আঞ্চলিক রাজনীতিতে পরিবর্তন আসন্ন
তুরস্কে একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর এ অঞ্চলের রাজনীতিতে একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের আভাস দিয়েছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষকরা। গত প্রায় দুই সপ্তাহ যাবৎ শীর্ষস্থানীয় প্রতিটি সাময়িকীতে এ নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে এবং ধারণা করছি ভবিষ্যতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে। বেশ কিছু কারণের জন্য এ অঞ্চলের রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, আইএসের উত্থান এ অঞ্চলের রাজনীতিকে পরিপূর্ণভাবে বদলে দিয়েছে। দীর্ঘদিন ফিলিস্তিন সমস্যা, ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনি এলাকায় আগ্রাসন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করে আসছিল। এখন ফিলিস্তিনের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দখল করে আছে আইএসের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। দ্বিতীয়ত, ‘আরব বসন্ত’ আরব বিশ্বে ব্যাপক পরিবর্তন ডেকে আনলেও একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল সিরিয়া। সিরিয়ায় কোনো পরিবর্তন আসেনি।তৃতীয়ত, সিরিয়া সংকটকে কেন্দ্র করে নতুন করে দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে নতুন করে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেন সংকটকে কেন্দ্র করে যে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হয়েছিল, যাকে কোনো কোনো পর্যবেক্ষক স্নায়ুযুদ্ধ-২ হিসেবে অভিহিত করেছেন। সিরিয়া সংকটকে কেন্দ্র করে সেই স্নায়ুযুদ্ধ আরো গভীর হয়েছে। চতুর্থত, এ অঞ্চলের রাজনীতি, অস্থিরতা, জঙ্গিবাদের উত্থান, এক ধরনের ‘অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ’ ইত্যাদি কারণে এ অঞ্চল থেকে লাখ লাখ লোক দেশান্তরিত হয়েছে এবং ইউরোপের ‘ঐক্যে’ বড় ধরনের ফাটল ধরিয়েছে। ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই রাজনীতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থাকে একটি বড় ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি পরিবর্তনের সঙ্গে তুরস্কের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ একটা যোগসূত্র রয়েছে। আইএস নির্মূল প্রশ্নে তুরস্কের যেমন একটি ভূমিকা রয়েছে, ঠিক তেমনি সিরিয়ায় আসাদের ক্ষমতায় টিকে থাকা, লাখ লাখ সিরীয় নাগরিকের দেশান্তরের ঘটনায়ও তুরস্কের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। প্রতিটি ক্ষেত্রে তুরস্কের রাজনীতি, তুরস্কের স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান গুরুত্বের দাবি রাখে। সুতরাং তুরস্কে যখন একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয় তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই এর একটি প্রতিক্রিয়া তুরস্কের রাজনীতির পাশাপাশি আঞ্চলিক রাজনীতিতেও থাকবে। বিশেষ করে সিরিয়া সংকটের সমাধান, আইএসকে পরিপূর্ণভাবে নির্মূলের প্রশ্নে তুরস্কের ভূমিকা কী হবে, সেটা হবে একটা বড় প্রশ্ন এখন। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে। এক. তুরস্ক ন্যাটোর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তুরস্কে মার্কিন সেনা রয়েছে এবং একাধিক বিমানঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করে। এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজিক ইন্টারেস্ট রয়েছে, তাতে তুরস্ক অন্যতম একটি ফ্যাক্টর। দুই. তুরস্কের ব্যাপারে রাশিয়ারও স্বার্থ রয়েছে। তুরস্ক রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশ নয়। ব্ল্যাক সি বা কৃষ্ণ সাগর এ দেশ দুটিকে আলাদা করেছে। এই দেশ দুটির মাঝে আছে আবার তিনটি দেশ—জর্জিয়া, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান। জর্জিয়াকে ন্যাটো সদস্যভুক্ত করার আগ্রহ যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের। জর্জিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার ‘সীমিত যুদ্ধ’-এর খবর আমরা জানি। অন্যদিকে আমেরিকা ও আজারবাইজানের ‘অভ্যন্তরীণ যুদ্ধে’ তুরস্ক ও রাশিয়া পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে। তবে ক্রিমিয়া রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় (২০১৪) কৃষ্ণ সাগরের গুরুত্ব বেড়েছে। এখানে রয়েছে রাশিয়ার বড় নৌঘাঁটি। কৃষ্ণ সাগরের পাশ ঘেঁষে রয়েছে তুরস্কের বিখ্যাত বসফোরাস প্রণালি ও মারমারা সাগর। ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত বসফোরাস প্রণালি হচ্ছে প্রাচ্য ও পশ্চিমের অদ্ভুত এক মিলনস্থান। এই মারমারা প্রণালি ভূমধ্যসাগর ও কৃষ্ণ সাগরকে সংযুক্ত করেছে। রাশিয়ার নৌ স্ট্র্যাটেজিস্টরা এ কারণেই তুরস্ককে গুরুত্ব দেন বেশি। সুতরাং তুরস্কে একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি যতটুকু ভূমিকাই পালন করে থাকুক না কেন দুই পরাশক্তির (রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র) এতে একটা ‘যোগসূত্র’ থাকা বিচিত্র কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুরস্কের ‘সনাতন সম্পর্ক’ থাকলেও সাম্প্রতিক সময়গুলোতে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখতে পারছিল না ওয়াশিংটন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তুরস্ক-যুক্তরাষ্ট্র বিরোধও লক্ষণীয়। অন্যদিকে স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বের কারণে রাশিয়া তুরস্কে এমন একটি সরকার চাইবে, যা তার স্বার্থ রক্ষা করবে। বিশ্ব আসরে রাশিয়াকে তার অবস্থান শক্তিশালী করতে হলে তুরস্ককে তার আস্থায় নেওয়া প্রয়োজন। ইতিমধ্যে ইরানের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের কারণে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে রাশিয়ার অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘পারমাণবিক সমঝোতা’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ইরানের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। ইরান এ অঞ্চলের অন্যতম উঠতি শক্তি, যা কি না বিশ্ব এখন গ্রহণযোগ্যতায় নিয়েছে। ফলে খুব সংগত কারণেই এ অঞ্চলে যদি রাশিয়া-ইরান-তুরস্ক একটি ‘ঐক্য’ গড়ে ওঠে, তাহলে তা বিশ্ব রাজনীতিতেও যে প্রভাব ফেলবে, তা বলাই বাহুল্য। মনে রাখতে হবে বেশ কিছু ইস্যুতে চীন-রাশিয়া ঐক্য গড়ে উঠেছে। দেশ দুটি এসসিও বা ‘সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন’-এর সদস্য। ভারত এ জোটের অবজারভার। অন্যদিকে চীন-রাশিয়া-ভারত এবং আরো বেশ কয়েকটি দেশের সমন্বয়ে একটি ‘বিকল্প বিশ্বব্যাংক’ (ব্রিকস ব্যাংক) গড়ে উঠেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করছে। ফলে দুই পরাশক্তির মধ্যে এক ধরনের প্রভাব বলয়ের রাজনীতি শুরু হয়েছে অনেক আগেই। এ ক্ষেত্রে তুরস্কের স্ট্র্যাটেজিক অবস্থানের কারণে এই দুই পরাশক্তি তুরস্কের ব্যাপারে যে আগ্রহী হয়ে উঠবে, সেটাই স্বাভাবিক। এখন যে প্রশ্নটি অনেকে করার চেষ্টা করেন, তা হচ্ছে যেখানে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের সদস্য ও দীর্ঘদিন এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করে আসছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কি তুরস্কের সম্পর্কের আদৌ অবনতি ঘটেছিল? সম্পর্ক যে আগের পর্যায়ে নেই, এটা বলাই বাহুল্য। তুরস্কের বিচার বিভাগীয় মন্ত্রী ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর অভিযোগ করেছেন যে এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র জড়িত। অভিযোগ উঠেছে ইসলামিক স্কলার তথা ধর্মগুরু ফেতুল্লাহ গুলেনকে নিয়ে। গুলেন ইসলামকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি কট্টরপন্থী নন। আদি ইসলামের ধারায়ও বিশ্বাসী নন। তিনি ইসলামকে আধুনিকতার ধারায় উপস্থাপন করেছেন। তাঁকে বলা হয় ‘ইসলামের গান্ধী’। এরদোয়ান এক সময় তাঁর অনুসারী ছিলেন। দেশের সেনাবাহিনী, প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে গুলেনের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। গুলেনপন্থী সমর্থকদের দ্বারা