রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

অভিবাসী সঙ্কট ও আগামীর ইউরোপ

সম্প্রতি সিরিয়া থেকে জার্মানে অভিবাসন প্রত্যাশী পরিবারের সন্তানে আইলান কুর্দির সলিল সমাধিকে কেন্দ্র করে সারা পৃথিবীতে অভিবাসন বিষয়টি জোরালোভাবে এসেছে। বিশেষ করে ইউরোপের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি গুরুতর। আইলানের মৃত্যু কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং অহরহ যা হচ্ছে তারই বহিঃপ্রকাশ। ইউরোপ এ মুহূর্তে অভিবাসন নিয়ে খুব চিন্তিত। অভিবাসী সংকট নিয়ে আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি সম্মেলনের আহ্বান করলেও দেখা গেছে, অভিবাসীদের বহন করার ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপ বিভক্ত হয়ে গেছে। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মরকেল অভিবাসীদের ইইউভুক্ত ২৮ দেশের মধ্যে বণ্টন করে দেয়ার প্রস্তাব করলেও পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশ তাতে আপত্তি জানিয়েছে। ফলে এ অভিবাসন সঙ্কটের গভীরতা বাড়ছে।
ব্যাপকসংখ্যক অভিবাসী ইউরোপে প্রবেশ ও প্রবেশের চেষ্টা সেখানে ইতোমধ্যে বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এই ব্যাপক সংখক অভিবাসীর ‘অনুপ্রবেশ’ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যে প্রশ্নটি অনেকেই করার চেষ্টা করেন তা হলো, হাজার হাজার অভিবাসী ইউরোপকে বেছে নিলেন কেন? ইউরোপ দীর্ঘদিন ধরেই ‘রাজনৈতিক আশ্রয়ধারীদের’ স্বর্গরাজ্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। গত ২০-৩০ বছরে হাজার হাজার শরণার্থী ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়ে সেখানে বসবাস করে আসছেন এবং সেখানকার নাগরিকত্বও অর্জন করেছেন। ইউরোপের নাগরিকরা, বিশেষ করে জার্মানি কিংবা স্ক্যান্ডেনেভিয়ান রাষ্ট্রগুলো বরাবরই শরণার্থীদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল ছিল। ফলে আফগানিস্তান, শ্রীলংকা কিংবা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে এরা এসব দেশে নতুন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিলেন। ফলে এসব দেশ রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থীদের জন্য একটি স্বর্গরাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। মানব পাচারকারীরা এটিকেই ব্যবহার করেছিল এবং তারা এ সুযোগটি গ্রহণ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা থেকে মানবপাচারের উদ্যোগ নেয়। সংখ্যক মানুষের ইউরোপে অভিবাসন ঘটেছে অবৈধভাবে। তবে আফ্রিকা থেকে যারা আসছেন, তারা মূলত অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য, উন্নত জীবন, ইউরোপের জীবনযাত্রা, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদিতে আকৃষ্ট হয়ে ইউরোপে পাড়ি জামানোর চেষ্টা করছেন অবৈধ উপায়ে। এমন খবরও শরণার্থীদের মুখ থেকে বের হয়েছে যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা ২ থেকে ৩ হাজার ডলার পর্যন্ত খরচ করেছেন অবৈধ পথে ইউরোপে যাওয়ার জন্য। আবার এমনও দেখা গেছে, দালালচক্র এসব শরণার্থীকে জিম্মি করে অবৈধভাবে অর্থ আদায় করছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ইউরোপে যাওয়ার ব্যাপারে অভিবাসীদের আগ্রহ বেশি কেন? এর একটা কারণ আমরা খুঁজে পেয়েছি যে, ইউরোপের অনেক নেতৃবৃন্দ এসব অভিবাসীর ব্যাপারে কিছুটা আগ্রহী! এর কারণ হচ্ছে, সেখানে জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির হার শূন্যতে নেমে এসেছে। অর্থাৎ পরিবারপ্রতি জনসংখ্যা বাড়ছে না। তরুণ প্রজন্ম তাদের নিজ নিজ পেশার প্রতি এত বেশি মনোযোগী যে, পৃথিবীতে সন্তান জন্ম দেয়ার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ কম। ফলে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী হ্রাস পাওয়ায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা চালানোর জন্য লোকের প্রচণ্ড অভাব অনুভূত হচ্ছে। জার্মানি একটি শিল্পোন্নত দেশ। তাদের ফ্যাক্টরিগুলো চালাতে লোক দরকার। ফলে তারা পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করছে শরণার্থীদের অনুপ্রবেশের। একসময় জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করলেই তা মঞ্জুর করা হতো। আশির দশকে হাজার হাজার আফগান নাগরিক জার্মানিতে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তারা সেখানকার অর্থনীতিতে বড় অবদান রেখেছেন। আজকে ঘুরেফিরে সেই পরিস্থিতি থেকে জার্মানি বেরিয়ে আসতে পেরেছে, এটা মনে হয় না। তাদের ‘শ্রমিক’ দরকার কারখানাগুলো চালানোর জন্য। যদিও এটা সত্য, ১৯৯০ সালের পর পূর্ব ইউরোপ থেকে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর অভিবাসন ঘটেছে জার্মানিতে। এরা শ্বেতাঙ্গ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত কোনো কোনো দেশের নাগরিক (যেমন-চেক, পোল্যান্ড)। এরা আইনগতভাবেই জার্মানিতে থাকার ও চাকরি করার অধিকার রাখেন। কিন্তু তারপরও জার্মানিতে শ্রমিক সঙ্কট রয়েছে। ফলে আজকে যারাই অবৈধভাবে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করছেন, তাদের সবার টার্গেট থাকে জার্মানিতে থাকার।

