রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

রাজনীতি কার স্বার্থে

রাজনীতি কার স্বার্থে
তা রে ক শা ম সু র রে হ মা ন
রাজনীতিকরা রাজনীতি করেন জনগণের মঙ্গলের জন্য। নির্বাচনের আগে তারা ভোট চান। জনগণ তাদের ভোট দেয়। দল জিতলে কেউ মন্ত্রী হন। কেউ মন্ত্রীর পদমর্যাদায় উপদেষ্টা হন। কিন্তু জনগণের মঙ্গল তারা করেন কতটুকু? একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকবে পাঁচ বছরÑ এটা ঠিক আছে। কিন্তু এ পাঁচ বছরে তাদের জবাবদিহি করার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। আজকে বাংলাদেশের যে পরিস্থিতি তাতে করে এ প্রশ্নটাই ঘুরে-ফিরে আসছে, রাজনীতি কার স্বার্থে! সরকার ও বিরোধী দল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে দুটি বড় দল এখন মুখোমুখি অবস্থানে। বিরোধী দলনেত্রী সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন ১৬ জুন। এর জবাব দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সংবাদ সম্মেলন করলেন ১৭ জুন। বিএনপি আবার ১৮ জুন আরেকটি ব্রিফিং করেছে। তাহলে কী এভাবে সংবাদ সম্মেলন ও পাল্টা সংবাদ সম্মেলন চলতে থাকবে? এরই মধ্যে আবার বিএনপি হুমকি দিয়েছে প্রয়োজনে ৭২ ঘণ্টা লাগাতার হরতাল দেয়া হবে। হরতাল দিয়ে সরকারের পতন ঘটানো যায় না। এ কথাটা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ জাতিকে জানান দিতে ভোলেননি। হরতালে ভোগান্তি বাড়ে ‘পাবলিকের’, যারা ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে। হরতালে রাজনীতিকদের তেমন ক্ষতি হয় না। অতীতে, আমার স্পষ্ট মনে আছে, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীকে (যখন তিনি বিরোধী শিবিরে) পুলিশ পিটিয়ে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল। রাস্তায় শুয়ে থাকা মতিয়া চৌধুরীর ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। আজ দেখলাম মির্জা ফখরুল ইসলামের ছবিÑ পুলিশ তাকেও পিটিয়েছে। ‘পুলিশের কাজ পুলিশ করে’, শুধু বদলে যায় দৃশ্যপট, মতিয়া চৌধুরীর পরিবর্তে মির্জা ফখরুল। কিন্তু আমজনতা তাতে কতটুকু উপকৃত হয়েছে? সরকার ওয়াদা করেছিল চালের দাম কমাবে। কমাতে পারেনি। তিনবেলা যে লোক ভাতের ওপর নির্ভরশীল, তার সরকারকে গালাগাল দেয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না। ১৮ জুনের সংবাদপত্রের খবরÑ ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে। বোতলজাত সয়াবিন তেল (যা বাহ্যত পাম অয়েল) বিক্রি হচ্ছে ১২৩ থেকে ১২৫ টাকায়। চিনি ৬৪ থেকে ৬৬ টাকা। সরকার জানিয়ে দিয়েছে তারা আর বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে না। আর ব্যবসায়ীরা তো এটাই চেয়েছে। বাজারে দাম বাড়লে কার কী? সরকার কিংবা বিরোধী দলÑ কারোরই মাথাব্যথা নেই। বিশাল এক বাজেট নিয়ে আসছে সরকার। দিনাজপুর থেকে ঢাকায় আসা ‘সিজনাল’ রিকশাওয়ালা মতিন বাজেট বোঝে না। কিন্তু অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব বোঝেন। বিশাল বাজেট বাস্তবায়নে ঝুঁকি মোকাবেলায় আইএমএফ থেকে কঠিন শর্তে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে সরকার। এটা আমাদের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী কিনা, এ ব্যাপারে বক্তব্য নেই বিরোধী দলের। সরকার ঋণ নিচ্ছে তার স্বার্থে। আমলাদের শেখানো বুলি আউড়িয়ে যাচ্ছেন আরেক সাবেক আমলা, আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কনোকোর সঙ্গে চুক্তি করল সরকার। বিকিয়ে দেয়া হল আমাদের জাতীয় স্বার্থ (আশিভাগ রফতানি, গ্যাস কিনতে হবে ৫০ থেকে ১০০ গুণ বেশি দামে, ২০ শতাংশ আনতে হবে বাংলাদেশের খরচে পাইপলাইন করে সমুদ্র থেকে)। কিন্তু বিএনপি তথা চার দলের বক্তব্য নেই এ ব্যাপারে। ডলার সংকটের (কিনতে হচ্ছে ৭৬ টাকায়) কারণে পণ্য আমদানিতে এলসি খোলা যাচ্ছে না। কাঁচামালের আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। ডলার পেতে বাড়ছে ভোগান্তি। অর্থনীতির এই ‘অশনি সংকেত’ নিয়ে কারও কোন মাথাব্যথা নেই। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা, রেমিটেন্সের প্রবাহ বাড়ানোর উদ্যোগও কোন ফল দিচ্ছে না। সুশাসনে ব্যর্থতা চোখে লাগার মতো। এসব ক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে সমঝোতা প্রয়োজন ছিল। না, এসব প্রশ্নে কারও কোন উদ্যোগ নেই। আমরা এখন আটকে আছি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকবে কী থাকবে না, তা নিয়ে।
