রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

প্রস্তাবিত সংবিধান সংশোধনী নিয়ে কিছু কথা

এটি সংবিধান সংশোধনের পথ নয়
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলসহ সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাব মন্ত্রিসভা অনুমোদন এবং সংসদে উত্থাপন করায় দেশ আজ এক গভীর সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে। বিরোধী দলের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা বা পরামর্শ না করে একতরফাভাবে সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ এবং এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সরকার এর আগে সংবিধান সংশোধনের জন্য একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করেছিল। যেখানে বিরোধী দলের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। ওই বিশেষ কমিটি গত ৮ জুন সংসদে সংবিধান সংশোধনের জন্য ৫১ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করে এবং মাত্র ১২ দিনের মাথায় মন্ত্রিসভা ওই ৫১ দফা প্রস্তাব হুবহু অনুমোদন দেয়ায় সরকারের ভূমিকা এখানে প্রশ্নবিদ্ধ। কেননা সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যখন বিরোধী দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার কথা বলেন, তখন আলাপ-আলোচনার কোনো উদ্যোগ না নিয়েই অতি দ্রুততার সঙ্গে সরকার সংবিধান সংশাধনের উদ্যোগ নিয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তথাকথিত বিশেষ কমিটি দেশের মুখচেনা কিছু বুদ্ধিজীবী, জাতীয় সংবাদপত্রের সম্পাদকবৃন্দ, আইনজীবী ও অবসরপ্রাপ্ত ক'জন প্রধান বিচারপতির সঙ্গেও আলাপ-আলোচনা করেন। কিন্তু তাদের কারো অভিমত ওই কমিটি গ্রহণ করেনি। কমিটি ২৭টি সভায় মিলিত হন। তারা শরিকদের কোনো মতামতও গ্রহণ করেননি। বরং শরিকদের কারো কারো আপত্তি রয়েছে কমিটি যেসব সুপারিশ করেছে সে ব্যাপারে। মজার ব্যাপার, কমিটি সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখা না রাখা নিয়ে যখন এক ধরনের সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন, তখন তারা দেখা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী তখন বলেছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করতে হবে এবং বিশেষ কমিটি যে রিপোর্ট দিয়েছে তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে করে এটা ধারণা করা স্বাভাবিক যে, বিশেষ কমিটি প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাস্তব প্রতিফলন ঘটিয়েছেন তাদের রিপোর্টে।
সংবিধান সংশোধনের বিপরীতে এই জঘন্যতা কাম্য নয়

বিশেষ কমিটি যে ৫১ দফা সংশোধনী উপস্থাপন করেছে তা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্যগুলো নিম্নরূপ :
এক.
কমিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের কথা বলেছে। যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, উচ্চ আদালতের একটি রায়। উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে বিশেষ কমিটি রায়ের পুরো অংশ গ্রহণ করেনি। উচ্চ আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ ঘোষণা করলেও, আবার বলা হয়েছে, 'জনগণ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই যেহেতু সর্বোচ্চ আইন, সে কারণে প্রয়োজনের নিরিখে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনেই অনুষ্ঠিত হতে পারবে।' সংসদ এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। বিশেষ কমিটি তাদের রিপোর্টে এই অংশটুকু যোগ না করায় তাতে বিতর্ক ও বিভ্রান্তি বেড়েছে। এটি আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে কি-না, তা ভেবে দেখা যেতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি আমরা এখনো পাইনি। এমতাবস্থায় আংশিক রায় দিয়ে যদি দ্রুততার সঙ্গে সংবিধান সংশোধন করা হয়, তাহলে বিশেষ কমিটির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।
দুই.
প্রস্তাবে ১৯৭২ সালের সংবিধানের চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা পুনঃপ্রবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে সংবিধানের মূলনীতিতে (৮.১ক) যেখানে 'সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হইবে যাবতীয় কার্যাবলীর ভিত্তি'র কথা বলা হয়েছে, তা বাতিল হবে। এ ধরনের কোনো প্রস্তাব যে দেশের শতকরা ৯০ ভাগের উপরে মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী তারা তা গ্রহণ করে নিতে পারে না। 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' প্রস্তাবনায় রেখে দেয়া হলেও, বাংলা শব্দ যোগ করা হয়েছে, 'পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে' বাক্যটি। এটি এক ধরনের জগাখিচুড়ি ও বিভ্রান্তিকর।
তিন.
সমাজতন্ত্র পুনঃস্থাপনের প্রস্তাব করা হলেও আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে বর্তমানে সমাজতন্ত্র নেই। এমনকি বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের চিন্তা-চেতনা এখন অচল। এর ফলে বহির্বিশ্বে বিশেষ করে গণতান্ত্রিক বিশ্বে বাংলদেশ সম্পর্কে ভিন্ন ধারণার জন্ম হতে পারে। চীনেও ধ্রুপদী সমাজতন্ত্র নেই। কিউবায় পরিবর্তন আসছে। আর ভিয়েতনামে পরিবর্তন এসেছে অনেক আগে।
চার.
প্রস্তাবে সংবিধানের ২৫(২) ধারা বাদ দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, 'রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।' এই ধারাটি বাদ দেয়ার ফলে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত আমাদের কর্মীরা এক ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকতে পারেন। রেমিটেন্স, যা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম উৎস, তাতে ভাটা আসতে পারে। একমাত্র সৌদি আরবেই কর্মরত বাংলাদেশিদের সংখ্যা ১০ লাখের উপরে।
পাঁচ.
জাতীয় পরিচয় বাঙালি ও নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশি প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে করে পাহাড়ে অশান্তি বাড়বে। পাহাড়িরা বাঙালি নয়, তারা তাদের নিজস্ব জাতিসত্তার পরিচয়ে পরিচিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাহাড়িদের বাঙালি হিসেবে গণ্য করার উদ্যোগ নিলে, সেদিন পাহাড়ে বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল। সম্প্রতি পাহাড়িদের নেতা সন্তু লারমাও এর প্রতিবাদ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন পাহাড়িরা বাঙালি নন।
ছয়.
সংবিধানে ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৭ম তফসিল নামে নতুন তিনটি তফসিল সংযোজন করে সেখানে শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্তি, শেখ মুজিবের ২৬ মার্চের মধ্যরাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার টেলিগ্রাম এবং ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা এতে অন্তর্ভুক্ত না থাকায়, তা বিতর্কের মাত্রা আরো বাড়াবে মাত্র। বিএনপির নেতারা ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, তারা এটা মানেন না।
সাত.
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, 'রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম'। তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্য ধর্মাবলম্বীদের রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করবে। এ ধরনের প্রস্তাব 'ধর্মনিরপেক্ষতার' প্রস্তাবের পরস্পরবিরোধী।
আট.
প্রস্তাবে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে (সংগঠনের স্বাধীনতা) কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিশেষ করে ৩৮(খ) এর অন্তর্ভুক্তির ভিন্ন ব্যাখ্যা হতে পারে এখন।
নয়.
নির্বাচন কমিশনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু তাদের নিরপেক্ষতা কিভাবে নিশ্চিত হবে, তা বলা হয়নি। বর্তমান সরকার সিইসি ও কমিশনারদের নিয়োগ দিলে, তাদের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে এদের নিয়োগ দিতে হবে।
দশ.
অবৈধ ক্ষমতা দখলকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে চিহ্নিত করে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান, যুদ্ধাপরাধে দ-িতদের নির্বাচনে অযোগ্য ও ভোটার হতে না পারা ইত্যাদি বিষয়ে কমিটি যেসব প্রস্তাব করেছে, তার ভিন্ন ব্যাখ্যা হতে পারে এখন। এতে করে অসাংবিধানিক শক্তিকে ক্ষমতা দখলে কতটুকু নিরুৎসাহিত করবে, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন।
সবচেয়ে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়া। সংবিধানের ১৪২ ধারায় সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে। এতে (১৪২ আ) সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে সংবিধান সংশোধন করা যায়। এখন সংশোধনীতে যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে সংশোধনী আনা সহজ হবে না। সংশোধন প্রক্রিয়ায় যেতে হলে উচ্চ আদালতসহ বহু বাধা পেরুতে হবে। খসড়া প্রস্তাবে ৭(খ) যোগ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে 'এ সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যাহাই কিছু থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, নবম ক-ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সাপেক্ষে তৃতীয়ভাগের সকল অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের অনুচ্ছেদ ১৫০ সহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলোর বিধানাবলী সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোন পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হইবে'।
এর ফলে বিলের খসড়ায় 'জাতির পিতা' শিরোনামের অনুচ্ছেদ ৪-এ যা কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে (ছবি প্রদর্শন) তাতে সংশোধনী আনা সহজ হবে না। ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা, মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ইত্যাদি সংযুক্তি (অনুচ্ছেদ ১৫০.২) সংশোধন কঠিন হবে। রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি, জাতি হিসেবে বাঙালি ও নাগরিকতায় বাংলাদেশি বাতিল করা কিংবা 'আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' পুনঃস্থাপন করা সহজ হবে না।
একটি দেশের সংবিধান কোনো দলের নয়। কোনো ব্যক্তির স্বার্থে রচিত হতে পারে না। সংবিধান সংশোধিত হতেই পারে। তবে তা হতে হবে ঐকমত্যের ভিত্তিতে। বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়া যে কোনো সংবিধান সংশোধন গ্রহণযোগ্য হবে না। বিরোধী দল তথা চারদলীয় জোট দেশের জনগোষ্ঠীর ৩৭ ভাগ ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করে। এই ৩৭ ভাগ ভোটারের মতামত যদি গ্রহণ করা না হয়, তাহলে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়বে। আগামী দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় অনুষ্ঠিত হতে পারে। এক্ষেত্রে সরকার জাতির বৃহত্তর স্বার্থে নতুন একটি প্রস্তাব আনতে পারেন। বিশেষ কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত অন্তর্বর্তী সরকারের যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা শুধু অসাংবিধানিকই নয়, বরং তা ধূম্রজাল সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট। সরকার যদি আন্তরিক থাকে, তাহলে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া গত ১৬ জুন সংবাদ সম্মেলনে যে বক্তব্য রেখেছেন, সেই আলোকে একটা সমাধান খোঁজা সম্ভব। এক্ষেত্রে বিএনপি সংসদে গেলে বরফ গলতে পারে।
এই কি গনতন্ত্র একেই কি বলে সংবিধান???

সংবিধান সংশোধন নিয়ে দেশ এক বড় ধরনের অস্থিরতার দিকে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে আমরা একাধিকবার হরতাল প্রত্যক্ষ করেছি। স্থিতিশীলতার স্বার্থে, বাংলাদেশে বিকাশমান গণতন্ত্রকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার স্বার্থে বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপ জরুরি। হরতাল কোনো সমাধান নয়। হরতাল দিয়ে সরকারের পতন ঘটানো যায় না। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মূল কথা হচ্ছে আস্থা ও বিশ্বাস। এটা যদি না থাকে, সে দেশে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না। ১৯৯২ সালে সংবিধানে দ্বাদশ সংশোধনী এনে আমরা সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলাম। পরে ১৯৯৬ সালে ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। আজ ১৫ বছর পর আবার এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার উদ্যোগ নিচ্ছি আমরা। এভাবে গণতন্ত্র চর্চা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ভালো নয়। এখন পঞ্চদশ সংশোধনী বিল সংসদে উত্থাপিত হয়েছে। পাসও হয়ে যাবে। তারপরও একটা সমাধান সম্ভব। সংসদ একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে যে, দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে। সরকারের পক্ষ থেকে অথবা শরিকদের পক্ষ থেকে এ ধরনের একটি বিল উত্থাপিত হতে পারে এবং সরকারি দল তাতে সমর্থন দিতে পারে। এতে করে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা থাকলো না বটে, কিন্তু পরবর্তী দুটো নির্বাচন একটি নিরপেক্ষ সরকারের আওতায় আয়োজন করা সম্ভব এবং এর মাধ্যমে বিরোধী দলের সঙ্গে একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে যাওয়াও সম্ভব।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
 

কেবিনেটের সিদ্ধান্ত ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি

আমাদের জাতীয় সংসদ
সংবিধান সংশোধন হতেই পারে। অতীতেও হয়েছে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিরোধী দলের সমর্থন ছাড়া যদি সংসদে পাস হয়ে যায় এবং এতে করে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে, তার দায়ভার তো সরকারকেই বহন করতে হবে। বিএনপি এখন কঠিন কর্মসূচিতে যাবে। এটাই স্বাভাবিক। বিএনপি এই মুহূর্তে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। স্থায়ী কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে যে তারা সহযোগী অন্য দলগুলোর সঙ্গে কথা বলবে। তবে তারা প্রতিহতের কথা বলছে। কেবিনেট একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে গত ২০ জুন। ওই বৈঠকে সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ কমিটির ৫১ দফা সুপারিশ সংবলিত খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এটা এখন বিল আকারে সংসদে উপস্থাপন করা হবে। কেবিনেটের এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে সরকার তার অবস্থান পরিষ্কার করল। এখন স্পষ্টতই এই সিদ্ধান্ত রাজনীতিতে উষ্ণতা বাড়াবে। ইতোমধ্যে বিএনপির সিনিয়র নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ জানিয়ে দিয়েছেন সরকার আলোচনার সব পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। বিরোধী দল এর আগে ৫ জুন এবং ১২ ও ১৩ জুন লাগাতার ৩৬ ঘণ্টা হরতাল পালন করেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে। বিএনপি গত ২১ জুন স্থায়ী পরিষদের সভায় একটি সিদ্ধান্তও নিয়েছে। যে প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে এরপর কী? সরকারের পক্ষ থেকে যখন বিএনপির সঙ্গে আলোচনার কথা বলা হচ্ছিল, তখন কেবিনেটের এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে যে কোনো ধরনের আলোচনার পথ রুদ্ধ করে দিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও অনেকেই একমত যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চাকে আরো শক্তিশালী করতে হলে আরো কিছুদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকা প্রয়োজন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংসদীয় সরকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও বিশেষ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে এটা জরুরি। কেননা মাগুরা উপনির্বাচনের পর বেশ কয়েক বছর পার হয়ে গেলেও ভোলা উপনির্বাচন (২০১০) আবারো প্রমাণ করল দলীয় সরকারের আওতায় কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হয় না।

আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের অন্যতম উদ্যোক্তা। সেদিন ক্ষমতায় ছিলেন বেগম জিয়া। তিনি রাজি ছিলেন না। এখন দৃশ্যপট পুরোটাই উল্টে গেল। বেগম জিয়া এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখতে চাচ্ছেন, আর শেখ হাসিনা চাচ্ছেন না। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের দাবি উঠতে থাকে। ক্ষমতা গ্রহণের এক বছরের মাথায় শেখ হাসিনাই প্রথম প্রসঙ্গটি অবতারণা করেন। তারপর আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা তার প্রতিধ্বনি করতে থাকেন। সরকারের আড়াই বছরের মাথায় এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে সরকার আর সংবিধানে এই ব্যবস্থাটি রাখতে চাইছে না। এরপর এলো উচ্চ আদালতের রায়টি। উচ্চ আদালতের রায়ে বলা হযেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে ভাবীসাপেক্ষে বাতিল ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হলো। রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে এই ব্যবস্থা আরো দুই মেয়াদে বহাল থাকার পর। এটি রায়ের পরবর্তী অংশে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে জনগণও রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই যেহেতু সর্বোচ্চ আইন, সে কারণে প্রয়োজনের নিরিখে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনেই অনুষ্ঠিত হতে পারবে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি কিংবা আপিল বিভাগের বিচারপতিরা নিযুক্ত হতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে স্বাধীনভাবে জাতীয় সংসদ সিদ্ধান্ত নিতে পারবে বলে রায়ে অভিমত দেয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে উচ্চ আদালতের রায় যদি মানতেই হয়, তাহলে তো পুরোটাই মানতে হবে। সংবিধান সংশোধনের জন্য যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সেই কমিটি তাহলে উচ্চ আদালতের রায়ের একটি অংশ গ্রহণ করল কেন? পুরোটা গ্রহণ করে সুপারিশ দিলে তো এই প্রশ্নটি আজ উঠত না।

বিরোধী দলের পক্ষ থেকেও বলার কিছু থাকত না। আজ যখন বেগম জিয়া পুরো রায়ের কথা বলছেন, তার যুক্তি তো ফেলে দেয়ার না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আমাদের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করেছে। এটাকে বাদ দেয়া যাবে না। তবে অবশ্যই আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় সংস্কার চাই। বিশেষ করে ৫৮গ(৩) ধারায় পরিবর্তন আনতে হবে। এই ধারায় সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করার বিধান রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে উচ্চ আদালতে রাজনীতি ঢুকে গেছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের কর্মকা- প্রমাণ করে তিনি নিজেকে বিতর্কের ঊধর্ে্ব রাখতে পারেননি। তার একাধিক রায় নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে ১০ লাখ টাকা গ্রহণের যে সংবাদ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, তার ব্যাখ্যা তিনি দেননি। স্বাভাবিক কারণেই এ নিয়ে জনগণের মাঝে প্রশ্নের উদ্রেগ করেছে। অতীতে কোনো প্রধান বিচারপতি এভাবে বিতর্কিত হননি। আরেক প্রধান বিচারপতি অবসর গ্রহণের পরও তাদের মেধা দিয়ে জাতিকে সেবা করে যাচ্ছেন। জাতিকে পথ দেখাচ্ছেন। কিন্তু বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক নিজেকেই শুধু বিতর্কিত করলেন না, বরং বিচারপতিদের জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করালেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের উদ্ধৃতি আমি কি দেব? যেখানে তিনি নিজে আইনজীবীদের কাছেই গ্রহণযোগ্য হলেন না সেখানে আমজনতার কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন কিভাবে? তার কুশপুত্তলিকা তো আইনজীবীরাই দাহ করেছিল।

অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় তিনি দিয়েছেন। পঞ্চম সংশোধনী, সপ্তম সংশোধনী কিংবা ত্রয়োদশ সংশোধনী_সংবিধানের এসব সংশোধনী বাতিল হয়েছে উচ্চ আদালতের রায়ে। তার নেতৃত্বে উচ্চ আদালত রায় দিয়েছে। রায় নিয়ে মন্তব্য করা যাবে না। তাতে করে আদালত অবমাননা হয়ে যেতে পারে। ওই তিনটি রায় নিয়ে নানা মন্তব্য, নানা কথা পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। মুন সিনেমা হল নিয়ে মামলা হয়েছিল। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক রায় দিলেন পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের। বিচারপতি মুন সিনেমা হলের মালিকানার সঙ্গে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর কি সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছিলেন, আমি বলতে পারব না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মুন সিনেমা হলের মালিক তার সিনেমা হল আর ফেরত পাননি। কিন্তু ইতোমধ্যে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হয়ে গেছে। ত্রয়োদশ সংশোধনীও বাতির হলো। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হলো। আবার একই রায়ে বলা হলো আগামী দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। এটা কি পরস্পর বিরোধী নয়। যদি বাতিল হয় সব সময়ের জন্যই বাতিল। পরের দুটো কেন তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে? এটা কি এ জন্য যে বিচারপতি খায়রুল হক নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার ইচ্ছা ছিল তাই। সংবিধান তো তাই বলে। সংবিধানের ৫৮(খ) এবং বিশেষ করে ৫৮(গ)(৩) ধারায় যদি পরিবর্তন আনা না হয়, তাহলে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকই হবেন পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান। একজন বিতর্কিত লোক প্রধান উপদেষ্টা হবেন, সেটা নিশ্চয়ই কারো কাম্য নয়।

যিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসরে গেছেন, তার তো চাওয়ার কিছু থাকতে পারে না। রাষ্ট্র তাকে তো অনেক দিয়েছে। সাধারণ নিয়মে তার প্রধান বিচারপতি হওয়ার কথা ছিল না। তিনি দুদুবার সুপারসিডেড হয়ে প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। সর্বশেষ ঘটনায় বিচারপতি শাহ মোহাম্মদ আবু নাইম মোমিনুর রহমান পদত্যাগ পর্যন্ত করেছিলেন। বিচারপতি শাহ আবু নাইমের পদত্যাগের ঘটনাও বিচার বিভাগের জন্য কলঙ্ক। উচ্চ আদালতের রায় অনুসরণ করে সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করতে পারতো। এ ক্ষেত্রে শাহ মোহাম্মদ আবু নাইম মোমিনুর রহমানকে প্রধান বিচারপতি করা হলে, তাতে ক্ষতির কিছু ছিল না। তিনিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারতেন না।

এখন বরফটা কিভাবে গলবে, তা আমি নিশ্চিত নই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। কেবিনেটে বাতিল হওয়া মানে একটি ধাপ। আরো কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে তা আইনে পরিণত হবে। কিন্তু এটাই কি শেষ? সংসদে মহা ঐক্যজোটের দুইতৃতীয়াংশ আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। সংসদে একটি বিল পাস করানোর জন্য তা যথেষ্ট। কেবিনেট জাতীয় কমিটি কর্তৃক উত্থাপিত ৫১ দফা পুরোটাই অনুমোদন করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল এর একটি অংশ মাত্র। কেবিনেটের এই সিদ্ধান্ত থেকে এটা ধরে নেয়া স্বাভাবিক যে, সরকার শুধু একটি বিষয়ই নয়, বরং সংবিধানের আমূল পরিবর্তন চাচ্ছেন। কিন্তু প্রধান বিরোধী দলকে বাইরে রেখে, তাদের কোনো মতামত গ্রহণযোগ্যতায় না নিয়ে সংবিধানে যে পরিবর্তন আনা হচ্ছে, তা সঙ্কটের মাত্রাকে আরো বাড়াবে মাত্র। একটা সমঝোতা প্রয়োজন ছিল। সৈয়দ আশরাফ যখন সংলাপের কথা বলেন, তখন আমরা ধরে নিয়েছিলাম সরকার দ্রুত জাতীয় কমিটি কর্তৃক উত্থাপিত ৫১ দফা কেবিনেটে উপস্থাপনা করবে না। এখন দ্রুত কেবিনেটের অনুমোদন দেয়ার ফলে সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

সংবিধান সংশোধন হতেই পারে। অতীতেও হয়েছে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিরোধী দলের সমর্থন ছাড়া যদি সংসদে পাস হয়ে যায় এবং এতে করে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে, তার দায়ভার তো সরকারকেই বহন করতে হবে। বিএনপি এখন কঠিন কর্মসূচিতে যাবে। এটাই স্বাভাবিক। বিএনপি এই মুহূর্তে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। স্থায়ী কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে যে তারা সহযোগী অন্য দলগুলোর সঙ্গে কথা বলবে। তবে তারা প্রতিহতের কথা বলছে।

ধারণা করা হচ্ছে যে এবার ৪৮ ঘণ্টার হরতাল আসছে। সরকার খুব দ্রুত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ পূর্ণাঙ্গ রায় আমরা এখনো পাইনি। এরই মধ্যে প্রধান বিচারপতি অবসরে চলে গেছেন। নূ্যনতম ছয় মাস প্রয়োজন হবে পূর্ণাঙ্গ রায়টি পেতে। এর আগেই বিশেষ কমিটির মাধ্যমে প্রস্তাব দিয়ে কেবিনেটে তা পাস করিয়ে সরকার খুব দ্রুত সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীটি পাস করিয়ে নিতে চাইছে। এটা চলমান রাজনীতির জন্য কোনো ভালো খবর নয়। বিশেষ কমিটি গত ৪ মে সব সম্পাদকদের সঙ্গে যখন মতবিনিময় করেছিলেন সেদিন সম্পাদকরা একবাক্যে সবাই বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে বিলটি সংসদে পাস করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এখন মনে হচ্ছে সম্পাদকদের এই বক্তব্যও উপেক্ষিত হলো। ৮ জুন সংসদের বিশেষ কমিটির রিপোর্টে সংসদে উপস্থাপনের ১২ দিনের মাথায় কেবিনেট তা অনুমোদনের মধ্য দিয়ে চলমান রাজনীতিতে যে 'সঙ্কটের' সূচনা হলো, তা আমাদের জন্য আদৌ কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। এমনিতেই আমরা 'ব্যর্থ রাষ্ট্র' হিসেবে স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছি। বিখ্যাত 'ফরেন পলিসি' ম্যাগাজিনে ১৭৭টি দেশ নিয়ে যে 'ব্যর্থ রাষ্ট্র'-এর তালিকা সম্প্রতি তৈরি করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ২৫তম। বাংলাদেশে প্রতি ৫ জনের মধ্যে ২ জনই দরিদ্র। এমনি এক পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে দু'দলের মাঝে বিরোধ ও নূ্যনতম ঐকমত্যে পৌঁছানোর ব্যর্থতা 'ব্যর্থ রাষ্ট্র'-এর ধারণাকে আরো শক্তিশালী করবে মাত্র।

ড. তারেক শামসুর রেহমানঃ অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[সূত্রঃ যায় যায় দিন, ২৭/০৬/১১]

রাজনীতি কার স্বার্থে

রাজনীতি কার স্বার্থে
তা রে ক শা ম সু র রে হ মা ন
রাজনীতিকরা রাজনীতি করেন জনগণের মঙ্গলের জন্য। নির্বাচনের আগে তারা ভোট চান। জনগণ তাদের ভোট দেয়। দল জিতলে কেউ মন্ত্রী হন। কেউ মন্ত্রীর পদমর্যাদায় উপদেষ্টা হন। কিন্তু জনগণের মঙ্গল তারা করেন কতটুকু? একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকবে পাঁচ বছরÑ এটা ঠিক আছে। কিন্তু এ পাঁচ বছরে তাদের জবাবদিহি করার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। আজকে বাংলাদেশের যে পরিস্থিতি তাতে করে এ প্রশ্নটাই ঘুরে-ফিরে আসছে, রাজনীতি কার স্বার্থে! সরকার ও বিরোধী দল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে দুটি বড় দল এখন মুখোমুখি অবস্থানে। বিরোধী দলনেত্রী সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন ১৬ জুন। এর জবাব দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সংবাদ সম্মেলন করলেন ১৭ জুন। বিএনপি আবার ১৮ জুন আরেকটি ব্রিফিং করেছে। তাহলে কী এভাবে সংবাদ সম্মেলন ও পাল্টা সংবাদ সম্মেলন চলতে থাকবে? এরই মধ্যে আবার বিএনপি হুমকি দিয়েছে প্রয়োজনে ৭২ ঘণ্টা লাগাতার হরতাল দেয়া হবে। হরতাল দিয়ে সরকারের পতন ঘটানো যায় না। এ কথাটা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ জাতিকে জানান দিতে ভোলেননি। হরতালে ভোগান্তি বাড়ে ‘পাবলিকের’, যারা ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে। হরতালে রাজনীতিকদের তেমন ক্ষতি হয় না। অতীতে, আমার স্পষ্ট মনে আছে, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীকে (যখন তিনি বিরোধী শিবিরে) পুলিশ পিটিয়ে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল। রাস্তায় শুয়ে থাকা মতিয়া চৌধুরীর ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। আজ দেখলাম মির্জা ফখরুল ইসলামের ছবিÑ পুলিশ তাকেও পিটিয়েছে। ‘পুলিশের কাজ পুলিশ করে’, শুধু বদলে যায় দৃশ্যপট, মতিয়া চৌধুরীর পরিবর্তে মির্জা ফখরুল। কিন্তু আমজনতা তাতে কতটুকু উপকৃত হয়েছে? সরকার ওয়াদা করেছিল চালের দাম কমাবে। কমাতে পারেনি। তিনবেলা যে লোক ভাতের ওপর নির্ভরশীল, তার সরকারকে গালাগাল দেয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না। ১৮ জুনের সংবাদপত্রের খবরÑ ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে। বোতলজাত সয়াবিন তেল (যা বাহ্যত পাম অয়েল) বিক্রি হচ্ছে ১২৩ থেকে ১২৫ টাকায়। চিনি ৬৪ থেকে ৬৬ টাকা। সরকার জানিয়ে দিয়েছে তারা আর বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে না। আর ব্যবসায়ীরা তো এটাই চেয়েছে। বাজারে দাম বাড়লে কার কী? সরকার কিংবা বিরোধী দলÑ কারোরই মাথাব্যথা নেই। বিশাল এক বাজেট নিয়ে আসছে সরকার। দিনাজপুর থেকে ঢাকায় আসা ‘সিজনাল’ রিকশাওয়ালা মতিন বাজেট বোঝে না। কিন্তু অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব বোঝেন। বিশাল বাজেট বাস্তবায়নে ঝুঁকি মোকাবেলায় আইএমএফ থেকে কঠিন শর্তে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে সরকার। এটা আমাদের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী কিনা, এ ব্যাপারে বক্তব্য নেই বিরোধী দলের। সরকার ঋণ নিচ্ছে তার স্বার্থে। আমলাদের শেখানো বুলি আউড়িয়ে যাচ্ছেন আরেক সাবেক আমলা, আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কনোকোর সঙ্গে চুক্তি করল সরকার। বিকিয়ে দেয়া হল আমাদের জাতীয় স্বার্থ (আশিভাগ রফতানি, গ্যাস কিনতে হবে ৫০ থেকে ১০০ গুণ বেশি দামে, ২০ শতাংশ আনতে হবে বাংলাদেশের খরচে পাইপলাইন করে সমুদ্র থেকে)। কিন্তু বিএনপি তথা চার দলের বক্তব্য নেই এ ব্যাপারে। ডলার সংকটের (কিনতে হচ্ছে ৭৬ টাকায়) কারণে পণ্য আমদানিতে এলসি খোলা যাচ্ছে না। কাঁচামালের আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। ডলার পেতে বাড়ছে ভোগান্তি। অর্থনীতির এই ‘অশনি সংকেত’ নিয়ে কারও কোন মাথাব্যথা নেই। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা, রেমিটেন্সের প্রবাহ বাড়ানোর উদ্যোগও কোন ফল দিচ্ছে না। সুশাসনে ব্যর্থতা চোখে লাগার মতো। এসব ক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে সমঝোতা প্রয়োজন ছিল। না, এসব প্রশ্নে কারও কোন উদ্যোগ নেই। আমরা এখন আটকে আছি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকবে কী থাকবে না, তা নিয়ে।
১৭ জুন সৈয়দ আশরাফ সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়ে দিলেন, ‘বিএনপি সংলাপে না থাকলে তত্ত্বাবধায়ক ছাড়াই নির্বাচন’ (যুগান্তর, ১৮ জুন)। আর মির্জা ফখরুল বললেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আলোচনার কোন সুযোগ নেই’ (যুগান্তর, ওই)। তাহলে সমাধানটা কোন পথে? লাগাতার ৭২ ঘণ্টার হরতাল কি সমাধান? সরকার কি চাচ্ছে বিএনপি ওই পথে যাক ও জনতার ভেতর থেকে প্রতিবাদ উঠুক! সৈয়দ আশরাফের বক্তব্য অনেকটা হঠকারী। নির্বাচনের বাকি আছে আরও আড়াই বছর। এখনই নির্বাচন নিয়ে আগাম মন্তব্য করা ঠিক নয়। সরকারে যিনি বা যারা থাকেন, তাদের সহনশীল হতে হয়। তাদের সহ্যশক্তি থাকতে হয়। সৈয়দ আশরাফ সিনিয়র নেতা। তার এ ধরনের উক্তি শোভন নয়। এতে জটিলতা আরও বাড়বে। বরং খালেদা জিয়ার বক্তব্যকে বিবেচনায় নিয়ে তিনি কিছু মন্তব্য করতে পারতেন। খালেদা জিয়া দুটো জিনিস বলেছেন। এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকবে। দুই. সদ্য অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক প্রধান উপদেষ্টা হতে পারবেন না। দুটো বক্তব্যের পেছনেই যথেষ্ট যুক্তি আছে। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক সরকারকে একটি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছেন। তার নানা ‘কাহিনী’ সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। এর একটিরও তিনি প্রতিবাদ করেননি। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ১০ লাখ টাকা গ্রহণের অভিযোগও তিনি অস্বীকার করেননি। সুতরাং মানুষ ধরেই নেবে উত্থাপিত অভিযোগগুলোর পেছনে সত্যতা আছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে আমি অনুরাধ করব বিচারপতি হককে, তিনি যেন বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দেন তিনি প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করবেন না। এতে করে সরকারের অবস্থান কিছুটা হলেও শক্তিশালী হবে। দ্বিতীয়ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে উচ্চ আদালতের রায়কে বিবেচনায় নিয়ে (দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকার) সরকার নিজে অথবা শরিকদের কারোর মাধ্যমে একটি প্রস্তাব সংসদে উপস্থাপন করতে পারে। তখন আমার বিশ্বাস আলোচনায় বিএনপি অংশ নেবে। এর আগে সংসদে এসে বিএনপিকে প্রস্তাব দেয়ার প্রয়োজন নেই। খালেদা জিয়ার বক্তব্যকে প্রস্তাব হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করা যায়। দুই পক্ষের মাঝে আলোচনার প্রয়োজন আছে। সংসদের বাইরেও আলোচনা হতে পারে। এমনকি তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমেও (যিনি বা যারা দুই পক্ষের বন্ধু) আলোচনার সূত্রপাত করা যায়। আমি বিশ্বাস করি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মাঝে এমন কিছু শুভবুদ্ধির মানুষ আছেন, যারা চান আলাপ-আলোচনা হোক। সেটা যে সংসদেই হতে হবে, তার কোন মানে নেই। এমনকি আমাদের সিনিয়র সিটিজেনদের কেউ কেউও এগিয়ে আসতে পারেন।
দেশের সমস্যা এখন অনেক। অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়। বেকারত্ব বাড়ছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ নেই। বৈদেশিক বিনিয়োগের অবস্থাও ভালো নয়। মন্ত্রী ও উপদেষ্টারা বেশি কথা বলেন। সুশাসন নিয়ে নানা প্রশ্ন এখন। র‌্যাবের অনেক ভালো কাজ ম্লান হয়ে গেছে দু’-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনায়। আমরা ভুলে যাই র‌্যাবকে এখন দেশের বাইরে থেকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আসরে মানবাধিকারের প্রশ্নটিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া হয়। আমরা চাই না র‌্যাব একটি বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হোক। এসব ক্ষেত্রেও বিরোধী দলের মতামত থাকা প্রয়োজন। কেননা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে বিরোধী দলের ভূমিকা উপেক্ষা করা যায় না।
মহাÍা গান্ধী একটা কথা বলেছিলেন। তার ভাষায় ‘যতক্ষণ পর্যন্ত না সকলে ক্ষমতার অংশীদার হয়ে ওঠে সে অবধি গণতন্ত্র অসম্ভব; গণতন্ত্রকে তাই বলে জনতাতন্ত্রে (গড়নড়পৎধপু) পর্যবসিত করা যাবে না।’ সরকারের কর্মকাণ্ড দেখে গান্ধীর উক্তিটি মনে পড়ে গেল। গণতন্ত্রে বিরোধী দল সরকারের একটি অংশ। তাই অবশ্যই তাকে ক্ষমতার অংশীদার হতে হবে। এর অর্থ এই নয়, বিএনপিকে মন্ত্রিসভায় নিতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে নীতিনির্ধারণীতে বিএনপির অংশগ্রহণ থাকা। সরকারের নীতির সমালোচনা করে, নতুন প্রস্তাব উত্থাপন করে বিএনপি তার অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে পারে। আর সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপিকে ভূমিকা পালনে সুযোগ দেয়া। এক্ষেত্রে সরকার যদি এককভাবে সব কাজ সম্পন্ন করে তাহলে তা পরিণত হবে জনতাতন্ত্রে, যাতে জনগণের মঙ্গল নিহিত থাকবে না। বর্তমান সরকারের কর্মকাণ্ড তাদের ‘জনতাতন্ত্রের’ দিকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা যে সংকটের মুখোমুখি, তার সমাধান হতে পারে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে। আর তা যে সংসদেই হতে হবে, তার কোন মানে নেই।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


