রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

শিক্ষকদের অসন্তোষের কথা ।। নতুন পে স্কেল


নতুন পে স্কেল অনুমোদিত হয়েছে গত ৭ সেপ্টেম্বর। এই পে স্কেল নিয়ে বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তারা ৮ সেপ্টেম্বর একদিন সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মবিরতি পালন করেছেন। তারা আগামীতে বড় ধরনের কর্মসূচি নিতে পারেন, এমন কথাও গণমাধ্যমকে জনিয়েছেন শিক্ষক ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ। শিক্ষকদের অসন্তোষ নিয়ে কথা বলার আগে নতুন পে স্কেল নিয়ে সোজাসাপটা কিছু কথা বলা প্রয়োজন। এতে করে সরকারি কর্মচারীদের বেতন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। মূল ২০টি গ্রেড থাকলেও আসলে গ্রেড ২২টি। মুখ্য সচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও তিন বাহিনীর প্রধানকে সবার উপরে স্থান দেওয়া হয়েছে। এই পাঁচ ব্যক্তির বেতন ও গ্রেড-১ এর বেতনের চাইতে ৮ হাজার টাকা বেশি। এখানে এক ধরনের ‘শ্রেণিবৈষম্য’ তৈরি করা হয়েছে। সিনিয়র সচিব ও একই পদমর্যাদার সশস্ত্র বাহিনী কর্মকর্তাদের বেতন ৮২ হাজার টাকা নির্ধারণ করেও ‘আরও একটি বৈষম্য’ সৃষ্টি করা হয়েছে। তারাও গ্রেড ১-এর উপরে স্থান পেয়েছেন। স্পষ্টতই বিশেষ দুটি ‘গ্রেড’ সৃষ্টি করে ‘বিশেষ বিশেষ শ্রেণির’ কিছু লোককে ‘খুশি’ করার একটি প্রবণতা লক্ষ করা যায়। নববর্ষ ভাতা চালু করে পেনশনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। এখন বাতিল হলো টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড। এটা ঠিক, চাকরিজীবনে অনেকেই সিলেকশন গ্রেড পান না। টাইম স্কেলও পান না। ফলে এটা না থাকায় অনেকেই স্বীকার করবেন তা ঠিক আছে। কিন্তু প্রশ্ন আছে অনেকটি। প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, কিছু মানুষের কাছে (২১ লাখ সরকারি কর্মচারী) টাকার পরিমাণ বাড়বে। কিন্তু সাধারণ মানুষ এতে উপকৃত হবে না। কেননা বাজারে টাকার জোগান বেড়ে গেলে দেশে মুদ্রাস্ফীতি ঘটবে। তাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। দ্বিতীয় প্রশ্ন, বেসরকারি সেক্টরে জনবল বেশি। এখন বেসরকারি খাতেও বেতন বাড়ানোর চাপের মুখে থাকবে। এ ক্ষেত্রে সব বেসরকারি খাতের পক্ষে এই বেতন বাড়ানো সম্ভব হবে না। ফলে বেসরকারি খাতে এক ধরনের অসন্তোষ তৈরি হবে। তৃতীয় প্রশ্ন, দুর্নীতি আমাদের সমাজজীবনে একটি সাধারণ চিত্র। এখন দুর্নীতির পরিমাণ যদি বেড়ে যায়, তা সাধারণ মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। চতুর্থ প্রশ্ন, বেতন বৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে অসাধু বাড়িওয়ালা, পরিবহন ব্যবসায়ী, খুচরা ব্যবসায়ী, আমদানিকারকরা ‘সুযোগ’ গ্রহণ করবেন। বাড়িভাড়া বাড়বে। জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। আমদানি করা জিনিসপত্রের দাম চলে যাবে ক্রয়সীমার বাইরে। এতে তো সাধারণ মানুষ আর পেনশনভোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন! বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ করার কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। এ নিয়ে আদালতে মামলা হলেও তাতে কোনো ফয়সালা হয়নি। উপরন্তু ২১ লাখ সরকারি কর্মচারীর একটা অংশ সরকারি আবাসন সুবিধা পায়। একটা বড় অংশ, বেসরকারি সেক্টরে কর্মরতদের বড় অংশ বাসা ভাড়া করে থাকেন। তারা এখন ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এই পে স্কেলে খুশি হননি। তাদের যুক্তি, সিনিয়র শিক্ষকরা এখন ‘সিলেকশন গ্রেড’ বাতিল হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তারা সচিব পদমর্যাদার গ্রেড ১-এর সুযোগ-সুবিধা, বেতনও পাবেন না। প্রশ্ন উঠতেই পারে, সচিবরা নিজেদের সুবিধার জন্য যদি সিনিয়র সচিবের পদ সৃষ্টি করতে পারেন, তাহলে শিক্ষকদের জন্য সিনিয়র অধ্যাপকের পদ নয় কেন? দ্বিতীয়ত, বেতন স্কেলে (অধ্যাপকের সিনিয়র অধ্যাপক নন) গ্রেড এখন ৩-এ। অর্থাৎ তার বেতন শুরু হবে ৫৬ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে। রাষ্ট্রের ‘ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সি’তে তাদের অবস্থান অনেক নিচে, যুগ্ম সচিবেরও নিচে। এটা কি শোভন? একজন অধ্যাপককে কি যুগ্ম সচিবের সঙ্গে তুলনা করা যায়? তাহলে একজন উপাচার্যের পদমর্যাদা কী? তিনি যদি ‘সিলেকশন গ্রেড’ভুক্ত প্রফেসর না হয়ে থাকেন (৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজনও ‘সিলেকশন গ্রেড’ভুক্ত প্রফেসর নন), তাহলে তার পদমর্যাদা কী হবে? ঢাকা বা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা কি সরকারি কোনো অনুষ্ঠানে তার ‘ছাত্রতুল্য’ যুগ্ম সচিবদের সঙ্গে বসবেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কি তাই করবেন? সচিবরাই এ কাজটি করলেন। তারা নিজেদের শিক্ষকদের চেয়েও উপরে রাখলেন। অথচ অনেক সচিবের ‘ভুয়া ডিগ্রি’ আছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করেছেন এ সংখ্যাও কম নয়। এমনকি অনেকে ‘ভুয়া পিএইচডি’ ডিগ্রি ব্যবহার করেন। অনেক সিনিয়র সচিবের নামের আগে ইদানীং দেখি তারা ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রি ব্যবহার করেন। কীভাবে পেলেন এই ডিগ্রি? কোথায় করলেন? এখন তারাই যদি নিজেদের সিনিয়র অধ্যাপকদের উপরে রাখেন তা দুঃখজনক। সচিব আর আমলা কখনো এক হতে পারে না। তাদের কাজের ধরন আলাদা। একজন সচিব যে শুধু এখন বেশি বেতন পাবেন, তাই নয়। তাদের সুযোগ-সুবিধা কয়েক লাখ টাকার সমান। যেমন একজন সচিব সার্বক্ষণিক তিনটি গাড়ি ব্যবহার করেন। তার স্ত্রী রাষ্ট্রের কর্মচারী নন। রাষ্ট্রীয় কাজে তিনি কোনো অবদানও রাখেন না। অথচ তিনি সার্বক্ষণিক একটি গাড়ি ব্যবহার করেন! বিভিন্ন প্রকল্প থেকে গাড়ি নিয়ে তা ব্যবহার করেন তার সন্তানরা। যে ‘বাংলোবাড়ি’তে তিনি থাকেন, তার বাসাভাড়া হিসাব করলে মাসপ্রতি ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা। তাদের জন্য গ্যাস, বিদ্যুৎ বিল খুব সম্ভবত ‘ফ্রি’। গাড়ির অকটেন, গ্যাস ‘ফ্রি’। হিসাব করুন এই রাষ্ট্র একজন সচিবের জন্য কী খরচ করে? সেই তুলনায় একজন শিক্ষক কী পান? ওই বেতনই তার একমাত্র ভরসা। আমি কয়েক ডজন অধ্যাপককে চিনি, যাদের গাড়ি নেই, বাড়ি নেই, চলেন রিকশাতে আর লক্কর মার্কা বাসে। রাষ্ট্র তাদের জন্য ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি কেনার ব্যবস্থা করে দেয়নি। কিংবা সরকারি ব্যাংক থেকে কম সুদে বাড়ি, ফ্যাট বা গাড়ি ক্রয় করার ব্যবস্থা করে দেয়নি! অথচ তারাই তথাকথিত ‘সমাজ গড়ার কারিগর’। তারাই সচিবদের ‘জন্ম’ দিয়েছেন, তৈরি করেছেন, শিক্ষিত করেছেন।
আর এই সচিব কমিটিই তাদের অমর্যাদা করল। অর্থমন্ত্রী যে ‘ভাষায়’ শিক্ষকদের সমালোচনা করেছেন তা ছিল অনাকাক্সিক্ষত। একজন অবিবেচক মানুষ তিনি। তিনি যে মনে-প্রাণে একজন আমলা, সেটাই তিনি প্রমাণ করলেন! পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জ্ঞানের গভীরতা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন! তার মতো একজন ‘সিনিয়র সিটিজেনের’ কাছ থেকে আমরা এটা আশা করিনি। তার অনাকাক্সিক্ষত বক্তব্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে সরকারকে একটা মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। তিনি অবশ্য তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। কিন্তু ‘ক্ষতি’ যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। এটা সত্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ‘সবকিছুর ঊর্ধ্বে’ নন। এটা আমি মনেও করি না। যাদের শিক্ষক হওয়ার কথা ছিল না, তারা ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ শিক্ষক হয়েছেনÑ এটা অস্বীকার করা যাবে না। যে যে বিভাগের ‘ছাত্র’ নন, তাকে সেই বিভাগে ‘বিশেষ বিবেচনায়’ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পদোন্নতির নীতি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক তা বলা যাবে না। এ ব্যাপারে অনেক সরকারি আমলার মধ্যে আমি এক ধরনের ‘ক্ষোভ’ দেখেছি। আমার ছাত্র যারা আমলা হয়েছে, তাদেরও দেখেছি এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে!
