রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কোন পথে বিএনপি

অনেকদিন ধরেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে বিএনপি। আগামী ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিল। এই কাউন্সিলকে ঘিরেই নানা আলোচনা। যদিও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন এই কাউন্সিলের মাধ্যমে বিএনপি বিপর্যয় কাটিয়ে উঠবে, তারপরও নানা প্রশ্ন, নানা জিজ্ঞাসা বিএনপিকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। সবচেয়ে বড় যে শংকা, তা হচ্ছে যে কোনো একটি মামলায় খালেদা জিয়ার যদি ‘শাস্তি’ হয় এবং আইনি প্রক্রিয়ায় তিনি যদি এর থেকে ‘মুক্তি’ না পান, তাহলে কী হবে বিএনপির? কেননা দলের যিনি হাল ধরবেন এবং যিনি খালেদা জিয়ার যোগ্য উত্তরসূরি, সেই তারেক রহমান লন্ডনে। তার ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ এবং অপর যে কোনো একটি মামলায় তার শাস্তি হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়ছে। তাহলে কে ধরবেন বিএনপির হাল? তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমান? নাকি তারেকের একমাত্র সন্তান জাইমা রহমান? একজন ‘বেনজির ভুট্টো’ কী তৈরি হচ্ছে! নানা গুঞ্জন আকাশে-বাতাসে ভাসছে। জিয়া পরিবারের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক নেই জোবায়দা রহমানের। কিন্তু রক্তের সম্পর্ক আছে কিশোরী জাইমা রহমানের। নিঃসন্দেহে তার জন্য বয়সটা একটা ফ্যাক্টর। এবং বোধকরি তারেক রহমান নিজেও এটা চাইবেন না। এখনও কলেজ অতিক্রম করেনি জাইমা। দাদা, দাদি, বাবা সবাই রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই ‘রাজনীতি’কে জাইমা অস্বীকার করে কীভাবে? খালেদা জিয়া ইতিমধ্যে সত্তরে পা দিয়েছেন। শারীরিকভাবে তিনি পুরোপুরি সুস্থ নন। তার সুস্থতার ওপর দলের অনেক কিছু নির্ভর করছে। এ মুহূর্তে দলে তারেক রহমান ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি নেই, যিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তারেক রহমান লন্ডনে অবস্থানের কারণে খালেদা জিয়াকে বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়েছিল দলের পুনর্গঠন ও সিদ্ধান্ত নিতে। এখন খালেদা জিয়া সেই কাজটি সারবেন। তবে খালেদা জিয়াকে অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নিতে হবে আগামীতে। তার অবর্তমানে দলের নেতৃত্ব কার হাতে থাকবে কিংবা দলের সংবিধান পরিবর্তন করে দলে কো-চেয়ারম্যানের একটি পদ সৃষ্টি করে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের পথ সৃষ্টি করতে হবে, এটাও ভাবতে হবে। কেননা এটা স্পষ্ট যে, তারেক রহমান দেশে আসতে পারছেন না। সে ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া যদি জেলে যান বা অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাহলে দল কে দেখবেন? ইতিমধ্যে কর্নেল অলির (অব.) বিএনপিতে ফিরে আসা, কিংবা অধ্যাপক বি. চৌধুরীর বিএনপিতে ফেরার আগ্রহ রাজনৈতিক পণ্ডিতদের মাঝে নানা প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপি এখনও বড় দল। জাতীয় পার্টির ব্যর্থতা বিএনপিকে সামনে নিয়ে এসেছে।

