রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কোন পথে জার্মানি

গত প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে জার্মানিতে থেকে যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হল, কোন পথে জার্মানি? বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জার্মানির ভূমিকাকে সামনে নিয়ে এসেছে। জার্মানি শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যেই বড় দেশ নয়। জার্মান বিশ্ব শক্তি। এখন জার্মানির ভূমিকা কী হবে? ইউরোপের ঐক্য ধরে রাখতে জার্মানির ভূমিকা কী হবে? জার্মানি বড় দেশ। বড় অর্থনীতি। সাধারণ নিয়মে জিডিপিতে বিশ্বে জার্মানির অবস্থান চতুর্থ (৩ দশমিক ৩৭১ ট্রিলিয়ন ডলার); মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে বিশ্বে এ অবস্থান ২০তম (৪১ হাজার ২৫৭ ডলার)। আর পিপিপির হিসেবে, অর্থাৎ ব্যয় ক্ষমতার ভিত্তিতে এর পরিমাণ ৩ দশমিক ৮৪২ ট্রিলিয়ন ডলার (৫ম) এবং ৪৭ হাজার ৩৩ ডলার (মাথাপিছু আয়)। ফলে ব্রিটেন যখন ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল, তখন থেকেই সবার দৃষ্টি জার্মানির দিকে। ১৯৯৩ সালে ইইউ গঠনের উদ্যোক্তাদের অন্যতম হচ্ছে জার্মানি। ১৯৯৯ সালে যখন ইউরো জোন গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়, তখনও জার্মানি ছিল এর প্রধান উদ্যোক্তা। ফলে ইইউকে ধরে রাখা, একক মুদ্রা হিসেবে ইউরোকে আরও শক্তিশালী করাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে জার্মানির ভূমিকা এখন বড়। এ ভূমিকা জার্মানি এখন কতটুকু পালন করতে পারবে, এ প্রশ্ন এখন অনেকেই করছেন।

জার্মানির সঙ্গে আমার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। আমার শিক্ষাজীবনের একটা সময় কেটেছে জার্মানিতে। আজ এত বছর পর জার্মানিতে এসে পরিবর্তন দেখেছি অনেক, যা আমাকে অবাক করেছে। জার্মানি আরও বড় হয়েছে। শক্তিশালী হয়েছে। যে ফ্রাংকফুর্ট শহরকে আমি রেখে গিয়েছিলাম ২৫ বছর আগে, সেই ফ্রাংকফুর্ট শহর এখন অনেক বড়। আকাশছোঁয়া সব ভবন হচ্ছে। নতুন নতুন এলাকা গড়ে তোলা হচ্ছে। এ ফ্রাংকফুর্ট শহরকে আমি আর চিনতে পারি না। আমি যে বিভাগে পড়াশোনা করেছি, তার নামও কিছুটা বদলে গেছে। বর্তমান চেয়ারম্যান, তিনিও নতুন। আমাকে তিনি দেখেননি কখনও। তবে ছাত্রদের সুযোগ বেড়েছে অনেক। অনেক ফান্ড আছে। এখানে এখনও উচ্চশিক্ষা ‘ফ্রি’। আরও মজার কথা, ছাত্রদের প্রতি সেমিস্টারে (বছরে দুই সেমিস্টার) যে ‘ফি’ দিতে হয় মাত্র ২৮০ ইউরো (বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা আলাদা) এবং এর বদৌলতে ছাত্রদের শহরের মধ্যে ট্রামে বা বাসে চলাচল ফ্রি। অর্থাৎ ছাত্ররা বিনা পয়সায় পড়াশোনা ও যাতায়াতের সুযোগ পায়। আমাদের সময় এমন সুযোগ ছিল না। বড় শহরে ছাত্ররা ৭০০ ইউরোতে মাস চালাতে পারে, যা সপ্তাহে দু’দিন কাজ করে একজন ছাত্র অর্জন করতে পারে। শুধু স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলো ছাড়া অন্য কোনো দেশে এ সুযোগ নেই। আমাদের দেশের ছাত্ররা এ সুযোগটি কেন নেয় না, আমি বুঝতে পারি না। আগে পাস করার পর কাজের সুযোগ মিলত না, এখন মিলছে। ডিগ্রি নেয়ার পর সরকার সুযোগ দিচ্ছে কাজ করার ও অভিজ্ঞতা অর্জন করার। আমার সরাসরি ছাত্রী রহিমা আক্তার মাস্টার্স করে এখন ছোট শহর উজবুর্গে একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ করছে। মারুফ পিএইচডি করে এখন এখানে শিক্ষকতার অপেক্ষায় আছে।

