রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

নতুন বছরের রাজনীতি কেমন হবে


নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনটি ভালো হলেও, ২৮ ডিসেম্বর দেশজুড়ে জেলা পরিষদের যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা ভালো হয়নি। জেলা পরিষদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রধান বিরোধী দলের প্রতিক্রিয়া এবং সেই প্রতিক্রিয়ার জবাবে সরকারি দলের পক্ষ থেকে যে ‘জবাব’ দেয়া হয়েছে, তাতে করে ‘আস্থার সম্পর্ক’ গড়ে ওঠার সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করেছে। ২০১৬ সালে যত নির্বাচন হয়েছে, প্রতিটি নির্বাচনই বিতর্কিত ছিল নানা কারণে। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। ভোট কারচুপি হয়নি। এমনকি নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ছুটে গিয়েছিলেন হেরে যাওয়া প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খানের বাসায়। সাংবাদিকদের তিনি জানিয়েছিলেন, সাখাওয়াতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই তিনি নারায়ণগঞ্জের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। পর্যবেক্ষকরা তখন বলেছিলেন, নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন জাতীয় রাজনীতির জন্য একটি মডেল হতে পারে! বলেছিলেন, এভাবে যদি ‘আস্থার রাজনীতি’ বজায় থাকে, তাহলে নির্বাচনী রাজনীতির স্পিরিট আবার দেশে ফিরে আসবে। কিন্তু জেলা পরিষদের নির্বাচন সেই সম্ভাবনাকে আবার পেছনে ঠেলে দিল। যদিও জেলা পরিষদের নির্বাচন ছিল পরোক্ষ নির্বাচন। জনগণ এখানে ভোট দেয়নি। স্থানীয় পরিষদে যারা জনগণের প্রতিনিধি হয়ে এর আগে বিজয়ী হয়েছিলেন, তারাই ভোট দিয়ে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানসহ অন্যদের ‘নির্বাচিত’ করেছেন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বাদে অন্য কোনো দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি। এমনকি আওয়ামী লীগের ‘মিত্র’ জাতীয় পার্টিও নির্বাচনের ময়দানে ছিল না। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থী ছিল বিদ্রোহী আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাই। এখানে অন্য কোনো দলের জনপ্রিয়তা যাচাই করার সুযোগ ছিল না। তরপরও দেখা গেছে, জেলা পরিষদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বড় দলগুলো নিজেদের মাঝে বিতর্কে জড়িয়ে গেছে। জেলা পরিষদের নির্বাচনী ফলে দেখা গেছে, সারা দেশের ৫৯টি জেলায় ভোট হলেও, চেয়ারম্যান পদে ভোট হয়েছে ৩৮টিতে। এর মাঝে আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা ২৫টিতে জয়ী হয়েছেন। আর বাকি ১৩টির মাঝে ১২টিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। গাইবান্ধার চেয়ারম্যান পদে বিজয়ীর কোনো দলীয় পরিচয় নেই। এর আগে ২১ জেলায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচনী মাঠে বিএনপি না থাকায় বড় ধরনের কোনো সংঘর্ষ হয়নি। তবে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, জেলা পরিষদের এ নির্বাচন চলতি ২০১৭ সালের রাজনীতিতে কতটুকু প্রভাব ফেলবে?
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, জেলা পরিষদ নির্বাচন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। বলতে দ্বিধা নেই, জেলা পরিষদের নির্বাচনটি ছিল পাকিস্তান আমলের ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ মডেলের নির্বাচনের মতো, যেখানে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। অর্থাৎ জনগণ ভোট দিয়ে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নির্বাচিত করেননি। এটা নিঃসন্দেহে গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার পরিপন্থী। এর আগে একাধিক সিটি করপোরেশনের নির্বাচন, ইউপি নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওইসব নির্বাচন নিয়ে যত বিতর্কই উঠুক না কেন, সেখানে জনগণের অংশগ্রহণের একটা সুযোগ ছিল। কিন্তু এ সুযোগটি ছিল না জেলা পরিষদ নির্বাচনে। ফলে গণতন্ত্র ও সংবিধান পরিপন্থী বলাটা একেবারে ফেলে দেয়া যাবে না। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা আছে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।’ জেলা পরিষদের নির্বাচন ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে’ হয়নি। উপরন্তু সংবিধানের ১১ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে।’ এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের কথাও বলা হয়েছে এখানে। কিন্তু জেলা পরিষদের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ১১ নং অনুচ্ছেদ বর্ণিত সেই ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হবে না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, স্বাধীনতার পর কখনোই জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। এবার হয়েছে। ভালো হোক, মন্দ হোক, আমরা একটা নির্বাচন পেয়েছি। হয়তো আমাদের প্রত্যাশা তাতে পূরণ হয়নি। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করার যে মনোবৃত্তি এবং মানসিকতা, সেই মানসিকতা থেকে এখনও তারা বের হয়ে আসতে পারছেন না। বিরোধী পক্ষ থেকে যখন নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে ‘ষড়যন্ত্র’ আবিষ্কার করা হচ্ছে, তখন একজন সাবেক মন্ত্রী বললেন, ‘বিএনপি জঙ্গিবাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে।’ সরকারের অনেক সিনিয়র নেতা ও মন্ত্রীর মুখে বিএনপির সমালোচনা শুনছি। ফলে ‘আস্থার সম্পর্ক’ গড় ওঠার যে সম্ভাবনা ছিল, তা এখন ক্ষীণ হয়ে আসছে। ফলে ২০১৭ সালটি আমাদের জন্য যে খুব ভালো সংবাদ বয়ে আনবেÑ এটা আশা করতে পারছি না।
গেল বছর দুইটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জাতীয় কাউন্সিল করেছে। কিন্তু কাউন্সিলের মাধ্যমে নয়া নেতৃত্ব বেরিয়ে আসেনি। আওয়ামী লীগের মূল কা-ারি এখনও শেখ হাসিনা। তবে নেতৃত্বে এবং তাকে কেন্দ্র করেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ৭০ বছরে পা দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৩৫ বছর তিনি দলকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। যদিও একাধিকবার তিনি বলেছেন, তিনি খুশি হতেন, যদি তিনি অবসরে যেতে পারতেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তিনি ছাড়া দলের নেতৃত্ব দেয়ার এ মুহূর্তে কেউ নেই। ফলে সংগতকারণেই তিনি নেতৃত্বে থেকে যাচ্ছেন এবং তার নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন জন্ম নেয়া আওয়ামী লীগের রাজনীতির ৩৫ বছরই, অর্থাৎ অর্ধেক সময়েরও বেশি সময় নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ হাসিনা। বোধ করি এটা একটা রেকর্ড, যা হয়তো ইতিহাসে খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যবে না। অন্যদিকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) বয়স প্রায় ৩৯ বছর। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জন্ম নেয়া এ দলটির ১৯৮৩ সাল থেকেই নেতৃত্ব দিয়ে আছেন খালেদা জিয়া। সেই অর্থে ৩৩ বছর তিনি দলটির চেয়ারপারসন। দলটি ২০১৬ সালে কাউন্সিল করেছে। কিন্তু ওই কাউন্সিলে নয়া নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়নি। বলা যেতে পারে, দুইটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এখনও ‘পুরনো নেতৃত্বের’ প্রতি আস্থাশীল। আওয়ামী লীগ অবিশ্যি কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে উপদেষ্টাম-লীতে পাঠিয়েছে। কিন্তু বিএনপি তা করেনি। নিয়ম রক্ষার্থে দল দুইটি কাউন্সিল করেছে। কিন্তু তাতে পরিবর্তন এসেছে অতি সামান্যই।
বাংলাদেশকে এখন তাকাতে হবে সামনের দিকে। ২০৫০ সালকে সামনে রেখে পরিকল্পনা সাজাতে হবে। আমরা বাংলাদেশকে ২০৫০ সালে কেমন দেখতে চাইÑ এমন পরিকল্পনা থাকা উচিত দুইটি বড় দলের। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের একটি পরিকল্পনা থাকলেও বড় দল হিসেবে বিএনপির সেই পরিকল্পনা নেই। বিএনপির থিঙ্ক ট্যাঙ্কও অকার্যকর। তাদের আদৌ ব্যবহার করা হয় বলে মনে হয় না। কিংবা এরা আদৌ সংগঠিতও নয়।
ফলে পরিকল্পনাহীনভাবেই বিএনপি এগিয়ে যাচ্ছে। তবে দলটির সমর্থকদের সংখ্যা অনেক। এখনও আওয়ামী লীগের বিকল্প বিএনপি। ফলে মানুষের আগ্রহ থাকবে বিএনপির দিকে চলতি বছরও।
গেল বছরের শেষ দিকে রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে সংলাপ শুরু করেছিলেন, তা চলতি বছরের প্রথমদিকেও অব্যাহত থাকবে। এর মধ্য দিয়ে চলতি বছর আমরা নতুন একটি নির্বাচন কমিশন পাব। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে যে আইন প্রণয়ন করার কথা সংবিধানে বলা হয়েছে (১১৮-১) দীর্ঘ ৪৫ বছরে কোনো সরকারই এ আইনটি প্রণয়ন করেনি। ডিসেম্বরে (২০১৬) রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনায় এ বিষয়টি উঠে আসে। একই সঙ্গে একটি ‘নিরপেক্ষ’ ও ‘যোগ্যতাসম্পন্ন’ নির্বাচন কমিশনের দাবিও ওঠে। রাষ্ট্রপতি তার সাংবিধানিক অধিকার বলে (১১৮-১ ও ৪৮) সিইসি ও কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন। কিন্তু তা সব ‘পক্ষ’কে কতটুকু খুশি করতে পারবে, সে প্রশ্ন রইলই। কেননা সিইসিসহ কমিশনারদের নিয়োগে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা থাকলেও ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দুইটি ক্ষেত্র ব্যতীত (প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ) অন্য সব নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি ‘প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ’ নিতে বাধ্য। ফলে রাষ্ট্রপতি যাদেরই নিয়োগ দেন না কেন ‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ’ এর বাধ্যবাধকতা একটি ‘সূক্ষ্ম অসন্তোষ’ সৃষ্টি করতে বাধ্য। এ নির্বাচন কমিশনের গুরুত্ব অনেক। কেননা তাদের ঘাড়ে বর্তাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা। সে ক্ষেত্রে ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ এ একটি নির্বাচন আয়োজন করা চাট্টিখানি কথা নয়। আমরা স্বাধীনতার ৪৫ বছর পার করেছি। কিন্তু একটা বড় ‘ব্যর্থতার’ জায়গা হচ্ছে, বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার অভাব। এ ‘আস্থার অভাব’ এর কারণে গণতন্ত্র বারবার মুখ থুবড়ে পড়ছে। আমরা একটি ভোটারবিহীন জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেখেছি। ফলে যে নির্বাচন কমিশনটি গঠিত হতে যাচ্ছে, চলতি বছরটি তাদের জন্য হবে একটি ‘লিটমাস টেস্ট’, অর্থাৎ পরীক্ষার সময়। তারা তাদের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু বাড়াতে পারবেন, সেটাই হবে মূল আলোচিত বিষয়। সংবিধানের ১১৮-৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। তারা সংবিধানের কাছে দায়বদ্ধ। কিন্তু কাজী রকিব উদ্দীনের কমিশন সংবিধানের এ অনুচ্ছেদ ব্যবহার করে ‘স্বাধীনভাবে নির্বাচন’ পরিচালনা করতে পারেননি। সরকারের ‘চাপ’ তারা অস্বীকার করতে পারেননি। ফলে একটা শঙ্কা থেকেই গেল, যে নির্বাচন কমিশনটি গঠিত হতে যাচ্ছে তার ‘ভূমিকা’ নিয়ে। একটি সার্চ কমিটি সব সমস্যার সমাধান এনে দেবে না। এজন্য প্রয়োজন ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজার্স’ বা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা। বিরোধী দলের উচিত, সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করা। তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সরকারকে সমালোচনা করার নামই গণতন্ত্র। অন্যদিকে বিএনপিকে উপেক্ষা করে, ওই দলটিকে একপাশে সরিয়ে রেখে, একতরফাভাবে নির্বাচন করলে, তাতে যেমনি ‘আস্থার সম্পর্ক’ তৈরি হবে না, ঠিক তেমনি বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল করবে না। বারবার আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ একটি নির্বাচন। সে ক্ষেত্রে বিএনপিসহ সব দলকে যদি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় আনা না যায়, তাহলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিকাশ নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। এজন্যই ২০১৭ সালটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
Daily Alokito Bangladesh
01.01.2017

নতুন বছর কতটা নতুন হবে?



কালের গর্ভে হারিয়ে গেল আরও একটি বছর। কেমন কাটবে ২০১৭? বিদায়ী বছরে অনেক ঘটনা ঘটেছে, যেগুলো চলতি বছরের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। গেল বছরে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। প্রথমটি জঙ্গিবাদের প্রসার এবং দ্বিতীয়টি নারায়ণগঞ্জে সুষ্ঠুভাবে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন। জঙ্গিবাদের প্রসারের বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয় এবং বছরের শেষ দিনগুলো পর্যন্ত এর ভয়াবহতা আমরা অনুভব করেছি। জঙ্গিবাদের প্রসারের পাশাপাশি আমরা লক্ষ করেছি আত্মঘাতী নারী জঙ্গিদের উত্থান। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে জঙ্গিবাদের উত্থান সাম্প্রতিককালে ঘটলেও নারী আত্মঘাতী বোমারুদের সংবাদ ছিল এই প্রথম। ঢাকার আশকোনায় নারী আত্মঘাতী বোমারু একটি বড় সংবাদের জন্ম দিয়েছে বটে; একই সঙ্গে রেখে গেছে অনেক প্রশ্ন। এ ঘটনা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম দেবে, সেটাই স্বাভাবিক। ২০১৫ সালেও আমরা জঙ্গিবাদের তৎপরতা লক্ষ করেছিলাম। ওই সময় একজন ইতালিয়ান ও একজন জাপানি নাগরিককে হত্যা করা হয়েছিল। অভিযোগ করা হয়েছিল, ওইসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আইএস জড়িত। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আইএস-সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করা হয়েছিল।

২০১৬ সালের জুনে ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলা এবং বেশ কয়েকজন জঙ্গিসহ ২৮ জন মানুষের মৃত্যুর খবর বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোচিত হয়। এই জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি নাম- ‘নিউ জেএমবি’ বা ‘নব্য জেএমবি’। জেএমবির একটি অংশ নতুন করে সংগঠিত হয়েছে। যেটা সবচেয়ে উদ্বেগের কারণ তা হচ্ছে, ‘নব্য জেএমবি’ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের, বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু তরুণকে আকৃষ্ট করতে পেরেছে। বিদেশ থেকে আসছে অর্থ ও অস্ত্র। এরই ধারাবাহিকায় আমরা লক্ষ করেছি আশকোনায় জঙ্গিদের সমাবেশ এবং বড় ধরনের একটি ‘জঙ্গি’ হামলার আশংকা। ওই জঙ্গি হামলা শেষ পর্যন্ত গোয়েন্দাদের তৎপরতার কারণে সফল হয়নি। তবে ২০১৬ সালজুড়ে জঙ্গিদের সংগঠিত হওয়ার একটি উদ্যোগ লক্ষ করা যায়। আশকোনার মতো ঢাকার কল্যাণপুরেও জঙ্গিরা সমবেত হয়েছিল। ফলে ভয়ের কারণ হচ্ছে, ২০১৭ সালেও জঙ্গিরা তাদের অপতৎপরতা চালাতে পারে। অর্থাৎ আমাদের ঝুঁকির মুখে থাকার আশংকা রয়েই গেল।

গত দু’বছরে জঙ্গি দমনে ব্যাপক সরকারি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ‘কাউন্টার টেরোরিজম ফোর্স’ গঠন করা হয়েছে। এর পাশাপাশি রয়েছে সোয়াতের মতো সংস্থাও। জঙ্গিদের মূলধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে সরকার আর্থিক সহযোগিতাও দিচ্ছে। কিন্তু তারপরও জঙ্গি তৎপরতা বন্ধ করা যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় আতংকের কারণ হচ্ছে নারী আত্মঘাতী বোমারুদের জন্ম। এটা প্রমাণ করে, জঙ্গি সংস্কৃতি আমাদের সমাজে প্রবেশ করেছে। এরা বিভ্রান্ত। শুধু আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে জঙ্গি দমন করা যাবে না। প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করা। ইসলামী স্কলারদের ব্যবহার করাও জরুরি। ইসলামী স্কলারের নামে যারা টিভি পর্দায় আসেন, তাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ক্যাম্পাসগুলোতে নজরদারি বাড়ানোর কথা আমরা বলেছিলাম। সেটা খুব একটা হয়নি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব ছাত্র ‘নিখোঁজ’ হয়ে গেছে বা নিখোঁজ হয়ে আছে, তাদের সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এতটুকু খোঁজখবর নিয়েছে বলে মনে হয় না। ফলে জঙ্গি রোধে মাঝে-মধ্যে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হয়ে ওঠে, তারপর সব যেন ঝিমিয়ে যায়। পরে জঙ্গি দমনে তেমন কোনো তৎপরতা আমরা দেখি না। সুতরাং নতুন বছর জঙ্গিবাদের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। ইসলামের নামে যে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে, তা রোধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। ইন্টারনেটে নজরদারি বাড়াতে হবে।

