দুজন
বিদেশি নাগরিকের হত্যাকা-, এই হত্যাকা-কে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র
দূতাবাসের সতর্কবার্তা ও তা নবায়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার সমালোচনা করে
একাধিক মন্ত্রীর বক্তব্যকে কেন্দ্র করে যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা
দিয়েছে, তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের কি অবনতি
ঘটেছে? যারা সমসাময়িক রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন একাধিক
ইস্যুতে এই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক খুব ভালো যাচ্ছে না। ৫ জানুয়ারির
নির্বাচনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র খুব সন্তুষ্ট ছিল না। এমনকি ‘সকল দলের
অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন’-এর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের যে ‘অবস্থান’, সেই
অবস্থানের এতটুকুও পরিবর্তন হয়নি। জিএসপি সুবিধা না পাওয়ায় একাধিক মন্ত্রী
যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে আসছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও অতীতে
যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেছিলেন। এই যখন পরিস্থিতি তখন দুজন বিদেশি
নাগরিকের হত্যাকা-কে যুক্তরাষ্ট্র খুব সহজভাবে নিতে পারেনি। দূতাবাসের
দেওয়া সতর্কবার্তা নিয়ে একাধিক মন্ত্রী বিরূপ সমালোচনা করেন। অর্থমন্ত্রী
আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ‘মার্কিন নীতি আমাদের জন্য আরামদায়ক নয়। গত
৬-৭ বছর ধরে মার্কিন নীতি আমাদের জন্য স্বস্তিদায়ক ছিল না।’ বাণিজ্যমন্ত্রী
তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, এটা যুক্তরাষ্ট্রের অতি বাড়াবাড়ি। আর
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া
সতর্কবার্তাকে ‘আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের’ অংশ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
প্রসঙ্গক্রমেই গত ৫ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্য
উল্লেখ করতে চাই। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র
পাশে না থাকলে বাংলাদেশ শেষ হয়ে যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশটি
বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু তাতে সার্বভৌম বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা
থেমে থাকেনি।’ প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র
দপ্তরের নির্দেশেই বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করেছিল। শুধু তাই
নয়, যুক্তরাষ্ট্র ৫ জানুয়ারির নির্বাচন যাতে না হয়, সে জন্য সব রকম চেষ্টা
করেছিল বলেও দাবি করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী সরকারপ্রধান। তার
মন্তব্য ধরে নেওয়া যায়, এটাই সরকারের বক্তব্য। আসলে মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের নানা ‘ভূমিকা’র কারণে সরকারপ্রধান তার প্রতিক্রিয়া
জানিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বহুল আলোচিত
টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল (২৫ নভেম্বর ২০১৩)। মজার ব্যাপার বাংলাদেশে
বাম সংগঠনগুলো টিকফা চুক্তির বিরোধিতা করলেও জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি এই
চুক্তির বিরোধিতা করেনি। এই দল দুটি সরকারের অন্যতম অংশীদার। পত্রপত্রিকায়
তাদের কোনো মন্তব্য আমার চোখে পড়েনি। চুক্তিটি সম্পর্কে আমরা যা জানতে
পেরেছি, তা হচ্ছে চুক্তিটিতে ১৬টি অনুচ্ছেদ আর ৭টি আর্টিকেল রয়েছে। প্রায়
৪২টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের এ রকম চুক্তি রয়েছে বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব
আমাদের জানিয়েছেন। অন্যদিকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত তখন আমাদের জানিয়েছিলেন
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ৫০টি দেশের এ রকম চুক্তি রয়েছে। তবে চুক্তির নামকরণের
ব্যাপারে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। শুরুতে চুক্তির সঙ্গে ‘এগ্রিমেন্ট’
শব্দটি থাকলেও বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা ওঠায় ‘ফ্রেমওয়ার্ক’ শব্দটি বদলে
ফোরাম শব্দটি যুক্ত করা হয়। বিভিন্ন মহল থেকে চুক্তিটির সঙ্গে জেএসপির একটা
যোগসূত্র আছে বলা হলেও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদের আমাদের
