রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

কোন পথে আওয়ামী লীগ

আগামী ২৮ মার্চ আওয়ামী লীগের ২০তম কাউন্সিল অধিবেশনকে ঘিরে যে প্রশ্নটি এখন আলোচিত তা হচ্ছে- কোন পথে যাবে আওয়ামী লীগ? এই কাউন্সিল অধিবেশনকে সাধারণ একটি কাউন্সিল অধিবেশন হিসেবে গণ্য করা হলে ভুল করা হবে। আমার বিবেচনায় এই কাউন্সিল অধিবেশনের গুরুত্ব অনেক বেশি। আওয়ামী লীগ এই মুহূর্তে কোনো সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে না। রাজনৈতিক পরিস্থিতি আওয়ামী লীগের অনুকূলে। দেশে স্থিতিশীলতা রয়েছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতিও আশাব্যঞ্জক। তবে প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস বা আস্থার সম্পর্কে ঘাটতি রয়েছে, এটা স্পষ্ট। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে দেশে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো (১৯৯৬ সালের পর) সরকার গঠন করেছিল। এরপর ৫ জানুয়ারির (২০১৪) বিতর্কিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ ‘বিজয়ী’ হয়েছিল। ওই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি বড় দল বিএনপির সঙ্গে আস্থার সম্পর্কে যে ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা আজও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। বিএনপির সহিংস আন্দোলন এই ‘আস্থার সম্পর্ক’ বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হিসেবে থাকলেও, ‘নির্বাচন পরিচালনাকারী সরকার’ নিয়ে বিএনপির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি গত দু’বছরেও। যদিও এটা সত্য সংবিধানে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে, তারপরও ‘উন্নয়ন ও জাতীয় ঐক্য’-এর প্রশ্নে এ ব্যাপারে একটি ‘পথ’ খুঁজে বের করা যেতে পারে। জাতীয় কাউন্সিলে প্রসঙ্গটি আলোচিত হবে বলেও মনে হয় না। তবে ঢাকায় সর্বশেষ সফর করে যাওয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক কমিটির প্রধান জিন ল্যাম্বার্ট যখন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পদ্ধতি বের করার তাগিদ দিয়ে যান, তখন প্রসঙ্গটি হালকাভাবে নেয়ার আর সুযোগ থাকে না। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচন সাংবিধানিকভাবে বৈধ হলেও, বাস্তবতা বলে ভিন্ন। বিপুলসংখ্যক ‘সংসদ প্রতিনিধি’ সংসদে এসেছেন জনগণের কোনো ম্যান্ডেট ছাড়াই। অর্থাৎ জনগণ তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেননি। পরে উপজেলা নির্বাচন, তিনটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন কিংবা সর্বশেষ ইউপি নির্বাচনে বিএনপি ফিরে এলেও, জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে কোনো ঐকমত্য হয়েছে, এটা বলা যাবে না। এ কারণেই আমার কাছে এই কাউন্সিল অধিবেশনের গুরুত্ব অনেক। দলের ঊর্ধ্বতন নেতারা যদি এ ব্যাপারে ‘মুখ খোলেন’, তাহলে এ প্রশ্নের জট খুলতে পারে। নিঃসন্দেহে সংবিধানকে সামনে রেখেই নির্বাচনটি হতে হবে। এ ক্ষেত্রে একটি ‘সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে’ করণীয় কী, কাউন্সিল এ ব্যাপারে একটি দিকনির্দেশনা দিতে পারে। আওয়ামী লীগ বড় দল। ১৯৪৯ সালের জুনে যে সংগঠনটির জন্ম, সেই সংগঠনটি অনেক ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে একাধিকবার ভাঙনের মুখে থেকেও, আজ এ দেশের অন্যতম একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। ‘এক-এগারো’ সময়কালে দলে ভাঙনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। দলের সিনিয়র কয়েকজন নেতাকে ‘সংস্কারবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের দিয়ে ‘আলাদা অবস্থান’ নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সফল হয়নি শুধু শেখ হাসিনার দৃঢ়চেতা মনোভাবের কারণে। পাঠক স্মরণ করতে পারেন ‘এক-এগারো’ সরকার একবার তার ঢাকায় ফেরা আটকে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সেটাকে চ্যালেঞ্জ করেই শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসেছিলেন। ১৯৮১ সালের পর থেকেই তিনি দলকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। এই হিসেবে দীর্ঘ ৩৫ বছর তিনি দলটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। দলের জন্য তিনি কতটুকু অপরিহার্য, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল একবার যখন ‘নির্বাচনে দল খারাপ করায়’ তার সব দায়দায়িত্ব নিয়ে দলীয় প্রধান হিসেবে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু কর্মীরা তাতে রাজি হয়নি। তিনি ফিরে এসেছিলেন। সেই থেকে তিনি এখনও আছেন। একমাত্র তিনিই দলের জন্য অপরিহার্য। অন্য কেউই অপরিহার্য নন। আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় দলের নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধু পরিবারের হাতেই থাকতে হবে। নতুবা দল অস্তিত্বের সংকটের মুখে পড়বে। তাই খুব স্পষ্ট করেই বলা যায়, আগামী কাউন্সিলে তার নেতৃত্ব পরিবর্তনের প্রশ্নটি উঠবে না। তবে কাউন্সিল পরবর্তী নেতৃত্ব তৈরির প্রশ্নে একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বিশেষ করে সজীব ওয়াজেদ জয়ের ব্যাপারে কর্মীদের আগ্রহ থাকবে ব্যাপক। আমার ধারণা সজীব ওয়াজেদ নিজেকে তৈরি করছেন ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব দেয়ার জন্য। দলের প্রাথমিক সদস্য পদ নিয়েছেন অনেক আগেই। প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা হিসেবে সরকারের কিছু কিছু দায়িত্ব পালনও করছেন। একটি সুনির্দিষ্ট সেক্টর তার। ‘নতুন এক বাংলাদেশ’কে তিনি গড়তে চান। তিনি যদি এখন মূলধারার রাজনীতিতে আসেন ও দলের কোনো সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেন, আমি তাতে অবাক হব না। জয়ের রক্তে রাজনীতি আছে। তিনি তা অস্বীকার করেন কীভাবে? যদিও প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করেছেন- সিদ্ধান্ত নেবেন জয় স্বয়ং তিনি রাজনীতিতে আসবেন কিনা! বাস্তবতা হচ্ছে তিনি আসবেন। আওয়ামী লীগ যে তারুণ্যের নেতৃত্বের জন্য তৈরি হচ্ছে, তিনি তার নেতৃত্ব দেবেন। শুধু বাংলাদেশ বলি কেন, দক্ষিণ এশিয়া থেকে শুরু করে উন্নয়নশীল বিশ্বে এই পারিবারিক রাজনীতির ধারা সর্বত্র প্রত্যক্ষ করা যায়। আমরা প্রায়ই ভারতের নেহেরু পরিবারের দৃষ্টান্ত দেই। কিন্তু ভারতে প্রতিটি রাজ্যে এই পারিবারিক রাজনীতির শক্ত ভিত্তি রয়েছে। কোথাও কোথাও (উড়িষ্যা, তামিলনাড়ু) ব্যক্তির নামেই দলের পরিচয়। পারিবারিক রাজনীতির এই ধারা যে শুধু কংগ্রেসের মাঝেই আছে, তা নয়। বরং বিজেপি থেকে শুরু করে প্রতিটি আঞ্চলিক দলের মাঝেই আছে। কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর মাঝে এই প্রবণতা ব্যাপকভাবে না থাকলেও আছে। আমি খোঁজখবর নিয়ে দেখেছি আফ্রিকার অনেক দেশে এই প্রবণতা ব্যাপক। কোথাও কোথাও স্বামী, সন্তান, ভাই সবাই মিলে মন্ত্রিসভা গঠন করে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করছেন। আফ্রিকার অনেক দেশে আমি দেখেছি যে, রাজনৈতিক পরিবারের সন্তানরা উচ্চশিক্ষিত। এদের সন্তানদের অনেকেই ব্রিটেন অথবা ফ্রান্স থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন। আমাদের উপমহাদেশের একটি ঐতিহ্য রয়েছে। উপমহাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের বীজ যেমনি রয়েছে, ঠিক তেমনি রয়েছে পারিবারিক ঐতিহ্য। নেহেরু পরিবার ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বদানকারী পরিবার। নেহেরুর বাবা মতিলাল নেহেরু এক সময় (১৯২১) কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। শ্রীলংকায় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। স্বাধীনতা-পরবর্তী শ্রীলংকার রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বন্দেরনায়েকে পরিবারের। প্রথমে বাবা, পরে মা, তারপর নিজে কুমারা রানাতুঙ্গা শ্রীলংকার রাজনীতি পরিচালনা করে গেছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে এবং তার পরিবার এখনও শ্রীলংকার রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন। শ্রীলংকার রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র একটি ঐতিহ্য। এটা নিয়ে কেউ সেখানে হইচই করে না। নেপালে যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হচ্ছে, সেখানেও রয়েছে পরিবারতন্ত্র। কৈরালা পরিবার অতীতে শুধু নেপালের সরকার পরিচালনাই সম্পৃক্ত ছিলেন না, বরং নেপালি কংগ্রেসের নেতৃত্বও রয়েছে কৈরালা পরিবারের হাতে। এমনকি মাওবাদী নেতা প্রচন্দও এ ধারা থেকে নিজেকে বাইরে রাখতে পারেননি। তার মেয়ে এখন দলের তথা রাষ্ট্রের নেতৃত্বের জন্য তৈরি হচ্ছেন। ছোট দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপেও গাইয়ুমের (সাবেক প্রেসিডেন্ট) মেয়ে পরবর্তী নেতৃত্বের জন্য তৈরি হচ্ছেন। সিঙ্গাপুরেও পরিবারতন্ত্র আছে। পাকিস্তানের কথা না হয় নাইবা বললাম। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ছেলেরা রাজনীতিতে আসছেন না। আসছেন তার মেয়ে কুলসুম। ফিলিপিন্সের দিকে তাকান। কোরাজান আকিনোর (সাবেক প্রেসিডেন্ট) ছেলে এখন সে দেশের প্রেসিডেন্ট। বেনিগনো আকিনো সিনেট সদস্য থেকেই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। এখন তিনি প্রেসিডেন্ট। প্রশ্ন হচ্ছে এই পরিবারতন্ত্র ভালো, না খারাপ। সিঙ্গাপুরে ২০০৪ সালে লি কুয়ান ইউর ছেলে লি শিয়েন লং যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন সেখানে প্রশ্ন ওঠে না। কারণ তিনি যোগ্য। সিঙ্গাপুরকে বিশ্বসভায় নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা তিনি অতীতে রেখেছেন। এ প্রশ্ন ওঠেনি ফিলিপিন্সে কোরাজন আকিনোর ছেলের বেলায়- একজন সিনেটর হিসেবে তিনি অবদান রেখেছিলেন। প্রশ্নটা সেখানেই। প্রাচীন ভারতে একটি শ্লোক আছে- Vasudua Kutumbikam। সংস্কৃতি থেকে ইংরেজি করলে দাঁড়ায় all the Univese is a family। অর্থাৎ বিশ্বকে একটি পরিবার হিসেবে গণ্য করা হয়। বর্তমান যুগের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সেই বিবেচনায় নিয়ে বংশানুক্রমভাবে তারা শাসন করে। ভারতের রাজনীতিতে এই পারিবারিক ধারা অত্যন্ত শক্তিশালী। নেহেরু পরিবারের বাইরে বেশকিছু পরিবারের জন্ম হয়েছে, যারা রাজনীতিতে প্রভাব খাটাচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় চরণসিং, দেবগৌড়া, শারদ পাওয়ার, আবদুল্লাহ, মুলায়াম সিং যাদব, করুণানিধি, রেড্ডি, সিঙ্গিয়া পরিবার। এসব পরিবারের পেশা হচ্ছে রাজনীতি। বাংলাদেশ এ থেকে পার্থক্য নয়। পারিবারিক এ রাজনীতির ধারা বাংলাদেশে আছে ও থাকবে। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে তাই আলোচিত হচ্ছেন সজীব ওয়াজেদ জয়। তিনি প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। তরুণ প্রজন্ম তার বক্তব্যে, তার আদর্শে আকৃষ্ট হচ্ছেন। তিনি একুশ শতক উপযোগী নতুন এক বাংলাদেশ উপহার দিতে চাচ্ছেন। তাই সঙ্গত কারণেই ২৮ মার্চের আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের দিকে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। সজীব ওয়াজেদ জয় এই কাউন্সিলে কোনো সাংগঠনিক দায়িত্ব পান কিনা, সে দিকে লক্ষ্য থাকবে অনেকের। দলের সংবিধানে কিছু কিছু পরিবর্তন আসতে পারে। কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য সংখ্যা বাড়ানো হতে পারে। এটা খুব স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রেসিডিয়াম সদস্য পদেও পরিবর্তন আনা যেতে পারে। আমার বিবেচনায় আওয়ামী লীগের জন্য যা এই মুহূর্তে জরুরি, তা হচ্ছে একটি শক্তিশালী উপদেষ্টা পরিষদ গঠন, যারা দলের জন্য একুশ শতক উপযোগী নীতি প্রণয়ন করবেন। তাদের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী গবেষণা সেল থাকবে, যারা বিশ্ব রাজনীতি, বিশ্ব অর্থনীতি, সন্ত্রাসবাদ, বাণিজ্য, আঞ্চলিক সহযোগিতা ইত্যাদি বিষয়কে সামনে রেখে দলের জন্য একুশ শতক উপযোগী একটি নীতি প্রণয়ন করবেন এবং দলীয় সভাপতিকে সহযোগিতা করবেন। এক্ষেত্রে যারা বিশেষজ্ঞ তাদের অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। আমলা দিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হলে, তা কোনো ভালো ফল বয়ে আনতে পারবে না। আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ বলি কেন, উপমহাদেশের একটি বড় সংগঠন। দলটি স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বের সারিতে ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৪৬ বছরে পা দিতে যাচ্ছে। বাংলাদেশকে আমরা আগামী দিনে কীভাবে দেখতে চাই, এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে একটি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা মানুষ প্রত্যাশা করে। বিশ্বকে দেখার অনেক কিছু আছে বাংলাদেশের। একটি মধ্যম আয়ের দেশ, বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার সক্ষমতা, একটি দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা, ‘সফট পাওয়ার’ হিসেবে নিজেকে বিশ্ব আসরে প্রতিষ্ঠা করা- এসবই বাংলাদেশ করতে পারে। এ জন্য দরকার যুগোপযোগী নেতৃত্ব, সঠিক নীতি, দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজ, সেইসঙ্গে দরকার পারস্পরিক একটি আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা। আওয়ামী লীগের ২৮ মার্চের কাউন্সিল অধিবেশনে এর কতটুকু প্রতিফলিত হয়, সেদিকে তাই লক্ষ্য থাকবে অনেকের
Daily Jugantor
 ২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় নয়া মাত্রা"

