আমাদের জাতীয় সংসদ |
সংবিধান সংশোধন হতেই পারে। অতীতেও হয়েছে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিরোধী দলের সমর্থন ছাড়া যদি সংসদে পাস হয়ে যায় এবং এতে করে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে, তার দায়ভার তো সরকারকেই বহন করতে হবে। বিএনপি এখন কঠিন কর্মসূচিতে যাবে। এটাই স্বাভাবিক। বিএনপি এই মুহূর্তে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। স্থায়ী কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে যে তারা সহযোগী অন্য দলগুলোর সঙ্গে কথা বলবে। তবে তারা প্রতিহতের কথা বলছে। কেবিনেট একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে গত ২০ জুন। ওই বৈঠকে সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ কমিটির ৫১ দফা সুপারিশ সংবলিত খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এটা এখন বিল আকারে সংসদে উপস্থাপন করা হবে। কেবিনেটের এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে সরকার তার অবস্থান পরিষ্কার করল। এখন স্পষ্টতই এই সিদ্ধান্ত রাজনীতিতে উষ্ণতা বাড়াবে। ইতোমধ্যে বিএনপির সিনিয়র নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ জানিয়ে দিয়েছেন সরকার আলোচনার সব পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। বিরোধী দল এর আগে ৫ জুন এবং ১২ ও ১৩ জুন লাগাতার ৩৬ ঘণ্টা হরতাল পালন করেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে। বিএনপি গত ২১ জুন স্থায়ী পরিষদের সভায় একটি সিদ্ধান্তও নিয়েছে। যে প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে এরপর কী? সরকারের পক্ষ থেকে যখন বিএনপির সঙ্গে আলোচনার কথা বলা হচ্ছিল, তখন কেবিনেটের এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে যে কোনো ধরনের আলোচনার পথ রুদ্ধ করে দিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও অনেকেই একমত যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চাকে আরো শক্তিশালী করতে হলে আরো কিছুদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকা প্রয়োজন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংসদীয় সরকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও বিশেষ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে এটা জরুরি। কেননা মাগুরা উপনির্বাচনের পর বেশ কয়েক বছর পার হয়ে গেলেও ভোলা উপনির্বাচন (২০১০) আবারো প্রমাণ করল দলীয় সরকারের আওতায় কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হয় না।
আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের অন্যতম উদ্যোক্তা। সেদিন ক্ষমতায় ছিলেন বেগম জিয়া। তিনি রাজি ছিলেন না। এখন দৃশ্যপট পুরোটাই উল্টে গেল। বেগম জিয়া এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখতে চাচ্ছেন, আর শেখ হাসিনা চাচ্ছেন না। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের দাবি উঠতে থাকে। ক্ষমতা গ্রহণের এক বছরের মাথায় শেখ হাসিনাই প্রথম প্রসঙ্গটি অবতারণা করেন। তারপর আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা তার প্রতিধ্বনি করতে থাকেন। সরকারের আড়াই বছরের মাথায় এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে সরকার আর সংবিধানে এই ব্যবস্থাটি রাখতে চাইছে না। এরপর এলো উচ্চ আদালতের রায়টি। উচ্চ আদালতের রায়ে বলা হযেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে ভাবীসাপেক্ষে বাতিল ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হলো। রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে এই ব্যবস্থা আরো দুই মেয়াদে বহাল থাকার পর। এটি রায়ের পরবর্তী অংশে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে জনগণও রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই যেহেতু