গেল প্রায় দুই সপ্তাহ আমি জার্মানিতে। এক শহর থেকে আরেক শহর
ঘুরে বেড়াচ্ছি। উদ্দেশ্য হচ্ছে, সাম্প্রতিক ইউরোপে যেসব পরিবর্তন এসেছে,
বিশেষ করে লাখ লাখ সিরীয় শরণার্থীর উপস্থিতি, ব্রেক্সিট থেকে ইংল্যান্ডের
বেরিয়ে যাওয়ার পর জার্মানির রাজনীতি কোন দিকে পরিচালিত হয়, তা কাছ থেকে
দেখা। কিন্তু এখানে থাকতে থাকতেই আমি একটি বড় পরিবর্তন লক্ষ করেছি, এখানে
বসবাসরত তুরস্কের নাগরিকদের নিয়ে এবং জার্মানি তুরস্কের একটি গোপন নথি ফাঁস
করে দেয়ায় তুরস্কের সঙ্গে জার্মানির সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। চলতি মাসের
প্রথম দিক থেকে জার্মানিতে আমার অবস্থানকালীন কোলন শহরে প্রায় ৪০ হাজার
নাগরিকের এক বিশাল র্যালি অনুষ্ঠিত হয়। ওই র্যালিতে এরদোগানের বক্তৃতা
দেয়ার কথা ছিল ইন্টারনেটের মাধ্যমে। কিন্তু জার্মান সরকার ওই অনুমতি দেয়নি।
অভিযোগ আছে, এরদোগান সরকার জার্মানিতে বসবাসকারী তুরস্কের নাগরিকদের যাদের
কেউ কেউ জার্মান নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন, তাদের ব্যবহার করছেন তার সরকারের
জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য। জার্মানিতে প্রায় ৫ লাখ ৭০ হাজার তুরস্কের নাগরিক
বসবাস করেন, যারা ২০১৫ সালে ভোট দিয়েছেন এবং প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ এরদোগান
‘জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ পার্টির পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। জার্মানিতে যে
৩ হাজার মসজিদ রয়েছে, তার মাঝে ২ হাজার মসজিদ পরিচালনা করেন তুরস্কের
নাগরিকরা। জার্মানিতে ইসলাম প্রচারে তুরস্কের নাগরিকদের একটি বড় ভূমিকা
রয়েছে। একসময় তুরস্কের নাগরিকরা ‘গেস্ট ওয়ার্কার’ হিসেবে এদেশে এসেছিলেন
এবং জার্মানির শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎপাদন বৃদ্ধিতে এক বড় ভূমিকা
রেখেছিলেন। এখন এদের সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। তুরস্কের নাগরিকদের দ্বিতীয়
জেনারেশনের কেউ কেউ এরই মধ্যে জার্মানির পার্লামেন্টের সদস্য পযন্ত
হয়েছেন। যেমন মিস্টার ওজডেমিরের কথা বলা যেতে পারে, যিনি এখন জার্মান
পার্লামেন্টের সদস্য। দীর্ঘদিন জার্মান-তুরস্ক সম্পর্ক ভালো থাকলেও এখন এ
সম্পর্কে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে, ১৫ জুলাইয়ের ব্যর্থ সামরিক
অভ্যুত্থানের পর দুই দেশের আস্থার সম্পর্কে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এরদোগান তার
বৈদেশিক সম্পর্কে বড় পরিবর্তন এনেছেন। যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি সরাসরি
অভিযুক্ত করেছেন সামরিক অভ্যুত্থানে জড়িত হওয়ার। রাশিয়া তিনি সফর করেছেন
এবং এ বিষয়ে আমার একটি নিবন্ধ এর আগে আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকায় ছাপা
হয়েছিল। ফলে তুরস্কের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক বৃদ্ধি পাওয়ায় জার্মানির সঙ্গে
সম্পর্কের প্রশ্নে তা প্রভাব ফেলছে। বলা হচ্ছে, তুরস্ক এখন ন্যাটোর
বিভক্তিকে আরও বৃদ্ধি করতে পারে। অর্থাৎ তুরস্কের ভূমিকার কারণে আগামীতে
ন্যাটো ভেঙে যেতে পারে। ফলে পুরো ইউরোপে, বিশেষ করে জার্মানিতে এরদোগানকে
নিয়ে আলোচনা এখন বেশি। এরদোগানের ভূমিকা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি এখন
তুরস্ককে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? প্রথমত, প্রেসিডেন্ট এরদোগান যেভাবে
শাসনকার্য পরিচালনা করছিলেন, সে ব্যাপারে অনেকেরই আপত্তি আছে। তার বিরুদ্ধে
অনেক অভিযোগের একটি হচ্ছে, তিনি ক্ষমতা নিজের হাতে রাখতে চান। ২০০৩ সালে
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি একটানা
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে গেছেন। কিন্তু সংবিধান তাকে আরও একবার
দায়িত্ব পালনের সুযোগ না দেয়ায় তিনি ২০১৪ সালের ২৮ আগস্ট প্রেসিডেন্টের