১৭ জুন সৈয়দ আশরাফ সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়ে দিলেন, ‘বিএনপি সংলাপে না থাকলে তত্ত্বাবধায়ক ছাড়াই নির্বাচন’ (যুগান্তর, ১৮ জুন)। আর মির্জা ফখরুল বললেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আলোচনার কোন সুযোগ নেই’ (যুগান্তর, ওই)। তাহলে সমাধানটা কোন পথে? লাগাতার ৭২ ঘণ্টার হরতাল কি সমাধান? সরকার কি চাচ্ছে বিএনপি ওই পথে যাক ও জনতার ভেতর থেকে প্রতিবাদ উঠুক! সৈয়দ আশরাফের বক্তব্য অনেকটা হঠকারী। নির্বাচনের বাকি আছে আরও আড়াই বছর। এখনই নির্বাচন নিয়ে আগাম মন্তব্য করা ঠিক নয়। সরকারে যিনি বা যারা থাকেন, তাদের সহনশীল হতে হয়। তাদের সহ্যশক্তি থাকতে হয়। সৈয়দ আশরাফ সিনিয়র নেতা। তার এ ধরনের উক্তি শোভন নয়। এতে জটিলতা আরও বাড়বে। বরং খালেদা জিয়ার বক্তব্যকে বিবেচনায় নিয়ে তিনি কিছু মন্তব্য করতে পারতেন। খালেদা জিয়া দুটো জিনিস বলেছেন। এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকবে। দুই. সদ্য অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক প্রধান উপদেষ্টা হতে পারবেন না। দুটো বক্তব্যের পেছনেই যথেষ্ট যুক্তি আছে। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক সরকারকে একটি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছেন। তার নানা ‘কাহিনী’ সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। এর একটিরও তিনি প্রতিবাদ করেননি। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ১০ লাখ টাকা গ্রহণের অভিযোগও তিনি অস্বীকার করেননি। সুতরাং মানুষ ধরেই নেবে উত্থাপিত অভিযোগগুলোর পেছনে সত্যতা আছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে আমি অনুরাধ করব বিচারপতি হককে, তিনি যেন বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দেন তিনি প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করবেন না। এতে করে সরকারের অবস্থান কিছুটা হলেও শক্তিশালী হবে। দ্বিতীয়ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে উচ্চ আদালতের রায়কে বিবেচনায় নিয়ে (দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকার) সরকার নিজে অথবা শরিকদের কারোর মাধ্যমে একটি প্রস্তাব সংসদে উপস্থাপন করতে পারে। তখন আমার বিশ্বাস আলোচনায় বিএনপি অংশ নেবে। এর আগে সংসদে এসে বিএনপিকে প্রস্তাব দেয়ার প্রয়োজন নেই। খালেদা জিয়ার বক্তব্যকে প্রস্তাব হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করা যায়। দুই পক্ষের মাঝে আলোচনার প্রয়োজন আছে। সংসদের বাইরেও আলোচনা হতে পারে। এমনকি তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমেও (যিনি বা যারা দুই পক্ষের বন্ধু) আলোচনার সূত্রপাত করা যায়। আমি বিশ্বাস করি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মাঝে এমন কিছু শুভবুদ্ধির মানুষ আছেন, যারা চান আলাপ-আলোচনা হোক। সেটা যে সংসদেই হতে হবে, তার কোন মানে নেই। এমনকি আমাদের সিনিয়র সিটিজেনদের কেউ কেউও এগিয়ে আসতে পারেন।
দেশের সমস্যা এখন অনেক। অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়। বেকারত্ব বাড়ছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ নেই। বৈদেশিক বিনিয়োগের অবস্থাও ভালো নয়। মন্ত্রী ও উপদেষ্টারা বেশি কথা বলেন। সুশাসন নিয়ে নানা প্রশ্ন এখন। র‌্যাবের অনেক ভালো কাজ ম্লান হয়ে গেছে দু’-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনায়। আমরা ভুলে যাই র‌্যাবকে এখন দেশের বাইরে থেকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আসরে মানবাধিকারের প্রশ্নটিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া হয়। আমরা চাই না র‌্যাব একটি বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হোক। এসব ক্ষেত্রেও বিরোধী দলের মতামত থাকা প্রয়োজন। কেননা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে বিরোধী দলের ভূমিকা উপেক্ষা করা যায় না।
মহাÍা গান্ধী একটা কথা বলেছিলেন। তার ভাষায় ‘যতক্ষণ পর্যন্ত না সকলে ক্ষমতার অংশীদার হয়ে ওঠে সে অবধি গণতন্ত্র অসম্ভব; গণতন্ত্রকে তাই বলে জনতাতন্ত্রে (গড়নড়পৎধপু) পর্যবসিত করা যাবে না।’ সরকারের কর্মকাণ্ড দেখে গান্ধীর উক্তিটি মনে পড়ে গেল। গণতন্ত্রে বিরোধী দল সরকারের একটি অংশ। তাই অবশ্যই তাকে ক্ষমতার অংশীদার হতে হবে। এর অর্থ এই নয়, বিএনপিকে মন্ত্রিসভায় নিতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে নীতিনির্ধারণীতে বিএনপির অংশগ্রহণ থাকা। সরকারের নীতির সমালোচনা করে, নতুন প্রস্তাব উত্থাপন করে বিএনপি তার অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে পারে। আর সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপিকে ভূমিকা পালনে সুযোগ দেয়া। এক্ষেত্রে সরকার যদি এককভাবে সব কাজ সম্পন্ন করে তাহলে তা পরিণত হবে জনতাতন্ত্রে, যাতে জনগণের মঙ্গল নিহিত থাকবে না। বর্তমান সরকারের কর্মকাণ্ড তাদের ‘জনতাতন্ত্রের’ দিকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা যে সংকটের মুখোমুখি, তার সমাধান হতে পারে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে। আর তা যে সংসদেই হতে হবে, তার কোন মানে নেই।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


0 comments:

Post a Comment