তিনি সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতি। গেল
অক্টোবরে তিনি অবসরে যান। কিন্তু তিনি ইতিমধ্যে বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম
দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে তার নানা বিরূপ মন্তব্য একাধিকবার
সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছে। প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে তিনি বিতর্কের জন্ম
দিয়েও ক্ষান্ত হননি, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রধান বিচারপতির ‘ভূমিকা’ নিয়েও
প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কি
প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতে পারেন! অ্যাটর্নি জেনারেল
তাই স্পষ্ট করেই বলেছেন, অবসরে যাওয়া ওই বিচারপতির এ ধরনের মন্তব্যে বিচার
বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা যে নজিরবিহীন, তা
সংবাদকর্মীদের জানাতেও তিনি ভোলেননি। আমি অ্যাটর্নি জেনারেলকে সাধুবাদ
জানাই তার স্পষ্ট বক্তব্যের জন্য।
বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত একজন ব্যক্তিত্ব। আপিল বিভাগে থাকার সময়ও তিনি আলোচিত ছিলেন নানা কারণে। তিনি সম্ভবত ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী এবং এক সময় লন্ডনে আইন পেশায়ও নিয়োজিত ছিলেন। এবং স্মরণ করছি, লন্ডন থাকাকালীন আমার সঙ্গে তার একবার দেখাও হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে কখনও তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। নিঃসন্দেহে একজন ‘সাহসী’ বিচারপতি তিনি। অনেক রায় তিনি দিয়েছেন, যা তাকে আলোচনায় এনেছে বারবার।
বিতর্কের সূত্রপাত হয় প্রধান বিচারপতির একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। গত ১৯ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি পদে দায়িত্ব নেয়ার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে দেয়া এক বাণীতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছিলেন, ‘কোনো কোনো বিচারপতি অবসর গ্রহণ করার দীর্ঘদিন পর রায় লেখা অব্যাহত রাখেন, যা আইন ও সংবিধানপরিপন্থী।’ এর বিরোধিতা করেন আপিল বিভাগ থেকে অবসরে যাওয়া বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। ঘটনাটা এখানেই শেষ হতে পারত। অথবা তিনি প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য না রেখে তার কাছে যে রায়গুলো লেখা বাকি ছিল, তা জমা দিতে পারতেন। এতে করে সাধারণ মানুষ এতকিছু জানত না। কিন্তু বিষয়টিকে তিনি প্রকাশ্যে নিয়ে এলেন। শুধু তাই নয়, তিনি প্রকাশ্যে এমন সব মন্তব্য করলেন যা বিচারপতি হিসেবে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। একজন রাজনীতিক, একজন শিক্ষক প্রকাশ্যে অনেক মন্তব্য করতে পারেন। কিন্তু একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি পারেন না। সেটা শোভনও নয়। একজন বিচারপতি অবসরে যাওয়ার পরও সমাজে তিনি ‘একজন বিচারপতি’ হিসেবেই গণ্য হন। সমাজ তাকে বিশেষ মর্যাদার চোখে দেখে। তিনি সমাজ তথা রাষ্ট্রের বিবেক। সাধারণত কোথাও লেখা থাকে না অবসরে যাওয়ার পর একজন বিচারপতি কী করবেন, কী করবেন না। সমাজ বা রাষ্ট্র তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের এমন সব ‘কর্মকাণ্ড’ করতে দেখি যা অনাকাক্সিক্ষত। আমরা অতীতে একজন বিচারপতিকে দেখেছিলাম, যিনি অবসরের পর রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছিলেন এবং সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এখন আমরা একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে দেখলাম যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত একজনের পক্ষে আইনি লড়াইয়ে দাঁড়াতে। এ ক্ষেত্রে আইন কোনো বাধা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে নৈতিকতার। একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির আইনি পেশায় ফিরে যাওয়া যেমন শোভন নয়, ঠিক তেমনি তার রাজনীতিতে অংশ নেয়াও কাম্য নয়। তবে নিঃসন্দেহে একজন বিচারপতি অবসরের পর তার মেধা, যোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সমাজকে ‘সেবা’ করতে পারেন। একাধিক অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি অবসরের পর আইন কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং সরকারের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়েছিলেন। অথচ সংবিধানের ৯৯(১)-এ বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি বিচারকরূপে দায়িত্ব পালন করিয়া থাকিলে উক্ত পদ হইতে অবসর গ্রহণের বা অপসারিত হইবার পর তিনি কোনো আদালত বা কোনো কর্তৃপক্ষের নিকট ওকালতি বা কার্য করিবেন না এবং বিচার বিভাগীয় বা আধাবিচার বিভাগীয় পদ ব্যতীত প্রজাতন্ত্র কর্মে কোনো লাভজনক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হইবেন না।’ যদিও ৯৯(২)(১)-এ বলা হয়েছে, তিনি আপিল বিভাগে ওকালতি করতে পারবেন। এখানে প্রশ্নটা নৈতিকতার। আইন তাকে সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু নৈতিকতা বলে একটা কথা আছে।
ফিরে আসি বিচারপতি চৌধুরীর প্রসঙ্গে। সাম্প্রতিককালে তিনি এমন ‘বেশ কিছু’ কাজ করেছেন, যা তাকে বিতর্কিতই করেছে। তিনি তার ‘পদের’ প্রতি কোনো সম্মান দেখাননি। গত ৮ ফেব্র“য়ারি তিনি সুপ্রিমকোর্টের মাজার গেটের পাশে রাস্তার ওপর আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘আমি তার (প্রধান বিচারপতি) কোনো আদেশ মানি না। মানব না।’ তিনি প্রধান বিচারপতির পদত্যাগও দাবি করেছিলেন। অতীতে কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এভাবে প্রকাশ্যে সুপ্রিমকোর্টের এলাকার ভেতরে সংবাদ সম্মেলন করেননি। বিচারপতি চৌধুরী করলেন। অতীতে কোনো বিচারপতি প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ দাবি করেননি। এখন বিচারপতি চৌধুরী এ ধরনের দাবি তুলে নতুন একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। বিচার বিভাগের ভাবমূর্তির জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। কিন্তু তার একটি বক্তব্যে আমি অবাক হয়েছি, যখন তিনি সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেছিলেন, প্রধান বিচারপতি সিনহা খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন! কী ভয়ংকর কথা। এ ধরনের কথাবার্তা তো আমরা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মুখে শুনি। একজন বিচারপতির মুখে কি এ ধরনের বক্তব্য শোভা পায়? প্রধান বিচারপতি তো কোনো ‘রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব’ নন। তিনি কেন একটি রাজনৈতিক দলের প্রধানের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবেন? বরং বিচারপতি চৌধুরীর বক্তব্যটিই স্পষ্ট একটি রাজনৈতিক বক্তব্য এবং তা প্রধান বিচারপতিকে বিতর্কিত করার শামিল। এটি কোনো ভালো কাজ নয়। বিচার বিভাগের জন্য একটি খারাপ নজিরও বটে।