রাজনীতিতে ২০১৬ সালে দুটো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। একটি হচ্ছে নারায়ণগঞ্জে একটি ‘সুষ্ঠু ও সুন্দর’ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপ। উভয় ঘটনাকে পর্যবেক্ষকরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। বিশেষ করে নাসিক নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ, নির্বাচনের পর হেরে যাওয়া বিএনপি প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খানের বাসায় বিজয়ী প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর গমন এবং তার সহযোগিতা নিয়ে সিটি কর্পোরেশনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার ঘোষণা সমসাময়িক রাজনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এর মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে যে আস্থার সম্পর্ক থাকা দরকার, তা অন্তত একটি জায়গায় (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটা দেশের সামগ্রিক রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে। ২০১৭ সালের রাজনীতিতে নাসিক নির্বাচন কতটুকু প্রভাব ফেলবে, সেটাই দেখার বিষয়। নাসিক নির্বাচন অনেকগুলো কারণে গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপির নির্বাচনী রাজনীতিতে ফিরে আসা, সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ না করা এবং দলীয় সরকারের অধীনে যে ‘সুষ্ঠু নির্বাচন’ সম্ভব তা প্রমাণ করা, নির্বাচন কমিশনের সফলতা, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘শক্ত’ অবস্থান ইত্যাদি নাসিক নির্বাচনকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিল। ওই নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে, সরকার যদি হস্তক্ষেপ না করে তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। এর আগে অবশ্য যেসব স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তা সুষ্ঠু হয়নি। আমাদের সামনে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনের দুটো মডেল ছিল ফেনীর নির্বাচন ও নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন। শেষ পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী সংস্কৃতির প্রতি মানুষের ‘আস্থা’ ফিরে এসেছে। মানুষ নির্বাচনমুখী হয়েছে।

গেল বছরের শেষের দিকে রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে সংলাপ শুরু করেছেন, তা চলতি বছরের প্রথম দিকেও অব্যাহত থাকবে। এর মধ্য দিয়ে চলতি বছর আমরা নতুন একটি নির্বাচন কমিশন পাব। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে যে আইন প্রণয়ন করার কথা সংবিধানে বলা হয়েছে (১১৮-১), দীর্ঘ ৪৫ বছরে কোনো সরকারই এ আইনটি প্রণয়ন করেনি। ডিসেম্বরে (২০১৬) রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনায় এ বিষয়টি উঠে আসে। একই সঙ্গে একটি ‘নিরপেক্ষ’ ও ‘যোগ্যতাসম্পন্ন’ নির্বাচন কমিশনের দাবিও ওঠে। রাষ্ট্রপতি তার সাংবিধানিক অধিকার বলে (১১৮-১ ও ৪৮) প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন। কিন্তু তা সব পক্ষকে কতটুকু খুশি করতে পারবে, সে প্রশ্ন রয়ে গেছে। কেননা সিইসিসহ কমিশনারদের নিয়োগে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা থাকলেও ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দুটি ক্ষেত্র ছাড়া (প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ) অন্য সব নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি ‘প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ’ নিতে বাধ্য। ফলে রাষ্ট্রপতি যাদেরই নিয়োগ দিন না কেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শের’ বাধ্যবাধকতা একটি ‘সূক্ষ্ম অসন্তোষ’ সৃষ্টি করতে বাধ্য।

এই নির্বাচন কমিশনের গুরুত্ব অনেক। কারণ তাদের ওপর বর্তাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব। সেক্ষেত্রে ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ এবং একটি নির্বাচন আয়োজন করা চাট্টিখানি কথা নয়। আমরা স্বাধীনতার ৪৫ বছর পার করেছি। তার পরও একটি বড় ‘ব্যর্থতার’ জায়গা হচ্ছে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার অভাব। এই আস্থার অভাবের কারণে গণতন্ত্র বারবার মুখ থুবড়ে পড়ছে। আমরা একটি ভোটারবিহীন জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেখছি। ফলে যে নির্বাচন কমিশনটি গঠিত হতে যাচ্ছে, চলতি বছরটি তাদের জন্য হবে একটি ‘লিটমাস টেস্ট’, অর্থাৎ পরীক্ষার সময়। তারা তাদের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু বাড়াতে পারবেন, সেটাই হবে মূল আলোচনার বিষয়। সংবিধানের ১১৮-৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। তারা সংবিধানের কাছে দায়বদ্ধ। কিন্তু কাজী রকিবউদ্দীনের কমিশন সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ ব্যবহার করে ‘স্বাধীনভাবে নির্বাচন’ পরিচালনা করতে পারেনি। সরকারের ‘চাপ’ তারা অস্বীকার করতে পারেননি। ফলে যে নির্বাচন কমিশনটি গঠিত হতে যাচ্ছে তার ‘ভূমিকা’ নিয়ে একটা শংকা থেকেই গেল। একটি সার্চ কমিটিই সব সমস্যার সমাধান এনে দেবে না। আমরা যেন ভুলে না যাই কাজী রকিবউদ্দীন সার্চ কমিটির মাধ্যমেই নিয়োগ পেয়েছিলেন। ফলে ‘আস্থার সম্পর্ক’ গড়ে তোলাটাই জরুরি।

গেল বছর দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জাতীয় কাউন্সিল করেছে। কিন্তু কাউন্সিলের মাধ্যমে নয়া নেতৃত্ব বেরিয়ে আসেনি। তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে পরিবর্তন এসেছে। নতুন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন ওবায়দুল কাদের। অবশ্য আওয়ামী লীগের মূল কাণ্ডারি এখনও শেখ হাসিনা। তার নেতৃত্বে এবং তাকে কেন্দ্র করেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে। শেখ হাসিনা ৩৫ বছর ধরে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। যদিও একাধিকবার তিনি বলেছেন, তিনি খুশি হতেন যদি তিনি অবসরে যেতে পারতেন; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তিনি ছাড়া দলের নেতৃত্ব দেয়ার মতো এ মুহূর্তে কেউ নেই। ফলে সঙ্গত কারণেই তিনি নেতৃত্বে থেকে যাচ্ছেন এবং তার নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ ২০১৯ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন জন্ম নেয়া আওয়ামী লীগের রাজনীতির ৩৫ বছরই, অর্থাৎ অর্ধেক সময় ধরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ হাসিনা। বোধকরি এটা একটা রেকর্ড। অন্যদিক বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) বয়স প্রায় ৩৯ বছর। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জন্ম নেয়া এ দলটির ১৯৮৩ সাল থেকেই নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন খালেদা জিয়া। সেই অর্থে দীর্ঘ ৩৩ বছর তিনি দলটির চেয়ারপারসন। দলটি ২০১৬ সালে কাউন্সিল করেছে। কিন্তু এই কাউন্সিলে নয়া নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়নি। বলা যেতে পারে, দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এখনও পুরনো নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল। আওয়ামী লীগ অবশ্য কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে উপদেষ্টামণ্ডলীতে স্থান দিয়েছে। কিন্তু বিএনপি তা করেনি। নিয়ম রক্ষার্থে দল দুটি কাউন্সিল করেছে। কিন্তু তাতে পরিবর্তন এসেছে অতি সামান্যই।

গেল বছরের (২০১৬) একদম শেষের দিকে সরকার জেলা পরিষদের নির্বাচন আয়োজন করে। এর একটি ইতিবাচক দিক ছিল। সেই সঙ্গে ছিল নেতিবাচক দিক। সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রশাসনের সকল পর্যায়ের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ এ ক্ষেত্রে জেলা পরিষদের নির্বাচন একটি নির্বাচন বটে। কিন্তু তাতে করে ‘জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ’ নিশ্চিত হয়নি। কারণ এটা পরোক্ষ নির্বাচন। ভোট দিয়েছেন স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা। বলা যেতে পারে, ওই নির্বাচন ছিল অনেকটা একদলীয় ও একতরফা। আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ‘বিদ্রোহী’ আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বিরুদ্ধে। উপরন্তু ৬১ জন জেলা চেয়ারম্যানের মধ্যে ২৩ জন চেয়ারম্যান, ১৩৭ জন সদস্য ও ৫১ জন সংরক্ষিত নারী সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘বিজয়ী’ হওয়ায় জেলা পরিষদের নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ নেয়নি।

কাজেই চলতি বছরের রাজনীতিতে প্রাধান্য পাবে কয়েকটি বিষয়। এক. আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আদৌ কোনো আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে কিনা। দুই. রাষ্ট্রপতি যে নির্বাচন কমিশনারদের (একজন সিইসি ও চারজন সদস্য) নিয়োগ দেবেন, তাদের গ্রহণযোগ্যতা থাকবে কতটুকু। বিএনপি এই নির্বাচন কমিশনকে আস্থায় নিয়ে ২০১৯ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করবে কিনা। তিন. জঙ্গিবাদ কতটুকু নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা সম্ভব হবে। আমার বিবেচনায় এ তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করেই ২০১৭ সালের রাজনীতি আবর্তিত হবে।
Daily Jugantor
01.01.2017

নাসিক নির্বাচন : একটি মূল্যায়ন



সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বিজয়ী হয়েছেন। এই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন কম ছিল না। খোদ আইভী নিজে কিছুটা উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং নির্বাচনের আগে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অন্যত্র বদলি করার দাবি জানিয়েছিলেন। এই নির্বাচন অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব আমাদের দিয়েছে, যা আগামী দিনের রাজনীতিতে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলবে। প্রথমত, আইভীর এই বিজয় তার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তারই প্রতিফলন। তিনি অনেকটা ‘এককভাবে’ নির্বাচন পরিচালনা করে গেছেন। দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি কমই পেয়েছেন। তার ব্যক্তিগত ইমেজ, সততা, পারিবারিক ঐতিহ্য ইত্যাদি নির্বাচনে বিজয়ী হতে তাকে সাহায্য করেছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের মাঝে তার সম্পর্কে একটা ‘রিজার্ভেশন’ ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বে¡ও তিনি জিতেছেন শুধু তার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার কারণেই। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের তিনটি ‘পক্ষ’ এখানে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে প্রথম থেকেই ‘কমিটেড’ ছিল। এই তিনটি ‘পক্ষ’ হচ্ছে নির্বাচন কমিশন, সরকার ও রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। নির্বাচন কমিশন এবার সরকারের পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছে। সরকারপ্রধান চাচ্ছিলেন দেশবাসী তথা বিশ্ববাসীকে দেখাতে যে, দলীয় সরকারের আওতায় ‘সুষ্ঠু’ নির্বাচন সম্ভব, যা অতীতে সরকার ‘প্রমাণ’ করতে পারেনি। সরকারের কাছে গোয়েন্দা রিপোর্ট ছিল। আইভী যে জিতবেন, তা গোয়েন্দা রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছিল। তাই সরকার নির্বাচনটা ‘সুষ্ঠু’ হতে দিয়েছে। প্রচুর আইন রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। ফলে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। উপরন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জন্য এই নির্বাচন ছিল একটি ‘টেস্ট কেস’। বিএনপির ভবিষ্যৎ নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা যাচাই করা- দুটোই ছিল। ফলে এই নির্বাচন একটি ‘মেসেজ’ দিয়ে গেল দুটো বড় দলের জন্য। তৃতীয়ত, এই নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি উঠেছিল। সরকার ও ইসি তাতে রাজি হয়নি। এখন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। ফলে আগামীতে একাদশ সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি উঠলেও সরকার নাসিক নির্বাচনের দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে পারবে। সেনাবাহিনী মোতায়েন ছাড়াও যে নির্বাচন সুষ্ঠু করা যায়, সরকার এটা এখন প্রচার করতে চাইবে। চতুর্থত, বলা হচ্ছে- এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নৌকা তথা আওয়ামী লীগের ‘বিশাল’ জনপ্রিয়তা প্রমাণিত হল। এর পেছনে কিছুটা সত্যতা থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে স্থানীয় পর্যায়ের একটি নির্বাচন দিয়ে কোনো দলের জনপ্রিয়তা কতটুকু তা ‘প্রমাণ’ করা যাবে না। ব্যক্তি আইভী ২০১১ সালে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিলেন। এবার তার ব্যক্তিগত ইমেজ, প্লাস নৌকা- দুটো একসঙ্গে কাজ করেছে। আমার বিশ্বাস- তিনি যদি নৌকা মার্কা ছাড়াও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন, বিজয়ী হতেন। পঞ্চমত, নাসিক নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৭৪ হাজার ৯৩১। ভোট পড়েছে ২ লাখ ৮৮ হাজার ৬৫। এর মধ্যে বিএনপি প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খান পেয়েছেন ৯৬ হাজার ৬৭৪ ভোট। আমার জানা মতে, ২৭টি ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে বিএনপির ১২, আওয়ামী লীগের ১১, জাতীয় পার্টির ৩ ও বাসদের একজন প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। এ থেকে একটা ধারণা করা স্বাভাবিক যে, আওয়ামী লীগের বিকল্প হচ্ছে বিএনপি। বিএনপির নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দেশজুড়ে অজস্র মামলা-মোকদ্দমা থাকলেও তাদের জনপ্রিয়তার যে এতটুকুও ঘাটতি হয়নি, নাসিক নির্বাচন এর বড় প্রমাণ। বাংলাদেশে যে একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থা বিদ্যমান, এটা আবারও প্রমাণিত হল। ষষ্ঠত, নাসিক নির্বাচনে মহিলা ভোটাররা একটা ফ্যাক্টর ছিলেন। ভোটারদের মধ্যে ২ লাখ ৩৫ হাজার ২৬৯ জন মহিলা ভোটার। পত্রপত্রিকার রিপোর্টে দেখা গেছে, মহিলারা ব্যাপক হারে উপস্থিত হয়েছেন ভোট দেয়ার জন্য। এদের একটা বড় অংশেরই ভোট পেয়েছেন আইভী। সপ্তম, রাজনীতিতে যে একটি ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজার্স’ বা আস্থার সম্পর্ক থাকা দরকার, নাসিক নির্বাচনে সেটা প্রমাণিত হয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণায় উভয় প্রার্থীই একে অপরকে আক্রমণ করে কোনো বক্তব্য দেননি। কোনো উত্তেজনা ছড়াননি। যাকে নিয়ে সবচেয়ে বড় ভয় ছিল, তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং তার সঙ্গে আইভীর অতীত সম্পর্ক ভালো ছিল না, তিনিও কোনো ‘উত্তেজনা’ ছড়াননি। ফলে আস্থার সম্পর্ক থাকায়, নির্বাচন সুষ্ঠু ও সুন্দর হয়েছে। এ ধরনের নির্বাচন একটি ‘মডেল’ হতে পারে। অষ্টম, নাসিক নির্বাচন প্রমাণ করল প্রার্থী যদি ‘ভালো’ হয়, দুর্নীতিমুক্ত হয়, তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী ও মাস্তানির অভিযোগ যদি না থাকে, তাহলে ওই প্রার্থীর পক্ষে জনমত থাকে। ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনের জন্য এটা একটা ‘সিগন্যাল’। উভয় দলের শীর্ষ নেতারা একটা বিবেচনায় নিতে পারেন। কেননা বর্তমান সরকারের আমলে অনেক এমপির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। অনেক এমপির বিরুদ্ধে স্থানীয় সমস্যাগুলোর ব্যাপারে গুরুত্ব না দিয়ে ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা বাস্তবায়নে বেশি উৎসাহী- এমন অভিযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সেলিনা হায়াৎ আইভী ছিলেন ব্যতিক্রম। দুর্নীতির কোনো অভিযোগ নেই তার বিরুদ্ধে। পরিবারের সদস্যরা তার ক্ষমতা ব্যবহার করে কোনো সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন, এমনটি শোনা যায় না। মাত্র ১০ লাখ টাকার সম্পত্তির মালিক তিনি। হলফনামায় এমন তথ্যই তিনি দিয়েছেন। ফলে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি যদি সৎ ও যোগ্য প্রার্থীদের প্রার্থী করে, তাতে করে রাজনীতিতে শুধু গুণগত পরিবর্তনই আসবে না, বরং দলীয় সেই প্রার্থীকে বিজয়ী হতেও সাহায্য করবে। নাসিক নির্বাচন প্রমাণ করল প্রার্থী দিতে হবে সৎ, যোগ্য ও আধুনিকমনস্ক। নবম, এই নির্বাচন বিএনপির জন্যও ছিল একটি প্লাস পয়েন্ট। বিএনপি মূল রাজনীতিতে ফিরে এসেছে। বিএনপি নাসিক নির্বাচনে অংশ নিয়ে এবং নির্বাচনী লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত থেকে প্রমাণ করেছে তারা ‘রাজনীতির মাঠে’ থাকতে চায়। তবে এই ‘রাজনীতির মাঠে’ থাকাটা শুধু বিএনপির ওপরই নির্ভর করে না। অনেকাংশে নির্ভর করে সরকারের ওপর। ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’-এর পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বিএনপিকে ‘স্পেস’ দিতে হবে। আক্রমণাত্মক বক্তব্য পরিহার করে, বিএনপিকে আস্থায় নিয়েই রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। দশম, নাসিক নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী হেরে গেছে। এই হারকে মেনে নিতে হবে এবং কেন বিএনপি হারল, এর চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে হবে। স্থানীয় কোনো কোনো নেতা নির্লিপ্ত ছিলেন কিনা, তা খতিয়ে দেখতে হবে এবং বিএনপির জন্য যা করা দরকার, তা হচ্ছে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য এখন থেকেই পরিকল্পনা প্রণয়ন। নির্বাচনের জন্য ইস্যু গ্রহণ, প্রার্থী বাছাই, জোটের সদস্যদের সঙ্গে ‘কো-অর্ডিনেশন’ করা ইত্যাদি বিষয়কে প্রাধান্য দিতে হবে। তরুণ নেতৃত্বকে সামনে আনতে হবে। বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের (স্থায়ী কমিটি) উপদেষ্টা কমিটিতে রেখে বিএনপি একটি তরুণ নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে পারত, যারা আগামী দশকে বিএনপিকে নেতৃত্ব দেবে। সেটা হয়নি। এদিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। একাদশ, নাসিক নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে- এটাই শেষ কথা নয়। যেতে হবে অনেকদূর। একদলীয় নির্বাচন নয়, সব দলের অংশগ্রহণে একটি জাতীয় নির্বাচন দরকার। নাসিক নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সেলিনা হায়াৎ আইভী ছুটে গেছেন সাখাওয়াত হোসেন খানের বাসায়। চেয়েছেন তার সহযোগিতা। জবাবে সাখাওয়াত সাহেবও নির্বাচিত মেয়রকে আশ্বাস দিয়েছেন সহযোগিতার। রাজনীতি এমনটিই হওয়া উচিত। আস্থার সম্পর্ক রেখেই রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি পরিবর্তন প্রয়োজন। রাজনীতিকে গণমুখী করা, পরস্পরকে আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকা, কোনো একটি বিশেষ দলকে আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত না করা, জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের প্রতি সম্মান দেখানো, সুস্থ ধারার রাজনীতি প্রবর্তন করা- এসবই হচ্ছে সময়ের দাবি। রাজনীতি থেকে যদি অপসংস্কৃতিকে বিদায় করা না যায়, তাহলে তরুণ প্রজন্ম রাজনীতির ব্যাপারে আকৃষ্ট হবে না। তরুণ প্রজন্মের জন্যই নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রয়োজন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, নাসিক নির্বাচনের পর কেন্দ্রীয়ভাবে দুটি বড় দলের নেতারা যে ধরনের মন্তব্য করেছেন, তাতে নাসিক নির্বাচনের ‘স্পিরিট’কে প্রশ্নবিদ্ধ করবে
নাসিক নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। বাস্তব ক্ষেত্রে এই নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে তিনটি পক্ষ। আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছে। কেননা আওয়ামী লীগের দলীয় সরকারের আমলে যে ‘সুষ্ঠু ও সুন্দর’ নির্বাচন সম্ভব, তা তারা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। বিএনপির প্রার্থীকে তারা শেষ পর্যন্ত মাঠে রাখতে পেরেছে। এটা তাদের জন্য বড় বিজয়। বিএনপি প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খান হেরে গেছেন বটে। কিন্তু বিএনপিও বিজয়ী হয়েছে। বিএনপির বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের মানুষ তা পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি। ১২ কাউন্সিলরকে (বিএনপি সমর্থক) তারা নির্বাচিত করেছে। বিএনপি আবার মূলধারার রাজনীতিতে ফিরে এসেছে। নাসিক নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ বিএনপিকে নিয়ে যাবে ২০১৯ সালের নির্বাচনে। নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ায় এক অর্থে নির্বাচন কমিশনও বিজয়ী হয়েছে। কমিশন শেষ সময় এসে একটি ভালো নির্বাচন ‘উপহার’ দিল। সরকারের সদিচ্ছা থাকায় তারা এটি করতে পেরেছে। প্রশ্নটা সেখানেই। অতীতের নির্বাচনগুলো নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল। মিডিয়ার কারণে মানুষ তা দেখেছে। এ ক্ষেত্রে কমিশন তথা সিইসি সাংবিধানিকভাবে তাদের যে ভূমিকা, সেই ভূমিকার প্রতি সম্মান দেখাতে পারেননি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচনে ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেলেন। নির্বাচন কমিশন ‘তাকিয়ে তাকিয়ে’ তা দেখল। পরবর্তী সময়ে ইউপি নির্বাচনে ‘ভোট কেন্দ্র দখল’ আর ‘সিল মারা’ সংস্কৃতি চালু হল, ইসি থাকল নির্লিপ্ত। ভোট চলাকালীন সিইসি চলে গেলেন ‘প্রমোদ ভ্রমণে’ যুক্তরাষ্ট্রে! ঢাকার দুটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনেও সাধারণ মানুষ দেখল ইসির নিষ্ক্রিয় ভূমিকা। সর্বশেষ নাসিক নির্বাচনটা ‘সফল’ করতে গিয়ে সরকার কমিশনকে সম্মানের সঙ্গে বিদায় দিতে চাইছে! ফলে ইসি একটি ক্রেডিট পেতে পারে বটে। কিন্তু এর পেছনে কাজ করছিল সরকারের সদিচ্ছা। নাসিক নির্বাচনকে নিয়ে আমরা যেভাবেই মূল্যায়ন করি না কেন, সবার দৃষ্টি থাকবে এখন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে। নাসিক নির্বাচনের পরদিন ২৩ ডিসেম্বর তোফায়েল আহমেদ একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, নির্বাচন (জাতীয় সংসদ) হবে ২০১৯ সালে। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখেই ওই নির্বাচনটি হবে। ২০১৭ সালটি আমাদের জন্য তাই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। একটি সার্চ কমিটি হবে, যারা সিইসিসহ নির্বাচন কমিশনারদের মনোনয়ন দেবে। রাষ্ট্রপতি এখন সংলাপ করছেন একটি সার্চ কমিটি গঠনের ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য। এ ব্যাপারে বিএনপিসহ সংলাপে অংশগ্রহণকারী সব দলের নিজস্ব একটা সুস্পষ্ট অভিমত আছে। এখন সার্চ কমিটি গঠিত হবে এবং তাদের মনোনয়নের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি সিইসিসহ কমিশনারদের মনোনয়ন দেবেন। এ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা, দক্ষতা ও যোগ্যতা কতটুকু রক্ষিত হবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। যদি নিরপেক্ষতা নিশ্চিত না হয়, যদি দলীয় বিবেচনা প্রাধান্য পায়, তাহলে সংকট থেকে যাবে। উপরন্তু সাংবিধানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীকে রেখে নির্বাচন আয়োজন করা বৈধ হলেও সংবিধানের আলোকে একটা ‘মেকানিজম’ খুঁজে বের করা প্রয়োজন, যার মাধ্যমে ‘নির্বাচনকালীন সরকারের’ নিরপেক্ষতা নিশ্চিত

করা যায়। কেননা ‘সকল দলের অংশগ্রহণের’ স্বার্থে এ ধরনের নিরপেক্ষ একটি সরকার প্রয়োজন। নাসিক নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। এটা ছিল একটা উৎসবের মতো।

এমনটি হওয়াই প্রত্যাশিত ছিল এবং তাই হয়েছে। এই মুহূর্তে নাসিক নির্বাচন কিছু প্রশ্নের ‘জবাব’ দেবে না সত্য, কিন্তু সরকার এই নির্বাচন থেকে অনেক কিছু ‘শিখতে’ পারে, যা ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় একাদশ জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে সহায়ক হবে।
Daily Jugantor
25.12.2016

সার্চ কমিটি গঠনে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগ ও প্রাসঙ্গিক কথা


নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর এ মুহূর্তে দেশবাসীর দৃষ্টি বঙ্গভবনের দিকে। রাষ্ট্রপতি বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করছেন। উদ্দেশ্য নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে সবার মতামত নেয়া এবং সে মতে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। এরই মধ্যে তিনি বিএনপি, জাতীয় পার্টি, এলডিপি এবং কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সঙ্গে কথা বলেছেন। জাসদের সঙ্গে তিনি কথা বলবেন পরে। আরও ছয়টি দলকে তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তার উদ্দেশ্য পরিষ্কারÑ তিনি সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের একটা মতামত নিতে চানÑ কীভাবে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা যায়। সংবিধানে এর একটি ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু এর বাইরে গিয়ে তিনি সবার মতামত নিয়ে একটা ‘সিদ্ধান্ত’ নিতে চান। এ সিদ্ধান্তে একটি সার্চ কমিটি গঠিত হতে পারে, যারা ৫ জন কমিশনারসহ সিইসিকে মনোনয়ন দেবেন। অথবা তিনি কোনো সার্চ কমিটি গঠন না করেও একটি পূর্ণাঙ্গ কমিশন গঠন করতে পারেন। সংবিধানের ১১৮(১) ধারা তাকে এ সুযোগ দিয়েছে।
রাষ্ট্রপতি সবার মতামত নিতে চাচ্ছেনÑ এটা নিঃসন্দেহে একটা ভালো খবর। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্রপতির এ উদ্যোগ কি ফল বয়ে আনবে? প্রধান বিরোধী দল বিএনপি কি এ সিদ্ধান্ত মেনে নেবে? যদি বিএনপি রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তে খুশি না হয়, তাহলে বিএনপি কী সিদ্ধান্ত নেবে? রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের দিকে যেমন তাকিয়ে আছে পুরো জাতি, তেমনি তাকিয়ে আছে বিএনপির দিকেও। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন জরুরি। কেননা এ কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে ফেব্রুয়ারিতে। নতুন একটি কমিশন আসছে, যারা ২০১৯ সালের সম্ভাব্য নির্বাচন পরিচালনা করবেন। নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়টি পরিপূর্ণভাবে একটি প্রশাসনিক বিষয়। তবে এখানে রাষ্ট্রপতিকে কিছুটা দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ১১৮(১) এ বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দান করিবেন।’ সমস্যাটা এখানেই। এই যে ‘নিয়োগ দান করিবেন’ কথাটা বলা হয়েছে, এতে রাষ্ট্রপতির একটি ‘স্বাধীন তথা নিরপেক্ষ’ ক্ষমতা কতটুকু? রাষ্ট্রপতি কি এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন? আমাদের দেশে সংসদীয় সরকার বিদ্যমান। এ সংসদীয় সরকারে একজন রাষ্ট্রপতিকে কিছু ‘সেরিমনিয়াল’ দায়িত্ব পালন করতে হয়। আমাদের সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা আছেÑ তিনি কী করতে পারেন। তার ক্ষমতা কতটুকু। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, প্রধান নির্বাহীর সম্মতি ছাড়া তিনি সংলাপ আয়োজন করতে পারতেন না। সংবিধানের ৫৬ ধারা সম্পর্কে একজন অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান রাষ্ট্রপতি ধারণা রাখবেন, এটা স্বাভাবিক। তাছাড়া প্রকাশ্যে প্রধানমন্ত্রীর অনেক বক্তব্য আমরা দেখেছি, যেখানে তিনি রাষ্ট্রপতির হাতে ইসি পুনর্গঠনের সিদ্ধান্তটি ছেড়ে দিয়েছেন। এখন রাষ্ট্রপতি একটি সিদ্ধান্ত নেবেন। তাতে সরকারের, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর সমর্থন থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এটা ভালো হতো যদি রাষ্ট্রপতি বিএনপির পরপরই আওয়ামী লীগকে সংলাপে ডাকতেন। তাতে করে আওয়ামী লীগের একটা মতামত আমরা পেতে পারতাম। আমরা এরই মধ্যে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, এলডিপি ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের একটা মতামত পেয়েছি। এ মতামতগুলো মূলত কীভাবে ইসি পুনর্গঠন করা যায়, তা নিয়ে। যেহেতু ইসি গঠন নিয়ে কোনো আইন নেই এবং কোনো বিধিবিধানও নেই যে কীভাবে ইসি গঠন করতে হবে, সেক্ষেত্রে পুরো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে। রাষ্ট্রপতি সবার মতামত নিতে বাধ্য নন। একটি সার্চ কমিটি গঠনের কথাও সংবিধানে নেই। তবুও একটা ‘ট্র্যাডিশন’ এ দেশে চালু হয়েছে। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান এ ধরনের সংলাপ করেই ২০১২ সালে একটি সার্চ কমিটি গঠন করেছিলেন। যদিও সার্চ কমিটির মাধ্যমে যিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে প্রায় ৫ বছর দায়িত্ব পালন করলেন, তিনি তার নামের প্রতি, সার্চ কমিটির প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। অদক্ষতা এবং অযোগ্যতা নিয়ে পুরো কমিশন বিদায় নিচ্ছে ৯ ফেব্রুয়ারি। ফলে সার্চ কমিটির অভিজ্ঞতা আমাদের আছে এবং তা সুখকর নয়। তবে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় কতগুলো প্রস্তাব এসেছে। খালেদা জিয়া যেসব প্রস্তাব দিয়েছেন, তার মাঝে রয়েছে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ইসি গঠিত হবে, একটি বাছাই কমিটি গঠন (৫ সদস্যবিশিষ্ট) এবং বাছাই কমিটির আহ্বায়ক হবেন একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, যিনি সরকারের কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন না, বাছাই কমিটির সদস্যরা হবেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, সাবেক সচিব, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও একজন জ্যেষ্ঠ নারী। প্রতি পদের বিপরীতে দুইজনের নাম প্রস্তাব করা হবে এবং রাষ্ট্রপতি ৫ জনকে (সিইসিসহ) মনোনয়ন দেবেন। তত্ত্বগতভাবে এ ধরনের প্রস্তাব ভালো। কিন্তু সমস্যা রয়েছে অন্যত্র। জাতি হিসেবে আমরা এত ‘বিভক্ত’ যে, কোনো সিনিয়র সিটিজেন এ ধরনের পদে নিয়োগলাভে আদৌ উৎসাহিত হবেন না। তিনি দ্রুত বিতর্কিত হয়ে যেতে পারেনÑ এ আশঙ্কায় কেউই দায়িত্ব নিতে রাজি হবেন না। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমনই যে, আমরা যে কোনো সিদ্ধান্ত যদি আমাদের মনঃপূত না হয়, তাহলে দ্রুত তাকে বিতর্কিত করে ফেলি। অনেক সময় দলের শীর্ষ পদ থেকে যখন মন্তব্য করা হয়, তখন দলের প্রতিটি স্তরের নেতাকর্মী ওই ব্যক্তির সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশে এখনও বেশ কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রয়েছেন, যারা এখনও কর্মক্ষম। তাদের গ্রহণযোগ্যতাও আছে। কিন্তু চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে কেউই রাজি হবেন না দায়িত্ব গ্রহণ করতে। ইসি গঠনে একটি জাতীয় ঐকমত্যের কথা বলেছেন খালেদা জিয়া। তত্ত্বগতভাবে এটা ভালো। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। আমাদের মধ্যে ‘বিভক্তি’ এত বেশি এবং একদল অপর দলকে বিতর্কিত করতে এত বেশি পারঙ্গম, তাতে ঐকমত্যের প্রশ্নটি অবান্তর। আমরা বারবার বলে আসছি একটি ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস’ বা আস্থার সম্পর্ক স্থাপন করা ছাড়া কোনো দিনই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে না। বিজয়ের ৪৫ বছর যখন পার করে ফেলেছি আমরা, তখনও অতীত নিয়ে অনেক বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করছি। রাজনীতির চেয়ে ব্যক্তি আক্রমণ প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি। এ মানসিকতা যতদিন না আমরা পরিত্যাগ করতে পারব, ততদিন ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ক্ষীণ। রাজনীতিবিদদের কিছু অলিখিত ‘কোড অব কনডাক্ট’ অনুসরণ করা উচিত। জাতীয় ইস্যুতে, জাতীয় নেতাদের সম্পর্কে ন্যূনতম একটা ঐকমত্য থাকা জরুরি। না হলে বিভক্তি, তিক্ততা শুধু বাড়বেই। আর তাতে করে জাতি ‘বিভক্ত’ থাকবেই। রাজনীতিতে মতপার্থক্য থাকবেই। এ মতপার্থক্য যেন শুধু রাজনীতি আর কর্মসূচির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। নির্বাচন কমিশন গঠন ও শক্তিশালীকরণের প্রশ্নে বিএনপির প্রস্তাব থাকতেই পারে। এখন আওয়ামী লীগও এ ধরনের প্রস্তাব দিতে পারে। এখন অব্দি আওয়ামী লীগ এ ধরনের প্রস্তাব দেয়নি এবং আমার ধারণা, আওয়ামী লীগ কোনো প্রস্তাব দেবে না। বরং বিষয়টি ছেড়ে দেবে রাষ্ট্রপতির ওপর। বাস্তবতা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি এমন কিছু করবেন না, যা সংবিধান তাকে অনুমতি দেয়নি।
বিএনপির পাশাপাশি অন্যান্য দল এ পর্যন্ত যেসব প্রস্তাব দিয়েছে, তা নিয়েও আমরা আলোচনা করতে পারি। জাতীয় পার্টি ৫ সদস্যের একটি সার্চ কমিটির নাম দিয়েছে। তারা আইন করতে বলেছে ইসি গঠনের জন্য। একটি ইসি সচিবালয় ও কমিশনারদের ‘নিরপেক্ষতার’ কথাও বলা হয়েছে। কাজী রকিব উদ্দীন তো ‘নিরপেক্ষই’ ছিলেন। অন্য কমিশনারদের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাও ছিল না। তাহলে তারা গ্রহণযোগ্য হলেন না কেন? প্রশ্নটা এখানেই। তারা সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারেননি। অনেকটা ‘চাকরি’ করে গেছেন। একজন ‘আমলা’ সারা জীবনই আমলা থাকেন। সরকারের প্রতি যে ‘দায়বদ্ধতা’ চাকরি জীবনে তিনি ধারণ করেন, সাংবিধানিক পদে গিয়েও তিনি তা উপেক্ষা করতে পারেন না। তার ভেতরে সব সময় সেই মানসিকতা কাজ করে। তার ‘মাইন্ড সেটআপ’ থেকে তিনি বের হয়ে আসতে পারেন না। কাজী রকিব উদ্দীনের ক্ষেত্রে এমনটিই হয়েছে। একজন নারী কমিশনার তথা সার্চ কমিটির সদস্য হবেনÑ এমন কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু নারী হলেই তিনি গ্রহণযোগ্য হবেন, এমন কোনো গ্যারান্টি নেই।
আমরা এক কঠিন সময় পার করছি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) অভিজ্ঞতা আমাদের ভালো নয়। একদিকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, অন্যদিকে নির্বাচন বয়কট ও নির্বাচন বয়কটকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংসতা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি কালো দিক। ভোটারবিহীন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রক্ষা করা গেছে বটে, কিন্তু দেশে নির্বাচনী সংস্কৃতির মৃত্যু ঘটেছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য শক্তিশালী একটি বিরোধী দল থাকা দরকার। আমরা এরই মধ্যে একটি হাস্যাস্পদ সংসদের জন্ম দিয়েছি। জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দলের ‘আসনে’ আছে বটে। আবার তারা মন্ত্রীও হয়েছেন। পার্টিপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দলের ওপর কর্তৃত্ব আছে বলে মনে হয় না। ফলে জাতীয় পার্টি বিএনপির বিকল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে যাওয়ার যে সম্ভাবনা ছিল, তা হয়নি। এ কারণে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল সংসদে থাকা দরকার। না হলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে না। গত তিন বছরে অনেক জাতীয় ইস্যু সংসদে আলোচিত হয়নি। অনেক সময় সংসদ সদস্যদের অনুপস্থিতির কারণে নির্দিষ্ট সময়ে সংসদ বসেনি। এর অর্থ, অনেক সংসদ সদস্যই সংসদীয় কার্যক্রমের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। এখন সেই ‘পরিস্থিতি’ থেকে ফিরে আসতে হবে। বিএনপি আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে। কেননা, এ সংসদ নির্বাচনে (২০১৯, জানুয়ারি) বিএনপি অংশ না নিলে তাদের নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। উপরন্তু নেতাকর্মীদের স্থানীয়ভাবে ‘নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করার স্বার্থেও বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেয়া জরুরি। তাই বিএনপির জন্য একটি ‘স্পেস’ দরকার। তবে বড় কথা হলো, আমাদের মানসিকতায় আমূল পরিবর্তন দরকার। বিএনপি নিঃসন্দেহে এখন যথেষ্ট দুর্বল। মামলা-মোকদ্দমা আর কোর্টে যাওয়া-আসার মধ্য দিয়ে তাদের দিন যাচ্ছে। সিনিয়র অনেক নেতা এখন আর সক্রিয় নন। কোনো বড় আন্দোলনও তারা গড়ে তুলতে পারছেন না। তারপরও বিএনপির একটা বড় জনসমর্থন আছে। বিএনপিকে আস্থায় নিয়েই নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। এক্ষেত্রে আমার বিবেচনায় সার্চ কমিটি নয়, বরং বিএনপি যদি সিইসি’সহ কমিশনারদের নাম প্রস্তাব করে সেখান থেকে অন্তত দুইটি নামকে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। আর যদি সার্চ কমিটি গঠন করতে হয়, সেক্ষেত্রে সাংবিধানিক পদে যারা আছেন, তাদেরসহ সাবেক বিচারপতি ও শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে একটি সার্চ কমিটি গঠন করা যেতে পারে। সাবেক বা এখনও রাষ্ট্রীয় পদে আছেন, এমন আমলাদের সার্চ কমিটির প্রধান করা ঠিক হবে না। আমলাদের অনেকের মাঝে সরকারের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নেয়ার একটা প্রবণতা থাকে। এমনকি অবসরের পরও তারা সরকারি দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন। এক্ষেত্রে একজন বিচারপতিকে সার্চ কমিটির প্রধান করা শ্রেয়। এখনও বিচারপতিরা আমাদের শদ্ধার পাত্র। তাদের ওপর আস্থা রাখা যায়। রাষ্ট্রপতি অনেক ‘খুচরা’ দলের সঙ্গে সংলাপ করবেন। আসলে এদের কি আদৌ কোনো গণভিত্তি আছে? ন্যাশনাল ফ্রন্ট, বিজেপি, তরিকত ফেডারেশনÑ এদের গণভিত্তি কী? কিংবা ওয়ার্কার্স পার্টি? বিগত সংসদ নির্বাচনগুলো পর্যালোচনা করলে এদের ভোটের প্যাটার্ন সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। তাই আস্থাটা রাখা দরকার দুইটি বড় দলের মাঝে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ যদি ন্যূনতম ইস্যুতে ‘এক’ হয়, তাহলে এ দেশে একটি সুস্থ নির্বাচন সম্ভব। এক্ষেত্রে প্রয়োজন এ দুইটি দলের নেতাদের মানসিকতার পরিবর্তন। মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে ওই ‘তালগাছ তত্ত্ব’ (বিচার মানি, তালগাছ আমার) সামনে চলে আসবে। রাষ্ট্রপতির উদ্যোগ ব্যর্থ হবে। আমরা আরও সংকট প্রত্যক্ষ করব আগামী দিনগুলোতে। সেটি আমরা কেউই চাই না। এরই মধ্যে নাসিক নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। আওয়ামী লীগ প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী বিজয়ী হয়েছেন এবং তিনি বিএনপি প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খানের বাসায় গিয়ে তার সহযোগিতা চেয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, যা অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। আমরা আগামী দিনগুলোতে এমনটাই দেখতে চাই।
Daily Alokito Bangladesh
25.12.2016