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আর বাকি আছে মাত্র আট মাস। চলতি বছরের ৮ নভেম্বর সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আর নয়া প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব গ্রহণ করবেন ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি। দুটি বড় দল—ডেমোক্রেটিক আর রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থীরা এখন বিভিন্ন রাজ্য ককাসে (প্রাথমিক বাছাই) অংশ নিচ্ছেন। এর মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পর্বে কোন দুজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, তা স্পষ্ট হচ্ছে। যেমন ইতিমধ্যে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী বাছাইয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের ছোট ভাই ও ফ্লোরিডার সাবেক গভর্নর জেব বুশ ছিটকে পড়েছেন। জেব বুশকে একসময় সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে মনে করা হতো। এখন জেব বুশ নিজেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরিয়ে নিলেন। তবে সাউথ ক্যারোলাইনা অঙ্গরাজ্যে ক্যাসিনো ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় নির্বাচনী প্রচারণায় নতুন একটি মাত্রা এনে দিয়েছে। প্রথম দিকে তাঁকে রিপাবলিকান পার্টির একজন সিরিয়াস প্রার্থী হিসেবে মনে করা হয়নি। অন্যদিকে ডেমোক্রেটিক পার্টির সর্বশেষ সাউথ ক্যারোলাইনা অঙ্গরাজ্যে অনুষ্ঠিত ককাসে বিজয়ী হয়েছেন হিলারি ক্লিনটন। এখন শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হিলারি আর ট্রাম্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে কি না, সেটাই দেখার বিষয়। ১৯৪৭ সালে জন্ম নেওয়া ও ৬৭ বছর বয়সী হিলারি ক্লিনটনের হোয়াইট হাউস, প্রশাসন ও আইন প্রণেতা হিসেবে অভিজ্ঞতা অনেক দিনের। হোয়াইট হাউসে তিনি ছিলেন আট বছর, ১৯৯৩ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত একজন ফার্স্ট লেডি হিসেবে। এরপর নিউ ইয়র্ক থেকে একজন সিনেটর হিসেবে তিনি কংগ্রেসে আইন প্রণয়নে সহায়তা করেন ২০০১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত। আবার ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সেক্রেটারি অব স্টেট হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি প্রণয়নপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এর আগে ২০০৮ সালে তিনি বারাক ওবামার সঙ্গে ডেমোক্রেটিক দলীয় প্রার্থী হতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে তিনি ওবামার কাছে হেরে গিয়েছিলেন। এরপর বারাক ওবামা তাঁকে মন্ত্রিপরিষদে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দিলেও হিলারি ক্লিনটন বারবারই আলোচনায় ছিলেন। মিডিয়া তাঁকে বারবার ফোকাস করেছে। শেষ পর্যন্ত সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু হোয়াইট হাউসে আসার পথটি কি মসৃণ? তিনি কি পারবেন ইতিহাস গড়তে? যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ ২০০৮ সালে ওবামাকে নির্বাচিত করে ট্রাডিশনাল প্রথা ভেঙেছিল—একজন কৃষ্ণাঙ্গ প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন।এই ধারাবাহিকতায় এখন যুক্তরাষ্ট্র একজন নারী প্রেসিডেন্টকে পায় কি না, সেটাই দেখার বিষয়। তবে অনেক প্রশ্ন তো আছেই। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ এখনো কনজারভেটিভ। তারা একজন নারীকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে নাও পারে; যদিও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নারীরা সরকার ও রাষ্ট্র পরিচালনায় বেশ সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। জার্মানি, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলসহ চার ডজন দেশে নারীরা এখনো রাষ্ট্র তথা সরকার পরিচালনা করে আসছেন। ইউরোপের অনেক দেশে রাষ্ট্রপ্রধান এখন নারী। ফলে একদিকে হিলারি ক্লিনটনের সম্ভাবনা যেমন আছে, তেমনি এটাও সত্য, তিনি কনজারভেটিভদের বাধার সম্মুখীন হতে পারেন। বলা ভালো, জনগণের ভোটে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন না। নির্বাচিত হন নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে। যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যের সংখ্যা ৫০, আর নির্বাচকমণ্ডলীর সংখ্যা ৫৩৮। সাধারণত সিনেট ও হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভের (প্রতিনিধি পরিষদ) সদস্য সংখ্যার ভিত্তিতে এই নির্বাচকমণ্ডলী গঠিত হয়। হিলারি ক্লিনটনের জন্য সমস্যা হচ্ছে কনজারভেটিভ রিপাবলিকানরা এখন কংগ্রেসের উভয় কক্ষ (সিনেট ও হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ) নিয়ন্ত্রণ করেন। অর্থাৎ নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে রিপাবলিকানরা ভারী। ২০১৬ সালে এক-তৃতীয়াংশ সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদের নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হবে। তাতে যদি পরিবর্তন আসে, তাহলে তা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। নতুবা কনজারভেটিভদের বলয় ভাঙা তাঁর জন্য কঠিন হবে। উল্লেখ্য, হিলারিকে বলা হয় দুর্বলচিত্তের একজন মানুষ। তাঁর স্বামী বিল ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় যখন মনিকা লিউনস্কির সঙ্গে অবৈধ যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে যান তখন স্ত্রী হিসেবে তিনি যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারেননি; যদিও ওই ঘটনার পরও তিনি স্বামীকে ‘ক্ষমা’ করে দিয়েছিলেন এবং বৈবাহিক জীবন টিকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। তবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, নির্বাচনী প্রচারণায় হিলারি ক্লিনটনকে ভবিষ্যতেও এ ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। এ জন্য হিলারি ক্লিনটন কতটুকু মানসিক শক্তির অধিকারী হন, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। উপরন্তু ক্লিনটন দম্পতির বিরুদ্ধে বেশ কিছু আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। যখন এই দম্পতি হোয়াইট হাউস ছাড়েন তখন তাঁদের আর্থিক ভিত্তি তেমন শক্তিশালী ছিল না। কিন্তু পরে নিউ ইয়র্কে ২৭ লাখ ডলারের একটি বাড়ি ও ওয়াশিংটনে ২৮ লাখ ৫০ হাজার ডলারে তাঁদের অপর একটি বাড়ি কেনা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা। ক্লিনটন ফাউন্ডেশন নিয়েও প্রশ্ন আছে। অভিযোগ আছে অনেক বিদেশি রাষ্ট্র এই ফাউন্ডেশনকে আর্থিক সুবিধা দিয়ে তাদের ‘সুবিধা’ আদায় করে নিয়েছে; যদিও দুজনই বক্তৃতা আর সেমিনার করে বেশ অর্থ আয় করেন। একই সঙ্গে হিলারির বিরুদ্ধে বড় একটি অভিযোগ হচ্ছে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থায় লিবিয়ার বেনগাজিতে যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলেটে জঙ্গিবাদীদের হামলা ও ওই হামলায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের নিহত হওয়ার ঘটনা ঠেকাতে পারেননি এবং রাষ্ট্রদূতসহ অন্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেননি। ওয়াশিংটনের পিউ রিচার্স ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বৈদেশিক নীতি ইস্যুতে মানুষ রিপাবলিকানদের বেশি বিশ্বাস করে। এটা হিলারি ক্লিনটনের জন্য একটা মাইনাস পয়েন্ট। অতীতে হিলারি ইরাক, বসনিয়া ও কসোভোয় ‘যুদ্ধ’ সমর্থন করেছিলেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরোধী একটা জনমত তাঁকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে। তবে হিলারি ক্লিনটনের বেশ কিছু প্লাস পয়েন্টও রয়েছে। এক. তিনি পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা বিষয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞ। এ ক্ষেত্রে রিপাবলিকান সম্ভাব্য প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের নানা বিতর্কিত মন্তব্য মার্কিন সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ফলে ট্রাম্পের চেয়ে তিনি অনেক এগিয়ে আছেন। দুই. ২০১৪ সালের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রে যে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে রিপাবলিকানরা বিজয়ী হলেও ইতিমধ্যে রিপাবলিকান স্রোতে উল্টো বাতাস বইছে, বিশেষ করে তরুণ ও গরিব আমেরিকান ভোটারদের মাঝে ডেমোক্রেটিক পার্টির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। তিন. যুক্তরাষ্ট্রে একটি শক্তিশালী তরুণ প্রজন্ম রয়েছে, যাদের নেতৃত্বে নিউ ইয়র্কসহ অন্যান্য শহরে ‘অক্যুপাই মুভমেন্ট’ পরিচালিত হয়েছিল। এই ‘শক্তি’ ডেমোক্র্যাটদের আবার ২০১৬ সালে কংগ্রেসে ফিরিয়ে আনতে পারে, যা হিলারিকে বিজয়ী হতে সাহায্য করবে। চার. ওবামা তাঁর শেষ টার্মে এসে বেশ কিছু কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন (স্বাস্থ্যসেবা, অভিবাসন, তরুণদের উচ্চশিক্ষায় সাহায্য ইত্যাদি), যা কিনা তিনি কংগ্রেসের বিরোধিতার কারণে বাস্তবায়ন করতে পারছেন না। এই তরুণ প্রজন্মের সমর্থন পেতে পারেন হিলারি। পাঁচ. যুক্তরাষ্ট্রে যুদ্ধবিরোধী একটি জনমত রয়েছে, যা বেশ শক্তিশালী। প্রেসিডেন্ট ওবামার আমলেই যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে আইএসবিরোধী যুদ্ধে অংশ নিয়ে নতুন একটি ‘ফ্রন্ট’ ওপেন করেছেন। কোটি কোটি ডলার খরচ হয় যুদ্ধে। হিলারি যদি এই ‘যুদ্ধবিরোধী’ জনমতের সঙ্গে অবস্থান করেন, তাহলে তাঁর সমর্থন ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। ছয়. রিপাবলিকান শিবিরে তেমন কোনো শক্ত প্রার্থী নেই। এটা হিলারির জন্য একটি প্লাস পয়েন্ট। সর্বশেষ ডোনাল্ড ট্রাম্পের নারীবিদ্বেষী মন্তব্য তাঁর অবস্থানকে শক্তিশালী করতে পারে।
ডেমোক্রেটিক শিবিরে হিলারি ক্লিনটনের অবস্থান অনেক শক্তিশালী। প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁকে একজন সম্ভাব্য ‘ভালো প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তুলনামূলক বিচারে জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে তিনি ভারমন্ট রাজ্যের সিনেটর বার্নি স্যান্ডারসের চেয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে আছেন। জনপ্রিয়তাও তাঁর বেশি। কৌশলী হিলারি অনেক আগে তাঁর প্রার্থী পদ ঘোষণা করে প্রতিযোগিতায় নিজেকে এগিয়ে রেখেছিলেন। তবে যেতে হবে অনেক দূর। আরো পার্টি ফোরামে ও কনভেনশনে তাঁকে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হবে নিজ দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে। সেই সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে তাঁকে আরো অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। বড় ব্যবসায়ী হাউসগুলো অর্থ জোগায়। হিলারিকে তাদের আস্থা অর্জন করতে হবে। এটা কতটুকু সম্ভব হবে, তা বলা এই মুহূর্তে কঠিন।
হিলারি ক্লিনটনের একটা বড় প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে তিনি বৈদেশিক নীতিতে একটা পরিবর্তন এনেছিলেন। তিনি এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলকে ঘিরে যে 'Forward Deployed Diplomacy' প্রণয়ন করেছিলেন তা এ অঞ্চলের যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ এই কূটনীতির মূলকথা হচ্ছে—এ অঞ্চলের রাজনৈতিক উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটা আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক স্থাপন করা। জন কেরি (যিনি পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে হিলারি ক্লিনটনের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন) হিলারি ক্লিনটন প্রণীত এই নীতি নিয়ে এগিয়ে গেলেও চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরো উন্নত হয়েছে, এটা বলা যাবে না; বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগরে বিতর্কিত দ্বীপে চীনের একটি বিমানবন্দর নির্মাণ, বিতর্কিত টিপিপি চুক্তি নিয়ে এগিয়ে যাওয়া (যেখানে চীনকে এই চুক্তির আওতায় রাখা হয়নি) ইত্যাদি কারণে দুই দেশের সম্পর্কের মাঝে সেই আস্থা ও বিশ্বাসের অভাব দেখা দিয়েছে। ফলে একজন সম্ভাব্য ‘প্রেসিডেন্ট’ হিলারি ক্লিনটন চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে কোন পর্যায়ে উন্নীত করতে পারবেন সেটা নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকলই। উপরন্তু রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে আইএসের উত্থান এবং ইরানের সঙ্গে ছয় জাতি পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তি। ওবামা এই চুক্তি করে মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধের ‘সম্ভাবনা’ কমিয়ে এনেছেন, এটা সত্য। কিন্তু রিপাবলিকান সমর্থিত কংগ্রেস এই চুক্তি অনুমোদন না করলে জটিলতা আরো বাড়বে। হিলারি ক্লিনটনের জন্যও বিষয়টি খুব সহজ হবে না।
স্পষ্টতই রিপাবলিকান শিবিরে কোনো শক্ত প্রার্থী নেই। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর একাধিক বিতর্কিত বক্তব্যের কারণে কট্টরপন্থীদের আকর্ষণ করতে পারলেও কিছুটা মডারেট টেড ক্রুজের অবস্থানও ভালো। এখন চূড়ান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ডেমোক্রেটিক শিবিরে যখন হিলারি ক্লিনটন আর বার্নি স্যান্ডারসের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে, ঠিক তেমনি রিপাবলিকান শিবিরে চূড়ান্ত বাছাই পর্বে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সীমাবদ্ধ থাকছে টেড ক্রুজ আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে। ১৭৮৯ সালে জর্জ ওয়াশিংটন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। এর ২২৭ বছর পর একজন নারী প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন কি না, তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে নভেম্বর পর্যন্ত। Daily Kalerkontho 29.02.16

ভারতে জাঠ আন্দোলন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

জাঠ আন্দোলন নতুন করে আবারও ভারতের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার অসঙ্গতিগুলোকে সামনে নিয়ে এলো। জাঠরা মূলত একটি অনগ্রসর শ্রেণি। হরিয়ানাসহ মোট ৯টি রাজ্যে এই জাঠদের বসবাস। এরা মূলত চাষবাসের সঙ্গে জড়িত, অর্থাৎ কৃষক। কিন্তু ওবিসি অর্থাৎ ‘আদার ব্যাকওয়ার্ড কাস’ হিসেবে তারা স্বীকৃত নন। ১৯৯১ সালে ম-ল কমিশনের রিপোর্ট বলবৎ হওয়ার পর থেকেই কেন্দ্র ও রাজ্যের ওবিসি তালিকা নিয়ে জাঠদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। ১৯৯৭ সালে হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশসহ ছয়টি রাজ্যের জাঠ নেতারা দাবি তুলেছিলেন কেন্দ্রের ওবিসি তালিকায় তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কিন্তু অনগ্রসর শ্রেণিসংক্রান্ত ন্যাশনাল কমিশন তা খারিজ করে দেয়। ব্যাপারটা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছিল। সেখানেও জাঠ নেতারা সুবিধা করতে পারেননি। সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিয়েছিল, ‘শিক্ষা ও আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়াটাকে অনগ্রসরতা বলা যাবে না। সামাজিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা মানুষদের অনগ্রসর বলতে হবে।’ কিন্তু তাতেও জাঠদের আন্দোলন থেমে থাকেনি। নিজেদের অনগ্রসর শ্রেণিভুক্ত দাবি করে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও চাকরিতে ‘কোটা’ সংরক্ষণ চেয়ে আবারও তারা আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলন ঠেকাতে সেনাবাহিনী নামাতে হয়েছে। কারফিউ দিতে হয়েছে। পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর সংখ্যা ১০ অতিক্রম করেছে। আন্দোলনকারীরা এক পর্যায়ে দিল্লিতে পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল। বলা ভালো দিল্লির পানির শতকরা ৬০ ভাগের উৎস হচ্ছে হরিয়ানা। স্পষ্টতই এই জাঠ আন্দোলন মোদি সরকারকে বড় ধরনের একটি চাপের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ভারত বড় দেশ। অর্থনীতিতে উঠতি শক্তি। ভারতের জিডিপির পরিমাণ ২ দশমিক ৩০৮ ট্রিলিয়ন ডলার (পিপিপি অর্থাৎ ক্রয় ক্ষমতার হিসেবে এর পরিমাণ ৭ দশমিক ৯৯৬ ট্রিলিয়ন ডলার)। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৩ ভাগ। বিশ্বের ৭ম বড় অর্থনীতির দেশ ভারত (পিপিপিতে তৃতীয়)। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতে জাত-পাতের সমস্যা প্রচুর। স্বাধীনতার ৬৮ বছরেও ভারত এ সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। সেখানে কৃষকদের ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে, আত্মহত্যার ঘটনা অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এ নিয়ে তেমন আন্দোলন হয় না। তবে গেল সপ্তাহে হরিয়ানায় জাঠরা কোটা সংরক্ষণ চেয়ে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছে তাতে নতুন করে ভারতের সমাজে যে অসঙ্গতি রয়েছে, সেই বিষয়টি সামনে চলে এলো। মোদি গত ২১ মাসে এ সমস্যার সমাধান করতে পারেননি। নিঃসন্দেহে গত দেড় বছরে মোদি নিজেকে একজন উদ্যমী ও শক্তিশালী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। দলে আদভানির (যিনি প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন) মতো নেতাকে পাশে সরিয়ে রেখে তিনি তার অবস্থানকে শক্তিশালী করেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগটি বড়, তা হচ্ছে তিনি ‘গরিব দেশের ধনী প্রধানমন্ত্রী’। প্রেসিডেন্ট ওবামাকে স্বাগত জানাতে (জানুয়ারি ২০১৫) তিনি ১০ লাখ রুপির স্যুট পরিধান করে প্রমাণ করেছিলেন তিনি আসলে ধনী শ্রেণিরই প্রতিনিধি! এক সময় যে নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি কৈশোরে ট্রেনের কামরায় কামরায় চা বিক্রি করতেন, মা পরের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালাতেন (মে মাসের ২০১৫ টাইম সাময়িকীর প্রতিবেদকের কাছে তা তিনি স্বীকারও করেছেন), সেই মোদির সঙ্গে এখন করপোরেট জগতের বাসিন্দাদের সম্পর্ক বেশি। ট্রেনে চা বিক্রেতাদের মতো সাধারণ ভারতীয়দের কাছে এখন তিনি ‘অনেক দূরের মানুষ’। তিনি যখন বিদেশ যান, তখন তার সঙ্গে যান ব্যবসায়ীরা, যান করপোরেট হাউসের প্রতিনিধিরা। গত দেড় বছরে তার শরীরে দশ লাখ রুপির স্যুট উঠেছে সত্য, কিন্তু দরিদ্র ভারতের চেহারা তিনি পরিবর্তন করতে পারেননি। কৃষকদের আত্মহত্যার প্রবণতা তিনি দূর করতে পারেননি। ইন্টারন্যাশনাল কম্পারিজন প্রোগ্রামের মতে, জাপানকে হটিয়ে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে ভারত। ২০০৫ সালে ভারত দশম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ছিল, আজ তৃতীয় অবস্থানে (সাধারণ নিয়মে এই অবস্থান সপ্তম)। আর গত বছর জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি চিনের চেয়ে বেশি হবে। যেখানে চিনের প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ২ ভাগ, সেখানে ভারতের হবে ৭ দশমিক ৭ ভাগ। নরেন্দ্র মোদি এই ভারতকেই প্রতিনিধিত্ব করছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ভারতের জনগোষ্ঠীর ৩৭ ভাগ মানুষ এখনো গরিব। ৫৩ ভাগ জনগোষ্ঠীর কোনো টয়লেট নেই, যারা প্রকাশ্যেই এই ‘কাজটি’ নিত্য সমাধান করেন। পরিসংখ্যান বলে, বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ গরিব মানুষের বাস ভারতে, যাদের দৈনিক আয় বিশ্বব্যাংক নির্ধারিত ১ দশমিক ২৫ সেন্টের নিচে। চিন্তা করা যায় প্রতিদিন ভারতে ৫ হাজার শিশু মারা যায় ক্ষুধা ও অপুষ্টির কারণে (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ৮ সেপ্টেম্বর ২০১০)। পাঁচ বছর আগের এই পরিসংখ্যানে খুব পরিবর্তন এসেছে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। শুধু দরিদ্রতা কেন বলি, প্রায় ৮০ কোটি লোকের দৈনিক আয় ২ দশমিক ৫০ ডলার। ৭০ ভাগ লোক গ্রামে বসবাস করে। নারী-পুরুষের পার্থক্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যেখানে অবস্থান (জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র ১৮৬-কে হিসাবে ধরে) ১৪৬, ভারতের সেখানে ১৩৬। এত নারী নির্যাতন আর নারী ধর্ষণ ঘটনা ঘটার পরও বন্ধ হয়নি। নারী নির্যাতনের কাহিনি নিয়ে তৈরি ছবি (যা বাস্তব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি) গুলাব গ্যাং-এর (উত্তরপ্রদেশের বুন্দেলখ-ে গ্রামের সত্য কাহিনি) কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। মোদি গত দেড় বছরে এদের জন্য কী করেছেন? যদিও মাত্র দেড় বছরে দরিদ্রতা কমানো সম্ভব নয়, কিংবা বিপুল তরুণ প্রজন্মের জন্য চাকরির সংস্থান করাও সম্ভব নয়। তিনি মনে করেন বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে। কিন্তু দরিদ্রতা কমানো তার জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তার ‘গুজরাট মডেল’ নিয়েও নানা প্রশ্ন আছে। গুজরাটে তিনি সড়ক, মহাসড়ক করেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের ন্যূনতম চাহিদা পূরণে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। ভারতের প্রভাবশালী সংবাদপত্রগুলো তার দেড় বছরের পারফরম্যান্স নিয়ে নানা প্রবাদ লিখেছে। তবে বেশিরভাগ সংবাদপত্রের ভাষ্য একটাইÑ তিনি যে নির্বাচনের আগে ‘আচ্ছে দিন’-এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা এখনো অধরা। প্রাপ্তির ঘরটা এখনো শূন্য। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ১২৫ কোটি মানুষের প্রত্যেকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ রুপি করে জমা হবে। কিন্তু তা হয়নি। ভবিষ্যতে হবে, এমন সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কালো টাকা উদ্ধার করার প্রতিশ্রুতিও ছিল। কিন্তু অর্থমন্ত্রী অরুন জেটলি জানিয়ে দিয়েছেন, কালো টাকার প্রশ্নটা ছেলে খেলা নয়। কাজেই অমন লুটোপুটি করলে চলবে না। আর অমিত শাহ বলেছেন, কালো টাকা দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসাÑ এটা কথার কথা। এ ধরনের কথা বলতে হয়। এটা কথার কথা, এটাকে সিরিয়াসলি নিতে নেইÑ এটা অমিত শাহের সাফ কথা তাই নরেন্দ্র মোদির সেই প্রতিশ্রুতি ‘আচ্ছে দিন’, অর্থাৎ সুসময় কবে আসবে, বলা মুশকিল। তবে এটা তো ঠিক, সুসময় এসেছে ব্যবসায়ীদের জন্য। তারা এখন মোদির সঙ্গে বিশ্বময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাদের চাই ব্যবসা। চাই বিনিয়োগ। আর সেই ব্যবসা ও বিনিয়োগ নিশ্চিত করছেন মোদি। জাপান, চিন ও দক্ষিণ কোরিয়ায় গিয়ে তিনি প্রচুর আশ্বাস পেয়েছেন। ভারতকে তিনি চিনের বিকল্প হিসেবে ‘পণ্যের উৎপাদন কারখানায়’ পরিণত করতে চান। বড় বড় কোম্পানি এখন ভারতে আসছে। কিন্তু কৃষক যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। তাদের কোনো উন্নতি হয়নি। জাত-পাতের সমস্যা যা ছিল, তাও রয়ে গেছে। সরকারের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে মোদি একটি খোলা চিঠি লিখেছিলেন। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায়ও তা ছাপা হয়েছিল। এখানে তিনি কতগুলো বিষয় স্পষ্ট করেছেন। এমনকি বিজেপি এক সংবাদ সম্মেলনও করেছিল গত ২৬ মে (২০১৫)। মোদির চিঠি ও বিজেপির সংবাদ সম্মেলনে কতগুলো বিষয় স্পষ্ট হয়েছিল। এক. রামমন্দির প্রতিষ্ঠা কিংবা শরিয়া আইন বাতিল তারা করবেন না। কেননা লোকসভায় তাদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাই যথেষ্ট নয়। অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ, মুসলিমদের শরিয়া আইন বাতিল, জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাবাহী সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলÑ এগুলো ছিল বিজেপির প্রধান নির্বাচনী ইস্যু। দুই. মোদি বলেছেন, তিনি গত এক বছরে দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজ উপহার দিতে পেরেছেন। তিনি বলেছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি প্রধান পাহারাদার, দেশের সম্পদের পাহারাদার। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমে মোদির ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ (ভারত নির্মাণ) অভিযানকে অতিরঞ্জিত প্রচার বলে মন্তব্য করা হয়েছে। মোদি সরকারের কাছে বিপুল প্রত্যাশা থাকলেও কর্মসংস্থানের হাল যথেষ্ট খারাপ বলেও মন্তব্য করেছে তারা। প্রভাবশালী দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে মোদি সরকারের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে ভারতে মোদির এক বছর উচ্ছ্বাসের পর্ব শেষ, সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, ‘ভারতে এক বছর আগে পরিবর্তন ও আর্থিক পুনরুজ্জীবনের আশায় নরেন্দ্র মোদি বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু এবার চূড়ান্ত বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছে মোদি সরকার। কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র অভিযান শুরু করলেও ভারতের অর্থনীতি খুঁড়িয়েই চলছে। আর নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, মোদির অধিকাংশ কর্মসূচি এখনো কথার কথাই রয়ে গেছে। নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, দেশের অভ্যন্তরে আর্থিক অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার এখনো বেহাল। ব্যবসায়িক উদ্যোগেও তেমন দানা বাঁধছে না। একই সঙ্গে রাজনৈতিকভাবেও চাপে পড়েছেন মোদি। এসব মূল্যায়ন মোদি সম্পর্কে কোনো ভাল ধারণা দেয় না। নিশ্চয়ই গত দেড় বছরে মোদি অনেক কিছু শিখেছেন। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, তিনি নিজস্ব একটি স্টাইল তৈরি করেছেন। তিনি সিদ্ধান্ত একাই নেন। এখানেই মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে তার পার্থক্য। মনমোহন সিং বেশি মাত্রায় সোনিয়া গান্ধীনির্ভর ছিলেন। নরেন্দ্র মোদির প্লাস পয়েন্ট এটাই। দলে তাকে চ্যালেঞ্জ করার কেউ নেই। তারপরও তার বিরুদ্ধে অসন্তোষ আছে। দলের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এটা মনে করে কিনা জানি না, গত আগস্টে (২০১৫) ভারতের ৬৯তম স্বাধীনতা দিবসে এক ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘দুর্নীতি ভারতকে ঘুণপোকার মতো খেয়ে ফেলেছে। ওপরের পর্যায় থেকে আসাদের এ কাজ শুরু করতে হবে।’ ভাষণে তিনি কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এর মাঝে আছে ১০০০ দিনের মধ্যে সব গ্রামে বিদ্যুৎ। তিনি বলেছিলেন, ‘স্ট্যান্ড আপ ইন্ডিয়া’। নতুন ভারত গড়ার প্রত্যয়। কিন্তু জাঠ আন্দোলন এখন তার ‘স্ট্যান্ড আপ ইন্ডিয়া’র পথে অন্যতম অন্তরায় হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল। ভারত পৃথিবীর বড় গণতান্ত্রিক দেশ হওয়া সত্ত্বে মানুষ আর মানুষের মধ্যে যে কোনো পার্থক্য নেই, এই ‘সত্যটি’ বাস্তবে রূপ দিতে পারেনি। ভারতে গণতন্ত্র আছে, এটা যেমন সত্য, ঠিক তেমনি এটাও সত্য সেখানে সমাজে মানুষের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সমাজে মাত্র ৫ ভাগ মানুষ ব্রাহ্মণ, অর্থাৎ তারা কুলিন শ্রেণি। অন্যদিকে নীচু তথা দলিত শ্রেণির সংখ্যা ১৩ ভাগ ও অনগ্রসর শ্রেণির সংখ্যাও ১৩ ভাগ। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর শ্রেণিকে যদি ধরা হয়, তাহলে এ সংখ্যা ২৮ ভাগ। দলিতরা সমাজের অনগ্রসর শ্রেণি হিসেবে চিহ্নিত হলেও এই দলিতদের নিয়েই ‘রাজনীতি’ করে অনেকে শুধু রাষ্ট্র ক্ষমতা ভোগই করেননি, বরং ধনী ব্যক্তিত্বেও পরিণত হয়েছেন। মায়াবতী এর বড় প্রমাণ। ভারতের রাজনীতিবিদরা তাদের নিজেদের স্বার্থেই এই ‘জাত-পাত’-এর ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখছেন। Daily Amader Somoy 27.02.16