গেল পহেলা সেপ্টেম্বর বিএনপি ৩৭ বছরে পা রেখেছে। একটি রাজনৈতিক দলের জন্য এই ৩৭ বছর একেবারে কম সময় নয়। দলটি একাধিকার রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জন্ম নেয়া এই রাজনৈতিক দলটি বর্তমানে এক কঠিন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বোধকরি অতীতে কখনোই দলটি এ ধরনের সংকটের মাঝে পড়েনি। যারা রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে কাজ করেন, তারা জানেন বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে দলটির একটি শক্ত অবস্থান আছে। তিনবার দলটি ক্ষমতায় ছিল (১৯৭৮-৮২, ১৯৯১-৯৬, ২০০১-০৬)। ফলে তৃণমূল পর্যায়ে দলটির একটি অবস্থান আছে। ১৯৮২ সালে এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থান ও ক্ষমতা থেকে বিএনপির উৎখাতের পর ওই সময় যখন বিএনপির অস্তিত্ব হুমকির মুখে ছিল, ঠিক তখনই একজন গৃহবধূ থেকে (১৯৮৩) রাজনীতির পাদপ্রদীপে আসেন খালেদা জিয়া। এখন তিনিই বিএনপির অবিসংবাদিত নেত্রী। তাকে কেন্দ্র করেই বিএনপির রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, নব্বই-এ এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সাধারণ মানুষ যে খালেদা জিয়াকে দেখেছিল একজন অবিসংবাদিত নেত্রী হিসেবে, সেই খালেদা জিয়াকে এখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল! বয়স বেড়েছে। অসুস্থ তিনি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচনে অংশ না নেয়া কিংবা পরবর্তী সময়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে যে সহিংস রাজনীতির জন্ম হয়েছে এ দেশে, তা ব্যক্তিগতভাবে খালেদা জিয়া তথা বিএনপির রাজনীতিকে উজ্জ্বল করেনি। খালেদা জিয়াকে আমার এখন মনে হচ্ছে নিঃসঙ্গ একজন নাবিক হিসেবে, যিনি আদৌ জানেন না কোন দিকে এবং কোন পথে বিএনপি নামক ‘জাহাজটি’কে পরিচালনা করবেন। এক সন্তানহারা, অপর সন্তান অনেক দূরে, নেতাকর্মীরা জেলে, নিঃসঙ্গ খালেদা জিয়া এখন একাই বিএনপি।

বর্তমানে বিএনপি নানা সমস্যায় আক্রান্ত এটা তো অস্বীকার করা যাবে না। বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিএনপি দল গোছানোর কথা বলছে। তবে অতীতে বিএনপির কয়েকজন নেতার ফোনালাপ ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে শীর্ষস্থানীয় বিএনপি নেতাদের মাঝে এক ধরনের হতাশা আছে। বিএনপি ভাঙার ‘গুজব’ এ কারণেই। খালেদা জিয়াকে দিয়ে হবে না, কিংবা জিয়ার আদর্শে ফিরে যেতে হবে- এ ধরনের বক্তব্য যখন বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মুখ থেকে বের হয়, তখন গুজবের নানা ডাল-পালা গজায়। মির্জা ফখরুল জামিন পেলেও কেউ কেউ জেলে আছেন এখনও। অনেকের বিরুদ্ধে মামলা আছে। আর যারা হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন, ওই জামিনের বিরুদ্ধে আপিল করেছে সরকার। এর অর্থ পরিষ্কার- মামলা, মোকদ্দমা দিয়ে বিএপির শীর্ষ নেতাদের ব্যস্ত রাখতে চায় সরকার, যাতে করে তারা আন্দোলনে নিজেদের জড়িত করতে না পারেন। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে অতীতে এমনটি কখনোই দেখা যায়নি- এত বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা! ফলে এসব নেতাকর্মী আর রাজপথে সক্রিয় হতে পারবেন না। খালেদা জিয়াকে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯-এর ২৭ ধারা অনুযায়ী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন সংক্রান্ত ধারা) বিচার, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় কিংবা গ্যাটকো দুর্নীতি মামলায় শাস্তি দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা, একই সঙ্গে ডান্ডি ডায়িং মামলায় তারেক রহমানকে ‘শাস্তি’ দিয়ে তাকেও অযোগ্য ঘোষণার মধ্য দিয়ে সরকার মাইনাস ওয়ান ফর্মুলার দিকেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। এ ক্ষেত্রে খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হলে আইনি প্রক্রিয়ায় তিনি নির্বাচনের জন্য যোগ্য হবেন কি-না জানি না। খালেদা জিয়াই বিএনপির মূল শক্তি। খালেদা জিয়া যদি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন, বিএনপির বিকল্প নেতৃত্ব নির্বাচনে অংশ নেবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমানকে বাদ দিয়ে বিএনপি সংগঠিত হবে এটাও আমার মনে হয় না। সরকারের নীতিনির্ধারকরা যদি মাইনাস ওয়ান ফর্মুলা কার্যকর করতে চান, আমার ধারণা তা কোনো কার্যকর ‘ফল’ দেবে না। ‘আসল বিএনপি’ কিংবা নাজমুল হুদার ফালতু কথাবার্তায় মানুষ খুব আস্থাশীল এটা আমার মনে হয় না। জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের আসনে বসিয়েও সরকার খুব লাভবান হয়নি। জাতীয় পার্টি এখন নানা জটিলতার মুখে। ফলে সরকারের কাছে এখন বিকল্প পথ দুটি। এক. বিএনপিকে যে কোনোভাবে আস্থায় নিয়ে ২০১৭ সালের প্রথম দিকে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়া। দুই. অথবা সংবিধান অনুযায়ী ২০১৮ সালের শেষের দিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা। যে কোনো সময়ের চেয়ে সরকারের অবস্থান এখন অনেক শক্তিশালী। উল্লিখিত দুটি সিদ্ধান্তের মাঝে একটি, অর্থাৎ প্রথমটির ব্যাপারে সরকারের আগ্রহ কম। এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত, অর্থাৎ সংবিধান অনুযায়ী পরবর্তী নির্বাচনটিই সরকার করতে চায়। কিন্তু প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিকে বাদ রেখে যদি ২০১৮ সালের শেষে নির্বাচন হয়, তাহলে সমস্যা যা ছিল, তাই থেকে যাবে!

