বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের অস্তিত্ব আছে কি নেই, এ বিতর্কের অবসান এখনো
হয়নি। তবে সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের কারো কারো বক্তব্যে বিভ্রান্তি
তৈরি হয়েছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং বলেছেন
বাংলাদেশে আইএস জঙ্গিদের কোনো ঘাঁটি নেই, সেখানে কোনো কোনো মন্ত্রীর
বক্তব্যে আইএস জঙ্গিদের অস্তিত্বের কথা বলা হচ্ছে। তবে বাংলাদেশে আইএস বা
আল-কায়েদার ঘাঁটি রয়েছে, এটা আমার কাছে নিশ্চিত নয় এখন অবধি। আল-কায়েদার
তাত্তি্বক হচ্ছেন আবু মুসাব আল সুরি। সুরি আল-কায়েদার স্ট্র্যাটেজির কথা
বলতে গিয়ে ঝঢ়রফবৎ বিন-এর কথা বলেছেন অর্থাৎ মাকড়সারা যেমনি এখানে সেখানে
জাল তৈরি করে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে এবং সেই জাল ভেঙে দিলে অন্যত্র
গিয়ে ঠিক তেমনি জাল তৈরি করে, আল-কায়েদার স্ট্র্যাটেজিও ঠিক তেমনি। ছোট ছোট
গ্রুপে অঞ্চল ভিত্তিতে তারা সংগঠিত হয় এবং তাদের ওপর আক্রমণ হলে তারা
অন্যত্র গিয়ে সংগঠিত হয়, ঠিক মাকড়সারা যেমনটি করে। অষ-ছধবফধ রহ অৎধনরধহ
চবহরহংঁষধ, অষ-ছধবফধ রহ ওংষধসরপ গধমৎধন, অষ-ছধবফধ রহ ওৎধয় এভাবেই সংগঠিত।
এর বাইরে তারা ভিন্ন নামেও অপারেট করে। যেমন আল নুসরা ফ্রন্ট (সিরিয়া),
আল-গামা আল ইসলামিয়া। এ দুটো সংগঠনের সঙ্গে আদর্শগতভাবে আল-কায়েদার মিল
আছে। এখানে ইসলামিক স্টেট জঙ্গি সংগঠনটির কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন।
আল-কায়েদার সঙ্গে ইসলামিক স্টেটের আদর্শগতভাবে অমিল রয়েছে। আল-কায়েদা
যেখানে শরিয়াভিত্তিক ইসলামী শাসন চায়, সেখানে ইসলামিক স্টেট চায় একটি
ইসলামী খিলাফত। অর্থাৎ একটি খিলাফত রাষ্ট্রের আওতায় সব মুসলিম রাষ্ট্র
একত্রিত হবে। সেখানে একজন খলিফা বা রাষ্ট্রপ্রধান থাকবেন। আল-কায়েদার সঙ্গে
পার্থক্য এখানেই যে আল-কায়েদা খিলাফতের পরিবর্তে ইসলামী আমিরাতে
বিশ্ববাসী। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উপমহাদেশে আল-কায়েদা কি আদৌ স্থান করে নিতে
পেরেছে? ভারতে এর কোনো স্থান নেই। পাকিস্তানে তালেবানদের প্রভাব বেশি,
আল-কায়েদা তার শাখা স্থাপন করতে পেরেছে, এমন খবর আমাদের জানা নেই। তবে
বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক থাকতে পারে। আর বাংলাদেশে তাদের
আদৌ কোনো অস্তিত্ব নেই। বাংলাদেশে জঙ্গিগোষ্ঠী হিসেবে যারা পরিচিত তাদের
সঙ্গে আল-কায়েদার যোগাযোগ আছে, এমন কোনো তথ্যভিত্তিক প্রমাণও আমাদের কাছে
নেই। ফলে বাংলাদেশে বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে, এটাও ঠিক নয়। তাহলে
অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তার ঝুঁকি তোলার অর্থা কী ছিল? এর আগে অনেক বিদেশি টিম
বাংলাদেশ সফর করে গেছে। তখন তো এ প্রশ্ন তোলা হয়নি। এখন তাহলে তোলা হলো
কেন? সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে এমন কোনো 'ঘটনা' ঘটেনি, যাতে তা বিদেশিদের
জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে!