বরফ কি আদৌ গলবে!

নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিএনপি সংলাপ করেছে গত ১৮ ডিসেম্বর। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনায় তার দল খুশি ও আশাবাদী। আর রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিবের বক্তব্য অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি মনে করেন বিএনপির প্রস্তাব নির্বাচন কমিশন গঠনে সহায়ক। এ ধরনের সংবাদগুলো আমাদের আশা জাগায়। বিএনপি সংলাপ চেয়েছিল আর প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ইসি পুনর্গঠনে বিএনপি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাব দিক। গেল নভেম্বরে লিখিত আকারে বেগম জিয়া ইসি পুনর্গঠনে কিছু প্রস্তাব রেখেছিলেন। তারা সেই প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির দপ্তরেও পৌঁছে দিয়েছিলেন। ১৮ তারিখ ওই প্রস্তাবগুলোর আলোকেই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপ করল বিএনপি। কিন্তু একটি সংলাপ সব সমস্যার সমাধান এনে দেয় না। টানেলের শেষ মাথায় অনেক দিন ধরেই কোনো আলো নেই। এখন কী সেই আলো জ্বলে উঠল! বরফ কী তাহলে গলতে শুরু করেছে? মির্জা ফখরুলের বক্তব্যে যেমনি আমরা একটি আশার আলো দেখতে পাই, ঠিক তেমনি ক্ষমতাসীন দলের দু-একজন নেতার বক্তব্যে আবারও আশাভঙ্গ হয়। টানেলের শেষ মাথায় যে আলো জ্বলে উঠল, তা আবার ‘দপ’ করে নিভে না যায়। তবে এই সংলাপ নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেক। প্রশ্ন আছে রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নিয়েও। তার পর বিএনপি বড় দল। আগামী সংসদ নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণ জরুরি। তাই ইসি পুনর্গঠন নিয়ে বিএনপি যে প্রস্তাব দেয় তার গুরুত্ব অনেক।
বেগম জিয়া নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে যে প্রস্তাব দিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে আলোচনার দাবি রাখে। মোটা দাগে বেগম জিয়ার প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ইসি গঠিত হবে, একটি বাছাই কমিটি গঠন (৫ সদস্যবিশিষ্ট) এবং বাছাই কমিটির আহ্বায়ক হবেন একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, যিনি সরকারের কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন না, বাছাই কমিটির সদস্যরা হবেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, সাবেক সচিব, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও একজন জ্যেষ্ঠ নারী। প্রতি পদের বিপরীতে ২ জনের নাম প্রস্তাব করা হবে এবং রাষ্ট্রপতি ৫ জনকে (ইইসিসহ) মনোনয়ন দেবেন। তত্ত্বগতভাবে এ ধরনের প্রস্তাব ভালো। কিন্তু সমস্যা রয়েছে অন্যত্র। জাতি হিসেবে আমরা এত ‘বিভক্ত’ যে, কোনো সিনিয়র সিটিজেন এ ধরনের পদে নিয়োগ লাভে আদৌ উৎসাহিত হবেন না। তিনি দ্রুত বিতর্কিত হয়ে যেতে পারেনÑ এই আশঙ্কায় কেউই দায়িত্ব নিতে রাজি হবেন না। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমনই যে, আমরা যে কোনো সিদ্ধান্ত যদি আমাদের মনঃপূত না হয়, তাহলে দ্রুত তাকে বিতর্কিত করে ফেলি। অনেক সময় দলের শীর্ষ পদ থেকে যখন মন্তব্য করা হয়, তখন দলের প্রতিটি স্তরের নেতাকর্মীরা ওই ব্যক্তির সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশে এখনো বেশ কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রয়েছেন, যারা এখনো কর্মক্ষম। তাদের গ্রহণযোগ্যতাও আছে। কিন্তু চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে কেউই রাজি হবেন না দায়িত্ব গ্রহণ করতে। ইসি গঠনে একটি জাতীয় ঐকমত্যের কথা বলেছেন বেগম জিয়া। তত্ত্বগতভাবে এটা ভালো। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। আমাদের মধ্যে বিভক্তি এত বেশি এবং এক দল অপর দলকে বিতর্কিত করতে এত বেশি পারঙ্গম তাতে ঐকমত্যের প্রশ্নটি অবান্তর। আমরা বারবার বলে আসছি একটি ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস’ বা আস্থার সম্পর্ক স্থাপন করা ছাড়া কোনোদিনই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে না। বিজয়ের ৪৫ বছর যখন পার করে ফেলেছি, এখনো আমরা অতীত নিয়ে অনেক বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করছি। রাজনীতির চেয়ে ব্যক্তি আক্রমণ প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি। ওই মানসিকতা যতদিন না আমরা পরিত্যাগ করতে পারব, ততদিন ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ক্ষীণ। রাজনীতিবিদদের কিছু অলিখিত কোড অব কনডাক্ট অনুসরণ করা উচিত। জাতীয় ইস্যুতে জাতীয় নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে ন্যূনতম একটা ঐকমত্য থাকা জরুরি। না হলে বিভক্তি, তিক্ততা শুধু বাড়বেই। আর তাতে করে জাতি বিভক্ত থাকবে। রাজনীতিতে মতপার্থক্য থাকবেই। এই মতপার্থক্য যেন শুধু রাজনীতি আর কর্মসূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। নির্বাচন কমিশন গঠন ও শক্তিশালীকরণের প্রশ্নে বিএনপির প্রস্তাব থাকতেই পারে। এখন আওয়ামী লীগও এ ধরনের প্রস্তাব দিতে পারে। এখন অবধি আওয়ামী লীগ এ ধরনের প্রস্তাব দেয়নি এবং আমার ধারণা আওয়ামী লীগ কোনো প্রস্তাব দেবে না। বরং বিষয়টি ছেড়ে দেবে রাষ্ট্রপতির ওপর। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকের পর কার্যবিবরণী প্রকাশ এবং আলোচনায় দুটি বড় জোটের (১৪ ও ২০ দলীয় জোট) প্রতিনিধির উপস্থিতির যে কথা বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাও বিতর্ক বাড়াতে পারে। একটি কার্যবিবরণী প্রকাশ করার অর্থ হচ্ছে, রাষ্ট্রপতিকে অস্বীকার করার শামিল। রাষ্ট্রপতির ওপর আস্থা রেখেই তো বিএনপি আলোচনায় যাচ্ছে। তাহলে কার্যবিবরণী প্রকাশ কেন?
একটি বাছাই কমিটির অভিজ্ঞতা আমাদের ভালো নয়। বাছাই কমিটির মাধ্যমেই কাজী রকিবউদ্দীন মনোনীত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। একজন সাবেক আমলা যে গ্রহণযোগ্য হবেন, তার কোনো মানে নেই। বরং দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় রাষ্ট্রপতি স্বউদ্যোগে সিইসি ও কমিশনারদের একটি তালিকা চাইতে পারেন প্রতিটি দলের কাছে। এর মধ্যে কোনো নাম যদি ‘কমন’ হয়ে যায়, রাষ্ট্রপতি ওই নামগুলো বেছে নিতে পারেন। এর মধ্য দিয়ে এক ধরনের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
আমরা এক কঠিন সময় পার করছি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) অভিজ্ঞতা আমাদের ভালো নয়। একদিকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, অন্যদিকে নির্বাচন বয়কট এবং নির্বাচন বয়কটকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংসতা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি ‘কালো দিক’। ‘ভোটারবিহীন’ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রক্ষা করা গেছে বটে, কিন্তু দেশে নির্বাচনী সংস্কৃতির মৃত্যু ঘটেছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য শক্তিশালী একটি বিরোধী দল থাকা দরকার। আমরা ইতোমধ্যে একটি হাস্যাস্পদ সংসদের জন্ম দিয়েছি। জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দলের ‘আসনে’ আছে বটে। আবার তারা মন্ত্রীও হয়েছেন। পার্টিপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দলের ওপর কর্তৃত্ব আছে বলে মনে হয় না। ফলে জাতীয় পার্টি বিএনপির বিকল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে যাওয়ার যে সম্ভাবনা ছিল তা হয়নি। এ কারণে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল সংসদে থাকা দরকার। না হলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে না। গত তিন বছরে অনেক জাতীয় ইস্যু সংসদে আলোচিত হয়নি। অনেক সময় সংসদ সদস্যদের অনুপস্থিতির কারণে নির্দিষ্ট সময়ে সংসদ বসেনি। এর অর্থ অনেক সংসদ সদস্যই সংসদীয় কার্যক্রমের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। এখন সেই ‘পরিস্থিতি’ থেকে ফিরে আসতে হবে। বিএনপি আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে। কেননা এই সংসদ নির্বাচনে (২০১৯ জানুয়ারি) বিএনপি অংশ না নিলে বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। উপরন্তু নেতাকর্মীদের স্থানীয়ভাবে ‘নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করার স্বার্থেও বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়া জরুরি। তাই বিএনপির জন্য একটি ‘স্পেস’ দরকার।
রাষ্ট্রপতি আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি জাতির অভিভাবক। অভিভাবক হিসেবে তার যে ‘ভূমিকা’ রাখার কথা, তিনি তাই রাখবেন। তিনি তার ‘সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা’ সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা রাখেন। একজন আইনজীবী অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান তিনি। আজ এক কঠিন সংকটের মুখোমুখি জাতি। একটি সিদ্ধান্ত তিনি দেবেন বটে, কিন্তু তাতে বিএনপিসহ সব দল ‘সন্তুষ্ট’ হবে এটা নাও হতে পারে। কিন্তু আমাদের উচিত হবে না রাষ্ট্রপতিকে বিতর্কিত করা। রাষ্ট্রপতি ইসি গঠনে একটি সার্চ কমিটি গঠন করুন আর নাই করুন, বড় দুটি দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলাটা জরুরি। এই আস্থার সম্পর্কটা না থাকায় গণতন্ত্রকে আমরা আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারছি না। গত ৪৫ বছরে আমাদের অনেক অর্জন আছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ ভাগের ওপরে ধরে রাখা, মাথাপিছু আয় ১৩১৪ ডলারে উন্নীত করা, তৈরি পোশাকশিল্পে বিশ্বব্যাপী আমাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ইত্যাদি। এখন বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ ২০২৪ সালের মধ্যেই স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে গিয়ে শিল্পোন্নত দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে। যে ১১টি দেশকে পরবর্তী শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, বাংলাদেশ তার অন্যতম। ফলে এই যে ‘অর্জন’, এই অর্জন ধরে রাখতে হলে আস্থার সম্পর্কটা গড়ে তোলা জরুরি। আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠলেই নির্বাচনের একটা পরিবেশ সৃষ্টি হবে। সব দল নির্বাচনে অংশ নেবে এবং আমরা একটা শক্তিশালী সংসদ পাব।
এখন বিএনপির সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপ শেষ হলো। পর্যায়ক্রমে অন্য দলগুলোর সঙ্গেও রাষ্ট্রপতির সংলাপ হবে। কিন্তু আমরা চাই না শুধু ‘ফটোসেশন’-এর মধ্য দিয়ে এই সংলাপ শেষ হোক। বিএনপির মতো অন্যান্য দলও প্রস্তাব দিতে পারে। আওয়ামী লীগও প্রস্তাব দিতে পারে। মূল বিষয় একটাইÑ ইসি পুনর্গঠন। এটা কীভাবে সম্পন্ন হবে? সংবিধান বলছে (১১৮-১) ‘রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।’ এই দায়িত্বটি সম্পূর্ণভাবে তার। তিনি যে একটি সার্চ কমিটি গঠন করবেন, তা করতে তিনি বাধ্য নন। সংবিধানেও সার্চ কমিটি বলে কোনো কথা বলা নেই। তবে ‘ডকট্রিন অব নেসাসিটি’ বলে একটা কথা আছে। এটা বিচার বিভাগীয় ভাষা। এই ডকট্রিন অব নেসাসিটি তত্ত্ব প্রয়োগ করে অতীতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান একটি সার্চ কমিটি গঠন করেছিলেন। বর্তমান রাষ্ট্রপতি এই সার্চ কমিটি গঠন নাও করতে পারেন। নিশ্চয়ই তিনি আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে একটি ধারণা পাবেন। যতদূর জানি সম্ভাব্য নামের তালিকা (সার্চ কমিটির) নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। বিএনপি একটি মতামত দিয়েছে কারা সার্চ কমিটিতে থাকতে পারেন। কোনো নাম দেয়নি। রাষ্ট্রপতিও কোনো নাম চাননি। হতে পারে আলোচনা চলাকালীন বিএনপির কাছে একটি নামের তালিকা চাইতে পারেন রাষ্ট্রপতি।
আসলে মূল কথা একটিই, আস্থার সম্পর্ক গড়ে না উঠলে সার্চ কমিটি গঠন করেও কোনো লাভ হবে না। সংবিধানের ৪৮(৩) ধারামতে রাষ্ট্রপতি ‘সম্ভাব্য সার্চ কমিটি গঠন’ কিংবা ‘কমিশনারসহ সিইসিকে নিয়োগ’দানের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতে বাধ্য। এখানেই রয়েছে তার সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা। তাই এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীই হচ্ছেন মুখ্য ব্যক্তি। যদিও প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, রাষ্ট্রপতি এ ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত দেবেন, তা তারা মেনে নেবেন। রাষ্ট্রপতির কাছে অনেক বিকল্প আছে। তিনি সার্চ কমিটির ব্যাপারে নাম চাইতে পারেন দলগুলোর কাছে। এককভাবে তিনি সার্চ কমিটি গঠন করতে পারেন। অথবা সরাসরি সিইসিসহ ৫ জনকে নিয়োগ দিতে পারেন। এটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। তাই একটা সংলাপ হচ্ছে। ভালো হোক, মন্দ হোক, এই সংলাপ একটা আস্থার সম্পর্ক সৃষ্টি করুক, এ প্রত্যাশা আমাদের সবার।
Daily Amader Somoy
20.12.2016

