পহেলা ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের নবনির্বাচিত সংসদের অধিবেশন শুরু হওয়ার মধ্য
দিয়ে দেশটিতে একটি নবযুগের সূচনা ঘটল। দীর্ঘ ৫৪ বছর দেশটি শাসন করেছে
সেনাবাহিনী ও সেনাবাহিনী-সমর্থিত রাজনৈতিক শক্তি। ৮ নভেম্বরের (২০১৫)
নির্বাচন এই দৃশ্যপট বদলে দেয়। ৬৬৪ সদস্যবিশিষ্ট পার্লামেন্টে অং সান সুচির
নেতৃত্বাধীন এনএলডির সদস্য রয়েছে ৩৯০ জন। আর সেনাবাহিনীর সরাসরি
প্রতিনিধিত্ব রয়েছে ১৬৬ জনের। পার্লামেন্টে সেনা-সমর্থিত ইউএসডিপির সদস্য
রয়েছে মাত্র ৪১ জন। ১৯৯০ সালের নির্বাচনেও অং সান সুচির দল বিজয়ী হয়েছিল।
কিন্তু সেনাবাহিনী সুচিকে ক্ষমতা দেয়নি। আজ দৃশ্যপট ভিন্ন। সেনাবাহিনীর
মনোভাবেও পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বরাজনীতি তথা আঞ্চলিক রাজনীতিতেও ব্যাপক
পরিবর্তন এসেছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এখন গণতন্ত্রের ব্যাপারে আরও বেশি
‘কমিটেড’। ফলে আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ‘চাপ’ থাকায়
এই নির্বাচন বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে সংশয় যে নেই, তাও বলা যাবে
না। সংশয়, উদ্বেগ এবং নানা প্রশ্নও আছে।
অং সান সুচি বলেছেন, ‘তার ভূমিকা হবে প্রেসিডেন্টের ঊর্ধ্বে।’ তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন সত্য, কিন্তু সংবিধানের বাইরে তিনি যেতে পারবেন না। সংবিধান তিনি পরিবর্তনও করতে পারবেন না। এর অর্থ হচ্ছে, সংবিধান তাকে মানতে হবে এবং সংবিধান মানলে তাকে বর্তমান প্রেসিডেন্টকে মানতে হবে। ফলে সুচি যদি ‘জোর করে’ কিছু করতে চান, তাহলে সংকট ঘনীভূত হবে এবং তাতে করে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তিনি বিবাদে জড়িয়ে যাবেন, যা মিয়ানমারের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্য কোনো ভালো খবর বয়ে আনবে না। তাহলে তার ভূমিকা কী হবে? তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। কারণ সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর পদটি বিলুপ্ত হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী মিয়ানমারে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার বিদ্যমান। সমস্যাটা এখানেই। সুচি প্রেসিডেন্ট হতে পারছেন না। তাকে একজন আস্থাভাজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করতে হবে। তাহলে তার ভূমিকাটা কী হবে? তিনি পর্দার অন্তরালে থেকে ক্ষমতা পরিচালনা করবেন। তার ভূমিকাটি হবে অনেকটা ভারতের সোনিয়া গান্ধীর মতো। সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রী না হয়ে মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। কিন্তু মূল ক্ষমতা ছিল তার কাছে। এখন সুচির ভূমিকা হবে সোনিয়া গান্ধীর মতো। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে এই মুহূর্তে তিনি প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী কোনোটাই হতে পারছেন না। সংবিধান সংশোধনে সেনাবাহিনী সমর্থন দেবে, এটা মনে হয় না।
তবে নির্বাচনের আগে মানুষ সুচিকে যেভাবে দেখেছে, নির্বাচনের পর তাকে দেখছে ভিন্নভাবে। তিনি বিদেশী গণমাধ্যমকে ইন্টারভিউ দিয়ে যেভাবে নিজের মনোভাবকে তুলে ধরছেন, তাতে করে তার মধ্যে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের প্রকাশ ঘটছে। অথচ তার উচিত ছিল একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা, ঐক্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেয়া। এটা না করে তিনি এক ধরনের ‘হুমকির সুরে’ সরকার পরিচালনার কথা বলছেন। গণতন্ত্রের নামে এ ধরনের কর্তৃত্ববাদী আচরণ আমরা কোনো কোনো দেশে লক্ষ করি। মালয়েশিয়ায় ক্ষমতাসীন জোট গণতন্ত্রের