রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বর্তমানে যা গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাড়িয়েছে

আসল কথাটি বলে ফেলেছেন মনমোহন সিং, ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, রাহুল গান্ধীই ভারতের প্রধানমন্ত্রী। রাহুল গান্ধী কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর বড় সন্তান ও কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক। রাহুল গান্ধী প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সন্তান। ভারতে রাহুল গান্ধীকে নিয়ে বিতর্ক অনেক দিনের। মনমোহন সিং একাধিকার তাকে মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানালেও সেই আমন্ত্রণ তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। এখন মনমোহন সিংয়ের ঘোষণার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, কংগ্রেস বা ইউপিএ জোট যদি আগামীতে সরকার গঠন করতে পারে, তাহলে রাহুল গান্ধীই হবেন সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী। ২০১৪ সালে সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।

ভারতের রাজনীতিতে নেহরু পরিবার যে ধারা সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন তারই ধারাবাহিকতায় এখন রাহুল গান্ধীর জন্য ‘ক্ষেত্র’ প্রস্তুত হচ্ছে। এই পরিবারের মূল ব্যক্তি ছিলেন মতিলাল নেহরু, যিনি ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর দাদা। মতিলাল অসহযোগ আন্দোলনের সময় ১৯২১ সালে কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার বড় সন্তান জওহর লাল নেহরু কংগ্রেসের সভাপতি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন (১৯৪৭-১৯৬৪)। জওহর লাল নেহরু জীবদ্দশায় কন্যা ইন্ধিরা গান্ধীকে কংগ্রেসের সভানেত্রী বানিয়েছিলেন ১৯৬৪ সালে। নেহরু মন্ত্রিসভায় তিনি মন্ত্রীও ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী তার নিজ দেহরক্ষীদের হাতে নিহত হলে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে হয়েছিল ইন্দিরার বড় সন্দান রাজীব গান্ধীকে (১৯৮৪-১৯৯১)। তবে ইন্দিরা গান্ধী দ্বিতীয়বার ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার আগে কংগ্রেসের বাইরে মোরারজি দেশাই (১৯৭৭-৭৯), চরন সিং (১৯৭৯-৮০) ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। নেহরু পরিবার ১৯৯১ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন ছিল। এরপর নেহরু পরিবার আর প্রধানমন্ত্রীর পদ পায়নি। এতদিন পর সম্ভবত রাহুল গান্ধীই হতে যাচ্ছেন ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী! যদিও এখন অবদি মন্ত্রী পদে তার অভিষেক হয়নি। উপমহাদেশে এটা রাজনৈতিক সংস্কৃতি। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সন্তানরা রাজনীতিতে আসেন এবং এক সময় প্রধানমন্ত্রী হন। পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের কন্যা কুলসুমের রাজনীতিতে অভিষেক ঘটেছে। বাংলাদেশে অনেক আগেই তারেক রহমানের রাজনীতিতে অভিষেক হয়েছে। তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। অতি সম্প্রতি তাকে নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে।
তারেক জিয়া প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বড় সন্তান। মা বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপার্সন। পারিবারিক রাজনীতির ধারাই তাকে রাজনীতিতে টেনে নিয়ে এসেছে। যেমনি এনেছিল শেখ হাসিনাকে। আমরা ভারতে নেহরু-গান্ধী পরিবারের দৃষ্টান্ত দিয়েছি। পাকিস্তানে ভুট্টো পরিবারের কথা বলি। পারিবারিক রাজনীতির ধারায় তারা রাজনীতিতে এসেছেন। কিন্তু আমরা কি জানি ভারতে এই পারিবারিক রাজনীতির ধারা শুধু নেহরু-গান্ধী পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। ভারতে এ ধরনের বেশকিছু পরিবারের জন্ম হয়েছে, যারা পারিবারিক রাজনীতির ধারা অনুসরণ করে রাজনীতি করে যাচ্ছেন। প্রাচীন ভারতীয় একটি শ্লোক হচ্ছে Vasudua Kutumbikam। এর ইংরেজি করা হয়েছে এভাবে ‘all the universe is a family। অর্থাৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই হচ্ছে