02:02
২৯
জুন জাতীয় সংসদে দুই নেত্রীর ভাষণের মধ্য দিয়ে দোষারোপের সেই রাজনীতির
আবার পুনরাবৃত্তি ঘটল। আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের যেখানে বাকি আছে
মাত্র পাঁচ থেকে ছ’মাস, সেখানে দোষারোপের এই রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসতে
পারলেন না দুই নেত্রীও। আমরা এরই মধ্যে ৪২ বছর পার করে এসেছি। সময়টা
একেবারে কম নয়। কিন্তু পরস্পরকে আক্রমণ করে বক্তব্য দেয়া ও নিজের সাফাই
গাওয়ার যে রাজনীতি, তা থেকে বের হয়ে আসতে পারলেন না দুই নেত্রী। এ ক্ষেত্রে
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে আগামী দিনের জন্য যে দিকনির্দেশনা থাকা উচিত ছিল,
তা আমরা পাইনি। বরং প্রায় প্রতিটি লাইনে তিনি বিএনপির সমালোচনা করেছেন
আপত্তিকর ভাষায়। তিনি অবশ্যই তার সরকারের অবস্থানকে সমর্থন করবেন। কিন্তু
বাস্তবতা অস্বীকার করে নয় নিশ্চয়ই? বাস্তবতাই বলে, এই সরকারের বেশ কিছু
ব্যর্থতা রয়েছে। এই ব্যর্থতা যদি প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে স্বীকার
করতেন, তাতে কোনো ক্ষতি ছিল না। বরং আমার বিবেচনায় তাতে সরকারের অবস্থান
আরও শক্তিশালী হতো। বিদেশে প্রতিটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে আমরা এটা
প্রত্যক্ষ করি। সেখানে সরকারের ব্যর্থতা চেপে রাখা যায় না। মিডিয়া,
গণমাধ্যম সেখানে যথেষ্ট শক্তিশালী। তাই সরকারপ্রধান কোনো কিছু লুকাতে পারেন
না। সব ক্ষেত্রেই সরকারের ব্যর্থতা বেশি, এটা আমি বলব না। কিছু কিছু
ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য তো আছেই।
খাদ্যঘাটতি নেই। সাধারণ মানুষ
না খেয়ে থাকছে না। যে কারণে খাদ্য আমদানির শঙ্কায় আমরা থাকছি না। যদিও
খাদ্য উৎপাদনের মূল কৃতিত্ব আমাদের কৃষকদের। তাদের কীভাবে আরও উৎসাহিত করা
যায়, এটা দেখার দায়িত্ব অবশ্য সরকারের। বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর কৃষকবান্ধব
অনেক নীতি গ্রহণ করতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১০ টাকায় ব্যাংক
অ্যাকাউন্ট খোলার সিদ্ধান্ত তার। এটা কৃষকদের উৎসাহিত করেছে নিঃসন্দেহে।
কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগীরা এখনও তৎপর। কৃষকরা উৎপাদিত পণ্যের প্রকৃত দাম
পাচ্ছেন নাÑ এ ধরনের অভিযোগ আছে। এটি দেখার ও মনিটরিং করার দায়িত্ব
সরকারের। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর এর
কৃতিত্ব নিতেই পারেন। কিন্তু পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি, হলমার্ক, ডেসটিনি,
বিসমিল্লাহ গ্রুপের দুর্নীতি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, ছাত্রলীগের তা-বÑ এসব
‘ঘটনা’ সরকারের বড় অর্জনের পথে ছিল প্রধান অন্তরায়। পদ্মা সেতু নিয়ে যা
ঘটল, তার ব্যাখ্যা প্রধানমন্ত্রী যেভাবেই দিন না কেন, বিদেশে এ ঘটনায়
বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট বিনষ্ট হয়েছে। পদ্মা সেতুতে কোনো দুর্নীতি
হয়নি, এ ধরনের বক্তব্য কী সত্যের অপলাপ নয়? যদি আদৌ ‘কিছু’ না হয়ে থাকে,
তাহলে বিশ্বব্যাংক কেন এত কঠোর হলো, কেন তদন্ত করল, কেনই বা কানাডায় মামলা
হলো? আমরা তা অস্বীকার করতেই পারি। কিন্তু বাস্তবতা কিন্তু তা বলে না।
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে হলমার্ক-ডেসটিনির অনিয়মের কথা স্বীকার করেছেন।
কিন্তু মানুষ প্রত্যাশা করে, যারাই এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, তাদের
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। একজন ব্যাংক উপ-মহাব্যবস্থাপকের
পক্ষে হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়া সম্ভব নয়। সুতরাং প্রভাবশালী যারাই নেপথ্যে
থেকে এই ‘কমিটি’ করেছেন, তাদের শাস্তি হোক।
প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই
বিদেশের গণতান্ত্রিক সমাজের কথা বলেন। কিন্তু ইউরোপের কোনো গণতান্ত্রিক
সমাজে কী এ ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারিতে অপরাধীরা পার পেয়ে যেতে পারেন?