জানিয়েছিলেন, টিকফার সঙ্গে জিএসপি বা শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের কোনো
যোগসূত্র নেই। বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধার দাবি অব্যাহত রাখবে, এরকমটিই আমাদের
জানিয়েছেন বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তবে বিষয়টি যে খুব সহসাই
সমাধান হবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। কারণ বেশ ক’জন মার্কিন সিনেটর এক
চিঠিতে জিএসপি সুবিধা স্থগিত রাখার অনুরোধ করেছিলেন। তারা তাদের অবস্থান
পরিবর্তন করেছেন এমনটি আমাদের জানা নেই। ইতোমধ্যে দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের
ক্ষেত্রে এক ধরনের শীতলতা আসায় জিএসপি প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র নমনীয় হবে,
এটা মনে করারও কোনো কারণ নেই। ফলে বাংলাদেশি পণ্য, বিশেষ করে আরএমজি পণ্য
জিএসপি সুবিধা ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করবে। এখানে বলা ভালো, ২০১৩
সালের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্র কিছু পণ্যের যে শুল্কমুক্ত সুবিধা (জিএসপি)
বাংলাদেশকে দিত, তা স্থগিত করে। স্থগিত হওয়ার পেছনে মূল কারণটি ছিল
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমমান নিশ্চিত করার ব্যর্থতা। এমনকি
আশুলিয়ায় শ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে না পারা,
তৈরি পোশাকশিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা না করার ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্র
অসন্তুষ্ট ছিল। ফলে এক পর্যায়ে কংগ্রেস সদস্যদের চাপের মুখে জিএসপি সুবিধা
স্থগিত হয়ে যায়। এরপর বাংলাদেশ সরকারের একটা প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায় যে,
টিকফা চুক্তির পর যুক্তরাষ্ট্র হয়তো বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা ফিরিয়ে দেবে।
প্রকৃতপক্ষে এর সঙ্গে টিকফা চুক্তির কোনো যোগসূত্র নেই। দ্বিতীয় আরেকটি যে
বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে জিএসপি সুবিধা ফিরে পেলেও তাতে যুক্তরাষ্ট্রে
বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বাড়বে না। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন যাবৎ তৈরি পোশাকে
জিএসপি সুবিধা চেয়ে আসছে। কিন্তু তৈরি পোশাকে আমাদের কোনো জিএসপি সুবিধা
নেই। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার হচ্ছে ৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের।
এর মাঝে মাত্র ০.৫ ভাগ পণ্য এই শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়। এর পরিমাণ মাত্র ২৬
মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ প্রায় ৭৫০ মিলিয়ন ডলার কর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের
বাজারে এখনো তার পণ্য নিয়ে টিকে আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র
শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় যেসব বাংলাদেশি পণ্যে, তার মধ্যে রয়েছে তামাক,
সিরামিক, ফার্নিচার, প্লাস্টিক, খেলনা ইত্যাদি। এর খুব কম পণ্যই বাংলাদেশ
যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে। গার্মেন্টস বা তৈরি পোশাকে বাংলাদেশি
রপ্তানিকারকরা শতকরা ১৫ ভাগ হারে শুল্ক পরিশোধ করে বাজার ধরে রেখেছে। অথচ
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দোহা চুক্তি অনুযায়ী একটি স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে
বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে তার পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। কিন্তু
যুক্তরাষ্ট্র তা দিচ্ছে না। এই সুবিধা উন্নত রাষ্ট্রগুলো পায়। তৈরি পোশাকে
শুল্কমুক্ত সুবিধা না দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দোহা চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। তাই তৈরি
পোশাকে আমরা যদি শুল্কমুক্ত সুবিধা না পাই, তাহলে এই জিএসপি সুবিধা
রপ্তানির ক্ষেত্রে কোনো বড় অবদান রাখতে পারবে না। আজ যদি জিএসপি সুবিধার
আশ্বাসে আমরা টিকফা চুক্তি করে থাকি তাতে আমাদের উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা
ক্ষীণ। টিকফা চুক্তির সঙ্গে তাই জিএসপি সুবিধাকে মেলানো যাবে না। জিএসপি
সুবিধা একটি ভিন্ন বিষয়।
