সম্প্রতি
পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, একবার যদি
অসাংবিধানিক শক্তি ক্ষমতায় আসে, তারা ‘রোজ কেয়ামত’ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে।
তারা আর নির্বাচন দেবে না। চার সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে দলের ভরাডুবির
পর প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের কথা বারবার বলছেন। তিনি এমন কথাও বলছেন যে,
অসাংবিধানিক শক্তি ক্ষমতায় এলে তাকে এবং বেগম জিয়া দু’জনকেই গ্রেফতার করবে!
আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান যে ক্ষমতা, যা তিনি সংবিধান থেকে পেয়েছেন,
পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের ক্ষমতা ভোগ করেন না। এজন্য
তাকে দোষ দেয়া যাবে না। ‘মোগল রাজাদের চেয়েও তিনি বেশি ক্ষমতা ভোগ করেন’,
কিংবা ‘সংসদীয় সরকারের নামে চলছে প্রধানমন্ত্রীর সরকার’Ñ এ ধরনের কথা অনেকে
বলেন বটে, কিন্তু তিনি যে ক্ষমতাই ভোগ করে থাকুন না কেন, সংবিধান তাকে সেই
অধিকার দিয়েছে।
তার দলের সংসদ সদস্যরাই তাকে এই অধিকার দিয়েছে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী এনে। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী তিনি হলে সেটাও হবেন সংবিধান বলে।
এখানেই এসে যায় মূল প্রশ্নটি। ২৫ অক্টোবর যদি সংসদ ভেঙে দেয়া হয় (?), নতুন সরকার দায়িত্ব না নেয়া পর্যন্ত তিনিই থাকবেন প্রধানমন্ত্রী। এক্ষেত্রে তিনি ‘রোজ কেয়ামতে’র কথা বলছেন কেন! তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, রাজনৈতিক মনন তাকে যদি বিরোধী দলের সঙ্গে কোনো আপসরফায় যেতে সাহায্য না করে, তাহলে সংবিধান অনুযায়ী তার দল এককভাবেই নির্বাচন করবে! আর এর দায়-দায়িত্ব তাকেই বহন করতে হবে! এক্ষেত্রে অসাংবিধানিক শক্তির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
সেনাবাহিনী এখন যথেষ্ট ‘প্রফেশনাল’। তাদের নেতৃত্ব বারবার বলে আসছেন, তারা সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ। রাজনীতির বিষয়টি দেখভাল করবেন রাজনীতিকরাই। উপরন্তু বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর একটা বৈশ্বিক পরিচয় রয়েছে। অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে তারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়ে বিশ্বে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। দ্বিতীয় আরেকটি ‘এক-এগারো’র জš§ দিয়ে তারা তাদের সেই ভাবমূর্তি নষ্ট করবেন না। তরুণ অফিসারদের মাঝে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এ প্রবণতা তাদের আর্থিক অবস্থানকে অনেক শক্তিশালী করেছে। তাই রাজনীতিতে তারা আর নাক গলাবেন না, এটাই স্বাভাবিক। এটাই বাস্তব।
দেয়ালের লিখন থেকে আমরা কেউ শিখি না। কোন পরিস্থিতিতে সেনানিয়ন্ত্রিত সরকারের আÍপ্রকাশ ঘটেছিল, ইতিহাস তার সাক্ষী। রাজনৈতিক দলগুলো যদি ওই সময়ে ন্যূনতম ইস্যুতে এক হতে পারত, তাহলে সেই পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না। এজন্য কি আমাদের রাজনীতিকরা দায়ী নন? আজ রাজনৈতিক দলগুলোকে এ কথাটা উপলব্ধি করতে হবে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য এই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের ধারণা ভালো। তাতে করে তারা একটা সুযোগ পাবেন, এটা যে তাদের আমলের অবদান ভবিষ্যতে তা তুলে ধরতে। উপরন্তু আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন যদি নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়, সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ তাদের বক্তব্য নিয়ে জনসাধারণের কাছে যাক। জনগণ যদি তা সমর্থন করে, তাহলে তারা আবার ক্ষমতায় ফিরে আসবেন। এতে তো ক্ষতির কিছু নেই।
একমাত্র আওয়ামী লীগ বাদে প্রতিটি দলই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে। এমনকি মহাজোটের অংশীদার জাতীয় পার্টি ও ওয়ার্কার্স পার্টিও চায় একটি নিরপেক্ষ সরকার। এক্ষেত্রে সরকার এ দাবি মেনে না নিলে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। আর প্রধানমন্ত্রী যখন স্পষ্ট করেই বলেন, ‘ওরা ক্ষমতায় এলে আর নির্বাচন দেবে না’, তখন নানা প্রশ্ন এসে ভিড় করে। কেন প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলছেন বারবার? প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। কেননা কোনো অসাংবিধানিক সরকারের পক্ষে এখন আর ক্ষমতা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। তারা চাইলেও পারবেন না। কারণ একদিকে রয়েছে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, অন্যদিকে বিদেশী দাতাগোষ্ঠীর চাপ। মাঝখানে রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। কারও পক্ষেই আর নির্ধারিত সময়ের বাইরে থাকা সম্ভব নয়। ২০০৭ সালের পরিস্থিতির সঙ্গে আজকের পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে না। তবে একজন নির্বাচিত ব্যক্তিও এই নির্বাচন পরিচালনা করতে পারেন। রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা সম্ভব। আর সেজন্য সংলাপটা জরুরি।