এখন অর্থমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করেছেন বটে কিন্তু সবকিছু ‘শেষ’ হয়ে গেছে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। একটি মন্ত্রিপরিষদ কমিটি করে দেওয়া হয়েছে, যারা শিক্ষকদের দাবি-দাওয়াগুলো খতিয়ে দেখবেন। এখানেও একটা ভুল হয়েছে। উচিত ছিল শিক্ষকদের নিয়ে ওই কমিটি গঠন করা। কমিটিতে সচিবরা থাকলে তারা বিরোধিতা করবেন। তবে মন্ত্রিপরিষদের বিবেচনার জন্য কিছু প্রস্তাব রাখতে চাই। ১. বর্তমান পে স্কেলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষকদের (স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়) জন্য আলাদা বেতন কাঠামো তৈরি করা হোক। কমিটি সময় দিক ও সবার মতামত নিক এবং সব শ্রেণির প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত হোক এই কমিটিতে। ২. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদান নিষিদ্ধ করা হোক। এখন অনুমতি নিয়ে, বিনা অনুমতিতে, প্রাপ্ত সম্মানীর ১০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডে জমা দেওয়ার শর্তে (যা কেউই দেন না) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাস নেন, এটা বন্ধ হোক। ৩. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হোক। তাদের কোনো সুদ ছাড়াই গাড়ি, ফ্যাট কেনার ব্যবস্থা করা হোক। মূল বেতনের পাশে অতিরিক্ত আরও ১০ হাজার টাকা দেওয়া হোক ‘বিশেষ ভাতা’ হিসেবে, যাতে তারা নিরুৎসাহিত হন অন্যত্র কাস নিতে। ৪. সব বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি আইনের আওতায় আনা হোক। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একই পদোন্নতির নীতিমালা হোক। ৫. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে পিএসসির মতো আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হোক। ৬. তরুণ শিক্ষকদের পিএইচডি করতে ‘ফান্ড’-এর ব্যবস্থা করা হোক এবং পিএইচডি ছাড়া অধ্যাপক পদে পদোন্নতি নিষিদ্ধ হোক। ৭. অধ্যাপক পদে দুটি গ্রেড করা হোকÑ গ্রেড-১ ও গ্রেড-২। ‘সিলেকশন গ্রেড’ অথবা ১০ বছর অধ্যাপক পদে থাকা অধ্যাপকদের গ্রেড ১-এ পদোন্নতির ব্যবস্থা করা হোক। তবে শর্ত থাকে, তাকে একটি গবেষণামূলক বই লিখতে হবে। এ ছাড়া শিক্ষকদের গবেষণামূলক পাঠ্যবই প্রণয়নে উৎসাহিত করা হোক। ৮. পাস করার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষক হিসেবে (প্রভাষক) নিয়োগ নিরুৎসাহিত করা হোক। এর পরিবর্তে তাকে ন্যূনতম এক বছর একজন সিনিয়র শিক্ষকের অধীনে ‘গবেষণা’ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করার সুযোগ দেওয়া হোক।
মোট কথা, ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন (যা চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করছে) পরিবর্তন করে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি আইন করা হোক। শিক্ষকদের ‘দায়িত্ব ও কর্তব্য’ সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হোক। ‘ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সি’তে শিক্ষকদের অবস্থান তুলে দেওয়া হোক। এটা থাকুক শুধু সরকারি কর্মচারীদের জন্য। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এর কোনো দরকার নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখনো আন্দোলনে আছেন। সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা শুরু করা হোক। সরকারপ্রধানও তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
Daily Amader Somoy
13 September 2015

0 comments:

Post a Comment