আচরণবিধি কি শুধু অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের জন্যই প্রযোজ্য

সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চ আদালতে একাধিক ঘটনায় একটি বিষয় সামনে চলে এসেছে। আর তা হচ্ছে বিচারপতিরা অবসরে গেলেও কিংবা কর্মে নিয়োজিত থাকলেও তাদের জন্য একটি নীতিমালা থাকা প্রয়োজন কিনা? সরকারের কোনো কোনো মহল থেকেও এ ধরনের মন্তব্য করা হয়েছে। আচরণবিধির প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছে যখন হাইকোর্ট ডিভিশনের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এলপিআর (অবসরকালীন ছুটি) এ থাকাবস্থায় সরকারের সব সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে একজন যুদ্ধাপরাধীর মামলায় অভিযুক্তের পক্ষে এবং সরকারের বিপক্ষে আইনি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। পরবর্তীকালে ওই মামলা থেকে তিনি নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন বটে, কিন্তু মূল বিষয়ের কোনো সমাধান হয়নি অর্থাৎ বিচারপতিদের ক্ষেত্রে একটি আচরণবিধি থাকা উচিত কিনা এর সুরাহা হয়নি। এর আগে আবার একজন আপিল বিভাগের অবসরে যাওয়া বিচারপতি প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে যেসব কথা প্রকাশ্যে বলেছেন, তা নিয়েও বিতর্ক কম হয়নি। আসলে সাংবিধানিক পদে যারা থাকেন (শুধুমাত্র উচ্চ আদালতই নয়) কিংবা যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন অথবা বলা যেতে পারে একজন লেখকের জন্য আচরণবিধি প্রণয়ন করা কি আদৌ প্রয়োজন আছে? পাঠক স্মরণ করতে পারেন একুশের বইমেলা থেকে ‘ইসলাম বিতর্ক’ শীর্ষক একটি বই সম্পাদনা করা, প্রকাশ করার অভিযোগে প্রকাশকসহ ৩ জনকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। ব-দ্বীপ নামে প্রকাশনাটি বন্ধ করেও দেয়া হয়েছে। অভিযোগ আছে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার। খোদ লেখক জাফর ইকবালও বইটি না পড়ার জন্য সবাইকে অনুরোধ করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে ওই সম্পাদক কি এ ধরনের একটি বই প্রকাশ করতে পারেন? মত প্রকাশের স্বাধীনতার অর্থ এই নয় মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা।
দুই সিনিয়র বিচারপতির মধ্যে বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছিল প্রধান বিচারপতির একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। গত ১৯ জানুয়ারি ২০১৬ তারিখে প্রধান বিচারপতি পদে দায়িত্ব নেয়ার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে দেয়া এক বাণীতে সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছিলেন, ‘কোনো কোনো বিচারপতি অবসর গ্রহণ করার দীর্ঘদিন পর রায় লেখা অব্যাহত রাখেন, যা আইন ও সংবিধান পরিপন্থি।’ এর বিরোধিতা করেন আপিল বিভাগ থেকে সদ্য অবসরে যাওয়া বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। ঘটনাটা ওখানেই শেষ হতে পারত অথবা তিনি প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য না রেখে তার কাছে যে রায়গুলো লেখা বাকি ছিল, তা দ্রুত জমা দিতে পারতেন। এতে করে সাধারণ মানুষ এত কিছু জানত না। কিন্তু বিষয়টিকে তিনি প্রকাশ্যে নিয়ে আসলেন। শুধু তাই নয়, তিনি প্রকাশ্যে এমন সব মন্তব্য করলেন যা বিচারপতি হিসেবে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। একজন রাজনীতিবিদ, একজন শিক্ষক প্রকাশ্যে অনেক মন্তব্য করতে পারেন। কিন্তু একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি পারেন না। সেটা শোভনও নয়। একজন বিচারপতি অবসরে থাকার পরও সমাজে তিনি একজন বিচারপতি হিসেবেই গণ্য হয়ে থাকেন। সমাজ তাকে বিশেষ মর্যাদার চোখে দেখে। তিনি সমাজ তথা রাষ্ট্রের বিবেক। সাধারণত এটা কোথায়ও লেখা থাকে না অবসরে যাওয়ার পর একজন বিচারপতি কি করবেন, কি করবেন না। সমাজ বা রাষ্ট্র তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের কাউকে কাউকে কখনো কখনো এমন সব কর্মকাণ্ড করতে দেখি, যা অনাকাক্সিক্ষত। আমরা অতীতে একজন বিচারপতিকে দেখেছিলাম, যিনি অবসরের পর রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছিলেন এবং সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিতও হয়েছিলেন। এখন আমরা দেখলাম একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে যুদ্ধাপরাধী অভিযোগে অভিযুক্ত একজনের পক্ষে আইনি লড়াইয়ে দাঁড়াতে। এক্ষেত্রে আইন কোনো বাধা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে নৈতিকতার। একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির আইনি পেশায় ফিরে যাওয়া যেমন শোভন নয়, ঠিক তেমনি তাদের রাজনীতিতে অংশ নেয়াও কাম্য নয়। তবে নিঃসন্দেহে একজন বিচারপতি অবসরের পর তার মেধা, যোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সমাজকে সেবা করতে পারেন। একাধিক অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিও অবসরের পর আইন কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং সরকারের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়েছিলেন। অথচ সংবিধানের ৯৯(১) এ বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি বিচারকরূপে দায়িত্ব পালন করিয়া থাকিলে উক্ত পদ হইতে অবসর গ্রহণের বা অপসারিত হইবার পর তিনি কোনো আদালত বা কোনো কর্তৃপক্ষের নিকট ওকালতি বা কার্য করিবেন না এবং বিচার বিভাগীয় বা আধা-বিভাগীয় পদ ব্যতীত প্রজাতন্ত্র কর্মে কোনো লাভজনক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হইবেন না।’ যদিও ৯৯ (২)(১) এ বলা হয়েছে, তিনি আপিল বিভাগে ওকালতি করতে পারবেন। এখানে প্রশ্নটা নৈতিকতার। আইন তাকে সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু নৈতিকতা বলে একটা কথা আছে।
আচরণবিধির প্রশ্নটা আসে তখনই যখন একজন বিচারপতি, অবসরে যাওয়ার পর পরই এমন কোনো বক্তব্য দিতে পারেন না, যা রাজনৈতিক বিতর্কের জš§ দিতে পারে কিংবা সংকট সৃষ্টি করতে পারে। আমরা দুঃখজনকভাবে লক্ষ্য করলাম অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মানিক প্রকাশ্যে এমন সব মন্তব্য করলেন, যা তার পদ ও মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সুপ্রিম কোর্ট মাজার গেটের পাশে রাস্তার ওপর আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তার (প্রধান বিচারপতি) কোনো আদেশ মানি না। মানব না।’ তিনি প্রধান বিচারপতির পদত্যাগও দাবি করেছিলেন। অতীতে কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এভাবে প্রকাশ্যে সুপ্রিম কোর্ট এলাকার ভেতরে সংবাদ সম্মেলন করেননি। বিচারপতি চৌধুরী করলেন। অতীতে কোনো বিচারপতি প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ দাবি করেননি। বিচারপতি চৌধুরী এ ধরনের দাবি করে নতুন একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। বিচার বিভাগের ভাবমূর্তির জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। কিন্তু তার একটি বক্তব্যে আমি অবাক হয়েছি, যখন তিনি সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেছিলেন প্রধান বিচারপতি সিনহা বেগম জিয়ার রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন এমন বক্তব্য শুনে! কি ভয়ঙ্কর কথা। এ ধরনের কথাবার্তা তো আমরা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মুখে শুনি। একজন বিচারপতির মুখে কি এ ধরনের বক্তব্য শোভা পায়! প্রধান বিচারপতি তো কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন। তিনি কেন একটি রাজনৈতিক দলের প্রধানের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবেন? এটি স্পস্টতই একটি রাজনৈতিক বক্তব্য এবং প্রধান বিচারপতিকে বিতর্কিত করার শামিল। এটি কোনো ভালো কাজ নয়। বিচার বিভাগের জন্য একটি খারাপ নজিরও বটে।
বিচারপতি মানিকের বক্তব্য ও আচরণ সমর্থন করেননি আরেকজন সাবেক প্রধান বিচারপতি। মূলত এটা সত্য, বর্তমান প্রধান বিচারপতি উচ্চ আদালতে একটি সংস্কার আনতে চাচ্ছেন। আমি মনে করি এটা যৌক্তিক ও সমর্থনযোগ্য। এর প্রয়োজন রয়েছে। এই নিবন্ধটি যখন লিখছি, তখন চোখ আটকে গেল আরো একটি সংবাদে। ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত ওই সংবাদে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের এক বিচারপতির স্ত্রী বিচারপতির গানম্যান নিয়ে আরেক আইনজীবীর চেম্বার দখলের চেষ্টা চালিয়েছেন (আমাদের সময়)। প্রশ্ন হচ্ছে, একজন বিচারপতি গানম্যান পাবেন কিন্তু তার স্ত্রী কি ওই গানম্যানকে কোথাও নিয়ে যেতে পারবেন? আসলে প্রশ্নটি এখানে নীতিমালার, আচরণবিধির। আচরণবিধিতে যদি সুস্পষ্ট করে কিছু লেখা না থাকে, তাহলে তা সুস্পষ্ট করা প্রয়োজন। আচরণবিধি সমাজের উচ্চ শ্রেণীর সবার জন্য প্রযোজ্য হওয়া উচিত। কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেই, তাহলে আমাদের বুঝতে সহজ হবে। তিনি একজন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য। শপথ নিয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি নিয়মিত টিভি টক-শোতে যান এবং রাজনৈতিক বক্তব্য দেন। প্রশ্ন হচ্ছে, শপথ নিয়ে তিনি কি এ ধরনের কাজ করতে পারেন? তার তো জানার কথা কোন কাজটা তিনি করবেন, কোন কাজটা করবেন না। তিনি যখন প্রকাশ্যে টক-শোতে রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন, তখন একটি সুস্পষ্ট ‘রাজনৈতিক লাইন’ তিনি অনুসরণ করেন। এটা কি তাহলে পিএসসির মৌখিক পরীক্ষাতেও প্রতিফলিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না? এ ক্ষেত্রেও আচরণবিধিতে সুস্পষ্ট করে থাকা উচিত কোন কাজটা পিএসসির সদস্যদের করা উচিত, কোন কাজটা করা উচিত নয়। পিএসসির চেয়ারম্যান বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন। আরেকজন পিএসসির সদস্য। পত্রিকাতে রাজনৈতিক কলাম লেখেন। এটা করা কি তার উচিত? বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান একজন শিক্ষাবিদ। তিনি পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখেন। টিভি টক-শোতে রাজনৈতিক বক্তব্য দেন। অতীতে কোনো চেয়ারম্যান কিংবা কোনো পিএসসির সদস্য এভাবে প্রকাশ্যে ‘সরকারি চাকরি’ করে রাজনৈতিক বক্তব্য দেননি। এ জমানায় আমরা দেখছি। পিএসসির সদস্যরা নিরপেক্ষতার শপথ নিয়েও প্রকাশ্যে রাজনৈতিক বক্তব্য দেন। যদি এমনই হতে থাকে তাহলে তা আচরণবিধিতে থাকুক। সুস্পষ্ট করেই থাকুক। প্রয়োজনে সংসদে আইন পাস করে তাদের অনুমতি দেয়া হোক। একই কথা প্রযোজ্য ইউজিসি চেয়ারম্যান কিংবা উপাচার্যদের ক্ষেত্রেও। একজন উপাচার্যকে দেখি টিভিতে অংশ নেয়াই বুঝি তার প্রধান কাজ! আইনে কখনো সব কিছু লেখা থাকে না। সেটা সম্ভবও নয়। প্রশ্ন হচ্ছে নৈতিকতার। শুধু বিচারপতিদের প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা করলে চলবে না।
বিচারপতি চৌধুরীকে নিয়ে যে ‘বিতর্ক’ সৃষ্টি হয়েছে এর অবসান হওয়া বাঞ্ছনীয়। তিনি এরপর আর অনাকাক্সিক্ষত কোনো বক্তব্য দেবেন না, এটাই প্রত্যাশা করি। সেই সঙ্গে এটাও প্রত্যাশা করি যে রায়গুলো এখনো লেখা শেষ হয়নি, তা তিনি দ্রুত শেষ করবেন এবং নথিসহ সব কাগজপত্র জমা দেবেন। তিনি যত দ্রুত এ কাজটি করবেন, ততই তার জন্য মঙ্গল। তিনি যত দেরি করবেন, ততই জটিলতা বাড়বে। সংবিধান লঙ্ঘন কিংবা মানহানির ঘটনায় তিনি অভিযুক্ত হতে পারেন। তিনি ‘প্রধান বিচারপতির আদেশ মানবেন না’ এ কথা তিনি বলতে পারেন না। প্রধান বিচারপতি একজন ব্যক্তি নন, একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানকে ‘বিতর্কিত’ করা অন্যায়। ন্যূনতম সৌজন্যবোধটুকু থাকলে একজন সিনিয়র বিচারপতি এ ধরনের মন্তব্য করতে পারেন না। তবে অবসরে গিয়ে রায় লেখা কতটুকু সাংবিধানিক কিংবা কতটুকু যৌক্তিক এ প্রশ্নটাকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। অনেক বিচারপতিই এই কাজটি করেন। কিন্তু কখনো এ বিষয়টি প্রকাশ্যে আসেনি। প্রধান বিচারপতি এই বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসলেন। স্পষ্টতই প্রধান বিচারপতি উচ্চ আদালতে সংস্কার চান। এটা মঙ্গল এবং ন্যায়পরায়ণতার স্বার্থে যুক্তিসঙ্গত। একটি সংক্ষিপ্ত রায় হয়ে গেল। পূর্ণ রায় একজন নাগরিক পেলেন ১৫ মাস পর এটা তো হতে পারে না। এটা তো একজন নাগরিকের অধিকার খর্বের শামিল। পূর্ণ রায় লিখতে একজন বিচারপতি কিছুটা সময় নিতেই পারেন। কিন্তু তার অর্থ এই নয় তিনি মাসের পর মাস রায়টি ‘ধরে’ রাখবেন এবং ১৫ মাস পর পূর্ণাঙ্গ রায়টি দেবেন! ততদিনে তো মানুষ সব কিছু ভুলে যায়।
তাই উচ্চ আদালতে সংস্কার প্রয়োজন। প্রধান বিচারপতি একটি মন্তব্য করেছেন গত ১৭ ফেব্রুয়ারি। বিচার বিভাগ নিয়ে কটাক্ষ না করতে রাজনীতিকসহ সব মহলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। আমি মনে করি বিচার বিভাগের প্রধানের এ ধরনের আহ্বানের প্রতি সবার শ্রদ্ধা জানানো উচিত। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে রাষ্ট্র বিচারপতি, আইনজীবীসহ সবার ব্যাপারে একটি আচরণবিধি তৈরি করতে পারে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রেরও উচিত বিভিন্ন পেশাজীবীদের ব্যাপারেও একটি সামগ্রিক আচরণবিধি তৈরি করা। না হলে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা বারবার ঘটতে থাকবে। এটা সত্য, একজন সাবেক বিচারপতির কর্মকাণ্ড কিংবা একজন পিএসসির সদস্যের কর্মকাণ্ড দিয়ে সবার মানসিকতা বোঝা যাবে না কিংবা পিএসসিকেও চিত্রিত করা যাবে না। বিচারপতিরা সাধারণত ‘পর্দার আড়ালেই’ থাকেন। তারা খুব একটা প্রকাশ্যে আসতে চান না। আইন তাদের আপিল বিভাগে ওকালতি করার সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু তাদের সেটা করাও শোভন নয়। বরং সামাজিক ক্ষেত্রে তারা অবদান রাখতে পারেন। তারা আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র। শ্রদ্ধার পাত্র হয়েই তারা থাকবেন এটাই কাম্য।
Daily Manobkontho
25.02.16