ব্যক্তি চৌধুরী আর বিচারপতি চৌধুরীর মধ্যে আমরা অবশ্যই পার্থক্য করব। একজন ব্যক্তি চৌধুরী যদি রাজনৈতিক মিছিলে যান, টিভির টকশোতে রাজনৈতিক বক্তব্য দেন, আমি তাতে অবাক হই না। যে কেউ এ ধরনের বক্তব্য দিতেই পারেন। কিন্তু তিনি যদি একজন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র বিচারপতি হন, আমার আস্থার জায়গাটা তাতে নষ্ট হয়ে যায়। ব্যক্তিগতভাব তার একটি ‘রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা’ থাকতেই পারে। প্রায় প্রত্যেক মানুষেরই তা আছে। কিন্তু বিচারপতি হিসেবে অবসরে যাওয়ার পরও তিনি যখন রাজনৈতিক বক্তব্য দেন, মিছিলে যান, স্বপ্রণোদিত হয়ে টকশোতে যান, তখন আমি হতাশায় পড়ে যাই বৈকি! সমাজের প্রতিটি সেক্টরই তো এখন আস্থাহীনতায় ভুগছে। বুদ্ধিজীবীরাও বিতর্কিত হচ্ছেন। একজন স্বনামধন্য সম্পাদক তার স্বীকারোক্তির জন্য বড় বিতর্কের জন্ম হয়েছে অতি সম্প্রতি। তাই বলে বিচারপতিরা? হোন না তিনি অবসরপ্রাপ্ত? তাতে কী? বিচারপতিরাই তো আমাদের আস্থার জায়গাটা নিশ্চিত করেছেন। রাষ্ট্র যখন অমানবিক হয়, তখন তো আমরা আশ্রয় খুঁজি বিচারপতিদের কাছেই! যতদূর মনে পড়ে জাতীয় সংসদেও বিচারপতি চৌধুরীর কোনো কোনো বক্তব্য ও সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। এবং কোনো কোনো সংসদ সদস্য তাকে ‘স্যাডিস্ট’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেছিলেন। সেদিন একটি অনুষ্ঠানে একজন সাবেক প্রধান বিচারপতিও শ্রোতা-দর্শকদের সেই বক্তব্যটি স্মরণ করিয়ে দিলেন! এতে করে কি বিচারপতি চৌধুরীর মান-মর্যাদা বাড়ল, না কমল? একজন বিচারপতি, তিনি অবসরে যাওয়ার পরও সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকবেন, এটা যেমন তিনি নিজে চান, তেমনি আমার বিশ্বাস এ দেশের সাধারণ মানুষও তা চায়। একজন বিচারপতিকে অন্য কারও সঙ্গে আমি তুলনা করতে চাই না। পারিও না।
বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীকে নিয়ে যে ‘বিতর্ক’, তার অবসান হলে আমি খুশি হতাম। কিন্তু এ বিষয়টি থেমে থাকবে বলে মনে হয় না। ইতিমধ্যে, এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত, আরও দুুটি ঘটনা ঘটেছে। সুপ্রিমকোর্টের একজন আইনজীবী রাষ্ট্রপতির কাছে লেখা একটি চিঠিতে বিচারপতি চৌধুরীর ‘জাজশিপ’ প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত না নিলে তিনি উচ্চ আদালতে একটি রিট করবেন। দ্বিতীয় একটি ঘটনায় অপর এক আইনজীবী দুদকে বিচারপতি চৌধুরীর বিরুদ্ধে তথ্য গোপন করার অভিযোগ এনেছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, বিচারপতি চৌধুরী একই সঙ্গে বাংলাদেশ ও ব্রিটেনের নাগরিক। তিনি এ তথ্যটি ‘গোপন’ করে বিচারপতি হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন, যা প্রচলিত আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ওই আইনজীবী তার আবেদনে উল্লেখ করেছেন। এখানে যে প্রশ্নটি আসে তা হচ্ছে, কোনো বিদেশী নাগরিক, যিনি একই সঙ্গে বাংলাদেশের নাগরিক, সাংবিধানিক কোনো পদে নিয়োজিত হতে পারেন কি-না? আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৫(২)-এ বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক না হলে তিনি বিচারক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না। এ অনুচ্ছেদ বিচারপতি চৌধুরীর ক্ষেত্রে পুরোপুরি প্রযোজ্য নয়। কারণ তিনি বাংলাদেশেরও নাগরিক! সংবিধানের কোথাও দ্বৈত নাগরিকের ক্ষেত্রে তিনি বিচারপতি হতে পারবেন কী পারবেন না- এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কোনো কথা বলা হয়নি। এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতের কোনো রুলিং আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে সুপ্রিম কোর্টে বেশ কয়েকজন আইনজীবী রয়েছেন, যাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে।
