রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কেরির ঢাকা সফর ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা



বাংলাদেশ অনেকদিন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে শুল্কমুক্ত জিএসপি সুবিধা চেয়ে আসছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশ এ সুবিধা চাইছে। কিন্তু বাংলাদেশকে এ সুবিধা দেয়া হয়নি। অথচ ১৫ দশমিক ৬২ ভাগ শুল্ক পরিশোধ করে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী তৈরি পোশাকের বিশাল এক বাজার গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী এখন ভিয়েতনাম। টিপিপি বা ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ চুক্তির ফলে ভিয়েতনামের পণ্য এখন বিনা শুল্কে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করবে। যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলো এখন ভিয়েতনামি তৈরি পোশাকে ভরা। ফলে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে। শুল্কমুক্ত থাকায় ভিয়েতনামি তৈরি পোশাক (শার্ট, ট্রাউজার, জ্যাকেট, ব্লেজার) সস্তা। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে মার খাচ্ছে। উপরন্তু তৈরি পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র নানা প্রতিবন্ধকতা আরোপ করায় (ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, মানসম্মত কারখানা ইত্যাদি) অনেক তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে অথবা যুক্তরাষ্ট্রে তাদের রফতানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সুতরাং বাংলাদেশের এই মুহূর্তে অগ্রাধিকার জিএসপি সুবিধা নিশ্চিত করা। জন কেরির ঢাকা সফরে বিষয়টি আলোচনায় আসবে। বাণিজ্যমন্ত্রী একবার বলেছিলেন, জিএসপি সুবিধা না দেয়ার বিষয়টি ‘রাজনৈতিক’। এটা আদৌ রাজনৈতিক বক্তব্য নাকি সত্যিকার অর্থেই যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক সুবিধা নেয়ার আশায় জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল (কিছু কিছু পণ্যে জিএসপি সুবিধা বাংলাদেশ পেত)- বিষয়টি স্পষ্ট না হলেও এটা সত্য বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বারবার জিএসপি সুবিধা প্রাপ্তিকে গুরুত্ব দিয়ে আসছিল। তবে একটা কথা এখানে বলা প্রয়োজন, আর তা হচ্ছে- বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাংলাদেশের অনুকূলে। অর্থাৎ বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে বেশি রফতানি করে, আমদানি করে সে তুলনায় কম। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত সূত্রমতে, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত বাংলাদেশ রফতানি করেছে ৩০৫২ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য, আর আমদানি করেছে ৪৩৯ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এই ৬ মাসে ঘাটতির পরিমাণ ২৬১২ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার। গত কয়েক বছর ধরেই এ ঘাটতি বাড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ২০১৫ সালে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫০৪৮ মিলিয়ন ডলার, ২০১৪ সালে ৪১৬৪ মিলিয়ন ডলার, ২০১৩ সালে ৪৬৪৩ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার, ২০১২ সালে ৪৪০৭ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার, আর ২০১১ সালে ৩৭৩৩ মিলিয়ন ডলার। জিএসপি সুবিধা না পেলেও বাংলাদেশ যে রফতানি বাড়াতে পারছে, এটাই বড় প্রমাণ।

যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলকে কেন্দ্র করে যে নীতি প্রণীত হয়েছে, বাংলাদেশ তারই অন্তর্ভুক্ত। নানা কারণে অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এই এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলকে যুক্তরাষ্ট্র বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এর প্রধান কারণ চীন। চীনকে ঘিরে ফেলার এক সদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া-প্যাসিফিক নীতি প্রণয়ন করছে। আর এ কারণেই বাংলাদেশ তথা ভারতের গুরুত্ব যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নীতিনির্ধারকদের কাছে অনেক বেশি। একদিকে ভারত মহাসাগর, অন্যদিকে দক্ষিণ চীন সাগর- এই দুটো অঞ্চলকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র এক মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের ৬টি জাহাজ মোতায়েন করা হবে। উদ্দেশ্য ভারত মহাসাগরে চীনা নৌবাহিনীর মুভমেন্টের দিকে লক্ষ্য রাখা। দক্ষিণ চীন সাগরকে বলা হচ্ছে সম্ভাব্য একটি স্থান, যাকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে বড় ধরনের সামরিক সংঘর্ষের সূত্রপাত হতে পারে। বছরে এই দক্ষিণ চীন সাগর এলাকা দিয়ে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য পরিবাহিত হয়। অর্থাৎ এই রুট ব্যবহার করে পণ্য পৃথবীর বিভিন্ন দেশে যায়, যার একটা বড় অংশ চীন রফতানি করে। ১১ বিলিয়ন ব্যারেল তেল ও ১৯০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট গ্যাস রয়েছে এ অঞ্চলে। বছরে এ অঞ্চল থেকে ১০ মিলিয়ন টন মৎস্য আহরণ করা হয়। ফলে চীনের এ অঞ্চলের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এ অঞ্চল ঘিরে উত্তেজনা বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী জাহাজ এ অঞ্চলে ঘোরাফেরা করছে। এ অঞ্চলের মালিকানা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালত সম্প্রতি চীনের দাবি খারিজ করে দিলেও চীন তা মেনে নেয়নি। ফিলিপাইনের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে চীন। ফলে এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়লে, তার ঢেউ এসে লাগবে ভারত মহাসাগরেও। সুতরাং চীনের বিরুদ্ধে একটি শক্ত অবস্থান নেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার তৎপরতা বাড়াবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই জন কেরির বাংলাদেশ ও ভারত সফর এ দৃষ্টিতেই আমাদের দেখতে হবে। মোদির জমানায় ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও বেড়েছে। ভারতে মার্কিন বিনিয়োগ বেড়েছে। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজির অংশ। ভারতকে তার প্রয়োজন এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমানোর জন্য। ফলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের যে নীতি, সেই নীতি ভারতকে আস্থায় নিয়েই তৈরি করা। অর্থাৎ ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের আলোকেই বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক রচিত হবে। আলাদা করে বাংলাদেশের ব্যাপারে কোনো নীতি প্রণয়ন করবে না যুক্তরাষ্ট্র। এবং যুক্তরাষ্ট্র এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না, যাতে ভারতের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়। ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের প্রয়োজন খুব বেশি।

কেরির ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও গণতন্ত্র প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা নিয়ে কথা হতে পারে। সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা যুক্তরাষ্ট্র বারবার বলে এসেছে। কেরি এ বিষয়টাকে আবারও গুরুত্ব দেবেন। এবং মানবাধিকার পরিস্থিতির যাতে উন্নতি হয়, সে ব্যাপারেও তিনি কথা বলবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আসলে এ ধরনের বক্তব্য নতুন নয়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে এই বিষয়গুলো আছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র কখনও এই বিষয়গুলো নিয়ে কোনো ‘শর্ত’ আরোপ করে না। কেরির সফরে এ ধরনের কোনো সম্ভাবনাও নেই। জন কেরির এ সফরে বিশ্ব মিডিয়ায় বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়বে। মার্কিন মিডিয়ায় নতুন করে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হবে। তবে এ সফরের মধ্য দিয়ে খুব বড় ধরনের অগ্রগতি সাধিত হবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।

ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র
Daily Jugantor
28.08.2016

0 comments:

Post a Comment