ভারত মহাসাগরে চিন ও ভারত দ্বন্দ্ব বাড়ছে


ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করার রাজনীতিকে কেন্দ্র করে ভারত ও চিনের মধ্যে দ্বন্দ্ব ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এ সংক্রান্ত দুটি সংবাদ সম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ সংবাদে বলা হয়েছে, ভারত তার নৌবাহিনীর বড় বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ বিক্রমাদিত্যকে মালদ্বীপে পাঠিয়েছে। যুদ্ধজাহাজ বিক্রমাদিত্যের সঙ্গে আছে ডেস্ট্রয়ার মাইশোর। চিনকে ‘চাপে’ রাখতেই ভারত যুদ্ধজাহাজ মালদ্বীপে পাঠিয়েছে বলে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ইকোনমিক টাইমস আমাদের খবর দিয়েছে। এই সংবাদটি বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায়ও ছাপা হয়েছে। এর আগে চলতি বছরের ২১-২২ জানুয়ারি বিক্রমাদিত্যকে শ্রীলংকার কলম্বোতে প্রথমবারের মতো বৈদেশিক জলসীমায় মোতায়েন করা হয়। দ্বিতীয় অপর একটি সংবাদেও এই চিন-ভারত দ্বন্দ্বের বিষয়টি উঠে এসেছে। টাইমস অব ইন্ডিয়া ও জিনিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরের নির্মাণকাজ পেতে যাচ্ছে ভারত। জিনিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোনাদিয়ায় যে গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণের কথা ছিল এবং যা চিনের সাহায্যে নির্মিত হওয়ার কথা ছিল, তা এখন পরিত্যক্ত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন পায়রা বন্দরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে যাচ্ছে, যেখানে চিনসহ আরও ১০টি কোম্পানি আগ্রহ দেখিয়েছিল। পাঠকরা নিশ্চয়ই স্মরণ করতে পারেন, কলম্বোতে চিনা ডুবজাহাজের উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে শ্রীলংকায় সরকার পর্যন্ত পরিবর্তন হয়েছিল। এই ডুবজাহাজের উপস্থিতিকে ভারত দেখেছিল তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ হিসেবে। সাবেক শ্রীলংকান রাষ্ট্রপতি রাজাপাকসে ছিলেন অতিমাত্রায় চিনানির্ভর। চিন শ্রীলংকার হামবানতোতা ও কলম্বোতে দুটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে দিয়েছিল। কিন্তু বিষয়টি খুব সহজভাবে দেখেনি ভারত। শেষ পর্যন্ত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা সেখানে এক ধরনের ‘হস্তক্ষেপ’ করে এবং সিরিসেনাকে রাজাপাকসের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ হিসেবে দাঁড় করায়। অবশ্য নির্বাচনে সিরিসেনা বিজয়ী হয়েছিলেন এটা সত্য। ভারতে মোদি ক্ষমতায় আসার পর ভারতীয় মহাসাগর তথা মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলকে ঘিরে নয়া ভারতীয় স্ট্র্যাটেজি রচিত হয়েছে। গেল বছর (মার্চ) ভারতের উড়িষ্যার ভুবনেশ্বরে ভারতীয় মহাসাগরভুক্ত দেশগুলোর সমন্বয়ে গঠিত ‘ইন্ডিয়ান ওসেন রিস’-এর একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশও তাতে অংশ নিয়েছিল। ওই সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ সুস্পষ্ট করেই বলেছিলেন, ভারত মহাসাগরে চিনের প্রবেশ ভারতের কাছে কাক্সিক্ষত নয়। ভুবনেশ্বর শীর্ষ সম্মেলনের আগে মোদি সরকার মরিশাসে ভারতীয় ঘাঁটি স্থাপনের ব্যাপারে একটি চুক্তি করেছে। মালদ্বীপ ও শ্রীলংকার সঙ্গে একটি মৈত্রী জোট গড়ারও উদ্যোগ নিয়েছিল ভারত। এই জোটে মরিশাস ও সিসিলিকে পর্যবেক্ষক হিসেবে রাখারও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তৃতীয় আরও একটি সংবাদে এই ভারত-চিন দ্বন্দ্বের খবর প্রকাশিত হয়েছে। এই খবরটিও দিয়েছে ভারতের বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার। ওই খবরে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, চিন এখন আর শুধু অরুনাচল ও লাদাখেই তার দাবি অব্যাহত রাখছে না বরং এই প্রথমবারের মতো ভারত মহাসাগরে ভারত নিয়ন্ত্রিত দ্বীপ আন্দামান ও নিকোবারও তাদের বলে দাবি করেছে। ধারণা করা হচ্ছে ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন ও ব্রুনাইয়ের সঙ্গে ভারত চুক্তি করে বিতর্কিত দক্ষিণ চিন সাগরে ভারতীয় নৌবাহিনীর উপস্থিতি নিশ্চিত করার পরই চিন আন্দামান ও নিকোবার দ্বীপপুঞ্জে তাদের অধিকার দাবি করল।
এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল তথা ভারত মহাসাগর আগামী দিনে প্রত্যক্ষ করবে এক ধরনের প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতা। এই দুটি অঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু ‘সামরিক তৎপরতা’ লক্ষণীয়। দক্ষিণ চিন সাগরে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে একটি সামরিক ঐক্য জোট গঠিত হয়েছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে চিনের ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ করা। অন্যদিকে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিন তার নৌবাহিনীর তৎপরতা বাড়িয়েছে। দক্ষিণ চিন সাগর থেকে মাল্লাক্কা প্রণালি হয়ে ভারত মহাসাগর অতিক্রম করে এরাবিয়ান গালফ পর্যন্ত যে সমুদ্রপথ, তার নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় চিন। কারণ ওই পথ তার জ্বালানি সরবরাহের পথ। চিনের জ্বালানি চাহিদা প্রচুর। এদিকে ভারতও ভারত মহাসাগরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ভারতের নৌবাহিনীর ‘নিউ ইস্টান ফিট’-এ যুক্ত হয়েছে বিমানবাহী জাহাজ। রয়েছে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন। আন্দামান ও নিকোবারে রয়েছে তাদের ঘাঁটি। ফলে এক ধরনের প্রতিযোগিতা ইতোমধ্যে চিন ও ভারতের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে। এশিয়া-প্যাসিফিক ও দক্ষিণ এশিয়ার কর্তৃত্ব নিয়ে চিন ও ভারতের অবস্থান এখন অনেকটা পরস্পরবিরোধী। যেখানে চিনা নেতৃত্ব একটি নয়া ‘মেরিটাইম সিল্ক রুট’-এর কথা বলছে, সেখানে মোদি সরকার বলছে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক করিডোরের কথা, স্বার্থ মূলত এক ও অভিন্নÑ এ অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। আর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই এশিয়ার এই দুটি বড় দেশের মাঝে দ্বন্দ্ব অনিবার্য। আর এটাকেই কাজে লাগাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
এক সময় মার্কিনি গবেষকরা একটি সম্ভাব্য চিন-ভারত অ্যালায়েন্সের কথা বলেছিলেন। জনাথন হোলসলাগ ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে লিখিত একটি প্রকল্পে ঈযরহফরধ (অর্থাৎ চিন ভারত)-এর ধারণা দিয়েছিলেন। চিনা প্রেসিডেন্টের ভারত সফরের (২০১৪) পর ধারণা করা হয়েছিল যে, দেশ দুটি আগে কাছাকাছি আসবে। কিন্তু শ্রীলংকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা, চিন-ভারত সীমান্ত নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং চিনা প্রেসিডেন্টের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয়েছে এই সম্ভাবনা এখন ক্ষীণ। নতুন আঙ্গিকে ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিনের’ ধারণা আবার ফিরে এসেছে। এই ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিন’ মনরো ডকট্রিনের দক্ষিণ এশীয় সংস্করণ। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ায় অন্য কারও কর্তৃত্ব ভারত স্বীকার করে নেবে না। এক সময় এই এলাকা, অর্থাৎ ভারত মহাসাগরীয় এলাকা ঘিরে ‘প্রিমাকভ ডকট্রিন’ (২০০৭ সালে রচিত। শ্রীলংকা, চিন, ইরান ও রাশিয়ার মধ্যকার ঐক্য)-এর যে ধারণা ছিল, শ্রীলংকায় সিরিসেনার বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ধারণা এখন আর কাজ করবে না। ফলে বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী ধারণাকে আরও শক্তিশালী করতে বিসিআইএম (বাংলাদেশ, চিনের ইউনান রাজ্য, ভারতের সাতবোন, মিয়ানমার) যে আগ্রহ দেখিয়েছিল, তাতে এখন শ্লথগতি আসতে পারে। সামরিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রশ্নে ভারত এখন আর বিসিআইএম ধারণাকে ‘প্রমোট’ করবে না। আর বাংলাদেশের একার পক্ষে চিন ও মিয়ানমারকে সঙ্গে নিয়ে ‘বিসিএম’ ধারণাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব হবে না। ভারত এখন উপ-আঞ্চলিক জোট বিবিআইএন জোটের কথা বলছে। ভারতের কর্তৃত্ব করার প্রবণতা এ অঞ্চলের দৃশ্যপটকে আগামী দিনে বদলে দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাও লক্ষণীয়। ভারত বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। এখানে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়ছে। ফলে এখানে মার্কিনি স্বার্থ থাকবেই। এ অঞ্চলে মার্কিনি স্বার্থের অপর একটি কারণ হচ্ছে চিন। চিনকে ‘ঘিরে ফেলা’র একটি অপকৌশল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একটি ‘কৌশলগত সম্পর্কে’ নিজেদের জড়িত করেছে। এই দুই দেশের স্বার্থ এক ও অভিন্ন। তবে ভারত মহাসাগর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দু’দেশের মাঝে অবিশ্বাসের জন্ম হওয়া বিচিত্র কিছু নয়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা লক্ষ করেছেন যে, একুশ শতকে ভারত মহাসাগর প্রত্যক্ষ করবে ত্রিদেশীয় একটি প্রতিযোগিতা। যুক্তরাষ্ট্র তার এশীয়-প্যাসিফিক ফিট থেকে ৬টি জাহাজ ভারত মহাসাগরে মোতায়েন করবে। এটি সম্পন্ন হবে ২০১৯ সালের মধ্যে। ভারত তার প্রাচীন ‘কটন রুট’কে আবার নতুন করে সাজাচ্ছে। এই ‘কটন রুট’ ধরে ভারতীয় পণ্য, বিশেষ করে তার সুতি কাপড় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেত। এমনকি এই ‘কটন রুট’ ধরে ভারতীয় ব্রাহ্মণরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া (বালি) ও কম্বোডিয়ায় হিন্দুধর্মের সম্প্রসারণ ঘটিয়েছিলেন। এ অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের বিকাশও ঘটেছিল এই ‘কটন রুট’ ধরে। এর আগে চিনা নেতা শিজেন পিং একটি ‘মেরিটাইম সিল্করুট’-এর কথা বলেছিলেন। এই ‘মেরিটাইম সিল্ক রুট’কে সামনে রেখে চিন বেশ কিছুদিন আগে তার বিখ্যাত ‘মুক্তার মালা’ নীতি গ্রহণ করেছিল। চিন যে ‘ঝঃৎরহম ড়ভ ঢ়বধৎষং’ বা ‘মুক্তার মালা’ নীতি গ্রহণ করেছে, তার মাধ্যমে এ অঞ্চলের সামুদ্রিক বন্দরগুলোকে একত্রিত করতে চায়। এতে করে আরব সাগর থেকে শুরু করে ভারত মহাসাগরে চিনা নৌবাহিনীর কর্তৃত্ব বেড়েছে। চিনের এই মুক্তার মালা নীতির কারণে দক্ষিণ চিন সাগর থেকে মাল্লাকা প্রণালি, ইন্দোনেশিয়ার বালি হয়ে ভারত মহাসাগর অতিক্রম করে এরাবিয়ান গালফ পর্যন্ত যে সমুদ্রপথ, এই সমুদ্রপথ থাকছে চিনের নিয়ন্ত্রণে। কেননা এ পথ তার জ্বালানি সরবরাহের পথ। সাওদার (বেলুচিস্তান, পাকিস্তান) ও চিনা নৌবাহিনীর একটি ছোট্ট ইউনিটও রয়েছে, যেখান থেকে চিন ভারত মহাসাগরের সব ধরনের নৌ-মুভমেন্ট লক্ষ করবে।
সাওদারের ঠিক উল্টো দিকে ভারত মহাসাগরেরর এক পাশে রয়েছে শ্রীলংকার হামবানতোতা গভীর সামুদ্রিক বন্দর। এই সামুদ্রিক বন্দরটি চিন নির্মাণ করে দিয়েছে। এখানে চিনা নৌবাহিনীর সাবমেরিনের উপস্থিতি ভারতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দাদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। ভারতের স্ট্র্যাটেজিস্টরা এ ধরনের কর্মকা- তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করেছিল। এ জন্য রাজাপাকসেকে ক্ষমতা পর্যন্ত হারাতে হয়েছিল। রাজাপাকসে অতি মাত্রায় চিনানির্ভর ছিলেন। এই চিনানির্ভরতা ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা খুব সহজভাবে নিতে পারেননি। সেখানে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। নয়া প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা দায়িত্ব নিয়েছেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি শ্রীলংকাও ঘুরে এসেছেন অতি সম্প্রতি। স্পষ্টতই মোদি সরকার ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলগুলো নিয়ে যে নীতি প্রণয়ন করেছেন, তাতে করে এটা স্পষ্ট, এই নীতি এই অঞ্চলে চিনা স্বার্থকে আঘাত করবে। ফলে এ অঞ্চল, অর্থাৎ ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে আগামী দিনগুলোতে যে এক ধরনের প্রভাব বলয় বিস্তার করার প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ইতোমধ্যে মিয়ানমারে একটি নয়া সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে। অং সান সুচি ভবিষ্যতে মিয়ানমারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে যাচ্ছেন। মিয়ানমারকে ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বাড়ছে। মিয়ানমারের জ্বালানিসম্পদ, বিশেষ করে গভীর সমুদ্রে গ্যাস ও তেল প্রাপ্তি মিয়ানমারকে আগামী সময়ে চিন ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে এক ধরনের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করতে পারে। এই জ্বালানিসম্পদের ব্যাপারে আগ্রহ রয়েছে ভারতেরও, যেখানে ভারতের বিনিয়োগ বাড়ছে। স্পষ্টতই ভারত মহাসাগরকে ঘিরে একদিকে ভারত, অন্যদিকে চিন এবং মাঝখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজ নিজ স্ট্র্যাটেজি ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে এই স্ট্র্যাটেজি এই দেশগুলোর স্বার্থে কতটুকু আঘাত করে কিংবা এই স্ট্র্যাটেজি আদৌ কোনো ‘সংঘর্ষের’ পর্যায়ে রূপ নেয় কিনা, তা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। 
Daily Amader Somoy
22.02.16

কোন পথে বিএনপি

অনেকদিন ধরেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে বিএনপি। আগামী ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিল। এই কাউন্সিলকে ঘিরেই নানা আলোচনা। যদিও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন এই কাউন্সিলের মাধ্যমে বিএনপি বিপর্যয় কাটিয়ে উঠবে, তারপরও নানা প্রশ্ন, নানা জিজ্ঞাসা বিএনপিকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। সবচেয়ে বড় যে শংকা, তা হচ্ছে যে কোনো একটি মামলায় খালেদা জিয়ার যদি ‘শাস্তি’ হয় এবং আইনি প্রক্রিয়ায় তিনি যদি এর থেকে ‘মুক্তি’ না পান, তাহলে কী হবে বিএনপির? কেননা দলের যিনি হাল ধরবেন এবং যিনি খালেদা জিয়ার যোগ্য উত্তরসূরি, সেই তারেক রহমান লন্ডনে। তার ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ এবং অপর যে কোনো একটি মামলায় তার শাস্তি হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়ছে। তাহলে কে ধরবেন বিএনপির হাল? তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমান? নাকি তারেকের একমাত্র সন্তান জাইমা রহমান? একজন ‘বেনজির ভুট্টো’ কী তৈরি হচ্ছে! নানা গুঞ্জন আকাশে-বাতাসে ভাসছে। জিয়া পরিবারের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক নেই জোবায়দা রহমানের। কিন্তু রক্তের সম্পর্ক আছে কিশোরী জাইমা রহমানের। নিঃসন্দেহে তার জন্য বয়সটা একটা ফ্যাক্টর। এবং বোধকরি তারেক রহমান নিজেও এটা চাইবেন না। এখনও কলেজ অতিক্রম করেনি জাইমা। দাদা, দাদি, বাবা সবাই রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই ‘রাজনীতি’কে জাইমা অস্বীকার করে কীভাবে? খালেদা জিয়া ইতিমধ্যে সত্তরে পা দিয়েছেন। শারীরিকভাবে তিনি পুরোপুরি সুস্থ নন। তার সুস্থতার ওপর দলের অনেক কিছু নির্ভর করছে। এ মুহূর্তে দলে তারেক রহমান ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি নেই, যিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তারেক রহমান লন্ডনে অবস্থানের কারণে খালেদা জিয়াকে বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়েছিল দলের পুনর্গঠন ও সিদ্ধান্ত নিতে। এখন খালেদা জিয়া সেই কাজটি সারবেন। তবে খালেদা জিয়াকে অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নিতে হবে আগামীতে। তার অবর্তমানে দলের নেতৃত্ব কার হাতে থাকবে কিংবা দলের সংবিধান পরিবর্তন করে দলে কো-চেয়ারম্যানের একটি পদ সৃষ্টি করে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের পথ সৃষ্টি করতে হবে, এটাও ভাবতে হবে। কেননা এটা স্পষ্ট যে, তারেক রহমান দেশে আসতে পারছেন না। সে ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া যদি জেলে যান বা অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাহলে দল কে দেখবেন? ইতিমধ্যে কর্নেল অলির (অব.) বিএনপিতে ফিরে আসা, কিংবা অধ্যাপক বি. চৌধুরীর বিএনপিতে ফেরার আগ্রহ রাজনৈতিক পণ্ডিতদের মাঝে নানা প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপি এখনও বড় দল। জাতীয় পার্টির ব্যর্থতা বিএনপিকে সামনে নিয়ে এসেছে।

গেল পহেলা সেপ্টেম্বর বিএনপি ৩৭ বছরে পা রেখেছে। একটি রাজনৈতিক দলের জন্য এই ৩৭ বছর একেবারে কম সময় নয়। দলটি একাধিকার রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জন্ম নেয়া এই রাজনৈতিক দলটি বর্তমানে এক কঠিন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বোধকরি অতীতে কখনোই দলটি এ ধরনের সংকটের মাঝে পড়েনি। যারা রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে কাজ করেন, তারা জানেন বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে দলটির একটি শক্ত অবস্থান আছে। তিনবার দলটি ক্ষমতায় ছিল (১৯৭৮-৮২, ১৯৯১-৯৬, ২০০১-০৬)। ফলে তৃণমূল পর্যায়ে দলটির একটি অবস্থান আছে। ১৯৮২ সালে এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থান ও ক্ষমতা থেকে বিএনপির উৎখাতের পর ওই সময় যখন বিএনপির অস্তিত্ব হুমকির মুখে ছিল, ঠিক তখনই একজন গৃহবধূ থেকে (১৯৮৩) রাজনীতির পাদপ্রদীপে আসেন খালেদা জিয়া। এখন তিনিই বিএনপির অবিসংবাদিত নেত্রী। তাকে কেন্দ্র করেই বিএনপির রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, নব্বই-এ এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সাধারণ মানুষ যে খালেদা জিয়াকে দেখেছিল একজন অবিসংবাদিত নেত্রী হিসেবে, সেই খালেদা জিয়াকে এখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল! বয়স বেড়েছে। অসুস্থ তিনি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচনে অংশ না নেয়া কিংবা পরবর্তী সময়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে যে সহিংস রাজনীতির জন্ম হয়েছে এ দেশে, তা ব্যক্তিগতভাবে খালেদা জিয়া তথা বিএনপির রাজনীতিকে উজ্জ্বল করেনি। খালেদা জিয়াকে আমার এখন মনে হচ্ছে নিঃসঙ্গ একজন নাবিক হিসেবে, যিনি আদৌ জানেন না কোন দিকে এবং কোন পথে বিএনপি নামক ‘জাহাজটি’কে পরিচালনা করবেন। এক সন্তানহারা, অপর সন্তান অনেক দূরে, নেতাকর্মীরা জেলে, নিঃসঙ্গ খালেদা জিয়া এখন একাই বিএনপি।

বর্তমানে বিএনপি নানা সমস্যায় আক্রান্ত এটা তো অস্বীকার করা যাবে না। বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিএনপি দল গোছানোর কথা বলছে। তবে অতীতে বিএনপির কয়েকজন নেতার ফোনালাপ ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে শীর্ষস্থানীয় বিএনপি নেতাদের মাঝে এক ধরনের হতাশা আছে। বিএনপি ভাঙার ‘গুজব’ এ কারণেই। খালেদা জিয়াকে দিয়ে হবে না, কিংবা জিয়ার আদর্শে ফিরে যেতে হবে- এ ধরনের বক্তব্য যখন বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মুখ থেকে বের হয়, তখন গুজবের নানা ডাল-পালা গজায়। মির্জা ফখরুল জামিন পেলেও কেউ কেউ জেলে আছেন এখনও। অনেকের বিরুদ্ধে মামলা আছে। আর যারা হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন, ওই জামিনের বিরুদ্ধে আপিল করেছে সরকার। এর অর্থ পরিষ্কার- মামলা, মোকদ্দমা দিয়ে বিএপির শীর্ষ নেতাদের ব্যস্ত রাখতে চায় সরকার, যাতে করে তারা আন্দোলনে নিজেদের জড়িত করতে না পারেন। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে অতীতে এমনটি কখনোই দেখা যায়নি- এত বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা! ফলে এসব নেতাকর্মী আর রাজপথে সক্রিয় হতে পারবেন না। খালেদা জিয়াকে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯-এর ২৭ ধারা অনুযায়ী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন সংক্রান্ত ধারা) বিচার, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় কিংবা গ্যাটকো দুর্নীতি মামলায় শাস্তি দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা, একই সঙ্গে ডান্ডি ডায়িং মামলায় তারেক রহমানকে ‘শাস্তি’ দিয়ে তাকেও অযোগ্য ঘোষণার মধ্য দিয়ে সরকার মাইনাস ওয়ান ফর্মুলার দিকেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। এ ক্ষেত্রে খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হলে আইনি প্রক্রিয়ায় তিনি নির্বাচনের জন্য যোগ্য হবেন কি-না জানি না। খালেদা জিয়াই বিএনপির মূল শক্তি। খালেদা জিয়া যদি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন, বিএনপির বিকল্প নেতৃত্ব নির্বাচনে অংশ নেবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমানকে বাদ দিয়ে বিএনপি সংগঠিত হবে এটাও আমার মনে হয় না। সরকারের নীতিনির্ধারকরা যদি মাইনাস ওয়ান ফর্মুলা কার্যকর করতে চান, আমার ধারণা তা কোনো কার্যকর ‘ফল’ দেবে না। ‘আসল বিএনপি’ কিংবা নাজমুল হুদার ফালতু কথাবার্তায় মানুষ খুব আস্থাশীল এটা আমার মনে হয় না। জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের আসনে বসিয়েও সরকার খুব লাভবান হয়নি। জাতীয় পার্টি এখন নানা জটিলতার মুখে। ফলে সরকারের কাছে এখন বিকল্প পথ দুটি। এক. বিএনপিকে যে কোনোভাবে আস্থায় নিয়ে ২০১৭ সালের প্রথম দিকে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়া। দুই. অথবা সংবিধান অনুযায়ী ২০১৮ সালের শেষের দিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা। যে কোনো সময়ের চেয়ে সরকারের অবস্থান এখন অনেক শক্তিশালী। উল্লিখিত দুটি সিদ্ধান্তের মাঝে একটি, অর্থাৎ প্রথমটির ব্যাপারে সরকারের আগ্রহ কম। এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত, অর্থাৎ সংবিধান অনুযায়ী পরবর্তী নির্বাচনটিই সরকার করতে চায়। কিন্তু প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিকে বাদ রেখে যদি ২০১৮ সালের শেষে নির্বাচন হয়, তাহলে সমস্যা যা ছিল, তাই থেকে যাবে!