সর্বোচ্চ আইন, সে কারণে প্রয়োজনের নিরিখে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনেই অনুষ্ঠিত হতে পারবে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি কিংবা আপিল বিভাগের বিচারপতিরা নিযুক্ত হতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে স্বাধীনভাবে জাতীয় সংসদ সিদ্ধান্ত নিতে পারবে বলে রায়ে অভিমত দেয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে উচ্চ আদালতের রায় যদি মানতেই হয়, তাহলে তো পুরোটাই মানতে হবে। সংবিধান সংশোধনের জন্য যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সেই কমিটি তাহলে উচ্চ আদালতের রায়ের একটি অংশ গ্রহণ করল কেন? পুরোটা গ্রহণ করে সুপারিশ দিলে তো এই প্রশ্নটি আজ উঠত না।
বিরোধী দলের পক্ষ থেকেও বলার কিছু থাকত না। আজ যখন বেগম জিয়া পুরো রায়ের কথা বলছেন, তার যুক্তি তো ফেলে দেয়ার না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আমাদের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করেছে। এটাকে বাদ দেয়া যাবে না। তবে অবশ্যই আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় সংস্কার চাই। বিশেষ করে ৫৮গ(৩) ধারায় পরিবর্তন আনতে হবে। এই ধারায় সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করার বিধান রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে উচ্চ আদালতে রাজনীতি ঢুকে গেছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের কর্মকা- প্রমাণ করে তিনি নিজেকে বিতর্কের ঊধর্ে্ব রাখতে পারেননি। তার একাধিক রায় নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে ১০ লাখ টাকা গ্রহণের যে সংবাদ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, তার ব্যাখ্যা তিনি দেননি। স্বাভাবিক কারণেই এ নিয়ে জনগণের মাঝে প্রশ্নের উদ্রেগ করেছে। অতীতে কোনো প্রধান বিচারপতি এভাবে বিতর্কিত হননি। আরেক প্রধান বিচারপতি অবসর গ্রহণের পরও তাদের মেধা দিয়ে জাতিকে সেবা করে যাচ্ছেন। জাতিকে পথ দেখাচ্ছেন। কিন্তু বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক নিজেকেই শুধু বিতর্কিত করলেন না, বরং বিচারপতিদের জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করালেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের উদ্ধৃতি আমি কি দেব? যেখানে তিনি নিজে আইনজীবীদের কাছেই গ্রহণযোগ্য হলেন না সেখানে আমজনতার কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন কিভাবে? তার কুশপুত্তলিকা তো আইনজীবীরাই দাহ করেছিল।
অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় তিনি দিয়েছেন। পঞ্চম সংশোধনী, সপ্তম সংশোধনী কিংবা ত্রয়োদশ সংশোধনী_সংবিধানের এসব সংশোধনী বাতিল হয়েছে উচ্চ আদালতের রায়ে। তার নেতৃত্বে উচ্চ আদালত রায় দিয়েছে। রায় নিয়ে মন্তব্য করা যাবে না। তাতে করে আদালত অবমাননা হয়ে যেতে পারে। ওই তিনটি রায় নিয়ে নানা মন্তব্য, নানা কথা পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। মুন সিনেমা হল নিয়ে মামলা হয়েছিল। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক রায় দিলেন পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের। বিচারপতি মুন সিনেমা হলের মালিকানার সঙ্গে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর কি সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছিলেন, আমি বলতে পারব না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মুন সিনেমা হলের মালিক তার সিনেমা হল আর ফেরত পাননি। কিন্তু ইতোমধ্যে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হয়ে গেছে। ত্রয়োদশ সংশোধনীও বাতির হলো। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হলো। আবার একই রায়ে বলা হলো আগামী দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। এটা কি পরস্পর বিরোধী নয়। যদি বাতিল হয় সব সময়ের জন্যই বাতিল। পরের দুটো কেন তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে? এটা কি এ জন্য যে বিচারপতি খায়রুল হক নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার ইচ্ছা ছিল তাই। সংবিধান তো তাই বলে। সংবিধানের ৫৮(খ) এবং বিশেষ করে ৫৮(গ)(৩) ধারায় যদি পরিবর্তন আনা না হয়, তাহলে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকই হবেন পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান। একজন বিতর্কিত লোক প্রধান উপদেষ্টা হবেন, সেটা নিশ্চয়ই কারো কাম্য নয়।
যিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসরে গেছেন, তার তো চাওয়ার কিছু থাকতে পারে না। রাষ্ট্র তাকে তো অনেক দিয়েছে। সাধারণ নিয়মে তার প্রধান বিচারপতি হওয়ার কথা ছিল না। তিনি দুদুবার সুপারসিডেড হয়ে প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। সর্বশেষ ঘটনায় বিচারপতি শাহ মোহাম্মদ আবু নাইম মোমিনুর রহমান পদত্যাগ পর্যন্ত করেছিলেন। বিচারপতি শাহ আবু নাইমের পদত্যাগের ঘটনাও বিচার বিভাগের জন্য কলঙ্ক। উচ্চ আদালতের রায় অনুসরণ করে সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করতে পারতো। এ ক্ষেত্রে শাহ মোহাম্মদ আবু নাইম মোমিনুর রহমানকে প্রধান বিচারপতি করা হলে, তাতে ক্ষতির কিছু ছিল না। তিনিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারতেন না।
এখন বরফটা কিভাবে গলবে, তা আমি নিশ্চিত নই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। কেবিনেটে বাতিল হওয়া মানে একটি ধাপ। আরো কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে তা আইনে পরিণত হবে। কিন্তু এটাই কি শেষ? সংসদে মহা ঐক্যজোটের দুইতৃতীয়াংশ আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। সংসদে একটি বিল পাস করানোর জন্য তা যথেষ্ট। কেবিনেট জাতীয় কমিটি কর্তৃক উত্থাপিত ৫১ দফা পুরোটাই অনুমোদন করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল এর একটি অংশ মাত্র। কেবিনেটের এই সিদ্ধান্ত থেকে এটা ধরে নেয়া স্বাভাবিক যে, সরকার শুধু একটি বিষয়ই নয়, বরং সংবিধানের আমূল পরিবর্তন চাচ্ছেন। কিন্তু প্রধান বিরোধী দলকে বাইরে রেখে, তাদের কোনো মতামত গ্রহণযোগ্যতায় না নিয়ে সংবিধানে যে পরিবর্তন আনা হচ্ছে, তা সঙ্কটের মাত্রাকে আরো বাড়াবে মাত্র। একটা সমঝোতা প্রয়োজন ছিল। সৈয়দ আশরাফ যখন সংলাপের কথা বলেন, তখন আমরা ধরে নিয়েছিলাম সরকার দ্রুত জাতীয় কমিটি কর্তৃক উত্থাপিত ৫১ দফা কেবিনেটে উপস্থাপনা করবে না। এখন দ্রুত কেবিনেটের অনুমোদন দেয়ার ফলে সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
সংবিধান সংশোধন হতেই পারে। অতীতেও হয়েছে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিরোধী দলের সমর্থন ছাড়া যদি সংসদে পাস হয়ে যায় এবং এতে করে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে, তার দায়ভার তো সরকারকেই বহন করতে হবে। বিএনপি এখন কঠিন কর্মসূচিতে যাবে। এটাই স্বাভাবিক। বিএনপি এই মুহূর্তে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। স্থায়ী কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে যে তারা সহযোগী অন্য দলগুলোর সঙ্গে কথা বলবে। তবে তারা প্রতিহতের কথা বলছে।