ব্রিটেনে ক্ষমতাসীন এক মন্ত্রীকে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করায় জরিমানা দিতে
হয়েছিল। জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর (প্রধানমন্ত্রী, তিন-তিনবার) হেলমুট
কোহল ঘুষ গ্রহণ করার অপরাধে অপরাধী স্বাব্যস্ত হওয়ায় দলের কর্তৃত্ব
হারিয়েছিলেন। আমরা বাংলাদেশে কী এ ধরনের ঘটনা চিন্তাও করতে পারি?
প্রধানমন্ত্রী ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন, মাগুরা উপ-নির্বাচনের কথা বলেছেন।
এটা মিথ্যা নয়। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে ভোলায় উপ-নির্বাচনে কী হয়েছিল,
তার সাক্ষী সংবাদপত্রগুলো। আসলে এই সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসা
প্রয়োজন, যা আমরা পারছি না। প্রধানমন্ত্রী শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে
দুই ব্যক্তির যোগসাজশের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, ওই দুই ব্যক্তি
যদি সত্যি সত্যিই জড়িত থাকনে, তাহলে সরকার তাদের গ্রেফতার করছে না কেন?
একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। ওই রিপোর্টে যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছিল,
তাদের কী আইনের আওতায় আনা হয়েছিল? আর যদি আইনের আওতায় আনা না হয়, তাহলে
আমরা বিদেশের গণতন্ত্রের দৃষ্টান্ত দিতে পারব কী? বিদেশে যেভাবে নির্বাচন
হয়, সেভাবেই নির্বাচন হবেÑ এটাই প্রত্যাশিত। প্রধানমন্ত্রী মিথ্যা বলেননি।
কিন্তু বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তার সঙ্গে কী আমরা বিদেশের
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কোনো মিল খুঁজে পাব? আমাদের সংবিধানে
প্রধানমন্ত্রীকে যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, তা পৃথিবীর কোনো সংবিধানে এভাবে
দেয়া হয়নি। এখানে প্রধানমন্ত্রীর কথাই আইন।
আমি জানি না,
প্রধানমন্ত্রী এটা স্বীকার করবেন কিনা যে, বাংলাদেশ এক কঠিন সময় পার করছে।
সমঝোতা যেখানে প্রয়োজন, সেখানে সমঝোতা একটি কৃষ্ণগহ্বরে পতিত হয়েছে। আর দশম
নির্বাচনকে ঘিরে যদি কোনো সমঝোতা না হয়, তাহলে আমরা নিশ্চিতভাবেই ‘১৫
ফেব্রুয়ারি’ প্রত্যক্ষ করব! সরকার এককভাবেই নির্বাচন করবে, যা সঙ্কটকে আরও
গভীরতর করবে।
সংসদে ২৯ ফেব্রুয়ারি বিরোধীদলীয় নেতা যে বক্তব্য
রেখেছেন, সে ব্যাপারেও কিছু কথা বলা প্রয়োজন। বেগম জিয়া সংবিধানে নির্দলীয়
সরকার বিধান সংযোজন করা, সংলাপ আহ্বান করা, ড. ইউনূসকে অসম্মানিত করা,
জাতীয় নেতাদের সম্মান দেয়া, সাগর-রুনী হত্যাকা-, ভারতের সঙ্গে আমাদের
সম্পর্ক ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। বাজেট নিয়েও তিনি মন্তব্য
করেছেন। তিনি বলেছেন, উচ্চ সুদের হার, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, গ্যাস ও
বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি, চাঁদাবাজি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি
বিনিয়োগে পরিস্থিতিকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। তিনি হেফাজতে ইসলামের
প্রসঙ্গও টেনেছেন। তুলনামূলক বিচারে শেখ হাসিনা যতটা আক্রমণাত্মক ছিলেন,
বেগম জিয়া ততটা আক্রমণাত্মক ছিলেন না। কিন্তু আমরা যারা আমজনতা, আমাদের
কাছে দুই নেত্রীর ভাষণের মধ্য দিয়ে কোনো সমাধান বা দিকনির্দেশনার পথ আমরা
খুঁজে পাইনি।
প্রথমত, বাজেট বাস্তবায়নে যেসব সমস্যার সম্মুখীন
আমরা হব, তার সমাধান কীভাবে হবে, তার কোনো দিকনির্দেশনা নেই। সরকার যে
প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা বলেছে, বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া সেই প্রবৃদ্ধি
অর্জিত হবে না। অর্থমন্ত্রীর মুখের কথায় প্রবৃদ্ধির টার্গেট অর্জিত হবে
না। এর জন্য দরকার বিনিয়োগকারীদের আস্থা, শিল্পোৎপাদন ও রাজনৈতিক
স্থিতিশীলতা। যার কোনো একটিও এই মুহূর্তে নেই। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের জিএসপি
সুবিধা স্থগিত হয়ে যাওয়ার ফলে আমাদের রফতানি খাত যে শুধু বাধাগ্রস্ত হবে
তা নয়, বরং বাংলাদেশ বড় ধরনের ভাবমূর্তির সঙ্কটে পড়েছে। এই ভাবমূর্তি
কীভাবে আমরা ফিরিয়ে আনব, তার কোনো দিকনির্দেশনা নেই। শুধু শুধু বিএনপিকে
দায়ী করে, দোষারোপের রাজনীতিটা আরও প্রলম্বিত হবে মাত্র, তাতে কাজের কাজ
হবে না। সরকার জনৈক মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি কমিটি করেছে মাত্র। তাতে কতটুকু
কাজ হবে, আমি নিশ্চিত নই। এটা জাতীয় ইস্যু। প্রয়োজনে জাপাসহ বিএনপির
প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত ছিল। সরকারের ‘একলা চল নীতি’ এই সঙ্কট
থেকে বাংলাদেশকে কতটুকু বের করে আনতে পারবে, সেটাই দেখার বিষয়। তৃতীয়ত, ড.