একটি পরিবার। রাজনীতিতে পারিবারিকরণের পেছনে ভারতে এই সংস্কৃতির শ্লোকটি আদর্শ হিসেবে কাজ করে। তাই ভারতে রাজনীতিতে পারিবারিকরণের বিষয়টি স্বাভাবিক একটি বিষয়। কেউ এটা নিয়ে কথাও বলে না। প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় এসব রাজনীতি পরিবারের সন্তানরা উচ্চশিক্ষিত, বিদেশ থেকে ডিগ্রিধারী। এই তরুণ প্রজšে§র কারণেই ভারত অর্থনীতিতে জাপানকেও অতিক্রম করল। কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিই। এক সময় ভারতে সীমিত সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী ছিলেন চরন সিং। তার ছেলে অজিত সিং এখন বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করছে। দেবগৌড়াও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তার ছেলে এখন কর্নাটক রাজ্যর মুখ্যমন্ত্রী। সারদ পাওয়ার ভারতের কৃষিমন্ত্রী। তার মেয়ে সুপ্রিয়া সুলে এখন সংসদ সদস্য। মন্ত্রী ফারুক আব্দুল্লাহর ছেলে ওমর আবদুল্লাহ এখন কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী। তার জামাই শচীন পাইলট রাহুল গান্ধীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শচীনের বাবা রাজেশ পাইলটকে রাজীব গান্ধী রাজনীতিতে নিয়ে এসেছিলেন। বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ মুলায়ম সিং যাদবের ছেলে অখিলেশ যাদব এখন এমপি এবং ভবিষ্যৎ উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। তামিলনাড়–তে করুণানিধি পরিবার রাজনীতিতে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। ৮২ বছর বয়সেও তিনি মুখ্যমন্ত্রী। ছেলে স্ট্যালিন উপ-মুখ্যমন্ত্রী। আরেক ছেলে আজহাগিরি কেন্দ্রে কোয়ালিশনের কোটায় মন্ত্রী। ভাইয়ের ছেলে দয়ানিধ মারানও কেন্দ্রের মন্ত্রী। স্ত্রী ও মেয়ে কানিমাধা রাজনীতিতে সক্রিয় ও এমপি। পাঞ্জাবে বাদল পরিবার, বিহারে যাদব পরিবার, মধ্য প্রদেশে পাওয়ার পরিবার, অন্ধ্র প্রদেশে রেড্ডি পরিবার যুগের পর যুগ রাজ্য রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এক সময়ের দক্ষিণের ছবির নায়ক বামারাও সেখানকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। স্ত্রী, উপপতিœ আর সন্তানরা এক ধরনের প্রভাব বলয় তৈরি করেছেন সেখানে। অনেকটা কর্পোরেট হাউসের মতো তারা রাজ্য চালান। আরো দৃষ্টান্ত দেয়া যায়। মনিপুরের পিএ সংমার মেয়ে অগাথা সাংমা মাত্র ৩০ বছর হওয়ার আগই কেন্দ্রের মন্ত্রী। রাজস্থানে সিন্ধিয়া রাজপরিবার আবার বিভক্ত। রাজমাতা সিন্ধিয়া করেন বিজেপি। ছেলে মাধব রাও কংগ্রেস সদস্য। বোন বসুন্ধরা রাজে রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী (বিজেপি)। সাবেক মন্ত্রী (দলিত) জগজীবন রামের মেয়ে মিরা কুমারী এখন লোকসভার স্পিকার। উড়িষ্যাতে পাটনায়েক পরিবার ছাড়া অন্য কিছু চিন্তা করাও যায় না। তার নিজের নামেই এখন একটি দল। রাজনীতিতে পারিবারিকরণ ভারতীয় গণতন্ত্রের একটি অন্যতম দিক।
শুধুই কি পাক-ভারত-বাংলাদেশেই এই রাজনীতি! ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট কোরাজান আকিন্যের ছেলে সে দেশের প্রেসিডেন্ট এখন। ২৩ জন সিনেটারের মধ্যে ১৫ জন এসেছেন পারিবারিক ধারায়। আফ্রিকার দেশ এঙ্গোলার প্রেসিডেন্ট জোসে এদোয়র্দো ডস সানটস (১৯৭৯ সাল থেকে) এর কাজিন ফানানদো দা পিদাদে দায়াসা ডস সানটস সে দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট। মেয়ে ইসাবেল সানটস এঙ্গোলার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি এবং মন্ত্রী। আর্জেন্টিনার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট নেসতার কিরচনার (২০০৩-২০০৭) স্ত্রী ক্রিস্টিনা কিরচনার এখন সে দেশের প্রেসিডেন্ট। সেনা কর্মকর্তা ইয়ান পেরেন (১৯৪৬-৫৫, ১৯৭৩-৭৪) প্রেসিডেন্ট হয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় তার স্ত্রী মারিয়া পেরেনও প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন (১৯৭৪-৭৬)। আজারবাইজানে (হায়দার আলিয়েভের ছেলে ইলহাম আলিয়েভ), বতসোয়ানায় (সেরেটসের খামা ও স্ত্রী রুথ খামা এবং ছেলে ইয়ান খামা), মিয়ানমারে (অং সান-এর মেয়ে অং সান সুকি), কঙ্গোতে (ল’রা কাবিলা ও তার ছেলে