বিচারপতি চৌধুরীকে নিয়ে যে ‘বিতর্ক’, তার অবসান হওয়া বাঞ্ছনীয়। তিনি এরপর আর অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো বক্তব্য দেবেন না, এটাই প্রত্যাশা করি। সেই সঙ্গে এও প্রত্যাশা করি, যে রায়গুলো এখনও লেখা শেষ হয়নি তা তিনি ‘দ্রুত’ শেষ করবেন এবং নথিসহ সব কাগজপত্র জমা দেবেন। তিনি যত দ্রুত এ কাজটি করবেন, ততই তার জন্য মঙ্গল। তিনি যত দেরি করবেন, ততই জটিলতা বাড়বে। সংবিধান লংঘন কিংবা মানহানির ঘটনায় তিনি অভিযুক্ত হতে পারেন। তিনি ‘প্রধান বিচারপতির আদেশ মানবেন না’- এ কথা তিনি বলতে পারেন না। প্রধান বিচারপতি একজন ব্যক্তি নন, একটি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানকে ‘বিতর্কিত’ করা অন্যায়। ন্যূনতম সৌজন্যবোধ থাকলে একজন সিনিয়র বিচারপতি এ ধরনের মন্তব্য করতে পারেন না।
তবে অবসরে গিয়ে রায় লেখা কতটুকু সাংবিধানিক, কিংবা কতটুকু যৌক্তিক, এ প্রশ্নকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। অনেক বিচারপতিই এ কাজটি করেন। কিন্তু কখনও এ বিষয়টি প্রকাশ্যে আসেনি। প্রধান বিচারপতি এ বিষয়টি সামনে নিয়ে এলেন। স্পষ্টতই তিনি উচ্চ আদালতে একটি সংস্কার চন। এটা মঙ্গল ও ন্যায়পরায়ণতার স্বার্থে যুক্তিসঙ্গত। একটি সংক্ষিপ্ত রায় হয়ে গেল। পূর্ণ রায় একজন নাগরিক পেলেন ১৫ মাস পর- এটা তো হতে পারে না? এটা তো একজন নাগরিকের অধিকার খর্বের শামিল। পূর্ণ রায় লিখতে একজন বিচারপতি কিছুটা সময় নিতেই পারেন। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তিনি মাসের পর মাস সময় নেবেন। প্রধান বিচারপতি এ ব্যাপারে একটি সংস্কার আনতে চাচ্ছেন। আমি তাকে স্বাগত জানাই। অতীতে কোনো প্রধান বিচারপতিই এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেননি। তবে প্রধান বিচারপতির এ বক্তব্য নিয়ে ‘রাজনীতি’ হোক এটা আমরা চাই না। তার বক্তব্যের ভেতরে ‘অন্য কোনো কিছুর গন্ধ’ খোঁজাও ঠিক নয়। অতীতের কোনো রায়ের ক্ষেত্রেও এ বক্তব্যকে বিবেচনায় নেয়া যাবে না। বর্তমান প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগকে সঠিক রাস্তায় নিয়ে যেতে চাইছেন বলে সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী যে মন্তব্য করেছেন, আমি মনে করি অনেকেই এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত হবেন। উচ্চ আদালত নিয়ে আমরা আর বিতর্ক চাই না। প্রধান বিচারপতি একটি প্রতিষ্ঠানও বটে। এ ‘প্রতিষ্ঠান’কে বিতর্কিত করা কখনও কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না Daily Jugantor 13.02.16
বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত একজন ব্যক্তিত্ব। আপিল বিভাগে থাকার সময়ও তিনি আলোচিত ছিলেন নানা কারণে। তিনি সম্ভবত ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী এবং এক সময় লন্ডনে আইন পেশায়ও নিয়োজিত ছিলেন। এবং স্মরণ করছি, লন্ডন থাকাকালীন আমার সঙ্গে তার একবার দেখাও হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে কখনও তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। নিঃসন্দেহে একজন ‘সাহসী’ বিচারপতি তিনি। অনেক রায় তিনি দিয়েছেন, যা তাকে আলোচনায় এনেছে বারবার।
বিতর্কের সূত্রপাত হয় প্রধান বিচারপতির একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। গত ১৯ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি পদে দায়িত্ব নেয়ার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে দেয়া এক বাণীতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছিলেন, ‘কোনো কোনো বিচারপতি অবসর গ্রহণ করার দীর্ঘদিন পর রায় লেখা অব্যাহত রাখেন, যা আইন ও সংবিধানপরিপন্থী।’ এর বিরোধিতা করেন আপিল বিভাগ থেকে অবসরে যাওয়া বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। ঘটনাটা এখানেই শেষ হতে পারত। অথবা তিনি প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য না রেখে তার কাছে যে রায়গুলো লেখা বাকি ছিল, তা জমা দিতে পারতেন। এতে করে সাধারণ মানুষ এতকিছু জানত না। কিন্তু বিষয়টিকে তিনি প্রকাশ্যে নিয়ে এলেন। শুধু তাই নয়, তিনি প্রকাশ্যে এমন সব মন্তব্য করলেন যা বিচারপতি হিসেবে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। একজন রাজনীতিক, একজন শিক্ষক প্রকাশ্যে অনেক মন্তব্য করতে পারেন। কিন্তু একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি পারেন না। সেটা শোভনও নয়। একজন বিচারপতি অবসরে যাওয়ার পরও সমাজে তিনি ‘একজন বিচারপতি’ হিসেবেই গণ্য হন। সমাজ তাকে বিশেষ মর্যাদার চোখে দেখে। তিনি সমাজ তথা রাষ্ট্রের বিবেক। সাধারণত কোথাও লেখা থাকে না অবসরে যাওয়ার পর একজন বিচারপতি কী করবেন, কী করবেন না। সমাজ বা রাষ্ট্র তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের এমন সব ‘কর্মকাণ্ড’ করতে দেখি যা অনাকাক্সিক্ষত। আমরা অতীতে একজন বিচারপতিকে দেখেছিলাম, যিনি অবসরের পর রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছিলেন এবং সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এখন আমরা একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে দেখলাম যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত একজনের পক্ষে আইনি লড়াইয়ে দাঁড়াতে। এ ক্ষেত্রে আইন কোনো বাধা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে নৈতিকতার। একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির আইনি পেশায় ফিরে যাওয়া যেমন শোভন নয়, ঠিক তেমনি তার রাজনীতিতে অংশ নেয়াও কাম্য নয়। তবে নিঃসন্দেহে একজন বিচারপতি অবসরের পর তার মেধা, যোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সমাজকে ‘সেবা’ করতে পারেন। একাধিক অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি অবসরের পর আইন কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং সরকারের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়েছিলেন। অথচ সংবিধানের ৯৯(১)-এ বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি বিচারকরূপে দায়িত্ব পালন করিয়া থাকিলে উক্ত পদ হইতে অবসর গ্রহণের বা অপসারিত হইবার পর তিনি কোনো আদালত বা কোনো কর্তৃপক্ষের নিকট ওকালতি বা কার্য করিবেন না এবং বিচার বিভাগীয় বা আধাবিচার বিভাগীয় পদ ব্যতীত প্রজাতন্ত্র কর্মে কোনো লাভজনক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হইবেন না।’ যদিও ৯৯(২)(১)-এ বলা হয়েছে, তিনি আপিল বিভাগে ওকালতি করতে পারবেন। এখানে প্রশ্নটা নৈতিকতার। আইন তাকে সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু নৈতিকতা বলে একটা কথা আছে।
ফিরে আসি বিচারপতি চৌধুরীর প্রসঙ্গে। সাম্প্রতিককালে তিনি এমন ‘বেশ কিছু’ কাজ করেছেন, যা তাকে বিতর্কিতই করেছে। তিনি তার ‘পদের’ প্রতি কোনো সম্মান দেখাননি। গত ৮ ফেব্র“য়ারি তিনি সুপ্রিমকোর্টের মাজার গেটের পাশে রাস্তার ওপর আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘আমি তার (প্রধান বিচারপতি) কোনো আদেশ মানি না। মানব না।’ তিনি প্রধান বিচারপতির পদত্যাগও দাবি করেছিলেন। অতীতে কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এভাবে প্রকাশ্যে সুপ্রিমকোর্টের এলাকার ভেতরে সংবাদ সম্মেলন করেননি। বিচারপতি চৌধুরী করলেন। অতীতে কোনো বিচারপতি প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ দাবি করেননি। এখন বিচারপতি চৌধুরী এ ধরনের দাবি তুলে নতুন একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। বিচার বিভাগের ভাবমূর্তির জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। কিন্তু তার একটি