ইউনূসকে নিয়ে সরকারপ্রধান আবার বিষোদ্গার করেছেন। এই বিষয়টি নিয়ে যত কম কথা
বলা যায়, ততই সরকারের জন্য মঙ্গল। কিন্তু বারে বারে ড. ইউনূস তথা গ্রামীণ
ব্যাংক প্রসঙ্গ আসছে। আমরা ভুলে যাই, সারা বিশ্বের মানুষ ড. ইউনূসকে চেনে।
তাকে দিয়ে বাংলাদেশের পরিচিতি ব্যাপক। অথচ তিনি নিজ বাসভূমেই বারে বারে
অসম্মানিত হয়েছেন। অতি সম্প্রতি ড. ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ
রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘ইউএস কংগ্রেসনাল অ্যাওয়ার্ড’-এ ভূষিত হয়েছেন। এটা
আমাদের গর্বের। কিন্তু আমরা বিষয়টি ভুলে যাই। চতুর্থত, দশম জাতীয় সংসদ
নির্বাচনটা হবে কীভাবে? সরকারপ্রধান ভালো করেই জানেন, তিনি যতই বিদেশের
দৃষ্টান্ত দিন না কেন, একটি নির্দলীয় সরকার ছাড়া বিএনপি এবং সম্ভবত জাতীয়
পার্টিকেও নির্বাচনে আনা সম্ভব হবে না। তাহলে তিনি যখন ১৫ ফেব্রুয়ারির
নির্বাচনের সমালোচনা করেন (যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ এই
সংসদ নির্বাচন বয়কট করেছিল), তখন কি তিনি নিজেই আরেকটি ‘১৫ ফেব্রুয়ারির’
মতো নির্বাচনের জন্ম দিতে যাচ্ছেন না? অনির্বাচিত কাউকে নির্বাচনকালীন
সরকারের প্রধান করা যাবে নাÑ প্রধানমন্ত্রীর এই উক্তিকে সমর্থন করেও একজন
নির্বাচিত ব্যক্তিকে প্রধান করে একটি সরকার গঠন করা যায়। প্রয়োজন শুধু
আন্তরিকতার। আমরা সামনে তাকাতে চাই। পেছনে নয়। কিন্তু শেখ হাসিনা এখনও
আওয়ামী লীগের প্রধান। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে গেলে
(অন্তর্র্বতীকালীন), নির্বাচন যে সুষ্ঠু হবে, তার গ্যারান্টি তিনি নিজেও
দিতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রীর ওপর আজ নির্ভর করে সবকিছু। ইতিহাস তাকে
কীভাবে স্মরণ করবে, তা শুধু ইতিহাসই জানাতে পারবে। আমরা শুধু প্রত্যাশা
করব, একটা সমঝোতা হোক।
দোষারোপের এই রাজনীতি আমাদের গণতান্ত্রিক
সংস্কৃতির অন্যতম একটা বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক
রাষ্ট্রে এভাবে বিরোধী দলের ওপর আক্রমণ, বিশেষ করে ব্যক্তি পর্যায়ে আক্রমণ
হয় কিনা, তা আমার জানা নেই। বিরোধী দলের ওপর আক্রমণ হতে হবে রাজনৈতিক।
রাজনৈতিকভাবেই তাদের সমালোচনা করতে হবে। আমাদের দুঃখ এটাই যে, স্বাধীনতার
৪২ বছর পার করার পরও আমাদের শুনতে হয়Ñ ‘বিরোধী দল বাংলাদেশকে পাকিস্তান
বানাতে চায়।’ পাকিস্তান আজ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। পাকিস্তান এই মুহূর্তে
আমাদের জন্য কোনো মডেল নয়। বিরোধী দল এ দেশটিকে ‘পাকিস্তান বানাবে’, শুনতেও
খারাপ লাগে। কিন্তু বাস্তবতা এটাই যে, দোষারোপের যে রাজনীতি, তা আমাদের আজ
এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা যতই
পরস্পর পরস্পরকে অভিযুক্ত করব, ততই সঙ্কট ঘনীভূত হবে। সঙ্কটের মাত্রা
বাড়বে। আমাদের জাতীয় নেতারা এ কথাটা যদি উপলব্ধি করে থাকেন, তাহলেই তা
আমাদের জন্য মঙ্গল।
এদেশে কোন দিন কি শান্তি আসবেনা ?
ReplyDeleteMay be you are correct. But we need someone to change the situation.
Delete