একটি শিশুর ছবি। কতই বা বয়স হবে ৫ থেকে ৬ মাস। কংক্রিটের রাস্তায়
হামাগুড়ি দিচ্ছে, আর অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে পুলিশের দিকে। তুরস্ক-গ্রিস
সীমান্তে সিরীয় শরণার্থীদের আটকে দিয়েছে তুরস্কের পুলিশ। বিবিসির ক্যামেরায়
আটকে আছে ওই ছবি, যা বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় পাঁচ
কলামে ছাপা হয়েছে গত ২০ সেপ্টেম্বর। ছবি কথা বলে। নাম না জানা ওই শিশুটির
ভাগ্য ভালো, আয়লান তুর্কির মতো ওকে মৃত্যুবরণ করে সাগরের পাড়ে বালুতে পড়ে
থাকতে হয়নি। কিন্তু ওর চাহনি, ওর অব্যক্ত কথা, সিরীয় শরণার্থীদের ব্যাপারে
কোনো আশাবাদী করে না। এই শিশুটি বাবা-মায়ের সঙ্গেই ‘নিরুদ্দেশ পথে’ যাত্রা
শুরু করেছিল। কিন্তু আটকে দিয়েছে তুরস্কের পুলিশ। হয়তো বাবা-মায়ের চোখ
ফাঁকি দিয়ে ‘হাঁটতে না শেখা’ ওই শিশুটি একাই বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু
ক্যামেরার চোখ ওকে ফাঁকি দিতে পারেনি। ওই শিশুটির মতো শত শত শিশু তখন
হাঙ্গেরি, ক্রোয়েশিয়া আর সেøাভাকিয়ার পথে-প্রান্তরে, এমনকি জঙ্গলে। যাদের
ভাগ্য ভালো, তারা জার্মানিতে ঢুকতে পেরেছে। যাদের ভাগ্য ভালো নয়, তারা এখনো
পথে-প্রান্তরে, অনেকটা UNHCR-এর (জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা) মুখপাত্র
মেলিসা ফেমিংয়ের ভাষায়, ‘পিং পং বল’-এর মতো ইউরোপের এক সীমান্ত থেকে অন্য
সীমান্তে যাচ্ছে। ক্রোয়েশিয়া তাদের ফেরত পাঠাচ্ছে হাঙ্গেরিতে। হাঙ্গেরি
তাদের ঠেলে দিচ্ছে সেøাভেনিয়ার দিকে। কিন্তু কেউই এখন আর জার্মানি যাওয়ার
পথ খুঁজে পাচ্ছে না। প্রায় প্রতিটি দেশ তাদের সীমান্তে বেড়া দিয়েছে, যাতে
করে সিরীয় আর ইরাকি শরণার্থীরা ঢুকতে না পারে। জার্মানি তার সীমান্ত বন্ধ
করে দিয়েছেÑ তারা আর শরণার্থী নিতে পারছে না। এই শরণার্থী সমস্যা ইউরোপের
অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। UNHCR-এর মতে, ইতোমধ্যে ৫ লাখ ৪০ হাজার
শরণার্থী ইউরোপে ঢুকেছে। আর সব মিলিয়ে চলতি বছর রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের
সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ৭ লাখ ৯৪ হাজারে। ১ লাখ ৬০ হাজার শরণার্থীর জন্য
ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি ‘কোটা’ সিস্টেম আরোপ করেছে। কিন্তু পূর্ব ইউরোপ তাদের
জন্য বরাদ্দকৃত ‘কোটা’ (শরণার্থী) নিতে চাচ্ছে না। তাদের নেতৃবৃন্দের
বক্তব্যে বর্ণবাদের গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। শরণার্থীরা হাঙ্গেরিতে প্রবেশ
করলেও কেউই হাঙ্গেরিতে থাকতে চাচ্ছে না। সবার টার্গেট জার্মানি যাওয়ার।
জার্মানির শরণার্থীদের বহনের ঐতিহাসিক ও বাস্তবভিত্তিক কারণ রয়েছে। আমি বেশ কিছুদিন জার্মানিতে ছিলাম। সেখানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছি এবং কিছুদিন জার্মান সরকারের অনুবাদক হিসেবেও কাজ করেছি। অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি জার্মানি বরাবরই শরণার্থীদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি প্রায় ১২ লাখ জাতিগতভাবে উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়া জার্মান নাগরিককে গ্রহণ করেছিল। এরা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করে আসছিল। সেই থেকে মূলত শুরু। এরপর ষাটের দশকে যখন জার্মানি অন্যতম শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়, তখন তাদের প্রয়োজন হয়ে পড়ে কর্মীর, যারা আবাসন খাতে এবং শিল্প-কারখানায় কাজ করবে। ষাটের দশকে তাই জার্মানি, তুরস্ক, ভিয়েতনাম ও সাবেক যুগোসøাভিয়া, পোল্যান্ড থেকে প্রচুর ‘গাস্ট আরবাইটার’ (অর্থাৎ অতিথি শ্রমিক) গ্রহণ করে। এদের তৃতীয় জেনারেশন (যারা ইতোমধ্যে জার্মান নাগরিকত্ব পেয়েছে) এখন স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে। সিরিয়ার নাগরিক আমি কম পেয়েছি জার্মানিতে। তবে তিউনিশিয়া, ইরান ও ইরাকের নাগরিক আমি দেখেছি। সুতরাং ঐতিহাসিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে জার্মানির একটা যোগাযোগ ছিল। ব্রিটেন, ফ্রান্স ছাড়া অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোতে আরব দেশগুলো থেকে আসা জনগোষ্ঠীর অভিবাসন ঘটেছে, এটা বলা যাবে না। তাই শরণার্থীরা তাদের প্রথম পছন্দের তালিকায় জার্মানিকে রেখেছিল। বলা ভালো, জার্মানিতে অভিবাসন প্রক্রিয়া অনেক সহজ। ২০০৫ সালে জার্মানিতে নতুন একটি অভিবাসন আইন চালু হয়। তাতে বলা হয়, ‘জার্মানি হচ্ছে অভিবাসীদের দেশ।’ আগে এই আইনটি ছিল না। আমরা যখন আশির দশকে সেখানে পড়াশোনা করেছি, তখন অভিবাসন আইন বেশ কড়াকড়ি ছিল। এমনকি নাগরিকত্ব অর্জনের কাজটিও ছিল বেশ কঠিন। পরে ২০১২ সালে জার্মানি European Blue Card Lesislation আইনটি বাস্তবায়ন করে। এই আইনের মধ্য দিয়ে বিদেশ থেকে ‘বিশেষজ্ঞ’দের অথবা বিদেশি ছাত্ররা যারা জার্মানিতে পড়াশোনা করেছেন (যেমন আইটি সেক্টর, বিজ্ঞানী ইত্যাদি), তাদের কাজের অনুমতিপত্র ও থাকার অনুমতি দেওয়া হয়, যা আগে কখনো ছিল না। জার্মানিতে বর্তমানে আইটি সেক্টরে বেশ কিছু চিনা ও ভারতীয় ‘বিশেষজ্ঞ’ কাজ করছেন। তাদের নাগরিকত্বও দেওয়া হয়েছে।
ফলে সিরীয় শরণার্থীদের জার্মানির ব্যাপারে আগ্রহ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এছাড়া ইউরোপের কোনো কোনো দেশে (গ্রিস, ইতালি, পর্তুগাল) অর্থনীতিতে শ্লথগতি ও সেখানে বেকার সমস্যা বাড়লেও জার্মানি ছিল এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। জার্মানি ৩ দশমিক ৪১৩ ট্রিলিয়ন অর্থনীতির দেশ, যা বিশ্বের চতুর্থ বড় অর্থনীতি। মাথাপিছু আয় বছরে ৪১ হাজার ৯৫৩ ডলার। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে যেখানে বেকার সংখ্যা প্রায় ২০ ভাগ, সেখানে জার্মানিতে এই সংখ্যা মাত্র ৫ ভাগ। ফলে অনেকের কাছেই এই দেশের ব্যাপারে একটা ‘আকর্ষণ’ রয়েছে। জার্মানি তার অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে হলে, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী দরকার। পরিসংখ্যান বলছে, শতকরা ৩৮ জন মানুষ জার্মানিতে এখন একা থাকেন। সেখানে বয়স্ক লোকের সংখ্যা বাড়ছে। আর কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী হ্রাস পাচ্ছে। অনেক পরিবার সন্তান নিতে চাচ্ছেন না। তারা পেশার উন্নয়নের প্রতি এত বেশি গুরুত্ব দেন যে, সন্তান পালন করার ‘ঝুঁকি’ তারা নিতে চান না। অথচ অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে ‘কর্মী’ দরকার। ফলে ‘গাস্ট আরবাইটার’ তাদের দরকার। উপরন্তু এমন বেশ কিছু পেশা রয়েছে (যেমন রেস্টুরেন্ট কর্মী, আবাসন খাতের কর্মী, কনস্ট্রাকশন কর্মী, পরিচ্ছন্নতা কর্মী ইত্যাদি) যেখানে জার্মান নাগরিকরা কাজ করেন না বা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। ফলে