সাড়ে চার দশকে বাংলাদেশের অর্জন

চলতি ডিসেম্বরে বাংলাদেশ তার বিজয় অর্জনের ৪৫ বছর পার করেছে। একটি রাষ্ট্রের জন্য এই ৪৫ বছর একেবারে কম সময় নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ একটি শক্ত অবস্থানে আছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে ধরে রাখা, পরবর্তী শিল্পোন্নত ১১টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম থাকা, বিশ্বের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবস্থান ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশ তার অবস্থান শীর্ষে ধরে রাখতে পেরেছে। এই ৪৫ বছরের বৈদেশিক নীতি যদি পর্যালোচনা করা যায়, তাহলে মূলত তিনটি ধারা আমরা লক্ষ করব। এক. স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত একটি ধারা। দ্বিতীয় ধারার সূচনা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের আগস্টের পর, যা অব্যাহত থাকে ২০০৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। তৃতীয় ধারার সূচনা হয়েছে পুনরায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে। এই তিনটি ধারায় কিছু কিছু উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আমরা লক্ষ করি। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ যে বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করেছিল, তা ছিল স্বাভাবিক; বিশেষ করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের সঙ্গে ‘বিশেষ সম্পর্ক’ ছিল আমাদের বৈদেশিক নীতির উল্লেখযোগ্য দিক। আন্তর্জাতিক আসরে চীনের বিরোধিতা ও নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থেই বৃহৎ শক্তি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ‘ভালো সম্পর্ক’ স্থাপন করেছিল বাংলাদেশ। একই সঙ্গে ১৯৭২ সালে ভারতের সঙ্গে একটি ২৫ বছর মেয়াদি মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশ যে তার জোট নিরাপত্তা (যা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল) ও ইসলামিক বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায়, তার প্রমাণ হিসেবেই ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু আলজিয়ার্সে ন্যাম সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন এবং ১৯৭৪ সালে লাহোরে ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরপরই চীন দু-দুবার জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করলেও বঙ্গবন্ধু চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে বড় পরিবর্তন আসে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। চীন ও সৌদি আরব ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ওই সময় বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে চীন ও সৌদি আরবের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায় এবং সেই সঙ্গে ভারতের সঙ্গেও সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এই প্রবণতা জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে শেখ হাসিনার প্রথম শাসনকাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। অর্থাৎ সম্পর্কের প্রশ্নে চীন ও সৌদি আরবকে গুরুত্ব দেওয়া। জিয়া মনে করতেন বাংলদেশ হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে ইসলামের ব্রিজস্বরূপ। জিয়ার শাসনামলে বাংলাদেশ ইসলামিক সলিডারিটি ফান্ডের স্থায়ী কাউন্সিলের সদস্য পদ লাভ করে। আল-কুদ কমিটি, ইরান-ইরাক যুদ্ধের মধ্যস্থতাকারী কমিটির (১৯৮১) সদস্যও ছিল বাংলাদেশ। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য পদে বিজয়ী হয়। চীনের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী এক ‘সামরিক সম্পর্কে’ বাংলাদেশ জড়িয়ে যায় ওই সময়। গঙ্গায় পানি প্রত্যাহার নিয়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের কিছুটা অবনতি হলেও ১৯৭৭ সালেই বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানিবণ্টনের প্রশ্নে একটি চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল। এই সময় (১৯৭৮) সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক আফগান আগ্রাসনের ব্যাপারে কঠোর হয়েছিল বাংলাদেশ। এমনকি প্রায় একই সময় ভিয়েতনাম কর্তৃক কম্পুচিয়া ‘দখলের’ও সমর্থন দেয়নি বাংলাদেশ, বরং কম্পুচিয়ার প্রবাসী সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল। এরশাদের সময়সীমায় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং ঢাকায় অবস্থিত ১৪ সোভিয়েত কূটনীতিককে বাংলাদেশে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের উদ্যোগেই ১৯৮৫ সালে সার্ক আত্মপ্রকাশ করে। চীনের ওপর ‘সামরিক নির্ভরতা’ (প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র ক্রয়) এরশাদের আমলেও অব্যাহত থাকে।
খালেদা জিয়া দু-দুবার সরকার পরিচালনা করেন (১৯৯১-১৯৯৬, ২০০১-২০০৬)। তিনি মূলত জিয়া-এরশাদের সময়সীমায় অনুসৃত বৈদেশিক নীতির ধারাবাহিকতা (চীনের সঙ্গে সম্পর্ক, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে উন্নতি, সার্ককে গুরুত্ব দেওয়া, সৌদি আরবের সঙ্গে ‘বিশেষ সম্পর্ক’ ইত্যাদি) অনুসরণ করেন। তিনি ‘নিবারক কূটনীতি’ প্রয়োগ করে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ নেন। তাঁর আমলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ব্যাপকভাবে অংশ নেয়। তিনি তাঁর দ্বিতীয় টার্মে ‘পূর্বমুখী বৈদেশিক’ নীতি গ্রহণ করেন। তাঁর শাসনামলেই চীনের ‘কুনমিং উদ্যোগ’ (যার পরিবর্তিত নাম বিসিআইএম)-এর কথা শোনা যায়। মিয়ানমার আমাদের সীমান্তবর্তী একটি দেশ। আমাদের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে মিয়ানমারে। ১৯৭২ সালেই মিয়ানমার আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমার আমাদের বৈদেশিক নীতিতে উপেক্ষিত ছিল। খালেদা জিয়ার শাসনামলে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
শেখ হাসিনা তিন টার্মের জন্য ক্ষমতাসীন হয়েছেন। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষমতাসীন হয়ে তিনি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারটিকে বেশ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানিবণ্টনের ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি হয়েছিল; যদিও তাঁর আমলে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তিটি তিনি আর নবায়ন করেননি। ভারতে আশ্রিত পাহাড়ি শরণার্থীদের তিনি দেশে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর আমলে সার্কের ভেতরে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার সিদ্ধান্ত (SAGQ) গৃহীত হয়েছিল; যদিও তা কার্যকর হয়নি। শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য আমদানি বাড়ে তিন গুণ। ১৯৯৮ সালে ভারত ও পাকিস্তান পর পর কয়েকটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে তিনি শান্তি স্থাপনের একটি উদ্যোগ নেন, যা প্রশংসিত হয়। তাঁর সময় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে আসেন। তাঁর শাসনামলে বাংলাদেশ সিটিপিটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। একই সঙ্গে ‘হানা’ চুক্তিও (হিউম্যানিটোরিয়ান অ্যাসিস্ট্যান্স নিডস অ্যাসেসমেন্ট) স্বাক্ষর করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। তিনি ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব ক্ষুদ্রঋণ শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে চীনকে বেছে নিলেও সামরিক ক্ষেত্রে চীনের ওপর থেকে পরিপূর্ণ নির্ভরশীলতা তিনি কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর আমলে ঢাকায় রাশিয়ার অস্ত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ওই সময় চীনের বদলে রাশিয়া থেকে আটটি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয় করেছিল (মূল্য ১২৪ মিলিয়ন ডলার)। চীন মিগ-২৯ বিমান সরবরাহ করতে রাজি হলেও বাংলাদেশ ওই বিমান রাশিয়া থেকে সংগ্রহ করেছিল। শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশ দুটি আঞ্চলিক জোট ডি-৮ ও বিমসটেকে যোগ দেয়। তিনি ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনে (ইসলামাবাদ, মার্চ ১৯৯৭) যোগ দিয়ে ইসলামিক বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদার করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ওই সময় তিনি একটি অভিন্ন বাজার প্রতিষ্ঠারও দাবি জানিয়েছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এবং ২০১৪ সালের সব শেষে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি এখনো সরকার পরিচালনা করছেন।
তাঁর সরকারের সময় অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি উন্নত হয়েছে। ট্রানজিট (ট্রান্সশিপমেন্ট অথবা করিডর) নিয়ে বাংলাদেশে বড় বিতর্ক থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর প্রথম ভারত সফরের সময় এ-সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং ইতিমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে তা কার্যকরও হয়েছে; যদিও ট্রানজিট ‘ফি’ নিয়ে একটি বিতর্ক আছে। বলা হচ্ছে ট্রানজিটের বিষয়টি বহুপক্ষীয়তার আলোকে দেখা হবে। কিন্তু দেখা গেছে ভারত একপক্ষীয়ভাবে তা ব্যবহার করেছে, ভুটান বা নেপাল এখনো ট্রানজিট পায়নি। ভারতের এ দুটি দেশকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার কথা। কিন্তু ইতিমধ্যে এই সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে—এ তথ্য আমাদের জানা নেই। এমনকি ভারতের ‘সাতবোন’ রাজ্যগুলো কর্তৃক চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা-ও বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশি পণ্য খালাস করতেই হিমশিম খাবে। এ ক্ষেত্রে ‘সাতবোন’ রাজ্যের পণ্য বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। ভারত অবকাঠামো খাতে যে ঋণ দিয়েছে তা-ও বাংলাদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর ঋণের মতোই এ ঋণ দিয়ে ভারতীয় পণ্য ও সেবা কিনতে আমরা বাধ্য। মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় যে উন্নয়ন ও সহযোগিতাসংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। ওই চুক্তিতে যে ‘ভাষা’ ব্যবহার করা হয়েছিল, তাতে ভারতীয় স্বার্থই রক্ষিত হয়েছে বেশি করে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। গত সাত বছর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফর (২০১৫) করে দুই দেশের সম্পর্ককে অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তাঁর আমলে ঐতিহাসিক ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়িত হয়েছে। ছিটমহলগুলোতে বসবাসরত (ভারতের ১১১টি, বাংলাদেশের ৫১টি) নাগরিকরা তাদের স্ব-ইচ্ছায় নিজ নিজ দেশে ফিরে গেছে। কিন্তু তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে যে সমস্যা তা রয়ে গেছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আগ্রহ থাকলেও শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারণে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হচ্ছে না। সীমান্ত হত্যাও বন্ধ হয়নি। মোদির ঢাকা সফরের সময় নতুন আঞ্চলিক জোট বিবিআইএন (বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল) আত্মপ্রকাশ করলেও নানা প্রশ্ন আছে। সার্ক অকার্যকর হয়ে গেছে। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমছে না। ট্যারিফ-প্যারাট্যারিফ কমানোর কোনো উদ্যোগ নেই। ভারত থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া গেছে বটে; কিন্তু আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না।
মহাজোট সরকারের আমলে হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির আলোকে ওই সফর গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাংলাদেশের প্রাপ্তি ছিল কম। যৌথ অংশীদারি সংলাপ নামের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তিতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই, সহিংস চরমপন্থা, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান এবং জলদস্যুতার মতো আন্তর্দেশীয় অপরাধবোধ ও নিরাপত্তা সহযোগিতার কথা বলা হয়েছিল। তবে ধারণা করা হচ্ছে এবং বিভিন্ন বিশ্লেষকের লেখনীতে এটা বেরিয়ে এসেছে যে এ ধরনের চুক্তি ভবিষ্যতে চীনের বিরুদ্ধে একটি জোট গড়ে তোলার কাজে ব্যবহৃত হতে পারে! দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান মার্কিন প্রভাব, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ গড়ে ওঠার আলোকেই হিলারির ওই সফরকে বিশ্লেষণ করা যায়; যদিও হিলারির ওই সফরে বাংলাদেশের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বাংলাদেশ তার সব পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের যে দাবি, তা এখন বাতিল হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ‘টিফা’র বদলে এখন ‘টিকফা’ চুক্তি (ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট) করেছে। এতে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশ ‘মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন’ (এমসিসি) থেকে ভবিষ্যতে সাহায্য পাবে—এমন কোনো প্রতিশ্রুতিও আমরা পাইনি। তবে হিলারি ক্লিনটনের ঢাকা সফরে তাঁর একটি বক্তব্যে আমি আশাবাদী। তরুণদের সঙ্গে এক আড্ডায় তিনি বাংলাদেশকে একটি Soft power হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। যেকোনো বিবেচনায় এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য। বিশ্ব শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়ে কিংবা আরএমজি সেক্টরে বিশ্ব আসরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে একটি ‘শক্তি’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। আমাদের নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে বাংলাদেশের এই অর্জনকে ধরে রাখা, বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের সঙ্গে দ্রুত একটা সম্পর্ক স্থাপন জরুরি। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত ভারতীয় ‘লবি’ আমাদের সাহায্য করতে পারে। শেখ হাসিনার সরকারের একটি বড় প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচন নিয়ে বহির্বিশ্বে যে নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছিল, তা তিনি কাটিয়ে উঠেছেন। বড় শক্তিগুলো তাঁর সরকারের ওপর আস্থা রেখেছে। তিনি চীন ও জাপান সফর করেছেন। চীনের প্রেসিডেন্ট ঐতিহাসিক সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন, এমনকি প্রধানমন্ত্রী গোয়ায় ব্রিকস-বিমসটেক আউটরিচ সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন (২০১৬)। এর মধ্য দিয়ে তাঁর সরকারের প্রতি এবং তাঁর বৈদেশিক নীতির প্রতি বহিঃসমর্থন আরো বাড়ল। বাংলাদেশকে এখন উঠতি শিল্পোন্নত ১১টি দেশের একটি হিসাবে ধরা হচ্ছে। এটা তাঁর জন্য একটি প্লাস পয়েন্ট। তাঁর চীন ও জাপান সফর আমাদের অর্থনৈতিক কূটনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জাপান ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক মূলত আর্থিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট। জাপানের কাছ থেকে আমরা বড় ধরনের সাহায্য পেয়ে থাকি এবং প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের সময়ও এই সাহায্যের ধারা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। চীনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। চীনের পররাষ্ট্রনীতি এখন ব্যবসানির্ভর। ‘আইডোলজি’ এখানে প্রাধান্য পায় না। ফলে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ বাড়ানো কিংবা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহ সব কিছুই আবর্তিত হচ্ছে চীনের ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণের আলোকে। বাংলাদেশ উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বিসিআইএমের (বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার) ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহী এবং এ লক্ষ্যে একটি টিম কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আরো একধাপ এগিয়ে যাবে এবং অদূর ভবিষ্যতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যে বিশাল মুক্তবাণিজ্য এলাকা গড়ে উঠছে, সেই বাজারে প্রবেশ করতে পারবে।
৪৫ বছর একটি রাষ্ট্রের জন্য কম সময় নয়। এই সময়সীমায় বৈদেশিক নীতিতে যেমন সফলতা এসেছে, ঠিক তেমনি ব্যর্থতাও একেবারে কম নয়। তবে বাংলাদেশকে এখন তাকাতে হবে ২০৫০ সালের দিকে। সনাতন বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। অর্থনৈতিক কূটনীতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। দক্ষ কূটনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তি বাড়াতে হবে। আমাদের জাতীয় স্বার্থকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলেই বৈদেশিক নীতিতে সফলতা আসবে।
Daily Kalerkontho
20.12.2016

