রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বাংলাদেশ ও অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রে মার্কিন নীতি

মার্কিন পরাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ভারত ঘুরে গেলেন। তিনি ২৪ জুন নয়াদিল্লি এসেছিলেন ভারত-যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত সংলাপে যোগ দিতে। এটা তার প্রথম ভারত সফর। আর কৌশলগত সংলাপের এটা চতুর্থ বৈঠক। ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত এবং কাতারে তালেবান-আফগান সরকার-যুক্তরাষ্ট্র এই ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের পরিপ্রেক্ষিতে জন কেরির ভারত সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা এখন অনেকের কাছেই স্পষ্ট যে, যুক্তরাষ্ট্র চায় মার্কিন সেনা প্রত্যাহার-পরবর্তী আফগানিস্তানে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করুক। বিষয়টি নিয়ে জন কেরি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদের সঙ্গে আলাপও করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্রদের কাছে অন্যতম একটি আলোচিত বিষয়। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে এক ধরনের রক্ষাকবচ। এ অঞ্চলে তালেবান তথা আল কায়েদার উত্থান রোধে এই দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করছে। আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চতকরণ, জ্বালানি, শিক্ষা, স্পেসপ্রযুক্তি, পারমাণবিক প্রযুক্তি সরবরাহ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে দেশ দুটি অনেক দিন ধরেই কাজ করছে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, প্রেসিডেন্ট ওবামা বিশাল এক বাণিজ্যবহর নিয়ে নয়াদিল্লি সফর করেছিলেন। এর ফলে সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বাণিজ্য ৫০ মিলিয়ন থেকে বেড়ে (২০০৮) এখন প্রায় ১০০ বিলিয়নের কাছাকাছি। যদিও অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চাইবে। চীনকে ঘিরে ফেলার যে নীতি যুক্তরাষ্ট্র গ্রহণ করেছে, সেখানে ভারত তার অন্যতম মিত্র। সে কারণে জন কেরির সফরে বেশ আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছিল দুটি দেশেই।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে মার্কিন নীতিতে বেশকিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ষষ্ঠ নৌ-বহরের উপস্থিতি বাড়ানোর পাশাপাশি মালদ্বীপ ও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরে নীতিগতভাবে এক হয়েছে। মালদ্বীপের সঙ্গে একটি ঝঙঋঅ চুক্তি করতে চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এদিকে বাংলাদেশ ন্যাটোর সম্প্রসারিত ভূমিকার ব্যাপারেও আগ্রহ দেখিয়েছে। ন্যাটোর সূত্র থেকে জানা গেছে, গত ১৫ মে ব্রাসেলসে বাংলাদেশি কূটনীতিকরা ন্যাটোর কমান্ডারদের সঙ্গে কথা বলেন। প্রায় একই সময় পরাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনিও ব্রাসেলস সফর করেছিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে এখন অবধি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। বিষয়টি নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা রয়েছে এবং আমরা স্পষ্ট নই, এই কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ কতটুকু উপকৃত হবে। ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজিক কনসেপ্ট সম্পর্কে যারা ধারণা রাখেন, তারা জানেন ন্যাটোর লিসবন সম্মেলনে ২০১০ সালে এই ধারণাপত্র গ্রহণ করা হয়েছিল। এই ধারণাপত্রের মূল বিষয়টি হচ্ছে ন্যাটোর সাম্প্রসারিত ভূমিকা। ন্যাটোর কর্মকাণ্ড এখন আর শুধু ইউরোপেই সীমাবদ্ধ নেই; বরং তা দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রসরিত হয়েছে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, যুক্তরাষ্ট্র তার নৌ-বাহিনীর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কর্মকাণ্ড ভারত মহাসাগর এলাকায় সাম্প্রসারিত করেছে। আগামীতে মার্কিন ষষ্ঠ ফ্লিটের বেশক’টি জাহাজ দক্ষিণ এশিয়ার সমুদ্রসীমায় মোতায়েন করা হবে। যে কারণে বাংলাদেশে সম্ভাব্য মার্কিনি ভূমিকা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে গেল। অনেকেরই জানার কথা, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইতোমধ্যে একটি অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