বিএনপির সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক তৈরি না হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করা যাবে না। সম্প্রতি ঢাকা সফর করে যাওয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধিদলও বলে গেছে, সব দলের অংশগ্রহণের স্বার্থে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে এখনই সংলাপ শুরু হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সরকার তাতে সায় দেবে বলে মনে হয় না।

এটা স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশে একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে। আওয়ামী লীগের বিকল্প বিএনপি, ঘুরে ফিরে এটা প্রমাণিত। দশম সংসদে জাতীয় পার্টি পারেনি। তাই যে কোনো বিবেচনায় বিএনপির সঙ্গে একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা সরকারের জন্য জরুরি। কেননা বাংলাদেশ নিুমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ ভাগের উপরে, যেখানে ইউরোপে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে শ্লথগতি এসেছে। এখন নিুমধ্যম আয়ের দেশের চূড়ান্ত স্বীকৃতি পেতে হলে এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হবে। আর এর পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। বিএনপিকে আস্থায় নিয়েই এই স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। এটা সবাই বলেন, সংসদীয় রাজনীতিতে শক্তিশালী একটি বিরোধী দল থাকা দরকার। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেয়ায় জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু গত প্রায় দুই বছরের সংসদীয় রাজনীতির কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জাতীয় পার্টি সেই দায়িত্বটি পালন করতে পারছে না। দ্বন্দ্ব আছে সরকারে থাকা না থাকা নিয়ে। ফলে সংসদকে আরও গ্রহণযোগ্য, আরও অর্থবহ এবং সর্বোপরি একটি সঠিক জাতীয় নীতি প্রণয়নে সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা বাঞ্চনীয়। আর বিএনপিই সেই দায়িত্বটি পালন করতে পারে। বলা ভালো, বিএনপি সংসদে না থাকলেও বিএনপি যে বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অপরিহার্য অংশ, দাতাগোষ্ঠী এটা স্বীকার করে এবং তারা সবাই বিএনপিকে মূল ধারার রাজনীতিতে দেখতে চায়। ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের অবস্থানও আমার ধারণা অনেকটা সে রকম। সরকারের ভূমিকা তাই এ ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। এটা স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অন্যতম দুটি শক্তি। এই দুটি দল দুটি রাজনৈতিক ধারার প্রতিনিধিত্ব করছে। অতীত ইতিহাস প্রমাণ করে এই দুটি দলের একটিকে বাদ দিয়ে যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, তা স্থায়ী হয়নি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এসেছিল জনগণের ভোটে। এর আগে ১৯৮৬ সালে এরশাদীয় জমানায় যে সংসদ নির্বাচন হয়েছিল, তাতে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করলেও বিএনপি নির্বাচন বয়কট করায় ওই সংসদ টিকে থাকেনি। ১৯৮৮ সালের সংসদও টেকেনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অংশ না নেয়ার কারণে। এই দু’দলের অংশগ্রহণ থাকার কারণেই ৫ম সংসদ (১৯৯১), ৭ম সংসদ (১৯৯৬), ৮ম সংসদ (২০০১) ও ৯ম সংসদ (২০০৮) গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। কিন্তু বিএনপির অংশগ্রহণ না থাকায় ৫ জানুয়ারির (২০১৪) দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপি অনেক নমনীয় হয়েছে এবং তাদের আগের অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছে। বিএনপির পক্ষ থেকে দেয়া অনেকগুলো বক্তব্য বিশ্লেষণ করে আমার মনে হয়েছে, বিএনপি সরকারের সঙ্গে একটি ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে’ যেতে চায় এবং যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। বিএনপির নেত্রী ও বিএনপির মুখপাত্রের ৪টি বক্তব্য দুটি বড় দলের মাঝে একটি ‘বরফ গলা’র সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে বলে আমার ধারণা। এক. খালেদা জিয়া বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক নয় বরং একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে। এর অর্থ বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাকে এখন আর গুরুত্ব দিচ্ছে না আগের মতো। দুই. সৈয়দ আশরাফ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে বলেছিলেন, তিনি দলনিরপেক্ষভাবেই এই মন্ত্রণালয় পরিচালনা করবেন। বিএনপির মুখপাত্র এই বক্তব্যকে তখন স্বাগত জানিয়েছিলেন। তিন. ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগকে বিএনপি সমর্থন করেছিল এবং বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল- এই ইস্যুতে তারা সরকারকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। চার. বিএনপির পক্ষ থেকে ‘স্বাভাবিক রাজনীতি’ করার দাবি জানানো হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন একটা ধর-পাকড়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে না। বিএনপির মুখপাত্র নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং করছেন। এখন দেখার পালা, বিএনপিকে কাউন্সিল করতে সরকার দেয় কি-না।

ইতিমধ্যে ১৯ মার্চ বিএনপির কাউন্সিলের জন্য একটি তারিখ নির্ধারিত হয়েছে। কিন্তু ভেন্যুর ব্যাপারে বিএনপির নেতৃবৃন্দ এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। সোহরাওয়ার্দীতে নিরাপত্তার কারণে বিএনপি নিজেই করতে চাচ্ছে না। তারপরও একটি ভেন্যু নিশ্চয় বের করা যাবে। পুনর্গঠন দ্রুত শেষ করতে ১১টি কমিটি করা হয়েছে। তবে ২২ মার্চ থেকে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন শুরু হবে বিধায়, বিএনপির কাউন্সিল পিছিয়ে যেতে পারে। যদিও ইতিমধ্যে ২ মার্চের মধ্যে পুনর্গঠন কাজ শেষ করার জন্য জেলা ও মহানগর নেতাদের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে কেন্দ্র। কাউন্সিলের আগে অনেক ‘কাজ’ গোছাতে হবে বিএনপিকে। বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাদের বাদ দিয়ে স্থায়ী কমিটির পুনর্গঠন- এ কাজটি সহজ নয়। কাউকে বাদ দেয়াও ঝুঁকিপূর্ণ। বাদ দেয়া কেউ সরকারের ‘ট্র্যাপে’ পা দিতে পারেন। অনেক সিনিয়র নেতাকে নিয়ে নানা কথা আছে। কেউ কেউ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন- এমন অভিযোগ আছে। ফলে ‘কাজটি’ করা খালেদা জিয়ার জন্য সহজ হবে না। তবে বেশ কয়েকজন পরীক্ষিত নেতা আছেন, যাদের পদোন্নতি দরকার। স্থায়ী কমিটিতে অপেক্ষাকৃত তরুণদের স্থান দেয়া প্রয়োজন। উপদেষ্টা পরিষদের কাঠামোতে পরিবর্তন প্রয়োজন। ব্যক্তিবিশেষের দিকে তাকিয়ে নয়, বরং বিষয়ভিত্তিকভাবে ১০টি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা যেতে পারে, যা গঠিত হবে একেকজন বিশেষজ্ঞের নেতৃত্বে এবং যারা পার্টির চেয়ারম্যানকে সঠিক নীতি, রাজনীতি ও স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করতে সাহায্য করবেন। বর্তমানে যারা উপদেষ্টা পরিষদে আছেন, তাদের কাউকে কাউকে সাংগঠনিক কাঠামোয় স্থান দেয়া যেতে পারে। ২০৫০ সালকে সামনে রেখে বিএনপি কীভাবে বাংলাদেশকে দেখতে চায়, তার একটি রূপকল্প প্রণয়ন করাও জরুরি। মোদ্দাকথা বিএনপির কাউন্সিলটি ভালোয় ভালোয় অনুষ্ঠিত হোক। একটা ‘নয়া নেতৃত্ব’ বিএনপিকে নেতৃত্ব দিক, বোধকরি সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিএনপির কর্মীরাও এমনটি চান। Daily Jugantor 22/02.16

কত দূর যেতে পারবেন অং সান সু চি


কত দূর যেতে পারবেন অং সান সু চি? এ মুহূর্তে তিনি মিয়ানমারের অবিসংবাদিত নেত্রী। গণতন্ত্রের 'মানসকন্যা' হিসেবেও তাকে অভিহিত করা হয়। পশ্চিমা মিডিয়া জগতে তিনি অন্যতম আলোচিত ব্যক্তিত্ব। খুব দ্রুতই জানা যাবে তিনি আদৌ প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন কিনা। অনেক বাধা আছে। সে বাধাগুলো তাড়াতাড়ি কেটে যাবে কিনা, এ ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না কেউ। গেল ৯ নভেম্বর সেখানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন তিনি। তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ৪৯১ আসনের পার্লামেন্টে (উভয় পক্ষ) পেয়েছিল ৩৯০ আসন। সেনাবাহিনী মনোনয়ন দিয়েছে ১৬৬ আসন। সব মিলিয়ে আসন সংখ্যা ৬৬৪। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সংসদের উচ্চকক্ষ মনোনয়ন দেবে একজন, নিম্নকক্ষ দেবে একজন, আর সেনাবাহিনী দেবে একজন। ভোটাভুটিতে একজন বিজয়ী হবেন, বাকি দুজন নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে। অর্থাৎ কোনো প্রার্থীই সেই অর্থে পরাজিত হবেন না। সু চি প্রার্থী হলেও, সেনাবাহিনীর সমর্থন ছাড়া প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। উপরন্তু রয়েছে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। তার সন্তানদের বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ (ব্রিটিশ), আর একজন বিদেশিকে বিয়ে করা_ তার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথে প্রধান অন্তরায়। এ ক্ষেত্রে সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হলেও, সেনাবাহিনীর সমর্থন প্রয়োজন। সেনাবাহিনী নভেম্বরের নির্বাচন মেনে নিয়েছে সত্য, কিন্তু সু চিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মানবে কিনা, এ প্রশ্ন রয়ে গেছে। শেষ অবধি আন্তর্জাতিক তথা আঞ্চলিক চাপের মুখে সেনাবাহিনী আরো নমনীয় হলেও, সেনাবাহিনীর সঙ্গে সু চির সহাবস্থানটা কী হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তাই মিয়ানমারের বিকাশমান গণতন্ত্র আর সু চির ভূমিকা নিয়ে একটা প্রশ্ন রয়েই গেল। দ্রুত এটা স্পষ্ট হবে মিয়ানমারে সুচির ভূমিকা কী হবে আগামীতে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু থাকলেও ১৯৬২ সালের পর থেকেই সেনাবাহিনী রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই জেনারেল নে উইন পিএসপিপি সোশ্যালিস্ট পার্টি গঠন করেছিলেন। ঠিক একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় ১৯৮৮ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর। তখন গঠন করা হয়েছিল ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টি। এরই ধারাবাহিকতায় পরে গঠন করা হয়েছিল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি)। জেনারেল থেইন সেইন ২০১০ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে এ দলটির নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এখনো তিনি দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তবে সামরিক বাহিনী অত্যন্ত কৌশলে সু চিকে ক্ষমতার বাইরে রাখার ব্যাপারে সংবিধান প্রণয়ন করেছে। সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে ১৯৯৩ সাল থেকেই সামরিক জান্তা জাতীয় পর্যায়ে একটি জাতীয় কনভেনশনের আয়োজন করে আসছিল এবং ২০১০ সালের আগেই একটি সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। সংবিধান অনুযায়ী যিনি মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হবেন, তিনি কোনো বিদেশিকে বিয়ে করতে পারবেন না। এক নাগাদে ২০ বছরের ওপরে বিদেশে থাকলে প্রার্থী হতে যোগ্য হবেন না এবং যিনি প্রার্থী হবেন তার বাবা ও মাকে মিয়ানমারের জন্মগ্রহণকারী নাগরিক হতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী সু চি সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পেরেছেন বটে, কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হিসেবে যোগ্য বিবেচিত হবেন না। অবশ্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়েও কথা আছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনগণ ভোট দেয় না। সংসদ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে, যিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তৃতীয় বা দ্বিতীয় হন পরে তাদের (তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন) প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী রাজনীতিতে, বিশেষ করে সংসদীয় রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব বজায় রাখা হয়েছে, অনেকটা ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তো জমানার (১৯৬৬-১৯৯৮)। গোলকার মডেলের মতো। মিয়ানমারের পার্লামেন্ট দুই কক্ষবিশিষ্ট ঐড়ঁংব ড়ভ ৎবঢ়ৎবংবহঃধঃরাব (ঢ়ুরঃযঁ ঐষঁঃঃধ,ি নিম্নকক্ষ) ও ঐড়ঁংব ড়ভ ঘধঃরড়হধষরঃরবং (অসুড়ঃযধ ঐষঁঃঃধ,ি উচ্চকক্ষ)। নিম্নকক্ষের সদস্য সংখ্যা ৪৪০, যেখানে সেনা প্রতিনিধিত্ব রয়েছে ১১০ জন, যাদের নিয়োগ দেন সেনাপ্রধান। আর উচ্চকক্ষের সদস্য সংখ্যা ২২৪, যার মাঝে ৫৬ জন সেনাবাহিনীর। আগে বলা ভালো, অত্যন্ত ক্ষমতালিপ্সু জেনারেল থেইন সেইন ধীরে ধীরে ক্ষমতার শীর্ষে চলে এসেছেন। প্রথমে এসপিডিসির নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল থান সু। কিন্তু থান সুকে একসময় সরিয়ে দিয়ে থেইন সেইন চলে আসেন মূল ক্ষমতায়। ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন থেইন সেইন। পরে ২০১১ সালের ৩০ মার্চ থেকে তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও পালন করে আসছিলেন। ২০১২ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত হন। তিনি আবারো প্রার্থী হবেন কিনা, তা-ও এ মুহূর্তে নিশ্চিত নয়। তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয়। সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো। অং সান সু চির সঙ্গে তার যদি সহাবস্থান হয়, তাহলে আমি অবাক হব না। অং সান সু চি সংসদে তার কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলকে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী মনোনীত করতে পারেন। মোদ্দা কথা, সু চি নিজে অথবা যাকেই প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করেন না কেন, সেনা সমর্থন না থাকলে তিনি বিজয়ী হতে পারবেন না। এ জন্য আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে সেনা সমর্থন নিয়েই সু চি নির্বাচন করেছেন। মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী সেখানে এখন রষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা বিদ্যমান। রাষ্ট্রপতিই এখানে রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান। অর্থাৎ মূল ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে। এখানে সু চি নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন তাতে ক্ষমতার ভারসাম্যে আদৌ কোনো পরিবর্তন হবে না। এমনকি প্রধানমন্ত্রী হতে হলেও তাকে সেনাবাহিনীর সমর্থনের প্রয়োজন হবে। নিদেনপক্ষে নিম্নকক্ষের ১১০ সদস্যবিশিষ্ট সেনা সদস্যের সমর্থন এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। সেনাবাহিনী রাষ্ট্রযন্ত্রে সু চিকে কিভাবে আনবে, তা-ও স্পষ্ট নয়। ১৯৯০ সালের নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতির মতো পরিস্থিতিও সৃষ্টি হতে পারে। সু চি অনেক দিন ধরেই চাচ্ছেন সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটা সহাবস্থানে যেতে। যারা সু চির গত এক বছরের ভূমিকা ও বক্তব্য অনুধাবন করেছেন, তারা দেখবেন তিনি সেনাবাহিনীবিরোধী কোনো বক্তব্য দেননি। কিন্তু সেনা-আস্থা কতটুকু তিনি পেয়েছেন, তা নিশ্চিত নয়।
মিয়ানমারের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরাও একটি ফ্যাক্টর। সেনাবাহিনী এই উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। অন্যদিকে প্রচ- মুসলমানবিদ্বেষী ও উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীরা মা বা কা (অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য প্রটেকশন অব রেস অ্যান্ড রিলিজিয়ন) সংগঠনের ব্যানারে সংগঠিত হয়েছেন। তাদের সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য সু চি নির্বাচনে ১ হাজার ৭১১টি আসনের (সংসদের উভয় কক্ষ, ১৪টি রাজ্যের সংসদ ও বিভিন্ন অঞ্চল) একটিতেও কোনো মুসলমান প্রার্থী দেননি। সরকারি দল এসপিডিসিও কোনো মুসলমান প্রার্থী দেয়নি। এমনকি নির্বাচনের আগে সু চি রাখাইন স্টেট সফরে গিয়েছিলেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের সমর্থনে তিনি সেখানে কোনো বক্তব্য দেননি। সিরিয়াস পাঠকরা লক্ষ্য করে থাকবেন ২০১২ সালের পর থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপকতা পেলে এবং শত শত রোহিঙ্গার নৌকাযোগে মালয়েশিয়া যাওয়ার ব্যাপারেও সু চির কোনো বক্তব্য নেই। মিয়ানমারের বর্তমান সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিচ্ছে না। মিয়ানমার সরকার মনে করে রোহিঙ্গারা মূলত বাংলাদেশের নাগরিক! অথচ ইতিহাস বলে শত বছর ধরেই রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছেন। উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা মিয়ানমারকে একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাচ্ছেন। সু চি এ প্রক্রিয়ার পুরোপুরি বাইরে নন। তিনি জানেন ক্ষমতা পেতে হলে তার উগ্র বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। তাই উগ্রপন্থীরা যখন মুসলমানদের হত্যা করছে, তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের বাধ্য করছে বাংলাদেশে 'পুশ ইন' করতে তখন তিনি নিশ্চুপ। মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারেও তার কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তিনি যে স্ট্রাটেজি গ্রহণ করছেন, তা সুবিধাবাদিতায় ভরা। সর্বজনগ্রহণযোগ্য একজন নেত্রী তিনি_ এ কথাটা বলা যাবে না। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নির্বাচনের আগে একদিকে তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক ধরনের 'সহাবস্থানে' গেছেন, অন্যদিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ থেকে উগ্র বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের অবস্থানকেই সমর্থন করেছেন। এতে তিনি 'বিজয়ী' হয়েছেন এটা সত্য। কিন্তু সর্বজনগ্রহণযোগ্য একটি সমাজব্যবস্থা সেখানে কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হবে, সে প্রশ্ন থাকলই। তিনি যদি কঠোর অবস্থানে যান এবং ক্ষমতা পরিচালনা করতে চান, তাহলে তা সামরিক অভ্যুত্থানে সেনাবাহিনীর জেনারেলদের প্ররোচিত করতে পারে। তিনি রিয়েল পলিটিকসের পরিচয় দেবেন, এটাই সবাই প্রত্যাশা করে। এই মুহূর্তে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে জাতীয় ঐক্য দৃঢ় করা, গণতন্ত্রকে সংহত করা ও শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করা। অনেকটা ইন্দোনেশিয়ায় সুহার্তো-পরবর্তী মডেল তিনি অনুসরণ করতে পারেন। সেখানে সেনাবাহিনী এখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় 'কমিটেড'। একই সঙ্গে তিনি প্রেসিডেন্টের পদটিকে একটি 'নিয়মতান্ত্রিক পদে' পরিণত করতে পারেন। সাংবিধানিকভাবে এটাও এখন সম্ভব নয়। সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হলে সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়েই তা করতে হবে। কিন্তু বিষয়টি অত সহজ নয়। সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরেই যে লিখিত সুবিধা ভোগ করে আসছে তা ছেড়ে দেবে, এটাও মনে হয় না।
মিয়ানমারে একটি গণতান্ত্রিক সরকার আমাদের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় রাষ্ট্রই বিসিআইএম ও বিবিআইএমএস টেকজোটের সদস্য। বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির জন্য এ দুটো জোটের গুরুত্ব অনেক বেশি। যদিও সেখানে দীর্ঘ সেনাশাসন থাকায়, দুই দেশের মাঝে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়নি। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য মিয়ানমারে রপ্তানি করে আমদানি করে তার চেয়ে বেশি। ২০০৫-০৬ সালে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছিল ৫ দশমিক ১৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য (২০১২-১৩ সালে এর পরিমাণ ১৩ দশমিক ৬৭ মিলিয়ন), আর আমদানি করেছিল ২৯ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য (২০১২-১৩ সালে এর পরিমাণ ৮৪ মিলিয়ন)। অথচ বিশাল এক সম্ভাবনার দেশ মিয়ানমার। বাংলাদেশের জ্বালানির অন্যতম উৎস হতে পারে মিয়ানমার। সুতরাং একটি গণতান্ত্রিক সরকার সম্ভাবনার অনেক দুয়ার খুলতে পারে।
এখন অনেক কিছুই নির্ভর করছে সু চির ওপর। 'রিয়েল পলিটিকস' নাকি সরাসরি সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিবাদ_ কোনটা বেছে নেবেন সু চি? দীর্ঘ ১৫ বছর তিনি অন্তরীণ ছিলেন। তিনি জানেন সেনাবাহিনী মিয়ানমারে কত শক্তিশালী। ক্ষমতা পেতে হলে সেনাবাহিনীকে আস্থায় নেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তার সম্মুখে মিসরের দৃষ্টান্ত আছে। সাময়িকভাবে সেখানে ড. মুরসিকে ক্ষমতা দিয়েছিল সেনাবাহিনী। সুযোগ বুঝে তারা আবার সে ক্ষমতাও নিয়ে নিয়েছে। সুতরাং 'বিচক্ষণ' সু চি কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নেবেন না।
সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিবাদে গিয়ে তার তেমন কোনো লাভ হবে না। ক্ষমতা পেতে তিনি স্বামীকে হারিয়েছেন। স্বামীর মৃতদেহ দেখতেও তিনি পারেননি। দুই ছেলে ব্রিটেনে, তাদের সঙ্গেও তেমন একটা যোগাযোগ নেই। ফলে সুচির আগামী দিনগুলো সত্যিকার অর্থেই লক্ষ্য রাখার বিষয়। আপাতত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তার পরই আমরা বুঝতে পারব ইতিহাসে কিভাবে চিহ্নিত হবেন অং সান সু চি।
daily Jai Jai Din18.02,16

