আগামী
১৭ ফেব্রুয়ারি জানা যাবে কে হতে যাচ্ছেন মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট।
আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এমন মন্তব্যও করা হয়েছে যে, সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক
ধরনের সমঝোতায় গিয়েই অং সান সু চি মিয়ানমারের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হতে
যাচ্ছেন! কিন্তু বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয়Ñ কেননা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার
কারণে সু চির প্রেসিডেন্ট না হওয়ারই কথা। মিয়ানমারের সংসদ দুই
কক্ষবিশিষ্ট। এই দুই কক্ষ থেকে দুজনকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন দেওয়া হবে।
এরপর সেনাবাহিনী একজনকে মনোনয়ন দেবে। দুপক্ষের যৌথ অধিবেশনে প্রেসিডেন্ট
নির্বাচিত হবেন। বাকি দুজন প্রার্থী ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ পাবেন।
উভয়পক্ষের মোট আসন ৬৫৪। নির্বাচিত সংসদ সদস্যের সংখ্যা ৪৯১। এর বাইরে
সেনাবাহিনী মনোনয়ন দিয়েছে ১৫৬ জনকে। নির্বাচনে সু চির দল এনএলডি বিজয়ী
হয়েছে ৩৯০ আসনে। সেনাবাহিনী সমর্থিত দল ইউএসডিপি পেয়েছে মাত্র ৪১ আসন। এতে
বোঝা যায়, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সু চিকে বিজয়ী হতে হলে ১৬৬ জন সেনা
সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন এখানেইÑ সেনাবাহিনী কোন ‘স্বার্থের’
বিনিময়ে সু চিকে সমর্থন করবে? ১৯৬২ সালে প্রথম সামরিক অভ্যুত্থানের পর
থেকেই সেনাবাহিনী মিয়ানমারের সমাজব্যবস্থায় অন্যতম একটি শক্তি। এখন
রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেনাবাহিনীর স্বার্থে আঘাত করলে, তা হিতে বিপরীত হতে
পারে। সেনাবাহিনী তাদের করপোরেট স্বার্থ বিসর্জন দেবে, এটা মনে হয় না।
মিয়ানমারে সাম্প্রতিককালে একটি উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জন্ম
হয়েছে। সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে
প্রমোট করছে। উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরা মা বা থা অথবা ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য
প্রটেকশন অব রেস অ্যান্ড রিলিজিয়ন’ নামক একটি সংগঠনের ব্যাপারে সংগঠিত
হয়েছে। একজন ‘বার্মিজ বিন লাদেন’ ভিরাথুর কথাও ছাপা হয়েছিল বিখ্যাত টাইম
ম্যাগাজিনে ২০১৩ সালের ১ জুলাই। ভিরাথু মিয়ানমার থেকে সব মুসলমানের উচ্ছেদ
চান। অং সান সু চি বরাবরই এদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে রাজনীতি করে গেছেন। এখন
দেখতে হবে উগ্রপন্থীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়। বর্তমান
প্রেসিডেন্ট সেই নির্বাচনের আগে ৮টি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে একটি
শান্তিচুক্তি করেছিলেন। কিন্তু আরও ৭টি সংগঠন রয়ে গেছে। এখন দেখতে হবে সু
চির ব্যাপারে এদের দৃষ্টিভঙ্গি কী? কিন্তু রোহিঙ্গাদের নিয়ে বড় সমস্যা রয়েই
গেল। সু চি কখনো রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের প্রশ্নটিকে বড় করে দেখেননি।
এমনকি সেনাবাহিনী যেখানে মনে করে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়, সু চি
এই বক্তব্যের কখনো সমালোচনা করেননি। রোহিঙ্গা ইস্যু এবং সেই সঙ্গে
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি করে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক
এখন নানা জটিলতায় আক্রান্ত। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে যে সমস্যা ছিল, তা
রয়ে গেছে। কক্সবাজারে অবৈধভাবে প্রবেশ করা হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানকে
মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ফিরিয়ে নিচ্ছে না। উপরন্তু প্রায়ই সীমান্তে গুলিবর্ষণ ও
অপহরণের ঘটনা ঘটিয়ে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী সীমান্তে উত্তেজনা
জিইয়ে রাখছে। সি চি নির্বাচনের আগে এই রোহিঙ্গা প্রশ্নে কোনো বক্তব্য
দেননি। তার উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কারÑ তিনি উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও সেই