ধারণা করা হচ্ছে যে এবার ৪৮ ঘণ্টার হরতাল আসছে। সরকার খুব দ্রুত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ পূর্ণাঙ্গ রায় আমরা এখনো পাইনি। এরই মধ্যে প্রধান বিচারপতি অবসরে চলে গেছেন। নূ্যনতম ছয় মাস প্রয়োজন হবে পূর্ণাঙ্গ রায়টি পেতে। এর আগেই বিশেষ কমিটির মাধ্যমে প্রস্তাব দিয়ে কেবিনেটে তা পাস করিয়ে সরকার খুব দ্রুত সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীটি পাস করিয়ে নিতে চাইছে। এটা চলমান রাজনীতির জন্য কোনো ভালো খবর নয়। বিশেষ কমিটি গত ৪ মে সব সম্পাদকদের সঙ্গে যখন মতবিনিময় করেছিলেন সেদিন সম্পাদকরা একবাক্যে সবাই বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে বিলটি সংসদে পাস করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এখন মনে হচ্ছে সম্পাদকদের এই বক্তব্যও উপেক্ষিত হলো। ৮ জুন সংসদের বিশেষ কমিটির রিপোর্টে সংসদে উপস্থাপনের ১২ দিনের মাথায় কেবিনেট তা অনুমোদনের মধ্য দিয়ে চলমান রাজনীতিতে যে 'সঙ্কটের' সূচনা হলো, তা আমাদের জন্য আদৌ কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। এমনিতেই আমরা 'ব্যর্থ রাষ্ট্র' হিসেবে স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছি। বিখ্যাত 'ফরেন পলিসি' ম্যাগাজিনে ১৭৭টি দেশ নিয়ে যে 'ব্যর্থ রাষ্ট্র'-এর তালিকা সম্প্রতি তৈরি করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ২৫তম। বাংলাদেশে প্রতি ৫ জনের মধ্যে ২ জনই দরিদ্র। এমনি এক পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে দু'দলের মাঝে বিরোধ ও নূ্যনতম ঐকমত্যে পৌঁছানোর ব্যর্থতা 'ব্যর্থ রাষ্ট্র'-এর ধারণাকে আরো শক্তিশালী করবে মাত্র।
ড. তারেক শামসুর রেহমানঃ অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[সূত্রঃ যায় যায় দিন, ২৭/০৬/১১]
আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের অন্যতম উদ্যোক্তা। সেদিন ক্ষমতায় ছিলেন বেগম জিয়া। তিনি রাজি ছিলেন না। এখন দৃশ্যপট পুরোটাই উল্টে গেল। বেগম জিয়া এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখতে চাচ্ছেন, আর শেখ হাসিনা চাচ্ছেন না। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের দাবি উঠতে থাকে। ক্ষমতা গ্রহণের এক বছরের মাথায় শেখ হাসিনাই প্রথম প্রসঙ্গটি অবতারণা করেন। তারপর আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা তার প্রতিধ্বনি করতে থাকেন। সরকারের আড়াই বছরের মাথায় এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে সরকার আর সংবিধানে এই ব্যবস্থাটি রাখতে চাইছে না। এরপর এলো উচ্চ আদালতের রায়টি। উচ্চ আদালতের রায়ে বলা হযেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে ভাবীসাপেক্ষে বাতিল ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হলো। রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে এই ব্যবস্থা আরো দুই মেয়াদে বহাল থাকার পর। এটি রায়ের পরবর্তী অংশে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে জনগণও রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই যেহেতু সর্বোচ্চ আইন, সে কারণে প্রয়োজনের নিরিখে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনেই অনুষ্ঠিত হতে পারবে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি কিংবা আপিল বিভাগের বিচারপতিরা নিযুক্ত হতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে স্বাধীনভাবে জাতীয় সংসদ সিদ্ধান্ত নিতে পারবে বলে রায়ে অভিমত দেয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে উচ্চ আদালতের রায় যদি মানতেই হয়, তাহলে তো পুরোটাই মানতে হবে। সংবিধান সংশোধনের জন্য যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সেই কমিটি তাহলে উচ্চ আদালতের রায়ের একটি অংশ গ্রহণ করল কেন? পুরোটা গ্রহণ করে সুপারিশ দিলে তো এই প্রশ্নটি আজ উঠত না।