কোরীয় উপদ্বীপে নতুন করে উত্তেজনা

গত ৭ ফেব্রুয়ারি উত্তর কোরিয়ার দূরপাল্লার রকেট উেক্ষপণের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে এ অঞ্চলে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ জরুরিভাবে একটি সভায় মিলিত হয়ে এর নিন্দা ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেখানে মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে (যা Thaad নামে পরিচিত) দক্ষিণ কোরিয়াকে আলোচনার প্রস্তাব করেছে। জাপান বলেছে উত্তর কোরিয়ার এই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের নিষেধাজ্ঞার লঙ্ঘন। এ ঘটনা উত্তর কোরিয়াকে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ এবং দুই কোরিয়ার একত্রীকরণ প্রশ্নটিকে বাধাগ্রস্ত করবে। ১৯৯০ সালের পর থেকেই বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ছিল দুই কোরিয়ার একত্রীকরণের দিকে। এখানে সমস্যা হচ্ছে—একত্রীকরণের পর কোরিয়ার সমাজব্যবস্থা কী হবে? পুঁজিবাদী সমাজ নাকি সমাজতান্ত্রিক সমাজ? জার্মানিতে এখন আর সমাজতান্ত্রিক সমাজ নেই। পূর্ব জার্মানি পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে মিশে গিয়ে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা গ্রহণ করেছে অনেক আগেই। চীনেও আজ ধ্রুপদী মার্ক্সবাদ নেই। চীনের সঙ্গে হংকং অনেক আগেই একীভূত হয়েছে হংকংয়ের পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা বজায় রেখেই। যে ব্যবস্থাকে চীন বলছে ‘এক দেশ দুই অর্থনীতি’। তেং শিয়াও পিং ছিলেন এই ধারণার প্রবক্তা। চীন তাইওয়ানের ক্ষেত্রেও একই নীতি অবলম্বন করছে। তাইওয়ান হংকং মডেল অনুসরণ করে চীনের সঙ্গে একীভূত হতে পারে। কোরিয়ার ক্ষেত্রে এই হংকং মডেল একটি সমাধান হতে পারে। ভবিষ্যতই বলে দেবে দুই কোরিয়া এক হবে কি না।
বেশ কিছুদিন কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা নেই। দক্ষিণ কোরিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন ইয়ংপিয়ং দ্বীপে উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনীর গোলাবর্ষণ (২০১০ সালের ২৩ নভেম্বর) ও তাতে দুই সৈনিকের মৃত্যু এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনী প্রধানের পদত্যাগের পর কিছুদিন উত্তেজনা সেখানে বজায় ছিল। ওই সময় একটি যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি সেখানে বিরাজ করছিল। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণে ছয় জাতির আলোচনাও কার্যত ব্যর্থ। উত্তর কোরিয়াকে কোনোভাবেই আলোচনার টেবিলে আনা যাচ্ছে না। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র এখন তিন জাতি (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া) আলোচনায় উৎসাহী। কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক প্রধান অ্যাডমিরাল মাইক মুলেন ছুটে গিয়েছিলেন জাপানে। তিনি সেখানে তিন জাতিভিত্তিক একটি ‘প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ গড়ে তোলার কথাও বলেছিলেন। চীনের একজন সিনিয়র কূটনীতিকও ওই সময় পিয়ংইয়ং সফর করেছিলেন। এতে করে উত্তেজনা সাময়িকভাবে হ্রাস পেয়েছিল সত্য, কিন্তু তা স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে যে এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ২০০৬ সালের অক্টোবরে উত্তর কোরিয়া কর্তৃক পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর থেকেই দেশটি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে। পারমাণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের মধ্য দিয়েই উত্তর কোরিয়া বিশ্বে অষ্টম পারমাণবিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এরপর থেকেই উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে এ অঞ্চলের, বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের আতঙ্ক বাড়তে থাকে। এরপর থেকেই আলোচনা শুরু হয় কিভাবে উত্তর কোরিয়াকে পরমাণুমুক্ত করা সম্ভব। একপর্যায়ে চীনের উদ্যোগে ২০০৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি উত্তর কোরিয়া একটি চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী উত্তর কোরিয়া অবিলম্বে তার ইয়ংবাইয়নের (Yongbyon) পারমাণবিক চুল্লিটি বন্ধ করে দেয়, যেখানে পশ্চিমা বিশ্বের ধারণা উত্তর কোরিয়া ছয় থেকে ১০টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারত। চুক্তির শর্তানুযায়ী উত্তর কোরিয়া ৬০ দিনের মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের তার পারমাণবিক চুল্লিগুলো পরিদর্শনেরও সুযোগ করে দেয়। বিনিময়ে উত্তর কোরিয়াকে ৫০ হাজার টন জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়। এরপর ২০০৭ সালের অক্টোবরে দুই কোরিয়ার মধ্যে একটি শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বোহ মু হিউম ২ অক্টোবর উত্তর কোরিয়া যান এবং সেখানে উত্তর কোরিয়ার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট কিম জং ইলের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক করেন। এটা ছিল দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে দ্বিতীয় শীর্ষ বৈঠক। এর আগে ২০০০ সালের ১২ জুন দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানরা প্রথমবারের মতো একটি শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। কোরিয়া বিভক্তকারী অসামরিক গ্রাম পানমুনজমে সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম দাই জং মিলিত হয়েছিলেন উত্তর কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম জং ইলের সঙ্গে। এ অঞ্চলের গত ৫৩ বছরের রাজনীতিতে ওই ঘটনা ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এর আগে আর দুই কোরিয়ার নেতারা কোনো শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হননি। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থা ও দুই জার্মানির একত্রীকরণের (১৯৯০) পর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি এখন কোরীয় উপদ্বীপের দিকে। সেই থেকে দুই কোরিয়ার পুনরেকত্রীকরণের সম্ভাবনাও দেখাচ্ছেন অনেকে। অনেকেরই মনে থাকার কথা, ২০০০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম দাই জংকে দুই কোরিয়ার পুনরেকত্রীকরণের অব্যাহত প্রচেষ্টার জন্য নোবেল শাস্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।
কোরিয়া একটি বিভক্ত সমাজ। দুই কোরিয়ায় দুই ধরনের সমাজব্যবস্থা চালু রয়েছে। উত্তর কোরিয়ায় সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা চালু রয়েছে। আর দক্ষিণ কোরিয়ায় রয়েছে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা। এক লাখ ২০ হাজার ৫৩৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট উত্তর কোরিয়ার লোকসংখ্যা মাত্র দুই কোটি ২৫ লাখ। আর ৯৯ হাজার ২২২ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট দক্ষিণ কোরিয়ার লোকসংখ্যা চার কোটি ২৮ লাখ। এক সময় যুক্ত কোরিয়া চীন ও জাপানের উপনিবেশ ছিল। ১৯০৪-০৫ সালে রাশিয়া ও জাপানের মধ্যকার যুদ্ধের পর কোরিয়া প্রকৃতপক্ষে জাপানের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়। ১৯১০ সালের ২৯ আগস্ট জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে কোরিয়াকে সাম্রাজ্যভুক্ত করে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর মার্কিন ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনাবাহিনী কোরিয়ায় ঢুকে পড়ে ও জাপানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য কৌশলগত কারণে কোরিয়াকে দুই ভাগ করে। এক অংশে মার্কিন বাহিনী ও অন্য অংশে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাহিনী অবস্থান নেয়।  সোভিয়েত বাহিনীর উপস্থিতিতেই কোরিয়ার উত্তরাঞ্চলে (আজকের যা উত্তর কোরিয়া) একটি কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৬ সালে নিউ ন্যাশনাল পার্টির সঙ্গে নবগঠিত কোরিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি একীভূত হয়ে কোরিয়ান ওয়ার্কার্স পার্টি গঠন করে। জাতিসংঘের আহ্বানে সেখানে নির্বাচনের আয়োজন করা হলেও দেখা গেল নির্বাচন শুধু দক্ষিণ কোরিয়াতেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর উত্তর কোরিয়া একটি আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে তার অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করে। ১৯৫০ সালের ২৫ জুন উত্তর কোরিয়ার বাহিনী ৩৮তম সমান্তরাল রেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবেশ করলে যুদ্ধ বেধে যায়। জাতিসংঘ এই যুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়াকে সমর্থন করার জন্য সব রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানায়। জাতিসংঘ বাহিনী মাঞ্চুরিয়া সীমান্তে উপস্থিত হলে ১৯৫০ সালের ২৬ নভেম্বর চীন উত্তর কোরিয়ার পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং চীনা সৈন্যরা দক্ষিণ কোরিয়ার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। ১৯৫১ সালের এপ্রিলে জাতিসংঘ বাহিনী ৩৮তম সমান্তরাল রেখা পুনরুদ্ধার করে। ১৯৫১ সালের ২৩ জুন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়। কিন্তু যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব কার্যকর হয় দুই বছর পর ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই। এরপর থেকে কার্যত উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া দুটি রাষ্ট্র হিসেবে তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখে আসছে। ১৯৫৩ সালে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি বলে দক্ষিণ কোরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকলেও উত্তর কোরিয়ায় কোনো চীনা সৈন্য নেই। উত্তর কোরিয়া চীনের সঙ্গে ১৯৬১ সালে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। গত ৬৪ বছরে দক্ষিণ কোরিয়ায় একাধিক সরকার গঠিত হলেও উত্তর কোরিয়ায় ক্ষমতার পট পরিবর্তন হয়েছে দুইবার। ১৯৯৪ সালে কিম উল সুংয়ের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র কিম জং ইল ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। দীর্ঘদিন কিম জং ইল অসুস্থ ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর এখন তাঁর ছোট ছেলে কিম জং উনকে সেখানে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি যদি দায়িত্ব পালনকালে দুই কোরিয়ার একত্রীকরণের উদ্যোগ নেন, সেটা হবে একুশ শতকের শুরুতে একটি বড় ধরনের ঘটনা। তবে যেকোনো মুহূর্তে উত্তেজনা সেখানে ছড়িয়ে পড়তে পারে। উত্তর কোরিয়া তাদের প্রধান পরমাণু স্থাপনা ছাড়াও গোপনে আরো কয়েকটি স্থাপনায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে বলে দক্ষিণ কোরিয়া অভিযোগ করেছে। একই সঙ্গে বিশ্ববাসীর প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে উত্তর কোরিয়া আরো পরমাণু পরীক্ষা চালানোর পরিকল্পনাও করছে। এ জন্য তারা সুড়ঙ্গ খুঁড়ছে। এ হারে সুড়ঙ্গ খোঁড়া হলে আগামী (২০১৬) মে মাস নাগাদ প্রয়োজনীয় এক হাজার মিটার সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ শেষ হবে। এর অর্থ হচ্ছে—উত্তর কোরিয়া আরেকটি পারমাণবিক পরীক্ষা চালাতে পারে। এতে করে কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না। যুদ্ধ হবে কি না বলা মুশকিল। কেননা, উত্তর কোরিয়া যেখানে বড় ধরনের খাদ্য সংকটের মুখে, সেখানে তারা এত বড় ঝুঁকি নেবে না। উত্তেজনা জিইয়ে রেখে তারা সুবিধা আদায় করে নিতে চায়। এরই মধ্যে উত্তর কোরিয়া সেখানে একটি হাইড্রোজেন বোমারও বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।
এই মুহূর্তে উত্তর কোরিয়ার বড় বন্ধু চীন। চীন যদি তার সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে উত্তর কোরিয়া ‘একা’ হয়ে পড়বে। তখন আলোচনায় যাওয়া ছাড়া তার কোনো বিকল্প থাকবে না। উত্তর কোরিয়া বারবার বলে আসছে তার পারমাণবিক কর্মসূচির উদ্দেশ্য হচ্ছে বিদ্যুৎ উত্পাদন। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব এবং দক্ষিণ কোরিয়া এ কথায় বিশ্বাস রাখতে পারছে না। অতীতে যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার জ্বালানি সংকটের সমাধানের সাময়িক উদ্যোগ নিলেও এই সংকটের স্থায়ী সমাধান হয়নি। উত্তর কোরিয়া তার জ্বালানি সংকটের স্থায়ী সমাধানের আশ্বাস পেলে দেশটি তার পারমাণবিক কর্মসূচি পরিত্যাগ করতে পারে। তবে একটা মূল প্রশ্নের সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয়। আর তা হচ্ছে—দুই কোরিয়ার একত্রীকরণ। ভবিষ্যতে সব আলোচনাই কেন্দ্রীভূত হবে একত্রীকরণের লক্ষ্যে। তবে এটাও সত্য, একত্রীকরণের প্রশ্নটি যত সহজ ভাবা হচ্ছে, অত সহজ নয়। উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি এখনো সমাজ ও সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং সেখানে অভ্যুত্থান কিংবা ক্ষমতাসীন পার্টিকে উত্খাত করার সম্ভাবনা কম।
এখন নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানোর ফলে দুই কোরিয়ার মধ্যে একত্রীকরণ প্রশ্নে আলোচনার সম্ভাবনা ক্ষীণ। যদিও উত্তর কোরিয়া এই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষাকে বলছে পৃথিবী পর্যবেক্ষণের জন্য এটি একটি স্যাটেলাইট। কুয়াংমিয়ংসং-৪ নামের ওই স্যাটেলাইটটি উেক্ষপণের ১০ মিনিটের মধ্যে কক্ষপথে স্থাপিত হয়েছে বলেও জানিয়েছে উত্তর কোরিয়া। এটি আসলে স্যাটেলাইট নাকি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র—এ নিয়ে দ্বিমত থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে উত্তর কোরিয়া দূরপাল্লার রকেট নিক্ষেপের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। ক্ষেপণাস্ত্রটি জাপানের দক্ষিণ অংশের ওকিনাওয়া দ্বীপের ওপর দিয়ে অতিক্রম করায় জাপানের নিরাপত্তা আজ হুমকির মুখে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলের নিরাপত্তাও হুমকির মুখে থাকল। উত্তর কোরিয়ার দূরপাল্লার রকেট উেক্ষপণের এই ঘটনা এখন এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়াবে। এবং যুক্তরাষ্ট্রকে এ অঞ্চলের ‘রাজনীতিতে’ জড়িয়ে পড়তে উৎসাহ জোগাবে। ফলে পুনরেত্রীকরণের সম্ভাবনা এখন আরো অনিশ্চিত হয়ে উঠল। Daily Kalerkontho 17.02.16

