রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব

দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় এখন লোডশেডিং হচ্ছে। এমনকি রাতের বেলায়ও লোডশেডিং হচ্ছে। গত ১৪ জুন ৬ হাজার ৪৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেও জনসাধারণের বিপুল চাহিদা পূরণ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। আসলে রাজধানীতে যে পরিমাণ বিদ্যুতের চাহিদার কথা বলা হচ্ছে বাস্তবে চাহিদা তার চেয়ে অনেক বেশি। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণের মাঝে রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। বর্তমান সরকারের সময় সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হয়েছে বলা হলেও পিডিবির হিসাবে এখনও ঘাটতি আছে দেড় হাজার মেগাওয়াট। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বিদ্যুতের চাহিদা যেভাবে বাড়ছে, তা সাম্প্রতিকালে বিদ্যুতের পরিস্থিতিকে একটি বড় ধরনের হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। গ্যাসের ওপর নির্ভরতা থেকে যদি আমরা বেরিয়ে আসতে না পারি, তাহলে আগামী দিনে আমাদের জন্য কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। সরকার ইতিমধ্যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়ার সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে। দ্বিতীয় আরেকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কোনো সমাধান নয়। বরং বাংলাদেশের যে কয়লা সম্পদ রয়েছে, তা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে বিদ্যুতের বিপুল চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। কিন্তু অদৃশ্য কারণে এই কয়লা সম্পদ উত্তোলনের ব্যাপারে সরকার এক নীরবতা পালন করছে। এখানে রাজনীতি ঢুকে গেছে। একটি জাতীয় কমিটি গঠিত হয়েছে, যার সঙ্গে বামমনা রাজনৈতিক ব্যক্তিরা জড়িত, তারা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিরোধিতা করছেন। অথচ জনমত উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার পক্ষে। দেশের পরিকল্পনা কমিশনও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার পক্ষে তাদের অভিমত দিয়েছেন। এর আগে একটি সংসদীয় কমিটি একই ধরনের অভিমত দিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে কয়লার বিশাল রিজার্ভ থাকা সত্ত্বেও আমরা ভারত থেকে নিুমানের কয়লা আমদানি করে খুলনা ও চট্টগ্রামে দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি। খুলনাতে যেখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কথা, তা সুন্দরবনের খুব কাছে। এতে পরিবেশ নষ্ট হতে পারে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে জনমত শক্তিশালী হলেও সরকার এখনও তাদের আগের সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে।
বিষয়টি খুব সঙ্গত কারণে স্পর্শকাতর। বিদ্যুৎ আমাদের প্রয়োজন। চাহিদা বাড়ছে দিন দিন। বিদ্যুৎ উৎপাদনের পুরোটাই এখন গ্যাসনির্ভর। অথচ বাংলাদেশে গ্যাসের রিজার্ভ ফুরিয়ে আসছে। আগামীতে যদি নতুন করে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত না হয়, তাহলে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করবে। ২৩ জুন সিলেটের বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ডে ত্র“টি দেখা দেয়ায় সারাদেশে ভয়াবহ গ্যাস সংকটের সৃষ্টি হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে আসে। লোডশেডিংয়ের পরিমাণ বেড়ে যায়। যদিও সন্ধ্যার দিকে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। এই একটি ঘটনা প্রমাণ করে আগামীতে বাংলাদেশ বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। সুতরাং গ্যাসের পরিবর্তে বিকল্প সূত্র থেকে আমরা যদি বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যাপারে উদ্যোগ না নিই, তাহলে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে আমাদের।