বাংলাদেশে
বিদেশি দুই নাগরিকের হত্যাকা- নিয়ে দেশ-বিদেশে যখন তোলপাড় চলছে, ঠিক তখনই
চট্টগ্রাম থেকে এলো আরও একটি আতঙ্কের খবর। পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী
গ্রেনেডসহ সেখান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জেএমবির কয়েক সদস্যকে এবং একজন-
যিনি জেএমবির সামরিক শাখার প্রধান বলে পুলিশ আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে,
তিনি গ্রেনেড বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন। এ ঘটনার সঙ্গে দুই বিদেশি হত্যাকা-
ঘটনার কোনো যোগসূত্র আছে কিনা, থাকলে কতটুকু আছে- এসব এই মুহূর্তে স্পষ্ট
নয়। তবে ঘটনাগুলো যখন একের পর এক ঘটতে থাকে, তখন দেশে ও বিদেশে এটি নিয়ে
প্রশ্ন তোলা হয় বৈকি!
যারা আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে চর্চা করেন, তারা জানেন- জঙ্গিবাদ তথা সন্ত্রাসবাদ একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা এবং সূক্ষ্মভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, পৃথিবীর যেখানে মুসলমান জনগোষ্ঠীর বসবাস, সেখানেই ধর্মের নামে এ ধরনের উগ্রবাদের জন্ম হয়েছে। এটি শুধু আফগানিস্তান কিংবা মধ্যপ্রাচ্যেই যে সীমাবদ্ধ, তা বলা যাবে না। বরং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া কিংবা ফিলিপাইনেও জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি আফ্রিকায়- যেখানে মুসলমান জনগোষ্ঠীর প্রাধান্য রয়েছে। যেমন- বলা যেতে পারে সোমালিয়া কিংবা কেনিয়ার কথা। সেখানে জঙ্গি উগ্রবাদী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে এবং তারা প্রচলিত নিরাপত্তার প্রতি এক ধরনের হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটেই বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। তবে অবশ্যই একটু প্রশ্ন এসে যায় বৈশ্বিক জঙ্গিবাদের সঙ্গে বাংলাদেশের জঙ্গিবাদের আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে কিনা? এখানে তথাকথিত জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটিয়ে কোনো বহির্শক্তি কোনো ফায়দা ওঠাতে চাচ্ছে কিনা, ওই বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। প্রসঙ্গক্রমে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের একটি বক্তব্য উল্লেখ করতে চাই। রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, আইএসের উগ্রবাদ দমনে ‘যৌথ উদ্যোগ’ গুরুত্বপূর্ণ। এর ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন। কেননা তথাকথিত ‘সন্ত্রাস দমন’-এর নামে যুক্তরাষ্ট্র যেখানেই সাময়িকভাবে নিজেদের জড়িত করছে, সেখানে সন্ত্রাস দমন তো হয়নিই- বরং সন্ত্রাসের মাত্রা বেড়েছে। সন্ত্রাসী কর্মকা- ‘জিইয়ে’ রেখে যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থ আদায় করে নিচ্ছে। পাঠক আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া কিংবা সিরিয়ার বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় নিতে পারেন। আমার আতঙ্কটা সেখানেইÑ আইএসের উগ্রবাদ দমনে বার্নিকাট ‘যৌথ উদ্যোগ’-এর কথা বলে কি কোনো ইঙ্গিত করলেন?
