রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

একটি মন্তব্য ও কিছু প্রশ্ন

নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. ডেভিড লুডেনের একটি বক্তব্য ছাপা হয়েছে নিউইয়র্কের বাংলা পত্রিকাগুলোতে গত ১৭ জুলাই। যুক্তরাষ্ট্রের মওলানা ভাসানী ফাউন্ডেশন আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে (নিউইয়র্কে) তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ শেখ হাসিনা চালান না, বাংলাদেশ চালান মাল্টিন্যাশনাল পুঁজির প্রতিনিধি ইউরোপের রাষ্ট্রদূত ও রাষ্ট্রদূতদের ট্যিউস ডে ক্লাব ও ঢাকায় আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা। তারাই বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন। তারাই দায়ী বাংলাদেশের আর্থ-রাজনৈতিক অবস্থার জন্য’ (সাপ্তাহিক পরিচয়, ১৭ জুলাই ২০১৩)। তার বক্তব্য এভাবেই ছাপা হয়েছে। অধ্যাপক লুডেনের এই বক্তব্য কমিউনিটির মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। স্থানীয় বাঙালিদের মাঝে অধ্যাপক লুডেন খুব একটা পরিচিত ব্যক্তি না হলেও যারা শিক্ষা জগতের সঙ্গে জড়িত, এখানে পড়াশোনা করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন, তাদের কাছে অধ্যাপক লুডেন একটি পরিচিত নাম। সুতরাং অধ্যাপক লুডেনের বক্তব্যকে হাল্কাভাবে উড়িয়ে দেয়া যায় না। উপরোক্ত আরো একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে লুডেন মওলানা ভাসানীর ওপর গবেষণা করছেন। অনুষ্ঠানে মওলানার রাজনীতি নিয়েও তিনি কথা বলেছেন।
মূলত বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের কাছে অধ্যাপক লুডেনের বক্তব্যটি অমূলক নয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের প্রভাব বাড়ছে। বিদেশিরা প্রকাশ্যেই বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে মন্তব্য করছেন। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা বলতে গেলে প্রতি সপ্তাহেই একটি মন্তব্য করছেন, যা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হচ্ছে বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোতে। তার এই মন্তব্য কারো কারো কাছে অনাকাক্সিক্ষত হলেও অনেক সময় তিনি ‘সত্য’ কথাটাই বলছেন। অনেকেরই মনে থাকার কথা, বেগম জিয়ার শাসনামালের (২০০১-২০০৬) শেষের দিকে এই ‘ট্যিউস ডে ক্লাব’-এর জন্ম হয়েছিল। মূলত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতের নেতৃত্বেই জন্ম হয়েছিল এই ‘ট্যিউস ডে ক্লাব’। এই ক্লাবের সদস্য ছিলেন বেশক’টি পশ্চিমা দাতাগোষ্ঠীর রাষ্ট্রদূতরা; যদিও কাগজে-কলমে এই ক্লাবের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। রাষ্ট্রদূতরা প্রতি মঙ্গলবার মিলিত হতেন বিধায়, সংবাদপত্রে এর নামকরণ করা হয়েছিল ‘ট্যিউস ডে ক্লাব’। বেগম জিয়ার শাসনামলে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মাঝে দ্বন্দ্বের ফলেই জন্ম হয়েছিল ‘ট্যিউস ডে ক্লাব’-এর। আজকের পরিস্থিতির সঙ্গে সেদিনের পরিস্থিতির তেমন কোনো পার্থক্য নেই; বরং পরিস্থিতির গভীরতা আরো বেশি। ফলে বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর তৎপরতা বেড়েছে। সম্ভবত অধ্যাপক লুডেন সে কথাটাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এই নিউইয়র্ক শহরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে সচেতন। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ঢাকা থেকে কেউ না কেউ আসছেন, মিটিং করছেন। মিটিংগুলোতে উপস্থিতির হারও কম নয়। নির্বাচন হবে কি, হবে না, আরেকটি ‘ওয়ান-ইলেভেন’-এর জন্ম হবে কি-না, এটা এখন এই নিউইয়র্ক শহরের বাংলাদেশিদের মাঝে আলোচনার অন্যতম বিষয়। ‘ওয়ান-ইলেভেন’-এর অভিজ্ঞতা সাধারণ মানুষের কাছে যেমন তিক্ত, রাজনীতিকদের কাছে আরো বেশি তিক্ত। নিশ্চয়ই রাজনীতিকরা সেই অধ্যায়ের কথা ভুলে যাননি।
