ক্ষিণ এশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি দক্ষিণ এশিয়া সফরে আসছেন ২৯
আগস্ট। এ সফরে তিনি বাংলাদেশ ও ভারত সফর করবেন। ভারত সফরে তিনি দ্বিতীয়
যুক্তরাষ্ট্র-ভারত স্ট্র্যাটেজিক ও কমার্শিয়াল ডায়ালগে অংশ নেবেন। ওবামা
প্রশাসনের শেষ সময়ে এসে জন কেরির এ সফর কিছুটা হলেও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ
করে, ভারতে তার সফরের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন এই মেসেজটি দিচ্ছে
যে, তারা ভারতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। বাংলাদেশে কেরি তার ৩ বছরের দায়িত্ব
পালনকালীন প্রথমবারের মতো আসছেন। তার পূর্বসূরি হিলারি ক্লিনটন ২০১২ সালে
বাংলাদেশ সফর করে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশে তার সফরও গুরুত্বের দাবি রাখে। তিনি
এমন একসময় বাংলাদেশে আসছেন, যখন দুই দেশের সম্পর্কের মাঝে কিছু কিছু
জটিলতা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান, আইএসের অবস্থান,
মানবাধিকার ও সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র
বরাবরই সোচ্চার। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যুুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের বিপরীতে
বাংলাদেশের বর্তমান। বিশেষ করে বাংলাদেশে আইএসের উত্থানের পেছনে
যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, বাংলাদেশে আইএস ঘাঁটি গেড়েছে। বাংলাদেশ এটা স্বীকার
করুকÑ এমনটাই চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বাংলাদেশ মনে করে, এদেশে আইএস
নেই। তবে স্থানীয় জঙ্গি আছে। বিপরীতমুখী এ অবস্থান থাকা সত্ত্বেও দুই দেশের
সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেমন কোনো অবনতি ঘটেনি। জেএসপি সুবিধা বাতিল হলেও
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পণ্যের রফতানির ক্ষেত্রে, বিশেষ করে তৈরি পোশাক
রফতানির ক্ষেত্রে তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়নি। বাংলাদেশ বারবারই
তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা চেয়ে আসছে।
তবে এখানে একটা জিনিস মনে রাখা প্রয়োজন, আর তা হচ্ছে ভারতের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের যে নীতি, সেই নীতির আলোকেই বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক গড়ে উঠছে। ভারত বড় দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ভারতে অনেক বেশি। পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে পাশে চায়। দক্ষিণ এশিয়ার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ভারতকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। ভারত বড় দেশ। বড় অর্থনীতি। এশিয়ায় দ্বিতীয় অর্থনীতি ভারতের। বলা হচ্ছে, চলতি শতাব্দীতে ভারত ও চীন দুইটি বড় অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হবে, যারা বিশ্ব রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। এদিকে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওবামা প্রশাসনের চরাড়ঃ ঃড় অংরধ, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া পলিসির মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ভারত। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, ভারতের গুরুত্ব অনুধাবন করেই প্রেসিডেন্ট ওবামা দুই-দুইবার ভারত সফর করেছিলেন। সর্বশেষ ভারতের রিপাবলিকান ডে’র অনুষ্ঠানে ওবামা ছিলেন প্রধান অতিথি। মোদির জমানায় ভারতের অর্থনীতি আরও উন্মুক্ত হওয়ায় ভারতে মার্কিন বিনিয়োগ বেড়েছে, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারত যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করে বেশি, আমদানি করে কম। একটি পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি সহজ হবে। ২০১৬ সালের প্রথম ৬ মাস যুক্তরাষ্ট্র ভারতে রফতানি করেছে ৯ হাজার ৯৯০ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারের পণ্য, আর আমদানি করেছে ২২ হাজার ৬৭১ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতি ১২ হাজার ৬৮০ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতি ছিল ২৩ হাজার ৩৩৯ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার। এ থেকেই বোঝা যায়, দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক কেন গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র শুধু ভারতের অন্যতম বাণিজ্যিক অংশীদারই নয়, বরং ভারতে পারমাণবিক প্রযুক্তিও সরবরাহ করছে যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়ে একাধিক চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে দুই দেশের মধ্যে। ভারত নিউক্লিয়ার সাপ্লাইয়ার্স গ্রুপের সদস্য হতে চায়। এ ব্যাপারেও