রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কোনো শক্তি বাংলাদেশে পাকিস্তানের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছে কি

প্রথমে হত্যা করা হলো ইতালিয়ান নাগরিককে। তারপর হত্যা করা হলো জাপানি এক নাগরিককে। এরপর বেছে নেওয়া হলো একজন পুলিশের এএসআইকে। এর রেশ ধরে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো হলো ঢাকায় শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিলে। মারা গেল সাধারণ এক কিশোর। সব ঘটনা কি একই সূত্রে গাঁথা? মজার ব্যাপার, অন্তত দুটি ঘটনায় ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের স্বীকারোক্তি SITE নামক একটি জিহাদি পর্যবেক্ষণ সংস্থার ওয়েবসাইটে প্রকাশ কি সত্যি সত্যিই প্রমাণ করে বাংলাদেশে আইএস আছে? কোনো শক্তি কি এমনটি চাইছে? বাংলাদেশে সংকট বাড়ছে। হঠাৎ করেই যেন বাংলাদেশে আইএসের প্রসঙ্গটি সামনে চলে এলো! বাংলাদেশে কোনো শক্তি কি পাকিস্তানের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে? যাঁরা 'ষড়যন্ত্র' তত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তাঁরা বিভিন্নভাবে এসব ঘটনার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এসব ঘটনা আমাদের জন্য যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি এতে করে নষ্ট হয়েছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না।
কাকতালীয়ভাবে এটিও সত্য, বাংলাদেশে শিয়া সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক তাজিয়া মিছিলে যখন গ্রেনেড হামলা চালানো হলো, ঠিক একই সময় পাকিস্তানে শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে হামলা চালিয়ে সেখানে ২২ জনকে হত্যা করা হয়েছে। পাকিস্তানে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব অনেক পুরনো। কিন্তু এ অঞ্চলে গত সাড়ে ৩০০ বছরের ইতিহাসে কখনো শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালানো হয়নি। পাকিস্তানে শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে বিভাজন, দ্বন্দ্ব ও হামলার ইতিহাস অনেক পুরনো। কিন্তু বাংলাদেশে তেমনটি নেই। বাংলাদেশে শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায় একত্র হয়েই কারবালার সেই বিয়োগান্তক ইতিহাস স্মরণ করে। তাজিয়া মিছিলে সুন্নিদের অংশগ্রহণও স্বতঃস্ফূর্ত। যে কিশোরটি বোমা হামলায় মারা গেল, সেও একজন সুন্নি ধর্মাবলম্বী, সে শিয়া সম্প্রদায়ের নয়। এ ধরনের বোমা হামলা কী ইঙ্গিত করে? কোনো পক্ষ কি চাচ্ছে বাংলাদেশে পাকিস্তানের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে? আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, ২০০৮ সালের পর থেকে পাকিস্তানে শিয়া সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এখানে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের মৌলিক কিছু পার্থক্য রয়েছে। পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর মাঝে শিয়া সম্প্রদায়ভুক্তদের সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। বাংলাদেশে এ সংখ্যা খুবই নগণ্য। বাংলাদেশের মানুষ কে সুন্নি, কে শিয়া- এ বিভাজনটা কখনো করেনি। পাকিস্তানে ন্যূনতম চারটি জঙ্গি সুন্নি সংগঠনের খবর পাওয়া যায়, যারা সরাসরিভাবে শিয়াদের ওপর আক্রমণের জন্য দায়ী। এগুলো হচ্ছে লস্কর-ই-জানভি, সিপাহি সাহাবা, তেহরিকে তালিবান ও জুনদুল্লাহ। বাংলাদেশে এ রকমটি নেই। এমনকি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে শিয়া ধর্মাবলম্বীরা আদৌ মুসলমান ধর্মাবলম্বী কি না, এ নিয়ে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি থাকলেও (যেমন জর্দানের শতকরা ৪৩ জন মানুষ মনে করে শিয়ারা মুসলমান নন। তিউনিসিয়ায় এ সংখ্যা ৪১ জন আর মরক্কোতে ৫০ জন) বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো বিভ্রান্তি নেই। তাই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, হঠাৎ করে শিয়াদের ঐতিহাসিক তাজিয়া মিছিলে এই হামলা ক তাই নিশ্চিত করেই বলা যায় এই হামলার সঙ্গে ইতালিয়ান, জাপানি ও এএসআই হত্যাকাণ্ডের একটা যোগসূত্র আছে- অর্থাৎ দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলা! প্রশ্ন হচ্ছে দেশে যখন এক ধরনের 'স্থিতিশীলতা' বিরাজ করছে, তখন হঠাৎ করে কারা, কোন উদ্দেশ্যে এই অস্থিরতা সৃষ্টি করছে? এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে বহিঃশক্তির যোগসাজশের প্রশ্নটিও সামনে চলে এলো। একটি 'পক্ষ', তারা অভ্যন্তরীণ হতে পারে, তাদের সঙ্গে বহিঃশক্তির যোগসাজশ থাকতে পারে, তারা দেশে একটি অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে 'ফায়দা' উঠাতে চায়। এই অভ্যন্তরীণ শক্তির সঙ্গে কি আইএসের (ইসলামিক স্টেট) কিংবা আল-কায়েদার কোনো যোগাযোগ রয়েছে? পাঠক লক্ষ করবেন SITE পর্যবেক্ষণ সংস্থার ওয়েবসাইটে শুধু আইএসের কথা বলা হয়েছে। আল-কায়েদার কোনো বক্তব্য কিন্তু উল্লেখ করা হয়নি! ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আল-কায়েদার বর্তমান নেতা জাওয়াহিরির একটি টেপ বার্তা প্রকাশ করা হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল এই উপমহাদেশে (মিয়ানমারসহ) আল-কায়েদার একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। (আল-কায়েদা এভাবেই বিভিন্ন দেশে তাদের অপারেশন পরিচালনা করে- যেমন Al-Qaeda in Arabian Peninsula, Al-Qaeda in Islamic Magreb)। বাংলাদেশে কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে আল-কায়েদার সম্পর্ক থাকতে পারে! কিন্তু আইএস এভাবে তাদের কোনো অপারেশন পরিচালনা করে না এবং মুসলিমপ্রধান দেশে কোনো জঙ্গি সংগঠনকে তারা সাধারণত স্বীকৃতি দেয় না। তাই আইএসের কোনো শাখা যে বাংলাদেশে নেই, তা নিয়ে প্রথম থেকেই আমাদের সন্দেহ ছিল। সাধারণত আইএস কোনো ব্যক্তিকে কখনোই টার্গেট করে না। অথচ বাংলাদেশে একজন ইতালিয়ান ও একজন জাপানি নাগরিককে হত্যা করা হয়েছিল। পাঠকদের আরেকটু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, যে পর্যবেক্ষণ সংস্থার (SITE-Search for International Terrorist Entities) ওয়েবসাইটে তথ্যটি কোনো ধরনের বিশ্লেষণ ও যাচাই-বাছাই ছাড়াই তুলে দেওয়া হয়েছিল, সেটি মূলত মার্কিন ও ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করে। সুতরাং এটি প্রচার করার পেছনে (শিয়াদের ওপর গ্রেনেড হামলার খবরও তারা প্রকাশ করেছে) স্পষ্টতই তাদের কোনো 'উদ্দেশ্য' থাকতে পারে। যারা বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস নিয়ে কাজ করে, গবেষণা করে, তাদের কোনো প্রতিবেদনে আমি বাংলাদেশে আইএসের তৎপরতা নিয়ে কোনো প্রতিবেদন দেখিনি (যেমন- The Long War Journal, South Asia Terrorism Portal, Institute for the Study of War)। ফলে একজন ইহুদি ও যিনি একসময় ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হয়ে কাজ করতেন, সেই রিটা কাট্জের (SITE-এর কর্ণধার) উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। কোনো একটি 'পক্ষ' চাচ্ছে এটা বহির্বিশ্বে প্রচার করতে যে বাংলাদেশে আইএসের কার্যক্রম আছে! সারা বিশ্ব এটা এখন জেনেছে। শিয়াদের ওপর হামলার পর সারা বিশ্বের মিডিয়ায় এটা আইএসের কাজ বলে প্রচার করা হয়েছে। এতে করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। এখন যারা এ থেকে 'সুবিধা' নিতে চায়, তারা সুবিধা নেওয়ার উদ্যোগ নেবে- এতে করে বাংলাদেশ কতটুকু লাভবান হবে, এ প্রশ্ন থাকলই।
সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি হত্যাকাণ্ডসহ একের পর এক যেসব 'ঘটনা' ঘটে চলেছে, তা কোনো আশার কথা বলে না। প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যও জনমানসে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। জঙ্গিবাদ, আইএস প্রশ্নে তাঁরা যত 'কম' কথা বলবেন, ততই আমাদের মঙ্গল। কোনো দেশে, এমনকি ভারতেও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা এভাবে জঙ্গিবাদ নিয়ে কথা বলেন না। আমাদের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ, এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ জঙ্গিবাদ নিয়ে এমনসব কথা বলেন, যা শুধু বিভ্রান্তিই বাড়ায়। এখন যেদিকে বেশি দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন, তা হচ্ছে- ১. প্রতিটি ক্ষেত্রে সুষুম ও নিরপেক্ষ তদন্ত সম্পন্ন করা এবং দোষী ব্যক্তিদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা। না হলে এক ধরনের আস্থার সংকটের সৃষ্টি হবে; ২. বাংলাদেশে 'কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স' ফোর্সকে আরো শক্তিশালী করা। দক্ষ তরুণ অফিসারদের এখানে নিয়োগ দেওয়া। তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। বৈদেশিক বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা নিয়ে দেশে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা। প্রয়োজনে প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষ বাজেট বরাদ্দ দেওয়া; ৩. গোয়েন্দা কার্যক্রমের শৈথিল্য দূর করা। ঢাকা শহরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বেড়েছে। রাতে তল্লাশি বেড়েছে। এটা ভালো লক্ষণ। এটা যেন স্থায়ী হয়। মনিটরিং যেন বাড়ানো হয়। একটা ঘটনা ঘটাল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা কিছুদিন থাকল। তারপর তৎপরতা থেমে গেল, এমনটি যেন না হয়; ৪. যদি আইএস (বা আল-কায়েদা) থেকে থাকে, তা স্পষ্ট করা হোক; ৫. জঙ্গি প্রশ্নে রাষ্ট্রের একজন মুখপাত্র কথা বলবেন। সবাই কথা বললে নানা রকম বিভ্রান্তি তৈরি হয়।
আমরা জানি না এসব অপতৎপরতার শেষ কোথায়। একের পর এক 'ঘটনা'গুলো ঘটছে এবং তাতে নানা বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। মানুষ যে স্বস্তিতে আছে, তা বলা যাবে না। আমরা চাই না এ ধরনের 'আরেকটি ঘটনা'র জন্ম হোক! বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে থাকুক। আমি দুঃখজনকভাবে লক্ষ করেছি 'জঙ্গি প্রশ্নে' বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে নিয়ে যখন বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে তখন আমাদের দূতাবাসের (বিশেষ করে ওয়াশিংটনে ও জাতিসংঘে) কর্মকাণ্ড খুব একটা চোখে পড়ে না। বাংলাদেশে যে আইএস নেই, এটা প্রমাণে তাদের কর্মকাণ্ডকে আমি গুরুত্ব দিই। SITE-এর 'কর্মকাণ্ডে' আমাদের দেশের 'সহনশীল ইসলাম'-এর ভাবমূর্তি যতটুকু নষ্ট হয়েছে, তা উদ্ধারে দূতাবাসের কর্মকর্তারা নির্লিপ্ত বলেই মনে হয়। তাই দূতাবাসগুলো পরিচালনায় নয়া নীতি প্রণয়ন করাও জরুরি।
পর পর দুটি বিদেশি হত্যাকাণ্ডকে আমি যতটা না গুরুত্ব দিই (এমন ঘটনা অতিসম্প্রতি ফিলিপাইনেও ঘটেছে), তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিই তাজিয়া মিছিলে হামলার ঘটনাকে। এ ঘটনা বহির্বিশ্বে একটি ভিন্ন মেসেজ দিচ্ছে। আশঙ্কা করছি, এর চেয়েও 'বড়' ঘটনা ঘটাতে পারে স্থানীয় জঙ্গিরা। তাই গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো, পুলিশি টহল অব্যাহত রাখা, নজরদারি বাড়ানো- এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত। সাধারণ মানুষ যদি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, তা হলে তা কারো জন্যই কোনো মঙ্গল নয়। তাভেল্লা হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে চারজনক গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আশা করি এসব হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন হবে। Daily Kaler Kontho 29.10.15

0 comments:

Post a Comment