এটা সত্য, ইউরোপে এই অভিবাসী সমস্যা কোনো একটি দেশের সমস্যা নয়। বরং সমস্যাটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব দেশের। তাই এর সমাধান ইউরোপীয় ইউনিয়নকেই খুঁজে বের করতে হবে। ইতোমধ্যে জার্মানির উদ্যোগে বলকান রাষ্ট্রগুলোর একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মেরকেল অংশ নিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল একটাই-কী করে অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধ করা যায়। কিন্তু ভিয়েনা সম্মেলনে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। জার্মানি চাচ্ছে ঐক্যবদ্ধভাবে ইইউর এই সমস্যা মোকাবিলা করতে। কিন্তু স্পষ্টতই ইইউর নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিভক্তি আছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না ‘শেঙ্গেন জোন’ (২৬ দেশ)-এর সুযোগ গ্রহণ করে এ অঞ্চলে একটি পাচারকারীচক্র অত্যন্ত সক্রিয়। ইইউর অন্তর্ভুক্ত প্রায় সব দেশ এই ‘শেঙ্গেন জোন’-এর অন্তর্ভুক্ত। এই ‘জোন’-এ অন্তর্ভুক্ত যে কোনো একটি দেশে প্রবেশ করলে অন্য দেশে ভিসা ছাড়াই যাওয়া যায়। ফলে পাচারকারীরা হাঙ্গেরিকে ব্যবহার করছে। প্রতিদিন হঙ্গেরিতে পা রাখছেন প্রায় ৩ হাজার মানুষ। হাঙ্গেরি সার্বিয়ার সঙ্গে ১৭৫ কিলোমিটার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করছে, যাতে করে সার্বিয়া থেকে অবৈধ অভিবাসীরা হাঙ্গেরিতে প্রবেশ করতে না পারেন। একবার হাঙ্গেরিতে প্রবেশ করলে ইইউভুক্ত যে কোনো দেশে যাওয়ার সুযোগ তাদের জন্য তৈরি হয় এবং হাঙ্গেরিতে প্রবেশ করামাত্র ইইউর সব সুযোগ-সুবিধা তারা পাবেন। জার্মানি ইতোমধ্যে ইউরোপে প্রবেশ করা প্রায় ৩ লাখ ১০ হাজার শরণার্থীকে (জাতিসংঘের তথ্যমতে) ইইউভুক্ত প্রতিটি দেশে অভিবাসীদের সুযোগ দেয়ার আহ্বান জানালেও অনেক দেশই তাতে আপত্তি জানিয়েছে। হাঙ্গেরি ভিয়েনা সম্মেলনে অংশ নেয়নি। ফলে অভিবাসীদের নিয়ে একটা সমস্যা রয়েই গেছে। ব্যাপক সংখ্যক অভিবাসীর অনুপ্রবেশ ইউরোপে একটি শক্তিশালী ‘অভিবাসনবিরোধী’ মনোভাবের জন্ম দিয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জার্মানিতে উগ্র জঙ্গিবাদের আবার জন্ম হয়েছে। অভিবাসীদের আশ্রয়কেন্দ্রে হাতবোমা নিক্ষেপ ও আগুন দেয়ার ঘটনাও সেখানে ঘটেছে। সুইডেনে দক্ষিণপন্থি অভিবাসনবিরোধী রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়েছে। যুক্তরাজ্য যে নতুন অভিবাসী নীতি প্রণয়ন করছে, তাতে অবৈধ অভিবাসীদের জেল ও অর্থদ-ের বিধান রাখা হয়েছে। যুক্তরাজ্যের অভিবাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, ব্রিটেনে অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা এখন ৮০ লাখ। ২০০৪ সালে দেশটিতে মোট জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ ছিল অভিবাসী, যা এখন ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এসব অভিবাসীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে ভারতের। আর প্রথম ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ।