তাদের ‘কর্মী’ দরকার। তাছাড়া জার্মানিতে ‘সামাজিক নিরাপত্তা’র বিষয়টি অত্যন্ত শক্তিশালী। অর্থাৎ একজন কর্মী, তিনি যদি বিদেশিও হন এবং তার যদি কাজ করার অনুমতিপত্র থাকে, তিনি যদি বেকার থাকেন, তাহলে রাষ্ট্র তাকে বেকার ভাতা দেবে, বাসা ভাড়া দেবে, সন্তানদের জন্য আলাদা ভাতা দেওয়া হবে এবং মাস শেষে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে খাবার ভাতা দেওয়া হবে। সব মিলিয়ে কাজ না করেও একজন তার পরিবারপ্রতি মাসে প্রায় ৩ হাজার ইউরো পাবেন। যে কোনো বিবেচনায় সিরিয়ার শরণার্থীদের জন্য এটা বড় পাওয়া। এই সুযোগটি তারা নেবেন, এটাই স্বাভাবিক। উপরন্তু অনেকে চিন্তা করেন তার সন্তানদের ভবিষ্যৎ। শরণার্থী মিছিলে আমি অনেক ছোট ছোট শিশু দেখেছি। অভিভাবকরা চিন্তা করেছেন তার সন্তানের ভবিষ্যৎ। উচ্চশিক্ষা নিতেও তাদের কোনো অর্থ ব্যয় করতে হবে না, যা আমেরিকা কিংবা ব্রিটেনে চিন্তাও করা যায় না। একজন অভিবাসী ভিয়েতনামের পরিবারের সন্তান এখন জার্মান মন্ত্রী। আমার দেখা অনেক বাংলাদেশি পরিবারের সন্তানরা এখন কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও পিএইচডি ডিগ্রিধারী। সিরীয়রা এই বিষয়টি মাথায় নিয়েছিলেন। হাঙ্গেরি কিংবা অন্য দেশে এই সুযোগটি কম। সেখানে সামাজিক নিরপত্তাও নেই। জার্মানিকে টার্গেট করেই তারা সিরিয়া ছেড়েছিল। জার্মান সরকারের এসব শরণার্থীর ব্যাপারে মূল আগ্রহের কারণÑ এসব শরণার্থীর প্রায় সবার বয়স ৩৫-এর নিচে এবং এদের সঙ্গে সন্তান আছে। অর্থ পরিষ্কারÑ এরা দক্ষ কর্মী হয়ে যাবেন এবং জার্মান অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে পারবেন, যেমনটি রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসীরা। ফলে শরণার্থীদের ব্যাপারে জার্মানিতে একটা ‘আগ্রহ’ তৈরি হয়েছিল এবং সেটা ছিল স্বাভাবিক। তবে এটাও সত্য, জার্মান সরকার যে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে শরণার্থীদের গ্রহণ করেছে, অন্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর কাছে এই মানবিকতা এতটুকুও স্থান পায়নি। বরং হাঙ্গেরি কিংবা চেক প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল উসকানিমূলক। তারা ‘ধর্মীয় প্রশ্ন’ তুলেও তাদের উগ্র মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে জার্মানি ছিল ব্যতিক্রম। জার্মানির একটি ‘কালো ইতিহাস’ আছে। জনগণের ভোটেই হিটলার বিজয়ী হয়েছিলেন এবং তার উগ্রবাদী নীতি জার্মানিকে বিশ্বের দরবারে অনেক ‘ছোট’ করেছিল। হাজার হাজার ইহুদি জনগোষ্ঠীকে হত্যা ও ‘ডিপোর্ট’ করে হিটলার যে ‘রাজনীতি’র সূচনা করেছিলেন, জার্মানির মানুষ তাই আজও তাকে ঘৃণা করে। এত বছর পরও আমি কোনো সন্তানকে ‘হিটলার’ নামে ডাকতে দেখিনি। বরং জার্মান পত্রপত্রিকা ঘেঁটে দেখেছি সাধারণ মানুষ শরণার্থীদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল। অনেককে দেখেছি তারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে শরণার্থী ফান্ডে তাদের বেতনের ১ ভাগ সরকারকে দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন। জার্মান সরকার তাদের ‘অতীত ইতিহাস’ থেকে বেরিয়ে এসে শরণার্থীদের গ্রহণ করে (প্রায় ৮ লাখ শরণার্থী এ বছর জার্মানিতে ঢুকবে) বিশ্বে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছেন এবং তাদের মর্যাদাও বেড়েছে। জার্মানি আবারও প্রমাণ করল দেশটি শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়ন নয়, বরং বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যও প্রস্তুত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এটা এই মুহূর্তে আর জার্মানির একার সমস্যা নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট স্পষ্ট করেই বলেছেন, সবাইকে এ সমস্যা ভাগ করে নিতে হবে। কিন্তু হাঙ্গেরি, ক্রোয়েশিয়া, সেøাভেনিয়া, যারা ২৫ বছর আগেও এক একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল, আজ তারা শরণার্থীদের গ্রহণ করতে চাইছে না। সিদ্ধান্ত হয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার শরণার্থীকে ইউরোপের ২৫টি দেশে (ধনী ১১ ও মাঝারি ধনী ১৪) পুনর্বাসন করা হবে। কিন্তু বাকিদের কী হবে, কেউ জানে না। এত বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি মানবিক কারণে হলেও এই শরণার্থীরা আগামী দিনে সমস্যা তৈরি করতে পারেন। ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী শরণার্থীদের উপস্থিতি ইউরোপের খ্রিস্ট্রীয় সংস্কৃতির প্রতি হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। একে কেন্দ্র করে উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী, বিশেষ করে জার্মানিতে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে। ২০১৬ সালে ব্রিটেনে গণভোট হবে। গণভোটে বিপুলসংখ্যক মানুষ যদি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট দেয়, আমি অবাক হব না। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, শরণার্থীদের দেশত্যাগ বন্ধের ব্যাপারে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের ওপর সামরিক আক্রমণ কেন চালানো হচ্ছে না। এ নিয়ে নানা মত আছে। জাতীয় স্বার্থের কাছে মানবতা স্থান পায়নি যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্বের কাছে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করলে লাভবান হবে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা। তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে পুরো সিরিয়া। অন্যদিকে ইসলামিক স্টেটকে উৎখাত করলে লাভবান হবে সিরিয়ার আসাদ, আর পরোক্ষভাবে রাশিয়া ও ইরানের তাতে লাভ। আসাদের কোনো বিকল্পও নেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। ‘মানবিক বিপর্যয়’-এর যুক্তি তুলে লিবিয়ায় জাতিসংঘের অনুমতি ছাড়াই বিমান হামলা চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। গাদ্দাফি উৎখাত হয়েছিলেন। আজ একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে সিরিয়ায়। কিন্তু সিরিয়ায় আসাদ কিংবা আইএস উৎখাতে ব্যাপক হামলা হচ্ছে না।
তুরস্ক-গ্রিস সীমান্তে ‘নাম না জানা’ ওই শিশুদের ছবি ও তার অভিব্যক্তি আমাকে মনে করিয়ে দিল, এখানে মানবতা নয় বরং রাজনীতিটাই প্রাধান্য। আর সে কারণে সিরিয়ার শরণার্থী সমস্যার অচিরেই সমাধান হবে, এটা মনে করারও কোনো কারণ নেই।