বাংলাদেশের রাজনীতি যেভাবে চলছে, সেভাবে চলতে দেয়া উচিত নয় বলেও প্রায় সবার অভিমত। প্রবাসীরা মনে করেন যেহেতু নির্বাচন সামনে, সেহেতু বিএনপির উচিত হবে নির্বাচনে অংশ নেয়া। নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপিরই ক্ষতি-এটাও মনে করেন অনেকে। আর নির্বাচন কোন্ প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হবে, সেটা নিয়েও সরকারের উচিত বিএনপির সঙ্গে কথাবার্তা বলা। জরুরি একটা সংলাপ হওয়া উচিত। না হলে দেশ আরো গভীর সংকটে পড়বে। রাজনীতিবিদরা আরো ‘ম্যাচুরিটির’ পরিচয় দেবেন, এটাও প্রত্যাশা করেন অনেকে। তবে কোনো অসাংবিধানিক শক্তির ক্ষমতা গ্রহণকেও তারা পছন্দ করছেন না। মুরসির ক্ষমতাচ্যুতির বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। মিসর আর বাংলাদেশ এক নয়। মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো কট্টর ইসলামপন্থিরা বাংলাদেশে ক্ষমতায় নেই। যারা ক্ষমতায়, তারা অসাম্প্রদায়িক একটি দল। আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র আজকের নয়; বরং অনেক পুরনো। অন্যদিকে বিএনপিকেও একটি ইসলামপন্থি দল হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। ইসলামকে দলটি ধারণ করে বটে, কিন্তু তারা কট্টরপন্থি নয়। এই দলটিতে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিরও উপস্থিতি রয়েছে। এমন অনেকেই দলটিতে আছেন, যারা একাত্তরে জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন। দলটির প্রতিষ্ঠাতাও মুক্তিযুদ্ধের একজন বীর সমর নায়ক। সুতরাং বাংলাদেশের সঙ্গে মিসরের পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে না। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিসরের সেনাবাহিনীরও কোনো তুলনা চলবে না। ১৯৫২ সাল থেকেই মিসর সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সেদেশের ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। মিসরের অর্থনীতিতে সেখানকার সেনাবাহিনীর বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সেনবাহিনী এই মুহূর্তে ‘টোটাল প্রফেশনাল’। রাজনীতির প্রতি তাদের আদৌ কোনো আগ্রহ নেই। তাই মিসরের পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে না।
অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, মিসরের সেনাবাহিনীর ভূমিকা বাংলাদেশে কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে? বলেছি, মিসরের সেনাবাহিনীর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অনেক বেশি। এই সেনা অভ্যুত্থানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের একটা ‘ভূমিকা’ রয়েছে। ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দেয় যুক্তরাষ্ট্র শুধু মিসরের সেনাবাহিনীকে। সেনাবাহিনীর নিজস্ব একটা অর্থনৈতিক ভিত্তি রয়েছে মিসরে। প্রায় প্রতিটি বড় বড় শিল্পে বিনিয়োগ রয়েছে সেনাবাহিনীর। কোনো সরকারের পক্ষেই এই ‘অর্থনৈতিক ভিত্তি’কে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। ইসরাইলের নিজস্ব স্বার্থ রয়েছে মিসরে। ১৯৭৮ সালে মিসর ও ইসরাইল একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, যার মধ্য দিয়ে ইসরাইল তার পার্শ্ববর্তী দেশের কাছ থেকে ‘নিরাপত্তা হুমকি’কে অনেকটাই ‘শূন্য পর্যায়ে’ নামিয়ে এনেছিল। কিন্তু ইসরাইলবিরোধী মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থান শঙ্কিত করেছিল ইসরাইলকে। তাই একটা সামরিক অভ্যুত্থান সেখানে অবশ্যম্ভাবী ছিল। কোন পথে এখন মিসর এ ব্যাপারে বাংলাদেশিদের অনেক আগ্রহ দেখেছি। জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ এলসিসির ভূমিকাই-বা কি হবে এখন এটিও আলোচনায় আছে। তিনি একটি ‘নির্বাচন’ (২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা) দিয়ে আবার ব্যারাকে ফিরে যাবেন, এটা কেউই বিশ্বাস করেন না। বাস্তবতাও তাই বলে। সাবেক মন্ত্রী ও একজন অর্থনীতিবিদ হাজেম এল বেবলাউই প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এটা তত্ত্বের কথা। সেনা অভ্যুত্থানকারীরা তত্ত্বগতভাবেই টেকনোক্রেটদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলেন। মিসরেও তা-ই হয়েছে। মিসরের রাজনীতি বাংলাদেশিদের স্পর্শ করেছে। তারা ‘ইফতার মাহফিল’-এর একটা অনুষ্ঠানে এ প্রসঙ্গে আমাকে আরো নানা প্রশ্ন করেছেন। বলেছি, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এখন যথেষ্ট ‘প্রফেশনাল।’ অনেকেরই প্রশ্ন, নির্বাচন কি আদৌ হবে? বলেছি, আওয়ামী লীগ যদি বিএনপিকে বাদ দিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যায়, তাহলে তা দলটির অস্তিত্বকেও একটা হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারে। অনেকেই বিশ্বাস করেন, যারা প্রধানমন্ত্রীকে উপদেশ দিচ্ছেন, তারা তাকে সঠিক উপদেশটি দিচ্ছেন না। দলের ভেতরে কট্টরপন্থিদের দ্বারা তিনি বেশিমাত্রায় প্রভাবান্বিত। এক সময় যারা মস্কোপন্থি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তারা বেশিমাত্রায় দলের নীতি-নির্ধারণীতে প্রভাব ফেলছেন। এমন কথাও অনেকের মুখ থেকে শুনেছি এদের ‘ভুলের’ কারণেই দলকে আজ কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে।
ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণে এসে আওয়ামী লীগ দাঁড়িয়েছে। একদিকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, অন্যদিকে সর্বমহলে নির্বাচনের একটা গ্রহণযোগ্যতা কোন্ পথে এখন আওয়ামী লীগ যাবে? আওয়ামী লীগ কি এতটুকু নমনীয় হবে? ঈদের পর বড় ধরনের সংকটের মুখে থাকবে দেশ। এই যুক্তরাষ্ট্রে নীতি-নির্ধারকদের কাছে এখন বাংলাদেশ একটি জনপ্রিয় নাম নয়। জিএসপি সুবিধা বাতিল হয়েছে। সিনেটে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ড. ইউনূস ইস্যুতে অসন্তুষ্ট সবাই। তাই সরকারকে তাদের দূরদর্শিতা প্রমাণ করতে হবে। ওয়াশিংটনে আমাদের দূতাবাসে যারা কাজ করেন, তারা বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু দেখছেন এ প্রশ্নও করেছেন অনেকে। তারা সঠিকভাবে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারছেন না এমন মন্তব্য প্রায় সবার।
তাই অধ্যাপক লুডেনের বক্তব্যকে হাল্কাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের কথা দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা বারবার বলে আসছেন। এখন মহাজোট সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে বিএনপিকে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান করে নির্বাচনকালীন সরকারের কোনো ফর্মুলাই কাজ করবে না। বেগম জিয়া ইতোমধ্যে এ বিষয়ে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। পরিষ্কার বলেছেন, এমনটি হলে তিনি নির্বাচনে যাবেন না। তাহলে ‘সকল দলের অংশগ্রহণ’ নিশ্চিত হবে কিভাবে? তাই