সমর্থন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। শুধু তাই নয়, ভারত জাতিসংঘের স্থায়ী পরিষদের সদস্য হতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রেরও সমর্থন রয়েছে তাতে। ওবামার ভারত সফরের সময় তিনি প্রকাশ্যেই ভারতের এ অবস্থান সমর্থন করেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলকে কেন্দ্র করে যে নীতি প্রণীত হয়েছে, বাংলাদেশ তারই অন্তর্ভুক্ত। নানা কারণে অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এই এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলকে যুক্তরাষ্ট্র বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এর প্রধান কারণ চীন। চীনকে ‘ঘিরে ফেলার’ এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া-প্যাসিফিক নীতি প্রণয়ন করছে। আর এ কারণেই বাংলাদেশ তথা ভারতের গুরুত্ব যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নীতিনির্ধারকদের কাছে অনেক বেশি। একদিকে ভারত মহাসাগর, অন্যদিকে দক্ষিণ চীন সাগরÑ এই দুইটি অঞ্চলকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র এক মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের ছয়টি জাহাজ মোতায়েন করা হবে। উদ্দেশ্য, ভারত মহাসাগরে চীনা নৌবাহিনীর মুভমেন্টের দিকে লক্ষ রাখা। দক্ষিণ চীন সাগরকে বলা হচ্ছে সম্ভাব্য একটি স্থান, যাকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে বড় ধরনের সামরিক সংঘর্ষের জন্ম হতে পারে। বছরে এ দক্ষিণ চীন সাগর এলাকা দিয়ে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য পরিবাহিত হয়। অর্থাৎ এ রুট ব্যবহার করে পণ্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যায়, যার একটা বড় অংশ চীন রফতানি করে। ১১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল ও ১৯০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট গ্যাস রয়েছে এ অঞ্চলে। বছরে এ অঞ্চল থেকে ১০ মিলিয়ন টন মৎস্য আহরণ করা হয়। ফলে চীনের যে এ অঞ্চলের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এ অঞ্চল ঘিরে উত্তেজনা বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী জাহাজ এ অঞ্চলে ঘোরাফেরা করছে। এ অঞ্চলের মালিকানা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালত সম্প্রতি চীনের দাবি খারিজ করে দিলেও চীন তা মেনে নেয়নি। চীন ফিলিপাইনের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে। ফলে এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়লে, তার ঢেউ এসে লাগবে ভারত মহাসাগরেও। সুতরাং চীনের বিরুদ্ধে একটি শক্ত অবস্থান নেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে ভারতীয় মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার তৎপরতা বাড়াবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই জন কেরির বাংলাদেশ ও ভারত সফর এ দৃষ্টিতেই আমাদের দেখতে হবে। মোদির জমানায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও বেড়েছে। ভারতে মার্কিন বিনিয়োগ বেড়েছে। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজির অংশ। ভারতকে তার প্রয়োজন এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমানোর জন্য। ফলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের যে নীতি, সেই নীতি ভারতকে আস্থায় নিয়েই তৈরি করা। অর্থাৎ ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের আলোকেই বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক রচিত হবে। আলাদা করে বাংলাদেশের ব্যাপারে কোনো নীতি প্রণয়ন করবে না যুক্তরাষ্ট্র এবং এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না, যাতে ভারতের স্বার্থ ক্ষুণœ হয়। ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের প্রয়োজন খুব বেশি।
এ প্রসঙ্গে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। চীনের বর্তমান শাসকচক্র ‘দি সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট অ্যান্ড মেরিটাইম সিল্ক রোড’ (বহুল প্রচারিত ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড) নামে যে নীতি প্রণয়ন করেছে, তাতে ৬০ দেশকে চীন তার বাণিজ্যিক কাঠামোয় নিয়ে আসতে চাইছে। এতে করে চীনের সঙ্গে সড়কপথে মধ্য এশিয়ার দেশগুলো যেমনি সংযুক্ত হবে, ঠিক তেমনি দক্ষিণ এশিয়া তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও সামুদ্রিক পথে সংযুক্ত হবে। এই বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের খরচ হবে ৪ থেকে ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ ও শীর্ষস্থানীয় বড় অর্থনীতির সঙ্গে টিপিপি বা ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ এবং ট্রান্স আটলান্টিক ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পার্টনারশিপ নামে যে দুইটি চুক্তি করেছে, তার বিকল্প হিসেবেই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের ‘ব্রেন চাইল্ড’ হচ্ছে এ ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি। সিরিয়াস পাঠকরা স্মরণ করতে পারেন, চীনের ‘ঝঃৎরহম ড়ভ চবধৎষং’ প্রজেক্টের কথা। এ প্রজেক্টের আওতায় চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক সমুদ্রবন্দরকে ‘মুক্তার মালা’র মতো একসঙ্গে সংযুক্ত করেছে। প্রতিটি বন্দরেই চীনের নৌবাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, চীন ভারত মহাসাগরে অবস্থিত একাধিক দেশে তাদের নৌঘাঁটি নির্মাণের চেষ্টা করছে। জিবুতি, গাওদার (বেলুচিস্তান), হাসবানতোতা (শ্রীলঙ্কা), মিয়ানমার, ইয়েমেন, মোজাম্বিক, মাদাগাস্কার, ওমান কিংবা কেনিয়াতে চীনা নৌঘাঁটি নির্মাণের আগ্রহের খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। জিবুতি ও মাদাগাস্কারে নৌঘাঁটি নির্মাণ শেষ হয়েছে। চীনের এ নৌঘাঁটি নির্মাণের বিষয়টিকে ভারত খুব সহজভাবে নেয়নি। ভারতও একইভাবে সিসিলি ও মৌরিতুসের দুইটি দ্বীপে তাদের নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে। ২০১৫ সালের মার্চে প্রধানমন্ত্রী মোদির এ দ্বীপ দুইটি সফরের সময় এ নৌঘাঁটি নির্মাণের কথা প্রথমবারের মতো জানা যায়। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, হাসবানতোতায় চীনা সাবমেরিনের উপস্থিতি ভারত তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ বলে মনে করেছিল। ভারত বিষয়টিকে এত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন যে, শেষ পর্যন্ত সেখানে রাজাপাকসের সরকারকে উৎখাত পর্যন্ত করেছিল ভারত। সিরিসেনাকে রাজাপাকসের বলয় থেকে বের করে এনে রাজাপাকসের বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে তাকে বিজয়ী করতে সাহায্য করেছিল ভারত। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হয়েছিল যে, ভারত মহাসাগরে চীনের তৎপরতাকে ভারত স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। এখানে প্রভাব বলয় বিস্তারের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে ভারত ও চীন দ্বন্দ্ব বাড়ছে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান হচ্ছে ভারতের পক্ষে। এ অঞ্চলজুড়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ গড়ে উঠছে, যা চীনা স্বার্থকে আঘাত করছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারত মহাসাগরে ভারতকে চীনের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে। আগামী দিনে এ অঞ্চল ও সেই সঙ্গে দক্ষিণ চীন সাগর প্রত্যক্ষ করবে এক অস্ত্র প্রতিযোগিতা। যে কোনো ধরনের নৌ-সংঘর্ষকেও উড়িয়ে দেয়া যায় না। সুতরাং আজ জন কেরি যখন ভারত সফরে আসছেন, এটাকে স্বাভাবিক একটি সফর ভাবলে ভুল হবে। চীনের কর্তৃপক্ষ চ্যালেঞ্জ করতেই ভারতকে সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে তৈরি করছে যুক্তরাষ্ট্র। কেরির সফর এ আলোকেই রচিত। এক্ষেত্রে কেরি বাংলাদেশেও আসবেন। কিন্তু তাতে করে বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে তেমন পরিবর্তন আসবে না। বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের যে ভূমিকা, যুক্তরাষ্ট্র সেই ভূমিকার বাইরে যেতে পারবে না।
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র
Daily Alokito Bangladesh
28.08.2016
তবে এখানে একটা জিনিস মনে রাখা প্রয়োজন, আর তা হচ্ছে ভারতের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের যে নীতি, সেই নীতির আলোকেই বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক গড়ে উঠছে। ভারত বড় দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ভারতে অনেক বেশি। পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে পাশে চায়। দক্ষিণ এশিয়ার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ভারতকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। ভারত বড় দেশ। বড় অর্থনীতি। এশিয়ায় দ্বিতীয় অর্থনীতি ভারতের। বলা হচ্ছে, চলতি শতাব্দীতে ভারত ও চীন দুইটি বড় অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হবে, যারা বিশ্ব রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। এদিকে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওবামা প্রশাসনের চরাড়ঃ ঃড় অংরধ, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া পলিসির মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ভারত। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, ভারতের গুরুত্ব অনুধাবন করেই প্রেসিডেন্ট ওবামা দুই-দুইবার ভারত সফর করেছিলেন। সর্বশেষ ভারতের রিপাবলিকান ডে’র অনুষ্ঠানে ওবামা ছিলেন প্রধান অতিথি। মোদির জমানায় ভারতের অর্থনীতি আরও উন্মুক্ত হওয়ায় ভারতে মার্কিন বিনিয়োগ বেড়েছে, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারত যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করে বেশি, আমদানি করে কম। একটি পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি সহজ হবে। ২০১৬ সালের প্রথম ৬ মাস যুক্তরাষ্ট্র ভারতে রফতানি করেছে ৯ হাজার ৯৯০ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারের পণ্য, আর আমদানি করেছে ২২ হাজার ৬৭১ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতি ১২ হাজার ৬৮০ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতি ছিল ২৩ হাজার ৩৩৯ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার। এ থেকেই বোঝা যায়, দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক কেন গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র শুধু ভারতের অন্যতম বাণিজ্যিক অংশীদারই নয়, বরং ভারতে পারমাণবিক প্রযুক্তিও সরবরাহ করছে যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়ে একাধিক চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে দুই দেশের মধ্যে। ভারত নিউক্লিয়ার সাপ্লাইয়ার্স গ্রুপের সদস্য হতে চায়। এ ব্যাপারেও সমর্থন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। শুধু তাই নয়, ভারত জাতিসংঘের স্থায়ী পরিষদের সদস্য হতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রেরও সমর্থন রয়েছে তাতে। ওবামার ভারত সফরের সময় তিনি প্রকাশ্যেই ভারতের এ অবস্থান সমর্থন করেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলকে কেন্দ্র করে যে নীতি প্রণীত হয়েছে, বাংলাদেশ তারই অন্তর্ভুক্ত। নানা কারণে অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এই এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলকে যুক্তরাষ্ট্র বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এর প্রধান কারণ চীন। চীনকে ‘ঘিরে ফেলার’ এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া-প্যাসিফিক নীতি প্রণয়ন করছে। আর এ কারণেই বাংলাদেশ তথা ভারতের গুরুত্ব যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নীতিনির্ধারকদের কাছে অনেক বেশি। একদিকে ভারত মহাসাগর, অন্যদিকে দক্ষিণ চীন সাগরÑ এই দুইটি অঞ্চলকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র এক মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের ছয়টি জাহাজ মোতায়েন করা হবে। উদ্দেশ্য, ভারত মহাসাগরে চীনা নৌবাহিনীর মুভমেন্টের দিকে লক্ষ রাখা। দক্ষিণ চীন সাগরকে বলা হচ্ছে সম্ভাব্য একটি স্থান, যাকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে বড় ধরনের সামরিক সংঘর্ষের জন্ম হতে পারে। বছরে এ দক্ষিণ চীন সাগর এলাকা দিয়ে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য পরিবাহিত হয়। অর্থাৎ এ রুট ব্যবহার করে পণ্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যায়, যার একটা বড় অংশ চীন রফতানি করে। ১১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল ও ১৯০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট গ্যাস রয়েছে এ অঞ্চলে। বছরে এ অঞ্চল থেকে ১০ মিলিয়ন টন মৎস্য আহরণ করা হয়। ফলে চীনের যে এ অঞ্চলের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এ অঞ্চল ঘিরে উত্তেজনা বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী জাহাজ এ অঞ্চলে ঘোরাফেরা করছে। এ অঞ্চলের মালিকানা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালত সম্প্রতি চীনের দাবি খারিজ করে দিলেও চীন তা মেনে নেয়নি। চীন ফিলিপাইনের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে। ফলে এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়লে, তার ঢেউ এসে লাগবে ভারত মহাসাগরেও। সুতরাং চীনের বিরুদ্ধে একটি শক্ত অবস্থান নেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে ভারতীয় মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার তৎপরতা বাড়াবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই জন কেরির বাংলাদেশ ও ভারত সফর এ দৃষ্টিতেই আমাদের দেখতে হবে। মোদির জমানায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও বেড়েছে। ভারতে মার্কিন বিনিয়োগ বেড়েছে। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজির অংশ। ভারতকে তার প্রয়োজন এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমানোর জন্য। ফলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের যে নীতি, সেই নীতি ভারতকে আস্থায় নিয়েই তৈরি করা। অর্থাৎ ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের আলোকেই বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক রচিত হবে। আলাদা করে বাংলাদেশের ব্যাপারে কোনো নীতি প্রণয়ন করবে না যুক্তরাষ্ট্র এবং এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না, যাতে ভারতের স্বার্থ ক্ষুণœ হয়। ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের প্রয়োজন খুব বেশি।