এখন যে প্রশ্নটি অনেকে করার চেষ্টা করেন, তা হচ্ছে টিকফা চুক্তি করে আমরা কতটুকু উপকৃত হলাম। টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় দেশে মার্কিনি বিনিয়োগ বাড়বে, এটা সত্য কথা। এতে করে আমাদের বাজার, সেবা খাত উন্মুক্ত হয়ে যাবে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের জন্য। ব্যাপক প্রাইভেটাইজেশন ঘটবে, তাতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্যক্তিগত খাত। টিকফা চুক্তির আওতায় ৫ ও ১৯ ধারা মতে উভয় দেশ (বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র) বাণিজ্যে বেশ নমনীয় নীতি গ্রহণ করবে এবং ব্যাপক বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করবে। ৮নং ধারায় ব্যাপক ব্যক্তিগত খাত প্রসারের কথা বলা হয়েছে। এই ধারায় একটি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিশন গঠন করার কথাও আছে। এদের কাজ হবে ব্যক্তিগত খাত কীভাবে আরও বিকশিত করা যায়, সে ব্যাপারে উভয় সরকারকে উপদেশ দেওয়া। ৯নং ধারায় বলা আছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে কিন্তু উৎপাদন খাতে জড়াবে না। অর্থাৎ কোনো পণ্য উৎপাদন করবে না। এখানে সমস্যা হবে অনেকগুলো। এক. যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করবে (বিশেষভাবে সেবা খাতে) এবং ওই সব কোম্পানিকে ট্যাক্স সুবিধা দিতে হবে। আইনে যদি কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, তাহলে বাংলাদেশকে সেই আইন সংশোধন করতে হবে। ফলে স্থানীয় উদ্যোক্তারা মার খাবে। তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। দুই. চুক্তির ফলে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোকে নিরাপত্তা দিতে বাধ্য থাকবে। জ্বালানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দর ব্যবহার, টেলিকমিউনিকেশন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ খাতে বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়ায় এসব খাতে সরকারি বিনিয়োগ কমে যাবে। ফলে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শিক্ষা খাতে সরকারি বিনিয়োগ কমে গেলে, শিক্ষা খাত পণ্যে পরিণত হবে। বিনামূল্যে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হবে। উচ্চশিক্ষা ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। এতে করে শিক্ষাক্ষেত্রে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যারা ধনী, তারা শিক্ষা গ্রহণ করবে, আর যারা গরিব তারা শিক্ষা, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে। একই কথা প্রযোজ্য স্বাস্থ্য খাতের ক্ষেত্রেও। স্বাস্থ্য খাতে খরচ বেড়ে যাবে। এসব সেবামূলক খাত থেকে সাধারণ মানুষ যে ‘সেবা’ পেত তা ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসবে। সেবার জন্য সাধারণ মানুষকে তখন বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানির দাম বেড়ে যাবে। সাধারণ গ্রাহককে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিংবা গ্যাস কিনতে হবে। সরকারি ভর্তুকির কোনো সুযোগ থাকবে না। তবে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে থাকবে কৃষি ও আইটি সেক্টর। কৃষিতে সরকার যে ভর্তুকি দেয়, তা আর দিতে পারবে না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দোহা চুক্তিতে বলা হয়েছিল, স্বল্পোন্নত দেশগুলো কৃষিতে ৫ ভাগের বেশি ভর্তুকি দিতে পারবে না। টিফকা চুক্তির ১৮নং ধারায় বলা হয়েছে, কৃষিতে ভর্তুকির পরিমাণ কমাতে হবে। মজার ব্যাপার যুক্তরাষ্ট্র নিজে কৃষিতে ভর্তুকি দেয় ৯ ভাগ। এখন বাংলাদেশে কৃষি সেক্টরে ভর্তুকি কমানো হলে কৃষিতে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। কৃষক উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। ফলে কৃষি উৎপাদন, বিশেষ করে চাল উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে।
আমরা বিষয়গুলো আলোচনা করলাম এই যুক্তিতে যে, প্রতিটি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে। আমাদের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। এখানে আরও তিনটি চুক্তির কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি ‘অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি’ স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তির আওতায় প্রতি বছর একবার ঢাকায় ও ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচান করেন। বাংলাদেশের সঙ্গে একটি SOFA (Status of Forces Agreement) করতে চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বাংলাদেশ এখন অবধি এ ধরনের কোনো চুক্তি করতে রাজি হয়নি। একই সঙ্গে ACSA (Acquisition of Cross Servicing Agreement) নামে অপর একটি চুক্তিও করতে চাচ্ছে। SOFA ও ACSA চুক্তিতে যদি বাংলাদেশ স্বাক্ষর করে তাহলে মার্কিন সেনাদের বাংলাদেশে সাময়িক উপস্থিতি, জ্বালানি গ্রহণ, যাত্রাবিরতি, ‘পোর্ট অব কল সুবিধা’ নিশ্চিত হবে।