প্রধানমন্ত্রীকে এবং আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকদের একটা ‘ফর্মুলা’ বের করতে হবে। যদি গ্রহণযোগ্য একটি ফর্মুলা বের করা না যায়, তাহলে দেশ একটি গভীর সংকটে পড়বে। আর সমঝোতা যদি না হয়, তাহলে ‘নতুন একটি ওয়ান-ইলেভেন’-এর সম্ভাবনা আরো উজ্জ্বল হবে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র ইতোমধ্যে অনেক কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। এই গণতন্ত্রের জন্য বাংলাদেশে অনেক মানুষের প্রাণ গেছে, রক্ত ঝরেছে, রাজনীতিকরাও অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই রাজনীতিকরাই আবার পরিস্থিতি জটিলও করে তুলেছেন। এর থেকে উত্তরণের পথ তাদেরই সন্ধান করতে হবে।
রাজনীতিতে ‘রিয়েল পলিটিকস’-এর একটি বিষয় রয়েছে। অর্থাৎ প্রয়োজনে বাস্তবমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা। পাকিস্তানে সর্বশেষ নির্বাচনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা দেশে ও বিদেশে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। নেপালেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। ইউরোপে ও গ্রিসে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। বুলগেরিয়াও একই পথ অবলম্বন করেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও এ ধরনের একটি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা প্রয়োজন। এটাই ‘রিয়েল পলিটিকস’-এর মূল কথা। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে মজবুত করার জন্যই প্রশ্নমুক্ত নির্বাচনী ব্যবস্থা নিশ্চিত করা বড় বেশি জরুরি। সরকারকে কখনো কখনো জাতীয় স্বার্থের কথা বিবেচনায় নিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আজ বাংলাদেশের পরিস্থিতি সে রকমই। জাতির বৃহত্তম স্বার্থের খাতিরেই নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে ঐকমত্য প্রয়োজন। ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হলে দাতাগোষ্ঠীর অপতৎপরতা আরো বাড়বে। বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। ইতোপূর্বে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। এর জন্য আমাদের ক্ষতিও হয়েছে যথেষ্ট। এ জন্য সব বিষয়ে আমাদের রাজনীতিকরা যে সচেতন নন সে কথাও বলা যাবে না। কিন্তু তাদের কাছে সব কিছু ছাপিয়ে দলীয় স্বার্থটাই বড় হয়ে উঠেছে, যা জনকল্যাণ এবং দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির জন্য অশনিসংকেত। রাজনীতিবিদরা বৈরী পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থের কথা বিবেচনা করে আরো বেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে সক্ষম হবেন এ প্রত্যাশা শান্তিপ্রিয় সবার। ইতোমধ্যে সরকারের ওপর চাপ বেড়েছে এবং এই চাপ শুধুই রাজনৈতিক নয়, আন্তর্জাতিক চাপও রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে ঈদের পর পরই সরকার আরো নানামুখী চাপে পড়বে এবং রাজনীতির মাঠ অধিকতর উত্তপ্ত হয়ে উঠবে, যা শান্তিপ্রিয় কারোরই কাম্য নয়। জাতীয় স্বার্থে সবাইকে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে অবস্থান নিতে না পারলে শান্তি আসবে না। আর অধ্যাপক লুডেনের মতো ব্যক্তিদের আমরা কথা বলার সুযোগ করে দেব। তাই আমাদের প্রত্যাশা, রাজনীতিবিদরা দূরদর্শিতার পরিচয় দেবেন। ‘রিয়েল পলিটিকস’ বাংলাদেশে বিকশিত হবে আমরা এটাই প্রত্যাশা করি।
নিউইয়র্ক, ১৮ জুলাই ২০১৩
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক - See more at: http://www.manobkantha.com/2013/07/25/131535.html#sthash.Qpd1yrM4.EkpfZBQM.dpuf


নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. ডেভিড লুডেনের একটি বক্তব্য ছাপা হয়েছে নিউইয়র্কের বাংলা পত্রিকাগুলোতে গত ১৭ জুলাই। যুক্তরাষ্ট্রের মওলানা ভাসানী ফাউন্ডেশন আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে (নিউইয়র্কে) তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ শেখ হাসিনা চালান না, বাংলাদেশ চালান মাল্টিন্যাশনাল পুঁজির প্রতিনিধি ইউরোপের রাষ্ট্রদূত ও রাষ্ট্রদূতদের ট্যিউস ডে ক্লাব ও ঢাকায় আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা। তারাই বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন। তারাই দায়ী বাংলাদেশের আর্থ-রাজনৈতিক অবস্থার জন্য’ (সাপ্তাহিক পরিচয়, ১৭ জুলাই ২০১৩)। তার বক্তব্য এভাবেই ছাপা হয়েছে। অধ্যাপক লুডেনের এই বক্তব্য কমিউনিটির মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। স্থানীয় বাঙালিদের মাঝে অধ্যাপক লুডেন খুব একটা পরিচিত ব্যক্তি না হলেও যারা শিক্ষা জগতের সঙ্গে জড়িত, এখানে পড়াশোনা করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন, তাদের কাছে অধ্যাপক লুডেন একটি পরিচিত নাম। সুতরাং অধ্যাপক লুডেনের বক্তব্যকে হাল্কাভাবে উড়িয়ে দেয়া যায় না। উপরোক্ত আরো একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে লুডেন মওলানা ভাসানীর ওপর গবেষণা করছেন। অনুষ্ঠানে মওলানার রাজনীতি নিয়েও তিনি কথা বলেছেন।
মূলত বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের কাছে অধ্যাপক লুডেনের বক্তব্যটি অমূলক নয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের প্রভাব বাড়ছে। বিদেশিরা প্রকাশ্যেই বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে মন্তব্য করছেন। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা বলতে গেলে প্রতি সপ্তাহেই একটি মন্তব্য করছেন, যা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হচ্ছে বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোতে। তার এই মন্তব্য কারো কারো কাছে অনাকাক্সিক্ষত হলেও অনেক সময় তিনি ‘সত্য’ কথাটাই বলছেন। অনেকেরই মনে থাকার কথা, বেগম জিয়ার শাসনামালের (২০০১-২০০৬) শেষের দিকে এই ‘ট্যিউস ডে ক্লাব’-এর জন্ম হয়েছিল। মূলত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতের নেতৃত্বেই জন্ম হয়েছিল এই ‘ট্যিউস ডে ক্লাব’। এই ক্লাবের সদস্য ছিলেন বেশক’টি পশ্চিমা দাতাগোষ্ঠীর রাষ্ট্রদূতরা; যদিও কাগজে-কলমে এই ক্লাবের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। রাষ্ট্রদূতরা প্রতি মঙ্গলবার মিলিত হতেন বিধায়, সংবাদপত্রে এর নামকরণ করা হয়েছিল ‘ট্যিউস ডে ক্লাব’। বেগম জিয়ার শাসনামলে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মাঝে দ্বন্দ্বের ফলেই জন্ম হয়েছিল ‘ট্যিউস ডে ক্লাব’-এর। আজকের পরিস্থিতির সঙ্গে সেদিনের পরিস্থিতির তেমন কোনো পার্থক্য নেই; বরং পরিস্থিতির গভীরতা আরো বেশি। ফলে বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর তৎপরতা বেড়েছে। সম্ভবত অধ্যাপক লুডেন সে কথাটাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এই নিউইয়র্ক শহরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে সচেতন। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ঢাকা থেকে কেউ না কেউ আসছেন, মিটিং করছেন। মিটিংগুলোতে উপস্থিতির হারও কম নয়। নির্বাচন হবে কি, হবে না, আরেকটি ‘ওয়ান-ইলেভেন’-এর জন্ম হবে কি-না, এটা এখন এই নিউইয়র্ক শহরের বাংলাদেশিদের মাঝে আলোচনার অন্যতম বিষয়। ‘ওয়ান-ইলেভেন’-এর অভিজ্ঞতা সাধারণ মানুষের কাছে যেমন তিক্ত, রাজনীতিকদের কাছে আরো বেশি তিক্ত। নিশ্চয়ই রাজনীতিকরা সেই অধ্যায়ের কথা ভুলে যাননি।