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত পাঁচটি কয়লাখনি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত মজুদের পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন টন। এ কয়লা সম্পদ ৭৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য। তবে উত্তোলনযোগ্য কয়লার পরিমাণ ২০ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য ধরা যেতে পারে, যা ৩০ থেকে ৪০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা দিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশে ভালো জাতের বিটুমিনাস কয়লা পাওয়া গেছে। উত্তরাঞ্চলের বড়পুকুরিয়ায় যে কয়লা পাওয়া গেছে, তা ভূপৃষ্ঠের ১১৯ মিটার থেকে ৫৬০ মিটার গভীরতায় অবস্থিত। মোট ছয়টি কয়লা স্তর পাওয়া গেছে, যার পুরুত্ব সর্বাধিক তিন মিটার এবং সর্বোচ্চ ৮২ মিটার। মোট মজুদের পরিমাণ ৬০৩ মিলিয়ন টন। বর্তমানে এ কয়লা খনিটি ভূগর্ভস্থ খনন পদ্ধতির মাধ্যমে উন্নয়নের পর্যায়ে রয়েছে। বড়পুকুরিয়া ছাড়াও জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে ভূপৃষ্ঠের ৬৪০ মিটার থেকে ১১৫৮ মিটার গভীরতায় সাতটি কয়লাস্তর আবিষ্কৃত হয়েছে। কয়লা এলাকার বিস্তৃতি প্রায় বারো বর্গকিলোমিটার এবং মোট আনুমানিক মজুদের পরিমাণ ১০৫৩ মিলিয়ন টন। দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর কয়লা বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনা হিসেবে দেখা দিয়েছে। ফুলবাড়ীর এই কয়লা খনি আবিষ্কৃত হয় ১৯৯৭ সালে এবং কয়লা মজুদ নিশ্চিত হয়েছে ৫৭২ মিলিয়ন টন।
জ্বালানি খাতে কয়লা একটা সম্ভাবনার সৃষ্টি করলেও তাতে এখন ‘রাজনীতি’ ঢুকে গেছে। ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ী কয়লাখনি উত্তোলনের বিরোধিতাকারী স্থানীয় জনগণের সঙ্গে আইন রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষ হয়। তাতে মারা যায় ৬ জন মানুষ। তারা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিরোধিতা করছিল। এখানে বলা ভালো, ১৯৯৪ সালে খালেদা জিয়ার প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে সরকার ব্রকেন হিল প্রপার্টি সংক্ষেপে বিএইচপি নামে এক অস্ট্রেলীয় কোম্পানির সঙ্গে অনুসন্ধান চুক্তি করে। পরে ১৯৯৭ সালে ওই কোম্পানি এশিয়া এনার্জি নামে এক ব্রিটিশ কোম্পানির কাছে লিজিং লাইসেন্স বিক্রি করে। এশিয়া এনার্জি ৩০ বছরের জন্য উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের জন্য অধিকার লাভ করলেও বিনিময়ে বাংলাদেশ সরকার পাবে রয়েলটি হিসেবে উত্তোলিত কয়লার মাত্র ৬ শতাংশ! এটাও বাংলাদেশে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশে খনি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কোন পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা লাভজনক সে ব্যাপারেও দ্বিমত আছে। একদল উন্মুক্ত পদ্ধতির পক্ষে। অন্য দল সুড়ঙ্গ পদ্ধতির পক্ষে। এমনকি বামমনা রাজনীতিকদের বক্তব্য থেকেও দেখা যায়, তারা সুড়ঙ্গ পদ্ধতির পক্ষে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই সুড়ঙ্গ পদ্ধতি আমাদের জন্য কতটুকু লাভজনক?