একাধিক কারণে বাংলাদেশ ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। একদিকে চিনের উত্থান, অন্যেিদক যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে চিন-রাশিয়া মৈত্রী আঘাত করছে। ভারত মহাসাগর ক্রমেই মার্কিন সামরিক নীতিনির্ধারকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফিটের কর্মকা- এখন সম্প্রসারিত হচ্ছে ভারত মহাসাগরে। অনেকেই মনে করতে পারেন, ২ মার্চ (২০১২) মার্কিন সিনেটের এক অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফিটের (বাংলাদেশ এর অন্তর্ভুক্ত) তৎকালীন কমান্ডার অ্যাডমিরাল রবার্ট উইলার্ড বলেছিলেন, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৫টি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিশেষ বাহিনী’ মোতায়েন রয়েছে। এ নিয়েও ওই সময় বাংলাদেশে কম বিতর্ক হয়নি। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ বেশ কয়টি চুক্তিতে আবদ্ধ (অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি ২০১৩, টিকফা চুক্তি ইত্যাদি)- যেখানে সন্ত্রাস দমনে ‘যৌথ কর্মসূচি’ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অনেকেই জানেন, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র SOFA (Status of forces agreement) চুক্তি ও ‘আকসা’ নামে (Acquisition and Cress Servicing Agreement) দুটি চুক্তি করতে চাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সাময়িক উপস্থিতি, জ্বালানি গ্রহণ, ‘পোর্ট অব কল’ সুবিধা দেওয়া হবে। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে সম্মতি না দিলেও ‘চাপ’-এ আছে। ফলে SITE-এর ওয়েবসাইটে বাংলাদেশে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) অস্তিত্ব ‘আবিষ্কার’ ও বার্নিকাটের ‘যৌথ উদ্যোগ’-এর কথা বলার মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কিনা, তা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে। এটা সত্য, বিশ্বে মুসলমান জনগোষ্ঠীর প্রাধান্য যেখানে বেশি, সেখানেই ইসলামের নামে উগ্রবাদ জন্ম হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া, সোমালিয়া, এমনকি থাইল্যান্ডের একটা অঞ্চলে (যেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ) ইসলামের নামে উগ্রবাদ বিস্তার লাভ করেছে। তাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর যোগসাজশও রয়েছে। এর বাইরে বাংলাদেশ নয়। এখানে আল-কায়েদা কিংবা আইএস সরাসরিভাবে সংগঠিত না হতে পারলেও স্থানীয় জঙ্গিরা যে তাদের কর্মকা-ে উৎসাহিত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেউ কেউ চেষ্টা করছেন যোগাযোগ রাখার। তবে যোগাযোগ হয়েছে তা বলার সময় বোধহয় এখনো আসেনি। অতীতে বাংলাদেশের জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে বিদেশের পার্লামেন্টে আলোচনা হয়েছে। আমরা মার্কিন কংগ্রেসের একটি আলোচনার কথা এখানে উল্লেখ করতে পারি।
মার্কিন কংগ্রেসের মূল্যায়ন আমাদের কোনো আশার কথা বলে না। বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা কিছুটা আছে বটে কিন্তু তা নিয়ন্ত্রিত। জঙ্গিগোষ্ঠী খুব বেশি সমাজে প্রবেশ করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। তাদের সমর্থক-গোষ্ঠীও খুব সীমিত। ফলে জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে ভয়ের কারণ নেই। বাংলাদেশে কোনো কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে বলা হচ্ছে। এটিও আমার কাছে মনে হয়েছে অতিরঞ্জিত। গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে আমাদের আশ্বস্তও করা হয়েছে। তবে অতীতে ‘হস্তক্ষেপ’ ও ‘সামরিক হস্তক্ষেপ’-এর যে আশঙ্কা কেউ কেউ মার্কিন কংগ্রেসের শুনাতিতে ব্যক্ত করেছিলেন, তাও অগ্রহণযোগ্য। কেননা এমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নিÑ যাতে বিদেশি ‘হস্তক্ষেপ’-এর প্রয়োজন পড়বে। আফগানিস্তান বা সিরিয়া-ইরাক নয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মাটিতে ‘তালেবান’ বা আইএসের মতো জঙ্গিগোষ্ঠী উত্থানের সম্ভাবনাও কম। বাংলাদেশে ইসলাম সহনীয়, মডারেট ও শান্তিপ্রিয়। আমাদের ঐতিহ্যের ধারক হচ্ছে এই ইসলাম ধর্ম। আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরাকে যেভাবে ইসলাম ধর্মকে জঙ্গি মানসিকতায় রূপ দেওয়া হয়েছে (যেখানে বহির্শক্তির ইন্ধন, সমর্থক, আর্থিক সহযোগিতা রয়েছে), এ দেশে কোনোদিনই তা সম্ভব নয়। মানুষ এটা গ্রহণ করে নেবেও না। বাংলাদেশে আমরা শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলাভাইয়ের উত্থান দেখেছি। কিন্তু তাদের কর্মকা-ের প্রতি কোনো শ্রেণির মানুষেরই এতটুকুও সমর্থন ছিল না। বরং মানুষ তাদের ধিক্কার জানিয়েছে। তাই দুই বিদেশির হত্যাকা-ের পূর্ণ তদন্ত দরকার। এই হত্যাকা-ের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ত আছে কিনা, থাকলে কতটুকু আছে- বিষয়গুলো স্পষ্ট হওয়া দরকার। তবে একজন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে আমার বিবেচনায় যেটা স্পষ্ট, তা হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিভেদ আর বিদ্বেষ যদি বাড়তে থাকেÑ তাহলে এ থেকে সুবিধা নেবে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো।
আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য এখানেই যে, দেশে একটি পার্লামেন্ট থাকলেও জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত ওই জঙ্গিবাদের বিষয়টি নিয়ে আমরা পার্লামেন্টে আলোচনা হতে দেখিনি। তথাকথিত একটি বিরোধী দল সংসদে রয়েছে বটে কিন্তু তাদের কোনো কর্মকা- নেই। উপরন্তু সরকারি দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা-নেত্রীদের মধ্যে বিএনপিবিরোধী মনোভাব এখনো অব্যাহত রয়েছে। এমন কথাও বলা হচ্ছে, ওই দুই বিদেশি হত্যাকা-ের সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াত চক্র জড়িত! অবশ্যই আমরা চাইব, এ ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হোক। কেননা জঙ্গিবাদের ওই সমস্যাটি শুধু সরকার বা আওয়ামী লীগের একক কোনো সমস্যা নয়। বরং এ সমস্যাটি বিএনপির ও পুরো জাতিরও। আমরা আইএসের নির্মম হত্যাকা-ের ভিডিও ও সংবাদ দেখেছি। কেনিয়ায় বোকো হারামের মেয়েশিশু অপহরণের কাহিনিও পত্রপত্রিকা থেকে পড়েছি। এসব পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আমরা মেলাতে চাই না। তাই বাংলাদেশের জঙ্গিবাদ উৎখাতে প্রয়োজন একটি জাতীয় ঐকমত্য। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তটিও জরুরিÑ যাতে ‘প্রকৃত সত্য’ বেরিয়ে আসে।
আমাদের দুর্ভোগের জায়গাটি এখানেই যে, আমরা অতীতে ‘জজ মিয়া নাটক’ দেখেছি। দুই বিদেশি হত্যাকা-ে আরেকটি ‘জজ মিয়া নাটক’ মঞ্চস্থ হোক, আমরা তা চাই না। যখন তদন্ত হচ্ছে, তখন ব্যক্তিগতভাবে কাউকে অথবা দলীয়ভাবে কোনো দলকে সরাসরি অভিযুক্ত করে মন্তব্য না করাই শ্রেয়। এতে তদন্তে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক কৃতিত্ব রয়েছে। তাদের কৃতিত্বটিকে আমরা ছোট করতে পারি না। তবে সন্ত্রাসবাদ দমনে তাদের দক্ষতা, কৌশল ও পরিকল্পনা বাড়ানো দরকার। একটি শক্তিশালী ‘কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স’ ইউনিট প্রতিষ্ঠা করাও জরুরি। এ মুহূর্তে এই দেশে এমন কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি- যাতে জঙ্গি দমনে করে আমাদের বৈদেশিক, বিশেষ করে মার্কিন সাহায্য ও সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে অর্থায়নের প্রশ্নটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই এদিকে নজরদারি বাড়ানো দরকার। জঙ্গি দমনে (মধ্যপ্রাচ্য) গঠিত হয়েছে Global Coalition to Counter ISIL. ৬২টি দেশ এতে যোগ দিয়েছে। বাংলাদেশ এখনো যোগ দেয়নি। ভারত, পাকিস্তান ও চিনও এই অ্যালায়েন্সে যোগ দেয়নি। তবে বাংলাদেশ Global Fund for Community Engagement of Resilience-এর বোর্ড মেম্বার। তাদের মূল কাজ হচ্ছে উগ্রবাদ দমন করা! ‘অংশীদারিত্ব ও সংলাপ’ চুক্তি পরবর্তী