এ প্রসঙ্গে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। চীনের বর্তমান শাসকচক্র ‘দি সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট অ্যান্ড মেরিটাইম সিল্ক রোড’ (বহুল প্রচারিত ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড) নামে যে নীতি প্রণয়ন করেছে, তাতে ৬০ দেশকে চীন তার বাণিজ্যিক কাঠামোয় নিয়ে আসতে চাইছে। এতে করে চীনের সঙ্গে সড়কপথে মধ্য এশিয়ার দেশগুলো যেমনি সংযুক্ত হবে, ঠিক তেমনি দক্ষিণ এশিয়া তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও সামুদ্রিক পথে সংযুক্ত হবে। এই বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের খরচ হবে ৪ থেকে ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ ও শীর্ষস্থানীয় বড় অর্থনীতির সঙ্গে টিপিপি বা ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ এবং ট্রান্স আটলান্টিক ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পার্টনারশিপ নামে যে দুইটি চুক্তি করেছে, তার বিকল্প হিসেবেই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের ‘ব্রেন চাইল্ড’ হচ্ছে এ ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি। সিরিয়াস পাঠকরা স্মরণ করতে পারেন, চীনের ‘ঝঃৎরহম ড়ভ চবধৎষং’ প্রজেক্টের কথা। এ প্রজেক্টের আওতায় চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক সমুদ্রবন্দরকে ‘মুক্তার মালা’র মতো একসঙ্গে সংযুক্ত করেছে। প্রতিটি বন্দরেই চীনের নৌবাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, চীন ভারত মহাসাগরে অবস্থিত একাধিক দেশে তাদের নৌঘাঁটি নির্মাণের চেষ্টা করছে। জিবুতি, গাওদার (বেলুচিস্তান), হাসবানতোতা (শ্রীলঙ্কা), মিয়ানমার, ইয়েমেন, মোজাম্বিক, মাদাগাস্কার, ওমান কিংবা কেনিয়াতে চীনা নৌঘাঁটি নির্মাণের আগ্রহের খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। জিবুতি ও মাদাগাস্কারে নৌঘাঁটি নির্মাণ শেষ হয়েছে। চীনের এ নৌঘাঁটি নির্মাণের বিষয়টিকে ভারত খুব সহজভাবে নেয়নি। ভারতও একইভাবে সিসিলি ও মৌরিতুসের দুইটি দ্বীপে তাদের নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে। ২০১৫ সালের মার্চে প্রধানমন্ত্রী মোদির এ দ্বীপ দুইটি সফরের সময় এ নৌঘাঁটি নির্মাণের কথা প্রথমবারের মতো জানা যায়। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, হাসবানতোতায় চীনা সাবমেরিনের উপস্থিতি ভারত তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ বলে মনে করেছিল। ভারত বিষয়টিকে এত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন যে, শেষ পর্যন্ত সেখানে রাজাপাকসের সরকারকে উৎখাত পর্যন্ত করেছিল ভারত। সিরিসেনাকে রাজাপাকসের বলয় থেকে বের করে এনে রাজাপাকসের বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে তাকে বিজয়ী করতে সাহায্য করেছিল ভারত। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হয়েছিল যে, ভারত মহাসাগরে চীনের তৎপরতাকে ভারত স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। এখানে প্রভাব বলয় বিস্তারের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে ভারত ও চীন দ্বন্দ্ব বাড়ছে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান হচ্ছে ভারতের পক্ষে। এ অঞ্চলজুড়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ গড়ে উঠছে, যা চীনা স্বার্থকে আঘাত করছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারত মহাসাগরে ভারতকে চীনের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে। আগামী দিনে এ অঞ্চল ও সেই সঙ্গে দক্ষিণ চীন সাগর প্রত্যক্ষ করবে এক অস্ত্র প্রতিযোগিতা। যে কোনো ধরনের নৌ-সংঘর্ষকেও উড়িয়ে দেয়া যায় না। সুতরাং আজ জন কেরি যখন ভারত সফরে আসছেন, এটাকে স্বাভাবিক একটি সফর ভাবলে ভুল হবে। চীনের কর্তৃপক্ষ চ্যালেঞ্জ করতেই ভারতকে সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে তৈরি করছে যুক্তরাষ্ট্র। কেরির সফর এ আলোকেই রচিত। এক্ষেত্রে কেরি বাংলাদেশেও আসবেন। কিন্তু তাতে করে বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে তেমন পরিবর্তন আসবে না। বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের যে ভূমিকা, যুক্তরাষ্ট্র সেই ভূমিকার বাইরে যেতে পারবে না।
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র
Daily Alokito Bangladesh
28.08.2016
0 comments:
Post a Comment