এমনকি এ ধরনের চুক্তির ফলে কোনো মার্কিন সেনার বিচার (যদি বাংলাদেশে কোনো অপরাধ করে) বাংলাদেশের আইনে করা যাবে না। সিরিয়ায় ‘ইসলামিক এস্টেট’-এর উত্থান ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে ৬২টি দেশ নিয়ে একটি জোট Global Coatition to Counter ISIL গঠন করেছে। বাংলাদেশকে এই জোটে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হলেও বাংলাদেশ এখন অবধি এই জোটে যোগ দেয়নি। (ভারতও যোগ দেয়নি)। আরও একটা কথাÑ যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলে তারা যে Forward presence নীতি গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ সেই নীতির অন্তর্ভুক্ত। তাই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছেই। এখন সর্বশেষ খবর অনুযায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ ৪ জন বিদেশি রাষ্ট্রদূত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে (২১ অক্টোবর) যখন বলেন, বিদেশিদের ওপর আরও হামলার আশঙ্কা রয়েছে, তখন বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের’ নাম করে এবং সন্ত্রাসের হুমকিকে নিউট্রাল করতে যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বার্থে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে কি না, এ প্রশ্নটি বারবারই আলোচিত হতে থাকবে। এ ক্ষেত্রে আমরা যেন পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা ভুলে না যাই। সন্ত্রাস দমনে আমরা অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চাইব। তখন যুক্তরাষ্ট্রকেই বলতে হবে তারা যে ‘আশঙ্কার’ কথা বলছে তা কোত্থেকে আসছে? কারা হামলা করতে পারে কিংবা বিদেশি কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী এর সঙ্গে জড়িত কিনাÑ এ বিষয়গুলো তাদের খোলাসা করা দরকার। না হলে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।
এখন যে প্রশ্নটি অনেকে করার চেষ্টা করেন, তা হচ্ছে টিকফা চুক্তি করে আমরা কতটুকু উপকৃত হলাম। টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় দেশে মার্কিনি বিনিয়োগ বাড়বে, এটা সত্য কথা। এতে করে আমাদের বাজার, সেবা খাত উন্মুক্ত হয়ে যাবে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের জন্য। ব্যাপক প্রাইভেটাইজেশন ঘটবে, তাতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্যক্তিগত খাত। টিকফা চুক্তির আওতায় ৫ ও ১৯ ধারা মতে উভয় দেশ (বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র) বাণিজ্যে বেশ নমনীয় নীতি গ্রহণ করবে এবং ব্যাপক বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করবে। ৮নং ধারায় ব্যাপক ব্যক্তিগত খাত প্রসারের কথা বলা হয়েছে। এই ধারায় একটি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিশন গঠন করার কথাও আছে। এদের কাজ হবে ব্যক্তিগত খাত কীভাবে আরও বিকশিত করা যায়, সে ব্যাপারে উভয় সরকারকে উপদেশ দেওয়া। ৯নং ধারায় বলা আছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে কিন্তু উৎপাদন খাতে জড়াবে না। অর্থাৎ কোনো পণ্য উৎপাদন করবে না। এখানে সমস্যা হবে অনেকগুলো। এক. যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করবে (বিশেষভাবে সেবা খাতে) এবং ওই সব কোম্পানিকে ট্যাক্স সুবিধা দিতে হবে। আইনে যদি কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, তাহলে বাংলাদেশকে সেই আইন সংশোধন করতে হবে। ফলে স্থানীয় উদ্যোক্তারা মার খাবে। তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। দুই. চুক্তির ফলে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোকে নিরাপত্তা দিতে বাধ্য থাকবে। জ্বালানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দর ব্যবহার, টেলিকমিউনিকেশন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ খাতে বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়ায় এসব খাতে সরকারি বিনিয়োগ কমে যাবে। ফলে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শিক্ষা খাতে সরকারি বিনিয়োগ কমে গেলে, শিক্ষা খাত পণ্যে পরিণত হবে। বিনামূল্যে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হবে। উচ্চশিক্ষা ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। এতে করে শিক্ষাক্ষেত্রে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যারা