প্রধানমন্ত্রীই নিউইয়র্কে প্রথমে বলেছিলেন বাংলাদেশে জঙ্গিদের কোনো স্থান নেই। এটাই হচ্ছে আসল কথা। বাংলাদেশে ইসলামের নামে যারা উগ্রবাদ প্রচার করছে, তারা বিভ্রান্ত। আল-কায়েদা কিংবা ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের সঙ্গে তাদের মেলানো যাবে না। তবে এটা সত্য, কোনো কোনো মন্ত্রী, সরকারের সম্পর্ক বুদ্ধিজীবী যখন মিডিয়ায় টিভির টকশোতে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করেন, তখন তা দেশে নয় বরং বিদেশেও বিভ্রান্তি তৈরি করে। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমান। এখানে উগ্রপন্থী ইসলামী দল আছে। ফলে বাংলাদেশ যে কোনো কোনো দেশের গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারিতে রয়েছে তা অস্বীকার করা যাবে না। বাংলাদেশ মডারেট মুসলমানের দেশ। এখানে উগ্রবাদের কোনো স্থান নেই। উগ্রবাদকে মানুষ পছন্দ করে না। সাধারণ মানুষের মাঝে এদের কোনো গ্রহণযোগ্যতাও নেই। তাই জঙ্গিবাদকে নিয়ে যত কম কথা বলা যায়, ততই মঙ্গল। মনে রাখতে হবে দলের সিনিয়র নেতারা, মন্ত্রীরা যদি জঙ্গিবাদ নিয়ে কথা বলেন, তাতে সমর্থকরা প্রভাবান্বিত হন। তাই তাদের সংযত কথাবার্তা বলা উচিত। জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। আমরা কেন কোনো দেশই এ সমস্যার বাইরে নয়। এ সমস্যার সঙ্গে আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নটি সরাসরি জড়িত। এ ক্ষেত্রে সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের মাঝে সমঝোতা প্রয়োজন। জঙ্গিবাদ নিয়ে কোনো 'গ্লেম গেম' নয়, বরং সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে যদি সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে তৃতীয় পক্ষ এ থেকে ফয়দা ওঠাবে, এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উদ্ধারে তাই প্রয়োজন এ মুহূর্তে একটি সমঝোতার। তবে অতিসম্প্রতি ঢাকায় দেয়া মার্কিন রাষ্ট্রদূতের একটি মন্তব্য আমার কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট বলেছেন, আইএসের উগ্রবাদ দমনে যৌথ উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বার্নিকাট আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা পুরোপুরি স্পষ্ট না হলেও, তথাকথিত 'সন্ত্রাস দমনে' বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ ইতোমধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এ নিয়ে গেল সেপ্টেম্বরে যায়যায়দিনে আমি একটি উপসম্পাদকীয় লিখেছিলাম। এ তথাকথিত সন্ত্রাস দমনের নামে যুক্তরাষ্ট্র যেখানেই সামরিকভাবে নিজেদের জড়িত করেছে, সেখানে সন্ত্রাস দমন তো হয়ইনি, বরং সন্ত্রাসের মাত্রা বেড়েছে। সন্ত্রাসী কর্মকা- 'জিইয়ে' রেখে যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থ আদায় করে নিচ্ছে। পাঠক, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া কিংবা সিরিয়ার বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় নিতে পারেন। আমার আতঙ্কটা সেখানেই_ আইএসের উগ্রবাদ দমনে বার্নিকাট 'যৌথ উদ্যোগের' কথা বলে কি কোনো ইঙ্গিত করলেন? একাধিক কারণে বাংলাদেশ ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। একদিকে চীনের উত্থান, অন্যদিকে চীন-রাশিয়া মৈত্রী যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করছে। ভারত মহাসাগর ক্রমেই মার্কিন সামরিক নীতিনির্ধারকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিটের কর্মকা- এখন সম্প্রসারিত হচ্ছে ভারত মহাসাগরে। অনেকেই মনে করতে পারেন ২ মার্চ, ২০১২ মার্কিন সিনেটের এক অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিটের (বাংলাদেশ এর অন্তর্ভুক্ত) তৎকালীন কমান্ডার অ্যাডমিরাল রবার্ট উইলার্ড বলেছিলেন, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের 'বিশেষ বাহিনী' মোতায়েন রয়েছে। এ নিয়ে ওই সময় বাংলাদেশে কম বিতর্ক হয়নি। তবে বাস্তবতা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ বেশ কটি চুক্তিতে আবদ্ধ (যেমন_ অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি ২০১৩, টিকফা চুক্তি ইত্যাদি) যেখানে সন্ত্রাস দমনে 'যৌথ কর্মসূচি' নেয়ার কথা বলা হয়েছে। অনেকেই জানেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে ঝঙঋঅ (ঝঃধঃঁং ড়ভ ঋড়ৎপবং অমৎববসবহঃ) চুক্তি ও 'আকসা' (অপয়ঁরংরঃরড়হ ধহফ ঈৎড়ংং ংবৎারপরহম অমৎববসবহঃ) নামে দুটি চুক্তি করতে চাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সাময়িক উপস্থিতি, জ্বালানি গ্রহণ, 'পোর্ট অব কল' সুবিধা দেয়া হবে। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে সম্মতি না দিলেও 'চাপে' আছে। ফলে ঝওঞঊ-এর ওয়েবসাইটে বাংলাদেশে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের অস্তিত্ব 'আবিষ্কার' এবং বার্নিকাটের 'যৌথ উদ্যোগে'র কথা বলার মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কিনা তা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে। এটা সত্য, বিশ্বে মুসলমান জনগোষ্ঠীর প্রাধান্য যেখানে বেশি সেখানেই ইসলামের নামে উগ্রবাদ জন্ম হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া, সোমালিয়া, এমনকি থাইল্যান্ডের একটা অঞ্চলে (যেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ) ইসলামের নামে উগ্রবাদ বিস্তার লাভ করছে। নাইজেরিয়ায় বোকো হারাম কিংবা সোমালিয়ায় আল-শাবাব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর খবর আমরা জানি। সেখানে কি 'সন্ত্রাস দমনে' মার্কিন সেনাবাহিনী পাঠানো হচ্ছে? এখানে পাঠকদের কিছু তথ্য দিতে চাই। যুক্তরাষ্ট্র আফ্রিকায় তাদের প্রথম সেনা কমান্ড অঋজওঈঙগ (টং-অভৎরপধহ পড়সসধহফ) প্রতিষ্ঠা করেছে। বর্তমানে আফ্রিকার ২৮টি দেশে ১ হাজার ৩০০ মার্কিন সৈন্য ঈড়ঁহঃবৎ ঞবৎৎড়ৎরংস কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত। ২০০৫ সাল থেকেই বেশ কয়েকটি আফ্রিকান দেশে ঋওঘঞখঙঈক বা টং ঃৎধরহরহম ঊীবৎপরংব নামে মার্কিন সেনারা তৎপর। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র ক্যামেরুনে ৩০০ সেনা পাঠাচ্ছে। যদি সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যাবে ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য থেকে তার দৃষ্টি আফ্রিকায় সম্প্রসারিত করছে। আফ্রিকার ইউরেনিয়াম ও তেলসম্পদের দিকে এখন তার দৃষ্টি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি সম্প্রসারিত হচ্ছে ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলগুলোর দিকে। যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিটের ৬টি যুদ্ধজাহাজ ২০২০ সালের মধ্যেই ভারত মহাসাগরে মোতায়েন করা হবে। আর ভারত মহাসাগর ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে বৃহৎ শক্তির কাছে। একদিকে চীন তার 'সিল্ক রুট'কে নতুন করে সাজাচ্ছে, যেখানে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল এর একটি অংশ। ভারতও এগিয়ে এসেছে তার প্রাচীন 'কটন রুট' নিয়ে। ভারত 'ইন্ডিয়ান ওশেন রিম'ভুক্ত দেশগুলোকে তার নেতৃত্বের আওতায় আনছে। এ নিয়ে চীনের উদ্বেগ আছে। ফলে এ অঞ্চলে সন্ত্রাসী তৎপরতা বাড়বে, আর তাকে কেন্দ্র করে বাড়বে মার্কিনি তৎপরতা। বাংলাদেশে দুজন বিদেশিকে হত্যা করা হয়েছে। ঈশ্বরদীতে একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজককে হত্যার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এ তিনটি ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা কিনা আমরা জানি না। তবে ১৫ অক্টোবর দুটি জাতীয় দৈনিকে গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে_ যারাই দুজন বিদেশিকে হত্যা করেছে, তারা বিভ্রান্ত করতেই আইএসের নাম ব্যবহার করেছে। এ হত্যাকা-ে জঙ্গিসংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাননি গোয়েন্দারা, এমন তথ্যও দিয়েছে একটি জাতীয় দৈনিক। তাহলে কি বাংলাদেশে আইএস নেই? এই যখন পরিস্থিতি, তখন যাত্রাবাড়ী থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে জনৈক সাখাওয়াতুল কবীরসহ চারজনকে আইএস তথা জেএমবি সমন্বয়ক সাজিয়ে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে অভিযোগ গঠনের দিনও নির্ধারণ করা হয়েছে। এ-সংক্রান্ত খবরও ছাপা হয়েছে সংবাদপত্রে। যখন ওই দৈনিকের খবরে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে, অভিযুক্ত সাখাওয়াতুল কবীরের সঙ্গে আইএসের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, তখন নানা প্রশ্ন জন্ম দিতে বাধ্য। আজ এটা আমাদের জানা জরুরি যে, আমাদের দেশে আদৌ আইএসের কোনো অস্তিত্ব আছে কিনা। কেননা এর সঙ্গে আমাদের নিরাপত্তা ও বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তির প্রশ্নটি জড়িত।
তাই যে কোনো বিবেচনায় দুজন বিদেশির হত্যাকা-ের সুষ্ঠু তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ জরুরি। কারণ এর সঙ্গে অনেক প্রশ্ন জড়িত। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক এখন ঝুঁকির মুখে। বিদেশি ক্রেতা তথা বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি। এ জন্য সন্ত্রাস দমনে এবং জঙ্গি উৎখাতে সব দলের মাঝে একটি ঐকমত্য গড়ে তোলা প্রয়োজন। এটি ঠিক, দুটি হত্যাকা-কে বড় করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এতে বাংলাদেশ বড় ধরনের সংকটের মাঝে পড়েছে, তেমনটিও নয়। এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হলেও হত্যাকা-ের বিষয়টিকে সিরিয়াসলি নেয়া উচিত। Daily Jai Jai Din 23.10.15
প্রধানমন্ত্রীই নিউইয়র্কে প্রথমে বলেছিলেন বাংলাদেশে জঙ্গিদের কোনো স্থান নেই। এটাই হচ্ছে আসল কথা। বাংলাদেশে ইসলামের নামে যারা উগ্রবাদ প্রচার করছে, তারা বিভ্রান্ত। আল-কায়েদা কিংবা ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের সঙ্গে তাদের মেলানো যাবে না। তবে এটা সত্য, কোনো কোনো মন্ত্রী, সরকারের সম্পর্ক বুদ্ধিজীবী যখন মিডিয়ায় টিভির টকশোতে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করেন, তখন তা দেশে নয় বরং বিদেশেও বিভ্রান্তি তৈরি করে। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমান। এখানে উগ্রপন্থী ইসলামী দল আছে। ফলে বাংলাদেশ যে কোনো কোনো দেশের গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারিতে রয়েছে তা অস্বীকার করা যাবে না। বাংলাদেশ মডারেট মুসলমানের দেশ। এখানে উগ্রবাদের কোনো স্থান নেই। উগ্রবাদকে মানুষ পছন্দ করে না। সাধারণ মানুষের মাঝে এদের কোনো গ্রহণযোগ্যতাও নেই। তাই জঙ্গিবাদকে নিয়ে যত কম কথা বলা যায়, ততই মঙ্গল। মনে রাখতে হবে দলের সিনিয়র নেতারা, মন্ত্রীরা যদি জঙ্গিবাদ নিয়ে কথা বলেন, তাতে সমর্থকরা প্রভাবান্বিত হন। তাই তাদের সংযত কথাবার্তা বলা উচিত। জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। আমরা কেন কোনো দেশই এ সমস্যার বাইরে নয়। এ সমস্যার সঙ্গে আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নটি সরাসরি জড়িত। এ ক্ষেত্রে সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের মাঝে সমঝোতা প্রয়োজন। জঙ্গিবাদ নিয়ে কোনো 'গ্লেম গেম' নয়, বরং সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে যদি সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে তৃতীয় পক্ষ এ থেকে ফয়দা ওঠাবে, এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উদ্ধারে তাই প্রয়োজন এ মুহূর্তে একটি সমঝোতার। তবে অতিসম্প্রতি