গণতন্ত্রের জন্য...


গণতন্ত্র নিয়ে এই ধরণের হাস্যরস কাম্য নয়

গণতন্ত্রের জন্য...

ড. তারেক শামসুর রেহমান

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৬তম প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্ট (১৯০১-১৯০৯) একবার বলেছিলেন, This country will not be a good place for aসচ of us to live in unless we make it a good place for all of us to live in| বাংলা করলে অনেকটা এ রকম দাঁড়ায়-'এ দেশকে যদি আমরা সবার বসবাসের জন্য ভালো জায়গা হিসেবে গড়ে না তুলি, তাহলে এটি আমাদের কারো বসবাসের জন্যই ভালো জায়গা হয়ে উঠবে না।' আজ বাংলাদেশের পরিস্থিতি দেখে কেন জানি প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্টের উক্তিটি মনে পড়ে গেল। এ দেশে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় না_এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন শেখ হাসিনা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে হরতাল পর্যন্ত হয়েছিল। আজ শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী। দ্বিতীয়বারের মতো তিনি এ দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। মানুষ তাঁর দলকে ভোট দিয়েছে। তাঁর কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। কিন্তু সেই তিনিই এখন চাচ্ছেন না, সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকুক। যুক্তি হচ্ছে আপিল বিভাগের একটি রায়। আপিল বিভাগের রায় মানতে আমরা বাধ্য। কিন্তু রায় মানলে তো পুরোটা (পর্যবেক্ষণসহ) মানাই শ্রেয়। রায়ের একটি অংশ মেনে, অপর অংশকে বাদ দিলে প্রশ্ন তো উঠবেই। রায়ে যেমনি বলা হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ, তেমনি বলা হয়েছে_'জনগণ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই যেহেতু সর্বোচ্চ আইন, সে কারণে প্রয়োজনের নিরিখে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনেই অনুষ্ঠিত হতে পারবে।' সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ সংসদীয় কমিটি সংবিধান সংশোধনের জন্য যে ৫১ দফা সুপারিশ করেছে, তাতে এই অংশটুকু না থাকায় বিতর্ক ও বিভ্রান্তি বেড়েছে। আজ জাতি এক বড় ধরনের সংকটের মুখোমুখি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময়ে শেখ হাসিনার আহ্বানে হরতাল হয়েছিল।

আজ প্রায় ১৭ বছর পর খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার দাবিতে হরতাল করলেন। ভয়ের কারণ যেটা তা হচ্ছে, এরপর ৩৬ ঘণ্টা নয়, লাগাতার ৪৮ ঘণ্টা কিংবা একটানা সাত দিনও হরতাল হতে পারে। এমন ধরনের একটি সম্ভাবনার কথা আমাদের জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এই যে পরিস্থিতি, এই পরিস্থিতিতে মনে পড়ে গেল রুজভেল্টের উক্তিটি, যেখানে তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন-দেশকে যদি সবাই মিলে গড়ে না তুলি, তাহলে দেশটি কারো জন্যই বসবাসের ভালো জায়গা হবে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই উক্তিটি কত সঠিক! দেশকে গড়ার দায়িত্ব তো রাজনীতিবিদদের। প্রধানমন্ত্রী বারবার বলছেন 'অদৃশ্য শক্তি'র কথা। কিন্তু নিজেরা মিলে সমস্যার যদি সমাধান করা না যায়, তাহলে 'অদৃশ্য শক্তি'কে কে রুখবে?

গণতন্ত্রের অভিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বিধান থাকতে পারে না_এটা সত্য। কিন্তু আমরা গুলিয়ে ফেলি এক জায়গায়_উন্নত বিশ্বের গণতন্ত্রচর্চার সঙ্গে উন্নয়নশীল বিশ্বের গণতন্ত্র চর্চাকে মেলানো যাবে না। ইউরোপের গণতন্ত্রচর্চার ইতিহাস অনেক পুরনো। আমরা সেই স্তরে এখনো পৌঁছতে পারিনি। আমাদের সমাজে গণতন্ত্রের বিকাশের স্বার্থেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মতো একটি ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। এ জন্য সংবিধান যে পরিবর্তন করতে হয়, সেটাও অমূলক নয়। জিম্বাবুয়েতে ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর সেখানে যে সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছিল, তার সমাধান হয়েছিল বিরোধী দলের নেতা সাভাঙ্গিরাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তির মধ্য দিয়ে। অথচ জিম্বাবুয়ের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর কোনো পদ ছিল না। এর আগে ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে একই ধরনের ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি কেনিয়ায়। প্রেসিডেন্ট কিবাকি ও বিরোধী দলের নেতা রাইলা ওডিঙ্গার মধ্যকার দ্বন্দ্বে সেখানে অনেক লোক মারা যায়। শেষ পর্যন্ত বিদেশিদের মধ্যস্থতায় ওডিঙ্গাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগের মধ্য দিয়ে কেনিয়ার গণতন্ত্র একটা সমাধান খুঁজে পায়। কেনিয়ার সংবিধানেও কোনো প্রধানমন্ত্রীর পদ ছিল না। প্রথমে কেনিয়া ও পরে জিম্বাবুয়ের ঘটনাবলি প্রমাণ করে, উন্নয়নশীল বিশ্বে গণতন্ত্রকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যেতে হলে কোনো কোনো রাষ্ট্রকে কখনো-সখনো সংবিধানবিরোধী সিদ্ধান্ত নিতে হয়। শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধপরবর্তী সময়ে এমন সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা গণতন্ত্রের পরিপন্থী; অথচ জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তা মেনে নেওয়া হয়েছে। আমি এ রকম অনেক দৃষ্টান্ত দিতে পারব, যেখানে গণতন্ত্রের স্বার্থেই রাষ্ট্র এমন সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা প্রকারান্তরে গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা ছিল এমন একটি সিদ্ধান্ত, যা বাংলাদেশের বিকাশমান গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করেছিল। এ ব্যবস্থা বিদেশে প্রশংসিতও হয়েছিল। তবে ব্যবস্থাটি ত্রুটিমুক্ত ছিল না। তিনটি নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পরই ত্রুটিগুলো আরো স্পষ্ট হলো। এখন যদি এই ত্রুটিগুলো দূর করা যায়, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি তাতে করে আরো শক্তিশালী হবে।

নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা যায়_এটা তত্ত্বের কথা। বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা হলেও, তা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প হতে পারে না। কেননা বর্তমান সরকারই সিইসি তথা নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেবে। ফলে প্রশ্ন উঠবে তাদের আনুগত্য নিয়ে। এখন তো শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই 'রাজনীতি' করেন না, আমলারাও রাজনীতি করেন। কেউ বিএনপির আমলা, কেউ আবার আওয়ামী লীগের আমলা। রাজনৈতিক বিবেচনায় সচিব নিয়োগ হচ্ছে। কেউবা আবার বঞ্চিত হচ্ছেন। বিএনপির আমলে প্রমোশন না হওয়া ব্যক্তিরা বর্তমান সরকারের আমলে হুট করে সচিব পর্যন্ত হয়ে গেছেন-এমন দৃষ্টান্তও আছে। তাই যাঁদেরই নিয়োগ দেওয়া হবে, তাঁদের নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। আর সরকার যে তাদের স্বার্থেই এসব পদে নিয়োগ দেবে, এটা বলাই বাহুল্য। তাহলে নিরপেক্ষতা থাকল কোথায়? নির্বাচন কমিশনকে অর্থের জন্য সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। তাদের নিজস্ব তেমন জনবল নেই। গ্রামপর্যায়ে তারা প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল। সেখানে 'ম্যানিপুলেশনের' আশঙ্কা বেশি। তাই নির্বাচন যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে_তার গ্যারান্টি কে দেবে? আমরা ভারতের দৃষ্টান্ত দিই বটে, কিন্তু সেখানকার রাজনীতিবিদরা আমলাদের নিয়ন্ত্রণ করেন। আর আমাদের এখানে আমলারা নিয়ন্ত্রণ করেন রাজনীতিবিদদের। ভারতের দৃষ্টান্ত আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়।

খালেদা জিয়া ১৬ জুন সংবাদ সম্মেলন করে তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তিনি অন্য কোনো সিদ্ধান্ত মানবেন না এবং নির্বাচনে অংশও নেবেন না। পাঠক, ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনের আগের দিনগুলোর কথা স্মরণ করতে চেষ্টা করুন। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ১৯৯৬ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল। তাতে আওয়ামী লীগ অংশ নেয়নি। ফলে ওই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। এমনকি ১৯৮৬ সালে এরশাদ সাধারণ নির্বাচন দিয়ে আওয়ামী লীগকে ওই নির্বাচনে নিয়ে গেলেও তৃতীয় জাতীয় সংসদ স্থায়ী হয়নি বিএনপি অংশগ্রহণ না করার কারণে। পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, ও নবম জাতীয় সংসদ ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল একটাই কারণে_কারণ দুটি বড় দল ওইসব নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। দশম জাতীয় সংসদ নিয়ে আগাম মন্তব্য করা সঠিক নয়। নির্বাচন হবে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে। অনেক সময় বাকি। কিন্তু স্থিতিশীলতার স্বার্থে একটা সমঝোতা প্রয়োজন। বিএনপিকে সংসদে এসে নতুন করে প্রস্তাব দিতে বলেছে আওয়ামী লীগ, এর কি আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে? খালেদা জিয়া দুটো জিনিস পরিষ্কার করেছেন_এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে অন্তত আগামী দুটো সাধারণ নির্বাচনের জন্য, দুই. সংবিধানের ৫৮গ(৩) ধারায় সংশোধনী এনে সাবেক প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টার পদে নিযুক্তিতে পরিবর্তন আনতে হবে। সংসদে যে কেউ এ ব্যাপারে প্রস্তাব আনতে পারেন। সরকার যে কাউকে উৎসাহিত করতে পারে এ ধরনের প্রস্তাব আনতে। এমনকি একমাত্র নির্দলীয় সদস্যও এ প্রস্তাব আনতে পারেন। এ ক্ষেত্রে সরকারি এমপিরাও সেই প্রস্তাব সমর্থন করে একটি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন। উচ্চ আদালতের রায় ও অভিমতের অনুসরণ করেও এ ধরনের প্রস্তাব আনা যায়।

আওয়ামী লীগ যদি এককভাবে চলে, তাহলে আওয়ামী লীগ ভুল করবে। দেয়ালের লিখন বড় কঠিন, বড় বাস্তব। আর দেয়ালের লিখন থেকে আমরা কেউ শিখি না, কেউ শিক্ষাও নেই না। ১০ জুন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সংবাদ সম্মেলন করে যে বক্তব্য দিলেন, তা কোনো সমাধানের পথ নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই নির্বাচন হবে_এ ধরনের বক্তব্য জনমনে হতাশা বাড়াবে। বিএনপিকে বাধ্য করবে আরো কঠোর কর্মসূচি দিতে। হুঁশিয়ারি নয়, বরং একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য সংলাপের পথ খোঁজা এই মুহূর্তে জরুরি। গণতন্ত্রকে যদি আমরা সত্যিকারভাবে ধারণ করি, তাহলে হুমকি ও পাল্টা হুমকি পরিহার করতে হবে। গণতন্ত্রের স্বার্থেই সমঝোতা প্রয়োজন। আর গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী ও আরো উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে যদি আগামী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যায়, তা গণতন্ত্রের ভিতকে এ দেশে আরো শক্তিশালী করবে মাত্র।

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
[সূত্রঃ কালের কণ্ঠ, ১৯/০৬/১১]