জাতির বৃহত্তম স্বার্থেই সরকারপ্রধান একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তিনি ইতিহাসে তার নাম রেখে যেতে পারবেন, যদি তিনি নির্দলীয় সরকারের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত দেন। এই নির্দলীয় সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার হবে না। এর কাঠামোও হবে ভিন্ন। শুধু প্রয়োজন আন্তরিকতার। না হলে দেশ এক চরম সংকটের মুখে পড়বে। এজন্য একটা সমঝোতা প্রয়োজন। বিএনপি নেত্রী স্পষ্ট করেই বলেছেন, দলীয় সরকারের অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে অংশ নেবেন না। জাতীয় পার্টিও অংশ নেবে না বলে মনে হচ্ছে। এর ফলে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার দোহাই দিয়ে চলতি বছরের শেষের দিকে সরকার যদি নির্বাচনের আয়োজন করে, তার পরিণতি তৃতীয় (১৯৮৬), চতুর্থ (১৯৮৮) কিংবা ষষ্ঠ (১৯৯৬) জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো হবে। এর কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। আমাদের মতো একটি গরিব দেশে নির্বাচনের নামে শত শত কোটি টাকা খরচ করা একটি বিলাসিতা মাত্র। তাই আওয়ামী নেতাদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে। একটি ভুল সিদ্ধান্ত দলকে অনেক পেছনে ফেলে দিতে পারে। নানা ধরনের ফাঁদ তৈরি হয়েছে। দেশী ও বিদেশী শক্তি দশম সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নানা ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। প্রতিটি নাগরিককে আজ এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।
নির্বাচন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে জনসাধারণ নিজেদের অধিকার প্রয়োগ করে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করে। আজ সাধারণ মানুষকে সেই সুযোগটি দেয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী যদি সংসদ ভেঙে দেয়ার পরও থেকে যান, তাহলে সরকারের সাজানো মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন দিয়ে নির্বাচন আয়োজন করলে তাতে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। প্রধানমন্ত্রী যে আশংকা প্রকাশ করেছেন, তার কোনো ভিত্তি নেই। অসাংবিধানিক শক্তির পক্ষে আর বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অংশীদার হওয়া সম্ভব নয়। সেনা নেতৃত্ব বারবার বলছেন, তারা সংবিধানের কাছে দায়বদ্ধ। আমাদের এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী সেনাবাহিনীকে যথেষ্ট বিতর্কিত করেছেন। সুতরাং তারা আর কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেবে, এটা আমার মনে হয় না।
তাই উদ্যোগটি নিতে হবে সরকারপ্রধানকেই। তিনিই পারেন একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে।
স্পষ্টতই বাংলাদেশ এক গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। চারটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীদের বিজয় বিএনপি কর্মীদের চাঙ্গা করলেও বিএনপির ভেতরে দুটি মতই আছে। নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে জনমত যেমন রয়েছে, ঠিক তেমনি রয়েছে নির্বাচনে অংশ না নেয়ার পক্ষের মতও। যদিও বর্তমানের সাংবিধানিক কাঠামোয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেয়ার পাল্লাটাই ভারি। কাজেই প্রধানমন্ত্রী যে কথাই বলুন না কেন, বিএনপি নেতাদের মন তাতে গলবে বলে মনে হয় না। দিন যতই যাবে, ততই সংকটের মাত্রা বাড়বে। সেটা দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। একটি বহুপাক্ষিক প্রতিযোগিতার জন্য আওয়ামী লীগকে তৈরি থাকতে হবে। জনগণের মুখোমুখি তাদের দাঁড়াতে হবে, যেমনটি তারা দাঁড়িয়েছিলেন ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম পার্লামেন্ট নির্বাচনে। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা যতই সরকারের সাফল্যের কথা বলুন না কেন, সাধারণ মানুষের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা অনেক হ্রাস পেয়েছে। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র, ডেসটিনি-হলমার্ক কেলেংকারিতে দলীয় লোকদের সংশ্লিষ্টতা, ছাত্রলীগের দৌরাÍ্য, সুশাসনের অভাব মহাজোট সরকারের জনপ্রিয়তাকে উচ্চতায় নিয়ে যায়নি। সাধারণ মানুষের যে আস্থা ছিল, সেই আস্থার প্রতি সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে মহাজোট সরকার। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে যেভাবে আওয়ামী লীগ তাদের পরিকল্পনা নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে গিয়েছিল, ২০১৩ সালে এসে তাদের কাছেই যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রী তো বলে দিয়েছেনই, ‘জনগণ ভোট না দিলে নাই’। তার এই বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণের জন্যই চাই নিরপেক্ষ একটি সরকার।
যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দলের পরাজয়ের পর মন্তব্য করেছিলেন, ‘ওয়েক আপ ফল ফর দি রুলিং পার্টি।’ তিনি এও বলেছিলেন, ‘এ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।’ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও বলেছিলেন, ওই ফলাফল ‘একটি অশনি সংকেত।’ প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের মন্তব্য কি প্রধানমন্ত্রী আদৌ বিবেচনায় নিয়েছেন? ওবায়দুল কাদের বারবারই স্পষ্ট কথা বলেন। একজন ছাত্রনেতা ও পরবর্তীকালে রাজনীতিক হিসেবে তিনি জানেন, তাকে আবার জনতার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। তাই তিনি বিবেকের কাছে স্পষ্ট থাকতে চান। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে সেই ‘ওয়েক আপ’ কলের কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। বিরোধী দলের ওপর দোষারোপ করে তিনি তার বক্তব্য এখনও দিয়ে যাচ্ছেন।
তিনি বাহ্যত নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছেন। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই জেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। কারা প্রার্থী হবেন, তার একটি তালিকাও বোধকরি তিনি ইতিমধ্যে তৈরি করে ফেলেছেন। সংবাদপত্রে বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ ১৫০টি আসনে নতুন প্রার্থী দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের আরেক নীতিনির্ধারকের মুখ থেকেও এ ধরনের কথাবার্তা বলা হচ্ছে। তাই স্পষ্ট করেই বলা যায়, আওয়ামী লীগ নির্বাচনের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দল নির্বাচনে অংশ না নিলেও। তাই প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য দলীয় কর্মীদের উৎসাহিত করলেও সাধারণ মানুষের মঝে এ ধরনের বক্তব্য আদৌ কোনো আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। আসলে সমস্যাটা অসাংবিধানিক শক্তির নয়। সমস্যাটা রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে সরকারি দলের।
তার দলের সংসদ সদস্যরাই তাকে এই অধিকার দিয়েছে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী এনে। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী তিনি হলে সেটাও হবেন সংবিধান বলে।
এখানেই এসে যায় মূল প্রশ্নটি। ২৫ অক্টোবর যদি সংসদ ভেঙে দেয়া হয় (?), নতুন সরকার দায়িত্ব না নেয়া পর্যন্ত তিনিই থাকবেন প্রধানমন্ত্রী। এক্ষেত্রে তিনি ‘রোজ কেয়ামতে’র কথা বলছেন কেন! তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, রাজনৈতিক মনন তাকে যদি বিরোধী দলের সঙ্গে কোনো আপসরফায় যেতে সাহায্য না করে, তাহলে সংবিধান অনুযায়ী তার দল এককভাবেই নির্বাচন করবে! আর এর দায়-দায়িত্ব তাকেই বহন করতে হবে! এক্ষেত্রে অসাংবিধানিক শক্তির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
সেনাবাহিনী এখন যথেষ্ট ‘প্রফেশনাল’। তাদের নেতৃত্ব বারবার বলে আসছেন, তারা সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ। রাজনীতির বিষয়টি দেখভাল করবেন রাজনীতিকরাই। উপরন্তু বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর একটা বৈশ্বিক পরিচয় রয়েছে। অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে তারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়ে বিশ্বে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। দ্বিতীয় আরেকটি ‘এক-এগারো’র জš§ দিয়ে তারা তাদের সেই ভাবমূর্তি নষ্ট করবেন না। তরুণ অফিসারদের মাঝে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এ প্রবণতা তাদের আর্থিক অবস্থানকে অনেক শক্তিশালী করেছে। তাই রাজনীতিতে তারা আর নাক গলাবেন না, এটাই স্বাভাবিক। এটাই বাস্তব।