ভারতের সেন্ট্রাল মাইন প্ল্যানিং অ্যান্ড ডিজাইন ইন্সটিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. অজয় কুমার ঘোষ একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, উš§ুক্ত পদ্ধতিতে তোলা গেলে ফুলবাড়ী থেকে শতকরা ৯০ ভাগ কয়লা তোলা সম্ভব। এমনকি পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রাক্তন ভূতত্ত্ববিদ ড. ইউনুস আকনও একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন উন্মুক্তভাবে কয়লা তোলা সফলভাবে সম্ভব। ভারতে উৎপাদিত কয়লার শতকরা ৮১ ভাগ আসে উন্মুক্ত পদ্ধতি বা ওপেন কাস্ট সাইনিং থেকে। ‘বাংলাদেশের নিরাপত্তা ভাবনা : অপ্রচলিত ধারণা’ শীর্ষক একটি গবেষণা পরিচালনা করতে গিয়ে দেখেছি ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে শতকরা ২০ ভাগের বেশি কয়লা তোলা সম্ভব হয় না (গবেষণাকর্মটি বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে)। বড়পুকুরিয়া কয়লা ক্ষেত্রের বেলায় দেখা গেছে, শতকরা ১০ ভাগ কয়লা তোলাও সম্ভব হচ্ছে না।
সরকার পারমাণবিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে শুধু একটিই কারণে। আর তা হচ্ছে দেশের বিপুল জ্বালানি চাহিদা মোকাবেলা করা। চূড়ান্ত বিচারে পারমাণবিক প্রকল্প কোনো সমাধান নয়। পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল (যেমন অস্ট্রেলিয়ায় ৭৯ শতাংশ, ভারতে ৬৯ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৯২ শতাংশ)। ফুলবাড়ী কয়লাখনি নিয়ে বড় অভিযোগ- কৃষি তথা বসতভিটা অধিগ্রহণ, পানিশূন্যতা, ৪০ হাজার মানুষকে স্থানান্তর ইত্যাদি। জাতীয় কমিটি এই বিষয়টিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। তবে পরিকল্পনা মিশন যে মতামত দিয়েছে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন সম্ভব বলে জানিয়েছে। তাদের প্রতিবেদনে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন সময়কার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। ওই সময় ১২০০ একর জমির ওপর বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং তাতে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার বাসিন্দাকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। তাই রূপপুর প্রকল্প আমাদের জ্বালানি সংকটের কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় গ্যাস থেকে (৮৭ ভাগ), কয়লা (৩ দশমিক ৭ ভাগ), বাকি ফার্নেস অয়েল, জলবিদ্যুৎ ও নবায়নযোগ্য উৎস থেকে। কিন্তু ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে গ্যাসের রিজার্ভ ফুরিয়ে আসছে। নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃতও হচ্ছে না। ফলে কয়লার ব্যাপারে আমাদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাংলাদেশ এক বড় ধরনের ‘এনার্জি ট্রাপ’ বা জ্বালানি ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে। গ্যাসের রিজার্ভ ফুরিয়ে যাওয়া, আর রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল অতিরিক্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় আমাদের বিপুল জ্বালানি চাহিদার উৎস এই কয়লাই। কিন্তু আমরা কয়লাসম্পদকে ব্যবহার করতে পারছি না। এটা ব্যবহার না করে বিপুল ব্যয়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছি এবং দ্বিতীয় আরেকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কথা বলা হচ্ছে। আমরা কখনও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নেতিবাচক দিকগুলো বিবেচনায় নেইনি। জাপানের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভয়াবহ বিস্ফোরণ (২০১১) কিংবা তারও আগে রাশিয়ার চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর অনেক দেশ ‘শিক্ষা’ নিয়েছে। জার্মানি ধীরে ধীরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমনই এক সময় আমরা আরও একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটা ভালো নয় এবং আমাদের জন্য তাতে আদৌ কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। বরং আমাদের নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার করে আমরা যদি বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর উদ্যোগ নেই, তা আমাদের জন্য মঙ্গল হবে।
বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। এ চাহিদা আরও বাড়বে। বাজেটে জ্বালানি খাতে যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে, তা মূলত রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল খাতে ব্যবহারের জন্য। এর ফলে আগামীতে বিদ্যুতের দাম আরও বাড়বে। কিন্তু তাতে কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। একমাত্র কয়লা উত্তোলনের মাঝেই এর সমাধান নিহিত। সরকার যত দ্রুত এ কাজটি করবে, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল।

0 comments:

Post a Comment