বাংলাদেশের রাজনীতি যেভাবে চলছে, সেভাবে চলতে দেয়া উচিত নয় বলেও প্রায় সবার অভিমত। প্রবাসীরা মনে করেন যেহেতু নির্বাচন সামনে, সেহেতু বিএনপির উচিত হবে নির্বাচনে অংশ নেয়া। নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপিরই ক্ষতি-এটাও মনে করেন অনেকে। আর নির্বাচন কোন্ প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হবে, সেটা নিয়েও সরকারের উচিত বিএনপির সঙ্গে কথাবার্তা বলা। জরুরি একটা সংলাপ হওয়া উচিত। না হলে দেশ আরো গভীর সংকটে পড়বে। রাজনীতিবিদরা আরো ‘ম্যাচুরিটির’ পরিচয় দেবেন, এটাও প্রত্যাশা করেন অনেকে। তবে কোনো অসাংবিধানিক শক্তির ক্ষমতা গ্রহণকেও তারা পছন্দ করছেন না। মুরসির ক্ষমতাচ্যুতির বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। মিসর আর বাংলাদেশ এক নয়। মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো কট্টর ইসলামপন্থিরা বাংলাদেশে ক্ষমতায় নেই। যারা ক্ষমতায়, তারা অসাম্প্রদায়িক একটি দল। আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র আজকের নয়; বরং অনেক পুরনো। অন্যদিকে বিএনপিকেও একটি ইসলামপন্থি দল হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। ইসলামকে দলটি ধারণ করে বটে, কিন্তু তারা কট্টরপন্থি নয়। এই দলটিতে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিরও উপস্থিতি রয়েছে। এমন অনেকেই দলটিতে আছেন, যারা একাত্তরে জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন। দলটির প্রতিষ্ঠাতাও মুক্তিযুদ্ধের একজন বীর সমর নায়ক। সুতরাং বাংলাদেশের সঙ্গে মিসরের পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে না। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিসরের সেনাবাহিনীরও কোনো তুলনা চলবে না। ১৯৫২ সাল থেকেই মিসর সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সেদেশের ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। মিসরের অর্থনীতিতে সেখানকার সেনাবাহিনীর বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সেনবাহিনী এই মুহূর্তে ‘টোটাল প্রফেশনাল’। রাজনীতির প্রতি তাদের আদৌ কোনো আগ্রহ নেই। তাই মিসরের পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে না।
অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, মিসরের সেনাবাহিনীর ভূমিকা বাংলাদেশে কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে? বলেছি, মিসরের সেনাবাহিনীর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অনেক বেশি। এই সেনা অভ্যুত্থানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের একটা ‘ভূমিকা’ রয়েছে। ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দেয় যুক্তরাষ্ট্র শুধু মিসরের সেনাবাহিনীকে। সেনাবাহিনীর নিজস্ব একটা অর্থনৈতিক ভিত্তি রয়েছে মিসরে। প্রায় প্রতিটি বড় বড় শিল্পে বিনিয়োগ রয়েছে সেনাবাহিনীর। কোনো সরকারের পক্ষেই এই ‘অর্থনৈতিক ভিত্তি’কে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। ইসরাইলের নিজস্ব স্বার্থ রয়েছে মিসরে। ১৯৭৮ সালে মিসর ও ইসরাইল একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, যার মধ্য দিয়ে ইসরাইল তার পার্শ্ববর্তী দেশের কাছ থেকে ‘নিরাপত্তা হুমকি’কে অনেকটাই ‘শূন্য পর্যায়ে’ নামিয়ে এনেছিল। কিন্তু ইসরাইলবিরোধী মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থান শঙ্কিত করেছিল ইসরাইলকে। তাই একটা সামরিক অভ্যুত্থান সেখানে অবশ্যম্ভাবী ছিল। কোন পথে এখন মিসর এ ব্যাপারে বাংলাদেশিদের অনেক আগ্রহ দেখেছি। জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ এলসিসির ভূমিকাই-বা কি হবে এখন এটিও আলোচনায় আছে। তিনি একটি ‘নির্বাচন’ (২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা) দিয়ে আবার ব্যারাকে ফিরে যাবেন, এটা কেউই বিশ্বাস করেন না। বাস্তবতাও তাই বলে। সাবেক মন্ত্রী ও একজন অর্থনীতিবিদ হাজেম এল বেবলাউই প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এটা তত্ত্বের কথা। সেনা অভ্যুত্থানকারীরা তত্ত্বগতভাবেই টেকনোক্রেটদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলেন। মিসরেও তা-ই হয়েছে। মিসরের রাজনীতি বাংলাদেশিদের স্পর্শ করেছে। তারা ‘ইফতার মাহফিল’-এর একটা অনুষ্ঠানে এ প্রসঙ্গে আমাকে আরো নানা প্রশ্ন করেছেন। বলেছি, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এখন যথেষ্ট ‘প্রফেশনাল।’ অনেকেরই প্রশ্ন, নির্বাচন কি আদৌ হবে? বলেছি, আওয়ামী লীগ যদি বিএনপিকে বাদ দিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যায়, তাহলে তা দলটির অস্তিত্বকেও একটা হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারে। অনেকেই বিশ্বাস করেন, যারা প্রধানমন্ত্রীকে উপদেশ দিচ্ছেন, তারা তাকে সঠিক উপদেশটি দিচ্ছেন না। দলের ভেতরে কট্টরপন্থিদের দ্বারা তিনি বেশিমাত্রায় প্রভাবান্বিত। এক সময় যারা মস্কোপন্থি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তারা বেশিমাত্রায় দলের নীতি-নির্ধারণীতে প্রভাব ফেলছেন। এমন কথাও অনেকের মুখ থেকে শুনেছি এদের ‘ভুলের’ কারণেই দলকে আজ কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে।
ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণে এসে আওয়ামী লীগ দাঁড়িয়েছে। একদিকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, অন্যদিকে সর্বমহলে নির্বাচনের একটা গ্রহণযোগ্যতা কোন্ পথে এখন আওয়ামী লীগ যাবে? আওয়ামী লীগ কি এতটুকু নমনীয় হবে? ঈদের পর বড় ধরনের সংকটের মুখে থাকবে দেশ। এই যুক্তরাষ্ট্রে নীতি-নির্ধারকদের কাছে এখন বাংলাদেশ একটি জনপ্রিয় নাম নয়। জিএসপি সুবিধা বাতিল হয়েছে। সিনেটে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ড. ইউনূস ইস্যুতে অসন্তুষ্ট সবাই। তাই সরকারকে তাদের দূরদর্শিতা প্রমাণ করতে হবে। ওয়াশিংটনে আমাদের দূতাবাসে যারা কাজ করেন, তারা বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু দেখছেন এ প্রশ্নও করেছেন অনেকে। তারা সঠিকভাবে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারছেন না এমন মন্তব্য প্রায় সবার।
তাই অধ্যাপক লুডেনের বক্তব্যকে হাল্কাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের কথা দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা বারবার বলে আসছেন। এখন মহাজোট সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে বিএনপিকে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান করে নির্বাচনকালীন সরকারের কোনো ফর্মুলাই কাজ করবে না। বেগম জিয়া ইতোমধ্যে এ বিষয়ে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। পরিষ্কার বলেছেন, এমনটি হলে তিনি নির্বাচনে যাবেন না। তাহলে ‘সকল দলের অংশগ্রহণ’ নিশ্চিত হবে কিভাবে? তাই প্রধানমন্ত্রীকে এবং আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকদের একটা ‘ফর্মুলা’ বের করতে হবে। যদি গ্রহণযোগ্য একটি ফর্মুলা বের করা না যায়, তাহলে দেশ একটি গভীর সংকটে পড়বে। আর সমঝোতা যদি না হয়, তাহলে ‘নতুন একটি ওয়ান-ইলেভেন’-এর সম্ভাবনা আরো উজ্জ্বল হবে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র ইতোমধ্যে অনেক কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। এই গণতন্ত্রের জন্য বাংলাদেশে অনেক মানুষের প্রাণ গেছে, রক্ত ঝরেছে, রাজনীতিকরাও অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই রাজনীতিকরাই আবার পরিস্থিতি জটিলও করে তুলেছেন। এর থেকে উত্তরণের পথ তাদেরই সন্ধান করতে হবে।
রাজনীতিতে ‘রিয়েল পলিটিকস’-এর একটি বিষয় রয়েছে। অর্থাৎ প্রয়োজনে বাস্তবমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা। পাকিস্তানে সর্বশেষ নির্বাচনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা দেশে ও বিদেশে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। নেপালেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। ইউরোপে ও গ্রিসে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। বুলগেরিয়াও একই পথ অবলম্বন করেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও এ ধরনের একটি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা প্রয়োজন। এটাই ‘রিয়েল পলিটিকস’-এর মূল কথা। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে মজবুত করার জন্যই প্রশ্নমুক্ত নির্বাচনী ব্যবস্থা নিশ্চিত করা বড় বেশি জরুরি। সরকারকে কখনো কখনো জাতীয় স্বার্থের কথা বিবেচনায় নিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আজ বাংলাদেশের পরিস্থিতি সে রকমই। জাতির বৃহত্তম স্বার্থের খাতিরেই নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে ঐকমত্য প্রয়োজন। ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হলে দাতাগোষ্ঠীর অপতৎপরতা আরো বাড়বে। বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। ইতোপূর্বে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। এর জন্য আমাদের ক্ষতিও হয়েছে যথেষ্ট। এ জন্য সব বিষয়ে আমাদের রাজনীতিকরা যে সচেতন নন সে কথাও বলা যাবে না। কিন্তু তাদের কাছে সব কিছু ছাপিয়ে দলীয় স্বার্থটাই বড় হয়ে উঠেছে, যা জনকল্যাণ এবং দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির জন্য অশনিসংকেত। রাজনীতিবিদরা বৈরী পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থের কথা বিবেচনা করে আরো বেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে সক্ষম হবেন এ প্রত্যাশা শান্তিপ্রিয় সবার। ইতোমধ্যে সরকারের ওপর চাপ বেড়েছে এবং এই চাপ শুধুই রাজনৈতিক নয়, আন্তর্জাতিক চাপও রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে ঈদের পর পরই সরকার আরো নানামুখী চাপে পড়বে এবং রাজনীতির মাঠ অধিকতর উত্তপ্ত হয়ে উঠবে, যা শান্তিপ্রিয় কারোরই কাম্য নয়। জাতীয় স্বার্থে সবাইকে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে অবস্থান নিতে না পারলে শান্তি আসবে না। আর অধ্যাপক লুডেনের মতো ব্যক্তিদের আমরা কথা বলার সুযোগ করে দেব। তাই আমাদের প্রত্যাশা, রাজনীতিবিদরা দূরদর্শিতার পরিচয় দেবেন। ‘রিয়েল পলিটিকস’ বাংলাদেশে বিকশিত হবে আমরা এটাই প্রত্যাশা করি।
নিউইয়র্ক, ১৮ জুলাই ২০১৩
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
দৈনিক মানবকন্ঠ ২৫ জুলাই ২০১৩।

0 comments:

Post a Comment