নামে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী আচরণের জন্ম দিয়েছে। সিঙ্গাপুরে পিপলস অ্যাকশন পার্টি একদলীয় শাসন বজায় রয়েছে। যদিও জনগণই তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে। কম্বোডিয়ায় সমাজতন্ত্র-পরবর্তী কাঠামোয় একদলীয় (পিপলস পার্টি) শাসন বিদ্যমান। থাইল্যান্ডে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করলেও সেখানে থাকসিন সিনাওয়াত্রার দলের প্রভাব অনেক বেশি। তার নামেই তার বোন ইংলাক সিনাওয়াত্রা নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন এবং সরকারও গঠন করেছিলেন। সমাজতন্ত্র-পরবর্তী মধ্য এশিয়ার প্রতিটি দেশে গণতন্ত্রের নামে একদলীয় কর্তৃত্ব বজায় রয়েছে। আমরা বেলারুশের কথাও বলতে পারি। সেখানে নির্বাচন হচ্ছে বটে, কিন্তু কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচনী ফলাফল ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে নেয়া হচ্ছে। অং সান সুচিও কি এ পথেই যাচ্ছেন? ক্ষমতা নিতে হলে তাকে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সংবিধান সংশোধনের একটি উদ্যোগ তিনি নিতে পারেন। কিন্তু আগেই বলেছি, সেনাবাহিনী এই উদ্যোগকে সমর্থন করবে- এটা মনে হয় না।
জনগণই যে ‘সব ক্ষমতার উৎস’ মিয়ানমারের নির্বাচন এ সত্যটা আবার প্রমাণ করেছিল। এ নির্বাচন পার্শ্ববর্তী দেশ থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের সাংবিধানিক ধারাকে নিঃসন্দেহে উৎসাহিত করবে। দুঃখের কথা, এই প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের সংসদে কোনো মুসলিম প্রতিনিধিত্ব নেই। ফলে মুসলমানদের মাঝে ক্ষোভ ও অসন্তোষ আরও দানা বাঁধবে। উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা মুসলিম নিধন ও উৎখাতে এতে আরও উৎসাহিত হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপকতা আরও বাড়বে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত সংসদের মেয়াদ ৫ বছর। অর্থাৎ ২০২১ সাল পর্যন্ত এই সংসদ টিকে থাকার কথা। সময়টা অনেক লম্বা। নতুন সংসদ গঠিত হওয়ার পর এখন অন্তত এক মাস সময় থাকবে হাতে। সুচি এই সময়টা কাজে লাগাবেন সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটি ‘সমঝোতায়’ যেতে। সম্ভবত এটাই তার জন্য শেষ সময়। ২০১০ সালেও একটি নির্বাচন হয়েছিল। তার দল ঠিক সময়মতো নিবন্ধন করতে না পারায় অথবা নিবন্ধন না করায় ৫ বছর পিছিয়ে গিয়েছিলেন সুচি। এবারও যদি তিনি ভুল করেন, তাহলে তাকে অপেক্ষা করতে হবে ২০২১ সাল পর্যন্ত। সময়টা অনেক বেশি। তখন সুচির বয়স গিয়ে দাঁড়াবে ৭৪। এরপর তার পক্ষে আর রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা সম্ভব হবে না। সে কারণেই তিনি মিয়ানমারের সমাজে সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে মেনে নেবেন। আমরা তার বাস্তবমুখী একটি সিদ্ধান্তই আশা করছি।
এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। বাংলাদেশের জন্য মিয়ানমারে একটি বন্ধুপ্রতিম সরকার থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির জন্য মিয়ানমার আমাদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সড়কপথ চালু হলে এ সড়ক একদিকে যেমন আমাদের চীনের সঙ্গে সংযোগ ঘটাবে, অন্যদিকে আমরা আমাদের পণ্য নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও যেতে পারব। আমাদের পণ্যের বিশাল এক বাজার সৃষ্টি হবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে উভয় দেশই বিমসটেক (BIMSTEC,, পরিবর্তিত নাম BBIMSTEC) ও BCIM জোটের সদস্য। যদিও প্রস্তাবিত BCIM জোটটি এখনও আলোর মুখ দেখেনি। ভুটান ও নেপাল বিমসটেক জোটে যোগ দেয়ায় এ জোটটি শক্তিশালী হয়েছে। এই জোটের উদ্দেশ্য বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলংকা ও থাইল্যান্ডে একটি মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক সম্প্রসারণে চট্টগ্রামে মিয়ানমারের কাঁচামালভিত্তিক শিল্পকারখানা স্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষিভিত্তিক মিয়ানমারে বাংলাদেশী সারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন চট্টগ্রাম এলাকায় বেশকিছু সার কারখানা স্থাপন করে বাংলাদেশ মিয়ানমারে সার রফতানি করতে পারে। মিয়ানমারের আকিয়াব ও মংডুর আশপাশের অঞ্চলে প্রচুর বাঁশ, কাঠ ও চুনাপাথর পাওয়া যায়। এসব কাঁচামালের ওপর ভিত্তি করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সিমেন্ট ও কাগজ শিল্প বিকশিত হতে পারে। মিয়ানমারে প্রচুর জমি অনাবাদি রয়েছে। এসব জমি লিজ নিয়ে বাংলাদেশের জন্য চাল উৎপাদনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। মান্দালয়-ম্যাগওয়ের তুলা আমদানি করতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তার ক্রমবর্ধিষ্ণু গার্মেন্ট সেক্টরের কাঁচামাল হিসেবে তুলা মিয়ানমারের এই অঞ্চল থেকে আমদানি করতে পারে। গবাদিপশু আমদানি করার সম্ভাবনাও রয়েছে। বাংলাদেশীরা মিয়ানমারে গবাদিপশুর খামারও গড়ে তুলতে পারে। মিয়ানমারের সেগুন কাঠ পৃথিবী বিখ্যাত। আমাদের ফার্নিচার শিল্পের চাহিদা মেটাতে পারে এই সেগুন কাঠ, যার ওপর ভিত্তি করে আমরা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে আমাদের ফার্নিচার শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারি। মিয়ানমার মূল্যবান পাথর যেমন- রুবি, জেড, বোম আর মার্বেলে সমৃদ্ধ। এসব মূল্যবান পাথর আমাদের জুয়েলারি শিল্পকে সমৃদ্ধ করে ভ্যালু-অ্যাডিশনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক হতে পারে। ভারত, মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও চীনের সমন্বয়ে যে আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা বলা হচ্ছে (বিসিআইএম), সেখানেও বাংলাদেশের স্বার্থ রয়েছে। সুতরাং মিয়ানমারে যে সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে, তার সঙ্গে সম্পর্ক সম্প্রসারণ করা আমাদের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
তবে মিয়ানমারকে নিয়ে প্রশ্ন অনেক। সে দেশে একটি নির্বাচন হয়েছে বটে; কিন্তু এই নির্বাচন সত্যিকার অর্থে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্মের সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করে না। দীর্ঘ ৫৪ বছর সেখানে যে সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে, তা হুট করে ভেঙে ফেলা যাবে না। রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর যে প্রভাব রয়েছে, তা হ্রাস করা যাবে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে সেনাবাহিনীর একটি নির্বাচন দেয়া প্রয়োজন ছিল। সেটা তারা দিয়েছে। কিন্তু তারা ব্যারাকে ফিরে যাবে, এটা আমার মনে হয় না। মিসরের মতো একটি পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হতে পারে মিয়ানমারে। আরব বসন্ত মিসরে পরিবর্তন ডেকে এনেছিল। সেনানিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভেঙে পড়েছিল কায়রোর ‘তেহরির স্কোয়ারে’ দীর্ঘ ১৭ দিনের গণঅবস্থানের কারণে। তার পরের ঘটনা সবাই জানেন। হোসনি মোবারকের ক্ষমতা হস্তান্তর, একটি নির্বাচন, নির্বাচনে ড. মুরসির বিজয় (জুন ২০১২) এবং পরবর্তী সময়ে (২০১৩) সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফিল্ড মার্শাল সিসির ক্ষমতা গ্রহণ। ‘আরব বসন্ত’ মিসরের জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। এখন মিয়ানমার কি সেদিকেই হাঁটবে? সেনাবাহিনী নির্বাচন ও সংসদকে মেনে নিয়েছে। কিন্তু সব ‘সুযোগ-সুবিধা’ তারা ছেড়ে দেবে, এটা মনে হয় না। এক্ষেত্রে সুচিকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটা সহাবস্থানে যেতে হবে। নতুবা তিনি ‘পর্দার অন্তরালে’ থেকে ক্ষমতা পরিচালনা করতে পারবেন না। এর অর্থ পরিষ্কার- সেনাসমর্থিত একজনকেই তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নেবেন এবং সমর্থন করবেন। তিনি নিজে কোনো ‘প্রার্থী’ দেবেন না। এর মাধ্যমে তিনি সেনাবাহিনীর আস্থা অর্জন করতে পারেন। সরকারে তার ‘ভূমিকা’ নিয়েও প্রশ্ন থাকবে এবং প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তিনি একটি ‘পদ’ পেতে পারেন।
মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস অনেক পুরনো। নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন বিচ্ছিন্নতাবাদী ৮টি গ্রুপের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু চুক্তির বাইরে আরও বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ রয়েছে। এদেরও চুক্তির আওতায় আনা দরকার। অর্থনৈতিক সংস্কারটা খুবই জরুরি। বৈদেশিক বিনিয়োগ দীর্ঘদিন সে দেশে বন্ধ ছিল। এখন এটি উন্মুক্ত। বিশেষ করে গভীর সমুদ্রে বিপুল জ্বালানি সম্পদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ এলেই এই সম্পদ আহরণ সম্ভব। মার্কিন বিনিয়োগকারীরা মিয়ানমারে আসতে শুরু করেছেন। এখন ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতির’ কারণে মার্কিন বিনিয়োগকারীরা আরও উৎসাহিত হবেন। রোহিঙ্গা সমস্যা বহির্বিশ্বে মিয়ানমারের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট করেছে। রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে এক অমানবিক জীবন যাপন করছে। সুচি এদের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি উগ্র বৌদ্ধ মানসিকতায় নিজেকে সম্পর্কিত করেছিলেন। উদ্দেশ্য পরিষ্কার- ভোটপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা। সেটা নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু একজন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীর কাছ থেকে মানুষ আরও বেশি কিছু প্রত্যাশা করে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়া, তাদের চলাচলে বাধা-নিষেধ প্রত্যাহার করে নেয়া কিংবা তাদের নিজ বাসভূমে বসবাসের অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। নতুন সরকার এ কাজটি করবে- এটাই মানুষ প্রত্যাশা করে। Dainik Jugantor 09.02.16
অং সান সুচি বলেছেন, ‘তার ভূমিকা হবে প্রেসিডেন্টের ঊর্ধ্বে।’ তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন সত্য, কিন্তু সংবিধানের বাইরে তিনি যেতে পারবেন না। সংবিধান তিনি পরিবর্তনও করতে পারবেন না। এর অর্থ হচ্ছে, সংবিধান তাকে মানতে হবে এবং সংবিধান মানলে তাকে বর্তমান প্রেসিডেন্টকে মানতে হবে। ফলে সুচি যদি ‘জোর করে’ কিছু করতে চান, তাহলে সংকট ঘনীভূত হবে এবং তাতে করে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তিনি বিবাদে জড়িয়ে যাবেন, যা মিয়ানমারের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্য কোনো ভালো খবর বয়ে আনবে না। তাহলে তার ভূমিকা কী হবে? তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। কারণ সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর পদটি বিলুপ্ত হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী মিয়ানমারে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার বিদ্যমান। সমস্যাটা এখানেই। সুচি প্রেসিডেন্ট হতে পারছেন না। তাকে একজন আস্থাভাজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করতে হবে। তাহলে তার ভূমিকাটা কী হবে? তিনি পর্দার অন্তরালে থেকে ক্ষমতা পরিচালনা করবেন। তার ভূমিকাটি হবে অনেকটা ভারতের সোনিয়া গান্ধীর মতো। সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রী না হয়ে মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। কিন্তু মূল ক্ষমতা ছিল তার কাছে। এখন সুচির ভূমিকা হবে সোনিয়া গান্ধীর মতো। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে এই মুহূর্তে তিনি প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী কোনোটাই হতে পারছেন না। সংবিধান সংশোধনে সেনাবাহিনী সমর্থন দেবে, এটা মনে হয় না।