কোন পথে মিয়ানমার

আগামী ১৭ ফেব্রুয়ারি জানা যাবে কে হতে যাচ্ছেন মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এমন মন্তব্যও করা হয়েছে যে, সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতায় গিয়েই অং সান সু চি মিয়ানমারের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন! কিন্তু বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয়Ñ কেননা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে সু চির প্রেসিডেন্ট না হওয়ারই কথা। মিয়ানমারের সংসদ দুই  কক্ষবিশিষ্ট। এই দুই কক্ষ থেকে দুজনকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন দেওয়া হবে। এরপর সেনাবাহিনী একজনকে মনোনয়ন দেবে। দুপক্ষের যৌথ অধিবেশনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। বাকি দুজন প্রার্থী ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ পাবেন। উভয়পক্ষের মোট আসন ৬৫৪। নির্বাচিত সংসদ সদস্যের সংখ্যা ৪৯১। এর বাইরে সেনাবাহিনী মনোনয়ন দিয়েছে ১৫৬ জনকে। নির্বাচনে সু চির দল এনএলডি বিজয়ী হয়েছে ৩৯০ আসনে। সেনাবাহিনী সমর্থিত দল ইউএসডিপি পেয়েছে মাত্র ৪১ আসন। এতে বোঝা যায়, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সু চিকে বিজয়ী হতে হলে ১৬৬ জন সেনা সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন এখানেইÑ সেনাবাহিনী কোন ‘স্বার্থের’ বিনিময়ে সু চিকে সমর্থন করবে? ১৯৬২ সালে প্রথম সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকেই সেনাবাহিনী মিয়ানমারের সমাজব্যবস্থায় অন্যতম একটি শক্তি। এখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেনাবাহিনীর স্বার্থে আঘাত করলে, তা হিতে বিপরীত হতে পারে। সেনাবাহিনী তাদের করপোরেট স্বার্থ বিসর্জন দেবে, এটা মনে হয় না। মিয়ানমারে সাম্প্রতিককালে একটি উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জন্ম হয়েছে। সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে প্রমোট করছে। উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরা মা বা থা অথবা ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য প্রটেকশন অব রেস অ্যান্ড রিলিজিয়ন’ নামক একটি সংগঠনের ব্যাপারে সংগঠিত হয়েছে। একজন ‘বার্মিজ বিন লাদেন’ ভিরাথুর কথাও ছাপা হয়েছিল বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনে ২০১৩ সালের ১ জুলাই। ভিরাথু মিয়ানমার থেকে সব মুসলমানের উচ্ছেদ চান। অং সান সু চি বরাবরই এদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে রাজনীতি করে গেছেন। এখন দেখতে হবে উগ্রপন্থীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়। বর্তমান প্রেসিডেন্ট সেই নির্বাচনের আগে ৮টি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি করেছিলেন। কিন্তু আরও ৭টি সংগঠন রয়ে গেছে। এখন দেখতে হবে সু চির ব্যাপারে এদের দৃষ্টিভঙ্গি কী? কিন্তু রোহিঙ্গাদের নিয়ে বড় সমস্যা রয়েই গেল। সু চি কখনো রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের প্রশ্নটিকে বড় করে দেখেননি। এমনকি সেনাবাহিনী যেখানে মনে করে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়, সু চি এই বক্তব্যের কখনো সমালোচনা করেননি। রোহিঙ্গা ইস্যু এবং সেই সঙ্গে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি করে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক এখন নানা জটিলতায় আক্রান্ত। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে যে সমস্যা ছিল, তা রয়ে গেছে। কক্সবাজারে অবৈধভাবে প্রবেশ করা হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানকে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ফিরিয়ে নিচ্ছে না। উপরন্তু প্রায়ই সীমান্তে গুলিবর্ষণ ও অপহরণের ঘটনা ঘটিয়ে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী সীমান্তে উত্তেজনা জিইয়ে রাখছে। সি চি নির্বাচনের আগে এই রোহিঙ্গা প্রশ্নে কোনো বক্তব্য দেননি। তার উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কারÑ তিনি উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও সেই সঙ্গে সেনাবাহিনীর আস্থা অর্জন করতে চেয়েছেন। বলা ভালো, সেনাবাহিনী এই উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করে আসছে। সু চি নিজেও এই প্রক্রিয়ায় নিজেকে সম্পর্কিত করেছিলেন। এদের সমর্থন পেতে সু চি নির্বাচনে মোট ১৭১১ আসনের (সংসদের উভয় কক্ষ, ১৪টি রাজ্যের সংসদ ও বিভিন্ন অঞ্চল) একটিতেও কোনো মুসলমান প্রার্থী দেননি। সরকারি দল এসপিডিসিও কোনো মুসলমান প্রার্থী দেয়নি। এমনকি নির্বাচনের আগে সু চি রাখাইন স্টেট সফরে গিয়েছিলেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে তিনি সেখানে কোনো বক্তব্য দেননি। সিরিয়াস পাঠকরা লক্ষ করে থাকবেন ২০১২ সালের পর থেকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপকতা পেলে এবং শত শত রোহিঙ্গাকে নৌকাযোগে মালয়েশিয়া যাওয়ার ব্যাপারেও সু চির কোনো বক্তব্য নেই। মিয়ানমারের বর্তমান সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিচ্ছে না। মিয়ানমার সরকার মনে করে রোহিঙ্গারা মূলত বাংলাদেশের নাগরিক! অথচ ইতিহাস বলে শত বছর ধরেই রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছে। উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা মিয়ানমারকে একটি বৌদ্ধরাষ্ট্রে পরিণত করতে চাচ্ছে। সু চি এই প্রক্রিয়ার পুরোপুরি বাইরে নন। তিনি জানেন ক্ষমতা পেতে হলে তার উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। তাই উগ্রপন্থীরা যখন মুসলমানদের হত্যা করছে, তাদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের বাধ্য করছে বাংলাদেশে ‘পুশইন’ করতে, তখন তিনি নিশ্চুপ। মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারেও তার কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তিনি যে স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেছেন, তা সুবিধাবাদিতায় ভরা। সর্বজন গ্রহণযোগ্য একজন নেত্রী তিনি, এ কথাটা বলা যাবে না। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নির্বাচনের আগে একদিকে তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক ধরনের ‘সহাবস্থানে’ গেছেন, অন্যদিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের পক্ষে নিশ্চুপ থেকে তিনি উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের আস্থাকেই সমর্থন করেছেন। এতে করে তিনি ‘বিজয়ী’ হয়েছেন, এটা সত্য। কিন্তু সর্বজন গ্রহণযোগ্য একটি সমাজব্যবস্থা সেখানে কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হবে, সে প্রশ্ন থাকলই।
এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে সেনাবাহিনীর ভূমিকা, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ও সাবেক সেনাপ্রধান থেইন সেইনের ভূমিকা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। ১৯৯০ সালের মতো এবারে নির্বাচন বাতিল করার কোনো উদ্যোগ তিনি নেননি। কেননা তিনি জানেন নির্বাচন বাতিল করা পশ্চিমা বিশ্বে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গ্রহণযোগ্য হবে না। আশিয়ানের নেতৃবৃন্দও এটা মানবে না। ফলে একটি ‘বড় ধরনের ঝুঁকি এড়াতেই’ জেনারেল থেইন সেইন এই নির্বাচনটা মেনে নিয়েছেন। সারা বিশ্বই এখন সাংবিধানিক পথে যাচ্ছে, নির্বাচনের পথে যাচ্ছে। এক সময় যে ইন্দোনেশিয়ায় সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব ছিল রাজনীতি প্রশাসনে সর্বত্র, সুহার্তো-পরবর্তী সেই ইন্দোনেশিয়া এখন ধীরে ধীরে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ফলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীও ধীরে ধীরে নিজেদের বদলে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে। এর প্রথম প্রকাশ হিসেবেই তারা সাধারণ নির্বাচনকে মেনে নিয়েছে। তবে ধারণা করছি অং সান সু চির সঙ্গে তাদের পরোক্ষ একটা ‘সমঝোতা’ হয়েছে। সু চি বর্তমান সংবিধানকে মেনে নেবেন। এই মুহূর্তে সংবিধান সংশোধনের কোনো উদ্যোগ তিনি নেবেন না। এমনকি মানবাধিকার সংস্থার অভিযোগে কোনো জেনারেলকে তিনি বিচারের মুখোমুখিও দাঁড় করাবেন না। এক ধরনের ‘স্ট্যাটাস বো’ তিনি মেনে নেবেন। তবে একটা প্রশ্ন থাকলইÑ নতুন সরকারে তিনি কী আদৌ প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন? এ ক্ষেত্রে সংবিধানের যে বাধ্যবাধকতা ছিল তা কী কোনো ডিক্রিবলে স্থগিত করা হবে? সু চি ইতোমধ্যে সাবেক একজন জেনারেলকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিয়েছেন, তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে পর্দার অন্তরালে দেনদরবারে লিপ্ত রয়েছেন। তিনি কি একটি সমঝোতায় গেছেন? তাহলে সমঝোতাটা কী? কিংবা সেনাবাহিনীর কর্তৃত্বই বা থাকবে কীভাবে? পুলিশপ্রধান, সেনাপ্রধান, সীমান্তরক্ষা ব্যবস্থাপনা তথা মন্ত্রণালয়ের ব্যাপারে সেনাবাহিনীর যে ভূমিকা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত, এ ব্যাপারে সু চি কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করবেন না। বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল লাইইন সম্পর্কেও তার কোনো রিজার্ভেশন নেই। তিনি তাকে আস্থায় নিয়েই সরকার পরিচালনা করবেন! সু চি সংসদীয় সরকার পদ্ধতিতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেও এই মুহূর্তে তা তিনি পারবেন বলে মনে হয় না। নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার আগেই তিনি বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে যে ভাষায় কথা বলেছেন, তা একটা শঙ্কারও জন্ম দিয়েছে। তিনি বলেছেন, পার্লামেন্টে সেনাবাহিনীর ৫ শতাংশ আসন প্রথা বিলুপ্ত হবেই। তিনি গণতান্ত্রিক সমাজের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, সেনাবাহিনীর জন্য আসন থাকা গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার পরিপন্থী। কথাটা তিনি মিথ্যা বলেননি।  কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মিয়ানমার কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট নয়। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি যদি এই ‘কোটা’ পদ্ধতি বাতিল করার এখনই উদ্যোগ নেন, তাহলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তিনি বিতর্কে জড়িয়ে যাবেন, যা কিনা পুনরায় সামরিক অভ্যুত্থানে সেনাবাহিনীর জেনারেলদের প্ররোচিত করতে পারে। তিনি ‘রিয়েল পলিটিকস’-এর পরিচয় দেবেন, এটাই সবাই প্রত্যাশা করে। এই মুহূর্তে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে জাতীয় ঐক্য দৃঢ় করা, গণতন্ত্রকে সংহত করা ও শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করা। অনেকটা ইন্দোনেশিয়ায় সুহার্তো-পরবর্তী মডেল তিনি অনুসরণ করতে পারেন, যেখানে সেনাবাহিনী এখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ‘কমিটেড’। একই সঙ্গে তিনি প্রেসিডেন্টের পদটিকে একটি ‘নিয়মতান্ত্রিক পদে’ পরিণত করতে চান। সাংবিধানিকভাবে এটাও এখন সম্ভব নয়। সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হলে সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়েই তা করতে হবে। কিন্তু বিষয়টি অত সহজ নয়। সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরেই যে লিখিত সুবিধা ভোগ করে আসছে, তা ছেড়ে দেবে এটাও মনে হয় না।
মিয়ানমারে একটি গণতান্ত্রিক সরকার আমাদের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় রাষ্ট্রই বিসিআইএম ও বিবিআইএমএস-টেকজোটের সদস্য। বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির জন্য এই দুটো জোটের গুরুত্ব অনেক বেশি। যদিও সেখানে দীর্ঘ সেনাশাসন থাকায়, দুদেশের মাঝে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়নি। পরিসখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য মিয়ানমারে রপ্তানি করে, আমদানি করে তার চেয়ে বেশি। ২০০৫-০৬ সালে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছিল ৫ দশমিক ১৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য (২০১২-১৩ সালে এর পরিমাণ ১৩ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন), আর আমদানি করেছিল ২৯ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য (২০১২-২০১৩ সালে এর পরিমাণ ৮৪ মিলিয়ন)। অথচ বিশাল এক সম্ভাবনার দেশ মিয়ানমার। বাংলাদেশের জ্বালানি  সুবিধার অন্যতম উৎস হতে পারে মিয়ানমার। সুতরাং একটি গণতান্ত্রিক সরকার সম্ভাবনার অনেক দুয়ার খুলতে পারে।
প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন নির্বাচনে এনএলডির বিজয়কে স্বাগত জানালেও সু চির একটি বক্তব্যে একটি আশঙ্কারও জন্ম হয়েছিল। সিঙ্গাপুরভিত্তিক চ্যানেল এশিয়ার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন, প্রেসিডেন্ট কে।’ তিনি এ কথাও বলেছেন, সংবিধান যদি তাকে সরকারের নেতৃত্ব দিতে বাধা সৃষ্টি করে, তাহলে একটি ‘পথ’ বের করতেই হবে, যাতে তিনি সরকারের নেতৃত্ব দিতে পারেন। সমস্যাটা এখানেই তৈরি হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রপ্রধান ও ক্যাবিনেটেরও প্রধান। সংবিধান পরিবর্তন না করলে সু চির পক্ষে ক্যাবিনেটের নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব নয়। আর সংবিধান সংশোধন করাও এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে বাস্তবমুখী একটি সিদ্ধান্ত তিনি নেবেনÑ এ প্রত্যাশা সবার। কেননা সেনাবাহিনীর সঙ্গে এই মুহূর্তে তিনি যদি কোনো ‘সংঘর্ষে’ও জড়িয়ে যান, তা বিকাশমান মিয়ানমারের গণতন্ত্রের জন্য কোনো ভালো খবর বয়ে আনবে না। তাই ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। নিম্নকক্ষ সু চিকে এখন মনোনয়ন (প্রেসিডেন্ট পদে) দেয় কিনা, সেটাই দেখার বিষয়। Daily Amader Somoy 14.02.16

বিচার বিভাগ নিয়ে কেন এই অনাহূত বিতর্ক?

তিনি সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতি। গেল অক্টোবরে তিনি অবসরে যান। কিন্তু তিনি ইতিমধ্যে বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে তার নানা বিরূপ মন্তব্য একাধিকবার সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছে। প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে তিনি বিতর্কের জন্ম দিয়েও ক্ষান্ত হননি, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রধান বিচারপতির ‘ভূমিকা’ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কি প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতে পারেন! অ্যাটর্নি জেনারেল তাই স্পষ্ট করেই বলেছেন, অবসরে যাওয়া ওই বিচারপতির এ ধরনের মন্তব্যে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা যে নজিরবিহীন, তা সংবাদকর্মীদের জানাতেও তিনি ভোলেননি। আমি অ্যাটর্নি জেনারেলকে সাধুবাদ জানাই তার স্পষ্ট বক্তব্যের জন্য।

বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত একজন ব্যক্তিত্ব। আপিল বিভাগে থাকার সময়ও তিনি আলোচিত ছিলেন নানা কারণে। তিনি সম্ভবত ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী এবং এক সময় লন্ডনে আইন পেশায়ও নিয়োজিত ছিলেন। এবং স্মরণ করছি, লন্ডন থাকাকালীন আমার সঙ্গে তার একবার দেখাও হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে কখনও তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। নিঃসন্দেহে একজন ‘সাহসী’ বিচারপতি তিনি। অনেক রায় তিনি দিয়েছেন, যা তাকে আলোচনায় এনেছে বারবার।

বিতর্কের সূত্রপাত হয় প্রধান বিচারপতির একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। গত ১৯ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি পদে দায়িত্ব নেয়ার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে দেয়া এক বাণীতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছিলেন, ‘কোনো কোনো বিচারপতি অবসর গ্রহণ করার দীর্ঘদিন পর রায় লেখা অব্যাহত রাখেন, যা আইন ও সংবিধানপরিপন্থী।’ এর বিরোধিতা করেন আপিল বিভাগ থেকে অবসরে যাওয়া বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। ঘটনাটা এখানেই শেষ হতে পারত। অথবা তিনি প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য না রেখে তার কাছে যে রায়গুলো লেখা বাকি ছিল, তা জমা দিতে পারতেন। এতে করে সাধারণ মানুষ এতকিছু জানত না। কিন্তু বিষয়টিকে তিনি প্রকাশ্যে নিয়ে এলেন। শুধু তাই নয়, তিনি প্রকাশ্যে এমন সব মন্তব্য করলেন যা বিচারপতি হিসেবে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। একজন রাজনীতিক, একজন শিক্ষক প্রকাশ্যে অনেক মন্তব্য করতে পারেন। কিন্তু একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি পারেন না। সেটা শোভনও নয়। একজন বিচারপতি অবসরে যাওয়ার পরও সমাজে তিনি ‘একজন বিচারপতি’ হিসেবেই গণ্য হন। সমাজ তাকে বিশেষ মর্যাদার চোখে দেখে। তিনি সমাজ তথা রাষ্ট্রের বিবেক। সাধারণত কোথাও লেখা থাকে না অবসরে যাওয়ার পর একজন বিচারপতি কী করবেন, কী করবেন না। সমাজ বা রাষ্ট্র তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের এমন সব ‘কর্মকাণ্ড’ করতে দেখি যা অনাকাক্সিক্ষত। আমরা অতীতে একজন বিচারপতিকে দেখেছিলাম, যিনি অবসরের পর রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছিলেন এবং সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এখন আমরা একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে দেখলাম যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত একজনের পক্ষে আইনি লড়াইয়ে দাঁড়াতে। এ ক্ষেত্রে আইন কোনো বাধা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে নৈতিকতার। একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির আইনি পেশায় ফিরে যাওয়া যেমন শোভন নয়, ঠিক তেমনি তার রাজনীতিতে অংশ নেয়াও কাম্য নয়। তবে নিঃসন্দেহে একজন বিচারপতি অবসরের পর তার মেধা, যোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সমাজকে ‘সেবা’ করতে পারেন। একাধিক অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি অবসরের পর আইন কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং সরকারের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়েছিলেন। অথচ সংবিধানের ৯৯(১)-এ বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি বিচারকরূপে দায়িত্ব পালন করিয়া থাকিলে উক্ত পদ হইতে অবসর গ্রহণের বা অপসারিত হইবার পর তিনি কোনো আদালত বা কোনো কর্তৃপক্ষের নিকট ওকালতি বা কার্য করিবেন না এবং বিচার বিভাগীয় বা আধাবিচার বিভাগীয় পদ ব্যতীত প্রজাতন্ত্র কর্মে কোনো লাভজনক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হইবেন না।’ যদিও ৯৯(২)(১)-এ বলা হয়েছে, তিনি আপিল বিভাগে ওকালতি করতে পারবেন। এখানে প্রশ্নটা নৈতিকতার। আইন তাকে সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু নৈতিকতা বলে একটা কথা আছে।

ফিরে আসি বিচারপতি চৌধুরীর প্রসঙ্গে। সাম্প্রতিককালে তিনি এমন ‘বেশ কিছু’ কাজ করেছেন, যা তাকে বিতর্কিতই করেছে। তিনি তার ‘পদের’ প্রতি কোনো সম্মান দেখাননি। গত ৮ ফেব্র“য়ারি তিনি সুপ্রিমকোর্টের মাজার গেটের পাশে রাস্তার ওপর আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘আমি তার (প্রধান বিচারপতি) কোনো আদেশ মানি না। মানব না।’ তিনি প্রধান বিচারপতির পদত্যাগও দাবি করেছিলেন। অতীতে কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এভাবে প্রকাশ্যে সুপ্রিমকোর্টের এলাকার ভেতরে সংবাদ সম্মেলন করেননি। বিচারপতি চৌধুরী করলেন। অতীতে কোনো বিচারপতি প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ দাবি করেননি। এখন বিচারপতি চৌধুরী এ ধরনের দাবি তুলে নতুন একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। বিচার বিভাগের ভাবমূর্তির জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। কিন্তু তার একটি বক্তব্যে আমি অবাক হয়েছি, যখন তিনি সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেছিলেন, প্রধান বিচারপতি সিনহা খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন! কী ভয়ংকর কথা। এ ধরনের কথাবার্তা তো আমরা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মুখে শুনি। একজন বিচারপতির মুখে কি এ ধরনের বক্তব্য শোভা পায়? প্রধান বিচারপতি তো কোনো ‘রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব’ নন। তিনি কেন একটি রাজনৈতিক দলের প্রধানের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবেন? বরং বিচারপতি চৌধুরীর বক্তব্যটিই স্পষ্ট একটি রাজনৈতিক বক্তব্য এবং তা প্রধান বিচারপতিকে বিতর্কিত করার শামিল। এটি কোনো ভালো কাজ নয়। বিচার বিভাগের জন্য একটি খারাপ নজিরও বটে।

ব্যক্তি চৌধুরী আর বিচারপতি চৌধুরীর মধ্যে আমরা অবশ্যই পার্থক্য করব। একজন ব্যক্তি চৌধুরী যদি রাজনৈতিক মিছিলে যান, টিভির টকশোতে রাজনৈতিক বক্তব্য দেন, আমি তাতে অবাক হই না। যে কেউ এ ধরনের বক্তব্য দিতেই পারেন। কিন্তু তিনি যদি একজন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র বিচারপতি হন, আমার আস্থার জায়গাটা তাতে নষ্ট হয়ে যায়। ব্যক্তিগতভাব তার একটি ‘রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা’ থাকতেই পারে। প্রায় প্রত্যেক মানুষেরই তা আছে। কিন্তু বিচারপতি হিসেবে অবসরে যাওয়ার পরও তিনি যখন রাজনৈতিক বক্তব্য দেন, মিছিলে যান, স্বপ্রণোদিত হয়ে টকশোতে যান, তখন আমি হতাশায় পড়ে যাই বৈকি! সমাজের প্রতিটি সেক্টরই তো এখন আস্থাহীনতায় ভুগছে। বুদ্ধিজীবীরাও বিতর্কিত হচ্ছেন। একজন স্বনামধন্য সম্পাদক তার স্বীকারোক্তির জন্য বড় বিতর্কের জন্ম হয়েছে অতি সম্প্রতি। তাই বলে বিচারপতিরা? হোন না তিনি অবসরপ্রাপ্ত? তাতে কী? বিচারপতিরাই তো আমাদের আস্থার জায়গাটা নিশ্চিত করেছেন। রাষ্ট্র যখন অমানবিক হয়, তখন তো আমরা আশ্রয় খুঁজি বিচারপতিদের কাছেই! যতদূর মনে পড়ে জাতীয় সংসদেও বিচারপতি চৌধুরীর কোনো কোনো বক্তব্য ও সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। এবং কোনো কোনো সংসদ সদস্য তাকে ‘স্যাডিস্ট’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেছিলেন। সেদিন একটি অনুষ্ঠানে একজন সাবেক প্রধান বিচারপতিও শ্রোতা-দর্শকদের সেই বক্তব্যটি স্মরণ করিয়ে দিলেন! এতে করে কি বিচারপতি চৌধুরীর মান-মর্যাদা বাড়ল, না কমল? একজন বিচারপতি, তিনি অবসরে যাওয়ার পরও সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকবেন, এটা যেমন তিনি নিজে চান, তেমনি আমার বিশ্বাস এ দেশের সাধারণ মানুষও তা চায়। একজন বিচারপতিকে অন্য কারও সঙ্গে আমি তুলনা করতে চাই না। পারিও না।

বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীকে নিয়ে যে ‘বিতর্ক’, তার অবসান হলে আমি খুশি হতাম। কিন্তু এ বিষয়টি থেমে থাকবে বলে মনে হয় না। ইতিমধ্যে, এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত, আরও দুুটি ঘটনা ঘটেছে। সুপ্রিমকোর্টের একজন আইনজীবী রাষ্ট্রপতির কাছে লেখা একটি চিঠিতে বিচারপতি চৌধুরীর ‘জাজশিপ’ প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত না নিলে তিনি উচ্চ আদালতে একটি রিট করবেন। দ্বিতীয় একটি ঘটনায় অপর এক আইনজীবী দুদকে বিচারপতি চৌধুরীর বিরুদ্ধে তথ্য গোপন করার অভিযোগ এনেছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, বিচারপতি চৌধুরী একই সঙ্গে বাংলাদেশ ও ব্রিটেনের নাগরিক। তিনি এ তথ্যটি ‘গোপন’ করে বিচারপতি হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন, যা প্রচলিত আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ওই আইনজীবী তার আবেদনে উল্লেখ করেছেন। এখানে যে প্রশ্নটি আসে তা হচ্ছে, কোনো বিদেশী নাগরিক, যিনি একই সঙ্গে বাংলাদেশের নাগরিক, সাংবিধানিক কোনো পদে নিয়োজিত হতে পারেন কি-না? আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৫(২)-এ বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক না হলে তিনি বিচারক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না। এ অনুচ্ছেদ বিচারপতি চৌধুরীর ক্ষেত্রে পুরোপুরি প্রযোজ্য নয়। কারণ তিনি বাংলাদেশেরও নাগরিক! সংবিধানের কোথাও দ্বৈত নাগরিকের ক্ষেত্রে তিনি বিচারপতি হতে পারবেন কী পারবেন না- এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কোনো কথা বলা হয়নি। এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতের কোনো রুলিং আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে সুপ্রিম কোর্টে বেশ কয়েকজন আইনজীবী রয়েছেন, যাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে।

বিচারপতি চৌধুরীকে নিয়ে যে ‘বিতর্ক’, তার অবসান হওয়া বাঞ্ছনীয়। তিনি এরপর আর অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো বক্তব্য দেবেন না, এটাই প্রত্যাশা করি। সেই সঙ্গে এও প্রত্যাশা করি, যে রায়গুলো এখনও লেখা শেষ হয়নি তা তিনি ‘দ্রুত’ শেষ করবেন এবং নথিসহ সব কাগজপত্র জমা দেবেন। তিনি যত দ্রুত এ কাজটি করবেন, ততই তার জন্য মঙ্গল। তিনি যত দেরি করবেন, ততই জটিলতা বাড়বে। সংবিধান লংঘন কিংবা মানহানির ঘটনায় তিনি অভিযুক্ত হতে পারেন। তিনি ‘প্রধান বিচারপতির আদেশ মানবেন না’- এ কথা তিনি বলতে পারেন না। প্রধান বিচারপতি একজন ব্যক্তি নন, একটি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানকে ‘বিতর্কিত’ করা অন্যায়। ন্যূনতম সৌজন্যবোধ থাকলে একজন সিনিয়র বিচারপতি এ ধরনের মন্তব্য করতে পারেন না।

তবে অবসরে গিয়ে রায় লেখা কতটুকু সাংবিধানিক, কিংবা কতটুকু যৌক্তিক, এ প্রশ্নকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। অনেক বিচারপতিই এ কাজটি করেন। কিন্তু কখনও এ বিষয়টি প্রকাশ্যে আসেনি। প্রধান বিচারপতি এ বিষয়টি সামনে নিয়ে এলেন। স্পষ্টতই তিনি উচ্চ আদালতে একটি সংস্কার চন। এটা মঙ্গল ও ন্যায়পরায়ণতার স্বার্থে যুক্তিসঙ্গত। একটি সংক্ষিপ্ত রায় হয়ে গেল। পূর্ণ রায় একজন নাগরিক পেলেন ১৫ মাস পর- এটা তো হতে পারে না? এটা তো একজন নাগরিকের অধিকার খর্বের শামিল। পূর্ণ রায় লিখতে একজন বিচারপতি কিছুটা সময় নিতেই পারেন। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তিনি মাসের পর মাস সময় নেবেন। প্রধান বিচারপতি এ ব্যাপারে একটি সংস্কার আনতে চাচ্ছেন। আমি তাকে স্বাগত জানাই। অতীতে কোনো প্রধান বিচারপতিই এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেননি। তবে প্রধান বিচারপতির এ বক্তব্য নিয়ে ‘রাজনীতি’ হোক এটা আমরা চাই না। তার বক্তব্যের ভেতরে ‘অন্য কোনো কিছুর গন্ধ’ খোঁজাও ঠিক নয়। অতীতের কোনো রায়ের ক্ষেত্রেও এ বক্তব্যকে বিবেচনায় নেয়া যাবে না। বর্তমান প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগকে সঠিক রাস্তায় নিয়ে যেতে চাইছেন বলে সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী যে মন্তব্য করেছেন, আমি মনে করি অনেকেই এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত হবেন। উচ্চ আদালত নিয়ে আমরা আর বিতর্ক চাই না। প্রধান বিচারপতি একটি প্রতিষ্ঠানও বটে। এ ‘প্রতিষ্ঠান’কে বিতর্কিত করা কখনও কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না Daily Jugantor 13.02.16

মিয়ানমারে নবযুগের সূচনা?

পহেলা ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের নবনির্বাচিত সংসদের অধিবেশন শুরু হওয়ার মধ্য দিয়ে দেশটিতে একটি নবযুগের সূচনা ঘটল। দীর্ঘ ৫৪ বছর দেশটি শাসন করেছে সেনাবাহিনী ও সেনাবাহিনী-সমর্থিত রাজনৈতিক শক্তি। ৮ নভেম্বরের (২০১৫) নির্বাচন এই দৃশ্যপট বদলে দেয়। ৬৬৪ সদস্যবিশিষ্ট পার্লামেন্টে অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন এনএলডির সদস্য রয়েছে ৩৯০ জন। আর সেনাবাহিনীর সরাসরি প্রতিনিধিত্ব রয়েছে ১৬৬ জনের। পার্লামেন্টে সেনা-সমর্থিত ইউএসডিপির সদস্য রয়েছে মাত্র ৪১ জন। ১৯৯০ সালের নির্বাচনেও অং সান সুচির দল বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু সেনাবাহিনী সুচিকে ক্ষমতা দেয়নি। আজ দৃশ্যপট ভিন্ন। সেনাবাহিনীর মনোভাবেও পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বরাজনীতি তথা আঞ্চলিক রাজনীতিতেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এখন গণতন্ত্রের ব্যাপারে আরও বেশি ‘কমিটেড’। ফলে আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ‘চাপ’ থাকায় এই নির্বাচন বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে সংশয় যে নেই, তাও বলা যাবে না। সংশয়, উদ্বেগ এবং নানা প্রশ্নও আছে।

অং সান সুচি বলেছেন, ‘তার ভূমিকা হবে প্রেসিডেন্টের ঊর্ধ্বে।’ তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন সত্য, কিন্তু সংবিধানের বাইরে তিনি যেতে পারবেন না। সংবিধান তিনি পরিবর্তনও করতে পারবেন না। এর অর্থ হচ্ছে, সংবিধান তাকে মানতে হবে এবং সংবিধান মানলে তাকে বর্তমান প্রেসিডেন্টকে মানতে হবে। ফলে সুচি যদি ‘জোর করে’ কিছু করতে চান, তাহলে সংকট ঘনীভূত হবে এবং তাতে করে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তিনি বিবাদে জড়িয়ে যাবেন, যা মিয়ানমারের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্য কোনো ভালো খবর বয়ে আনবে না। তাহলে তার ভূমিকা কী হবে? তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। কারণ সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর পদটি বিলুপ্ত হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী মিয়ানমারে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার বিদ্যমান। সমস্যাটা এখানেই। সুচি প্রেসিডেন্ট হতে পারছেন না। তাকে একজন আস্থাভাজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করতে হবে। তাহলে তার ভূমিকাটা কী হবে? তিনি পর্দার অন্তরালে থেকে ক্ষমতা পরিচালনা করবেন। তার ভূমিকাটি হবে অনেকটা ভারতের সোনিয়া গান্ধীর মতো। সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রী না হয়ে মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। কিন্তু মূল ক্ষমতা ছিল তার কাছে। এখন সুচির ভূমিকা হবে সোনিয়া গান্ধীর মতো। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে এই মুহূর্তে তিনি প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী কোনোটাই হতে পারছেন না। সংবিধান সংশোধনে সেনাবাহিনী সমর্থন দেবে, এটা মনে হয় না।

তবে নির্বাচনের আগে মানুষ সুচিকে যেভাবে দেখেছে, নির্বাচনের পর তাকে দেখছে ভিন্নভাবে। তিনি বিদেশী গণমাধ্যমকে ইন্টারভিউ দিয়ে যেভাবে নিজের মনোভাবকে তুলে ধরছেন, তাতে করে তার মধ্যে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের প্রকাশ ঘটছে। অথচ তার উচিত ছিল একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা, ঐক্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেয়া। এটা না করে তিনি এক ধরনের ‘হুমকির সুরে’ সরকার পরিচালনার কথা বলছেন। গণতন্ত্রের নামে এ ধরনের কর্তৃত্ববাদী আচরণ আমরা কোনো কোনো দেশে লক্ষ করি। মালয়েশিয়ায় ক্ষমতাসীন জোট গণতন্ত্রের নামে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী আচরণের জন্ম দিয়েছে। সিঙ্গাপুরে পিপলস অ্যাকশন পার্টি একদলীয় শাসন বজায় রয়েছে। যদিও জনগণই তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে। কম্বোডিয়ায় সমাজতন্ত্র-পরবর্তী কাঠামোয় একদলীয় (পিপলস পার্টি) শাসন বিদ্যমান। থাইল্যান্ডে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করলেও সেখানে থাকসিন সিনাওয়াত্রার দলের প্রভাব অনেক বেশি। তার নামেই তার বোন ইংলাক সিনাওয়াত্রা নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন এবং সরকারও গঠন করেছিলেন। সমাজতন্ত্র-পরবর্তী মধ্য এশিয়ার প্রতিটি দেশে গণতন্ত্রের নামে একদলীয় কর্তৃত্ব বজায় রয়েছে। আমরা বেলারুশের কথাও বলতে পারি। সেখানে নির্বাচন হচ্ছে বটে, কিন্তু কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচনী ফলাফল ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে নেয়া হচ্ছে। অং সান সুচিও কি এ পথেই যাচ্ছেন? ক্ষমতা নিতে হলে তাকে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সংবিধান সংশোধনের একটি উদ্যোগ তিনি নিতে পারেন। কিন্তু আগেই বলেছি, সেনাবাহিনী এই উদ্যোগকে সমর্থন করবে- এটা মনে হয় না।

জনগণই যে ‘সব ক্ষমতার উৎস’ মিয়ানমারের নির্বাচন এ সত্যটা আবার প্রমাণ করেছিল। এ নির্বাচন পার্শ্ববর্তী দেশ থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের সাংবিধানিক ধারাকে নিঃসন্দেহে উৎসাহিত করবে। দুঃখের কথা, এই প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের সংসদে কোনো মুসলিম প্রতিনিধিত্ব নেই। ফলে মুসলমানদের মাঝে ক্ষোভ ও অসন্তোষ আরও দানা বাঁধবে। উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা মুসলিম নিধন ও উৎখাতে এতে আরও উৎসাহিত হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপকতা আরও বাড়বে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত সংসদের মেয়াদ ৫ বছর। অর্থাৎ ২০২১ সাল পর্যন্ত এই সংসদ টিকে থাকার কথা। সময়টা অনেক লম্বা। নতুন সংসদ গঠিত হওয়ার পর এখন অন্তত এক মাস সময় থাকবে হাতে। সুচি এই সময়টা কাজে লাগাবেন সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটি ‘সমঝোতায়’ যেতে। সম্ভবত এটাই তার জন্য শেষ সময়। ২০১০ সালেও একটি নির্বাচন হয়েছিল। তার দল ঠিক সময়মতো নিবন্ধন করতে না পারায় অথবা নিবন্ধন না করায় ৫ বছর পিছিয়ে গিয়েছিলেন সুচি। এবারও যদি তিনি ভুল করেন, তাহলে তাকে অপেক্ষা করতে হবে ২০২১ সাল পর্যন্ত। সময়টা অনেক বেশি। তখন সুচির বয়স গিয়ে দাঁড়াবে ৭৪। এরপর তার পক্ষে আর রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা সম্ভব হবে না। সে কারণেই তিনি মিয়ানমারের সমাজে সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে মেনে নেবেন। আমরা তার বাস্তবমুখী একটি সিদ্ধান্তই আশা করছি।

এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। বাংলাদেশের জন্য মিয়ানমারে একটি বন্ধুপ্রতিম সরকার থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির জন্য মিয়ানমার আমাদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সড়কপথ চালু হলে এ সড়ক একদিকে যেমন আমাদের চীনের সঙ্গে সংযোগ ঘটাবে, অন্যদিকে আমরা আমাদের পণ্য নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও যেতে পারব। আমাদের পণ্যের বিশাল এক বাজার সৃষ্টি হবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে উভয় দেশই বিমসটেক (BIMSTEC,, পরিবর্তিত নাম BBIMSTEC) ও BCIM জোটের সদস্য। যদিও প্রস্তাবিত BCIM জোটটি এখনও আলোর মুখ দেখেনি। ভুটান ও নেপাল বিমসটেক জোটে যোগ দেয়ায় এ জোটটি শক্তিশালী হয়েছে। এই জোটের উদ্দেশ্য বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলংকা ও থাইল্যান্ডে একটি মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক সম্প্রসারণে চট্টগ্রামে মিয়ানমারের কাঁচামালভিত্তিক শিল্পকারখানা স্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষিভিত্তিক মিয়ানমারে বাংলাদেশী সারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন চট্টগ্রাম এলাকায় বেশকিছু সার কারখানা স্থাপন করে বাংলাদেশ মিয়ানমারে সার রফতানি করতে পারে। মিয়ানমারের আকিয়াব ও মংডুর আশপাশের অঞ্চলে প্রচুর বাঁশ, কাঠ ও চুনাপাথর পাওয়া যায়। এসব কাঁচামালের ওপর ভিত্তি করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সিমেন্ট ও কাগজ শিল্প বিকশিত হতে পারে। মিয়ানমারে প্রচুর জমি অনাবাদি রয়েছে। এসব জমি লিজ নিয়ে বাংলাদেশের জন্য চাল উৎপাদনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। মান্দালয়-ম্যাগওয়ের তুলা আমদানি করতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তার ক্রমবর্ধিষ্ণু গার্মেন্ট সেক্টরের কাঁচামাল হিসেবে তুলা মিয়ানমারের এই অঞ্চল থেকে আমদানি করতে পারে। গবাদিপশু আমদানি করার সম্ভাবনাও রয়েছে। বাংলাদেশীরা মিয়ানমারে গবাদিপশুর খামারও গড়ে তুলতে পারে। মিয়ানমারের সেগুন কাঠ পৃথিবী বিখ্যাত। আমাদের ফার্নিচার শিল্পের চাহিদা মেটাতে পারে এই সেগুন কাঠ, যার ওপর ভিত্তি করে আমরা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে আমাদের ফার্নিচার শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারি। মিয়ানমার মূল্যবান পাথর যেমন- রুবি, জেড, বোম আর মার্বেলে সমৃদ্ধ। এসব মূল্যবান পাথর আমাদের জুয়েলারি শিল্পকে সমৃদ্ধ করে ভ্যালু-অ্যাডিশনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক হতে পারে। ভারত, মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও চীনের সমন্বয়ে যে আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা বলা হচ্ছে (বিসিআইএম), সেখানেও বাংলাদেশের স্বার্থ রয়েছে। সুতরাং মিয়ানমারে যে সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে, তার সঙ্গে সম্পর্ক সম্প্রসারণ করা আমাদের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।

তবে মিয়ানমারকে নিয়ে প্রশ্ন অনেক। সে দেশে একটি নির্বাচন হয়েছে বটে; কিন্তু এই নির্বাচন সত্যিকার অর্থে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্মের সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করে না। দীর্ঘ ৫৪ বছর সেখানে যে সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে, তা হুট করে ভেঙে ফেলা যাবে না। রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর যে প্রভাব রয়েছে, তা হ্রাস করা যাবে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে সেনাবাহিনীর একটি নির্বাচন দেয়া প্রয়োজন ছিল। সেটা তারা দিয়েছে। কিন্তু তারা ব্যারাকে ফিরে যাবে, এটা আমার মনে হয় না। মিসরের মতো একটি পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হতে পারে মিয়ানমারে। আরব বসন্ত মিসরে পরিবর্তন ডেকে এনেছিল। সেনানিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভেঙে পড়েছিল কায়রোর ‘তেহরির স্কোয়ারে’ দীর্ঘ ১৭ দিনের গণঅবস্থানের কারণে। তার পরের ঘটনা সবাই জানেন। হোসনি মোবারকের ক্ষমতা হস্তান্তর, একটি নির্বাচন, নির্বাচনে ড. মুরসির বিজয় (জুন ২০১২) এবং পরবর্তী সময়ে (২০১৩) সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফিল্ড মার্শাল সিসির ক্ষমতা গ্রহণ। ‘আরব বসন্ত’ মিসরের জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। এখন মিয়ানমার কি সেদিকেই হাঁটবে? সেনাবাহিনী নির্বাচন ও সংসদকে মেনে নিয়েছে। কিন্তু সব ‘সুযোগ-সুবিধা’ তারা ছেড়ে দেবে, এটা মনে হয় না। এক্ষেত্রে সুচিকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটা সহাবস্থানে যেতে হবে। নতুবা তিনি ‘পর্দার অন্তরালে’ থেকে ক্ষমতা পরিচালনা করতে পারবেন না। এর অর্থ পরিষ্কার- সেনাসমর্থিত একজনকেই তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নেবেন এবং সমর্থন করবেন। তিনি নিজে কোনো ‘প্রার্থী’ দেবেন না। এর মাধ্যমে তিনি সেনাবাহিনীর আস্থা অর্জন করতে পারেন। সরকারে তার ‘ভূমিকা’ নিয়েও প্রশ্ন থাকবে এবং প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তিনি একটি ‘পদ’ পেতে পারেন।

মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস অনেক পুরনো। নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন বিচ্ছিন্নতাবাদী ৮টি গ্রুপের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু চুক্তির বাইরে আরও বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ রয়েছে। এদেরও চুক্তির আওতায় আনা দরকার। অর্থনৈতিক সংস্কারটা খুবই জরুরি। বৈদেশিক বিনিয়োগ দীর্ঘদিন সে দেশে বন্ধ ছিল। এখন এটি উন্মুক্ত। বিশেষ করে গভীর সমুদ্রে বিপুল জ্বালানি সম্পদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ এলেই এই সম্পদ আহরণ সম্ভব। মার্কিন বিনিয়োগকারীরা মিয়ানমারে আসতে শুরু করেছেন। এখন ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতির’ কারণে মার্কিন বিনিয়োগকারীরা আরও উৎসাহিত হবেন। রোহিঙ্গা সমস্যা বহির্বিশ্বে মিয়ানমারের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট করেছে। রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে এক অমানবিক জীবন যাপন করছে। সুচি এদের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি উগ্র বৌদ্ধ মানসিকতায় নিজেকে সম্পর্কিত করেছিলেন। উদ্দেশ্য পরিষ্কার- ভোটপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা। সেটা নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু একজন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীর কাছ থেকে মানুষ আরও বেশি কিছু প্রত্যাশা করে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়া, তাদের চলাচলে বাধা-নিষেধ প্রত্যাহার করে নেয়া কিংবা তাদের নিজ বাসভূমে বসবাসের অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। নতুন সরকার এ কাজটি করবে- এটাই মানুষ প্রত্যাশা করে। Dainik Jugantor 09.02.16