বিএনপির সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক তৈরি না হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করা যাবে না। সম্প্রতি ঢাকা সফর করে যাওয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধিদলও বলে গেছে, সব দলের অংশগ্রহণের স্বার্থে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে এখনই সংলাপ শুরু হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সরকার তাতে সায় দেবে বলে মনে হয় না।

এটা স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশে একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে। আওয়ামী লীগের বিকল্প বিএনপি, ঘুরে ফিরে এটা প্রমাণিত। দশম সংসদে জাতীয় পার্টি পারেনি। তাই যে কোনো বিবেচনায় বিএনপির সঙ্গে একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা সরকারের জন্য জরুরি। কেননা বাংলাদেশ নিুমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ ভাগের উপরে, যেখানে ইউরোপে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে শ্লথগতি এসেছে। এখন নিুমধ্যম আয়ের দেশের চূড়ান্ত স্বীকৃতি পেতে হলে এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হবে। আর এর পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। বিএনপিকে আস্থায় নিয়েই এই স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। এটা সবাই বলেন, সংসদীয় রাজনীতিতে শক্তিশালী একটি বিরোধী দল থাকা দরকার। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেয়ায় জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু গত প্রায় দুই বছরের সংসদীয় রাজনীতির কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জাতীয় পার্টি সেই দায়িত্বটি পালন করতে পারছে না। দ্বন্দ্ব আছে সরকারে থাকা না থাকা নিয়ে। ফলে সংসদকে আরও গ্রহণযোগ্য, আরও অর্থবহ এবং সর্বোপরি একটি সঠিক জাতীয় নীতি প্রণয়নে সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা বাঞ্চনীয়। আর বিএনপিই সেই দায়িত্বটি পালন করতে পারে। বলা ভালো, বিএনপি সংসদে না থাকলেও বিএনপি যে বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অপরিহার্য অংশ, দাতাগোষ্ঠী এটা স্বীকার করে এবং তারা সবাই বিএনপিকে মূল ধারার রাজনীতিতে দেখতে চায়। ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের অবস্থানও আমার ধারণা অনেকটা সে রকম। সরকারের ভূমিকা তাই এ ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। এটা স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অন্যতম দুটি শক্তি। এই দুটি দল দুটি রাজনৈতিক ধারার প্রতিনিধিত্ব করছে। অতীত ইতিহাস প্রমাণ করে এই দুটি দলের একটিকে বাদ দিয়ে যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, তা স্থায়ী হয়নি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এসেছিল জনগণের ভোটে। এর আগে ১৯৮৬ সালে এরশাদীয় জমানায় যে সংসদ নির্বাচন হয়েছিল, তাতে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করলেও বিএনপি নির্বাচন বয়কট করায় ওই সংসদ টিকে থাকেনি। ১৯৮৮ সালের সংসদও টেকেনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অংশ না নেয়ার কারণে। এই দু’দলের অংশগ্রহণ থাকার কারণেই ৫ম সংসদ (১৯৯১), ৭ম সংসদ (১৯৯৬), ৮ম সংসদ (২০০১) ও ৯ম সংসদ (২০০৮) গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। কিন্তু বিএনপির অংশগ্রহণ না থাকায় ৫ জানুয়ারির (২০১৪) দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপি অনেক নমনীয় হয়েছে এবং তাদের আগের অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছে। বিএনপির পক্ষ থেকে দেয়া অনেকগুলো বক্তব্য বিশ্লেষণ করে আমার মনে হয়েছে, বিএনপি সরকারের সঙ্গে একটি ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে’ যেতে চায় এবং যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। বিএনপির নেত্রী ও বিএনপির মুখপাত্রের ৪টি বক্তব্য দুটি বড় দলের মাঝে একটি ‘বরফ গলা’র সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে বলে আমার ধারণা। এক. খালেদা জিয়া বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক নয় বরং একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে। এর অর্থ বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাকে এখন আর গুরুত্ব দিচ্ছে না আগের মতো। দুই. সৈয়দ আশরাফ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে বলেছিলেন, তিনি দলনিরপেক্ষভাবেই এই মন্ত্রণালয় পরিচালনা করবেন। বিএনপির মুখপাত্র এই বক্তব্যকে তখন স্বাগত জানিয়েছিলেন। তিন. ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগকে বিএনপি সমর্থন করেছিল এবং বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল- এই ইস্যুতে তারা সরকারকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। চার. বিএনপির পক্ষ থেকে ‘স্বাভাবিক রাজনীতি’ করার দাবি জানানো হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন একটা ধর-পাকড়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে না। বিএনপির মুখপাত্র নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং করছেন। এখন দেখার পালা, বিএনপিকে কাউন্সিল করতে সরকার দেয় কি-না।