তবে নির্বাচনের আগে মানুষ সুচিকে যেভাবে দেখেছে, নির্বাচনের পর তাকে দেখছে ভিন্নভাবে। তিনি বিদেশী গণমাধ্যমকে ইন্টারভিউ দিয়ে যেভাবে নিজের মনোভাবকে তুলে ধরছেন, তাতে করে তার মধ্যে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের প্রকাশ ঘটছে। অথচ তার উচিত ছিল একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা, ঐক্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেয়া। এটা না করে তিনি এক ধরনের ‘হুমকির সুরে’ সরকার পরিচালনার কথা বলছেন। গণতন্ত্রের নামে এ ধরনের কর্তৃত্ববাদী আচরণ আমরা কোনো কোনো দেশে লক্ষ করি। মালয়েশিয়ায় ক্ষমতাসীন জোট গণতন্ত্রের নামে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী আচরণের জন্ম দিয়েছে। সিঙ্গাপুরে পিপলস অ্যাকশন পার্টি একদলীয় শাসন বজায় রয়েছে। যদিও জনগণই তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে। কম্বোডিয়ায় সমাজতন্ত্র-পরবর্তী কাঠামোয় একদলীয় (পিপলস পার্টি) শাসন বিদ্যমান। থাইল্যান্ডে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করলেও সেখানে থাকসিন সিনাওয়াত্রার দলের প্রভাব অনেক বেশি। তার নামেই তার বোন ইংলাক সিনাওয়াত্রা নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন এবং সরকারও গঠন করেছিলেন। সমাজতন্ত্র-পরবর্তী মধ্য এশিয়ার প্রতিটি দেশে গণতন্ত্রের নামে একদলীয় কর্তৃত্ব বজায় রয়েছে। আমরা বেলারুশের কথাও বলতে পারি। সেখানে নির্বাচন হচ্ছে বটে, কিন্তু কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচনী ফলাফল ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে নেয়া হচ্ছে। অং সান সুচিও কি এ পথেই যাচ্ছেন? ক্ষমতা নিতে হলে তাকে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সংবিধান সংশোধনের একটি উদ্যোগ তিনি নিতে পারেন। কিন্তু আগেই বলেছি, সেনাবাহিনী এই উদ্যোগকে সমর্থন করবে- এটা মনে হয় না।
জনগণই যে ‘সব ক্ষমতার উৎস’ মিয়ানমারের নির্বাচন এ সত্যটা আবার প্রমাণ করেছিল। এ নির্বাচন পার্শ্ববর্তী দেশ থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের সাংবিধানিক ধারাকে নিঃসন্দেহে উৎসাহিত করবে। দুঃখের কথা, এই প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের সংসদে কোনো মুসলিম প্রতিনিধিত্ব নেই। ফলে মুসলমানদের মাঝে ক্ষোভ ও অসন্তোষ আরও দানা বাঁধবে। উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা মুসলিম নিধন ও উৎখাতে এতে আরও উৎসাহিত হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপকতা আরও বাড়বে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত সংসদের মেয়াদ ৫ বছর। অর্থাৎ ২০২১ সাল পর্যন্ত এই সংসদ টিকে থাকার কথা। সময়টা অনেক লম্বা। নতুন সংসদ গঠিত হওয়ার পর এখন অন্তত এক মাস সময় থাকবে হাতে। সুচি এই সময়টা কাজে লাগাবেন সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটি ‘সমঝোতায়’ যেতে। সম্ভবত এটাই তার জন্য শেষ সময়। ২০১০ সালেও একটি নির্বাচন হয়েছিল। তার দল ঠিক সময়মতো নিবন্ধন করতে না পারায় অথবা নিবন্ধন না করায় ৫ বছর পিছিয়ে গিয়েছিলেন সুচি। এবারও যদি তিনি ভুল করেন, তাহলে তাকে অপেক্ষা করতে হবে ২০২১ সাল পর্যন্ত। সময়টা অনেক বেশি। তখন সুচির বয়স গিয়ে দাঁড়াবে ৭৪। এরপর তার পক্ষে আর রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা সম্ভব হবে না। সে কারণেই তিনি মিয়ানমারের সমাজে সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে মেনে নেবেন। আমরা তার বাস্তবমুখী একটি সিদ্ধান্তই আশা করছি।
এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। বাংলাদেশের জন্য মিয়ানমারে একটি বন্ধুপ্রতিম সরকার থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির জন্য মিয়ানমার আমাদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সড়কপথ চালু হলে এ সড়ক একদিকে যেমন আমাদের চীনের সঙ্গে সংযোগ ঘটাবে, অন্যদিকে আমরা আমাদের পণ্য নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও যেতে পারব। আমাদের পণ্যের বিশাল এক বাজার সৃষ্টি হবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে উভয় দেশই বিমসটেক (BIMSTEC,, পরিবর্তিত নাম BBIMSTEC) ও BCIM জোটের সদস্য। যদিও প্রস্তাবিত BCIM জোটটি এখনও আলোর মুখ দেখেনি। ভুটান ও নেপাল বিমসটেক জোটে যোগ দেয়ায় এ জোটটি শক্তিশালী হয়েছে। এই জোটের উদ্দেশ্য বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলংকা ও থাইল্যান্ডে একটি মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক সম্প্রসারণে চট্টগ্রামে মিয়ানমারের কাঁচামালভিত্তিক শিল্পকারখানা স্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষিভিত্তিক মিয়ানমারে বাংলাদেশী সারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন চট্টগ্রাম এলাকায় বেশকিছু সার কারখানা স্থাপন করে বাংলাদেশ মিয়ানমারে সার রফতানি করতে পারে। মিয়ানমারের আকিয়াব ও মংডুর আশপাশের অঞ্চলে প্রচুর বাঁশ, কাঠ ও চুনাপাথর পাওয়া যায়। এসব কাঁচামালের ওপর ভিত্তি করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সিমেন্ট ও কাগজ শিল্প বিকশিত হতে পারে। মিয়ানমারে প্রচুর জমি অনাবাদি রয়েছে। এসব জমি লিজ নিয়ে বাংলাদেশের জন্য চাল উৎপাদনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। মান্দালয়-ম্যাগওয়ের তুলা আমদানি করতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তার ক্রমবর্ধিষ্ণু গার্মেন্ট সেক্টরের কাঁচামাল হিসেবে তুলা মিয়ানমারের এই অঞ্চল থেকে আমদানি করতে পারে। গবাদিপশু আমদানি করার সম্ভাবনাও রয়েছে। বাংলাদেশীরা মিয়ানমারে গবাদিপশুর খামারও গড়ে তুলতে পারে। মিয়ানমারের সেগুন কাঠ পৃথিবী বিখ্যাত। আমাদের ফার্নিচার শিল্পের চাহিদা মেটাতে পারে এই সেগুন কাঠ, যার ওপর ভিত্তি করে আমরা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে আমাদের ফার্নিচার শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারি। মিয়ানমার মূল্যবান পাথর যেমন- রুবি, জেড, বোম আর মার্বেলে সমৃদ্ধ। এসব মূল্যবান পাথর আমাদের জুয়েলারি শিল্পকে সমৃদ্ধ করে ভ্যালু-অ্যাডিশনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক হতে পারে। ভারত, মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও চীনের সমন্বয়ে যে আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা বলা হচ্ছে (বিসিআইএম), সেখানেও বাংলাদেশের স্বার্থ রয়েছে। সুতরাং মিয়ানমারে যে সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে, তার সঙ্গে সম্পর্ক সম্প্রসারণ করা আমাদের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