উগ্র জাতীয়তাবাদ ও নয়া বিশ্ব ব্যবস্থার স্বরূপ


বদলে যাচ্ছে ইউরোপের রাজনীতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় সেখানে এক ধরনের শ্বেতাঙ্গ উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জন্ম দিয়েছিল। এখন তার ঢেউ এসে লেগেছে ইউরোপে। অতি সম্প্রতি ইতালি ও অস্ট্রিয়ায় দুইটি নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। ওই নির্বাচন একটি ‘মেসেজ’ দিয়ে গেছে এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ঐক্যকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে ওই দুইটি নির্বাচনের ফল একটি সতর্কবার্তা। পার্লামেন্টের ক্ষমতার কাঠামো পরিবর্তন ও সংবিধান সংশোধনের প্রশ্নে এ গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই গণভোটে ‘না’ এর জয়কে দেখা হচ্ছে অভিবাসন ও ইইউবিরোধী শক্তির বিজয় হিসেবে। গণভোটে ‘না’ জয়যুক্ত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী মাত্তিও রেনজি পদত্যাগ করেছেন। এতে বিজয়ী হয়েছেন ফাইভ স্টার মুভমেন্ট পার্টির নেতা বেবে গ্রিলো। বেবে অতি সম্প্রতি রাজনীতিতে এসেছেন। তিনি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অভিন্ন মুদ্রা ইউরো বাতিলের প্রশ্নে গণভোট দাবি করেছেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ক্ষমতায় গেলে তিনি এ গণভোটের আয়োজন করবেন। একই সঙ্গে অভিবাসনবিরোধী নর্দান লীগের নেতা মাত্তিও সালভিনিও গণভোটের ফলাফলে খুশি। এর মধ্য দিয়ে ইউরো জোনের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ইতালিতে যে প্রচ- একটি অভিবাসন তথা ইউরোপিয়ান ঐক্যবিরোধী শক্তিশালী জনমত তৈরি হয়েছে, তা প্রমাণিত হলো। অন্যদিকে অস্ট্রিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে উগ্র জাতীয়তাবাদী ও অভিবাসনবিরোধী ফ্রিডম পার্টির প্রার্থী নর্বাট হফার পরাজিত হয়েছেন সত্য; কিন্তু তিনি প্রায় বিজয়ের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন। নব্য নাজি নেতা হফার ইইউ থেকে অস্ট্রিয়াকে বের করে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন প্রচ- অভিবাসনবিরোধী ও ইসলামবিদ্বেষী। অস্ট্রিয়ায় তার যে জনপ্রিয়তা রয়েছে, নির্বাচনে বিপুল ভোটপ্রাপ্তি এর বড় প্রমাণ। তিনি হেরে গেলে ইউরোপিয়ান নেতারা কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন বটে; কিন্তু ভয়ের কারণ হচ্ছে ২০১৭ সালে ফ্রান্স, হল্যান্ড ও জার্মানিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ দেশগুলোতে অভিবাসনবিরোধী একটি শক্তিশালী জনমত রয়েছে এবং স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে অভিবাসন ও ইইউবিরোধী দলগুলো ভালো করেছে। ফলে তারা যে চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। নিঃসন্দেহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় ইউরোপের দক্ষিণপন্থী দলগুলোকে যথেষ্ট উৎসাহ জুগিয়েছে। ট্রাম্পের অভিবাসন ও ইসলামবিরোধী অবস্থান এদের উৎসাহিত করেছে।
ট্রাম্পের এ বিজয় প্রমাণ করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে যে ‘লিবারেলিজম’ এর ধারণা বহমান ছিল, তা এখন ভাঙছে। কট্টরপন্থী উগ্র এক ধরনের জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। একথা ভারতের ক্ষেত্রে যেমনি প্রযোজ্য (বিজেপি তথা হিন্দুত্ববাদীদের উল্লাস), তেমনি প্রযোজ্য তুরস্কের ক্ষেত্রেও (এ কে কে পার্টির একক কর্তৃত্ব করার প্রবণতা)। ইউরোপে ব্যাপক সিরীয় শরণার্থীর আগমনের কারণে সেখানে সমাজে রাজনীতিতে এক ধরনের মেরুকরণের জন্ম হয়েছে। এতে করে দেখা যায়, জার্মানি ও ফ্রান্সে কট্টর দক্ষিণপন্থী দলগুলোর উত্থান ঘটেছে। এরা মুসলিমবিদ্বেষী মনোভাবকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। একটা কট্টর দক্ষিণপন্থী ইসলামবিরোধী ‘রাজনৈতিক স্রোত’ এখন সারা ইউরোপে বইছে। এর প্রভাব পড়ছে সেখানকার নির্বাচনে। ট্র্যাডিশনাল দলগুলো কট্টরপন্থীদের কাছে হেরে যাচ্ছে। আমি জুলাই মাসে জার্মানি ও ফ্রান্স ঘুরে এসেছি। সিরীয় শরণার্থীদের ইউরোপ, বিশেষ করে জার্মানি ও ফ্রান্সে আশ্রয়দানের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেখানে অভিবাসনবিরোধী একটি শক্তিশালী জনমত তৈরি হয়েছে। এরা স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে ভালো করছে। আমি অন্তত ৭টি দেশের নাম বলতে পারব, যেখানে দক্ষিণপন্থী নব্য নাজি পার্টি এ অভিবাসন ইস্যুকে কেন্দ্র করে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করেছে। যেমন বলা যেতে পারে, ফ্রিডম পার্টি (অস্ট্রিয়া), ল’ অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি (পোল্যান্ড), ফিদেস্জ (হাঙ্গেরি), সুইডেন ডেমোক্র্যাটস (সুইডেন), গোল্ডেন ডন (গ্রিস), ন্যাশনাল ফ্রন্ট (ফ্রান্স) এবং অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি (জার্মানি) পার্টির কথা। ফ্রিডম পার্টির নেতার (নর্বাট হফার) প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার একটা সম্ভাবনা ছিল। সংসদে এদের আসন সংখ্যা এখন ৪০ (মোট আসন ১৮৩)। পোল্যান্ডের নির্বাচনে ল’ অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির নেতা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৫ সালের নির্বাচনে এরা ভোট পেয়েছিল শতকরা ৩৯ ভাগ। হাঙ্গেরিতে ফিদেস্জ পার্টি সরকারের অংশীদার। গ্রিসে বামরা ক্ষমতায় থাকলেও কট্টর দক্ষিণপন্থী পার্টি ‘গোল্ডেন ডন’ এর সংসদে আসন রয়েছে ১৮টি। ফ্রান্সে ন্যাশনাল ফ্রন্ট পুরনো রাজনৈতিক সংগঠন। অভিবাসন ইস্যুতে তারা স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে শতকরা ২৭ ভাগ ভোট নিশ্চিত করেছে। আর জার্মানির মতো ইউরোপের বড় গণতান্ত্রিক দেশে দক্ষিণপন্থী ‘অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি’ সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে ৪ দশমিক ৭ ভাগ ভোট নিশ্চিত করেছে (শতকরা ৫ ভাগ ভোট পেলে তারা সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে পারত)। এসব দলের মধ্যে অদ্ভুত এক মিল আছে। এরা সবাই অভিবাসনবিরোধী, ইসলামবিরোধী এবং ‘শ্বেতাঙ্গ’ সুপ্রিমেসিতে বিশ্বাসী।
এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ইউরোপের দক্ষিণপন্থী ওইসব নেতার রাজনৈতিক দর্শনের একটা অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ট্রাম্প নিজে ইসলামবিরোধী। অভিবাসনবিরোধী এবং তার যে সেøাগান ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট’ এর পেছনে কাজ করেছে শ্বেতাঙ্গ সুপ্রিমেসির বিষয়টি। বিশ্বজুড়েই এক ধরনের দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থান ঘটেছে। আফ্রিকার অনেক দেশের কথা বাদই দিলাম। গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত ভারত ও তুরস্কের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নিয়েও প্রশ্ন আছে। মোদি ‘হিন্দুত্ববাদের’ সেøাগান তুলে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। আর অতি সম্প্রতি তুরস্কে এরদোগান তথাকথিত ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে গুলেনপন্থীদের জড়িত থাকার অভিযোগ এনে পুরো রাজনৈতিক ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছেন। গণতন্ত্রের নামে সেখানে কায়েম হয়েছে একনায়কতন্ত্র। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বরাবরই সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করে আসছে। কিন্তু ট্রাম্পের বিজয় এখন অনেক প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে। তার বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সেখানে ‘হেইট ক্রাইম’ বেড়েছে। মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ আরও বেড়েছে। এ সমাজকে মানুষ আগে কোনো দিন দেখেনি। তাই আগামী ৪ বছর ওই দেশে কী হবে, এ নিয়ে চিন্তা অনেকের। পিউ রিসার্চ একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে। তাতে বেরিয়ে এসেছে শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষ মনে করে ট্রাম্পের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর তেমন শ্রদ্ধাবোধ নেই। গত ২৭ অক্টোবর (২০১৬), অর্থাৎ নির্বাচনের আগে এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে যদি পরিবর্তন আসে, তাতে করে তা ইউরোপের রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলে। ফলে ট্রাম্পের উত্থান এবং তার ঘোষিত নীতি যদি তিনি কার্যকর করার উদ্যোগ নেন, তা বিশ্বে এক বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে নিরাপত্তা ও বৈদেশিক সম্পর্কের ব্যাপারে তিনি যেসব প্রস্তাব করেছেন বা দিয়েছেন, তা যদি তিনি কার্যকর করেন, তাহলে বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আসবে। এতে করে ইউরোপীয় রাজনীতিতেও পরিবর্তন আসতে পারে। এরই মধ্যে ব্রিটেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থাৎ সেখানে অনুষ্ঠিত এক গণভোটে ব্রিটেনের আলাদা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে রায় হয়েছে। তবে এখনও তা কার্যকরী হয়নি। ব্রিটেন ২ বছর সময় পাবে ইইউ থেকে বেরিয়ে আসার। ৫ ডিসেম্বর ব্রেক্সিট প্রক্রিয়া শুরু করতে পার্লামেন্টের অনুমোদনের প্রয়োজন কিনা এ বিষয়ে একটি আপিলের শুনানি করেছে ব্রিটেনের সুপ্রিমকোর্ট। সুপ্রিমকোর্টের ১১ জন বিচারক শুনানি শুনছেন এবং আগামী জানুয়ারি মাসে এ ব্যাপারে একটি রায় দেয়া হবে। যে প্রশ্নটি উঠেছে তা হচ্ছে, জনমতে একটি রায় পাওয়ার পর পার্লামেন্টের আদৌ তা অনুমোদনের প্রয়োজন কিনা। বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে নির্বাহী ক্ষমতাবলে লিসবন চুক্তির অনুচ্ছেদ ৫০ সক্রিয় করতে পারেন। এক্ষেত্রে হাউস অব কমন্সে সংসদ সদস্যদের অনুমোদন নেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তবে সমস্যা তৈরি হয়েছে হাইকোর্টের একটি রায় নিয়ে। ওই রায়ে বলা হয়েছে, লিসবন চুক্তির (যেখানে ইইউর সদস্যভুক্ত যে কোনো দেশের বেরিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে) অনুচ্ছেদ ৫০ সক্রিয় করতে পার্লামেন্টের অনুমোদন লাগবে। এখন সুপ্রিমকোর্ট যে রায়ই দিন না কেন, ব্রিটেনের ইইউতে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন নির্বাচনের আগে (২০১৫) প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার দল বিজয়ী হলে ইইউতে থাকা-না থাকা নিয়ে একটি গণভোট করবেন। সে গণভোটে তিনি হেরে যান এবং পদত্যাগ করেন।
শুধু ব্রিটেন বলি কেন, পুরো ইউরোপে অভিবাসনবিরোধী জনমত শক্তিশালী হচ্ছে। সেই সঙ্গে রয়েছে ‘ইসলাম ফোবিয়া’। বিশেষ করে ফ্রান্স ও বেলজিয়ামে উগ্র গোষ্ঠী আইএসএ’র নেটওয়ার্কের বিস্তৃতি ও সন্ত্রাসী কর্মকা- একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়েছে। এটাকে পুঁজি করেছে উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী। এদের অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের বিজয়ে। এই উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী এখন আরও উৎসাহিত হয়েছে। ফলে আগামী এক দশকে নতুন এক ইউরোপের জন্ম হতে যাচ্ছে। ইইউ ভেঙে না গেলেও একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারে। এই উগ্র জাতীয়তাবাদ বিশ্ব ব্যবস্থায়ও প্রভাব ফেলবে। ট্রাম্পের নেতৃত্বে যে নয়া বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে উঠবে, সেখানে ‘লিবারেলিজম’ এর কোনো চিহ্ন থাকবে না। ফ্রান্স এর বড় প্রমাণ। ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ আর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে (২০১৭) প্রার্থী হবেন না। খুব দ্রুত পরিবর্তন আসছে বিশ্ব রাজনীতিতে। উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা আগামীতে বিশ্ব রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহকে প্রভাবিত করবে।
 ভয়টা সেখানেই।
Daily Alokito Bangladesh
19.12.2016

রাষ্ট্রপতির উদ্যোগ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন


আজ ইসি পুনর্গঠন প্রশ্নে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনায় বসছে বিএনপি। এর আগে দলটির পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশন গঠন ও শক্তিশালীকরণে ১৩ দফাসংবলিত একটি প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে পৌঁছে দেয়া হয়েছিল। ধারণা করা স্বাভাবিক, ওই ১৩ দফাকে কেন্দ্র করেই আলোচনাটি অনুষ্ঠিত হবে। তবে একটি ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ নিয়েও বিএনপি কোনো প্রস্তাব দিতে পারে। রাষ্ট্রপতি পর্যায়ক্রমে জাতীয় পার্টিসহ অন্য দলগুলোর সঙ্গেও ‘সংলাপ’ করবেন। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগও যাবে রাষ্ট্রপতির কাছে। মূল বিষয়টি হচ্ছে ইসি পুনর্গঠন। অতীতে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানও ইসি পুনর্গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমান রাষ্ট্রপতিও ‘সংলাপে’ বসছেন। কিন্তু তাতে কি আদৌ কোনো ফল পাওয়া যাবে? এখানে দুটি বিষয় আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। এক. রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ক্ষমতা, দুই. সরকারপ্রধানের দৃষ্টিভঙ্গি।

নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন জরুরি। কারণ এ কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে ফেব্রুয়ারিতে। নতুন একটি কমিশন আসছে, যারা ২০১৯ সালের সম্ভাব্য নির্বাচন পরিচালনা করবে। নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়টি পরিপূর্ণভাবে একটি প্রশাসনিক বিষয়। তবে এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে কিছুটা দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।’ সমস্যাটা এখানেই। এই যে ‘নিয়োগদান করিবেন’ কথাটা বলা হয়েছে, এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ‘স্বাধীন’ তথা ‘নিরপেক্ষ’ ক্ষমতা কতটুকু? রাষ্ট্রপতি কি এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন? আমরা যদি আবারও সংবিধানের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব এর ৪৮(৩) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।’ এর ব্যাখ্যা হচ্ছে এরকম : রাষ্ট্রপতি নিজে শুধু পারেন প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দিতে। এর বাইরে তিনি যেসব কাজ করেন (যেমন- প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনার নিয়োগ), সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেবেন। এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। কিন্তু তারপরও রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্রপতির দিকে তাকিয়ে থাকে। ভুলে যায় তার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। তবে এটাও সত্য, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান এমনই এক পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন প্রশ্নে একটি ‘সার্চ কমিটি’ গঠন করেছিলেন। এবং ওই সার্চ কমিটি কাজী রকিবউদ্দীনকে সিইসি পদে মনোনয়ন দিয়েছিল। কিন্তু সার্চ কমিটির সাংবিধানিক কোনো বৈধতা নেই। কোনো সচেতন নাগরিক এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতে গেলে আদালত ‘সার্চ কমিটির সাংবিধানিক বৈধতা’ নিয়ে একটা রায় দিতে পারতেন। কেউ উচ্চ আদালতে তখন যাননি। কেননা সবার প্রত্যাশা ছিল একজন ‘নিরপেক্ষ’ ব্যক্তিকে খুঁজে বের করার জন্য সার্চ কমিটিই উত্তম। কিন্তু সার্চ কমিটি যাকে খুঁজে বের করেছিল, তিনি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি। কাজী রকিবউদ্দীন সাবেক আমলা। ডাকসাইটে আমলা। আমলা মানসিকতার বাইরে তিনি যেতে পারেননি। যে প্রত্যাশার জন্ম হয়েছিল, সেই প্রত্যাশা তিনি পূরণ করতে পারেননি। এখন একরাশ কলংকের বোঝা মাথায় নিয়ে কাজী রকিবউদ্দীন ও তার সহকর্মীরা বিদায় নিচ্ছেন। ২০১২ সালের পর ২০১৬ সালে এসেও জাতি একই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। আবারও প্রশ্ন ও দাবি উঠেছে, ইসি পুনর্গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতি সব নিবন্ধিত দলের সঙ্গে কথা বলবেন! প্রশ্ন হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে কি একটি নিরপেক্ষ ও সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন আমরা পাব?

রাষ্ট্রপতি আপাতত ৫ দলকে ডেকেছেন। বিএনপি, জাতীয় পার্টি, এলডিপি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও জাসদ এ লিস্টে আছে। এর বাইরে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অনেক আছে। রাষ্ট্রপতি সবার সঙ্গেই তাহলে কথা বলবেন! এলডিপি বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলের শরিক। আবার জাসদ ১৪ দলীয় জোটে আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এলডিপি কি বিএনপির প্রস্তাবের বাইরে গিয়ে কোনো প্রস্তাব রাখতে পারবে? একই কথা প্রযোজ্য জাসদের ক্ষেত্রেও। জাসদ কি আওয়ামী লীগের বাইরে গিয়ে নিজস্ব কোনো প্রস্তাব রাখতে পারবে, যা ১৪ দলের স্বার্থ ক্ষুণœ করে? কিংবা দুই বড় জোটের বাইরে থাকা সিপিবি যদি এমন কোনো প্রস্তাব রাখে, তা কি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাছে গ্রহণযোগ্য হবে? পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এখন এসব প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। আবার জাতীয় পার্টি নিয়েও একটা প্রশ্ন রয়েছে। পার্টিপ্রধান এইচএম এরশাদ কি এমন কোনো প্রস্তাব রাখতে পারবেন, যা বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না? জাতীয় পার্টি সরকারে আছে। সুতরাং সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কি জাতীয় পার্টি আদৌ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে?