বক্তব্যে আমি অবাক হয়েছি, যখন তিনি সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেছিলেন, প্রধান বিচারপতি সিনহা খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন! কী ভয়ংকর কথা। এ ধরনের কথাবার্তা তো আমরা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মুখে শুনি। একজন বিচারপতির মুখে কি এ ধরনের বক্তব্য শোভা পায়? প্রধান বিচারপতি তো কোনো ‘রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব’ নন। তিনি কেন একটি রাজনৈতিক দলের প্রধানের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবেন? বরং বিচারপতি চৌধুরীর বক্তব্যটিই স্পষ্ট একটি রাজনৈতিক বক্তব্য এবং তা প্রধান বিচারপতিকে বিতর্কিত করার শামিল। এটি কোনো ভালো কাজ নয়। বিচার বিভাগের জন্য একটি খারাপ নজিরও বটে।
ব্যক্তি চৌধুরী আর বিচারপতি চৌধুরীর মধ্যে আমরা অবশ্যই পার্থক্য করব। একজন ব্যক্তি চৌধুরী যদি রাজনৈতিক মিছিলে যান, টিভির টকশোতে রাজনৈতিক বক্তব্য দেন, আমি তাতে অবাক হই না। যে কেউ এ ধরনের বক্তব্য দিতেই পারেন। কিন্তু তিনি যদি একজন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র বিচারপতি হন, আমার আস্থার জায়গাটা তাতে নষ্ট হয়ে যায়। ব্যক্তিগতভাব তার একটি ‘রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা’ থাকতেই পারে। প্রায় প্রত্যেক মানুষেরই তা আছে। কিন্তু বিচারপতি হিসেবে অবসরে যাওয়ার পরও তিনি যখন রাজনৈতিক বক্তব্য দেন, মিছিলে যান, স্বপ্রণোদিত হয়ে টকশোতে যান, তখন আমি হতাশায় পড়ে যাই বৈকি! সমাজের প্রতিটি সেক্টরই তো এখন আস্থাহীনতায় ভুগছে। বুদ্ধিজীবীরাও বিতর্কিত হচ্ছেন। একজন স্বনামধন্য সম্পাদক তার স্বীকারোক্তির জন্য বড় বিতর্কের জন্ম হয়েছে অতি সম্প্রতি। তাই বলে বিচারপতিরা? হোন না তিনি অবসরপ্রাপ্ত? তাতে কী? বিচারপতিরাই তো আমাদের আস্থার জায়গাটা নিশ্চিত করেছেন। রাষ্ট্র যখন অমানবিক হয়, তখন তো আমরা আশ্রয় খুঁজি বিচারপতিদের কাছেই! যতদূর মনে পড়ে জাতীয় সংসদেও বিচারপতি চৌধুরীর কোনো কোনো বক্তব্য ও সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। এবং কোনো কোনো সংসদ সদস্য তাকে ‘স্যাডিস্ট’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেছিলেন। সেদিন একটি অনুষ্ঠানে একজন সাবেক প্রধান বিচারপতিও শ্রোতা-দর্শকদের সেই বক্তব্যটি স্মরণ করিয়ে দিলেন! এতে করে কি বিচারপতি চৌধুরীর মান-মর্যাদা বাড়ল, না কমল? একজন বিচারপতি, তিনি অবসরে যাওয়ার পরও সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকবেন, এটা যেমন তিনি নিজে চান, তেমনি আমার বিশ্বাস এ দেশের সাধারণ মানুষও তা চায়। একজন বিচারপতিকে অন্য কারও সঙ্গে আমি তুলনা করতে চাই না। পারিও না।
বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীকে নিয়ে যে ‘বিতর্ক’, তার অবসান হলে আমি খুশি হতাম। কিন্তু এ বিষয়টি থেমে থাকবে বলে মনে হয় না। ইতিমধ্যে, এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত, আরও দুুটি ঘটনা ঘটেছে। সুপ্রিমকোর্টের একজন আইনজীবী রাষ্ট্রপতির কাছে লেখা একটি চিঠিতে বিচারপতি চৌধুরীর ‘জাজশিপ’ প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত না নিলে তিনি উচ্চ আদালতে একটি রিট করবেন। দ্বিতীয় একটি ঘটনায় অপর এক আইনজীবী দুদকে বিচারপতি চৌধুরীর বিরুদ্ধে তথ্য গোপন করার অভিযোগ এনেছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, বিচারপতি চৌধুরী একই সঙ্গে বাংলাদেশ ও ব্রিটেনের নাগরিক। তিনি এ তথ্যটি ‘গোপন’ করে বিচারপতি হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন, যা প্রচলিত আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ওই