দায়িত্ব নেন। এক পর্যায়ে তার ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে তিনি প্রেসিডেন্ট
শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ফলে তিনি তার একসময়ের
বিশ্বস্ত ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী আহমেত দাভুলগলুর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যান
এবং দাভুলগলুকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। দ্বিতীয়ত, তিনি রাজধানী আঙ্কারার
একটি পাহাড়ে প্রেসিডেন্ট হাউস নির্মাণ করছেন, যার পরিচিতি ‘হোয়াইট
প্যালেস’ হিসেবে। প্রায় ১ হাজার কক্ষবিশিষ্ট এ বাড়িটি ওয়াশিংটন ডিসিতে
অবস্থিত মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাসস্থান হোয়াইট হাউস থেকেও বড়। নির্মাণ
ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬১৫ মিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৪ হাজার ৯২০ কোটি।
এত বিপুল অর্থ ব্যয় করে প্রাসাদতুল্য এ ধরনের একটি ভবন তৈরি করা আদৌ উচিত
কিনা, সে প্রশ্ন কোনো কোনো মহলে উঠেছে। তৃতীয়ত, এরদোগানের মন্ত্রিসভার অনেক
সদস্য ও তাদের পরিবারবর্গ সরাসরি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন।
শীর্ষস্থানীয় একেপি দলের নেতাদের এ দুর্নীতি তিনি রোধ করতে পারেননি।
চতুর্থত, ইরানের বিরুদ্ধে যখন আন্তর্জাতিক অবরোধ বজায় ছিল, তখন তুরস্ক ইরান
থেকে তেল ও গ্যাস আমদানি করে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করেছে। একই কথা
প্রযোজ্য, সিরিয়ার আইএস (ইসলামিক স্টেট) বিদ্রোহীর ক্ষেত্রেও। সিরিয়া এবং
ইরাকের অনেক তেলক্ষেত্র দখল করে নিয়েছিল আইএস বিদ্রোহীরা। তারা ওই
তেলক্ষেত্র থেকে তেল উত্তোলন করে অবৈধপথে তুরস্ক দিয়ে ওই তেল বিদেশে রফতানি
করত। এ তেল বিক্রি ছিল আইএসের অর্থ আয়ের অন্যতম উৎস। বিশ্ব যখন
মোটামুটিভাবে আইএসের জঙ্গি তৎপরতার ব্যাপারে উৎকণ্ঠিত, তখন তুরস্ক আইএসের
অর্থ আয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। এমন কথাও শোনা যায়, জঙ্গিদের প্রশিক্ষণও
দেয়া হয় তুরস্কের কোনো কোনো গোপন আস্তানায়(?)। পঞ্চমত, খোদ এরদোগানের
বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ, তিনি নিজেকে এরই মধ্যে তুরস্কের ‘সুলতান’ ভাবতে শুরু
করেছেন। তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য ১৮০৮ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত
ছিল। একদিকে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া, মধ্য এশিয়ার ককেশিয়ান অঞ্চল
ও অন্যদিকে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন তুরস্কের
শাসকরা, যারা সুলতান হিসেবে পরিচিত ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের
পরপরই এ রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। ১৯২২ সালের ১ নভেম্বর অটোমান সাম্রাজ্যের
অবসানের ঘোষণা করা হয়। এরপর কামাল পাশার নেতৃত্বে আধুনিক তুরস্কের
গোড়াপত্তন হয়। এখন এরদোগান যেভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করছেন, যেভাবে মুসলিম
বিশ্বের নেতৃত্ব দেয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন, তাতে করে কেউ কেউ তাকে
সাবেক অটোমান শাসকদের সঙ্গে তুলনা করছেন। ষষ্ঠত, গেল বছর তুরস্কের জনপ্রিয়
পত্রিকা জামান এর নিয়ন্ত্রণভার সরকারের হাতে তুলে দেয়া হয়। অর্থাৎ দৈনিক
পত্রিকাটি সরকারীকরণ করা হয়। এর মাধ্যমে তিনি মিডিয়ার ওপর তার নিয়ন্ত্রণ
প্রতিষ্ঠা করেন।
তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয়। নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা তার আছে। রাজনীতি বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে ‘ক্যারিসম্যাটিক’ বা সম্মোহনী নেতৃত্ব বলে, সেই সম্মোহনী নেতৃত্ব তার রয়েছে। মুসলিমপ্রধান দেশগুলোকে এক প্লাটফর্মে নিয়ে আসার মহাপরিকল্পনা তার রয়েছে। চীনের মতোই পুরনো ‘সিল্ক রোড’কে তিনি পুনরুজ্জীবিত করতে চান। তুরস্কে আমি দেখেছি, আফ্রিকার অনেক গরিব দেশের শিশুদের তার সরকার আশ্রয় দিয়েছে। ইসলামিক মতাদর্শের প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস থাকলেও, তিনি ওয়াহেবি বা জিহাদি মতাদর্শে বিশ্বাসী নন। একসময়ের ফুটবল খেলোয়াড় এরদোগান তার রাজনৈতিক জীবন গড়ে তুলেছেন ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টির নেতা নেকমাতিন এরবাকানের ছত্রছায়ায়। তিনি ছিলেন প্রাচীন নগরী ইস্তানবুলের জনপ্রিয় মেয়র। এ ইস্তানবুলই হচ্ছে তার ‘ক্ষমতার ঘাঁটি’। যখন অভ্যুত্থানকারীরা আঙ্কারার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়েছিল, তখন তিনি ছিলেন অবসরকালীন ছুটিতে। তিনি কর্মীদের আহ্বান জানিয়েছিলেন, রাস্তায় অবস্থান নিতে। আর হাজার হাজার সমর্থক ইস্তানবুলের রাস্তায় অবস্থান নিয়ে অভ্যুত্থানকারীদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিয়েছিল। এখানে বলা দরকার, নেকমাতিন এরবাকানের নেতৃত্বে ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টি ‘অতি ইসলামিক’ এবং তুরস্কের সংবিধানের মূল ধারার (অর্থাৎ ধর্ম নিরপেক্ষতার) পরিপন্থী হওয়ায় দলটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল, যা কিনা সেনাবাহিনী চেয়েছিল। দলটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ায় ওই দলের সমর্থকরা প্রথমে ভার্চু পার্টি গঠন করে এবং পরে গঠন করে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি, যা একেপি নামেও পরিচিত। আবদুল্লাহ গুল ও এরদোগান একেপি পার্টি গঠনের উদ্যোক্তা। ২০০২ সালের নির্বাচনে একেপি পার্টি বিজয়ী হওয়ায় আবদুল্লাহ গুল প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। এরদোগান তখন ছিলেন জেলে। একটি কবিতা আবৃত্তি করার অভিযোগে যেখানে তিনি তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে কটাক্ষ করেছিলেন, তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়েছিল। একেপি পার্টি সরকার গঠন করে তার সাজা মওকুফ করে দেয়। তিনি উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সংসদে আসেন, প্রধানমন্ত্রী হন আর আবদুল্লাহ গুল হন প্রেসিডেন্ট। সেই থেকে তার যাত্রা শুরু। ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে তিনি আর প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। হয়েছেন প্রেসিডেন্ট এবং সংবিধানে পরিবর্তন এনে তুরস্ককে রাষ্ট্রপতি শাসিত একটি দেশে পরিণত করেছেন। দেশটিতে একজন প্রধানমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি ক্যাবিনেট থাকলেও মূল ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে।
এখন ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর সন্দেহাতীতভাবে এরদোগানের হাত আরও শক্তিশালী হয়েছে। একটি শক্তিশালী প্রেসিডেন্সি কি তুরস্কের গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবে? একটি জিনিস অবশ্য লক্ষণীয়, আর তা হচ্ছে, এরদোগান আর একেপি পার্টির ক্ষমতা পরিচালনা নিয়ে নানা প্রশ্ন ও বিতর্ক থাকলেও সংসদে সব বিরোধী দল একত্রিত হয়ে সামরিক অভ্যত্থানের উদ্যোগকে সমালোচনা করেছে। এরদোগানের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রেসিডেন্ট এরদোগানও সব বিরোধী দলকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। গণতন্ত্রের জন্য এটা একটা মেসেজ। জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে জাতি যদি বিভক্ত থাকে, তাহলে গণতন্ত্রও শক্তিশালী হয় না। তুরস্কের গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েনি, একটি ধাক্কা খেয়েছে। এক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্যটা বড় প্রয়োজন। তবে সেই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট এরদোগানেরও দায়িত্ব রয়েছে অনেক। ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’ এটা তুরস্কের জনগণ প্রমাণ করেছেন। কিন্তু ব্যক্তি-স্বাধীনতা, আইনের শাসন, মিডিয়ার স্বাধীনতা, স্বাধীন বিচার বিভাগÑ এসব যদি নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে সত্যিকার গণতন্ত্রের স্বাদ তুরস্কের জনগণ পাবে না। অভ্যুত্থান-পরবর্তী তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের কাছে প্রত্যাশা তাই অনেক বেশি। কিন্তু যে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তুরস্কের সঙ্গে জার্মানির সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। বাটেন-উটেনবুর্গ প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী উইনফ্রিড ক্রেটসম্যান অভিযোগ করেছেন, তার প্রদেশে গুলেন সমর্থিতদের দ্বারা পরিচালিত স্কুল বন্ধ করে দেয়ার জন্য তুরস্ক সরকার তাকে অনুরোধ করেছে। এটা তিনি করবেন না বলেও জানিয়েছেন। জুনে জার্মান পার্লামেন্ট একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তাতে তুরস্ক কর্তৃক অতীতে আরমেনিয়ানদের হত্যা করার ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত তুরস্ক সরকার ভালো চোখে নেয়নি। এরদোগান জার্মান পার্লামেন্ট সদস্যদের তুরস্কে অবস্থানরত ন্যাটোর ঘাঁটি ভ্রমণের অনুমতিও দেননি। ফলে দুই দেশের সম্পর্কে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে।
এরদোগান তুরস্কে একটি বড় পরিবর্তন আনতে চাচ্ছেন। প্রায় ৮০ হাজার কর্মকর্তা, তথা কর্মচারীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তিনি এখন অত্যন্ত শক্তিশালী এক ‘শাসক’। তবে স্পষ্টতই এটা করতে গিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে তিনি ‘বন্ধু’ হারিয়েছেন। এতে করে তার ‘স্বার্থ’ হয়তো হাসিল হতে পারে। কিন্তু তার ব্যক্তিগত ‘ইমেজ’ থাকবে নানা প্রশ্নের মুখে।
ফ্রাঙ্কফুট, জার্মানি
Daily Alokito Bangladesh
21.08.16
তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয়। নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা তার আছে। রাজনীতি বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে ‘ক্যারিসম্যাটিক’ বা সম্মোহনী নেতৃত্ব বলে, সেই সম্মোহনী নেতৃত্ব তার রয়েছে। মুসলিমপ্রধান দেশগুলোকে এক প্লাটফর্মে নিয়ে আসার মহাপরিকল্পনা তার রয়েছে। চীনের মতোই পুরনো ‘সিল্ক রোড’কে তিনি পুনরুজ্জীবিত করতে চান। তুরস্কে আমি দেখেছি, আফ্রিকার অনেক গরিব দেশের শিশুদের তার সরকার আশ্রয় দিয়েছে। ইসলামিক মতাদর্শের প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস থাকলেও, তিনি ওয়াহেবি বা জিহাদি মতাদর্শে বিশ্বাসী নন। একসময়ের ফুটবল খেলোয়াড় এরদোগান তার রাজনৈতিক জীবন গড়ে তুলেছেন ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টির নেতা নেকমাতিন এরবাকানের ছত্রছায়ায়। তিনি ছিলেন প্রাচীন নগরী ইস্তানবুলের জনপ্রিয় মেয়র। এ ইস্তানবুলই হচ্ছে তার ‘ক্ষমতার ঘাঁটি’। যখন অভ্যুত্থানকারীরা আঙ্কারার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়েছিল, তখন তিনি ছিলেন অবসরকালীন ছুটিতে। তিনি কর্মীদের আহ্বান জানিয়েছিলেন, রাস্তায় অবস্থান নিতে। আর হাজার হাজার সমর্থক ইস্তানবুলের রাস্তায় অবস্থান নিয়ে অভ্যুত্থানকারীদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিয়েছিল। এখানে বলা দরকার, নেকমাতিন এরবাকানের নেতৃত্বে ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টি ‘অতি ইসলামিক’ এবং তুরস্কের সংবিধানের মূল ধারার (অর্থাৎ ধর্ম নিরপেক্ষতার) পরিপন্থী হওয়ায় দলটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল, যা কিনা সেনাবাহিনী চেয়েছিল। দলটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ায় ওই দলের সমর্থকরা প্রথমে ভার্চু পার্টি গঠন করে এবং পরে গঠন করে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি, যা একেপি নামেও পরিচিত। আবদুল্লাহ গুল ও এরদোগান একেপি পার্টি গঠনের উদ্যোক্তা। ২০০২ সালের নির্বাচনে একেপি পার্টি বিজয়ী হওয়ায় আবদুল্লাহ গুল প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। এরদোগান তখন ছিলেন জেলে। একটি কবিতা আবৃত্তি করার অভিযোগে যেখানে তিনি তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে কটাক্ষ করেছিলেন, তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়েছিল। একেপি পার্টি সরকার গঠন করে তার সাজা মওকুফ করে দেয়। তিনি উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সংসদে আসেন, প্রধানমন্ত্রী হন আর আবদুল্লাহ গুল হন প্রেসিডেন্ট। সেই থেকে তার যাত্রা শুরু। ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে তিনি আর প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। হয়েছেন প্রেসিডেন্ট এবং সংবিধানে পরিবর্তন এনে তুরস্ককে রাষ্ট্রপতি শাসিত একটি দেশে পরিণত করেছেন। দেশটিতে একজন প্রধানমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি ক্যাবিনেট থাকলেও মূল ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে।
এখন ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর সন্দেহাতীতভাবে এরদোগানের হাত আরও শক্তিশালী হয়েছে। একটি শক্তিশালী প্রেসিডেন্সি কি তুরস্কের গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবে? একটি জিনিস অবশ্য লক্ষণীয়, আর তা হচ্ছে, এরদোগান আর একেপি পার্টির ক্ষমতা পরিচালনা নিয়ে নানা প্রশ্ন ও বিতর্ক থাকলেও সংসদে সব বিরোধী দল একত্রিত হয়ে সামরিক অভ্যত্থানের উদ্যোগকে সমালোচনা করেছে। এরদোগানের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রেসিডেন্ট এরদোগানও সব বিরোধী দলকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। গণতন্ত্রের জন্য এটা একটা মেসেজ। জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে জাতি যদি বিভক্ত থাকে, তাহলে গণতন্ত্রও শক্তিশালী হয় না। তুরস্কের গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েনি, একটি ধাক্কা খেয়েছে। এক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্যটা বড় প্রয়োজন। তবে সেই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট এরদোগানেরও দায়িত্ব রয়েছে অনেক। ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’ এটা তুরস্কের জনগণ প্রমাণ করেছেন। কিন্তু ব্যক্তি-স্বাধীনতা, আইনের শাসন, মিডিয়ার স্বাধীনতা, স্বাধীন বিচার বিভাগÑ এসব যদি নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে সত্যিকার গণতন্ত্রের স্বাদ তুরস্কের জনগণ পাবে না। অভ্যুত্থান-পরবর্তী তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের কাছে প্রত্যাশা তাই অনেক বেশি। কিন্তু যে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তুরস্কের সঙ্গে জার্মানির সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। বাটেন-উটেনবুর্গ প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী উইনফ্রিড ক্রেটসম্যান অভিযোগ করেছেন, তার প্রদেশে গুলেন সমর্থিতদের দ্বারা পরিচালিত স্কুল বন্ধ করে দেয়ার জন্য তুরস্ক সরকার তাকে অনুরোধ করেছে। এটা তিনি করবেন না বলেও জানিয়েছেন। জুনে জার্মান পার্লামেন্ট একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তাতে তুরস্ক কর্তৃক অতীতে আরমেনিয়ানদের হত্যা করার ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত তুরস্ক সরকার ভালো চোখে নেয়নি। এরদোগান জার্মান পার্লামেন্ট সদস্যদের তুরস্কে অবস্থানরত ন্যাটোর ঘাঁটি ভ্রমণের অনুমতিও দেননি। ফলে দুই দেশের সম্পর্কে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে।
এরদোগান তুরস্কে একটি বড় পরিবর্তন আনতে চাচ্ছেন। প্রায় ৮০ হাজার কর্মকর্তা, তথা কর্মচারীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তিনি এখন অত্যন্ত শক্তিশালী এক ‘শাসক’। তবে স্পষ্টতই এটা করতে গিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে তিনি ‘বন্ধু’ হারিয়েছেন। এতে করে তার ‘স্বার্থ’ হয়তো হাসিল হতে পারে। কিন্তু তার ব্যক্তিগত ‘ইমেজ’ থাকবে নানা প্রশ্নের মুখে।
ফ্রাঙ্কফুট, জার্মানি
Daily Alokito Bangladesh
21.08.16
0 comments:
Post a Comment