বাস্তবতা হল, পুরো বিষয়টিই আবর্তিত হচ্ছে সরকারের চিন্তাভাবনা ও বিএনপির প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে। যদিও প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে স্পষ্ট করেছেন, রাষ্ট্রপতি যে সিদ্ধান্ত নেবেন, তাতে তার নিজের ও দলের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৪৮(৩) ধারার বাধ্যবাধকতা অস্বীকার করবেন কীভাবে? তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ‘পরামর্শ’ করবেন, এটাই স্বাভাবিক। রাষ্ট্রপতি মূলত ইসি গঠন নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। এর বাইরে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে তিনি আলোচনা করবেন বলে আমার মনে হয় না এবং কোনো দল এটা করতে চইলে রাষ্ট্রপতির সহকারীরা তাদের নিরুৎসাহিত করবেন।

তবে ইসি গঠন প্রশ্নে বিএনপির মতামত আমরা জানি। নির্বাচনকালীন সরকার গঠন নিয়ে বিএনপি কথা বলতে পারে। তাতে রাষ্ট্রপতি সম্মতি দেবেন কিনা, তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। নির্বাচন কমিশন গঠন এবং নির্বাচন কমিশন শক্তিশালীকরণের ব্যাপারে খালেদা জিয়ার একটি রূপরেখা ইতিমধ্যে উত্থাপিত হয়েছে। আমার ধারণা, রাষ্ট্রপতি যেহেতু নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আলোচনা করবেন, সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালীকরণসংক্রান্ত খালেদা জিয়ার ১৩ দফা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হবে না। এটি একটি ভিন্ন বিষয়। এ নিয়ে রাষ্ট্রপতি নন, বরং নবনিযুক্ত সিইসি আলোচনা শুরু করতে পারেন।

খালেদা জিয়া নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে আলোচনার দাবি রাখে। মোটা দাগে খালেদা জিয়ার প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে : ১. ঐকমত্যের ভিত্তিতে ইসি গঠন; ২. একটি বাছাই কমিটি গঠন (৫ সদস্যবিশিষ্ট); ৩. বাছাই কমিটির আহ্বায়ক হবেন একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, যিনি সরকারের কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন না; ৪. বাছাই কমিটির সদস্যরা হবেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, সাবেক সচিব, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও একজন জ্যেষ্ঠ নারী; ৫. প্রতি পদের বিপরীতে ২ জনের নাম প্রস্তাব করা হবে এবং রাষ্ট্রপতি ৫ জনকে (সিইসিসহ) মনোনয়ন দেবেন। তত্ত্বগতভাবে এ ধরনের প্রস্তাব ভালো। কিন্তু সমস্যা রয়েছে অন্যত্র। জাতি হিসেবে আমরা এত ‘বিভক্ত’ যে কোনো সিনিয়র সিটিজেন এ ধরনের পদে নিয়োগ লাভে আদৌ উৎসাহিত হবেন না। তিনি দ্রুত বিতর্কিত হয়ে যেতে পারেন- এ আশংকায় কেউই দায়িত্ব নিতে রাজি হবেন না। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমনই যে, কোনো সিদ্ধান্ত যদি আমাদের মনঃপুত না হয়, তাহলে দ্রুত তাকে বিতর্কিত করে ফেলি। অনেক সময় দলের শীর্ষপদ থেকে যখন মন্তব্য করা হয়, তখন দলের প্রতিটি স্তরের নেতাকর্মীরা ওই ব্যক্তির সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন। দেশে বেশ কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রয়েছেন, যারা এখনও কর্মক্ষম। তাদের গ্রহণযোগ্যতাও আছে। কিন্তু চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে কেউই রাজি হবেন না দায়িত্ব গ্রহণ করতে।

ইসি গঠনে একটি জাতীয় ঐকমত্যের কথা বলেছেন খালেদা জিয়া। তত্ত্বগতভাবে এটিও ভালো। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। আমাদের মধ্যে ‘বিভক্তি’ এত বেশি এবং একদল অপর দলকে বিতর্কিত করতে এত বেশি পারঙ্গম যে ঐকমত্যের প্রশ্নটি অবান্তর। আমরা বারবার বলে আসছি একটি ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস’ বা আস্থার সম্পর্ক স্থাপন ছাড়া কোনোদিনই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে না। বিজয়ের ৪৫ বছর যখন পার করতে যাচ্ছি, তখনও আমরা অতীত নিয়ে অনেক বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করছি। রাজনীতির চেয়ে ব্যক্তি আক্রমণ প্রধান্য পাচ্ছে বেশি। এ মানসিকতা যতদিন না আমরা পরিত্যাগ করতে পারব, ততদিন ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ক্ষীণ। রাজনীতিকদের কিছু অলিখিত ‘কোড অব কনডাক্ট’ অনুসরণ করা উচিত। জাতীয় ইস্যুতে, জাতীয় নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে ন্যূনতম একটা ঐকমত্য থাকা জরুরি। তা না হলে বিভক্তি, তিক্ততা শুধু বাড়বেই। আর এতে করে জাতি ‘বিভক্ত’ হয়ে থাকবেই। রাজনীতিতে মতপার্থক্য থাকে। এ মতপার্থক্য যেন শুধু রাজনীতি আর কর্মসূচির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। নির্বাচন কমিশন গঠন ও শক্তিশালীকরণের প্রশ্নে বিএনপির প্রস্তাব থাকতেই পারে। আওয়ামী লীগও এ ধরনের প্রস্তাব দিতে পারে। এখন অব্দি আওয়ামী লীগ এ ধরনের প্রস্তাব দেয়নি। আমার ধারণা আওয়ামী লীগ কোনো প্রস্তাব দেবে না। বরং বিষয়টি ছেড়ে দেবে রাষ্ট্রপতির ওপর। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকের পর কার্যবিবরণী প্রকাশ এবং আলোচনায় দুটি বড় জোটের (১৪ ও ২০ দলীয় জোট) প্রতিনিধির উপস্থিতির যে কথা বলা হয়েছে, তাও বিতর্ক বাড়াতে পারে। একটি কার্যবিবরণী প্রকাশ রাষ্ট্রপতিকে অস্বীকার করার শামিল। রাষ্ট্রপতির ওপর আস্থা রেখেই তো বিএনপি আলোচনায় যাচ্ছে। তাহলে কার্যবিবরণী প্রকাশ কেন?

বাছাই কমিটির অভিজ্ঞতা আমাদের ভালো নয়। বাছাই কমিটির মাধ্যমেই কাজী রকিবউদ্দীন মনোনীত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। একজন সাবেক আমলা যে গ্রহণযোগ্য হবেন, তার কোনো মানে নেই। বরং দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় রাষ্ট্রপতি স্ব-উদ্যোগে সিইসি ও কমিশনারদের একটি তালিকা চাইতে পারেন প্রতিটি দলের কাছে। এর মধ্যে কোনো নাম যদি ‘কমন’ হয়ে যায়, রাষ্ট্রপতি ওই নামগুলো বেছে নিতে পারেন। এর মধ্য দিয়ে এক ধরনের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

আমরা এক কঠিন সময় পার করছি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) অভিজ্ঞতা আমাদের ভালো নয়। একদিকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, অন্যদিকে নির্বাচন বয়কট এবং নির্বাচন বয়কটকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংসতা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি ‘কালো’ দিক। ‘ভোটারবিহীন’ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রক্ষা করা গেছে বটে, কিন্তু দেশে নির্বাচনী সংস্কৃতির মৃত্যু ঘটেছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য শক্তিশালী একটি বিরোধী দল থাকা দরকার। যে যুক্তিতে বিএনপি ওই নির্বাচন বয়কট করেছিল, তার পেছনে ‘যুক্তি’ যাই থাকুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে আমরা একটি শক্তিশালী সংসদ পাইনি গত ৩ বছরে। সংসদ ও রাজনীতি এককেন্দ্রিক ও একদলীয় হয়ে গেছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা হতে দেখিনি। সরকারকে এক ধরনের ‘দায়বদ্ধতার’ মধ্যে আনা যায়নি। সরকার যা চেয়েছে তা-ই পাস করিয়ে নিয়েছে সংসদে। সরকারকে ‘প্রশ্ন’ করা যায়নি। কেউ প্রশ্ন করেনি। আমার বিশ্বাস, সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরাও গত ৩ বছরে তাদের কর্মকাণ্ডে স্বস্তিতে ছিলেন না। দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা বারবার বলেছেন, ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ ও ‘গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের’ কথা। এটাও একটি খারাপ দিক। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিদেশীরা হস্তক্ষেপ করবে কেন? আমাদের রাজনৈতিক সমস্যা আমরাই সমাধান করব। বৈরিতা থাকবে, মতের অমিল থাকবে। কিন্তু সমস্যার সমাধান করতে হবে আলোচনা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে।

রাষ্ট্রপতি আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি জাতির অভিভাবক। অভিভাবক হিসেবে তার যে ‘ভূমিকা’ রাখার কথা, তিনি তা-ই রাখবেন। তিনি তার ‘সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা’ সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা রাখেন। তিনি একজন আইনজীবী ও অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান। আজ এক কঠিন সংকটের মুখোমুখি জাতি। একটি সিদ্ধান্ত তিনি দেবেন বটে, কিন্তু তাতে বিএনপিসহ সব দল ‘সন্তুষ্ট’ হবে, এটা নাও হতে পারে। কিন্তু আমাদের উচিত হবে না রাষ্ট্রপতিকে বিতর্কিত করা। রাষ্ট্রপতি ইসি গঠনে একটি সার্চ কমিটি গঠন করুন আর নাই করুন, বড় দুটি দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলাটা জরুরি। এ আস্থার সম্পর্ক বিএনপিকে ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে অংশ নিতে উৎসাহিত করবে। বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসার ব্যাপারে সরকারের বড় দায়িত্ব রয়েছে। সরকারের কঠোর মনোভাব, আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলায় ব্যর্থতা আবারও ৫ জানুয়ারির মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। আমরা তা চাই না। ৫ জানুয়ারি অতীত। একটি ‘দ্বিতীয় ৫ জানুয়ারি’ কারও জন্যই মঙ্গলজনক নয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য তো নয়ই। সুতরাং রাষ্ট্রপতি যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছেন, তা সফল করার দায়িত্ব আজ সবার। সবার আস্থাভাজন একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হোক, রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ কমিশনে যুক্ত হবেন না, এ প্রত্যাশাই রইল। কারণ নিরপেক্ষতার স্বার্থে একটি ‘অরাজনৈতিক’ ইসি আমাদের দরকার।
Daily Jugantor
18.12.2016

তিস্তার জট খুলবে কি?



পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন গত ৭ ডিসেম্বর। তিনি বলেছেন, ভারতের দু’জন প্রধানমন্ত্রী (মনমোহন সিং ও নরেন্দ্র মোদি) তাদের ঢাকা সফরের সময় প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিলেন, তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে একটা সমাধান হবে। তিনি আশাবাদী, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় তিস্তা চুক্তির জট খুলবে। আগামী ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের কথা ছিল। কিন্তু এ সফর স্থগিত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যস্ততার কারণে দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীর কর্মসূচি নির্ধারণে সমস্যা, অনেক জটিল ইস্যুর প্রস্তুতি শেষ না হওয়া এবং তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে অগ্রগতি না হওয়াই সফর স্থগিতের কারণ (যুগান্তর, ১০.১২.১৬)। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর সফরটি ফেব্রুয়ারিতে পিছিয়ে দিতে ভারতকে অনুরোধ করা হয়েছে। সম্ভাব্য নতুন সময়সূচি বের করার বিষয়ে ভারত কাজ করছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর সেই সফরে তিস্তা চুক্তিটি আদৌ স্বাক্ষরিত হবে কিনা?

আমরা মোটামুটিভাবে এতদিনে জেনে গেছি, তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে সমস্যাটা কোথায়। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের (যাদের সঙ্গে আমাদের চুক্তি করার কথা) এই চুক্তির ব্যাপারে ‘আগ্রহ’ থাকলেও সমস্যা তৈরি করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। তিস্তার পানিবণ্টন তার জন্য ছিল একটি ‘রাজনৈতিক ইস্যু’। দু’দুবার তিনি ঢাকা এসেছেন এবং বলে গেছেন তার ওপর আস্থা রাখার জন্য। বাংলাদেশের মানুষ তার ওপর আস্থা রেখেছে। কিন্তু তিনি ‘প্রতিদান’ দেননি। তিস্তার পানিবণ্টনের ব্যাপারে তিনি স্পষ্ট করে কোনো কথা বলেননি। পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভার নির্বাচনে (এপ্রিল-মে ২০১৬) মমতা ব্যানার্জি পুনরায় বিজয়ী হয়ে আবারও রাজ্য সরকার গঠন করেছেন। এর আগে ২০১১ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গে বামদের ‘একনায়কতন্ত্র’ খতম করেছিলেন। বামদের ক্ষমতা থেকে নামানো অত সহজ ছিল না। তিনি তা পেরেছিলেন। তখন থেকেই তিস্তা চুক্তি নিয়ে তার বিতর্কিত মন্তব্য আমাদের মাঝে শংকার জন্ম দিয়েছিল। আমাদের জন্য আরও খারাপ খবর ছিল, তিস্তায় পানিপ্রবাহ কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশের লালমনিরহাটের ডালিয়া পয়েন্টে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে পানির প্রবাহ কমে এসে দাঁড়িয়েছিল মাত্র ৫০০ কিউসেকে। অথচ নদী রক্ষার জন্য প্রয়োজন হয় ১ হাজার কিউসেক। এখন ফেব্রুয়ারি আসতে বাকি মাত্র দু’মাস। হয়তো এবারও পানির গড় প্রবাহ ৫০০ কিউসেকের নিচে নেমে যাবে। যৌথ নদী কমিশন পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণ শুরুর আগে ১৯৭৩-৮৫ সালের সময়সীমাকে ঐতিহাসিক গড় প্রবাহ হিসেবে ধরে। ওই সময় ফেব্রুয়ারির প্রথম ১০ দিনে পানির গড় প্রবাহ ছিল ৫ হাজার ৯৮৬ কিউসেক।

শুধু নদী বাঁচানোই নয়, সেচ প্রকল্পের জন্যও আমাদের দরকার ন্যূনতম ৩ হাজার কিউসেক পানি। সুতরাং তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে এটি সরাসরি সম্পৃক্ত। আমাদের নীতিনির্ধারকরা যদি বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখেন, তাহলে এ দেশ, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ একটি বড় ধরনের সংকটে পড়বে। খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে থাকবে। এমনকি এতে করে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও বাড়বে। মনে রাখতে হবে, তিস্তায় পানিপ্রাপ্তি আমাদের ন্যায্য অধিকার। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব আমাদের অধিকার নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জির আপত্তি বা সমর্থন থাকা না-থাকার বিষয়টি আমাদের দেখার বিষয় নয়। আমরা এটা বিবেচনায় নিতে চাই না। আমাদের অধিকার, যা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত, তা নিশ্চিত করবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এখানে বলা ভালো, সিকিম হয়ে ভারতের দার্জিলিং এবং জলপাইগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ারের সমভূমি দিয়ে চিলাহাটি থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার উত্তর খড়িবাড়ির কাছে ডিমলা উপজেলার ছাতনাই দিয়ে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। ছাতনাই থেকে এ নদী নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, লালমনিরহাট সদর, পাটগ্রাম, হাতিবান্দা, কালীগঞ্জ, রংপুরের কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর হয়ে চিলমারীতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। ডিমলা থেকে চিলমারী এ নদীর বাংলাদেশ অংশের মোট ক্যাচমেন্ট এরিয়া প্রায় ১ হাজার ৭১৯ বর্গকিলোমিটার।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশন গঠনের পর তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে দু’দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের এক বৈঠকে তিস্তার পানিবণ্টনে ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ ও ৩৯ ভাগ ভারত এবং ২৫ ভাগ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু কোনো চুক্তি হয়নি। পরবর্তী সময়ে ২০০৭ সালের ২৫, ২৬, ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ ভাগ দু’দেশের মধ্যে বণ্টন করে বাকি ২০ ভাগ নদীর জন্য রেখে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। ভারত সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এরপর যুক্ত হয়েছিল মমতার আপত্তি। বাংলাদেশের কোনো প্রস্তাবের ব্যাপারেই অতীতে মমতার সম্মতি পাওয়া যায়নি। এখানে আরও একটা বিষয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। তিস্তার পানিবণ্টনে সিকিমকে জড়িত করার প্রয়োজনীয়তা পড়েছে। কেননা সিকিম নিজে উজানে পানি প্রত্যাহার করে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ফলে তিস্তায় পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে দিন দিন। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে কৃষকদের কাছে তিস্তার পানির চাহিদা বেশি। সেচ কাজের জন্য তাদের প্রচুর পানি দরকার। এটা বরাবরই মমতার জন্য একটি ‘রাজনৈতিক ইস্যু’। তাই মমতা তিস্তা চুক্তি করে বাংলাদেশের পানিপ্রাপ্তি নিশ্চিত করবেন- এটা আমার কখনোই বিশ্বাস হয়নি। সুতরাং মমতায় আস্থা রাখা যায় না। এ ক্ষেত্রে আমাদের যা করণীয় তা হচ্ছে, তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে ভারতের ওপর ‘চাপ’ অব্যাহত রাখা। আমরা ভারতের অনেক ‘দাবি’ পূরণ করেছি। মোদির আমলে সীমানা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর দু’দেশের সীমানা এখন চিহ্নিত। দু’দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা একটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। এখন প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরও মমতা যদি তার ওপর রাখা আস্থার প্রতিদান না দেন, তাহলে তা যে দু’দেশের সম্পর্কের মাঝে একটা অবিশ্বাসের জন্ম দেবে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

মমতাকে আস্থায় নেয়া কঠিন। ঢাকা সফরে আসার আগে আত্রাই প্রসঙ্গটি তুলে তিনি একটি ‘জট’ লাগিয়েছিলেন। তিনি আত্রাইয়ের সঙ্গে তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি এক করে দেখেছেন। অথচ এটি একটি ভিন্ন বিষয়। আত্রাই নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু তিস্তার পানিপ্রাপ্তি আমাদের অগ্রাধিকার। এর সঙ্গে অন্য কোনো ইস্যুকে তুলনা করা যাবে না। বাংলাদেশ সরকারকে দ্রুত তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টিকে সামনে রেখে ভারতের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে। ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমাও নির্ধারিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক আসরে। দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়নি। কাজেই প্রয়োজন হলে তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক আসরে তুলে ধরতে হবে। দেশের লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল। মমতা ব্যানার্জির দয়া-দাক্ষিণ্যের ওপর বিষয়টি নির্ভর করে না। ভাটির দেশ হিসেবে তিস্তার পানির ন্যায্য অধিকার আমাদের রয়েছে। মমতা ব্যানার্জি এককভাবে পানি প্রত্যাহার করে নিতে পারেন না। যদি তিনি তা করেন, তাহলে তা হবে আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লংঘন। সে ক্ষেত্রে মমতা নয়, বরং ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর আমাদের চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। তবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, মমতা বারবার রং বদলেছেন। একবার বলেছিলেন তিনি ‘কাঠবিড়ালি’ হবেন। আর এবার বললেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা দেবেন। স্পষ্টতই এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে তিনি অন্যদিকে দৃষ্টি সরাতে চান।

তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ এককভাবে পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারসংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র অভিন্ন নদীসমূহ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। পশ্চিমবঙ্গের পানি ব্যবহারে বাংলাদেশের ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজন’কে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। হেলসিংকি নীতিমালার ১৫নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি তীরবর্তী রাষ্ট্র তার সীমানায় আন্তর্জাতিক পানিসম্পদের ব্যবহারের অধিকার ভোগ করবে যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে। কিন্তু এই ‘যুক্তি ও ন্যায়ের’ ভিত্তিটি উপেক্ষিত থাকে যখন পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার ২নং নীতিতে বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। তিস্তার পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটা হয়নি। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ‘জলপ্রবাহ কনভেনশন’ নামে একটি নীতিমালা গ্রহণ করে। এই নীতিমালার ৬নং অনুচ্ছেদে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার’ কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের এককভাবে তিস্তার পানি ব্যবহার এই ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতা’র ধারণাকে সমর্থন করে না। আমরা আরও আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারব, যেখানে বাংলাদেশকে অধিকারবঞ্চিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে পরিবেশসংক্রান্ত জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের ১৪নং অনুচ্ছেদ, জলাভূমিবিষয়ক রামসার কনভেনশনের ৫নং অনুচ্ছেদ- প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবেশের প্রভাব এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীসমূহের সংরক্ষণের যে কথা বলা হয়েছে, যা রক্ষিত হচ্ছে না। এখানে সমস্যাটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের। ভারতের ফেডারেল কাঠামোয় রাজ্য কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু কোনো রাজ্য (এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ) এমন কিছু করতে পারে না, যা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ এবং আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে। সমস্যাটা ভারতের। পশ্চিমবঙ্গকে আশ্বস্ত করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। আমরা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীই আমাদের পানির হিস্যা নিশ্চিত করতে চাই।

আমরা চাই তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যার স্থায়ী সমাধান। এ ক্ষেত্রে প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, মোদি সরকার একটি চুক্তিতে যেতে চায়। ইতিমধ্যে স্থলসীমানা চুক্তিতে সম্মতি দিয়ে মমতা ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন। এমনটি তিস্তার ব্যাপারেও তিনি পারেন। এটা কঠিন নয়। তিনি যদি সত্যিই আন্তরিক হন, তাহলে কল্যাণ রুদ্র কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারেন। তিনি নিজে এই কমিশন গঠন করেছিলেন। কলকাতার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রুদ্র কমিশন পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে দেয়া রিপোর্টে বলেছে, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষতি না করেও বাংলাদেশকে ৫০ ভাগ পানি দেয়া সম্ভব। তার এই বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন আরেকজন পানি বিশেষজ্ঞ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক প্রণব কুমার রায়। অধ্যাপক রায়ের অভিমত হচ্ছে, তিস্তায় পানি নেই কথাটা ঠিক নয়। পানি মজুদ রেখে (বর্ষা মৌসুমে) এবং ম্যানেজমেন্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ সমস্যার সমাধান করা যায়।

আসলে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে মানসিকতা। মমতা নিজে বাঙালি। এটা সত্য বাঙালিদের দাবি-দাওয়া নিয়ে তিনি বরাবরই সোচ্চার। তার পূর্বপুরুষ একসময় যশোরে বসবাস করত। বাংলাদেশের মানুষ তাকে নিকট আপনজন হিসেবেই মনে করে। এ জন্যই দ্বিতীয়বারের মতো তিনি যখন বিজয়ী হন, তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ তাকে ২০ কেজি ইলিশ পাঠিয়েছিলেন। সে খবর তখন পত্র-পত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল। তাহলে আমাদের ন্যায্য হিস্যার ব্যাপারে তিনি আন্তরিক হবেন না কেন? প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় তার সঙ্গে মমতা ব্যানার্জির সাক্ষাৎ হওয়ার সম্ভাবনা কম। আমরা চাই দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় এর সমাধান। আমাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে তিস্তার পানি চুক্তি। আমাদের প্রত্যাশা একটাই- তিস্তা চুক্তির জট খুলুক।
Daily Jugantor
11.12.2016

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ও কিছু মৌলিক প্রশ্ন




প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৮ ডিসেম্বর ভারত সফরে যাওয়ার কথা ছিল। তবে সফরটি স্থগিত হয়েছে। সফরের নতুন সময়সূচি শিগগিরই জানানো হবে বলে পত্রিকায় প্রকাশ। প্রধানমন্ত্রীর এ ভারত সফর অনেক আগেই প্রত্যাশিত ছিল। বিশেষ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের পর (২৭ মে, ২০১৫) বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফিরতি ভারত সফর প্রত্যাশিত ছিল। বর্তমান সরকারের সময় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে বেশকিছু অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ৪০ বছর ছিটমহল সমস্যা দুই দেশের মাঝে আস্থার সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় জটিলতা সৃষ্টি করেছিল। বাংলাদেশের ভেতরে ছিল ১১১টি ভারতীয় ছিটমহল, আর ভারতের ভেতরে ছিল ৫১টি। এ ছিটমহলগুলো এখন দুই দেশের মাঝে বণ্টন করা হয়েছে এবং এগুলোতে যারা বসবাস করতেন, তারা তাদের পছন্দ অনুযায়ী বাংলাদেশ ও ভারতে থেকে গেছেন। এটি ছিল একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। বাংলাদেশে অবৈধভাবে বসবাসরত ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদেরও ‘তাদের ইচ্ছায়’ ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। এটি নিয়ে দুই দেশের সম্পর্কের মাঝে একসময় একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছিল।
ভারতের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছিল, অতীতে বাংলাদেশ সরকার ওইসব বিচ্ছিন্নতাবাদীকে আশ্রয় দিয়েছিল, যারা এখানে থেকে ভারতের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কর্মকা-ে অংশ নিত। সেই সমস্যাটিরও সমাধান হয়েছে। বাংলাদেশের জ্বালানি সংকটে ভারত বিদ্যুৎ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আমরা এখন ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছি। বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের ‘সাতবোন’ রাজ্যে এখন ভারতের পণ্য যাচ্ছে। কিন্তু বেশকিছু সমস্যা এখনও রয়ে গেছে। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি, টিপাইমুখ বাঁধ, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প, ট্যারিফ ও প্যারা ট্যারিফজনিত সমস্যা, সীমান্ত হত্যা ইত্যাদি বিষয়ে সমস্যা রয়ে গেছে।
তবে বড় সমস্যা আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে। এটি নিয়ে খোদ ভারতেও বিতর্ক আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মোদি ক্ষমতা গ্রহণ করে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ভারতের সুপ্রিমকোর্টের একটি রায়ও আছে মোদির পক্ষে। বাংলাদেশ বারবার আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এ দেশের যে ক্ষতি হবে, সে কথা বলে আসছে। এখনও প্রকল্পটি বাতিল হয়েছে, এমন তথ্য আমাদের জানা নেই। সত্যিকার অর্থেই ভারত যদি এ প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে না যায়, তাহলে তাতে ভারতের পরিবেশবাদীরাই যে খুশি হবেন, তা নয়। বরং বাংলাদেশ বড় ধরনের পানি সংকট থেকে রক্ষা পাবে। একই কথা প্রযোজ্য টিপাইমুখ বাঁধের ক্ষেত্রেও। মোদি সরকার সাবেক মনমোহন সিং সরকারের দেয়া বক্তব্যই উল্লেখ করেছে মাত্র। তাদের ভাষায়, ভারত এমন কিছু করবে না যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভারতেও এরই মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে এবং ভারত সরকার ৯ হাজার কোটি রুপি খরচও করে ফেলেছে। এ অর্থ তাহলে ব্যয় হলো কোথায়? গঙ্গা চুক্তি নিয়েও আলোচনার প্রয়োজন আছে। কেননা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ পানি পাচ্ছে না। চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালে। জনসংখ্যা তখন বাড়বে তিনগুণ। পানির চাহিদাও বাড়বে। সুতরাং চুক্তিতে পর্যালোচনার যে সুযোগ রয়েছে, বাংলাদেশের উচিত এ ব্যাপারে ভারতকে রাজি করানো। অনুপ চেটিয়াকে (উলফা নেতা ও বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী) ফেরত দেয়া ও নূর হোসেনকে (নারায়ণগঞ্জ সাত খুনের আসামি) ফেরত আনার বিষয়টি একটি বড় ধরনের অগ্রগতি। নূর হোসেন কলকাতায় একটি অপরাধ করেছিলেন। সেই অপরাধে তার বিচার শুরু হয়েছিল সেখানে। বিচার চলাকালীনই তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। এটি ছিল একটি আইনগত প্রশ্ন। তবে অনুপ চেটিয়ার সঙ্গে এ বিষয়টিকে মেলানো যাবে না। অনুপ চেটিয়া নিজেই ভারতে যেতে চেয়েছিলেন। আজও সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সীমান্তবর্তী জেলার জেলা প্রশাসকরা আগামীতে দিল্লিতে মিলিত হবেন। কিন্তু তাতে সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি। গেল বছর জেসিসির বৈঠক চলাকালীনও বিএসএফের গুলিতে তিন বাংলাদেশী আহত হয়েছিলেন। নেপাল, ভুটান, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও বাংলাদেশকে নিয়ে উপ-আঞ্চলিক জোটের যে ধারণা, তাতে মিয়ানমারের অন্তর্ভুক্তিও চাচ্ছেন মোদি। এতে নতুন একটি জোট গঠন হতে পারে। যদিও বিসিআইএম জোট (বাংলাদেশ, চীন, ভারত, মিয়ানমার) কাজ করছে এবং বাংলাদেশ এ জোট কার্যকরণে বড় ভূমিকা পালন করছে। এখন মোদির প্রস্তাবিত নয়া জোটের সঙ্গে বিসিআইএমের কী সম্পর্ক থাকবে, সেটা একটা প্রশ্ন হয়েই আছে।
দুই দেশের বাণিজ্য ৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ভারতে বাংলাদেশের পণ্যের সম্প্রসারণে কোনো উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে না। ট্যারিফ ও প্যারা ট্যারিফের কারণে বাংলাদেশী পণ্য ভারতে বাজার পাচ্ছে না। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির ব্যাপারে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। আমরা ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছি। আরও ৫০০ মেগাওয়াটের প্রতিশ্রুতি মিলেছে। আসলে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করতে হবে আঞ্চলিক ভিত্তিতে। বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান ও ভারত সম্মিলিতভাবে বিনিয়োগ করে হিমালয় অঞ্চলে বিপুল বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু ভারত এটা করছে দ্বিপক্ষীয়ভাবে।
ভারতের এ দ্বিপক্ষীয় নীতিতে লাভবান হচ্ছে ভারত। বাংলাদেশ লাভবান হচ্ছে না। চেন্নাই হয়ে কলকাতা, তারপর মংলা ও চট্টগ্রাম উপকূল পথকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত জাহাজ চলাচলের একটি সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত আদৌ কার্যকরী হয়নি। বাংলাদেশে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের জন্য একটি রফতানি প্রক্রিয়াজাত অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু এ ব্যাপারে অগ্রগতির খবর আমরা তেমন একটা পাই না। রফতানি প্রক্রিয়াজাত অঞ্চলে ভারতীয় বিনিয়োগকারীরা আদৌ বিনিয়োগ করবেন কিনা, সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা মূলত চান ব্যবসা। পুঁজি বিনিয়োগ নয়। গোহাটি-শিলং-ঢাকা বাস সার্ভিস চালুর বিষয়টি কিংবা মৈত্রী ট্রেনের বগির সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়টি এর আগে আলোচিত হয়েছে। এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু মৈত্রী ট্রেনে কেন যাত্রী বাড়ছে না, এ বিষয়টি তলিয়ে দেখা হয়নি। বাংলাদেশী যাত্রীরা মৈত্রী ট্রেনের যাত্রা পছন্দ করেন। কিন্তু ‘যাত্রী হয়রানি’ বন্ধ না হলে বগির সংখ্যা বাড়িয়েও কোনো লাভ হবে না। গোহাটি-শিলং বাস সার্ভিস শুনতে ভালো শোনায়। কিন্তু এ রুটের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কে করবে? কবে হবে এসব কাজ? এসব ব্যাপারে আজ অবধি কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ভাঙা পথে এসি বাস চললে তাতে যাত্রী পাওয়া যাবে না! বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় রয়েছে অনেক। তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি এ মুহূর্তে অন্যতম আলোচিত বিষয়গুলোর মাঝে একটি। এখানে বাংলাদেশের স্বার্থ অনেক বেশি। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে তিস্তার পানি বণ্টনের দাবি করে আসছে। এক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। তিনি ঢাকায় এসে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলাপের পর তার ওপর আস্থা রাখতে বলেছিলেন। বাংলাদেশ আস্থা রেখে আসছে। কিন্তু মমতা ব্যানার্জি তার অবস্থানের পরিবর্তন করেছেন, এমন তথ্য আমাদের জানা নেই। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী যখন নয়াদিল্লি যাবেন, তখন তিনি তিস্তার ব্যাপারে একটি ভালো সংবাদ নিয়ে আসবেন, এটা আমরা আশা করতে পারি না। সমস্যাটা ভারতের। কিন্তু আমরা তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা চাই। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্যা মমতা ব্যানার্জিকে নিয়ে। মমতার জন্য তিস্তার পানি একটি ‘রাজনৈতিক ইস্যু’। ২০১৯ সালে সেখানে লোকসভার নির্বাচন (১৭তম)। লোকসভার নির্বাচন এবং সর্বশেষ উপনির্বাচনেও তৃণমূলের পক্ষে বেশি ভোট পড়েছে। সুতরাং তিস্তা তার জন্য একটি ইস্যু। এটি তিনি আবারও ব্যবহার করবেন। দিল্লিকে তিনি ছাড় দেবেন না এতটুকুও। এর আগে সীমান্ত চুক্তিতে তিনি রাজি হয়েছিলেন কেন্দ্র থেকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পরই। তিস্তা চুক্তির ব্যাপারেও তিনি সম্মতি দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে তিনি তার নিজের স্বার্থ দেখবেন। বাংলাদেশের স্বার্থ তার কাছে কখনও মুখ্য ছিল না। এখনও নেই।
সম্প্রতি ঢাকা ঘুরে গেছেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। স্বাধীনতার পর আজ অবধি কোনো ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী বাংলাদেশে আসেননি। মনোহর পারিকার ঢাকা ঘুরে গেলেন। বলা হচ্ছে, একটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্দেশ্যেই তার ঢাকা আগমন। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় এ চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হতে পারে। তবে আমাদের কাছে এটা স্পষ্ট নয়, এ চুক্তিটির কাঠামো কী হবে, কিংবা চুক্তিটিতে কী আছে? একমাত্র চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরপরই বোঝা যাবে চুক্তিটিতে কী আছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী যে জঙ্গি তৎপরতা বেড়েছে, তার ঢেউ এসে লেগেছে বাংলাদেশেও। ওই জঙ্গি উত্থান রোধে বাংলাদেশ ও ভারত একসঙ্গে কাজ করতে পারে। কেননা বাংলাদেশী জঙ্গিদের পশ্চিমবঙ্গে প্রশিক্ষণ গ্রহণ, আশ্রয় নেয়া কিংবা সেখানে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়া ইত্যাদি খবর আমরা পশ্চিম বাংলার সংবাদপত্র থেকেই পেয়েছি। এক্ষেত্রে ভারত-বাংলাদেশ একসঙ্গে কাজ করতে পারে। ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নতুন একটি মাত্রা এনে দেবে। তবে অন্য সমস্যাগুলোর সমাধান যদি না হয়, তাহলে ভারতের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। তাই তিস্তাসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানে ভারতকে আরও আন্তরিক হতে হবে। আমাদের তাকাতে হবে সামনের দিকে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এ অঞ্চলের রাজনীতিকে পরিপূর্ণভাবে বদলে দিতে পারে। এক্ষেত্রে ভারতকে দ্বিপাক্ষিকতার বেড়াজাল থেকে বের হয়ে আসতে হবে। দ্বিপাক্ষিকতা নয়, দরকার বহুপাক্ষিকতা। বাংলাদেশ বহুপাক্ষিকতায় বিশ্বাসী। কিন্তু ভারতের আদর্শ হচ্ছে দ্বিপাক্ষিকতা। অর্থাৎ দ্বিপাক্ষিকতার আলোকেই ভারত সমস্যাগুলোর সমাধান চায়! কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার যে সমস্যা, তা দ্বিপাক্ষিকতার চেয়ে বহুপাক্ষিকতার আলোকে সমাধান করা শ্রেয়। ভারতকে এ বিষয়টি বুঝতে হবে। ভারতের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশ ভারত। আর বাংলাদেশ উঠতি ১৮টি অর্থনীতির দেশের একটি।
সুতরাং আজ ভারতের অর্থনীতি থেকে যেমনি আমরা উপকৃত হতে পারব, ঠিক তেমনি আমাদের অর্থনীতি থেকেও ভারত উপকৃত হতে পারবে। সেই সঙ্গে ভারত যদি বহুপাক্ষিকতার অ্যাপ্রোচ গ্রহণ করে, তাহলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যেসব সমস্যার সম্মুখীন, তাতে বড় পরিবর্তন আসতে পারে। সেক্ষেত্রে ভারতকে পুরনো ‘বৃত্ত’ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত আমাদের সাহায্য ও সহযোগিতা করেছে। এজন্য জাতি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। যেসব ভারতীয় সেনা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নয়াদিল্লিতে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের সম্মানিত করবেন। বাংলাদেশ ‘বন্ধুদের’ সম্মান করতে জানে। এক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যাশা, ‘বন্ধুরাও’ আমাদের সম্মান করুন। প্রধানমন্ত্রীর এ সফরের মধ্য দিয়ে সব সমস্যার সমাধান হবে এ প্রত্যাশাই রইল।
Daily Alokito Bangladesh
11.12.2016