জার্মানির শরণার্থীদের গ্রহণের ঐতিহাসিক ও বাস্তবাভিত্তিক কারণ রয়েছে। আমি বেশকিছুদিন জার্মানিতে ছিলাম। সেখানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছি এবং কিছুদিন জার্মান সরকারের অনুবাদক হিসেবেও কাজ করেছি। অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি জার্মানি বরাবরই শরণার্থীদের ব্যাপারে সহানুভুতিশীল। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি প্রায় ১২ লাখ জাতিগতভাবে উদ্ভাস্তুতে পরিণত হওয়া জার্মান নাগরিককে গ্রহণ করেছিল। এরা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করে আসছিল। সেই থেকে মূলত শুরু। এরপর ষাটের দশকে যখন জার্মানি অন্যতম শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়, তখন তাদের প্রয়োজন হয়ে পড়ে কর্মীর, যারা আবাসন খাতে এবং শিল্প কারখানায় কাজ করবে। ষাটের দশকে তাই জার্মানি, তুরস্ক ভিয়েতনাম ও সাবেক যুগোস্লাভিয়া, পোল্যান্ড থেকে প্রচুর ‘গাস্ট আরবাইটার’ (অর্থাৎ অতিথি শ্রমিক) গ্রহণ করে। এদের তৃতীয় জেনারেশন (যারা ইতিমধ্যে জার্মান নাগরিকত্ব পেয়েছে) এখন স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে। সিরিয়ার নাগরিক আমি কম পেয়েছি জার্মানিতে। তবে তিউনেশিয়া, ইরান ও ইরাকের নাগরিক আমি দেখেছি। সুতরাং ঐতিহাসিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে জার্মানির একটা যোগাযোগ ছিল। ব্রিটেন, ফ্রান্স ছাড়া অন্য ইউরোপীয় দেশগুলোতে আরব দেশগুলোতে থেকে আসা জনগোষ্ঠীর অভিবাসন ঘটেছে, এটা বলা যাবে না। তাই শরণার্থীরা তাদের প্রথম পছন্দের তালিকায় জার্মানিকে রেখেছিল। দ্বিতীয়ত, জার্মানিতে অভিবাসন প্রক্রিয়া অনেক সহজ। ২০০৫ সালে জার্মানিতে নতুন একটি অভিবাসন আইন চালু হয়। তাতে বলা হয় জার্মানি হচ্ছে অভিবাসীদের দেশ। আগে এই আইন ছিল না। আমরা যখন আশির দশকে সেখানে পড়াশোনা করেছি, তখন অভিবাসন আইন বেশ কড়াকড়ি ছিল। এমনকি নাগরিকত্ব অর্জনের কাজটিও ছিল বেশ কঠিন। পরবর্তীকালে ২০১২ সালে জার্মানি European Blue Card Legislations আইনটি বাস্তবায়ন করে। এই আইনের মধ্য দিয়ে বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞদের অথবা বিদেশি ছাত্ররা যারা জার্মানিতে পড়াশোনা করেছেন (যেমন আইটি সেক্টর, বিজ্ঞানী ইত্যাদি) তাঁদের কাজের অনুমুতিপত্রও থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। যা আগে কখনো ছিল না। জার্মানিতে বর্তমানে আইটি সেক্টরে বেশ কিছু চীনা ও ভারতীয় বিশেষজ্ঞ কাজ করছেন। তাঁদের নাগরিকত্বও দেওয়া হয়েছে। ফলে সিরীয় শরণার্থীদের জার্মানির ব্যাপারে আগ্রহ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তৃতীয়ত, ইউরোপের কোনো কোনো দেশে (গ্রিস, ইতালি, পর্তুগাল) অর্থনীতিতে শ্লথগতি ও সেখানে বেকার সমস্যা বাড়ালেও, জার্মানি ছিল এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। জার্মানি ৩ দশমিক ৪১৩ ট্রিলিয়ন অর্থনীতির দেশ, যা বিশ্বের চতুর্থ বড় অর্থনীতি। মাথাপিছু আয় বছরে ৪১ হাজার ৯৫৩ ডলার। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে যেখানে বেকার সংখ্যা প্রায় ২০ ভাগ, সেখানে জার্মানিতে এই সংখ্যা মাত্র পাঁচ ভাগ। ফলে অনেকের কাছেই এই দেশের ব্যাপারে একটা ‘আকর্ষণ’ রয়েছে। অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে জার্মানির কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী দরকার। পরিসংখ্যান বলছে শতকরা ৩৮ জন মানুষ জার্মানিতে এখন একা থাকেন। সেখানে বয়স্ক লোকের সংখ্যা বাড়ছে। আর কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী হ্রাস পাচ্ছে। অনেক পরিবার সন্তান নিতে চাচ্ছে না। তারা পেশার উন্নয়নের প্রতি এত বেশি গুরুত্ব দেয় যে সন্তান পালন করার ‘ঝুঁকি’ তারা নিতে চায় না। অথচ অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে কর্মী দরকার। ফলে ‘গাস্ট আরবাইটার’ তাদের দরকার। উপরন্তু এমন বেশ কিছু পেশা রয়েছে (যেমন-রেস্টুরেন্ট-কর্মী, আবাসন খাতের কর্মী, কনস্ট্রকশন-কর্মী, পরিচ্ছন্নকর্মী ইত্যাদি) যেখানে জার্মান নাগরিকরা কাজ করে না বা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। ফলে তাদের কর্মী দরকার। চতুর্থত, জার্মানিতে ‘সামাজিক নিরাপত্তার’ বিষয়টি অত্যন্ত শক্তিশালী। অর্থাৎ একজন কর্মী, তিনি যদি বিদেশিও হন এবং তাঁর যদি কাজ করার অনুমতিপত্র থাকে এবং তিনি যদি বেকার থাকেন, তাহলে রাষ্ট্র তাকে বেকার ভাতা দেবে, বাসাভাড়া দেবে, সন্তানদের জন্য আলাদা ভাতা দেওয়া হবে এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে খাবার ভাতা দেওয়া হবে। সব মিলিয়ে কাজ না করেও একজন তাঁর পরিবারপ্রতি মাসে প্রায় তিন হাজার ইউরো পাবেন। যেকোনো বিবেচনায় সিরিয়ার শরণার্থীদের জন্য এটা বড় পাওয়া। এই সুযোগ তাঁরা নেবেন, এটাই স্বাভাবিক। উপরন্তু অনেকে চিন্তা করেন তাঁর সন্তানদের ভবিষ্যৎ। শরণার্থী মিছিলে আমি অনেক ছোট ছোট শিশু দেখেছি। অভিভাবকরা চিন্তা করেছেন তাঁর সন্তানের ভবিষ্যৎ। উচ্চশিক্ষা নিতেও তাদের কোনো অর্থ ব্যয় করতে হবে না। যা আমেরিকা কিংবা ব্রিটেনে চিন্তাও করা যায় না। একজন অভিবাসী ভিয়েতনামের পরিবারের সন্তান এখন জার্মান মন্ত্রী। আমার দেখা অনেক বাংলাদেশি পরিবারের সন্তানরা এখন কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও পিএইচডি ডিগ্রিধারী। সিরীয়রা এই বিষয়টি মাথায় নিয়েছিলেন। হাঙ্গেরি কিংবা অন্য দেশে এই সুযোগটি কম। সেখানে সামাজিক নিরাপত্তাই নেই। জার্মানিকে টার্গেট করেই তারা সিরিয়া ছেড়েছিলেন। পঞ্চমত, জার্মান সরকারের এসব শরণার্থীর ব্যাপারে মূল আগ্রহের কারণ- এসব শরণার্থীর প্রায় সবার বয়স ৩৫-এর নিচে এবং এদের সাথে সন্তান আছে। অর্থ পরিষ্কার- এরা দক্ষ কর্মী হয়ে যাবে এবং জার্মান অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে পারবে, যেমনটি রেখেছিল জার্মান যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীরা। ফলে শরণার্থীদের ব্যাপারে জার্মানিতে একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছিল এবং সেটা ছিল স্বাভাবিক। তবে এটাও সত্য, জার্মান সরকার যে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে শরণার্থীদের গ্রহণ করেছে, অন্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর কাছে এই মানবিকতা এতটুকুও স্থান পায়নি। বরং হাঙ্গেরি কিংবা চেক প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল উসকানিমূলক। তাঁরা ধর্মীয় প্রশ্ন তুলেও তাঁদের উগ্র মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে জার্মানি ছিল ব্যতিক্রম। জার্মানির একটি কালো ইতিহাস আছে। জনগণের ভোটেই হিটলার বিজয়ী হয়েছিলেন এবং তাঁর উগ্রবাদী নীতি জার্মানিকে বিশ্বের দরবারে অনেক ‘ছোট’ করেছিল। হাজার হাজার ইহুদি জনগোষ্ঠীকে হত্যা ও বিতাড়িত করে হিটলার যে রাজনীতির সূচনা করেছিলেন, জার্মানির মানুষ তাই আজও তাঁকে ঘৃণা করে। এত বছর পরও আমি কোনো সন্তানকে হিটলার নামে ডাকতে দেখিনি। বরং জার্মান পত্রপত্রিকা ঘেঁটে দেখেছি সাধারণ মানুষ শরণার্থীদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল। অনেককে দেখেছি তারা স্বপ্রণোদিত হয়ে শরণার্থী ফান্ডে তাদের বেতনের ১ ভাগ সরকারকে দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। জার্মান সরকার তাদের অতীত ইতিহাস থেকে বেরিয়ে এসে শরণার্থীদের গ্রহণ করে (প্রায় আট লাখ শরণার্থী এ বছর জার্মানিতে ঢুকবে) বিশ্বে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে এবং তাদের মর্যাদাও বেড়েছে। জার্মানি আবারও প্রমাণ করল দেশটি শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়ন নয়, বরং বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যও প্রস্তুত।
Ntv Online
07.09.15
0 comments:
Post a Comment