এরদোয়ানের ছেলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করা, সেই সঙ্গে আরো তিন মন্ত্রীর ছেলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনলে ২০১৩ সালের পর থেকেই এরদোয়ানের সঙ্গে গুলেনপন্থীদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এরপর ঘটে ইস্তাম্বুলে গাজি পার্কে অবস্থান ধর্মঘটের ঘটনা (২০১৩)। এ ক্ষেত্রেও অভিযোগ আনা হয়েছিল গুলেনপন্থীদের বিরুদ্ধে। একটা ধারণা চালু হয়ে গিয়েছিল যে গুলেনপন্থীরা এরদোয়ানকে উত্খাত করে ক্ষমতা দখল করতে পারে। এরদোয়ান স্বয়ং অভিযোগ এনেছেন যে ফেতুল্লাহ গুলেন এই ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত। গুলেন এখন অনেকটা নির্বাসিত জীবনযাপন করেন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ায়। অভিযোগ আছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ গুলেনকে ব্যবহার করে এই অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করে। সিআইএর সহযোগিতায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ‘গ্রিনকার্ড’ পেয়েছেন, এমন অভিযোগ তুরস্কের সরকারি দলের নেতাদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত হয়েছে। এর পেছনে সত্যতা কতটুকু, তা বিতর্কিত। কিন্তু সিআইএর স্টেশন কমান্ডার (তুরস্ক) তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের জন্য চিঠি দিয়েছিলেন, এমন তথ্য পাওয়া গেছে। তুরস্ক সরকারের অভিযোগের জবাবে অবশ্য গুলেন বলেছেন, তিনি সামরিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত নন। এটা এরদোয়ানের সাজানো নাটক! ক্ষমতা স্থায়ী করতেই তিনি এ কাজটি করেছেন। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমি পেয়েছি জন চুকম্যান কর্তৃক ফরেন পলিসি জার্নালে (২২ জুলাই, ২০১৬) প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে। চুকম্যান তাঁর প্রবন্ধে ইঙ্গিত করেছেন যে ইনসিরলিক বিমানঘাঁটি (যেখানে কয়েক হাজার মার্কিন বিমান সেনা, ৬০টির মতো বিমান ও পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে) বিদ্রোহীরা ব্যবহার করেছিল। বিদ্রোহীদের পক্ষে যে বিমানগুলো উড়ছিল, তারা এই বিমানঘাঁটি থেকে জ্বালানি নিয়েছিল। সুতরাং ঊর্ধ্বতন মার্কিন বিমানবাহিনীর অফিসারদের এটা জানার কথা। তাঁদের সম্মতিতেই বিমানগুলো জ্বালানি নিয়েছিল। এই স্টেশনের তুর্কি কমান্ডার জেনারেল বেকির এরকান ভ্যান গ্রেপ্তার হওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন। ফলে অনেকেই এই যুক্তি খাড়া করাতে চাইবেন যে তুরস্কে সরকার উত্খাতের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ সমর্থন থাকতে পারে! তবে এটা ঠিক, যুক্তরাষ্ট্র এরদোয়ানের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখতে পারছিল না। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি সত্ত্বেও প্রতিদিন তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্ত দিয়ে শতাধিক ইসলামিক জঙ্গি সিরিয়ায় প্রবেশ করত। এটা ছিল ফরাসি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য। এসব জঙ্গি আইএসের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিত। উপরন্তু তুরস্কের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো, এমন অভিযোগও উঠেছে। দ্বিতীয়ত, আইএসের জঙ্গিরা সিরিয়া ও ইরাকের দখলকৃত এলাকার তেল উত্তোলন করে তুরস্কের মাধ্যমে বিশ্ববাজারে বিক্রি করত, যার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে যায়। এই তেল ছিল আইএসের অর্থের অন্যতম উৎস। জিহাদিদের বেতন দেওয়া হতো এই অর্থ থেকে। উপরন্তু ইরানের ওপর যখন আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা বজায় ছিল, ইরানের তেল তুরস্কের ব্যবসায়ীরা (যার সঙ্গে এরদোয়ানের ঘনিষ্ঠজনরা জড়িত ছিলেন) বিশ্ববাজারে বিক্রি করে অনেক টাকা আয় করতেন। ফলে তত্ত্বগতভাবে মার্কিন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা এরদোয়ানের ওপর খুশি ছিলেন না। তাঁদের করারও কিছু ছিল না এরদোয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করা ছাড়া। অন্যদিকে ২০১৫ সালের নভেম্বরে একটি রাশিয়ান বিমান ধ্বংস করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটলেও তা এখন অতীত। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে আজ রাশিয়ার যেমনি প্রয়োজন তুরস্কের, ঠিক তুরস্কেরও প্রয়োজন রাশিয়াকে। তুরস্ক হচ্ছে রাশিয়ার তৃতীয় বাণিজ্যিক অংশীদার। বিনিয়োগের দিক থেকে রাশিয়ার অবস্থান চতুর্থ। দুটি খাত—গ্যাস বিক্রি ও ট্যুরিজম খাতে রাশিয়ার আগ্রহ বেশি। এর বাইরে তুরস্কের আক্কুউইউ শহরে রাশিয়া একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। রাশিয়ার বিমান ধ্বংস করে দেওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে রাশিয়া তুরস্কের বিরুদ্ধে যে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, তাতে তুরস্কের বার্ষিক জিডিপি বৃদ্ধি ০.৭ ভাগ কমে গিয়েছিল। এসব এখন অতীত। যে বিমানের পাইলট রাশিয়ার প্লেনকে ধ্বংস করেছিলেন (অবৈধভাবে তুরস্কের সীমানায় প্রবেশ করায়), অতি সম্প্রতি তুরস্ক সরকার তাঁকে গ্রেপ্তারও করেছে, ক্ষমাও চেয়েছে। এটা রাশিয়াকে আস্থায় আনার একটা বড় উদ্যোগ। শোনা যায়, সম্ভাব্য একটি সামরিক অভ্যুত্থানের খবর রাশিয়া আগেই তুরস্ক সরকারকে জানিয়েছিল। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে তুরস্কের একাধিক স্বার্থ কাজ করছে। প্রথমত, সিরিয়ার সংকটে কুর্দিদের একটি গ্রুপ কুর্দিজ ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন পার্টি (পিওয়াইডি) অত্যন্ত সক্রিয়। রাশিয়া পিওয়াইডিকে সমর্থন করে ও মস্কোতে তাদের একটি লিয়াজোঁ অফিস খুলতেও অনুমতি দিয়েছে। তুরস্ক মনে করে, পিওয়াইডি হচ্ছে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) একটি অঙ্গ সংগঠন। পিকেকে তুরস্ক ও ইরাকের কুর্দিস্তানে তত্পর। দলটি ১৯৮৪ সালের পর থেকে তুরস্ক সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করে আসছে। দলটি তুরস্কে নিষিদ্ধ। এখন তুরস্ক মনে করছে, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে পিকেকে তথা পিওয়াইডির ওপর থেকে রাশিয়ার সমর্থন কমে যাবে এবং পিকেকে তুরস্কের অভ্যন্তরে যে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, তা হ্রাস পাবে। দ্বিতীয়ত, রাশিয়ার গ্যাস। প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার (এক হাজার ২০০ কোটি ডলার) ব্যয়ে একটি পাইপলাইন নির্মিত হচ্ছে, যার মাধ্যমে রাশিয়ার গ্যাস ইউরোপে যাবে (টার্কিশ স্ট্রিম প্রজেক্ট)। ইউরোপের অনেক দেশ রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল, যা কি না ইউক্রেনের মাধ্যমে (সাউথ স্ট্রিম) সরবরাহ করা হতো। কিন্তু ইউক্রেন সংকট গভীর হলে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পুতিন তাঁর তুরস্ক সফরের সময় এই বিকল্প ‘টার্কিশ স্ট্রিম’ গ্যাস পাইপলাইন চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এর ফলে রাশিয়ার গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে কৃষ্ণ সাগরের নিচ দিয়ে ইউরোপের কয়েকটি দেশে সরবরাহ করা হবে। এই গ্যাস পাইপলাইন চালু হলে তা তুরস্কের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে। তৃতীয়ত, তুরস্ক ও রাশিয়া একটি ‘যৌথ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। ফলে তুরস্ক তার আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। রাশিয়াকে এখন ‘কাছের বন্ধু’ হিসেবে মনে করছে। এই ‘নয়া সম্পর্ক’ সিরিয়ার সংকট থেকে শুরু করে এ অঞ্চলের রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে। সিরিয়ায় আসাদবিরোধিতা থেকে তুরস্ক এখন সরে আসবে এবং আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বিদ্রোহী বাহিনীগুলো এখন আর তুরস্ক সরকারের সহযোগিতা পাবে না। তুরস্কের এই ‘অবস্থান’ কিছুটা হলেও এ অঞ্চলের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। তবে এই অবস্থান পরিবর্তন যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে দেখে, সেটাই এখন মূল আলোচনার বিষয়। Daily Kaler Kontho 03.08.2016