আরব বিশ্বের রাজনীতি কোন পথে



আরব বিশ্বের রাজনীতি কোন পথে

লেখক: ড. তারেক শামসুর রেহমান  
দৈনিক ইত্তেফাক
রবি, ১৯ জুন ২০১১, ৫ আষাঢ় ১৪১৮

ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহর দেশ ত্যাগের মধ্যে দিয়ে ‘আরব বসন্ত’ তৃতীয় পর্যায় পার করলো। তিউনিসিয়ার বেকার কম্পিউটার গ্র্যাজুয়েট বউকুজিজির আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে যে ‘বিপ্লব’এর শুরু হয়েছিল, সেই ‘বিপ্লব’ একে একে পতন ডেকে আনলো তিউনিসিয়ার বেন আলীর, মিসরের হোসনি মোবারকের ও সর্বশেষ ইয়েমেনের আলী আবদুল্লাহ সালেহের। মধ্যপ্রাচ্য তথা উত্তর আফ্রিকায় যে পরিবর্তনের বাতাস বইছে, তাকে তুলনা করা হচ্ছে ‘প্রাগ বসন্ত’ কিংবা চেকোস্লাভিয়ার ভেলভেট রেভ্যুলেশনের সাথে। প্রাগ বসন্ত সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশ চেকোস্লাভিয়ায় ১৯৬৮ সালে একটি পরিবর্তনের সূূচনা করলেও সমাজতান্ত্রিক সমাজে সেই পরিবর্তন টিকে থাকেনি। সোভিয়েত ট্যাংক সাবেক চেকোস্লাভিয়ার রাজধানী প্রাগে নেমেছিল ও সংস্কারবাদীদের চেক কমিউনিস্ট পার্টি তথা রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে উচ্ছেদ করেছিল। কিন্তু নাট্যকার ভাসলাভ হাভেলের নেতৃত্বে ১৯৮৯ সালে ওই চেকোস্লাভিয়াতেই যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল, তা ছেয়ে গিয়েছিল সমগ্র পূর্ব ইউরোপে। সমাজতন্ত্রের পতন ঘটেছিল। শান্তিপূর্ণ ওই বিপ্লব চিহ্নিত হয়ে আছে, ‘ভেলভেট রেভ্যুলেশন’ হিসেবে। আজ ২২ বছর পর আরব বিশ্বে যে পরিবর্তনের ঢেউ উঠেছে, তাতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় পরিবর্তন এসেছে তিউনিসিয়া ও মিসরে। আর এখন পরিবর্তন এলো ইয়েমেনে। লিবিয়া ও সিরিয়ায়ও পরিবর্তনের পথে। লিবিয়ায় গাদ্দাফির পতন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু যে প্রশ্ন এখন অনেকেই করেন তা হচ্ছে, ‘আরব বসন্ত’ কী ধরনের পরিবর্তন ডেকে আনছে মধ্যপ্রাচ্য তথা উত্তর আফ্রিকায়? ভাসলাভ হাভেল যে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, তা স্ফুলিঙ্গের মতো সমগ্র পূর্ব ইউরোপে ছড়িয়ে গিয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে সেখানে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে। গত ২২ বছরে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো একটি গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তুলেছে। সেখানে নিয়মিতভাবে নির্বাচন হয়। সরকার পরিবর্তন হয় জনগণের ভোটে। গণতান্ত্রিক পার্টিগুলোও বিকাশ লাভ করেছে, যা আগে ছিল না। মানুষ গণতন্ত্রের ফল ভোগ করতে শুরু করেছে। ফ্রিপ্রেস সেখানে। মানুষ সরকারকে সমালোচনা করছে, যা আগে ছিল অকল্পনীয়। পুঁজিবাদনির্ভর অর্থনীতিও সেখানে বিকাশ লাভ করছে। কিন্তু আরব বিশ্বে কী পরিবর্তন আসছে? সেখানে একদলীয় শাসনের পরিবর্তে কী বহুদলীয় গণতন্ত্র বিকশিত হবে? বেন আলী ও তার দল এককভাবে ক্ষমতা পরিচালনা করে গেছেন দীর্ঘ ২৩ বছর। হোসনি মোবারক ও তার দল ক্ষমতায় ছিলেন ৩৫ বছর। আর আবদুল্লাহ সালেহ ছিলেন দীর্ঘ ৩৩ বছর ক্ষমতায়। বেন আলী, হোসনি মোবারক কিংবা আলী আবদুল্লাহ সালেহর শাসন আর যাই হোক গণতন্ত্রসম্মত ছিল না। এখন এদের বিদায়ের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র কী প্রতিষ্ঠিত হবে?
এই যখন পরিস্থিতি, তখন মরক্কো থেকে এসেছে একটি আশাব্যাঞ্জক খবর। বাদশাহ মুহম্মদ-৬ সেখানে সংস্কারের কথা বলেছেন। জনগণের ভোটে তিনি সেখানে পরিবর্তন আনতে চান। তরুণ এই রাজা ক্ষমতায় আছেন ১৯৯৯ সাল থেকে। তুলনামূলক বিচারে আরব বিশ্বের অন্য দেশগুলোর চেয়ে মরক্কোর অবস্থা অনেক ভালো। গণতন্ত্র ইনডেক্সে ১৬৭টি দেশের মাঝে মরক্কোর অবস্থান ১১৬। আর সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ১৯৬টি দেশের মাঝে দেশটির অবস্থান ১৪৬। এখন গণভোটে সংবিধান যদি পরিবর্তন আনা হয় এবং সেখানে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে আরব বিশ্বের রাজনীতির জন্য তা হবে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সম্ভবত, বাদশাহ মুহম্মদ পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছেন। তাই আগেভাগেই তিনি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন, এখন দেখতে হবে তিনি কতটুকু আন্তরিক। তবে একটা ভালো দিক হচ্ছে, মরক্কোতে বড় ধরনের কোনো গণঅভ্যুত্থানের এখনো সৃষ্টি হয়নি। মিসর কিংবা সিরিয়ার মতো পরিস্থিতি সেখানে এখনো সৃষ্টি হয়নি। তার আগেই বাদশাহ মুহম্মদ-৬ সংস্কারের উদ্যোগ নিলেন। তিনি নিজের কিছু ক্ষমতা ছেড়ে দিতে চান।
আরব বসন্তকে সামনে রেখে এখন অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। এক. লিবিয়া ইরাকের মতো পরিস্থিতি বরণ করবে কি না? অর্থাত্ বিদেশি শক্তি সেখানে অবতরণ করবে কি না? ২০০৩ সালে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে মিত্র বাহিনী অবতরণ করেছিল এবং সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। এখন লিবিয়ার পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। সেখানে গৃহযুদ্ধ চলছে। যুক্তরাষ্ট্র তথা ইউরোপীয় শক্তিগুলোর বোমাবর্ষণের পরও মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে উত্খাত করা সম্ভব হয়নি। তিনি ক্ষমতায় আছেন দীর্ঘ ৪১ বছর। এই দীর্ঘ ৪১ বছরে তিনি লিবিয়ায় নতুন ধরনের এক রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্ম দিয়েছেন। সেখানে কোনো সংবিধান নেই। গাদ্দাফি রাষ্ট্রের কোনো পদে অধিষ্ঠিত নেই। তাকে অভিহিত করা হয় ‘বিপ্লবের নেতা’ হিসেবে আর এই যুক্তিটিই তিনি দেখাচ্ছেন যে তিনি কার কাছে পদত্যাগ করবেন। তিনি তো কোনো রাষ্ট্রীয় পদে নেই। কার্যত, লিবিয়া এখন ভাগ হয়ে গেছে। রাজধানী লিবিয়া ও এর আশপাশের অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে গাদ্দাফি ও তার অনুগত বাহিনী। অন্যদিকে, পূর্বাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে বিদ্রোহীরা। তেলসমৃদ্ধ বেনগাজিকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিদ্রোহীদের আন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন। অনেক আরব রাষ্ট্র ও অন্তর্বর্তী প্রশাসনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিদ্রোহীরা অর্থ ও অস্ত্র সংকটে আছে। দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে লিবিয়ায় যুদ্ধ চললেও গাদ্দাফিকে উত্খাত করা সম্ভব হয়নি। এরই মাঝে আফ্রিকান ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধিদল সার্বিয়া সফর করেছেন। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। এরই মাঝে গাদ্দাফিপুত্র সাইফ আল-ইসলাম নির্বাচনের একটি প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নির্বাচনে হেরে গেলে গাদ্দাফি পদত্যাগ করবেন। কিন্তু বিদ্রোহীরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র এই প্রস্তাবে রাজি নয়। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, গাদ্দাফিকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। তাই লিবিয়ার পরিস্থিতি কোন দিকে যায় বলা কঠিন। ভয়ের কারণ হচ্ছে, গাদ্দাফি ইতিমধ্যে তার অস্ত্রভাণ্ডার খুলে দিয়েছেন। ধারণা করছি, এই অস্ত্র চলে গেছে ইসলামি জঙ্গি গ্রুপগুলোর হাতে, যারা যুক্তরাষ্ট্রকে ‘শত্রু’ মনে করে। দুটি গ্রুপের কথা জানা যায়, তাদের সাথে আল-কায়েদার সম্পর্ক রয়েছে। এ দুটি সংগঠন হচ্ছে-Al jamaa al Muqatilah bi libya এবং Libya Islamic Fighting Grop (LIFG)। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যে ক’টি সংগঠনকে আল-কায়েদার সাথে সম্পৃক্ত বলে চিহ্নিত করেছিল, তার মাঝে LIFG আছে। এরা যদি সত্যি সত্যি অস্ত্র পেয়ে থাকে, তাহলে তা এ অঞ্চলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই লিবিয়ার ভবিষ্যত্ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। দুই. সিরিয়ার পরিস্থিতিও দিনে দিনে ঘোলাটে হচ্ছে। সেনাবাহিনী এখনো প্রেসিডেন্ট বাসার আল-আসাদকে সমর্থন করে যাচ্ছে, যিনি ক্ষমতায় আছেন ২০০০ সাল থেকে। তার ছোট ভাই সেনাবাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটের কমান্ডার। বিদ্রোহীরা দুটি গুরুত্বপূর্ণ শহর জিসার আল-শুখোর ও মারাত আল-লুমান দখল করে নিলেও সেনারা তা পুনর্দখল করেছে। গৃহযুদ্ধে কয়েক হাজার মানুষ মারা গেছেন এবং লক্ষাধিক মানুষ দেশান্তরিত হয়ে সীমান্তবর্তী তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছেন। তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য। সিরিয়া সংকটে তুরস্ক একটি ভূমিকা পালন করতে পারে। তুরস্কের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল ঘিরে যে সিরীয় শহর, সেখানে বিদ্রোহীদের ঘাঁটি গড়ে তুলতে পারে, যা কি না হতে পারে ‘লিবিয়ার বেনগাজী’। তিন. ‘আরব বসন্ত’ মিসর ও তিউনিসিয়ায় সরকার পরিবর্তন করেছে। কিন্তু সরকারের চরিত্রের আদৌ কোনো পরিবর্তন ঘটায়নি। পুরনো কাঠামো রয়ে গেছে। সেনাবাহিনী দুটি দেশেই পর্দার অন্তরালে থেকে কলকাঠি নাড়াচ্ছে। দুটি দেশেই ইসলামিক শক্তিগুলো নতুন উদ্যোমে আত্মপ্রকাশ করেছে। মিসরে দীর্ঘদিন ধরে নিষিদ্ধ ছিল ইসলামিক ব্রাদারহুড পার্টি। তারা এখন ইসলামিক ফ্রিডম ও জাস্টিস পার্টি নামে আত্মপ্রকাশ করেছে। শুধু তাই নয়, তারা পুরনো দল wafd পার্টির সাথে নির্বাচনী ঐক্য করেছে। আগামী জুলাইয়ে সেখানে সংসদ নির্বাচন। ধারণা করা হচ্ছে, এই ঐক্যজোট নির্বাচনে ভালো করবে। ইতিমধ্যে সংবিধান প্রণয়নেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নতুন সংবিধানে সেনাবাহিনী তাদের প্রতিনিধিত্বে নিশ্চিত করতে চায়। বর্তমান যে সামরিক জান্তা ক্ষমতা পরিচালনা করছে, তারা চাচ্ছেন, নয়া সংবিধানে সেনাবাহিনীর একটা প্রতিনিধিত্ব থাকুক। শেষ পর্যন্ত সংবিধান প্রণয়ন কমিটি এই চাপ উপেক্ষা করতে পারবে কি না এটা দেখার বিষয়। চার. আরব বিশ্বের তরুণ সমাজ এই ‘বিপ্লব’কে সম্পন্ন করেছে। কিন্তু নতুন যে সংস্কৃতি বিকশিত হচ্ছে, তাতে তাদের কোনো স্বীকৃতি বা ভূমিকা নেই। ফলে এদের আশা ভঙ্গ হয়েছে এবং তাদের যদি আবার রাজপথে আন্দোলনে নিয়ে আসে, আমি অবাক হব না। এই তরুণ সমাজ আরব বিশ্বে একটি শক্তি। আলজেরিয়ায় মোট জনগোষ্ঠীর মাঝে শতকরা ৪৬ ভাগ হচ্ছে তরুণ, তিউনিসিয়ায় ২৭ ভাগ, লিবিয়ায় ৪০ ভাগ, মিসরে ২৬ ভাগ, সিরিয়ায় ২০ ভাগ, জর্ডানে ৩৯ ভাগ, বাহরাইনে ২৫ ভাগ, আর মরক্কোতে ১৬ ভাগ। এই শক্তিকে অস্বীকার করা যাবে না। পাঁচ. আরব বিশ্বে গোষ্ঠীতন্ত্র একটি ফ্যাক্টর। দেখা গেছে, নিজস্ব গোষ্ঠী তথা গোত্রের লোকদের নিয়েই ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা ধরে রেখেছেন। গাদ্দাফির পেছনে আছে তার গোত্রের লোকেরা। সিরিয়ার ‘আলাবি’ গোষ্ঠী প্রেসিডেন্ট বাসারের ক্ষমতার অন্যতম উত্স। তিউনিসিয়ায় ক্ষমতাচ্যুত বেন আলী তার পরিবার ও গোত্রের লোকদের নিয়ে একটা ক্ষমতার বলয় সৃষ্টি করেছিলেন। বাহরাইনে শিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ; কিন্তু সুন্নি সম্প্রদায় সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়েও সেখানে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছেন। বাহরাইনের শাসক হামাদ বিন ইসা আল-খলিফার (১৯৯৯ সাল থেকে যিনি ক্ষমতায়) বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছিল, তা দমন করতে উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিলের উদ্যোগে সৌদি সেনাবাহিনী বাহরাইনে প্রবেশ করেছিল এবং আন্দোলন নস্যাত্ করে দিয়েছিল। এটা একটা নতুন উপাদান। ইয়েমেনেও এই কাউন্সিল উদ্যোগ নিচ্ছে। এখানেও উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিল সেনাবাহিনী পাঠাতে পারে। স্পষ্টতই আরব বিশ্ব একটা সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের উত্খাত করে সেখানে আদৌ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে কি না-সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা গত ১৯ মে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে আরব বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন। কিন্তু কাজটি সহজ নয়। যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে সাহায্য, সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণ দিলেও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো যে শক্তিশালী হয়েছে তা বলা যাবে না। লিবিয়ার দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ, সিরিয়ায় সেনাবাহিনীর শাসনগোষ্ঠীর প্রতি সমর্থন, ইয়েমেনে আল-কায়েদা গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত একটি জঙ্গিগোষ্ঠী কর্তৃক সমগ্র উপকূলবর্তী শহর জিনজিবার দখল প্রমাণ করে এ অঞ্চলে সত্যিকারার্থে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে পরিবর্তন আসছে। খুব ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে আরব বিশ্বের সমাজ। ক্ষমতাসীনরাও কিছু কিছু ছাড় দিচ্ছেন। নতুন সংবিধান, নয়া নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নতুন নতুন শক্তির উদ্ভব হচ্ছে। এরাই আগামী দিনের আরব বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে।
[লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]
tcrahmanbd@yahoo.com

রুমানার জন্য দুঃখবোধ





মুত্যুর সাথে লড়ছেন রুমানা
নারী নির্যাতন একটা অপরাধ। যারা অপরাধ করে, রাষ্ট্র যদি তাদের 'সুযোগ' করে দেয়, তাহলে অপরাধীর সংখ্যা এ দেশে বাড়বেই। আইন আছে। কিন্তু আইনের সঠিক প্রয়োগ হয় না। অনেক সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্লিপ্ততার সুযোগ নেয় অপরাধীরা। রুমানার নির্যাতনকারীর ক্ষেত্রেও এমনটি হতে যাচ্ছিল, যদি উচ্চ আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল ইস্যু না করতেন। আদালত রুল ইস্যু করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গ্রেফতার করা হয় 'স্বামী' নামের বর্বরটিকে।

রুমানার খবরটা যখন আমি পত্রিকায় পড়লাম, তখন আমি সিলেটে। সংবাদটা বারবার পড়েছি আর বোঝার চেষ্টা করেছি এই সমাজটা তাহলে কোথায় যাচ্ছে? এই সমাজ একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকাকে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ঘটনা হয়তো নয়, কিংবা এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ঘটেনি, কিন্তু তবুও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তো একটা দায়িত্ব ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি আহত, নিগৃহীত, অসম্মানিত একজন শিক্ষিকার ব্যাপারে তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা যখন ওই ঘটনার প্রতিবাদে 'মানববন্ধন' করেছিল, মৌন মিছিল করেছিল, আমি সেখানে উপাচার্যকে অংশ নিতে দেখিনি। নিদেনপক্ষে যে ছবি ছাপা হয়েছে সেখানে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য তাদের কারও ছবি আমি দেখিনি। এটা কি কোনো অপরাধ ছিল না? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক যখন হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন, যেখানে তার চিরদিনের জন্য দৃষ্টিহীন হয়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, সেখানে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনুপস্থিত। কেন? তারা তো হাজারটা 'প্রতিবাদী অনুষ্ঠানে' উপস্থিত থাকেন। রুমানার ঘটনায় তাদের প্রতিবাদটা কি আরও জোরালো হতে পারত না? শুনেছি অসুস্থ এবং প্রায় অন্ধ রুমানাকে যখন ঢাকা বিমানবন্দর থেকে চেন্নাই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেদিনও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কেউ যাননি। বিশেষ ব্যবস্থা করার জন্য বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকেও বলা হয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এটা কি শুধুই অবহেলা? মাননীয় রাষ্ট্রপতি বারবার শিক্ষার মানোন্নয়নের কথা বলেন। কিন্তু একজন শিক্ষিকা যেখানে নির্যাতনের শিকার হন, যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যায়, সেখানে শিক্ষকদের কাছ থেকে শিক্ষার মানোন্নয়ন আশা করি কীভাবে? আমাকে এ ঘটনা আরও পীড়া দেয়, যখন শুনি ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় (যেখানে রুমানা সর্বশেষ ছাত্রী ছিলেন। আছেন এখনও) রুমানার সব চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে নিজেরাই এগিয়ে এসেছে। শুধু তাই নয়, তারা রুমানার উচ্চশিক্ষার সব ব্যয়ভারও বহন করবে। কিন্তু যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন রুমানা, ছিলেন শিক্ষক, সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার দায় এড়িয়ে গেল! রুমানার উন্নত চিকিৎসা দরকার। দরকার প্রচুর অর্থের। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় যদি এগিয়ে আসত, আমি খুশি হতাম।


দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলা রুমানার এই ছবিটি কেবলই স্মৃতি
রুমানা আমার সহকর্মী। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশাল ভাণ্ডারে আমরা কাজ করি। আমি যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে যোগ দিতে পারতাম, তাহলে রুমানা আমার ছাত্রী হতে পারতেন। ওর অনেক বন্ধু কিংবা এক-দু'বছরের সিনিয়র আমার সহকর্মী। তাদের সবাইকে নিয়ে আমি গর্ব করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তরুণ শিক্ষকদের সবাই আমার প্রিয়। তারা সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল। সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক যখন নির্যাতনের শিকার হন, তখন এই দুঃখবোধ আমি রাখি কোথায়? একটি ঘটনা আরেকটি ঘটনার জন্ম দেয়। এর আগেও ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও একজন নারী শিক্ষক যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। যৌন নির্যাতনকারীকে আমরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারিনি। নারী নির্যাতন একটা অপরাধ। যারা অপরাধ করে, রাষ্ট্র যদি তাদের 'সুযোগ' করে দেয়, তাহলে অপরাধীর সংখ্যা এ দেশে বাড়বেই। আইন আছে। কিন্তু আইনের সঠিক প্রয়োগ হয় না। অনেক সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্লিপ্ততার সুযোগ নেয় অপরাধীরা। রুমানার নির্যাতনকারীর ক্ষেত্রেও এমনটি হতে যাচ্ছিল, যদি উচ্চ আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল ইস্যু না করতেন। আদালত রুল ইস্যু করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গ্রেফতার করা হয় 'স্বামী' নামের বর্বরটিকে। উচ্চ আদালতের ওই দুই বিচারপতিকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাদের ছোট করতে চাই না। কিন্তু উচ্চ আদালত ক'টি ঘটনায় এ ধরনের রুল ইস্যু করতে পেরেছেন? ক'টি ঘটনা আদালতের দৃষ্টিতে আসে? সংবাদপত্রে এ ধরনের 'স্ত্রী' নির্যাতনের খবর থাকে বটে, কিন্তু আদালতের দৃষ্টিতে সব আসে না। আর এটা উচ্চ আদালতের মুখ্য কাজও নয়। তবুও আদালতের এ ধরনের উদ্যোগে আমরা উৎসাহিত হই।

এ করুণ দৃশ্য কখনই বাংলাদেশে কাম্য নয়
'স্বামী' নামের ক্রিমিনাল সাইদ তার দোষ কিছুটা হলেও স্বীকার করেছে। আইন তার নিজ গতিতেই চলবে। হয়তো তার শাস্তিও হবে, কিন্তু এটাই কি শেষ? এ সমাজে একজন শিক্ষিকা যদি তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হন, তাহলে সমাজের অন্যদের নিরাপত্তা কে দেবে? ক্যাম্পাসগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। সেখানেও শিক্ষিকারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আর দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব ক্ষেত্রে 'রাজনৈতিক বিবেচনা' প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন নির্যাতনের ঘটনা, যেখানে শিক্ষিকারাও আক্রান্ত হচ্ছেন, উচ্চশিক্ষার পথে প্রধান অন্তরায়। সবাই আমরা যদি সচেতন না হই, যদি প্রতিবাদমুখর না হই, তাহলে ভয়াবহ আকারে তা ছড়িয়ে পড়বে সব ক্যাম্পাসে। তাই আসুন, সবাই মিলে যৌন নির্যাতনকারীকে আমরা ঘৃণা করি।

রুমানা মঞ্জুর এখনও বিপদমুক্ত নন। চেন্নাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে এক মাস পর আবার যেতে বলেছে। রুমানার ভালো চিকিৎসা দরকার এবং তা বিদেশে। রুমানাকে বলি, আপনি ভেঙে পড়বেন না। আপনার বিভাগের আপনার শিক্ষক, আপনার ছাত্ররা যেমনি আপনার পাশে আছে, আমরাও আছি আপনার পাশে। এই সমাজের দুষ্ট কীটদের বিরুদ্ধে আপনাকে দাঁড়াতে হবে। আপনাকে হতে হবে প্রতিবাদী। দেশবাসীকে দেখাতে হবে আপনিও পারেন। আপনি ভেঙে পড়বেন না, প্লিজ। আমি জানি আপনার ওপর দিয়ে যে 'ঝড়' বয়ে গেছে, সেই ঝড়ে টিকে থাকা কঠিন। কিন্তু টিকে আপনাকে থাকতেই হবে। তা যে শুধু আপনার কন্যা অনুসূয়া, শুধু ওর জন্যই নয়, বরং এ দেশের নারী সমাজের জন্য, প্রতিবাদের 'প্রতীক' হয়ে থাকার জন্য। একজন বর্বর ক্রিমিনাল সাইদের 'হত্যা প্রচেষ্টায়' প্রতিবাদী হয়ে আপনি সাংবাদিকদের আপনার কথা জানিয়েছেন। আমি আপনার এ সাহসী উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। সাধারণত আমাদের সমাজের মেয়েরা এসব ঘটনা চেপে যান। মান-সম্মানের ভয়ে তারা কথা বলেন না। আপনি বলেছেন। আপনার এ 'সাহস' আমাদের সবাইকে আলোকিত করুক। আরও একটা কথা। নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১ নিয়ে তো অনেক কথাই হলো। একটি হরতালও হয়ে গেল। একজন রুমানা মঞ্জুর যখন আহত হন, যখন তার জীবন বিপন্ন, তখন নারী নীতিমালা-২০১১ কী কথা বলে? আমরা তো CEDAW-এর কথাও শুনেছিলাম। জাতিসংঘে ১৯৮১ সালে গৃহীত CEDAW সনদ বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালে অনুসমর্থন করে (চারটি ধারা)। এটা ছিল নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আইনের সংশোধন। কিন্তু CEDAW সনদ বাংলাদেশের রুমানা মঞ্জুরকেও তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাহায্য করেনি। যদিও বৈষম্যের কথা বলা হয়েছে, নিরাপত্তার কথা বলা হয়নি। কিন্তু নারী যখন আক্রান্ত হয়, তখন বৈষম্যের প্রশ্ন ওঠে বৈকি! আমাদের সংবিধানে (২৮-২) নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। আমি নারীকে সেভাবেই দেখি। তাই একজন রুমানা মঞ্জুর যখন নির্যাতনের শিকার হন, তখন একটা লজ্জা, দুঃখবোধ আমাকে তাড়িত করে। আমি সত্যিই দুঃখিত রুমানা।
প্রফেসর ড. তারেক শামসুর রেহমান : শিক্ষক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
[সূত্রঃ সমকাল, ২১/০৬/১১]

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিতর্ক ও বেগম জিয়ার প্রস্তাব

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিতর্ক ও বেগম জিয়ার প্রস্তাব

ড. তারেক শামসুর রেহমান
বেগম খালেদা জিয়া গত ১৬ জুন সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়ে দিয়েছেন শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখা হলে সরকারের সঙ্গে ভবিষ্যত্ প্রধান উপদেষ্টা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। গত ৫ জুন এবং ১২ ও ১৩ জুন লাগাতার হরতালের পর বেগম জিয়ার এই অবস্থান পরিষ্কার ও স্পষ্ট। যে ইস্যুতে বিএনপি তথা চার দল হরতাল পালন করেছিল, সেই ইস্যুটিকেই যে বেগম জিয়া প্রাধান্য দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। বেগম জিয়া জানিয়ে দিলেন তিনি ও তার দল নির্বাচনে যাবে, যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকে। এ ব্যাপারে তার দল সরকারের সঙ্গে আলোচনায় যেতেও রাজি। ‘বল’টি তিনি এখন ঠেলে দিলেন সরকারের কোর্টে। সরকারকেই এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখবে কী রাখবে না।
আমরা বার বার বলে আসছি একদলীয়ভাবে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সেই সিদ্ধান্তের পেছনে জনগণের কোনো সম্মতি থাকবে না। সরকার দেয়ালের লিখন থেকে কিছুই শিখছে না। এই আওয়ামী লীগই ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। শেখ হাসিনা নিজেও স্বীকার করেছেন তিনি হচ্ছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার উদ্ভাবক। এ ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে আওয়ামী লীগ অতীতে দেশে হরতাল পর্যন্ত করেছিল। ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। কৈ সেদিন তো আওয়ামী লীগ এই ব্যবস্থা বাতিলের দাবি জানায়নি? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামোয় ১৯৯৬ সালেই আওয়ামী লীগ সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার পর্যন্ত গঠন করেছিল। সেদিন এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন শেখ হাসিনা। তারপর পর্যায়ক্রমে অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদের নির্বাচনও সম্পন্ন হয়, তাও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আওতায়। কোনোদিনই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেননি শেখ হাসিনা। সরকার গঠনের এক বছরের মাথায় সরকার যখন একের পর এক সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হচ্ছিল, তখনই এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে না রাখার দাবি উঠতে থাকে। শেখ হাসিনাই প্রথম প্রসঙ্গটির অবতারণা করেন। তারপর আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা তার প্রতিধ্বনি করতে থাকেন। সরকারের আড়াই বছরের মাথায় এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে সরকার আর সংবিধানে এই ব্যবস্থাটি রাখতে চাইছে না। এরপর এলো উচ্চ আদালতের রায়টি। উচ্চ আদালতের রায়ে বলা হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে ভাবীসাপেক্ষে বাতিল ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হলো। রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে এই ব্যবস্থা আরও দুই মেয়াদে বহাল থাকার পর। এটি রায়ের পরবর্তী অংশে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে জনগণ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই যেহেতু সর্বোচ্চ আইন, সে কারণে প্রয়োজনের নিরিখে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনেই অনুষ্ঠিত হতে পারবে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি কিংবা আপিল বিভাগের বিচারপতিরা নিযুক্ত হতে পারবেন কিনা, সে বিষয়ে স্বাধীনভাবে জাতীয় সংসদ সিদ্ধান্ত নিতে পারবে বলে রায়ে অভিমত দেয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উচ্চ আদালতের রায় যদি মানতেই হয় তাহলে তো পুরোটাই মানতে হবে। সংবিধান সংশোধনের জন্য যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সেই কমিটি তাহলে উচ্চ আদালতের রায়ের একটি অংশ গ্রহণ করল কেন? পুরোটা গ্রহণ করে সুপারিশ দিলে তো এই প্রশ্নটি আজ উঠত না। বিরোধী দলের পক্ষ থেকেও বলার কিছু থাকত না। আজ যখন বেগম জিয়া পুরো রায়ের কথা বলছেন, তার যুক্তি তো ফেলে দেয়ার নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আমাদের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করেছে। এটাকে বাদ দেয়া যাবে না। তবে অবশ্যই আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় সংস্কার চাই। বিশেষ করে ৫৮(গ)(৩) ধারায় পরিবর্তন আনতে হবে। এই ধারায় সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করার বিধান রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে উচ্চ আদালতে ‘রাজনীতি’ ঢুকে গেছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে তিনি নিজেকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে পারেননি। তার একাধিক রায় নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে ১০ লাখ টাকা গ্রহণের যে সংবাদ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, তার ব্যাখ্যা তিনি দেননি। স্বাভাবিক কারণেই এ নিয়ে জনগণের মধ্যে প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। অতীতে কোনো প্রধান বিচারপতি এভাবে বিতর্কিত হননি। অনেক প্রধান বিচারপতি অবসর গ্রহণের পরও তাদের মেধা দিয়ে জাতিকে সেবা করে যাচ্ছেন। জাতিকে পথ দেখাচ্ছেন। কিন্তু বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক নিজেকেই শুধু বিতর্কিত করলেন না, বরং বিচারপতিদের জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করালেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের উদ্ধৃতি আমি কী দেব? যেখানে তিনি নিজে আইনজীবীদের কাছেই গ্রহণযোগ্য হলেন না সেখানে আমজনতার কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন কীভাবে? তার কুশপুত্তলিকা তো আইনজীবীরাই দাহ করেছিলেন।
অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় তিনি দিয়েছেন। পঞ্চম সংশোধনী, সপ্তম সংশোধনী কিংবা ত্রয়োদশ সংশোধনী—সংবিধানের এসব সংশোধনী বাতিল হয়েছে উচ্চ আদালতের রায়ে। তার নেতৃত্বে উচ্চ আদালত রায় দিয়েছে। রায় নিয়ে মন্তব্য করা যাবে না। তাতে করে আদালত অবমাননা হয়ে যেতে পারে। আমি একজন সাধারণ শিক্ষক। আমি ঝুঁকি নিতে পারি না। ওই তিনটি রায় নিয়ে নানা মন্তব্য, নানা কথা পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। মুন সিনেমা হল নিয়ে মামলা হয়েছিল। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক রায় দিলেন পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের। বিচারপতি মুন সিনেমা হলের মালিকানার সঙ্গে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর কী সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছিলেন, আমি বলতে পারব না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মুন সিনেমা হলের আদি মালিক তার সিনেমা হল আর ফেরত পাননি। কিন্তু এরই মধ্যে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হয়ে গেছে। ত্রয়োদশ সংশোধনীও বাতিল হলো। অর্থাত্ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হলো। আবার একই রায়ে বলা হলো আগামী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। এটা কি পরস্পরবিরোধী নয়? যদি বাতিল হয়, সব সময়ের জন্যই বাতিল। পরের দুটি কেন তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে? এটা কি এজন্য যে বিচারপতি খায়রুল হকের নিজেরই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার ইচ্ছে ছিল তাই? সংবিধান তো তা-ই বলে। সংবিধানের ৫৮(খ), এবং বিশেষ করে ৫৮(গ)(৩) ধারায় যদি পরিবর্তন আনা না হয়, তাহলে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকই হবেন পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান। একজন বিতর্কিত লোক প্রধান উপদেষ্টা হবেন, সেটা নিশ্চয়ই কারও কাম্য নয়।
যিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসরে গেছেন, তার তো চাওয়ার কিছু থাকতে পারে না। রাষ্ট্র তাকে তো অনেক দিয়েছে। সাধারণ নিয়মে তার প্রধান বিচারপতি হওয়ার কথা ছিল না। তিনি দু-দু’বার ‘সুপারসিডেড’ হয়ে প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। সর্বশেষ ঘটনায় বিচারপতি শাহ মোহাম্মদ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান পদত্যাগ পর্যন্ত করেছিলেন। বিচারপতি শাহ আবু নাঈমের পদত্যাগের ঘটনাও বিচার বিভাগের জন্য কলঙ্ক। উচ্চ আদালতের রায় অনুসরণ করে সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করতে পারত। এক্ষেত্রে শাহ মোহাম্মদ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানকে প্রধান বিচারপতি করা হলে, তাতে ক্ষতির কিছু ছিল না। তিনিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারতেন না। যারা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ বিশ্বাস করেন, তারা তো ‘ষড়যন্ত্র’ খুঁজবেনই। আমি আরও খুশি হতাম যদি বিচারপতি খায়রুল হক অবসরে যাওয়ার আগের দিন যখন সাংবাদিকদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন, তখন যদি তিনি ঘোষণা করতেন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন না, তাহলে তিনি সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা বলেননি। বলেছেন ভবিষ্যত্ই নির্ধারণ করবে সবকিছু। এটা ‘ডিপ্লোম্যাটিক এনসার’। জবাব এড়িয়ে যাওয়া। তার এই জবাবই বলে দেয় তার কিছুটা হলেও ওই পদটির ব্যাপারে আগ্রহ রয়েছে। এটা আমাকে অবাক করেছে। একজন বিচারপতি তো সব লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থাকেন। এই রাষ্ট্র তো বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে অনেক কিছু দিয়েছে। তিনি কোনোদিনই প্রধান বিচারপতি হতে পারতেন না। কিন্তু হয়েছেন। তাকে নিয়ে এত যখন বিতর্ক, তখন তার বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দেয়া উচিত, তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন না। যেমনটি করেছিলেন বিচারপতি কেএম হাসান। তবে সময় এখনও আছে। তিনি তা করতে পারেন।
আরও একটি বিষয়ে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমি কষ্ট পেয়েছি। তা হচ্ছে তার স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার। বিচারপতি খায়রুল হক আপিল বিভাগে আইনজীবীদের এনরোলমেন্ট নিয়ে লাগামহীন অনিয়ম আর স্বজনপ্রীতি করেছেন। কিছু মুখচেনা আর রাজনৈতিক আদর্শগতভাবে একই ঘরানার লোকদের এনরোলমেন্ট করে গেছেন তিনি। এর ফলে হাইকোর্ট বিভাগের অনেক যোগ্য আইনজীবীও আপিল বিভাগে অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে বাদ পড়েছেন। এটা করা কি তার ঠিক হয়েছে? তিনি কেন রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে উঠতে পারলেন না? এখন কেউ যদি তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়, তাহলে কি তিনি ভুল করবেন? বিচারপতিরা আমাদের নমস্য। তারা যদি কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শে অনুপ্রাণিত কিংবা প্রভাবিত হন, তাহলে তা জাতির জন্য খারাপ। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক সুন্দরবনে ‘প্রমোদ ভ্রমণে’ গিয়েছিলেন। তিনি সুন্দরবনে যেতেই পারেন। একজন নাগরিক হিসেবে এ অধিকার তার আছে। কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি কীভাবে সুন্দরবন ভ্রমণে গেছেন, তা আমাদের জানিয়ে দিয়েছে একটি জাতীয় সংবাদপত্রের প্রতিবেদন। তিনি তো অতীতে অনেককে ‘শাস্তি’ দিয়েছেন। বিচারপতিদের হাত অনেক লম্বা। তারা যখন এজলাসে থাকেন, তখন কথা বলা যায় না, প্রশ্ন তোলা যায় না, তাতে আদালত অবমাননা হয়। এখন তিনি অবসরে। এখন সাহস করে বলা যায়। সত্য উত্ঘাটিত হোক। তিনি যদি অন্যায় করে থাকেন, তারও ‘বিচার’ হওয়া উচিত। তিনি যদি সত্যিসত্যিই ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকেন, প্রমোদ ভ্রমণের নামে সরকারি অর্থের অপচয় করে থাকেন, নিয়ম ও ট্র্যাডিশন ভঙ্গ করে তিনি যদি প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ১০ লাখ টাকা গ্রহণ করে থাকেন, তাহলে আমজনতার মতো তাকেও বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। আজ তাই একটি সংবাদপত্র যখন তাদের প্রতিবেদনে বলে ‘সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে গেছেন খায়রুল হক’ (যুগান্তর ১৮ মে), তখন বেগম জিয়ার মন্তব্যকে অবশ্যই আমাদের সমর্থন করতে হবে। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অযোগ্য। তাকে রেখে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। এক্ষেত্রে সংবিধানের ৫৮গ(৪) ধারা আমরা অনুসরণ করতে পারি। মোট কথা, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য চাই একটি গ্রহণযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সরকার যদি এটা করতে না চায়, যদি এককভাবে সংসদে ৫১ দফা সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করে, তাহলে দেশে সংঘাত দেখা দিতে বাধ্য। আমরা আশা করব সরকার দূরদর্শিতার পরিচয় দেবে। সংসদে যাওয়ারও প্রয়োজন নেই। বেগম জিয়ার বক্তব্য পত্রপত্রিকায় গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়েছে। এটাকে বিবেচনায় নিয়ে সরকার সংসদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারে। আমার বিশ্বাস বিএনপি তথা চার দলের সংসদ সদস্যরা তখন সংসদে আলোচনায় অংশ নেবেন। দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য এটা মঙ্গল। রাজনীতিতে জেদাজেদির কোনো বিষয় নেই। রাজনীতি হচ্ছে ‘অ্যান আর্ট অব কমপ্রোমাইজ’। পরস্পরের প্রতি আস্থা, বিশ্বাস রেখেই রাজনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করা যায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