ইতিমধ্যে ১৯ মার্চ বিএনপির কাউন্সিলের জন্য একটি তারিখ নির্ধারিত হয়েছে। কিন্তু ভেন্যুর ব্যাপারে বিএনপির নেতৃবৃন্দ এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। সোহরাওয়ার্দীতে নিরাপত্তার কারণে বিএনপি নিজেই করতে চাচ্ছে না। তারপরও একটি ভেন্যু নিশ্চয় বের করা যাবে। পুনর্গঠন দ্রুত শেষ করতে ১১টি কমিটি করা হয়েছে। তবে ২২ মার্চ থেকে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন শুরু হবে বিধায়, বিএনপির কাউন্সিল পিছিয়ে যেতে পারে। যদিও ইতিমধ্যে ২ মার্চের মধ্যে পুনর্গঠন কাজ শেষ করার জন্য জেলা ও মহানগর নেতাদের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে কেন্দ্র। কাউন্সিলের আগে অনেক ‘কাজ’ গোছাতে হবে বিএনপিকে। বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাদের বাদ দিয়ে স্থায়ী কমিটির পুনর্গঠন- এ কাজটি সহজ নয়। কাউকে বাদ দেয়াও ঝুঁকিপূর্ণ। বাদ দেয়া কেউ সরকারের ‘ট্র্যাপে’ পা দিতে পারেন। অনেক সিনিয়র নেতাকে নিয়ে নানা কথা আছে। কেউ কেউ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন- এমন অভিযোগ আছে। ফলে ‘কাজটি’ করা খালেদা জিয়ার জন্য সহজ হবে না। তবে বেশ কয়েকজন পরীক্ষিত নেতা আছেন, যাদের পদোন্নতি দরকার। স্থায়ী কমিটিতে অপেক্ষাকৃত তরুণদের স্থান দেয়া প্রয়োজন। উপদেষ্টা পরিষদের কাঠামোতে পরিবর্তন প্রয়োজন। ব্যক্তিবিশেষের দিকে তাকিয়ে নয়, বরং বিষয়ভিত্তিকভাবে ১০টি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা যেতে পারে, যা গঠিত হবে একেকজন বিশেষজ্ঞের নেতৃত্বে এবং যারা পার্টির চেয়ারম্যানকে সঠিক নীতি, রাজনীতি ও স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করতে সাহায্য করবেন। বর্তমানে যারা উপদেষ্টা পরিষদে আছেন, তাদের কাউকে কাউকে সাংগঠনিক কাঠামোয় স্থান দেয়া যেতে পারে। ২০৫০ সালকে সামনে রেখে বিএনপি কীভাবে বাংলাদেশকে দেখতে চায়, তার একটি রূপকল্প প্রণয়ন করাও জরুরি। মোদ্দাকথা বিএনপির কাউন্সিলটি ভালোয় ভালোয় অনুষ্ঠিত হোক। একটা ‘নয়া নেতৃত্ব’ বিএনপিকে নেতৃত্ব দিক, বোধকরি সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিএনপির কর্মীরাও এমনটি চান। Daily Jugantor 22/02.16

0 comments:

Post a Comment