দেয়ালের লিখন থেকে আমরা কেউ শিখি না। কোন পরিস্থিতিতে সেনানিয়ন্ত্রিত সরকারের আÍপ্রকাশ ঘটেছিল, ইতিহাস তার সাক্ষী। রাজনৈতিক দলগুলো যদি ওই সময়ে ন্যূনতম ইস্যুতে এক হতে পারত, তাহলে সেই পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না। এজন্য কি আমাদের রাজনীতিকরা দায়ী নন? আজ রাজনৈতিক দলগুলোকে এ কথাটা উপলব্ধি করতে হবে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য এই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের ধারণা ভালো। তাতে করে তারা একটা সুযোগ পাবেন, এটা যে তাদের আমলের অবদান ভবিষ্যতে তা তুলে ধরতে। উপরন্তু আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন যদি নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়, সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ তাদের বক্তব্য নিয়ে জনসাধারণের কাছে যাক। জনগণ যদি তা সমর্থন করে, তাহলে তারা আবার ক্ষমতায় ফিরে আসবেন। এতে তো ক্ষতির কিছু নেই।
একমাত্র আওয়ামী লীগ বাদে প্রতিটি দলই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে। এমনকি মহাজোটের অংশীদার জাতীয় পার্টি ও ওয়ার্কার্স পার্টিও চায় একটি নিরপেক্ষ সরকার। এক্ষেত্রে সরকার এ দাবি মেনে না নিলে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। আর প্রধানমন্ত্রী যখন স্পষ্ট করেই বলেন, ‘ওরা ক্ষমতায় এলে আর নির্বাচন দেবে না’, তখন নানা প্রশ্ন এসে ভিড় করে। কেন প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলছেন বারবার? প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। কেননা কোনো অসাংবিধানিক সরকারের পক্ষে এখন আর ক্ষমতা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। তারা চাইলেও পারবেন না। কারণ একদিকে রয়েছে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, অন্যদিকে বিদেশী দাতাগোষ্ঠীর চাপ। মাঝখানে রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। কারও পক্ষেই আর নির্ধারিত সময়ের বাইরে থাকা সম্ভব নয়। ২০০৭ সালের পরিস্থিতির সঙ্গে আজকের পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে না। তবে একজন নির্বাচিত ব্যক্তিও এই নির্বাচন পরিচালনা করতে পারেন। রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা সম্ভব। আর সেজন্য সংলাপটা জরুরি।
জাতির বৃহত্তম স্বার্থেই সরকারপ্রধান একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তিনি ইতিহাসে তার নাম রেখে যেতে পারবেন, যদি তিনি নির্দলীয় সরকারের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত দেন। এই নির্দলীয় সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার হবে না। এর কাঠামোও হবে ভিন্ন। শুধু প্রয়োজন আন্তরিকতার। না হলে দেশ এক চরম সংকটের মুখে পড়বে। এজন্য একটা সমঝোতা প্রয়োজন। বিএনপি নেত্রী স্পষ্ট করেই বলেছেন, দলীয় সরকারের অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে অংশ নেবেন না। জাতীয় পার্টিও অংশ নেবে না বলে মনে হচ্ছে। এর ফলে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার দোহাই দিয়ে চলতি বছরের শেষের দিকে সরকার যদি নির্বাচনের আয়োজন করে, তার পরিণতি তৃতীয় (১৯৮৬), চতুর্থ (১৯৮৮) কিংবা ষষ্ঠ (১৯৯৬) জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো হবে। এর কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। আমাদের মতো একটি গরিব দেশে নির্বাচনের নামে শত শত কোটি টাকা খরচ করা একটি বিলাসিতা মাত্র। তাই আওয়ামী নেতাদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে। একটি ভুল সিদ্ধান্ত দলকে অনেক পেছনে ফেলে দিতে পারে। নানা ধরনের ফাঁদ তৈরি হয়েছে। দেশী ও বিদেশী শক্তি দশম সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নানা ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। প্রতিটি নাগরিককে আজ এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।
নির্বাচন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে জনসাধারণ নিজেদের অধিকার প্রয়োগ করে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করে। আজ সাধারণ মানুষকে সেই সুযোগটি দেয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী যদি সংসদ ভেঙে দেয়ার পরও থেকে যান, তাহলে সরকারের সাজানো মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন দিয়ে নির্বাচন আয়োজন করলে তাতে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। প্রধানমন্ত্রী যে আশংকা প্রকাশ করেছেন, তার কোনো ভিত্তি নেই। অসাংবিধানিক শক্তির পক্ষে আর বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অংশীদার হওয়া সম্ভব নয়। সেনা নেতৃত্ব বারবার বলছেন, তারা সংবিধানের কাছে দায়বদ্ধ। আমাদের এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী সেনাবাহিনীকে যথেষ্ট বিতর্কিত করেছেন। সুতরাং তারা আর কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেবে, এটা আমার মনে হয় না।