আইনজীবী তার আবেদনে উল্লেখ করেছেন। এখানে যে প্রশ্নটি আসে তা হচ্ছে, কোনো বিদেশী নাগরিক, যিনি একই সঙ্গে বাংলাদেশের নাগরিক, সাংবিধানিক কোনো পদে নিয়োজিত হতে পারেন কি-না? আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৫(২)-এ বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক না হলে তিনি বিচারক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না। এ অনুচ্ছেদ বিচারপতি চৌধুরীর ক্ষেত্রে পুরোপুরি প্রযোজ্য নয়। কারণ তিনি বাংলাদেশেরও নাগরিক! সংবিধানের কোথাও দ্বৈত নাগরিকের ক্ষেত্রে তিনি বিচারপতি হতে পারবেন কী পারবেন না- এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কোনো কথা বলা হয়নি। এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতের কোনো রুলিং আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে সুপ্রিম কোর্টে বেশ কয়েকজন আইনজীবী রয়েছেন, যাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে।
বিচারপতি চৌধুরীকে নিয়ে যে ‘বিতর্ক’, তার অবসান হওয়া বাঞ্ছনীয়। তিনি এরপর আর অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো বক্তব্য দেবেন না, এটাই প্রত্যাশা করি। সেই সঙ্গে এও প্রত্যাশা করি, যে রায়গুলো এখনও লেখা শেষ হয়নি তা তিনি ‘দ্রুত’ শেষ করবেন এবং নথিসহ সব কাগজপত্র জমা দেবেন। তিনি যত দ্রুত এ কাজটি করবেন, ততই তার জন্য মঙ্গল। তিনি যত দেরি করবেন, ততই জটিলতা বাড়বে। সংবিধান লংঘন কিংবা মানহানির ঘটনায় তিনি অভিযুক্ত হতে পারেন। তিনি ‘প্রধান বিচারপতির আদেশ মানবেন না’- এ কথা তিনি বলতে পারেন না। প্রধান বিচারপতি একজন ব্যক্তি নন, একটি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানকে ‘বিতর্কিত’ করা অন্যায়। ন্যূনতম সৌজন্যবোধ থাকলে একজন সিনিয়র বিচারপতি এ ধরনের মন্তব্য করতে পারেন না।
তবে অবসরে গিয়ে রায় লেখা কতটুকু সাংবিধানিক, কিংবা কতটুকু যৌক্তিক, এ প্রশ্নকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। অনেক বিচারপতিই এ কাজটি করেন। কিন্তু কখনও এ বিষয়টি প্রকাশ্যে আসেনি। প্রধান বিচারপতি এ বিষয়টি সামনে নিয়ে এলেন। স্পষ্টতই তিনি উচ্চ আদালতে একটি সংস্কার চন। এটা মঙ্গল ও ন্যায়পরায়ণতার স্বার্থে যুক্তিসঙ্গত। একটি সংক্ষিপ্ত রায় হয়ে গেল। পূর্ণ রায় একজন নাগরিক পেলেন ১৫ মাস পর- এটা তো হতে পারে না? এটা তো একজন নাগরিকের অধিকার খর্বের শামিল। পূর্ণ রায় লিখতে একজন বিচারপতি কিছুটা সময় নিতেই পারেন। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তিনি মাসের পর মাস সময় নেবেন। প্রধান বিচারপতি এ ব্যাপারে একটি সংস্কার আনতে চাচ্ছেন। আমি তাকে স্বাগত জানাই। অতীতে কোনো প্রধান বিচারপতিই এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেননি। তবে প্রধান বিচারপতির এ বক্তব্য নিয়ে ‘রাজনীতি’ হোক এটা আমরা চাই না। তার বক্তব্যের ভেতরে ‘অন্য কোনো কিছুর গন্ধ’ খোঁজাও ঠিক নয়। অতীতের কোনো রায়ের ক্ষেত্রেও এ বক্তব্যকে বিবেচনায় নেয়া যাবে না। বর্তমান প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগকে সঠিক রাস্তায় নিয়ে যেতে চাইছেন বলে সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী যে মন্তব্য করেছেন, আমি মনে করি অনেকেই এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত হবেন। উচ্চ আদালত নিয়ে আমরা আর বিতর্ক চাই না। প্রধান বিচারপতি একটি প্রতিষ্ঠানও বটে। এ ‘প্রতিষ্ঠান’কে বিতর্কিত করা কখনও কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না Daily Jugantor 13.02.16
Dear Sir,
ReplyDeleteTotal parliamentary seats are 564/664-which one is correct.