সঙ্গে সেনাবাহিনীর আস্থা অর্জন করতে চেয়েছেন। বলা ভালো, সেনাবাহিনী এই উগ্র
বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করে আসছে। সু চি নিজেও এই
প্রক্রিয়ায় নিজেকে সম্পর্কিত করেছিলেন। এদের সমর্থন পেতে সু চি নির্বাচনে
মোট ১৭১১ আসনের (সংসদের উভয় কক্ষ, ১৪টি রাজ্যের সংসদ ও বিভিন্ন অঞ্চল)
একটিতেও কোনো মুসলমান প্রার্থী দেননি। সরকারি দল এসপিডিসিও কোনো মুসলমান
প্রার্থী দেয়নি। এমনকি নির্বাচনের আগে সু চি রাখাইন স্টেট সফরে গিয়েছিলেন।
কিন্তু রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে তিনি সেখানে কোনো বক্তব্য দেননি। সিরিয়াস
পাঠকরা লক্ষ করে থাকবেন ২০১২ সালের পর থেকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যার
ব্যাপকতা পেলে এবং শত শত রোহিঙ্গাকে নৌকাযোগে মালয়েশিয়া যাওয়ার ব্যাপারেও
সু চির কোনো বক্তব্য নেই। মিয়ানমারের বর্তমান সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব
দিচ্ছে না। মিয়ানমার সরকার মনে করে রোহিঙ্গারা মূলত বাংলাদেশের নাগরিক! অথচ
ইতিহাস বলে শত বছর ধরেই রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে
বসবাস করে আসছে। উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা মিয়ানমারকে একটি বৌদ্ধরাষ্ট্রে পরিণত
করতে চাচ্ছে। সু চি এই প্রক্রিয়ার পুরোপুরি বাইরে নন। তিনি জানেন ক্ষমতা
পেতে হলে তার উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। তাই
উগ্রপন্থীরা যখন মুসলমানদের হত্যা করছে, তাদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে,
তাদের বাধ্য করছে বাংলাদেশে ‘পুশইন’ করতে, তখন তিনি নিশ্চুপ। মিয়ানমারের
মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারেও তার কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। ক্ষমতায়
যাওয়ার জন্য তিনি যে স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেছেন, তা সুবিধাবাদিতায় ভরা।
সর্বজন গ্রহণযোগ্য একজন নেত্রী তিনি, এ কথাটা বলা যাবে না। ক্ষমতায় যাওয়ার
জন্য নির্বাচনের আগে একদিকে তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক ধরনের ‘সহাবস্থানে’
গেছেন, অন্যদিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের পক্ষে
নিশ্চুপ থেকে তিনি উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের আস্থাকেই সমর্থন করেছেন। এতে
করে তিনি ‘বিজয়ী’ হয়েছেন, এটা সত্য। কিন্তু সর্বজন গ্রহণযোগ্য একটি
সমাজব্যবস্থা সেখানে কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হবে, সে প্রশ্ন থাকলই।
এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে সেনাবাহিনীর ভূমিকা, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ও সাবেক সেনাপ্রধান থেইন সেইনের ভূমিকা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। ১৯৯০ সালের মতো এবারে নির্বাচন বাতিল করার কোনো উদ্যোগ তিনি নেননি। কেননা তিনি জানেন নির্বাচন বাতিল করা পশ্চিমা বিশ্বে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গ্রহণযোগ্য হবে না। আশিয়ানের নেতৃবৃন্দও এটা মানবে না। ফলে একটি ‘বড় ধরনের ঝুঁকি এড়াতেই’ জেনারেল থেইন সেইন এই নির্বাচনটা মেনে নিয়েছেন। সারা বিশ্বই এখন সাংবিধানিক পথে যাচ্ছে, নির্বাচনের পথে যাচ্ছে। এক সময় যে ইন্দোনেশিয়ায় সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব ছিল রাজনীতি প্রশাসনে সর্বত্র, সুহার্তো-পরবর্তী সেই ইন্দোনেশিয়া এখন ধীরে ধীরে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ফলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীও ধীরে ধীরে নিজেদের বদলে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে। এর প্রথম প্রকাশ হিসেবেই তারা সাধারণ নির্বাচনকে মেনে নিয়েছে। তবে ধারণা করছি অং সান সু চির সঙ্গে তাদের পরোক্ষ একটা ‘সমঝোতা’ হয়েছে। সু চি বর্তমান সংবিধানকে মেনে নেবেন। এই মুহূর্তে সংবিধান সংশোধনের কোনো উদ্যোগ তিনি নেবেন না। এমনকি মানবাধিকার সংস্থার অভিযোগে কোনো জেনারেলকে তিনি বিচারের মুখোমুখিও দাঁড় করাবেন না। এক ধরনের ‘স্ট্যাটাস বো’ তিনি মেনে নেবেন। তবে একটা প্রশ্ন থাকলইÑ নতুন সরকারে তিনি কী আদৌ প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন? এ ক্ষেত্রে সংবিধানের যে বাধ্যবাধকতা ছিল তা কী কোনো ডিক্রিবলে স্থগিত করা হবে? সু চি ইতোমধ্যে সাবেক একজন জেনারেলকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিয়েছেন, তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে পর্দার অন্তরালে দেনদরবারে লিপ্ত রয়েছেন। তিনি কি একটি সমঝোতায় গেছেন? তাহলে সমঝোতাটা কী? কিংবা সেনাবাহিনীর কর্তৃত্বই বা থাকবে কীভাবে? পুলিশপ্রধান, সেনাপ্রধান, সীমান্তরক্ষা ব্যবস্থাপনা তথা মন্ত্রণালয়ের ব্যাপারে সেনাবাহিনীর যে ভূমিকা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত, এ ব্যাপারে সু চি কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করবেন না। বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল লাইইন সম্পর্কেও তার কোনো রিজার্ভেশন নেই। তিনি তাকে আস্থায় নিয়েই সরকার পরিচালনা করবেন! সু চি সংসদীয় সরকার পদ্ধতিতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেও এই মুহূর্তে তা তিনি পারবেন বলে মনে হয় না। নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার আগেই তিনি বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে যে ভাষায় কথা বলেছেন, তা একটা শঙ্কারও জন্ম দিয়েছে। তিনি বলেছেন, পার্লামেন্টে সেনাবাহিনীর ৫ শতাংশ আসন প্রথা বিলুপ্ত হবেই। তিনি গণতান্ত্রিক সমাজের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, সেনাবাহিনীর জন্য আসন থাকা গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার পরিপন্থী। কথাটা তিনি মিথ্যা বলেননি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মিয়ানমার কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট নয়। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি যদি এই ‘কোটা’ পদ্ধতি বাতিল করার এখনই উদ্যোগ নেন, তাহলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তিনি বিতর্কে জড়িয়ে যাবেন, যা কিনা পুনরায় সামরিক অভ্যুত্থানে সেনাবাহিনীর জেনারেলদের প্ররোচিত করতে পারে। তিনি ‘রিয়েল পলিটিকস’-এর পরিচয় দেবেন, এটাই সবাই প্রত্যাশা করে। এই মুহূর্তে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে জাতীয় ঐক্য দৃঢ় করা, গণতন্ত্রকে সংহত করা ও শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করা। অনেকটা ইন্দোনেশিয়ায় সুহার্তো-পরবর্তী মডেল তিনি অনুসরণ করতে পারেন, যেখানে সেনাবাহিনী এখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ‘কমিটেড’। একই সঙ্গে তিনি প্রেসিডেন্টের পদটিকে একটি ‘নিয়মতান্ত্রিক পদে’ পরিণত করতে চান। সাংবিধানিকভাবে এটাও এখন সম্ভব নয়। সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হলে সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়েই তা করতে হবে। কিন্তু বিষয়টি অত সহজ নয়। সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরেই যে লিখিত সুবিধা ভোগ করে আসছে, তা ছেড়ে দেবে এটাও মনে হয় না।
মিয়ানমারে একটি গণতান্ত্রিক সরকার আমাদের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় রাষ্ট্রই বিসিআইএম ও বিবিআইএমএস-টেকজোটের সদস্য। বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির জন্য এই দুটো জোটের গুরুত্ব অনেক বেশি। যদিও সেখানে দীর্ঘ সেনাশাসন থাকায়, দুদেশের মাঝে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়নি। পরিসখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য মিয়ানমারে রপ্তানি করে, আমদানি করে তার চেয়ে বেশি। ২০০৫-০৬ সালে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছিল ৫ দশমিক ১৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য (২০১২-১৩ সালে এর পরিমাণ ১৩ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন), আর আমদানি করেছিল ২৯ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য (২০১২-২০১৩ সালে এর পরিমাণ ৮৪ মিলিয়ন)। অথচ বিশাল এক সম্ভাবনার দেশ মিয়ানমার। বাংলাদেশের জ্বালানি সুবিধার অন্যতম উৎস হতে পারে মিয়ানমার। সুতরাং একটি গণতান্ত্রিক সরকার সম্ভাবনার অনেক দুয়ার খুলতে পারে।