রাজনীতিতে অশনি সংকেত

ড. তারেক শামসুর রেহমান


গত ৫ জুন চারদলীয় জোটের উদ্যোগে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করার পর বিএনপি ও জামায়াত আবারো ৩৬ ঘণ্টার টানা হরতাল পালন করলো। গত সোমবার সন্ধ্যায় হরতাল শেষ হওয়ার পর যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে এরপর কী? পরপর দু'সপ্তাহে দুটি হরতালের পরও সরকার যে একটু নমনীয় হবে, তার কোনো লক্ষণ নেই। এ ধরনের হরতালে সরকারের পতন হয় না। এটা আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের বলেছেন বটে; কিন্তু এটা বিএনপির নেতৃবৃন্দ যে জানেন না, তাও নয়। তারা জানেন; কিন্তু রাজনীতির স্বার্থেই তাদের হরতাল দিতে হয়। অতীতে আওয়ামী লীগও দিয়েছিল। আগামীতে, দশম সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ যদি বিরোধী দলে যায়, তাহলেও হরতাল হবে। এই হরতালের সংস্কৃতি থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারিনি। আগামীতেও পারবো না। তাহলে করণীয় কী? দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভালো তা বলা যাবে না। প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে কথা বলা হয়েছে, তা কতটুকু সঠিক, তা আগামী দিনেই বলা যাবে। এক ধরনের স্থবিরতা আছে অর্থনীতিতে। বিদ্যুৎ সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে। গত দু'বছরে মাত্র একটি কারখানায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। গ্যাস ফুরিয়ে আসছে। নতুন গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কারের কথাও আমরা শুনছি না। তবে শুনতে পাচ্ছি গ্যাসের রিজার্ভ বেড়েছে। তাতে করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়েনি। বিদ্যুৎ অর্থনীতির প্রাণ। চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু সাপ্লাই নেই। বেকার সমস্যা বাড়ছে। অর্থমন্ত্রী বেকার সংখ্যার যে পরিসংখ্যান দিয়েছেন, তার সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই। বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। ব্যর্থ বাণিজ্যমন্ত্রী তার ব্যর্থতা নিয়ে এখনো কেবিনেটে আছেন। প্রতিদিনই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ছে। রমজানে এই দাম কোথায় গিয়ে ঠেকবে আল্লাহমালুম। এমনি এক পরিস্থিতিতে হরতালের পর হরতাল হচ্ছে। এতে করে পরিস্থিতির যে আরো অবনতি হবে, তা বলাই বাহুল্য।
এই হরতালের প্রেক্ষাপট হচ্ছে জাতীয় কমিটি কর্তৃক সংসদে দাখিলকৃত ৫১ দফা সংবিধান সংশোধনী, যার মাঝে একটি হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, যা এখন পর্যন্ত সংবিধানের একটি অংশ। এটি বাতিলের সুপারিশ করেছে জাতীয় কমিটি। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের সুপারিশই চূড়ান্ত নয়। নিয়ম অনুযায়ী উক্ত রিপোর্ট নিয়ে সংসদীয় পার্টিতে আলোচনা হবে, মন্ত্রিসভায় নীতিগত সিদ্ধান্ত হবে, বিল তৈরি হবে, আইন মন্ত্রণালয়ের ভোটিংয়ের মধ্য দিয়ে টেকনিক্যালিটি যাচাই হবে, আবার মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর সংসদে বিল আকারে তুলতে হবে। এরপর সংসদে আইন আকারে পাস করার আগে আবার কমিটিতে যাবে। সেখান থেকে রিপোর্ট পাওয়ার পর সংসদে ভোটের মাধ্যমে পাস হবে। পথটা দীর্ঘ। পাস হতেও সময় লাগে। সুতরাং তড়িঘড়ি করে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। বিএনপি ও চারদলীয় জোট হরতাল আহ্বান করে তাদের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে। সরকারি দল এটাকে বিবেচনায় নিতে পারে। এককভাবে যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়, তাহলে সেটা হবে ভুল।
রাজনীতিতে সহনশীলতা থাকতে হয়। বিরোধী দলের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে হয়। এর নামই গণতন্ত্র। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় বটে এবং তা সাংবিধানিকভাবে বৈধও বটে; কিন্তু তা গণতান্ত্রিক স্পিরিটের পরিপন্থী। গণতান্ত্রিক স্পিরিট হচ্ছে বিরোধী দলের মতামত নেয়া এবং বিরোধী দলের মতামতের ভিত্তিতেই আইন প্রণয়ন করা। এটি না হলে এ দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র বিকশিত হবে না এবং অসাংবিধানিক শক্তিগুলো এ থেকে ফয়দা লুটবে। জাতীয় কমিটি তত্ত্বাধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার পক্ষে মত দিয়েছে, তারপরও সুযোগ রয়েছে বিকল্প একটি প্রস্তাব সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার। যেমন, সংসদ সিদ্ধান্ত নিতে পারে আাগমী দশম ও এগারোতম জাতীয় সংসদ একটি নির্দলীয় সরকারের (তত্ত্বাবধায়ক কথাটা ব্যবহার না করাই শ্রেয়) অধীনে অনুষ্ঠিত হবে। একটি তিন সদস্যবিশিষ্ট 'এলডার্স কাউন্সিল' এই নির্বাচন পরিচালনা করবেন। এই 'এলডার্স কাউন্সিল' গঠিত হবে সাবেক একজন প্রধান বিচারপতি, একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও একজন সুশীল সমাজের প্রতিনিধির সমন্বয়ে। বিরোধী দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে এই 'এলডার্স কাউন্সিল' গঠন করা হবে। এরা ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করবেন এবং কোনো নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। তাদের সহযোগিতা করার জন্য একটি উপদেষ্টা ম-লী থাকতে পারে। রাষ্ট্রপতি তার পদে বহাল থাকবেন; কিন্তু তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। এই কাউন্সিল নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে পারবেন। সেনাবাহিনীর সহযোগিতাও তারা নিতে পারবেন। কোনো অবস্থাতেই সদ্য অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতিকে কোনো প্রক্রিয়ায় জড়িত করানো যাবে না। দ্বাদশ পার্লামেন্ট নির্বাচন আয়োজন করবে নির্বাচন কমিশন। এ জন্য সিইসি কিংবা নির্বাচন কমিশনারদের নিযুক্তিতে নিরপেক্ষতা যাতে নিশ্চিত হয়, সে ব্যাপারে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের দেশের আমলাদের মাঝে (সামরিক ও বেসামরিক) 'রাজনীতি' করার একটা প্রবণতার জন্ম হয়েছে। চাকরি জীবনের শেষের দিনগুলোতে তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং অবসরে যাওয়ার পর পরই তারা এক একজন 'রাজনীতিবিদ' হয়ে যান। তাদের টার্গেট থাকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়া। এই প্রবণতা খারাপ।
যাদের সঙ্গে এলাকার জনগণের কোনো যোগাযোগ নেই, এলাকার জনগণের দুঃখ-কষ্টের ভাগিদার যারা হননি, তারা হঠাৎ করে এমপি হয়ে যান। তারা সঠিক অর্থে জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন না। এ জন্য আমলাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ নূ্যনতম ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করতে হবে। ফলে তারা সচিবালয়ে বসে কোনো বিশেষ দলের পক্ষে কলকাঠি নাড়াতে পারবেন না। তারা যদি বুঝতে পারেন অবসরের সঙ্গে সঙ্গেই তারা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না, তাহলে তারা নিরপেক্ষ থেকেই প্রশাসন পরিচালনা করবেন। সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলকে আরো শক্তিশালী করা যেতে পারে। প্রয়োজনে তাদের কর্ম পরিধিও আরো বাড়ানো যেতে পারে। সাংবিধানিক পদে যারা নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন, তাদের নিয়োগের দায়িত্বটি সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের হাতে ছেড়ে দেয়া যেতে পারে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল একটাই কারণে_ আর তা হচ্ছে নিরপেক্ষ নির্বাচন। দলীয় সরকারের অধীনে যে নির্বাচন হয়, সেই নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে। অতীতে বারবার এমনটি হয়েছে। 'মাগুরা সিনড্রম' আমরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পেরেছি বলে মনে হয় না। বর্তমান সরকারের সময় ভোলায় যে উপনির্বাচন হয়ে গেল (২৪ এপ্রিল ২০১০), তাতে সরকারি দলের ভোটকেন্দ্র দখল, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেয়া, সন্ত্রাস, ইত্যাদি নানা কারণে উপনির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের যতটুকু না ভূমিকা ছিল, তার চাইতে বেশি ভূমিকা ছিল স্থানীয় নেতৃত্বের। স্থানীয় নেতৃত্ব এটাকে 'প্রেসটিজ ইস্যু' হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছিল। ফলে তাদের এভাবে স্থানীয় প্রশাসন ছিল অসহায়। এটাই হচ্ছে মূল সমস্যা। আমরা গণতন্ত্রকে ধারণ করলেও, আমাদের মানসিকতায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। গণতন্ত্রকে আমরা আমাদের নিজেদের মতো করে দেখতে চাই। যে কারণে মাগুরা কিংবা ভোলার মতো ঘটনা ঘটে। এই বৃত্ত আমরা ভাঙতে পারিনি। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো একটি নিরপেক্ষ সরকার দরকার, যারা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবে। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হলে, এটা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। এ ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক নাম ব্যবহার না করেও, বিকল্প একটি নাম ব্যবহার করে সরকারই পারে তাদের সৎ উদ্দেশ্য জাতির সম্মুখে উপস্থাপন করতে। না হলে সরকারের উদ্দেশ্য প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
ধারণা করছি এই হরতালই শেষ নয়। আরো হরতাল আসবে। আরো বড় কর্মসূচি গ্রহণ করবে বিএনপি তথা চারদল। ইসলামিক দলগুলোও তাদের সঙ্গে থাকবে। ফলে সৃষ্টি হবে নানা সংকটের। সরকার তো অভিভাবক। জনগণের ভোটে তারা নির্বাচিত হয়েছেন সত্য; কিন্তু তাদেরও সহনীয় হতে হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ একটি সংলাপ আহ্বান করতে পারে। স্পিকার মধ্যস্থতা করতে পারেন। ওই সংলাপে বিএনপি বিকল্প প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারে। পৃথিবীর অনেক বড় বড় সমস্যা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশে এটা সম্ভব হবে না, এটা আমি বিশ্বাস করি না। শুধু প্রয়োজন আন্তরিকতার। রাজনীতি হচ্ছে একটি প্রক্রিয়া, যেখানে সব সময় কমপ্রোমাইজ' করে চলতে হয়। আজ সরকার যদি বিএনপির ডাকে সারা দেয়, তাতে ক্ষতি কী? জাতীয় কমিটিও বলতে পারে তারা দশম ও এগারোতম সংসদ নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার স্বার্থে বিএনপির সঙ্গে কথা বলবে। এর মধ্য দিয়ে বরফ গলতে পারে। এতে কারোরই ক্ষতি নেই। বরং জাতি একটি মহা দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাবে। হ
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবিধান সংশোধন নিয়ে সঙ্ঘাত কাম্য নয়