জার্মান রাজনীতিকদের দূরদর্শিতার প্রশংসা করতে হয়। সারা বিশ্বে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যখন জাতিগত বিদ্বেষ বাড়ছে, তখন জার্মানিতে এ সমস্যা নেই বললেই চলে। প্রায় ১০ লাখ সিরীয়কে আশ্রয় দিয়েছে জার্মানি- চিন্তা করা যায়? মানবতা এখানে নিঃসন্দেহে বড় ভূমিকা পালন করেছে। পুরো ইউরোপজুড়ে সিরীয় শরণার্থীদের যখন ভিন্ন চোখে দেখা হচ্ছে, যখন পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী শুধু খ্রিস্টীয় ধর্মাবলম্বীদের আশ্রয় দেয়ার কথা বলেছিলেন, সেখানে জার্মানি তার ‘দুয়ার’ খুলে দিয়েছিল। যদিও কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, জার্মানিতে জন্মহার কমে যাওয়ায় ফ্যাক্টরি চালাতে দক্ষ মানবসম্পদ পাওয়া যাবে না, এটা বিবেচনায় নিয়েই সিরীয় শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়া হয়েছে। এর পেছনে হয়তো সত্যতা কিছুটা আছে, কিন্তু মানবতাবোধ থেকে লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল জার্মানি, এটা তো অস্বীকার করা যাবে না! শরণার্থীদের জন্য জার্মানি আগামী ৫ বছর ৯৪ বিলিয়ন ইউরো খরচ করবে। জার্মানির এ প্রতিশ্রুতি একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আমার ধারণা ছিল, ২০১৫ সালেই জার্মানির চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেল তার ‘অবদানের’ জন্য নোবেল পুরস্কার পাবেন। তিনি তা পাননি। তবে ২০১৬ সালে এ পুরস্কারের জন্য তার নাম বিবেচনায় আছে, তা বলতেই হয়। বলা প্রয়োজন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী জার্মানির যে রাজনীতি, তা নিয়ন্ত্রণ করছে দুটো বড় দল- এসপিডি ও সিডিইউ। কখনও এসপিডি থেকে চ্যান্সেলর বা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন, কখনও বা সিডিইউ থেকে। তবে সিডিইউর বেভেরিয়ার অঙ্গ সংগঠন হচ্ছে সিএসইউ। ২০১৩ সালের ১৮তম সংসদ নির্বাচনের পর সিডিইউ আর এসপিডির সমন্বয়ে একটি গ্রান্ড কোয়ালিশনের জন্ম হয়েছে। জার্মান পার্লামেন্টের ৬৩১ সদস্যের মধ্যে ৫০৪ সদস্য বর্তমানে এ কোয়ালিশনের সদস্য। এর মাঝে ৩১১ সদস্য সিডিইউ/সিএসইউর সদস্য। অন্যদিকে এসপিডির সদস্য মাত্র ১৯৩। বিরোধী দলে আছে দি লেফ্ট (৬৪ সদস্য) এবং অ্যালায়েন্স ’৯০ ও গ্রিন (৬৩ সদস্য)। বোঝাই যায়, এ বামপন্থীদের ভূমিকা সীমিত। গ্রান্ড কোয়ালিশন থাকায় যৌথভাবে তারা শরণার্থীদের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল। এটাই একটা প্লাস পয়েন্ট। এখানে শরণার্থীদের ব্যাপারে দক্ষিণপন্থীদের আপত্তি রয়েছে এবং কয়েকটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু তা সরকারের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। একটা ভয় ছিল, শরণার্থীদের ব্যাপক অভিবাসনের ফলে জার্মানিতে দক্ষিণপন্থীদের উত্থান ঘটতে পারে। জার্মানিতে চরম দক্ষিণপন্থী ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি অব জার্মানির (এনডিপি) উত্থান ঘটলেও, তা জনমানসে কোনো বড় প্রভাব ফেলেনি। এনডিপি আদৌ কোনোদিন জার্মান পার্লামেন্টে আসতে পারবে বলে মনে হয় না। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, নাজি পার্টি নেতা হিটলারকে এ দেশের জনগণই ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছিল। তবে অনেকেই মনে করেন, এ ধরনের সম্ভাবনা এখন আর নেই।