তাই উদ্যোগটি নিতে হবে সরকারপ্রধানকেই। তিনিই পারেন একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে।
স্পষ্টতই বাংলাদেশ এক গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। চারটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীদের বিজয় বিএনপি কর্মীদের চাঙ্গা করলেও বিএনপির ভেতরে দুটি মতই আছে। নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে জনমত যেমন রয়েছে, ঠিক তেমনি রয়েছে নির্বাচনে অংশ না নেয়ার পক্ষের মতও। যদিও বর্তমানের সাংবিধানিক কাঠামোয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেয়ার পাল্লাটাই ভারি। কাজেই প্রধানমন্ত্রী যে কথাই বলুন না কেন, বিএনপি নেতাদের মন তাতে গলবে বলে মনে হয় না। দিন যতই যাবে, ততই সংকটের মাত্রা বাড়বে। সেটা দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। একটি বহুপাক্ষিক প্রতিযোগিতার জন্য আওয়ামী লীগকে তৈরি থাকতে হবে। জনগণের মুখোমুখি তাদের দাঁড়াতে হবে, যেমনটি তারা দাঁড়িয়েছিলেন ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম পার্লামেন্ট নির্বাচনে। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা যতই সরকারের সাফল্যের কথা বলুন না কেন, সাধারণ মানুষের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা অনেক হ্রাস পেয়েছে। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র, ডেসটিনি-হলমার্ক কেলেংকারিতে দলীয় লোকদের সংশ্লিষ্টতা, ছাত্রলীগের দৌরাÍ্য, সুশাসনের অভাব মহাজোট সরকারের জনপ্রিয়তাকে উচ্চতায় নিয়ে যায়নি। সাধারণ মানুষের যে আস্থা ছিল, সেই আস্থার প্রতি সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে মহাজোট সরকার। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে যেভাবে আওয়ামী লীগ তাদের পরিকল্পনা নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে গিয়েছিল, ২০১৩ সালে এসে তাদের কাছেই যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রী তো বলে দিয়েছেনই, ‘জনগণ ভোট না দিলে নাই’। তার এই বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণের জন্যই চাই নিরপেক্ষ একটি সরকার।
যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দলের পরাজয়ের পর মন্তব্য করেছিলেন, ‘ওয়েক আপ ফল ফর দি রুলিং পার্টি।’ তিনি এও বলেছিলেন, ‘এ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।’ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও বলেছিলেন, ওই ফলাফল ‘একটি অশনি সংকেত।’ প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের মন্তব্য কি প্রধানমন্ত্রী আদৌ বিবেচনায় নিয়েছেন? ওবায়দুল কাদের বারবারই স্পষ্ট কথা বলেন। একজন ছাত্রনেতা ও পরবর্তীকালে রাজনীতিক হিসেবে তিনি জানেন, তাকে আবার জনতার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। তাই তিনি বিবেকের কাছে স্পষ্ট থাকতে চান। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে সেই ‘ওয়েক আপ’ কলের কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। বিরোধী দলের ওপর দোষারোপ করে তিনি তার বক্তব্য এখনও দিয়ে যাচ্ছেন।
তিনি বাহ্যত নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছেন। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই জেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। কারা প্রার্থী হবেন, তার একটি তালিকাও বোধকরি তিনি ইতিমধ্যে তৈরি করে ফেলেছেন। সংবাদপত্রে বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ ১৫০টি আসনে নতুন প্রার্থী দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের আরেক নীতিনির্ধারকের মুখ থেকেও এ ধরনের কথাবার্তা বলা হচ্ছে। তাই স্পষ্ট করেই বলা যায়, আওয়ামী লীগ নির্বাচনের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দল নির্বাচনে অংশ না নিলেও। তাই প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য দলীয় কর্মীদের উৎসাহিত করলেও সাধারণ মানুষের মঝে এ ধরনের বক্তব্য আদৌ কোনো আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। আসলে সমস্যাটা অসাংবিধানিক শক্তির নয়। সমস্যাটা রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে সরকারি দলের।
Daily JUGANTOR
02.07.13
0 comments:
Post a Comment