বিরোধী দলের পক্ষ থেকেও বলার কিছু থাকত না। আজ যখন বেগম জিয়া পুরো রায়ের কথা বলছেন, তার যুক্তি তো ফেলে দেয়ার না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আমাদের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করেছে। এটাকে বাদ দেয়া যাবে না। তবে অবশ্যই আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় সংস্কার চাই। বিশেষ করে ৫৮গ(৩) ধারায় পরিবর্তন আনতে হবে। এই ধারায় সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করার বিধান রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে উচ্চ আদালতে রাজনীতি ঢুকে গেছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের কর্মকা- প্রমাণ করে তিনি নিজেকে বিতর্কের ঊধর্ে্ব রাখতে পারেননি। তার একাধিক রায় নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে ১০ লাখ টাকা গ্রহণের যে সংবাদ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, তার ব্যাখ্যা তিনি দেননি। স্বাভাবিক কারণেই এ নিয়ে জনগণের মাঝে প্রশ্নের উদ্রেগ করেছে। অতীতে কোনো প্রধান বিচারপতি এভাবে বিতর্কিত হননি। আরেক প্রধান বিচারপতি অবসর গ্রহণের পরও তাদের মেধা দিয়ে জাতিকে সেবা করে যাচ্ছেন। জাতিকে পথ দেখাচ্ছেন। কিন্তু বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক নিজেকেই শুধু বিতর্কিত করলেন না, বরং বিচারপতিদের জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করালেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের উদ্ধৃতি আমি কি দেব? যেখানে তিনি নিজে আইনজীবীদের কাছেই গ্রহণযোগ্য হলেন না সেখানে আমজনতার কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন কিভাবে? তার কুশপুত্তলিকা তো আইনজীবীরাই দাহ করেছিল।
অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় তিনি দিয়েছেন। পঞ্চম সংশোধনী, সপ্তম সংশোধনী কিংবা ত্রয়োদশ সংশোধনী_সংবিধানের এসব সংশোধনী বাতিল হয়েছে উচ্চ আদালতের রায়ে। তার নেতৃত্বে উচ্চ আদালত রায় দিয়েছে। রায় নিয়ে মন্তব্য করা যাবে না। তাতে করে আদালত অবমাননা হয়ে যেতে পারে। ওই তিনটি রায় নিয়ে নানা মন্তব্য, নানা কথা পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। মুন সিনেমা হল নিয়ে মামলা হয়েছিল। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক রায় দিলেন পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের। বিচারপতি মুন সিনেমা হলের মালিকানার সঙ্গে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর কি সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছিলেন, আমি বলতে পারব না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মুন সিনেমা হলের মালিক তার সিনেমা হল আর ফেরত পাননি। কিন্তু ইতোমধ্যে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হয়ে গেছে। ত্রয়োদশ সংশোধনীও বাতির হলো। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হলো। আবার একই রায়ে বলা হলো আগামী দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। এটা কি পরস্পর বিরোধী নয়। যদি বাতিল হয় সব সময়ের জন্যই বাতিল। পরের দুটো কেন তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে? এটা কি এ জন্য যে বিচারপতি খায়রুল হক নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার ইচ্ছা ছিল তাই। সংবিধান তো তাই বলে। সংবিধানের ৫৮(খ) এবং বিশেষ করে ৫৮(গ)(৩) ধারায় যদি পরিবর্তন আনা না হয়, তাহলে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকই হবেন পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান। একজন বিতর্কিত লোক প্রধান উপদেষ্টা হবেন, সেটা নিশ্চয়ই কারো কাম্য নয়।
যিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসরে গেছেন, তার তো চাওয়ার কিছু থাকতে পারে না। রাষ্ট্র তাকে তো অনেক দিয়েছে। সাধারণ নিয়মে তার প্রধান বিচারপতি হওয়ার কথা ছিল না। তিনি দুদুবার সুপারসিডেড হয়ে প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। সর্বশেষ ঘটনায় বিচারপতি শাহ মোহাম্মদ আবু নাইম মোমিনুর রহমান পদত্যাগ পর্যন্ত করেছিলেন। বিচারপতি শাহ আবু নাইমের পদত্যাগের ঘটনাও বিচার বিভাগের জন্য কলঙ্ক। উচ্চ আদালতের রায় অনুসরণ করে সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করতে পারতো। এ ক্ষেত্রে শাহ মোহাম্মদ আবু নাইম মোমিনুর রহমানকে প্রধান বিচারপতি করা হলে, তাতে ক্ষতির কিছু ছিল না। তিনিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারতেন না।