প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন নির্বাচনে এনএলডির বিজয়কে স্বাগত জানালেও সু চির একটি বক্তব্যে একটি আশঙ্কারও জন্ম হয়েছিল। সিঙ্গাপুরভিত্তিক চ্যানেল এশিয়ার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন, প্রেসিডেন্ট কে।’ তিনি এ কথাও বলেছেন, সংবিধান যদি তাকে সরকারের নেতৃত্ব দিতে বাধা সৃষ্টি করে, তাহলে একটি ‘পথ’ বের করতেই হবে, যাতে তিনি সরকারের নেতৃত্ব দিতে পারেন। সমস্যাটা এখানেই তৈরি হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রপ্রধান ও ক্যাবিনেটেরও প্রধান। সংবিধান পরিবর্তন না করলে সু চির পক্ষে ক্যাবিনেটের নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব নয়। আর সংবিধান সংশোধন করাও এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে বাস্তবমুখী একটি সিদ্ধান্ত তিনি নেবেনÑ এ প্রত্যাশা সবার। কেননা সেনাবাহিনীর সঙ্গে এই মুহূর্তে তিনি যদি কোনো ‘সংঘর্ষে’ও জড়িয়ে যান, তা বিকাশমান মিয়ানমারের গণতন্ত্রের জন্য কোনো ভালো খবর বয়ে আনবে না। তাই ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। নিম্নকক্ষ সু চিকে এখন মনোনয়ন (প্রেসিডেন্ট পদে) দেয় কিনা, সেটাই দেখার বিষয়। Daily Amader Somoy 14.02.16
এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে সেনাবাহিনীর ভূমিকা, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ও সাবেক সেনাপ্রধান থেইন সেইনের ভূমিকা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। ১৯৯০ সালের মতো এবারে নির্বাচন বাতিল করার কোনো উদ্যোগ তিনি নেননি। কেননা তিনি জানেন নির্বাচন বাতিল করা পশ্চিমা বিশ্বে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গ্রহণযোগ্য হবে না। আশিয়ানের নেতৃবৃন্দও এটা মানবে না। ফলে একটি ‘বড় ধরনের ঝুঁকি এড়াতেই’ জেনারেল থেইন সেইন এই নির্বাচনটা মেনে নিয়েছেন। সারা বিশ্বই এখন সাংবিধানিক পথে যাচ্ছে, নির্বাচনের পথে যাচ্ছে। এক সময় যে ইন্দোনেশিয়ায় সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব ছিল রাজনীতি প্রশাসনে সর্বত্র, সুহার্তো-পরবর্তী সেই ইন্দোনেশিয়া এখন ধীরে ধীরে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ফলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীও ধীরে ধীরে নিজেদের বদলে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে। এর প্রথম প্রকাশ হিসেবেই তারা সাধারণ নির্বাচনকে মেনে নিয়েছে। তবে ধারণা করছি অং সান সু চির সঙ্গে তাদের পরোক্ষ একটা ‘সমঝোতা’ হয়েছে। সু চি বর্তমান সংবিধানকে মেনে নেবেন। এই মুহূর্তে সংবিধান সংশোধনের কোনো উদ্যোগ তিনি নেবেন না। এমনকি মানবাধিকার সংস্থার অভিযোগে কোনো জেনারেলকে তিনি বিচারের মুখোমুখিও দাঁড় করাবেন না। এক ধরনের ‘স্ট্যাটাস বো’ তিনি মেনে নেবেন। তবে একটা প্রশ্ন থাকলইÑ নতুন সরকারে তিনি কী আদৌ প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন? এ ক্ষেত্রে সংবিধানের যে বাধ্যবাধকতা ছিল তা কী কোনো ডিক্রিবলে স্থগিত করা হবে? সু চি ইতোমধ্যে সাবেক একজন জেনারেলকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিয়েছেন, তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে পর্দার অন্তরালে দেনদরবারে লিপ্ত রয়েছেন। তিনি কি একটি সমঝোতায় গেছেন? তাহলে সমঝোতাটা কী? কিংবা সেনাবাহিনীর কর্তৃত্বই বা থাকবে কীভাবে? পুলিশপ্রধান, সেনাপ্রধান, সীমান্তরক্ষা ব্যবস্থাপনা তথা মন্ত্রণালয়ের ব্যাপারে সেনাবাহিনীর যে ভূমিকা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত, এ ব্যাপারে সু চি কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করবেন না। বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল লাইইন সম্পর্কেও তার কোনো রিজার্ভেশন নেই। তিনি তাকে আস্থায় নিয়েই সরকার পরিচালনা করবেন! সু চি সংসদীয় সরকার পদ্ধতিতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেও এই মুহূর্তে তা তিনি পারবেন বলে মনে হয় না। নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার আগেই তিনি বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে যে ভাষায় কথা বলেছেন, তা একটা শঙ্কারও জন্ম দিয়েছে। তিনি বলেছেন, পার্লামেন্টে সেনাবাহিনীর ৫ শতাংশ আসন প্রথা বিলুপ্ত হবেই। তিনি গণতান্ত্রিক সমাজের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, সেনাবাহিনীর জন্য আসন থাকা গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার পরিপন্থী। কথাটা তিনি মিথ্যা বলেননি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মিয়ানমার কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট নয়। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি যদি এই ‘কোটা’ পদ্ধতি বাতিল করার এখনই উদ্যোগ নেন, তাহলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তিনি বিতর্কে জড়িয়ে যাবেন, যা কিনা পুনরায় সামরিক অভ্যুত্থানে সেনাবাহিনীর জেনারেলদের প্ররোচিত করতে পারে। তিনি ‘রিয়েল পলিটিকস’-এর পরিচয় দেবেন, এটাই সবাই প্রত্যাশা করে। এই মুহূর্তে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে জাতীয় ঐক্য দৃঢ় করা, গণতন্ত্রকে সংহত করা ও শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করা। অনেকটা ইন্দোনেশিয়ায় সুহার্তো-পরবর্তী মডেল তিনি অনুসরণ করতে পারেন, যেখানে সেনাবাহিনী এখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ‘কমিটেড’। একই সঙ্গে তিনি প্রেসিডেন্টের পদটিকে একটি ‘নিয়মতান্ত্রিক পদে’ পরিণত করতে চান। সাংবিধানিকভাবে এটাও এখন সম্ভব নয়। সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হলে সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়েই তা করতে হবে। কিন্তু বিষয়টি অত সহজ নয়। সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরেই যে লিখিত সুবিধা ভোগ করে আসছে, তা ছেড়ে দেবে এটাও মনে হয় না।
মিয়ানমারে একটি গণতান্ত্রিক সরকার আমাদের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় রাষ্ট্রই বিসিআইএম ও বিবিআইএমএস-টেকজোটের সদস্য। বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির জন্য এই দুটো জোটের গুরুত্ব অনেক বেশি। যদিও সেখানে দীর্ঘ সেনাশাসন থাকায়, দুদেশের মাঝে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়নি। পরিসখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য মিয়ানমারে রপ্তানি করে, আমদানি করে তার চেয়ে বেশি। ২০০৫-০৬ সালে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছিল ৫ দশমিক ১৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য (২০১২-১৩ সালে এর পরিমাণ ১৩ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন), আর আমদানি করেছিল ২৯ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য (২০১২-২০১৩ সালে এর পরিমাণ ৮৪ মিলিয়ন)। অথচ বিশাল এক সম্ভাবনার দেশ মিয়ানমার। বাংলাদেশের জ্বালানি সুবিধার অন্যতম উৎস হতে পারে মিয়ানমার। সুতরাং একটি গণতান্ত্রিক সরকার সম্ভাবনার অনেক দুয়ার খুলতে পারে।
প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন নির্বাচনে এনএলডির বিজয়কে স্বাগত জানালেও সু চির একটি বক্তব্যে একটি আশঙ্কারও জন্ম হয়েছিল। সিঙ্গাপুরভিত্তিক চ্যানেল এশিয়ার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন, প্রেসিডেন্ট কে।’ তিনি এ কথাও বলেছেন, সংবিধান যদি তাকে সরকারের নেতৃত্ব দিতে বাধা সৃষ্টি করে, তাহলে একটি ‘পথ’ বের করতেই হবে, যাতে তিনি সরকারের নেতৃত্ব দিতে পারেন। সমস্যাটা এখানেই তৈরি হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রপ্রধান ও ক্যাবিনেটেরও প্রধান। সংবিধান পরিবর্তন না করলে সু চির পক্ষে ক্যাবিনেটের নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব নয়। আর সংবিধান সংশোধন করাও এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে বাস্তবমুখী একটি সিদ্ধান্ত তিনি নেবেনÑ এ প্রত্যাশা সবার। কেননা সেনাবাহিনীর সঙ্গে এই মুহূর্তে তিনি যদি কোনো ‘সংঘর্ষে’ও জড়িয়ে যান, তা বিকাশমান মিয়ানমারের গণতন্ত্রের জন্য কোনো ভালো খবর বয়ে আনবে না। তাই ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। নিম্নকক্ষ সু চিকে এখন মনোনয়ন (প্রেসিডেন্ট পদে) দেয় কিনা, সেটাই দেখার বিষয়। Daily Amader Somoy 14.02.16
0 comments:
Post a Comment