জোসেফ কাবিলা), জায়ারের (সেসে সেকো মবুতুর ছেলে নাজাঙ্গা মবুতু) দৃষ্টান্তও আমরা দিতে পারি। এই তালিকা আরো বাড়ানো যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও (বুশ পরিবার) এই প্রবণতা রয়ে গেছে। সুতরাং তারেক রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে আসবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। এই ধারাবাহিকতায় প্রধামন্ত্রীর পুত্র ও বঙ্গবন্ধুর নাতি সজীব ওয়াজেদ জয়ও রাজনীতিতে আসবেন, সেটা আজ অথবা কাল। রাজনীতিতে তাকে আসতে হবেই। তবে যত দ্রুত তিনি রাজনীতিতে আসবেন, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। জয় ইতোমধ্যে রংপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত হয়েছেন। প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণ করেছেন। তবে সক্রিয় নন। ধারণা করছি আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে আমরা তাকে সক্রিয় হতে দেখব। অন্যদিকে তারেক রহমান অনেক আগেই সক্রিয় হয়েছেন। জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনি গ্রাম থেকে গ্রামে গেছেন, যেটা এক সময় তার বাবা শহীদ জিয়া করতেন। রাজনীতিতে থাকলে অভিযোগ উঠবেই। তার বিরুদ্ধেও উঠেছে। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ২০টি, যার মধ্যে রয়েছে সিঙ্গাপুরে ২০ কোটি টাকার বেশি অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অভিযোগ, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা ইত্যাদি। তার মধ্যে আয়কর ফাঁকির অভিযোগও রয়েছে। এর মাঝে কতগুলোর সত্যতা রয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সরকার মামলাগুলো সক্রিয় করেছে। শিগগিরই শুনানির তালিকায় মামলাগুলো দেখা যাবে। আর বিএনপির ভাষ্য হচ্ছে, ‘সরকারের এ ধরনের উদ্যোগ তারেক রহমানকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার জন্যই। সরকার এভাবে দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’ লন্ডনে তারেক রহমানের একটি বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক মন্ত্রী যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন তাতে করে বিএনপির ভাষ্যকেই সত্য বলে ধরে নিতে পারেন অনেকে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তারেক রহমান মন্ত্রী বা এমপি ছিলেন না। তিনি ‘ক্ষমতাবান’ ছিলেন এটা সত্য। যদি তিনি অন্যায় করে থাকেন, অবশ্যই আইন তা দেখবে। কিন্তু যেভাবে এবং যে ভাষায় তাকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখা হয়েছিল তা অশোভন ও রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত। রাজনীতিবিদদের মধ্যে ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত। আমরা যদি অপর পক্ষকে সম্মান জানাতে না পারি, তাহলে নিজেও সম্মান পাব না। রাজনীতিবিদদের মধ্যে আস্থা, বিশ্বাস ও সৌহার্দ্য না থাকলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হবে না। গণতন্ত্রকে আমরা উচ্চতর পর্যায়েও নিয়ে যেতে পারব না।
একুশ শতকে এসে এই পারিবারিক রাজনীতির ধারা আমরা অস্বীকার করতে পারব না। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে পারিবারিক রাজনীতির ধারা গণতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নেহরু ভারতকে গোটা বিশ্বের কাছে পরিচিত করেছিলেন। সুকর্নো ছিলেন জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা, যা ইন্দোনেশিয়াকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে চিনত বাংলাদেশ। আর জিয়াউর রহমান মুসলিম বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিলেন নতুন এক বাংলাদেশকে। তাই পারিবারিক রাজনীতি নিয়ে যারাই প্রশ্ন তোলেন, তারা ভুল করেন। এই পারিবারিক রাজনীতি বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা কিংবা নেপালের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অংশ। এটাকে উপেক্ষা করা যাবে না। বাংলাদেশে যে তরুণ নেতৃত্ব একুশ শতকে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে তা আসবে এই পারিবারিক রাজনীতির কাছ থেকেই। এখন শুধু অপেক্ষার পালা।

0 comments:

Post a Comment