এখন বরফটা কিভাবে গলবে, তা আমি নিশ্চিত নই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। কেবিনেটে বাতিল হওয়া মানে একটি ধাপ। আরো কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে তা আইনে পরিণত হবে। কিন্তু এটাই কি শেষ? সংসদে মহা ঐক্যজোটের দুইতৃতীয়াংশ আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। সংসদে একটি বিল পাস করানোর জন্য তা যথেষ্ট। কেবিনেট জাতীয় কমিটি কর্তৃক উত্থাপিত ৫১ দফা পুরোটাই অনুমোদন করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল এর একটি অংশ মাত্র। কেবিনেটের এই সিদ্ধান্ত থেকে এটা ধরে নেয়া স্বাভাবিক যে, সরকার শুধু একটি বিষয়ই নয়, বরং সংবিধানের আমূল পরিবর্তন চাচ্ছেন। কিন্তু প্রধান বিরোধী দলকে বাইরে রেখে, তাদের কোনো মতামত গ্রহণযোগ্যতায় না নিয়ে সংবিধানে যে পরিবর্তন আনা হচ্ছে, তা সঙ্কটের মাত্রাকে আরো বাড়াবে মাত্র। একটা সমঝোতা প্রয়োজন ছিল। সৈয়দ আশরাফ যখন সংলাপের কথা বলেন, তখন আমরা ধরে নিয়েছিলাম সরকার দ্রুত জাতীয় কমিটি কর্তৃক উত্থাপিত ৫১ দফা কেবিনেটে উপস্থাপনা করবে না। এখন দ্রুত কেবিনেটের অনুমোদন দেয়ার ফলে সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
সংবিধান সংশোধন হতেই পারে। অতীতেও হয়েছে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিরোধী দলের সমর্থন ছাড়া যদি সংসদে পাস হয়ে যায় এবং এতে করে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে, তার দায়ভার তো সরকারকেই বহন করতে হবে। বিএনপি এখন কঠিন কর্মসূচিতে যাবে। এটাই স্বাভাবিক। বিএনপি এই মুহূর্তে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। স্থায়ী কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে যে তারা সহযোগী অন্য দলগুলোর সঙ্গে কথা বলবে। তবে তারা প্রতিহতের কথা বলছে।
ধারণা করা হচ্ছে যে এবার ৪৮ ঘণ্টার হরতাল আসছে। সরকার খুব দ্রুত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ পূর্ণাঙ্গ রায় আমরা এখনো পাইনি। এরই মধ্যে প্রধান বিচারপতি অবসরে চলে গেছেন। নূ্যনতম ছয় মাস প্রয়োজন হবে পূর্ণাঙ্গ রায়টি পেতে। এর আগেই বিশেষ কমিটির মাধ্যমে প্রস্তাব দিয়ে কেবিনেটে তা পাস করিয়ে সরকার খুব দ্রুত সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীটি পাস করিয়ে নিতে চাইছে। এটা চলমান রাজনীতির জন্য কোনো ভালো খবর নয়। বিশেষ কমিটি গত ৪ মে সব সম্পাদকদের সঙ্গে যখন মতবিনিময় করেছিলেন সেদিন সম্পাদকরা একবাক্যে সবাই বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে বিলটি সংসদে পাস করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এখন মনে হচ্ছে সম্পাদকদের এই বক্তব্যও উপেক্ষিত হলো। ৮ জুন সংসদের বিশেষ কমিটির রিপোর্টে সংসদে উপস্থাপনের ১২ দিনের মাথায় কেবিনেট তা অনুমোদনের মধ্য দিয়ে চলমান রাজনীতিতে যে 'সঙ্কটের' সূচনা হলো, তা আমাদের জন্য আদৌ কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। এমনিতেই আমরা 'ব্যর্থ রাষ্ট্র' হিসেবে স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছি। বিখ্যাত 'ফরেন পলিসি' ম্যাগাজিনে ১৭৭টি দেশ নিয়ে যে 'ব্যর্থ রাষ্ট্র'-এর তালিকা সম্প্রতি তৈরি করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ২৫তম। বাংলাদেশে প্রতি ৫ জনের মধ্যে ২ জনই দরিদ্র। এমনি এক পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে দু'দলের মাঝে বিরোধ ও নূ্যনতম ঐকমত্যে পৌঁছানোর ব্যর্থতা 'ব্যর্থ রাষ্ট্র'-এর ধারণাকে আরো শক্তিশালী করবে মাত্র।
ড. তারেক শামসুর রেহমানঃ অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[সূত্রঃ যায় যায় দিন, ২৭/০৬/১১]
0 comments:
Post a Comment