ধনী, তারা শিক্ষা গ্রহণ করবে, আর যারা গরিব তারা শিক্ষা, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে। একই কথা প্রযোজ্য স্বাস্থ্য খাতের ক্ষেত্রেও। স্বাস্থ্য খাতে খরচ বেড়ে যাবে। এসব সেবামূলক খাত থেকে সাধারণ মানুষ যে ‘সেবা’ পেত তা ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসবে। সেবার জন্য সাধারণ মানুষকে তখন বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানির দাম বেড়ে যাবে। সাধারণ গ্রাহককে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিংবা গ্যাস কিনতে হবে। সরকারি ভর্তুকির কোনো সুযোগ থাকবে না। তবে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে থাকবে কৃষি ও আইটি সেক্টর। কৃষিতে সরকার যে ভর্তুকি দেয়, তা আর দিতে পারবে না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দোহা চুক্তিতে বলা হয়েছিল, স্বল্পোন্নত দেশগুলো কৃষিতে ৫ ভাগের বেশি ভর্তুকি দিতে পারবে না। টিফকা চুক্তির ১৮নং ধারায় বলা হয়েছে, কৃষিতে ভর্তুকির পরিমাণ কমাতে হবে। মজার ব্যাপার যুক্তরাষ্ট্র নিজে কৃষিতে ভর্তুকি দেয় ৯ ভাগ। এখন বাংলাদেশে কৃষি সেক্টরে ভর্তুকি কমানো হলে কৃষিতে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। কৃষক উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। ফলে কৃষি উৎপাদন, বিশেষ করে চাল উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে।
আমরা বিষয়গুলো আলোচনা করলাম এই যুক্তিতে যে, প্রতিটি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে। আমাদের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। এখানে আরও তিনটি চুক্তির কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি ‘অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি’ স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তির আওতায় প্রতি বছর একবার ঢাকায় ও ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচান করেন। বাংলাদেশের সঙ্গে একটি SOFA (Status of Forces Agreement) করতে চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বাংলাদেশ এখন অবধি এ ধরনের কোনো চুক্তি করতে রাজি হয়নি। একই সঙ্গে ACSA (Acquisition of Cross Servicing Agreement) নামে অপর একটি চুক্তিও করতে চাচ্ছে। SOFA ও ACSA চুক্তিতে যদি বাংলাদেশ স্বাক্ষর করে তাহলে মার্কিন সেনাদের বাংলাদেশে সাময়িক উপস্থিতি, জ্বালানি গ্রহণ, যাত্রাবিরতি, ‘পোর্ট অব কল সুবিধা’ নিশ্চিত হবে।
এমনকি এ ধরনের চুক্তির ফলে কোনো মার্কিন সেনার বিচার (যদি বাংলাদেশে কোনো অপরাধ করে) বাংলাদেশের আইনে করা যাবে না। সিরিয়ায় ‘ইসলামিক এস্টেট’-এর উত্থান ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে ৬২টি দেশ নিয়ে একটি জোট Global Coatition to Counter ISIL গঠন করেছে। বাংলাদেশকে এই জোটে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হলেও বাংলাদেশ এখন অবধি এই জোটে যোগ দেয়নি। (ভারতও যোগ দেয়নি)। আরও একটা কথাÑ যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলে তারা যে Forward presence নীতি গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ সেই নীতির অন্তর্ভুক্ত। তাই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছেই। এখন সর্বশেষ খবর অনুযায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ ৪ জন বিদেশি রাষ্ট্রদূত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে (২১ অক্টোবর) যখন বলেন, বিদেশিদের ওপর আরও হামলার আশঙ্কা রয়েছে, তখন বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের’ নাম করে এবং সন্ত্রাসের হুমকিকে নিউট্রাল করতে যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বার্থে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে কি না, এ প্রশ্নটি বারবারই আলোচিত হতে থাকবে। এ ক্ষেত্রে আমরা যেন পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা ভুলে না যাই। সন্ত্রাস দমনে আমরা অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চাইব। তখন যুক্তরাষ্ট্রকেই বলতে হবে তারা যে ‘আশঙ্কার’ কথা বলছে তা কোত্থেকে আসছে? কারা হামলা করতে পারে কিংবা বিদেশি কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী এর সঙ্গে জড়িত কিনাÑ এ বিষয়গুলো তাদের খোলাসা করা দরকার। না হলে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।
Daily Amader Somoy
26.10.15
0 comments:
Post a Comment