তবে মিয়ানমারকে নিয়ে প্রশ্ন অনেক। সে দেশে একটি নির্বাচন হয়েছে বটে; কিন্তু এই নির্বাচন সত্যিকার অর্থে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্মের সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করে না। দীর্ঘ ৫৪ বছর সেখানে যে সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে, তা হুট করে ভেঙে ফেলা যাবে না। রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর যে প্রভাব রয়েছে, তা হ্রাস করা যাবে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে সেনাবাহিনীর একটি নির্বাচন দেয়া প্রয়োজন ছিল। সেটা তারা দিয়েছে। কিন্তু তারা ব্যারাকে ফিরে যাবে, এটা আমার মনে হয় না। মিসরের মতো একটি পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হতে পারে মিয়ানমারে। আরব বসন্ত মিসরে পরিবর্তন ডেকে এনেছিল। সেনানিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভেঙে পড়েছিল কায়রোর ‘তেহরির স্কোয়ারে’ দীর্ঘ ১৭ দিনের গণঅবস্থানের কারণে। তার পরের ঘটনা সবাই জানেন। হোসনি মোবারকের ক্ষমতা হস্তান্তর, একটি নির্বাচন, নির্বাচনে ড. মুরসির বিজয় (জুন ২০১২) এবং পরবর্তী সময়ে (২০১৩) সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফিল্ড মার্শাল সিসির ক্ষমতা গ্রহণ। ‘আরব বসন্ত’ মিসরের জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। এখন মিয়ানমার কি সেদিকেই হাঁটবে? সেনাবাহিনী নির্বাচন ও সংসদকে মেনে নিয়েছে। কিন্তু সব ‘সুযোগ-সুবিধা’ তারা ছেড়ে দেবে, এটা মনে হয় না। এক্ষেত্রে সুচিকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটা সহাবস্থানে যেতে হবে। নতুবা তিনি ‘পর্দার অন্তরালে’ থেকে ক্ষমতা পরিচালনা করতে পারবেন না। এর অর্থ পরিষ্কার- সেনাসমর্থিত একজনকেই তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নেবেন এবং সমর্থন করবেন। তিনি নিজে কোনো ‘প্রার্থী’ দেবেন না। এর মাধ্যমে তিনি সেনাবাহিনীর আস্থা অর্জন করতে পারেন। সরকারে তার ‘ভূমিকা’ নিয়েও প্রশ্ন থাকবে এবং প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তিনি একটি ‘পদ’ পেতে পারেন।
মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস অনেক পুরনো। নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন বিচ্ছিন্নতাবাদী ৮টি গ্রুপের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু চুক্তির বাইরে আরও বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ রয়েছে। এদেরও চুক্তির আওতায় আনা দরকার। অর্থনৈতিক সংস্কারটা খুবই জরুরি। বৈদেশিক বিনিয়োগ দীর্ঘদিন সে দেশে বন্ধ ছিল। এখন এটি উন্মুক্ত। বিশেষ করে গভীর সমুদ্রে বিপুল জ্বালানি সম্পদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ এলেই এই সম্পদ আহরণ সম্ভব। মার্কিন বিনিয়োগকারীরা মিয়ানমারে আসতে শুরু করেছেন। এখন ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতির’ কারণে মার্কিন বিনিয়োগকারীরা আরও উৎসাহিত হবেন। রোহিঙ্গা সমস্যা বহির্বিশ্বে মিয়ানমারের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট করেছে। রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে এক অমানবিক জীবন যাপন করছে। সুচি এদের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি উগ্র বৌদ্ধ মানসিকতায় নিজেকে সম্পর্কিত করেছিলেন। উদ্দেশ্য পরিষ্কার- ভোটপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা। সেটা নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু একজন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীর কাছ থেকে মানুষ আরও বেশি কিছু প্রত্যাশা করে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়া, তাদের চলাচলে বাধা-নিষেধ প্রত্যাহার করে নেয়া কিংবা তাদের নিজ বাসভূমে বসবাসের অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। নতুন সরকার এ কাজটি করবে- এটাই মানুষ প্রত্যাশা করে। Dainik Jugantor 09.02.16
0 comments:
Post a Comment