গত কয়েকদিন ফ্রাংকফুর্টের সাইলের বিপণিবিতান এলাকায় লক্ষ্য করেছি, কীভাবে জনসংখ্যার মধ্যে পরিবর্তন আসছে। ফ্রাংকফুট এখন ছোটখাটো নিউইয়র্কে পরিণত হয়েছে। বলতে গেলে ফ্রাংকফুর্টে এখন প্রতিটি দেশের নাগরিক খুঁজে পাওয়া যাবে। সাইলের শপিংমলে যারা যাচ্ছেন, তাদের মধ্যে ৬০ ভাগ অভিবাসী, অর্থাৎ অন্য দেশ থেকে এখানে এসেছেন। এর ফলে এখানে একটা মিশ্র জনসংখ্যা তৈরি হচ্ছে। বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে, জার্মান ভাষা শিখছে- বোঝার উপায় নেই, এরা আদি জার্মান কিনা! পূর্ব ইউরোপ থেকে প্রচুর অভিবাসন হয়েছে শেঙেন চুক্তির কারণে। পূর্ব ইউরোপের সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো থেকে যারা শেঙেন চুক্তির কারণে আসতে পেরেছিলেন, তারা ছিলেন দক্ষ। চাকরি পেতে সমস্যা হয়নি। আমি ফ্রাংকফুটের পাশে এসর্বন নামে একটা ছোট্ট শহরে ছিলাম। এখানে আমার বন্ধু কামাল থাকে। ৮০’র দশকে আমি যখন এখানে নিয়মিত আসতাম, তখন এটি ছিল মূলত একটি গ্রাম, কোনো প্রতিষ্ঠান তেমন একটা ছিল না। এখন এসর্বন শহরকে চেনা যায় না। কর্পোরেট জগতের অনেকগুলো হেড অফিস এখানে। এখানেই গড়ে উঠছে ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকের কার্যালয়। অফিস সময় পার হলেই দেখা যায় শত শত তরুণ, যারা সবাই উচ্চশিক্ষিত এবং ৮০ ভাগই বিদেশী, রাস্তা পার হয়ে ট্রাম ধরছে বাড়িতে যাওয়ার জন্য। আমি লক্ষ্য করেছি, এদের মধ্যে ভারতীয় ও চাইনিজের সংখ্যা বেশি। এরা আইটি বিশেষজ্ঞ, যে বিশেষজ্ঞ জার্মান স্কুলগুলো তৈরি করতে পারেনি। এসব জায়গায় আমরা দক্ষ জনশক্তি পাঠাতে পারতাম। আমি বারবার বলেছি এবং এখনও বলছি, আইটি সেক্টরকে আরও গুরুত্ব দিতে। এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের দেশে। কিন্তু দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারছি না, শুধু বেকারের সংখ্যা বাড়াচ্ছি। অথচ এই জার্মানিতেই দক্ষ জনশক্তির (আইটি, ডাক্তার, নার্স, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিসিন ইত্যাদি) বাজার আমরা সৃষ্টি করতে পারতাম, যেমনটি করেছে ভারত ও চীন। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী জিপিএ-৫ নিয়ে গর্ব করেন। কিন্তু জিপিএ-৫ আমাদের দক্ষ জনশক্তি উপহার দিতে পারেনি। জার্মানিতে এসে আমার উপলব্ধি হয়েছে, এখনও সুযোগ আছে। আমরা এ সুযোগটি কাজে লাগাতে পারি।