সংবিধান সংশোধন নিয়ে সঙ্ঘাত কাম্য নয়
সংবিধান কোনো ব্যক্তি বা দলের স্বার্থে পরিবর্তন হতে পারে না। উচ্চ আদালতে একাধিক রায়ের ফলে সংবিধান সংশোধন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। সমসাময়িক কালে উচ্চ আদালতের তিনটি রায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চ আদালত সংবিধানের পঞ্চম, সপ্তম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করেছে। এর ফলে আদালতের দৃষ্টিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেমনি অবৈধ, ঠিক তেমনি ১৯৭৫ সালে ও ১৯৮২ সালে জারিকৃত সামরিক শাসনের সময় রাষ্ট্রের কর্মকা- পরিচালনার জন্য যেসব আদেশ/ফরমান জারি করাও অবৈধ বলে ঘোষিত হয়েছিল। সঙ্গত কারণেই তাই আদালতের রায়কে অনুসরণ করে সংবিধান সংশোধন করতে হবে।ড. তারেক শামসুর রেহমান সংবিধান সংশোধন নিয়ে বিশেষ কমিটির ৫১ দফা সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপনের পর যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে সরকার কি শেষ পর্যন্ত এককভাবে এসব সংশোধনী সংসদে পাস করিয়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত করবে? এর ফলে কি সঙ্ঘাত আরো বাড়বে না? তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি তথা চারদল হরতাল পালন করেছিল গত ৫ জুন। এখন ১২ ও ১৩ জুন লাগাতার ৩৬ ঘণ্টা হরতাল হলো। সংবিধান সংশোধনী নিয়ে দেশ তাহলে কোন দিকে যাচ্ছে? এমনিতেই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভালো নয়। মুদ্রাস্ফীতি দুই অঙ্কের কোটা অতিক্রম করেছে। রেমিট্যান্সের প্রবাহ হ্রাস পেয়েছে। খাদ্যদ্রব্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করা সম্ভব হয়নি। সামনে রমজান। মানুষ আছে আতঙ্কে। সুশাসন নিয়েও কথা আছে। এই যখন পরিস্থিতি তখন সংবিধান সংশোধন নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা জটিলতা।
সংবিধান কোনো ব্যক্তি বা দলের স্বার্থে পরিবর্তন হতে পারে না। উচ্চ আদালতে একাধিক রায়ের ফলে সংবিধান সংশোধন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। সমসাময়িক কালে উচ্চ আদালতের তিনটি রায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চ আদালত সংবিধানের পঞ্চম, সপ্তম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করেছে। এর ফলে আদালতের দৃষ্টিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেমনি অবৈধ, ঠিক তেমনি ১৯৭৫ সালে ও ১৯৮২ সালে জারিকৃত সামরিক শাসনের সময় রাষ্ট্রের কর্মকা- পরিচালনার জন্য যেসব আদেশ/ফরমান জারি করাও অবৈধ বলে ঘোষিত হয়েছিল। সঙ্গত কারণেই তাই আদালতের রায়কে অনুসরণ করে সংবিধান সংশোধন করতে হবে।
সরকার একটি কমিটিও গঠন করে দিয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ওই কমিটিতে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব থাকলেও, তারা দীর্ঘ ২৭টি বৈঠকের একটিওতে অংশগ্রহণ করেনি। তবে বিএনপি নেতাদের বক্তৃতায় সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে তাদের কিছু মতামত পাওয়া গেছে। যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার প্রশ্নে তারা মতামত দিয়েছেন। কিন্তু বিশেষ কমিটির তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করার প্রস্তাব করেছে। এই দুই পরস্পরবিরোধী মতামত জাতিকে আরো সঙ্ঘাতের দিকে ঠেলে দিতে পারে। যদিও বিশেষ কমিটির চেয়ারম্যান এবং প্রধানমন্ত্রী নিজেও বিএনপিকে সংসদে এসে প্রস্তাব উত্থাপন করার আহ্বান জানিয়েছেন। বিএনপি এ কাজটি করতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সরকার বিএনপির একটি প্রস্তাব গ্রহণ করতে নাও পারে। সেখানেই বিএনপির সার্থকতা। তারা জাতিকে জানাতে পারবে সরকার তাদের একটি প্রস্তাবও গ্রহণ করেনি। তবে একটা সমঝোতা প্রয়োজন। প্রয়োজন নূ্যনতম ঐকমত্য। যেসব প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে যার জবাব খোঁজা অত্যন্ত জরুরি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে। যুক্ত হচ্ছে উচ্চ আদালতের একটি রায়। কিন্তু রায়ে এ কথাটাও বলা হয়েছিল যে আরো দুটো টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। সুপারিশে এটি নেই। তাই সঙ্গত কারণেই সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। সরকার ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়_ এই অভিযোগ কাটিয়ে ওঠা এখন কঠিন হবে। সংবিধানে মাত্র দু'টার্মের জন্য এই ব্যবস্থা থাকবে, এ ধরনের বিধান রাখা যায় না। এমনকি মূল সংবিধানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যেভাবে আছে, সেটাও রাখা যাবে না। কেননা তাতে করে সংবিধান ৫৮ গ (৩) ধারা মতে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার কথা, যাতে বিএনপির রায়ের প্রবল আপত্তি। তাই সংবিধানে নয়, বরং সাংসদ একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন একটি দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে। এই 'দল নিরপেক্ষ' এর ব্যাখ্যাও সাংসদকে দিতে হবে। সংসদ একটি 'এলডার্স কাউন্সিলের' এ প্রস্তাব করতে পারে, যেখানে চারজনের একটি টিম (দু'জন আওয়ামী লীগের দু'জন বিএনপির মনোনীত নিরপেক্ষ ব্যক্তি) নির্বাচন পরিচালনা করবেন। এখানে কেউ এককভাবে 'প্রধান উপদেষ্টার' দায়িত্ব পালন করবেন না। বিকল্প হিসেবে তিনজন 'সিনিয়র সিটিজেন' (একজন প্রবীণ প্রদান বিচারপতি, একজন শিক্ষাবিদ, একজন সুশীল অথবা ব্যবসায়িক সমাজের প্রতিনিধি) নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বটি পালন করতে পারেন।
সংসদ যদি এ ধরনের একটি ফর্মুলা উপস্থাপন করে, তাহলে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষমতা ধরে রাখার যে অভিযোগ, সেই অভিযোগ থেকে সরকার নিষ্কৃতি পাবে। তখন সরকারের বিরুদ্ধে বলার কিছু থাকবে না। প্রধানমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প হিসেবে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করার কথা বলেছে। এটাও গ্রহণযোগ্য হবে না। কেননা আগামী মাসেই সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। সরকারকে এ পদে নতুনদের নিয়োগ দিতে হবে। এখন সরকার যাদেরকেই নিয়োগ দিক, তাদের নিয়ে বিতর্ক উঠবে। তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা খুঁজে বের করা হবে। আর এটা তো ঠিক সামরিক ও বেসামরিক আমলারা তাদের অবসরের আগেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একটি সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং দল ক্ষমতায় গেলেই তারা সরকারের একটা 'পদ বাগিয়ে নেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছে যে এখানে 'নিরপেক্ষ' ব্যক্তি এখন খুঁজে পাওয়া ভার। 'জনতার মঞ্চ' করে আমরা সচিবালয়ের আমলাদের রাজনীতিতে টেনে এনেছিলাম। 'প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী' হিসেবে যে তত্ত্বই হাজির করা হোক না কেন, বাস্ততা হচ্ছে সচিবালয়ের আমলারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে গেছেন। কেউ এখন বিএনপির আমলা, কেউ আওয়ামী লীগের। কেউবা আবার কবিতা লিখে নেতানেত্রীর গুণগান করে তার ভবিষ্যৎ পথ পরিষ্কার করে রাখছেন। সুতরাং সরকার এখন যাদেরকেই এ পদে নিয়োগ দেবে, তাদের নিয়ে বিতর্ক হবে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের সময় একটি বড় ভূমিকা পালন করে। তাদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা জরুরি। সুতরাং এ ধরনের সাংবিধানিক পদে নিযুক্ত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ন্যায় একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করা যায়। প্রয়োজনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কর্ম পরিধির মধ্যও এই বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যায়। বিশেষ কমিটি যখন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাখার পক্ষে অভিমত দিয়েছে, ঠিক তখনই অষ্টম সংশোধনী অর্থাৎ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম কেন সংবিধান পরিপন্থী নয়, সে ব্যাপারে হাইকোর্ট একটি কারণ দর্শাও নোটিস জারি করেছেন। এখন হাইকোর্ট যদি একটি রায় দেন, তাহলে তা সংসদ সদস্যদের একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দিতে পারে। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সংসদ সদস্যরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। তাতে করে হাইকোর্ট অবমাননার প্রশ্ন উঠতে পারে। উপরন্তু সুপারিশমালায় রয়েছে ১৯৭২ সালের সংবিধানের চার মূলনীতিতে ফিরে যাওয়া, যেখানে বলা হয়েছে ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা। এই ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম পরস্পর বিরোধী। এমনকি সংবিধানের ২৫(২) ধারায় যেখানে বলা হয়েছে 'রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন' _ সংবিধানের এই অংশটুকু নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। পঞ্চম সংশোধনীতে সংবিধানে এটি সংযোজন করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে এই অংশটুকু ছিল না। বিশেষ কমিটি অবশ্যি এ ব্যাপারে কোনো সুপারিশ করেনি। পঞ্চম সংশোধনী এখন উচ্চ আদালত কর্তৃক বাতিল হয়ে যাওয়ায়, যে কেউ এখন সংবিধানের ২৫(২) ধারা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। সুপারিশে বলা হয়েছে বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে 'বাঙালি' এবং নাগরিক হিসেবে 'বাংলাদেশি' হিসেবে পরিচিত হবেন। এটা কি নতুন করে আবারো বিতর্ক সৃষ্টি করবে না? পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী ১৩টি নৃগোষ্ঠী কি নিজেদের 'বাঙালি' ভাববে? এই বিতর্ক তো বেশ পুরনো। এই বিতর্কের সূত্র ধরেই এক সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিল। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমারা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘ অসন্তোষের অবসান হয়েছিল আওয়ামী লীগের সময়েই ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অসন্তোষের একটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে একটি অংশ বেরিয়ে গিয়ে গঠন করেছে ইউপিডিএফ, যারা অধিক স্বায়ত্তশাসন চায়। পাহাড়িদের বাঙালি বলা যাবে না। তারা বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে এবং জাতি হিসেবেও। অসাংবিধানিক শক্তির ক্ষমতা গ্রহণ, কিংবা সংরক্ষিত নারী আসন নিয়েও কথা আছে।
সরকার এককভাবে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তা বিতর্কের মাত্রা বাড়াবে। অভিযোগ উঠেছে বিশেষ কমিটি এর আগে দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, প্রধান বিচারপতি, আইনজ্ঞ কিংবা সুশীল সমাজের যাদের সঙ্গেই কথা বলেছেন, তাদের কারো মতামতই গ্রহণ করা হয়নি। পত্রিকায় প্রকাশিত এই অভিযোগ যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে তা সত্যিই দুঃখজনক। প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে কি সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা লোক দেখানো ছিল? বিশেষ কমিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রশ্নে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। কিন্তু কমিটি যখন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলেন, যখন প্রধানমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে মতামত দিলেন, কমিটির রিপোর্টে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যই প্রতিফলিত হলো। এতে করে কমিটির নিরপেক্ষতা রক্ষিত হলো কি?
প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের কথা না বললেও পারতেন। জাতি হিসেবে আমরা এখনো বিভক্ত। প্রতিটি ইস্যুতে আমাদের এই বিভক্তি লক্ষ্য করার মতো। পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা গড়ে ওঠেনি। সরকারে থাকলে যে সহনশীল হতে হয়, তার দৃষ্টান্ত আমরা দেখাতে পারিনি। আমরা নিজস্ব রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা থেকে সবকিছু ভাবতে পছন্দ করি এবং সেভাবেই দেখতে চাই। এই প্রবণতা ২০০৬ সালে চারদলীয় জোটের ক্ষমতা ছাড়ার পর চরম সঙ্কটের জন্ম দিয়েছিল। দেশ আবারো সেদিকে যাচ্ছে কি না, এ প্রশ্ন এখন অনেকের।
উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অগণতান্ত্রিক হিসেবে অভিহিত করেছে। উচ্চ আদালতের রায় নিয়ে কথা বলা যাবে না। কিন্তু আদালত সংবিধান পরিবর্তন করতে পারে না। তারা মতামত দিতে পারে। সংবিধান পরিবর্তন করবে সংসদ। সংসদ এই কাজটিই এখন করছে। সংসদ সদস্যরা উচ্চ আদালতের রায়কে বিবেচনায় নিয়ে নতুন একটি ফর্মুলা দিতে পারে। কেননা আমরা আমাদের মানসিকতা এখনো পরিবর্তন করিনি। যারা ক্ষমতায় থাকে, তারা ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। সংবিধানে বিসমিল্লাহ রাখা না রাখা নিয়ে যে বিতর্ক, এই বিতর্ক চলতে দেয়া ঠিক না। মৌলবাদীরা এটা থেকে ফায়দা ওঠাতে পারে। সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে তাই একটি সমঝোতা ও ঐকমত্য খুবই জরুরি।

ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

জাতীয় ঐকমত্য জরুরি

জাতীয় ঐকমত্য জরুরি

ড. তারেক শামসুর রেহমান

সংবিধান সংশোধন নিয়ে যেমন সুপারিশ করা হয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গেই সংবিধানে সংযোজন হবে না। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে (মন্ত্রণালয়, ভেটিং, মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত, বিল আকারে সংসদে উত্থাপন, সংসদে বিতর্ক) এটি সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী হিসেবে গৃহীত হবে। সুতরাং আলাপ-আলোচনার যথেষ্ট সুযোগ আছে।

গত ৮ জুন জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধনের জন্য ৫১ দফা সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়েছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর জন্য গঠিত বিশেষ কমিটি এ সুপারিশমালা প্রণয়ন করেছে। ওই সুপারিশমালায় কী আছে, তা পাঠক ইতিমধ্যে জেনেও গেছেন। বিশেষ কমিটি গত ১০ মাসে ২৭টি বৈঠক করেছে। তথাকথিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের বক্তব্যও নিয়েছে। সাবেক প্রধান বিচারপতিদের কেউ কেউ বিশেষ কমিটির আমন্ত্রণে বক্তব্যও রেখেছেন; কিন্তু যেটা অবাক করার বিষয় তা হচ্ছে_ বিশেষ কমিটি কারও সুপারিশই আমলে নেয়নি। সুপারিশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ, ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়া, বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকা ইত্যাদি যে বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তাতে বিতর্কের মাত্রা আরও বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানে অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির নেতা এরশাদের শাসনামলে এটি পাস হয়েছিল। এরশাদ এখনও চাচ্ছেন রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিষয়টি সংবিধানে থাকুক। রাষ্ট্রধর্মের প্রশ্নে মহাজোটের শরিক বাম দলগুলোর প্রবল আপত্তি রয়েছে। এমনকি সেক্টর কমান্ডার্স ফেরামের সুপারিশও গ্রহণ করা হয়নি। ইতিমধ্যে অষ্টম সংশোধনীকে (১৯৮৭) চ্যালেঞ্জ করা একটি রিট পিটিশন (২৩ বছর আগে করা) পুনরুজ্জীবিত করে হাইকোর্ট সরকারের ওপর একটি কারণ দর্শাও নোটিশ জারি করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্যের প্রতিবাদে বিএনপি তথা চারদলীয় জোট গত ৫ জুন সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালও পালন করেছে।

উত্থাপিত সুপারিশমালা, বিরোধী দলের তাতে অংশগ্রহণ না থাকা, সর্বোপরি ২৩ বছর আগে করা একটি মামলা পুনরুজ্জীবিত করে হাইকোর্টের কারণ দর্শাও নোটিশ প্রদান_ সব মিলিয়ে একটি জটিল পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে দেশটি। দুঃখজনক হলেও সত্য, সংবিধান সংশোধনের মতো একটি জাতীয় ইস্যুতে কোনো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলো না। এখন সরকার যদি এককভাবে সুপারিশগুলো পাস করিয়ে নেয় তাহলে এর পরিণতির জন্য সরকারই এক সময় অভিযুক্ত হবে। বিশেষ কমিটি অনেক বিষয়ে সুপারিশ করেছে, তার ধরন রাজনৈতিক। রাজনৈতিকভাবে এর সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল; কিন্তু যে বিভক্তি বাংলাদেশের রাজনীতিকে কুরে কুরে খাচ্ছে, তারই প্রতিফলন ঘটল সংবিধান সংশোধনীতে। সংবিধান সংশোধনীকে কেন্দ্র করে বেশকিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, যার জবাব খোঁজা অত্যন্ত জরুরি। এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে। যুক্তি হচ্ছে, উচ্চ আদালতের একটি রায়। কিন্তু রায়ে একথাটিও বলা হয়েছিল যে, আরও দুটি টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। সুপারিশে এটি নেই। তাই সঙ্গত কারণেই সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। সরকার ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়_ এ অভিযেগে কাটিয়ে ওঠা এখন কঠিন হবে। সংবিধানে মাত্র দুই টার্মের জন্য এ ব্যবস্থা থাকবে, এ ধরনের বিধান রাখা যায় না। এমনকি মূল সংবিধানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যেভাবে আছে, সেটাও রাখা যাবে না। কেননা তাতে করে সংবিধানে ৫৮গ(৩) ধারা মতে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার কথা, যাতে বিএনপির রয়েছে প্রবল আপত্তি। তাই সংবিধানে নয়, বরং সংসদ একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারে, দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন একটি দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে। এই 'দলনিরপেক্ষ'-এর ব্যাখ্যাও সংসদকে দিতে হবে। সংসদ একটি 'এলডার্স কাউন্সিলের' প্রস্তাব করতে পারে, যেখানে চারজনের একটি টিম (দু'জন আওয়ামী লীগের, দু'জন বিএনপির মনোনীত নিরপেক্ষ ব্যক্তি) নির্বাচন পরিচালনা করবেন। এখানে কেউ এককভাবে 'প্রধান উপদেষ্টার' দায়িত্ব পালন করবেন না। বিকল্প হিসেবে তিনজন 'সিনিয়র সিটিজেন (একজন প্রবীণ প্রধান বিচারপতি, একজন শিক্ষাবিদ, একজন সুশীল অথবা ব্যবসায়িক সমাজের প্রতিনিধি) নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বটি পালন করতে পারেন।

সংসদ যদি এ ধরনের একটি ফর্মুলা উপস্থাপন করে তাহলে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষমতা ধরে রাখার যে অভিযোগ, সেই অভিযোগে থেকে সরকার নিষ্কৃতি পাবে। তখন সরকারের বিরুদ্ধে বলার কিছু থাকবে না। দুই. প্রধানমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প হিসেবে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করার কথা বলেছেন। এটাও গ্রহণযোগ্য হবে না। কেননা আগামী মাসেই সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। সরকারকে এ পদে নতুনদের নিয়োগ দিতে হবে। এখন সরকার যাদেরই নিয়োগ দিক, তাদের নিয়ে বিতর্ক উঠবে। তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা খুঁজে বের করা হবে। আর এটা তো ঠিক সামরিক-বেসামরিক আমলারা তাদের অবসরের আগেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তার দল ক্ষমতায় গেলেই তারা সরকারের একটা 'পদ' বাগিয়ে নেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছে যে, এখানে 'নিরপেক্ষ' ব্যক্তি এখন খুঁজে পাওয়া ভার। 'প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী' হিসেবে যে তত্ত্বই হাজির করা হোক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে সচিবালয়ের আমলারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে গেছেন। কেউ এখন বিএনপির আমলা, কেউ আওয়ামী লীগের। সুতরাং সরকার এখন যাদেরই এ পদে নিয়োগ দেবে, তাদের নিয়ে বিতর্ক হবে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের সময় একটি বড় ভূমিকা পালন করে। তাদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা জরুরি। সুতরাং এ ধরনের সাংবিধানিক পদে নিযুক্তি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করা যায়। প্রয়োজনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কর্মপরিধির মধ্যেও এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যায়। তিন. বিশেষ কমিটি যখন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাখার পক্ষে অভিমত দিয়েছে ঠিক তখনই অষ্টম সংশোধনী, অর্থাৎ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম কেন সংবিধান পরিচালিত নয়, সে ব্যাপারে হাইকোর্ট একটি কারণ দর্শাও নোটিশ জারি করেছেন। এখন হাইকোর্ট যদি একটি রায় দেন তাহলে তা সংসদ সদস্যদের একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দিতে পারে।

হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সংসদ সদস্যরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। তাতে করে হাইকোর্ট অবমাননার প্রশ্ন উঠতে পারে। উপরন্তু সুপারিশমালায় রয়েছে ১৯৭২ সালের সংবিধানের চার মূলনীতিতে ফিরে যাওয়া, যেখানে বলা হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা। এ ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম পরস্পরবিরোধী। এমনকি সংবিধানের ২৫(২) ধারায় যেখানে বলা হয়েছে, 'রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন'_ সংবিধানের এ অংশটুকু নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। পঞ্চম সংশোধনীতে সংবিধানে এটি সংযোজন করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে এ অংশটুকু ছিল না। বিশেষ কমিটি অবিশ্যিই এ ব্যাপারে কোনো সুপারিশ করেনি। পঞ্চম সংশোধনী এখন উচ্চ আদালত কর্তৃক বাতিল হয়ে যাওয়ায় যে কেউ এখন সংবিধানের ২৫(২) ধারা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। চার. সুপারিশে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে 'বাঙালি' এবং নাগরিক হিসেবে 'বাংলাদেশী' হিসেবে পরিচিত হবেন। এটা কি নতুন করে আবারও বিতর্ক সৃষ্টি করবে না? তবে একটি ভালো দিক হচ্ছে, প্রস্তাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, কোনো আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশে কোনো আদিবাস নেই। পাঁচ. খসড়ায় অসাংবিধানিক পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের মতো কাজকে রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এটি নিয়ে কারোরই আপত্তি থাকার কথা নয়। তবে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, কেন অসাংবিধানিক শক্তি ক্ষমতা দখলে উৎসাহিত হয়, সে ব্যাপারে নজর দেওয়া প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলো এ ব্যাপারে তাদের দায় এড়াতে পারে না।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব, অসহযোগিতা, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর করা, সংসদ একদলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়া ইত্যাদি কারণেই অসাংবিধানিক শক্তিগুলো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ছয়. নির্বাচন কমিশনে চারজন কমিশনার (দু'জনের পরিবর্তে) নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রস্তাবের কোনো গুরুত্ব নেই। মূল প্রশ্ন হচ্ছে, নিরপেক্ষ ও যোগ্য লোকদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে হবে। সরকার তার 'পছন্দের' লোকদের নিয়োগ দেয়। ফলে বিতর্ক বাড়ে। সুপ্রিম জডিশিয়াল কাউন্সিলের কথা বলা হয়েছে, যেখানে বিচারপতিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো নিষ্পত্তি হবে। এটি একটি ভালো প্রস্তাব। সাত. সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন হবে না। বরং নারীদের মূল ধারায় নিয়ে আসতে হবে এবং সরাসরি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দিতে হবে। সংরক্ষিত আসন তুলে দিয়ে এক-পঞ্চমাংশ কিংবা এক-ষষ্ঠাংশ আসনে মহিলাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করতে হবে।

সংবিধান সংশোধন নিয়ে যেমন সুপারিশ করা হয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গেই সংবিধানে সংযোজন হবে না। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে (মন্ত্রণালয়, ভেটিং, মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত, বিল আকারে সংসদে উত্থাপন, সংসদে বিতর্ক) এটি সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী হিসেবে গৃহীত হবে। সুতরাং আলাপ-আলোচনার যথেষ্ট সুযোগ আছে। বিএনপির মতামত থাকা প্রয়োজন। কেননা বিএনপি তথা চার দল প্রায় ৩৭ ভাগ ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করে। স্পিকার নিজে উদ্যোগী হয়ে বিএনপির মতামত নিতে পারেন এবং তা সুপারিশে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। সংবিধান সংশোধন নিয়ে একটি জাতীয় ঐকমত্য থাকা প্রয়োজন।

প্রফেসর ড. তারেক শামসুর রেহমান : শিক্ষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
www.tsrahmanbd.blogspot.com
[সূত্রঃ সমকাল, ১৩/০৬/১১]

রাজনীতি কোন পথে?

 রাজনীতি কোন পথে? 
জ্বলন্ত এই বাসের ছবিটি এখন প্রতিকী দেশেও জ্বলছে অশান্তির আগুন
ড. তা রে ক শা ম সু র রে হ মা ন         
আজ রোববার ৩৬ ঘণ্টার হরতাল শুরু হচ্ছে। শেষ হবে আগামীকাল সন্ধ্যায়। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী আলাদাভাবে এই লাগাতার হরতাল আহ্বান করেছে। সমর্থন দিয়েছে ইসলামী ঐক্যজোট। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে ৫১ দফা সংশোধনী সংসদে উপস্থাপন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে সরকারের ব্যর্থতার প্রতিবাদে বিএনপি এ হরতাল ডেকেছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী হরতাল ডেকেছে সব রাজবন্দির মুক্তিসহ নানা দাবিতে। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত একটি বক্তব্যের প্রতিবাদে গেল সপ্তাহেও চারদলীয় জোটের উদ্যোগে হরতাল পালিত হয়েছে। গত ৫ জুনের ওই হরতাল ছিল সরকারের জন্য একটি হুশিয়ারি। যেখানে ৩৭ ভাগ জনগোষ্ঠীকে প্রতিনিধিত্বকারী চারদলীয় জোটের বক্তব্যকে গ্রহণযোগ্যতায় নেয়া উচিত ছিল, তা না করে সরকার এককভাবে সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে নতুন করে হরতাল আহ্বান করা অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। হরতালে জনগণের কষ্ট হয়। কিন্তু বৃহত্তর কষ্ট এড়ানোর জন্যই এ হরতাল। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ কথা স্বীকার করে ক্ষমাও চেয়েছেন।
স্পষ্টতই সংবিধান সংশোধনের নামে সরকার একটি জটিল পরিস্থিতির দিকে জাতিকে ঠেলে দিয়েছে। গত ১০ মাসে সংবিধান সংশোধনের জন্য গঠিত কমিটির কর্মকাণ্ড দেখে এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে কমিটি নিজের ইচ্ছায় নয়, বরং ‘অন্য কারো’ ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্যই ৫১ দফা সুপারিশ করেছে। কমিটি যাদের দাওয়াত দিয়ে তাদের কথা শুনেছিল, তাদের কারো সুপারিশই ৫১ দফায় নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে শরিকদের মতামতও প্রতিফলিত হয়নি ওই ৫১ দফায়। মজার ব্যাপার বিশেষ কমিটির সদস্যরা তাদের ২৭টি সভায়ও যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না, তখন তারা দেখা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী তখন বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করতে হবে। একটি কমিটি যখন গুরুত্বপূর্ণ কোনো ইস্যুতে কাজ করে, তখন ওই কমিটির সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা না করারই কথা। কেননা তাতে করে তারা প্রভাবান্বিত হতে পারেন। এ রকমটিই ঘটেছিল বিশেষ কমিটির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সময়। বিশেষ কমিটি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যই সুপারিশে রাখলেন। ফলে তারা তাদের নিরপেক্ষতা হারিয়েছিলেন। ফলে যা হওয়ার তাই হলো—৩৬ ঘণ্টার লাগাতার হরতাল আহ্বান করতে হলো বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে। চারদলীয় জোট তো আগেই হুশিয়ার করে দিয়েছিল যে বড় ধরনের কর্মসূচি আসতে পারে।
শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই নয়, বরং ইভিএম মেশিন নিয়েও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। প্রধানমন্ত্রী অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছেন যে আগামী নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটার মেশিন বা ইভিএম মেশিন ব্যবহৃত হবে। প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পরপরই নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছে। সংলাপের অন্যতম এজেন্ডা হচ্ছে নির্বাচনে ইভিএম মেশিন ব্যবহার। তাহলে কী দাঁড়াল ব্যাপারটা। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্যই নির্বাচন কমিশন উদ্যোগ নিচ্ছে। নির্বাচন কমিশন কি তার নিরপেক্ষতা হারাল না? নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তো সিইসি নিজেই বলেছিলেন, তিনি ১৯৭০ সালের মতো একটি নির্বাচন করতে চান। সেদিনই তিনি তার নিরপেক্ষতা হারিয়েছিলেন। আজ তিনি যখন ইভিএম মেশিনের কথা বলেন, তখন তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। এ দেশের জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ যেখানে অশিক্ষিত ও নিরক্ষর, তাদের কাছে কোন যুক্তিতে আমরা ইভিএম মেশিন নিয়ে যাব? বলা হচ্ছে ভোট কেন্দ্রে তাদের প্রশিক্ষণ বা ধারণা দেয়া হবে। এখানে কি ‘ম্যানিপুলেশন’ হবে না? ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত থাকা ব্যক্তিদের প্রভাব কি কাজ করবে না? ‘সূক্ষ্ম কারচুপির’ তত্ত্ব তো প্রধানমন্ত্রীই আমাদের শিখিয়েছিলেন। প্রযুক্তি মানুষকে অনেক দূর নিয়ে গেছে, এটা সত্য। কিন্তু এই প্রযুক্তি দিয়ে অনেক কিছু বদলে দেয়াও সম্ভব। যেখানে জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশই প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, সেখানে কোন উদ্দেশ্যে ইভিএম চালু করতে চায় নির্বাচন কমিশন? প্রশ্ন ওঠা তো খুবই স্বাভাবিক। এই ইভিএম মেশিনের সঙ্গে আমি পরিচিত হয়েছিলাম ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে Democracy and the American political process : Single country Project for Bangladesh-এর আওতায় আমরা ক’জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষল গিয়েছিলাম যুক্তরাষ্ট্রে। আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সাউথ ক্যারোলিনা রাজ্যের স্টেট ইলেকশন কমিশন অফিসে। সেখানে আমাদের সঙ্গে দীর্ঘ কথা হয়েছিল কমিশনের সহকারী পরিচালক মিস ডোনা রয়সনের সঙ্গে। আমরা অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছিলাম। ডোনা আমাদের বলেছিলেন, ভোটার মেশিন নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। সব রাজ্যে এটা এখনও গ্রহণযোগ্য হয়নি। রাজ্যগুলো তা চালুও করছে না। তখন প্রশ্ন উঠল আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট নিয়ে। অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী, একেবারেই সাধারণ, যাদের প্রযুক্তি সম্পর্কে এতটুকুও ধারণা নেই, এই বাংলাদেশে ভোটার মেশিনের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু? প্রশ্ন করেছিলাম ডোনাকে। আট বছর আগের কথা। ডোনা আমেরিকার রাজনৈতিক সংস্কৃতি আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি পর্যালোচনা করে বলেছিলেন, যেখানে খোদ আমেরিকাতেই এটা চালু হয়নি, বাংলাদেশের মতো একটি প্রযুক্তিগত অনেক পেছনে থাকা দেশে কীভাবে এটা চালু করা যায়? ডোনার এ প্রশ্নের কোনো জবাব আমার জানা ছিল না। পৃথিবীর অনেক দেশে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে এখনও ইভিএম চালু করা হয়নি। সেখানে আমরা কি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছি না? আমরা বারবার বলছি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ হতে হবে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন তার নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। সিইসি ও দুই নির্বাচন কমিশনারের কথাবার্তায় তারা তাদের নিরপেক্ষতা হারিয়েছিলেন। এই নির্বাচন কমিশনই বিএনপির মতো একটি বড় দলকে ভাঙতে চেয়েছিল। তারা বিএনপির সংস্কারবাদীদের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের দিয়ে একটা আলাদা দল করতে চেয়েছিল। আজ বিএনপি যখন নির্বাচন কমিশনের তথাকথিত সংলাপ বয়কট করে, তার একটা যুক্তি তো আছেই।
নবম জাতীয় সংসদের নির্বাচন হয়েছিল ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে। সরকার ইচ্ছে করলে তার আগেও নির্বাচন দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে আগামী মাসে। সরকার নতুন তিনজন কমিশনার (সিইসিসহ) নিয়োগ দেবে (সংবিধান সংশোধন হওয়ার পর এ সংখ্যা পাঁচে গিয়ে দাঁড়াবে)। তারাই তত্ত্বগতভাবে দশম সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করবেন। কারা আসছেন নির্বাচন কমিশনে? সরকার যদি তার বলয়ভুক্ত রাজনৈতিক অনুসারী আমলাদের (সিভিল ও মিলিটারি) নিয়োগ দেয় (যার সম্ভাবনা বেশি), তাহলে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই চারদলীয় জোটের সঙ্গে কথা বলতে হবে। সরকার প্রয়োজনে একটি নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করতে পারে, যারা নির্বাচন কমিশনকে ঢেলে সাজাবেন। সাবেক একজন প্রধান বিচারপতির (যিনি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য) নেতৃত্বে এই কমিশন গঠিত হতে পারে, যারা সিইসি তথা কমিশনারদের মনোনয়ন চূড়ান্ত করবেন। সরকার একতরফাভাবে যদি সিইসি ও কমিশনারদের নিয়োগ দেয়, তাতে বিতর্কের মাত্রা আরও বাড়বে।
দলীয়ভাবে (অর্থাত্ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়ে) নির্বাচন করলে যে সেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয় না এবং সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা যে ওই নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করে, তার বড় প্রমাণ বর্তমান সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়া ভোলার উপনির্বাচন (২৪ এপ্রিল ২০১০)। সংবাদপত্রগুলো সাক্ষী ওই নির্বাচনে কী হয়েছিল। এখন কী হচ্ছে? ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হচ্ছে দেশজুড়ে। ব্যালট ছিনতাই, আর জাল ভোটের ছড়াছড়ি। এমনকি ইউএনওর অফিস ঘেরাও করে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানানো হচ্ছে (আমার দেশ, ১০ জুন)। এই যখন পরিস্থিতি, তখন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের সুষ্ঠুতা ও নিরপেক্ষতা আমরা নিশ্চিত করব কীভাবে? না, দলীয় সরকারের আওতায় কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হবে না। এ জন্যই দরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
বিরোধী দলের হরতাল আহ্বান আবারও প্রমাণ করল বিরোধী দলের সঙ্গে কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা ছাড়া ‘রাজনৈতিক সমস্যা’র কোনো সমাধান সম্ভব নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি রাজনৈতিক। আদালত রাজনৈতিক বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। তারা একটি অভিমত দিয়েছেন। কিন্তু আদালত বলেননি দলীয় সরকারের আওতায় নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অবৈধ বলেছেন। আমরা এ প্রশ্নে যাব না। আমরা যাব সংবিধান সংশোধনের প্রশ্নে, যেখানে সংবিধানই আমাদের বলে দিচ্ছে (অনুচ্ছেদ ১৪২-১) সংসদই সংবিধান সংশোধন করবে। অতীতেও করেছে। বিশেষ কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এ কথাটিই বারবার বলে আসছেন—সংসদই সংবিধান সংশোধন করবে। সংবিধান সংশোধন হতে পারে। কিন্তু তা হতে হবে সংসদ এবং বিরোধী দলের সম্মতিসহ। এখন বিরোধী দলেকে বাদ দিয়ে সংবিধান সংশোধন করলে তা দেশকে আরও অস্থিরতার দিকে ঠেলে দেবে। ৩৬ ঘণ্টার টানা হরতাল আবারও প্রমাণ করল চারদলের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হোক, দুই টার্মের জন্য (আদালতের রায় অনুসরণ করে) একটি নিরপেক্ষ সরকারের আওতায় নির্বাচন (দশম ও এগারতম জাতীয় সংসদ) আয়োজন করতে সরকারকে নতুন ফর্মুলা’ উপস্থাপন করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, সরকারকে বিএনপির সঙ্গে সংলাপে উদ্যোগী হতে হবে। সরকার ও বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপের উদ্যোগ নিতে পারেন স্পিকার স্বয়ং। সরকার যদি নমনীয় না হয়, তাহলে দেশ আবারও এক চরম সঙ্কটের দিকে যাবে, যা আমরা কেউই চাই না। আমরা যদি ‘দেয়ালের লিখন’ থেকে কিছু না শিখি, সেটা হবে আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
www. tsrahmanbd. blogspot. com