জার্মানির শরণার্থীদের বহনের ঐতিহাসিক ও বাস্তবভিত্তিক কারণ রয়েছে। আমি বেশ কিছুদিন জার্মানিতে ছিলাম। সেখানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছি এবং কিছুদিন জার্মান সরকারের অনুবাদক হিসেবেও কাজ করেছি। অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি জার্মানি বরাবরই শরণার্থীদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি প্রায় ১২ লাখ জাতিগতভাবে উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়া জার্মান নাগরিককে গ্রহণ করেছিল। এরা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করে আসছিল। সেই থেকে মূলত শুরু। এরপর ষাটের দশকে যখন জার্মানি অন্যতম শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়, তখন তাদের প্রয়োজন হয়ে পড়ে কর্মীর, যারা আবাসন খাতে এবং শিল্প-কারখানায় কাজ করবে। ষাটের দশকে তাই জার্মানি, তুরস্ক, ভিয়েতনাম ও সাবেক যুগোসøাভিয়া, পোল্যান্ড থেকে প্রচুর ‘গাস্ট আরবাইটার’ (অর্থাৎ অতিথি শ্রমিক) গ্রহণ করে। এদের তৃতীয় জেনারেশন (যারা ইতোমধ্যে জার্মান নাগরিকত্ব পেয়েছে) এখন স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে। সিরিয়ার নাগরিক আমি কম পেয়েছি জার্মানিতে। তবে তিউনিশিয়া, ইরান ও ইরাকের নাগরিক আমি দেখেছি। সুতরাং ঐতিহাসিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে জার্মানির একটা যোগাযোগ ছিল। ব্রিটেন, ফ্রান্স ছাড়া অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোতে আরব দেশগুলো থেকে আসা জনগোষ্ঠীর অভিবাসন ঘটেছে, এটা বলা যাবে না। তাই শরণার্থীরা তাদের প্রথম পছন্দের তালিকায় জার্মানিকে রেখেছিল। বলা ভালো, জার্মানিতে অভিবাসন প্রক্রিয়া অনেক সহজ। ২০০৫ সালে জার্মানিতে নতুন একটি অভিবাসন আইন চালু হয়। তাতে বলা হয়, ‘জার্মানি হচ্ছে অভিবাসীদের দেশ।’ আগে এই আইনটি ছিল না। আমরা যখন আশির দশকে সেখানে পড়াশোনা করেছি, তখন অভিবাসন আইন বেশ কড়াকড়ি ছিল। এমনকি নাগরিকত্ব অর্জনের কাজটিও ছিল বেশ কঠিন। পরে ২০১২ সালে জার্মানি European Blue Card Lesislation আইনটি বাস্তবায়ন করে। এই আইনের মধ্য দিয়ে বিদেশ থেকে ‘বিশেষজ্ঞ’দের অথবা বিদেশি ছাত্ররা যারা জার্মানিতে পড়াশোনা করেছেন (যেমন আইটি সেক্টর, বিজ্ঞানী ইত্যাদি), তাদের কাজের অনুমতিপত্র ও থাকার অনুমতি দেওয়া হয়, যা আগে কখনো ছিল না। জার্মানিতে বর্তমানে আইটি সেক্টরে বেশ কিছু চিনা ও ভারতীয় ‘বিশেষজ্ঞ’ কাজ করছেন। তাদের নাগরিকত্বও দেওয়া হয়েছে।
ফলে সিরীয় শরণার্থীদের জার্মানির ব্যাপারে আগ্রহ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এছাড়া ইউরোপের কোনো কোনো দেশে (গ্রিস, ইতালি, পর্তুগাল) অর্থনীতিতে শ্লথগতি ও সেখানে বেকার সমস্যা বাড়লেও জার্মানি ছিল এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। জার্মানি ৩ দশমিক ৪১৩ ট্রিলিয়ন অর্থনীতির দেশ, যা বিশ্বের চতুর্থ বড় অর্থনীতি। মাথাপিছু আয় বছরে ৪১ হাজার ৯৫৩ ডলার। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে যেখানে বেকার সংখ্যা প্রায় ২০ ভাগ, সেখানে জার্মানিতে এই সংখ্যা মাত্র ৫ ভাগ। ফলে অনেকের কাছেই এই দেশের ব্যাপারে একটা ‘আকর্ষণ’ রয়েছে। জার্মানি তার অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে হলে, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী দরকার। পরিসংখ্যান বলছে, শতকরা ৩৮ জন মানুষ জার্মানিতে এখন একা থাকেন। সেখানে বয়স্ক লোকের সংখ্যা বাড়ছে। আর কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী হ্রাস পাচ্ছে। অনেক পরিবার সন্তান নিতে চাচ্ছেন না। তারা পেশার উন্নয়নের প্রতি এত বেশি গুরুত্ব দেন যে, সন্তান পালন করার ‘ঝুঁকি’ তারা নিতে চান না। অথচ অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে ‘কর্মী’ দরকার। ফলে ‘গাস্ট আরবাইটার’ তাদের দরকার। উপরন্তু এমন বেশ কিছু পেশা রয়েছে (যেমন রেস্টুরেন্ট কর্মী, আবাসন খাতের কর্মী, কনস্ট্রাকশন কর্মী, পরিচ্ছন্নতা কর্মী ইত্যাদি) যেখানে জার্মান নাগরিকরা কাজ করেন না বা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। ফলে তাদের ‘কর্মী’ দরকার। তাছাড়া জার্মানিতে ‘সামাজিক নিরাপত্তা’র বিষয়টি অত্যন্ত শক্তিশালী। অর্থাৎ একজন কর্মী, তিনি যদি বিদেশিও হন এবং তার যদি কাজ করার অনুমতিপত্র থাকে, তিনি যদি বেকার থাকেন, তাহলে রাষ্ট্র তাকে বেকার ভাতা দেবে, বাসা ভাড়া দেবে, সন্তানদের জন্য আলাদা ভাতা দেওয়া হবে এবং মাস শেষে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে খাবার ভাতা দেওয়া হবে। সব মিলিয়ে কাজ না করেও একজন তার পরিবারপ্রতি মাসে প্রায় ৩ হাজার ইউরো পাবেন। যে কোনো বিবেচনায় সিরিয়ার শরণার্থীদের জন্য এটা বড় পাওয়া। এই সুযোগটি তারা নেবেন, এটাই স্বাভাবিক। উপরন্তু অনেকে চিন্তা করেন তার সন্তানদের ভবিষ্যৎ। শরণার্থী মিছিলে আমি অনেক ছোট ছোট শিশু দেখেছি। অভিভাবকরা চিন্তা করেছেন তার সন্তানের ভবিষ্যৎ। উচ্চশিক্ষা নিতেও তাদের কোনো অর্থ ব্যয় করতে হবে না, যা আমেরিকা কিংবা ব্রিটেনে চিন্তাও করা যায় না। একজন অভিবাসী ভিয়েতনামের পরিবারের সন্তান এখন জার্মান মন্ত্রী। আমার দেখা অনেক বাংলাদেশি পরিবারের সন্তানরা এখন কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও পিএইচডি ডিগ্রিধারী। সিরীয়রা এই বিষয়টি মাথায় নিয়েছিলেন। হাঙ্গেরি কিংবা অন্য দেশে এই সুযোগটি কম। সেখানে সামাজিক নিরপত্তাও নেই। জার্মানিকে টার্গেট করেই তারা সিরিয়া ছেড়েছিল। জার্মান সরকারের এসব শরণার্থীর ব্যাপারে মূল আগ্রহের কারণÑ এসব শরণার্থীর প্রায় সবার বয়স ৩৫-এর নিচে এবং এদের সঙ্গে সন্তান আছে। অর্থ পরিষ্কারÑ এরা দক্ষ কর্মী হয়ে যাবেন এবং জার্মান অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে পারবেন, যেমনটি রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসীরা। ফলে শরণার্থীদের ব্যাপারে জার্মানিতে একটা ‘আগ্রহ’ তৈরি হয়েছিল এবং সেটা ছিল স্বাভাবিক। তবে এটাও সত্য, জার্মান সরকার যে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে শরণার্থীদের গ্রহণ করেছে, অন্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর কাছে এই মানবিকতা এতটুকুও স্থান পায়নি। বরং হাঙ্গেরি কিংবা চেক প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল উসকানিমূলক। তারা ‘ধর্মীয় প্রশ্ন’ তুলেও তাদের উগ্র মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে জার্মানি ছিল ব্যতিক্রম। জার্মানির একটি ‘কালো ইতিহাস’ আছে। জনগণের ভোটেই হিটলার বিজয়ী হয়েছিলেন এবং তার উগ্রবাদী নীতি জার্মানিকে বিশ্বের দরবারে অনেক ‘ছোট’ করেছিল। হাজার হাজার ইহুদি জনগোষ্ঠীকে হত্যা ও ‘ডিপোর্ট’ করে হিটলার যে ‘রাজনীতি’র সূচনা করেছিলেন, জার্মানির মানুষ তাই আজও তাকে ঘৃণা করে। এত বছর পরও আমি কোনো সন্তানকে ‘হিটলার’ নামে ডাকতে দেখিনি। বরং জার্মান পত্রপত্রিকা ঘেঁটে দেখেছি সাধারণ মানুষ শরণার্থীদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল। অনেককে দেখেছি তারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে শরণার্থী ফান্ডে তাদের বেতনের ১ ভাগ সরকারকে দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন। জার্মান সরকার তাদের ‘অতীত ইতিহাস’ থেকে বেরিয়ে এসে শরণার্থীদের গ্রহণ করে (প্রায় ৮ লাখ শরণার্থী এ বছর জার্মানিতে ঢুকবে) বিশ্বে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছেন এবং তাদের মর্যাদাও বেড়েছে। জার্মানি আবারও প্রমাণ করল দেশটি শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়ন নয়, বরং বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যও প্রস্তুত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এটা এই মুহূর্তে আর জার্মানির একার সমস্যা নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট স্পষ্ট করেই বলেছেন, সবাইকে এ সমস্যা ভাগ করে নিতে হবে। কিন্তু হাঙ্গেরি, ক্রোয়েশিয়া, সেøাভেনিয়া, যারা ২৫ বছর আগেও এক একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল, আজ তারা শরণার্থীদের গ্রহণ করতে চাইছে না। সিদ্ধান্ত হয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার শরণার্থীকে ইউরোপের ২৫টি দেশে (ধনী ১১ ও মাঝারি ধনী ১৪) পুনর্বাসন করা হবে। কিন্তু বাকিদের কী হবে, কেউ জানে না। এত বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি মানবিক কারণে হলেও এই শরণার্থীরা আগামী দিনে সমস্যা তৈরি করতে পারেন। ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী শরণার্থীদের উপস্থিতি ইউরোপের খ্রিস্ট্রীয় সংস্কৃতির প্রতি হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। একে কেন্দ্র করে উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী, বিশেষ করে জার্মানিতে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে। ২০১৬ সালে ব্রিটেনে গণভোট হবে। গণভোটে বিপুলসংখ্যক মানুষ যদি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট দেয়, আমি অবাক হব না। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, শরণার্থীদের দেশত্যাগ বন্ধের ব্যাপারে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের ওপর সামরিক আক্রমণ কেন চালানো হচ্ছে না। এ নিয়ে নানা মত আছে। জাতীয় স্বার্থের কাছে মানবতা স্থান পায়নি যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্বের কাছে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করলে লাভবান হবে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা। তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে পুরো সিরিয়া। অন্যদিকে ইসলামিক স্টেটকে উৎখাত করলে লাভবান হবে সিরিয়ার আসাদ, আর পরোক্ষভাবে রাশিয়া ও ইরানের তাতে লাভ। আসাদের কোনো বিকল্পও নেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। ‘মানবিক বিপর্যয়’-এর যুক্তি তুলে লিবিয়ায় জাতিসংঘের অনুমতি ছাড়াই বিমান হামলা চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। গাদ্দাফি উৎখাত হয়েছিলেন। আজ একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে সিরিয়ায়। কিন্তু সিরিয়ায় আসাদ কিংবা আইএস উৎখাতে ব্যাপক হামলা হচ্ছে না।
তুরস্ক-গ্রিস সীমান্তে ‘নাম না জানা’ ওই শিশুদের ছবি ও তার অভিব্যক্তি আমাকে মনে করিয়ে দিল, এখানে মানবতা নয় বরং রাজনীতিটাই প্রাধান্য। আর সে কারণে সিরিয়ার শরণার্থী সমস্যার অচিরেই সমাধান হবে, এটা মনে করারও কোনো কারণ নেই।
Daily Amader Somoy
28.09.15
0 comments:
Post a Comment