জার্মানির রাষ্ট্রীয় চরিত্রও বদলে যাচ্ছে। বিভিন্ন সংস্কৃতির সমন্বয়ে নতুন এক সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে। হিজাবি মহিলাদের সংখ্যাও বাড়ছে। ফ্রাংকফুট শহরের বিপণিবিতান সাইলের রাস্তায় হিজাবি মহিলা দেখা এখন অতি সাধারণ একটি ঘটনা। পুরো শরীর বোরকায় ঢাকা একাধিক মহিলাও আমি দেখেছি রাস্তায়। বদলে যাচ্ছে ফ্রাংকফুটের চরিত্র। তবে আমাকে যা অবাক করেছে, তা হচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তি। নিউইয়র্ক শহরের মতো এই ফ্রাংকফুট শহরেও আমি দেখেছি মানুষকে, বিশেষ করে মহিলাদের ভিক্ষা করতে, যা আগে ছিল না। তবে অধিকাংশই বিদেশী। ডাস্টবিন থেকে কোকের বোতল সংগ্রহ করার দৃশ্য খুব স্বাভাবিক একটি ঘটনা। প্রতি বোতল বিক্রি করে এরা পায় ২৫ সেন্ট। অনেকেই এ থেকে প্রতিদিন ন্যূনতম ১০ ইউরো আয় করেন। সরকার সবাইকে ভাতা দেয়। এটা তাদের উপরি আয়। আমার এক বন্ধু আমাকে শোনাল এক অদ্ভুত কথা- এখানে ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধ নয়। বেকার ভাতার জন্য যে আবেদন করা হয়, তাতে লেখা থাকে- আপনি ভিক্ষাবৃত্তি করে অতিরিক্ত কিছু ইউরো অর্জন করছেন কিনা। জানি না, এটা সত্য কিনা! তবে আমি নিজ চোখে দেখেছি- যারা ভিক্ষা করছে, পুলিশ তাদের কাগজ পরীক্ষা করছে এবং কিছু না বলে চলে যাচ্ছে। পরোক্ষভাবে আয় করতে উৎসাহিত করা আর কী! এক তরুণীকে আমি দেখেছিলাম, প্রধান রেলস্টেশনের পাশে কাইজার স্ট্রেসেতে রাস্তায় ছোট একটি টুলে বসে ভিক্ষা করতে। তরুণী সিরিয়া থেকে আসা। জানি না, শুধু উপার্জনের আশায়ই মেয়েটি ভিক্ষা করছিল কিনা! নিজের কাছেই খারাপ লাগছিল। জার্মানিতে আমি থাকতে থাকতেই দেখলাম, তুরস্কের সঙ্গে জার্মানির সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। এখানে তুরস্কের নাগরিকদের নিয়ে সমস্যা দুটি। কুর্দিরা এখানে শক্তিশালী। তাদের সংগঠন আছে। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সমর্থকের সংখ্যাও অনেক।