তুরস্কে একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর এ অঞ্চলের রাজনীতিতে একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের আভাস দিয়েছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষকরা। গত প্রায় দুই সপ্তাহ যাবৎ শীর্ষস্থানীয় প্রতিটি সাময়িকীতে এ নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে এবং ধারণা করছি ভবিষ্যতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে। বেশ কিছু কারণের জন্য এ অঞ্চলের রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, আইএসের উত্থান এ অঞ্চলের রাজনীতিকে পরিপূর্ণভাবে বদলে দিয়েছে। দীর্ঘদিন ফিলিস্তিন সমস্যা, ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনি এলাকায় আগ্রাসন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করে আসছিল। এখন ফিলিস্তিনের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দখল করে আছে আইএসের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। দ্বিতীয়ত, ‘আরব বসন্ত’ আরব বিশ্বে ব্যাপক পরিবর্তন ডেকে আনলেও একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল সিরিয়া। সিরিয়ায় কোনো পরিবর্তন আসেনি।তৃতীয়ত, সিরিয়া সংকটকে কেন্দ্র করে নতুন করে দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে নতুন করে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেন সংকটকে কেন্দ্র করে যে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হয়েছিল, যাকে কোনো কোনো পর্যবেক্ষক স্নায়ুযুদ্ধ-২ হিসেবে অভিহিত করেছেন। সিরিয়া সংকটকে কেন্দ্র করে সেই স্নায়ুযুদ্ধ আরো গভীর হয়েছে। চতুর্থত, এ অঞ্চলের রাজনীতি, অস্থিরতা, জঙ্গিবাদের উত্থান, এক ধরনের ‘অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ’ ইত্যাদি কারণে এ অঞ্চল থেকে লাখ লাখ লোক দেশান্তরিত হয়েছে এবং ইউরোপের ‘ঐক্যে’ বড় ধরনের ফাটল ধরিয়েছে। ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই রাজনীতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থাকে একটি বড় ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি পরিবর্তনের সঙ্গে তুরস্কের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ একটা যোগসূত্র রয়েছে। আইএস নির্মূল প্রশ্নে তুরস্কের যেমন একটি ভূমিকা রয়েছে, ঠিক তেমনি সিরিয়ায় আসাদের ক্ষমতায় টিকে থাকা, লাখ লাখ সিরীয় নাগরিকের দেশান্তরের ঘটনায়ও তুরস্কের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। প্রতিটি ক্ষেত্রে তুরস্কের রাজনীতি, তুরস্কের স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান গুরুত্বের দাবি রাখে। সুতরাং তুরস্কে যখন একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয় তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই এর একটি প্রতিক্রিয়া তুরস্কের রাজনীতির পাশাপাশি আঞ্চলিক রাজনীতিতেও থাকবে। বিশেষ করে সিরিয়া সংকটের সমাধান, আইএসকে পরিপূর্ণভাবে নির্মূলের প্রশ্নে তুরস্কের ভূমিকা কী হবে, সেটা হবে একটা বড় প্রশ্ন এখন। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে। এক. তুরস্ক ন্যাটোর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তুরস্কে মার্কিন সেনা রয়েছে এবং একাধিক বিমানঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করে। এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজিক ইন্টারেস্ট রয়েছে, তাতে তুরস্ক অন্যতম একটি ফ্যাক্টর। দুই. তুরস্কের ব্যাপারে রাশিয়ারও স্বার্থ রয়েছে। তুরস্ক রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশ নয়। ব্ল্যাক সি বা কৃষ্ণ সাগর এ দেশ দুটিকে আলাদা করেছে। এই দেশ দুটির মাঝে আছে আবার তিনটি দেশ—জর্জিয়া, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান। জর্জিয়াকে ন্যাটো সদস্যভুক্ত করার আগ্রহ যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের। জর্জিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার ‘সীমিত যুদ্ধ’-এর খবর আমরা জানি। অন্যদিকে আমেরিকা ও আজারবাইজানের ‘অভ্যন্তরীণ যুদ্ধে’ তুরস্ক ও রাশিয়া পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে। তবে ক্রিমিয়া রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় (২০১৪) কৃষ্ণ সাগরের গুরুত্ব বেড়েছে। এখানে রয়েছে রাশিয়ার বড় নৌঘাঁটি। কৃষ্ণ সাগরের পাশ ঘেঁষে রয়েছে তুরস্কের বিখ্যাত বসফোরাস প্রণালি ও মারমারা সাগর। ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত বসফোরাস প্রণালি হচ্ছে প্রাচ্য ও পশ্চিমের অদ্ভুত এক মিলনস্থান। এই মারমারা প্রণালি ভূমধ্যসাগর ও কৃষ্ণ সাগরকে সংযুক্ত করেছে। রাশিয়ার নৌ স্ট্র্যাটেজিস্টরা এ কারণেই তুরস্ককে গুরুত্ব দেন বেশি। সুতরাং তুরস্কে একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি যতটুকু ভূমিকাই পালন করে থাকুক না কেন দুই পরাশক্তির (রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র) এতে একটা ‘যোগসূত্র’ থাকা বিচিত্র কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুরস্কের ‘সনাতন সম্পর্ক’ থাকলেও সাম্প্রতিক সময়গুলোতে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখতে পারছিল না ওয়াশিংটন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তুরস্ক-যুক্তরাষ্ট্র বিরোধও লক্ষণীয়। অন্যদিকে স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বের কারণে রাশিয়া তুরস্কে এমন একটি সরকার চাইবে, যা তার স্বার্থ রক্ষা করবে। বিশ্ব আসরে রাশিয়াকে তার অবস্থান শক্তিশালী করতে হলে তুরস্ককে তার আস্থায় নেওয়া প্রয়োজন। ইতিমধ্যে ইরানের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের কারণে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে রাশিয়ার অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘পারমাণবিক সমঝোতা’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ইরানের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। ইরান এ অঞ্চলের অন্যতম উঠতি শক্তি, যা কি না বিশ্ব এখন গ্রহণযোগ্যতায় নিয়েছে। ফলে খুব সংগত কারণেই এ অঞ্চলে যদি রাশিয়া-ইরান-তুরস্ক একটি ‘ঐক্য’ গড়ে ওঠে, তাহলে তা বিশ্ব রাজনীতিতেও যে প্রভাব ফেলবে, তা বলাই বাহুল্য। মনে রাখতে হবে বেশ কিছু ইস্যুতে চীন-রাশিয়া ঐক্য গড়ে উঠেছে। দেশ দুটি এসসিও বা ‘সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন’-এর সদস্য। ভারত এ জোটের অবজারভার। অন্যদিকে চীন-রাশিয়া-ভারত এবং আরো বেশ কয়েকটি দেশের সমন্বয়ে একটি ‘বিকল্প বিশ্বব্যাংক’ (ব্রিকস ব্যাংক) গড়ে উঠেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করছে। ফলে দুই পরাশক্তির মধ্যে এক ধরনের প্রভাব বলয়ের রাজনীতি শুরু হয়েছে অনেক আগেই। এ ক্ষেত্রে তুরস্কের স্ট্র্যাটেজিক অবস্থানের কারণে এই দুই পরাশক্তি তুরস্কের ব্যাপারে যে আগ্রহী হয়ে উঠবে, সেটাই স্বাভাবিক। এখন যে প্রশ্নটি অনেকে করার চেষ্টা করেন, তা হচ্ছে যেখানে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের সদস্য ও দীর্ঘদিন এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করে আসছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কি তুরস্কের সম্পর্কের আদৌ অবনতি ঘটেছিল? সম্পর্ক যে আগের পর্যায়ে নেই, এটা বলাই বাহুল্য। তুরস্কের বিচার বিভাগীয় মন্ত্রী ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর অভিযোগ করেছেন যে এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র জড়িত। অভিযোগ উঠেছে ইসলামিক স্কলার তথা ধর্মগুরু ফেতুল্লাহ গুলেনকে নিয়ে। গুলেন ইসলামকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি কট্টরপন্থী নন। আদি ইসলামের ধারায়ও বিশ্বাসী নন। তিনি ইসলামকে আধুনিকতার ধারায় উপস্থাপন করেছেন। তাঁকে বলা হয় ‘ইসলামের গান্ধী’। এরদোয়ান এক সময় তাঁর অনুসারী ছিলেন। দেশের সেনাবাহিনী, প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে গুলেনের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। গুলেনপন্থী সমর্থকদের দ্বারা এরদোয়ানের ছেলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করা, সেই সঙ্গে আরো তিন মন্ত্রীর ছেলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনলে ২০১৩ সালের পর থেকেই এরদোয়ানের সঙ্গে গুলেনপন্থীদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এরপর ঘটে ইস্তাম্বুলে গাজি পার্কে অবস্থান ধর্মঘটের ঘটনা (২০১৩)। এ ক্ষেত্রেও অভিযোগ আনা হয়েছিল গুলেনপন্থীদের বিরুদ্ধে। একটা ধারণা চালু হয়ে গিয়েছিল যে গুলেনপন্থীরা এরদোয়ানকে উত্খাত করে ক্ষমতা দখল করতে পারে। এরদোয়ান স্বয়ং অভিযোগ এনেছেন যে ফেতুল্লাহ গুলেন এই ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত। গুলেন এখন অনেকটা নির্বাসিত জীবনযাপন করেন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ায়। অভিযোগ আছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ গুলেনকে ব্যবহার করে এই অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করে। সিআইএর সহযোগিতায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ‘গ্রিনকার্ড’ পেয়েছেন, এমন অভিযোগ তুরস্কের সরকারি দলের নেতাদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত হয়েছে। এর পেছনে সত্যতা কতটুকু, তা বিতর্কিত। কিন্তু সিআইএর স্টেশন কমান্ডার (তুরস্ক) তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের জন্য চিঠি দিয়েছিলেন, এমন তথ্য পাওয়া গেছে। তুরস্ক সরকারের অভিযোগের জবাবে অবশ্য গুলেন বলেছেন, তিনি সামরিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত নন। এটা এরদোয়ানের সাজানো নাটক! ক্ষমতা স্থায়ী করতেই তিনি এ কাজটি করেছেন। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমি পেয়েছি জন চুকম্যান কর্তৃক ফরেন পলিসি জার্নালে (২২ জুলাই, ২০১৬) প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে। চুকম্যান তাঁর প্রবন্ধে ইঙ্গিত করেছেন যে ইনসিরলিক বিমানঘাঁটি (যেখানে কয়েক হাজার মার্কিন বিমান সেনা, ৬০টির মতো বিমান ও পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে) বিদ্রোহীরা ব্যবহার করেছিল। বিদ্রোহীদের পক্ষে যে বিমানগুলো উড়ছিল, তারা এই বিমানঘাঁটি থেকে জ্বালানি নিয়েছিল। সুতরাং ঊর্ধ্বতন মার্কিন বিমানবাহিনীর অফিসারদের এটা জানার কথা। তাঁদের সম্মতিতেই বিমানগুলো জ্বালানি নিয়েছিল। এই স্টেশনের তুর্কি কমান্ডার জেনারেল বেকির এরকান ভ্যান গ্রেপ্তার হওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন। ফলে অনেকেই এই যুক্তি খাড়া করাতে চাইবেন যে তুরস্কে সরকার উত্খাতের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ সমর্থন থাকতে পারে! তবে এটা ঠিক, যুক্তরাষ্ট্র এরদোয়ানের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখতে পারছিল না। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি সত্ত্বেও প্রতিদিন তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্ত দিয়ে শতাধিক ইসলামিক জঙ্গি সিরিয়ায় প্রবেশ করত। এটা ছিল ফরাসি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য। এসব জঙ্গি আইএসের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিত। উপরন্তু তুরস্কের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো, এমন অভিযোগও উঠেছে। দ্বিতীয়ত, আইএসের জঙ্গিরা সিরিয়া ও ইরাকের দখলকৃত এলাকার তেল উত্তোলন করে তুরস্কের মাধ্যমে বিশ্ববাজারে বিক্রি করত, যার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে যায়। এই তেল ছিল আইএসের অর্থের অন্যতম উৎস। জিহাদিদের বেতন দেওয়া হতো এই অর্থ থেকে। উপরন্তু ইরানের ওপর যখন আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা বজায় ছিল, ইরানের তেল তুরস্কের ব্যবসায়ীরা (যার সঙ্গে এরদোয়ানের ঘনিষ্ঠজনরা জড়িত ছিলেন) বিশ্ববাজারে বিক্রি করে অনেক টাকা আয় করতেন। ফলে তত্ত্বগতভাবে মার্কিন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা এরদোয়ানের ওপর খুশি ছিলেন না। তাঁদের করারও কিছু ছিল না এরদোয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করা ছাড়া। অন্যদিকে ২০১৫ সালের নভেম্বরে একটি রাশিয়ান বিমান ধ্বংস করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটলেও তা এখন অতীত। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে আজ রাশিয়ার যেমনি প্রয়োজন তুরস্কের, ঠিক তুরস্কেরও প্রয়োজন রাশিয়াকে। তুরস্ক হচ্ছে রাশিয়ার তৃতীয় বাণিজ্যিক অংশীদার। বিনিয়োগের দিক থেকে রাশিয়ার অবস্থান চতুর্থ। দুটি খাত—গ্যাস বিক্রি ও ট্যুরিজম খাতে রাশিয়ার আগ্রহ বেশি। এর বাইরে তুরস্কের আক্কুউইউ শহরে রাশিয়া একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। রাশিয়ার বিমান ধ্বংস করে দেওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে রাশিয়া তুরস্কের বিরুদ্ধে যে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, তাতে তুরস্কের বার্ষিক জিডিপি বৃদ্ধি ০.৭ ভাগ কমে গিয়েছিল। এসব এখন অতীত। যে বিমানের পাইলট রাশিয়ার প্লেনকে ধ্বংস করেছিলেন (অবৈধভাবে তুরস্কের সীমানায় প্রবেশ করায়), অতি সম্প্রতি তুরস্ক সরকার তাঁকে গ্রেপ্তারও করেছে, ক্ষমাও চেয়েছে। এটা রাশিয়াকে আস্থায় আনার একটা বড় উদ্যোগ। শোনা যায়, সম্ভাব্য একটি সামরিক অভ্যুত্থানের খবর রাশিয়া আগেই তুরস্ক সরকারকে জানিয়েছিল। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে তুরস্কের একাধিক স্বার্থ কাজ করছে। প্রথমত, সিরিয়ার সংকটে কুর্দিদের একটি গ্রুপ কুর্দিজ ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন পার্টি (পিওয়াইডি) অত্যন্ত সক্রিয়। রাশিয়া পিওয়াইডিকে সমর্থন করে ও মস্কোতে তাদের একটি লিয়াজোঁ অফিস খুলতেও অনুমতি দিয়েছে। তুরস্ক মনে করে, পিওয়াইডি হচ্ছে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) একটি অঙ্গ সংগঠন। পিকেকে তুরস্ক ও ইরাকের কুর্দিস্তানে তত্পর। দলটি ১৯৮৪ সালের পর থেকে তুরস্ক সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করে আসছে। দলটি তুরস্কে নিষিদ্ধ। এখন তুরস্ক মনে করছে, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে পিকেকে তথা পিওয়াইডির ওপর থেকে রাশিয়ার সমর্থন কমে যাবে এবং পিকেকে তুরস্কের অভ্যন্তরে যে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, তা হ্রাস পাবে। দ্বিতীয়ত, রাশিয়ার গ্যাস। প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার (এক হাজার ২০০ কোটি ডলার) ব্যয়ে একটি পাইপলাইন নির্মিত হচ্ছে, যার মাধ্যমে রাশিয়ার গ্যাস ইউরোপে যাবে (টার্কিশ স্ট্রিম প্রজেক্ট)। ইউরোপের অনেক দেশ রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল, যা কি না ইউক্রেনের মাধ্যমে (সাউথ স্ট্রিম) সরবরাহ করা হতো। কিন্তু ইউক্রেন সংকট গভীর হলে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পুতিন তাঁর তুরস্ক সফরের সময় এই বিকল্প ‘টার্কিশ স্ট্রিম’ গ্যাস পাইপলাইন চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এর ফলে রাশিয়ার গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে কৃষ্ণ সাগরের নিচ দিয়ে ইউরোপের কয়েকটি দেশে সরবরাহ করা হবে। এই গ্যাস পাইপলাইন চালু হলে তা তুরস্কের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে। তৃতীয়ত, তুরস্ক ও রাশিয়া একটি ‘যৌথ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। ফলে তুরস্ক তার আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। রাশিয়াকে এখন ‘কাছের বন্ধু’ হিসেবে মনে করছে। এই ‘নয়া সম্পর্ক’ সিরিয়ার সংকট থেকে শুরু করে এ অঞ্চলের রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে। সিরিয়ায় আসাদবিরোধিতা থেকে তুরস্ক এখন সরে আসবে এবং আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বিদ্রোহী বাহিনীগুলো এখন আর তুরস্ক সরকারের সহযোগিতা পাবে না। তুরস্কের এই ‘অবস্থান’ কিছুটা হলেও এ অঞ্চলের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। তবে এই অবস্থান পরিবর্তন যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে দেখে, সেটাই এখন মূল আলোচনার বিষয়। Daily Kaler Kontho 03.08.2016
0 comments:
Post a Comment