এই তথাকথিত অংশীদায়িত্ব সংলাপ চুক্তির আওতায় দৃশ্যত বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদ দমন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ, শ্রমমান, পণ্যের শুল্ক ইত্যাদি বিষয় নিয়ে মতবিনিময় করলেও মূল বিষয় একটি যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীত নীতির ব্যাপারে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করা। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় যৌথ কর্মসূচি গ্রহণের আড়ালে এ অঞ্চলে মার্কিন সেনা মোতায়েনের বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না। বলা ভালো, প্রতি বছর একবার ‘অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি’র আওতায় বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র মিলিত হবে। প্রথম সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল গেল বছরের ১৯-২০ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনে। আর এবার দ্বিতীয় সংলাপ হলো ঢাকায় গত ২৬ মে। সংলাপ শেষে একটি ব্রিফিং করা হয় বটে, কিন্তু ‘ভেতরের অনেক কথাই’ জানানো হয় না। তাই বাংলাদেশ যখন ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করে, তখন গুজনের ডাল-পালা বেড়েছে এবং আগামীতে তা আরো ছড়াবে। গেল বছরের ১৮ জুন ইউরোপের দেশ ক্রোয়েশিয়ায় একটি ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ন্যাটোর ২৫টি সদস্য দেশের বাইরেও মোট ৫৫ দেশ অংশ নিয়েছিল। ওই সম্মেলনকে তারা বলছে Strategic Military Partnership Conference. যারা সরাসরি ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্র নয়, তারাও এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিল। ন্যাটোর সঙ্গে কাজ করতে পারে, এমন দেশগুলোকে ন্যাটোর নীতি-নির্ধারকরা মোট ৪ ভাগে ভাগ করেছে যারা ন্যাটোর সদস্য নয়, তবে ন্যাটোর সহযোগী। যেমন ইউরোপের ১২টি দেশকে নিয়ে গঠিত হয়েছে। The Partnership for peace. ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলভুক্ত আলজেরিয়া, তিউনেসিয়ার মতো দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত হয়েছে Mediterrian Dialogue Members. সৌদি আরব কিংবা ওমানের মতো দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত হয়েছে Istsmtul cooperation Initiative. অস্ট্রেলিয়া কিংবা জাপানের মতো দেশগুলোকেও ন্যাটো Poutners Accross the Globe এর ব্যাপারে একত্রিত করেছে। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানেও এই ব্যানারে রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে ন্যাটোর কোনো কর্মকাণ্ড নেই। এখন এল সালভাদর ও কলম্বিয়ার মতো দেশও ন্যাটোর সঙ্গে জড়িত হতে যাচ্ছে। মজার ব্যাপার ইউরোপে ন্যাটোর কমান্ডার অ্যাডমিরাল স্টাভরিডিস সম্প্রতি বলেছেন, তারা ভারত ও ব্রাজিলের মতো দেশকে নিয়ে ভাবছেন এবং আশা করছেন এই দেশ দুটো Partners Accross the Glove এর ব্যানারে আগামীতে ন্যাটোর কর্মকাণ্ডে শরিক হবে। ২০১২ সালে ন্যাটো লিসবন সম্মেলনে ন্যাটোর strategic concept গ্রহণ করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ক্রোয়েশিয়ায় সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এর মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয়ে গেল একুশ শতকে ন্যাটো নতুন এক কৌশলগত ধারণা নিয়ে উপস্থিত হচ্ছে। ন্যাটোর এই ভূমিকা, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক মিসরকে কর্তৃত্ব করার প্রবণতা নতুন করে øায়ুযুদ্ধের জন্ম দিতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে প্রভাব বলয়কে কেন্দ্র করে জন্ম হয়েছিল øায়ুযুদ্ধের। আর ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্যে দিয়ে সেই øায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটেছিল। আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ওয়ারশ সামরিক জোট ভেঙে দেয়া হলেও, ন্যাটো জোট ভেঙে দেয়া হয়নি।