অবৈধ অভিবাসী ঠেকাতে ইউরোপের প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রের সীমান্তে বেড়া তৈরি হচ্ছে। ১৯৮৯ সালে বার্লিন দেয়ালের পতন নতুন এক ইউরোপের জন্ম দিয়েছিল। আজ ২৬ বছর পর নতুন করে আবার দেয়াল উঠছে-এ দেয়াল অবৈধ অভিবাসী ঠেকাতে। কিন্তু আদৌ কি এই অবৈধ অভিবাসন বন্ধ করা যাবে?

এ অভিবাসন প্রক্রিয়া কীভাবে বন্ধ হবে? যুদ্ধপীড়িত অঞ্চলে (সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া ও ইয়েমেন) যদি স্থিতিশীলতা ফিরে না আসে তাহলে মানুষ আশ্রয়ের জন্য দেশ ত্যাগ করবেই। একই সঙ্গে মানব পাচারকারীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা না হলে এই অবৈধ তৎপরতা বন্ধ হবে না কোনোদিনও। যুদ্ধপীড়িত অঞ্চলে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মোতায়েন করা জরুরি। বিশেষ করে সিরিয়ায়। একই সঙ্গে ‘অর্থনৈতিক অভিবাসন’ ঠেকাতে আফ্রিকায় বিনিয়োগ বাড়ানো ও কাজের ক্ষেত্র সৃষ্টি করা জরুরি। মানুষ যদি বেকার থাকে তখন উন্নত জীবনের আশায় তারা বের হবেই। এ মুহূর্তে যেসব অভিবাসী ইউরোপে প্রবেশ করেছেন, তাদের আশ্রয় দেয়া জরুরি। এখন এককভাবে জার্মানি সব শরণার্থীকে গ্রহণ করতে পারবে না। চ্যান্সেলর মরকেল আশঙ্কা করছেন, চলতি বছর জার্মানিতে আশ্রয় প্রার্থীদের সংখ্যা ৮ লাখে গিয়ে পৌঁছবে। এই সংখ্যা ২০১৪ সালের চেয়ে চারগুণ বেশি। তাই জার্মানিতে এটা নিয়ে যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় ধরনের মানবিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে ইউরোপের দেশগুলো। এর জন্য ইউরোপের দেশগুলো আদৌ দায়ী নয়। এখন যদি বিশ্বসম্প্রদায় সমস্যার মূলে না যায়, তাহলে এই শরণার্থী সমস্যার সমাধান করা যাবে না। এমনিতেই ইউরোপ নানা সমস্যায় আক্রান্ত। গ্রিসের অর্থনৈতিক সঙ্কটকে কেন্দ্র করে দেখা গেছে অর্থনৈতিকভাবে ইউরোপ মূলত বিভক্ত। এখানে ধনী রাষ্ট্র যেমন রয়েছে, তেমন রয়েছে গরিব রাষ্ট্রও। একক মুদ্রা (ইউরো) সেখানে কোনো সমাধান বয়ে আনতে পারেনি। এখন এর সঙ্গে যোগ হলো শরণার্থী সমস্যা। এ সমস্যা অর্থনৈতিক সমস্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে। তাই স্পষ্ট করেই বলা যায়, আগামী দিনগুলো ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর জন্য কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না।
Daily Ajkerpotrika 08.09.15

0 comments:

Post a Comment