আমার অবস্থানকালীন কোলন শহরে প্রায় ৪০ হাজার নাগরিকের এক বিশাল র‌্যালি অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই র‌্যালিতে এরদোগানের বক্তৃতা দেয়ার কথা ছিল ইন্টারনেটের মাধ্যমে। কিন্তু জার্মান সরকার অনুমতি দেয়নি। অভিযোগ আছে, এরদোগান সরকার জার্মানিতে বসবাসকারী তুরস্কের নাগরিকদের- যাদের কেউ কেউ জার্মান নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন, তাদের ব্যবহার করছেন তার সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য। জার্মানিতে প্রায় ৫ লাখ ৭০ হাজার তুরস্কের নাগরিক বসবাস করেন, যারা ২০১৫ সালে ভোট দিয়েছেন এবং এদের প্রায় ৬০ ভাগ এরদোগানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির পক্ষ ভোট দিয়েছিলেন। জার্মানিতে যে ৩ হাজার মসজিদ রয়েছে, তার মধ্যে ২ হাজার মসজিদ পরিচালনা করে তুরস্কের নাগরিকরা। জার্মানিতে ইসলাম প্রচারে তুরস্কের নাগরিকদের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। এক সময় তুরস্কের নাগরিকরা গেস্ট ওয়ার্কার হিসেবে এদেশে এসেছিলেন এবং জার্মানির শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোয় উৎপাদন বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। এখন এদের সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। তুরস্কের নাগরিকদের দ্বিতীয় জেনারেশনের কেউ কেউ ইতিমধ্যে জার্মানির পার্লামেন্টের সদস্য পর্যন্ত হয়েছেন। যেমন মিস্টার ওজডেমিরের কথা বলা যেতে পারে, যিনি এখন পার্লামেন্টের সদস্য। দীর্ঘদিন জার্মান-তুরস্ক সম্পর্ক ভালো থাকলেও, এখন এ সম্পর্ক ঘিরে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে ১৫ জুলাইয়ের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর দুই দেশের আস্থার সম্পর্কে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এরদোগান তার বৈদেশিক সম্পর্কে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছেন। যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি সরাসরি অভিযুক্ত করেছেন সামরিক অভ্যুত্থানে জড়িত হওয়ার। তিনি রাশিয়া সফর করেছেন এবং প্রকাশিত একটি নিবন্ধে এ বিষয়ে আমি আলোকপাত করেছিলাম। তুরস্কের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক বৃদ্ধি পাওয়ায় জার্মানির সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে তা প্রভাব ফেলছে। বলা হচ্ছে, তুরস্ক এখন ন্যাটোর বিভক্তিকে আরও বৃদ্ধি করতে পারে। অর্থাৎ তুরস্কের ভূমিকার কারণে আগামীতে ন্যাটো ভেঙে যেতে পারে। ফলে পুরো ইউরোপে, বিশেষ করে জার্মানিতে এরদোগানকে নিয়ে আলোচনা এখন বেশি; এরদোগানের ভূমিকা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি এখন তুরস্ককে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন- এ প্রশ্ন অনেকের।

জার্মানিতে শরণার্থীদের নিয়ে দু-একটি প্রশ্ন আছে বটে; কিন্তু ফ্রান্সের মতো এখানকার শহরগুলোকে কোনো ধরনের নিরাপত্তা চাদরে ঢেকে দেয়া হয়নি। তবে বলতেই হয়, বদলে যাচ্ছে জার্মানি ও জার্মানির রাজনীতি। শরণার্থীরা, বিশেষ করে সিরীয় শরণার্থীরা একটা সমস্যা- এটা অস্বীকার করা যাবে না। এ শরণার্থীদের মধ্যে আইএসের কোনো এজেন্ট নেই- তাও অস্বীকার করা যাবে না। তবে এখানকার মানুষ বিষয়টি নিয়ে অতটা ভাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জার্মানির পার্থক্য এখানেই যে, জার্মানি বিদেশীদের প্রতি যতটা সহানুভূতিশীল এবং তাদের যত সামাজিক নিরাপত্তা দেয়, যুক্তরাষ্ট্র তা দেয় না। যুক্তরাষ্ট্রে সামাজিক নিরাপত্তা নেই বললেই চলে। প্রায় তিন মাস যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন শহরে ঘুরছি। জানতে ও বুঝতে চেষ্টা করছি এখানকার রাজনীতি। তবে জার্মানির বর্তমান রাজনীতি ও সমাজ ব্যবস্থা আমাকে অবাকই করছে। এক সময় জার্মান নাগরিকত্ব পাওয়া অত সহজ ছিল না। জার্মানরা তাদের রক্তের সঙ্গে অন্য রক্ত মিশতে দিতে রাজি ছিল না। সেই জার্মানি এখন বদলে গেছে। আগামী ২০ বছর পর কোন জার্মানিকে দেখব, তা আমি কল্পনাও করতে পারছি না এখন।

ফ্রাংকফুর্ট, জার্মানি
Daily Jugantor
22.08.2016

0 comments:

Post a Comment