বরং এর সম্প্রসারণ ঘটেছিল। øায়ুযুদ্ধ চলাকালীন ন্যাটো ও ওয়ারশ জোটের মধ্যে সামরিক প্রতিযোগিতা এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে উন্নীত হয়েছিল যে ইউরোপে একাধিকবার ‘পারমাণবিক যুদ্ধ’-এর সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ‘যুদ্ধ’ হয়নি বটে, কিন্তু বিংশ শতাব্দীর পুরোটা সময় এই দুই শক্তির মাঝে প্রতিযোগিতা বজায় ছিল। দুই পরাশক্তিই ইউরোপে পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র মোতায়েন করেছিল। শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরই এই øায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটে। এর প্রধান কারণ ছিল একটি রাশিয়া এখন আর ইউরোপের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি নয় । দুটি আদর্শের (সমাজতন্ত্র বনাম পুঁজিবাদ) মাঝে যে দ্বন্দ্ব ছিল, সেই দ্বন্দ্বেরও অবসান ঘটে, যখন রাশিয়া আদর্শ হিসেবে মুক্তবাজার ও পুঁজিবাদকে গ্রহণ করে। উপরন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার অনেক আগেই ১৯৮৮ সালে গরবাচেভ ওয়ারশ সামরিক জোট ভেঙে দিয়েছিলেন।
যে কারণে ইউরোপে রাশিয়ার উত্থান যুক্তরাষ্ট্র তথা ইউরোপের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি নয়। আর তাই নতুন করে এই অঞ্চলে øায়ুযুদ্ধের জšে§র সম্ভাবনাও ক্ষীণ। এখন ভারত মহাসাগর হচ্ছে সম্ভাব্য ক্ষেত্র যেখানে নতুন করে øায়ুযুদ্ধের জন্ম হতে যাচ্ছে। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে চীন। চীনকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ভয় ও শঙ্কা এখন অনেক বেশি। প্রথাগত, তত্ত্বগতভাবে চীন তখন আর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। কিন্তু একটি অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীন এখন বিশ্বকে কর্তৃত্ব করছে। চীন বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হওয়ায় তা এখন মার্কিন স্বার্থকে আঘাত করছে। দ্বিতীয়ত যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে নিজের অভ্যন্তরীণ বাজারকে সচল রাখছে। এটা মার্কিন নীতি নির্ধারকদের অনেকেরই অপছন্দের । গত ৮ জুন নয়া চীনা প্রেসিডেন্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন। এই সফরে ওবামার সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক হয়েছে। কিন্তু তারপরও কিছু ইস্যুতে বিরোধ করেছে। তৃতীয়ত, দক্ষিণ এশিয়া তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের প্রভাব বাড়ছে। এটা মার্কিনিদের চিন্তার কারণ। বিশেষ করে ভারত মহাসাগর ও আফগানিস্তানের ব্যাপারে তাদের আশঙ্কার কারণ রয়েছে যথেষ্ট। ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য ও সেই সঙ্গে সব বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে না। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। এ কারণেই তথাকথিত ‘অংশীদারিত্ব চুক্তি’ করছে যুক্তরাষ্ট্র। এবং ন্যাটোকে ব্যবহার করে এ অঞ্চলে তার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ প্রোগ্রাম এক ধরনের কর্মসূচি, যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার উপস্থিতিকে নিশ্চিত করতে চায়।
দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে একটা পরিবর্তন এসেছে। পাকিস্তানে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে নওয়াজ শরিফ তৃতীয়বারের মতো সেদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তিনি ইতোমধ্যে পাকিস্তানে মার্কিনি ড্রোন বিমান হামলা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। ভারতে আগামী বছর নির্বাচন হওয়ার কথা। সেই নির্বাচন এ বছর এগিয়ে নিয়ে আসা হতে পারে। নেপালে জুন মাসেই নির্বাচন হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায়। আর বাংলাদেশে ২৫ অক্টোবর হচ্ছে সংসদের শেষ দিন। এরপর ৩ মাসের মধ্যে নির্বাচন। সুতরাং এ অঞ্চলে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মার্কিনি নীতির ব্যাপারটিও লক্ষণীয়। এ অঞ্চলে, বিশেষ করে ভারত মহাসাগরে মার্কিন স্বার্থ রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কখনও চাইবে না তার স্বার্থ বিঘিœত হোক।
সম্প্রতি নতুন করে যে বিতর্কের জন্ম হয়েছে তা হচ্ছে ভারত মহাসাগরকে ঘিরে নতুন করে একটি øায়ুযুদ্ধের জন্ম হতে যাচ্ছে। বিশেষ করে গত বছরের ৩১ মে ভারতের প্রভাবশালী টিভি চ্যানেল টাইম নাউ-এর প্রতিবেদন এবং মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্যানেটার সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত গাংগ্রি-লা সম্মেলনকে যুক্তরাষ্ট্রের ৬০ শতাংশ নৌশক্তির এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিয়োজিত করার ঘোষণার পর এ ধারণাটি এখন বদ্ধমূল হয়েছে যে, চলতি একুশ শতকেই øায়ুযুদ্ধের ‘নতুন এক রূপ’ আমরা দেখতে পাব। যারা আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা রাখেন তারা জানেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের প্রভাব বলয়কে কেন্দ্র করে প্রথম øায়ুযুদ্ধের জন্ম হয়েছিল। ইউরোপের কর্তৃত্ব কার হাতে থাকবে এটা নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। ইউরোপ মূলত দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল একদিকে পশ্চিম ইউরোপ, যে দেশগুলো পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও পুঁজিবাদনির্ভর গণতন্ত্রকে তাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। অন্যদিকে পূর্ব ইউরোপ, যে দেশগুলো সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গ্রহণ করেছিল এবং সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করেছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার আগ পর্যন্ত পরস্পরবিরোধী এই দুই আদর্শের মধ্যে লড়াই আমরা প্রত্যক্ষ করি। øায়ুযুদ্ধকে বলা হয় এমন একটি ‘যুদ্ধ’ যে ‘যুদ্ধ’ হয়নি বটে, কিন্তু তা ছিল যুদ্ধের চাইতেও ভয়ঙ্কর। আজ নতুন আঙ্গিকে øায়ুযুদ্ধের জন্ম হতে যাচ্ছে। প্রতিপক্ষ হচ্ছে চীন। গত ৮ জুন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতে ওবামা ও নয়া চীনা প্রসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও স্পষ্টত দু দেশের মাঝে বিরোধ রয়ে গেছে। এমনি এক প্রেক্ষাপটে জন কেরি নয়াদিল্লি সফর করলেন। বাংলাদেশেও যুক্তরাষ্ট্রেরস্বার্থরয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে ‘আকসা’ নামে একটি চুক্তি করতে চায়। প্রস্তাবিত আকসা চুক্তি অনুয়ায়ী যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ‘গাইডেড মিসাইল’ সরবরাহ করবে। বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্রবাহিনীর জ্বালানি সংগ্রহ, যাত্রাবিরতি, সাময়িক অবস্থানসহ বাংলাদেশে ‘পোর্ট অব কল’ সুবিধা পাবে। তবে এই চুক্তি বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষা করতে পারবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত ‘টিকফা’ চুক্তি নিয়েও কথা আছে। তাই জন কেরি যখন নয়াদিল্লি সফর করলেন তখন সঙ্গত কারণেই এসব বিভিন্ন মহলে আলোচিত হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতি নতুন করে আলোচনায় আসবে। যদিও জিএসপি সুবিধা, পোশাক শিল্পের শ্রমমান, শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের
হত্যাকাণ্ড, ড. ইউনূস ইস্যু ইত্যাদি বেশ কটি ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের কিছুটা অবনতি হয়েছে। তারপরও বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিনী আগ্রহ থাকবেই। এ ক্ষেত্রে মার্কিন-ভারত সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশ এই প্রভাবের বাইরে থাকতে পারবে না।


0 comments:

Post a Comment