ঢাকায় দেয়া মার্কিন রাষ্ট্রদূতের একটি মন্তব্য আমার কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট বলেছেন, আইএসের উগ্রবাদ দমনে যৌথ উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বার্নিকাট আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা পুরোপুরি স্পষ্ট না হলেও, তথাকথিত 'সন্ত্রাস দমনে' বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ ইতোমধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এ নিয়ে গেল সেপ্টেম্বরে যায়যায়দিনে আমি একটি উপসম্পাদকীয় লিখেছিলাম। এ তথাকথিত সন্ত্রাস দমনের নামে যুক্তরাষ্ট্র যেখানেই সামরিকভাবে নিজেদের জড়িত করেছে, সেখানে সন্ত্রাস দমন তো হয়ইনি, বরং সন্ত্রাসের মাত্রা বেড়েছে। সন্ত্রাসী কর্মকা- 'জিইয়ে' রেখে যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থ আদায় করে নিচ্ছে। পাঠক, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া কিংবা সিরিয়ার বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় নিতে পারেন। আমার আতঙ্কটা সেখানেই_ আইএসের উগ্রবাদ দমনে বার্নিকাট 'যৌথ উদ্যোগের' কথা বলে কি কোনো ইঙ্গিত করলেন? একাধিক কারণে বাংলাদেশ ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। একদিকে চীনের উত্থান, অন্যদিকে চীন-রাশিয়া মৈত্রী যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করছে। ভারত মহাসাগর ক্রমেই মার্কিন সামরিক নীতিনির্ধারকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিটের কর্মকা- এখন সম্প্রসারিত হচ্ছে ভারত মহাসাগরে। অনেকেই মনে করতে পারেন ২ মার্চ, ২০১২ মার্কিন সিনেটের এক অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিটের (বাংলাদেশ এর অন্তর্ভুক্ত) তৎকালীন কমান্ডার অ্যাডমিরাল রবার্ট উইলার্ড বলেছিলেন, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের 'বিশেষ বাহিনী' মোতায়েন রয়েছে। এ নিয়ে ওই সময় বাংলাদেশে কম বিতর্ক হয়নি। তবে বাস্তবতা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ বেশ কটি চুক্তিতে আবদ্ধ (যেমন_ অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি ২০১৩, টিকফা চুক্তি ইত্যাদি) যেখানে সন্ত্রাস দমনে 'যৌথ কর্মসূচি' নেয়ার কথা বলা হয়েছে। অনেকেই জানেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে ঝঙঋঅ (ঝঃধঃঁং ড়ভ ঋড়ৎপবং অমৎববসবহঃ) চুক্তি ও 'আকসা' (অপয়ঁরংরঃরড়হ ধহফ ঈৎড়ংং ংবৎারপরহম অমৎববসবহঃ) নামে দুটি চুক্তি করতে চাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সাময়িক উপস্থিতি, জ্বালানি গ্রহণ, 'পোর্ট অব কল' সুবিধা দেয়া হবে। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে সম্মতি না দিলেও 'চাপে' আছে। ফলে ঝওঞঊ-এর ওয়েবসাইটে বাংলাদেশে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের অস্তিত্ব 'আবিষ্কার' এবং বার্নিকাটের 'যৌথ উদ্যোগে'র কথা বলার মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কিনা তা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে। এটা সত্য, বিশ্বে মুসলমান জনগোষ্ঠীর প্রাধান্য যেখানে বেশি সেখানেই ইসলামের নামে উগ্রবাদ জন্ম হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া, সোমালিয়া, এমনকি থাইল্যান্ডের একটা অঞ্চলে (যেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ) ইসলামের নামে উগ্রবাদ বিস্তার লাভ করছে। নাইজেরিয়ায় বোকো হারাম কিংবা সোমালিয়ায় আল-শাবাব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর খবর আমরা জানি। সেখানে কি 'সন্ত্রাস দমনে' মার্কিন সেনাবাহিনী পাঠানো হচ্ছে? এখানে পাঠকদের কিছু তথ্য দিতে চাই। যুক্তরাষ্ট্র আফ্রিকায় তাদের প্রথম সেনা কমান্ড অঋজওঈঙগ (টং-অভৎরপধহ পড়সসধহফ) প্রতিষ্ঠা করেছে। বর্তমানে আফ্রিকার ২৮টি দেশে ১ হাজার ৩০০ মার্কিন সৈন্য ঈড়ঁহঃবৎ ঞবৎৎড়ৎরংস কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত। ২০০৫ সাল থেকেই বেশ কয়েকটি আফ্রিকান দেশে ঋওঘঞখঙঈক বা টং ঃৎধরহরহম ঊীবৎপরংব নামে মার্কিন সেনারা তৎপর। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র ক্যামেরুনে ৩০০ সেনা পাঠাচ্ছে। যদি সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যাবে ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য থেকে তার দৃষ্টি আফ্রিকায় সম্প্রসারিত করছে। আফ্রিকার ইউরেনিয়াম ও তেলসম্পদের দিকে এখন তার দৃষ্টি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি সম্প্রসারিত হচ্ছে ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলগুলোর দিকে। যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিটের ৬টি যুদ্ধজাহাজ ২০২০ সালের মধ্যেই ভারত মহাসাগরে মোতায়েন করা হবে। আর ভারত মহাসাগর ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে বৃহৎ শক্তির কাছে। একদিকে চীন তার 'সিল্ক রুট'কে নতুন করে সাজাচ্ছে, যেখানে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল এর একটি অংশ। ভারতও এগিয়ে এসেছে তার প্রাচীন 'কটন রুট' নিয়ে। ভারত 'ইন্ডিয়ান ওশেন রিম'ভুক্ত দেশগুলোকে তার নেতৃত্বের আওতায় আনছে। এ নিয়ে চীনের উদ্বেগ আছে। ফলে এ অঞ্চলে সন্ত্রাসী তৎপরতা বাড়বে, আর তাকে কেন্দ্র করে বাড়বে মার্কিনি তৎপরতা। বাংলাদেশে দুজন বিদেশিকে হত্যা করা হয়েছে। ঈশ্বরদীতে একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজককে হত্যার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এ তিনটি ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা কিনা আমরা জানি না। তবে ১৫ অক্টোবর দুটি জাতীয় দৈনিকে গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে_ যারাই দুজন বিদেশিকে হত্যা করেছে, তারা বিভ্রান্ত করতেই আইএসের নাম ব্যবহার করেছে। এ হত্যাকা-ে জঙ্গিসংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাননি গোয়েন্দারা, এমন তথ্যও দিয়েছে একটি জাতীয় দৈনিক। তাহলে কি বাংলাদেশে আইএস নেই? এই যখন পরিস্থিতি, তখন যাত্রাবাড়ী থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে জনৈক সাখাওয়াতুল কবীরসহ চারজনকে আইএস তথা জেএমবি সমন্বয়ক সাজিয়ে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে অভিযোগ গঠনের দিনও নির্ধারণ করা হয়েছে। এ-সংক্রান্ত খবরও ছাপা হয়েছে সংবাদপত্রে। যখন ওই দৈনিকের খবরে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে, অভিযুক্ত সাখাওয়াতুল কবীরের সঙ্গে আইএসের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, তখন নানা প্রশ্ন জন্ম দিতে বাধ্য। আজ এটা আমাদের জানা জরুরি যে, আমাদের দেশে আদৌ আইএসের কোনো অস্তিত্ব আছে কিনা। কেননা এর সঙ্গে আমাদের নিরাপত্তা ও বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তির প্রশ্নটি জড়িত।
তাই যে কোনো বিবেচনায় দুজন বিদেশির হত্যাকা-ের সুষ্ঠু তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ জরুরি। কারণ এর সঙ্গে অনেক প্রশ্ন জড়িত। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক এখন ঝুঁকির মুখে। বিদেশি ক্রেতা তথা বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি। এ জন্য সন্ত্রাস দমনে এবং জঙ্গি উৎখাতে সব দলের মাঝে একটি ঐকমত্য গড়ে তোলা প্রয়োজন। এটি ঠিক, দুটি হত্যাকা-কে বড় করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এতে বাংলাদেশ বড় ধরনের সংকটের মাঝে পড়েছে, তেমনটিও নয়। এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হলেও হত্যাকা-ের বিষয়টিকে সিরিয়াসলি নেয়া উচিত। Daily Jai Jai Din 23.10.15
0 comments:
Post a Comment