সভায় বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিষয়টি যে উঠবে, তা স্পষ্ট করেই বলা যায়। তাই আমাদের প্রস্তুতি থাকা দরকার। জঙ্গিবাদের উত্থানকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। কোনো না কোনোভাবে স্থানীয় জঙ্গিরা কারও মদদ পাচ্ছে। তারা কারা- এটা খুঁজে বের করার দায়িত্ব গোয়েন্দাদের। তাদের আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততার বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া দরকার। একটি বিদেশি ক্রিকেট টিমকে (জিম্বাবুয়ে টিম আসবে নভেম্বরে) বাংলাদেশে নিয়ে এলেই আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে না। তাই চাই একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।
যারা আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে চর্চা করেন, তারা জানেন- জঙ্গিবাদ তথা সন্ত্রাসবাদ একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা এবং সূক্ষ্মভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, পৃথিবীর যেখানে মুসলমান জনগোষ্ঠীর বসবাস, সেখানেই ধর্মের নামে এ ধরনের উগ্রবাদের জন্ম হয়েছে। এটি শুধু আফগানিস্তান কিংবা মধ্যপ্রাচ্যেই যে সীমাবদ্ধ, তা বলা যাবে না। বরং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া কিংবা ফিলিপাইনেও জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি আফ্রিকায়- যেখানে মুসলমান জনগোষ্ঠীর প্রাধান্য রয়েছে। যেমন- বলা যেতে পারে সোমালিয়া কিংবা কেনিয়ার কথা। সেখানে জঙ্গি উগ্রবাদী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে এবং তারা প্রচলিত নিরাপত্তার প্রতি এক ধরনের হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটেই বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। তবে অবশ্যই একটু প্রশ্ন এসে যায় বৈশ্বিক জঙ্গিবাদের সঙ্গে বাংলাদেশের জঙ্গিবাদের আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে কিনা? এখানে তথাকথিত জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটিয়ে কোনো বহির্শক্তি কোনো ফায়দা ওঠাতে চাচ্ছে কিনা, ওই বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। প্রসঙ্গক্রমে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের একটি বক্তব্য উল্লেখ করতে চাই। রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, আইএসের উগ্রবাদ দমনে ‘যৌথ উদ্যোগ’ গুরুত্বপূর্ণ। এর ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন। কেননা তথাকথিত ‘সন্ত্রাস দমন’-এর নামে যুক্তরাষ্ট্র যেখানেই সাময়িকভাবে নিজেদের জড়িত করছে, সেখানে সন্ত্রাস দমন তো হয়নিই- বরং সন্ত্রাসের মাত্রা বেড়েছে। সন্ত্রাসী কর্মকা- ‘জিইয়ে’ রেখে যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থ আদায় করে নিচ্ছে। পাঠক আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া কিংবা সিরিয়ার বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় নিতে পারেন। আমার আতঙ্কটা সেখানেইÑ আইএসের উগ্রবাদ দমনে বার্নিকাট ‘যৌথ উদ্যোগ’-এর কথা বলে কি কোনো ইঙ্গিত করলেন?
একাধিক কারণে বাংলাদেশ ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। একদিকে চিনের উত্থান, অন্যেিদক যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে চিন-রাশিয়া মৈত্রী আঘাত করছে। ভারত মহাসাগর ক্রমেই মার্কিন সামরিক নীতিনির্ধারকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফিটের কর্মকা- এখন সম্প্রসারিত হচ্ছে ভারত মহাসাগরে। অনেকেই মনে করতে পারেন, ২ মার্চ (২০১২) মার্কিন সিনেটের এক অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফিটের (বাংলাদেশ এর অন্তর্ভুক্ত) তৎকালীন কমান্ডার অ্যাডমিরাল রবার্ট উইলার্ড বলেছিলেন, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৫টি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিশেষ বাহিনী’ মোতায়েন রয়েছে। এ নিয়েও ওই সময় বাংলাদেশে কম বিতর্ক হয়নি। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ বেশ কয়টি চুক্তিতে আবদ্ধ (অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি ২০১৩, টিকফা চুক্তি ইত্যাদি)- যেখানে সন্ত্রাস দমনে ‘যৌথ কর্মসূচি’ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অনেকেই জানেন, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র SOFA (Status of forces agreement) চুক্তি ও ‘আকসা’ নামে (Acquisition and Cress Servicing Agreement) দুটি চুক্তি করতে চাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সাময়িক উপস্থিতি, জ্বালানি গ্রহণ, ‘পোর্ট অব কল’ সুবিধা দেওয়া হবে। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে সম্মতি না দিলেও ‘চাপ’-এ আছে। ফলে SITE-এর ওয়েবসাইটে বাংলাদেশে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) অস্তিত্ব ‘আবিষ্কার’ ও বার্নিকাটের ‘যৌথ উদ্যোগ’-এর কথা বলার মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কিনা, তা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে। এটা সত্য, বিশ্বে মুসলমান জনগোষ্ঠীর প্রাধান্য যেখানে বেশি, সেখানেই ইসলামের নামে উগ্রবাদ জন্ম হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া, সোমালিয়া, এমনকি থাইল্যান্ডের একটা অঞ্চলে (যেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ) ইসলামের নামে উগ্রবাদ বিস্তার লাভ করেছে। তাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর যোগসাজশও রয়েছে। এর বাইরে বাংলাদেশ নয়। এখানে আল-কায়েদা কিংবা আইএস সরাসরিভাবে সংগঠিত না হতে পারলেও স্থানীয় জঙ্গিরা যে তাদের কর্মকা-ে উৎসাহিত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেউ কেউ চেষ্টা করছেন যোগাযোগ রাখার। তবে যোগাযোগ হয়েছে তা বলার সময় বোধহয় এখনো আসেনি। অতীতে বাংলাদেশের জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে বিদেশের পার্লামেন্টে আলোচনা হয়েছে। আমরা মার্কিন কংগ্রেসের একটি আলোচনার কথা এখানে উল্লেখ করতে পারি।
মার্কিন কংগ্রেসের মূল্যায়ন আমাদের কোনো আশার কথা বলে না। বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা কিছুটা আছে বটে কিন্তু তা নিয়ন্ত্রিত। জঙ্গিগোষ্ঠী খুব বেশি সমাজে প্রবেশ করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। তাদের সমর্থক-গোষ্ঠীও খুব সীমিত। ফলে জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে ভয়ের কারণ নেই। বাংলাদেশে কোনো কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে বলা হচ্ছে। এটিও আমার কাছে মনে হয়েছে অতিরঞ্জিত। গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে আমাদের আশ্বস্তও করা হয়েছে। তবে অতীতে ‘হস্তক্ষেপ’ ও ‘সামরিক হস্তক্ষেপ’-এর যে আশঙ্কা কেউ কেউ মার্কিন কংগ্রেসের শুনাতিতে ব্যক্ত করেছিলেন, তাও অগ্রহণযোগ্য। কেননা এমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নিÑ যাতে বিদেশি ‘হস্তক্ষেপ’-এর প্রয়োজন পড়বে। আফগানিস্তান বা সিরিয়া-ইরাক নয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মাটিতে ‘তালেবান’ বা আইএসের মতো জঙ্গিগোষ্ঠী উত্থানের সম্ভাবনাও কম। বাংলাদেশে ইসলাম সহনীয়, মডারেট ও শান্তিপ্রিয়। আমাদের ঐতিহ্যের ধারক হচ্ছে এই ইসলাম ধর্ম। আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরাকে যেভাবে ইসলাম ধর্মকে জঙ্গি মানসিকতায় রূপ দেওয়া হয়েছে (যেখানে বহির্শক্তির ইন্ধন, সমর্থক, আর্থিক সহযোগিতা রয়েছে), এ দেশে কোনোদিনই তা সম্ভব নয়। মানুষ এটা গ্রহণ করে নেবেও না। বাংলাদেশে আমরা শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলাভাইয়ের উত্থান দেখেছি। কিন্তু তাদের কর্মকা-ের প্রতি কোনো শ্রেণির মানুষেরই এতটুকুও সমর্থন ছিল না। বরং মানুষ তাদের ধিক্কার জানিয়েছে। তাই দুই বিদেশির হত্যাকা-ের পূর্ণ তদন্ত দরকার। এই হত্যাকা-ের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ত আছে কিনা, থাকলে কতটুকু আছে- বিষয়গুলো স্পষ্ট হওয়া দরকার। তবে একজন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে আমার বিবেচনায় যেটা স্পষ্ট, তা হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিভেদ আর বিদ্বেষ যদি বাড়তে থাকেÑ তাহলে এ থেকে সুবিধা নেবে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো।
আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য এখানেই যে, দেশে একটি পার্লামেন্ট থাকলেও জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত ওই জঙ্গিবাদের বিষয়টি নিয়ে আমরা পার্লামেন্টে আলোচনা হতে দেখিনি। তথাকথিত একটি বিরোধী দল সংসদে রয়েছে বটে কিন্তু তাদের কোনো কর্মকা- নেই। উপরন্তু সরকারি দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা-নেত্রীদের মধ্যে বিএনপিবিরোধী মনোভাব এখনো অব্যাহত রয়েছে। এমন কথাও বলা হচ্ছে, ওই দুই বিদেশি হত্যাকা-ের সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াত চক্র জড়িত! অবশ্যই আমরা চাইব, এ ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হোক। কেননা জঙ্গিবাদের ওই সমস্যাটি শুধু সরকার বা আওয়ামী লীগের একক কোনো সমস্যা নয়। বরং এ সমস্যাটি বিএনপির ও পুরো জাতিরও। আমরা আইএসের নির্মম হত্যাকা-ের ভিডিও ও সংবাদ দেখেছি। কেনিয়ায় বোকো হারামের মেয়েশিশু অপহরণের কাহিনিও পত্রপত্রিকা থেকে পড়েছি। এসব পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আমরা মেলাতে চাই না। তাই বাংলাদেশের জঙ্গিবাদ উৎখাতে প্রয়োজন একটি জাতীয় ঐকমত্য। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তটিও জরুরিÑ যাতে ‘প্রকৃত সত্য’ বেরিয়ে আসে।
আমাদের দুর্ভোগের জায়গাটি এখানেই যে, আমরা অতীতে ‘জজ মিয়া নাটক’ দেখেছি। দুই বিদেশি হত্যাকা-ে আরেকটি ‘জজ মিয়া নাটক’ মঞ্চস্থ হোক, আমরা তা চাই না। যখন তদন্ত হচ্ছে, তখন ব্যক্তিগতভাবে কাউকে অথবা দলীয়ভাবে কোনো দলকে সরাসরি অভিযুক্ত করে মন্তব্য না করাই শ্রেয়। এতে তদন্তে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক কৃতিত্ব রয়েছে। তাদের কৃতিত্বটিকে আমরা ছোট করতে পারি না। তবে সন্ত্রাসবাদ দমনে তাদের দক্ষতা, কৌশল ও পরিকল্পনা বাড়ানো দরকার। একটি শক্তিশালী ‘কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স’ ইউনিট প্রতিষ্ঠা করাও জরুরি। এ মুহূর্তে এই দেশে এমন কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি- যাতে জঙ্গি দমনে করে আমাদের বৈদেশিক, বিশেষ করে মার্কিন সাহায্য ও সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে অর্থায়নের প্রশ্নটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই এদিকে নজরদারি বাড়ানো দরকার। জঙ্গি দমনে (মধ্যপ্রাচ্য) গঠিত হয়েছে Global Coalition to Counter ISIL. ৬২টি দেশ এতে যোগ দিয়েছে। বাংলাদেশ এখনো যোগ দেয়নি। ভারত, পাকিস্তান ও চিনও এই অ্যালায়েন্সে যোগ দেয়নি। তবে বাংলাদেশ Global Fund for Community Engagement of Resilience-এর বোর্ড মেম্বার। তাদের মূল কাজ হচ্ছে উগ্রবাদ দমন করা! ‘অংশীদারিত্ব ও সংলাপ’ চুক্তি পরবর্তী সভায় বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিষয়টি যে উঠবে, তা স্পষ্ট করেই বলা যায়। তাই আমাদের প্রস্তুতি থাকা দরকার। জঙ্গিবাদের উত্থানকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। কোনো না কোনোভাবে স্থানীয় জঙ্গিরা কারও মদদ পাচ্ছে। তারা কারা- এটা খুঁজে বের করার দায়িত্ব গোয়েন্দাদের। তাদের আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততার বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া দরকার। একটি বিদেশি ক্রিকেট টিমকে (জিম্বাবুয়ে টিম আসবে নভেম্বরে) বাংলাদেশে নিয়ে এলেই আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে না। তাই চাই একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।
Daily Amader Somoy
11.10.15
0 comments:
Post a Comment