যবদ্ধভাবে অনেক কর্মসূচিই নেয়া সম্ভব। কিন্তু আমাদের জাতীয় নেতারা কখনও প্রবাসী বাংলাদেশীদের ঐক্যবদ্ধ করার কোনো উদ্যোগ নেননি। বরং তারা সব সময় দলীয় আনুগত্য ও দলীয় রাজনীতিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন বেশি। তাই ক্যাপিটাল হিলে বাংলাদেশবিরোধী যে একটা জনমত গড়ে উঠেছে, সে ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি বাংলাদেশ। এই ব্যর্থতা সমগ্র বাংলাদেশের।
দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ।
২১ জুলাই ২০১৩
0 comments:
Post a Comment