রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

রুমানার জন্য দুঃখবোধ





মুত্যুর সাথে লড়ছেন রুমানা
নারী নির্যাতন একটা অপরাধ। যারা অপরাধ করে, রাষ্ট্র যদি তাদের 'সুযোগ' করে দেয়, তাহলে অপরাধীর সংখ্যা এ দেশে বাড়বেই। আইন আছে। কিন্তু আইনের সঠিক প্রয়োগ হয় না। অনেক সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্লিপ্ততার সুযোগ নেয় অপরাধীরা। রুমানার নির্যাতনকারীর ক্ষেত্রেও এমনটি হতে যাচ্ছিল, যদি উচ্চ আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল ইস্যু না করতেন। আদালত রুল ইস্যু করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গ্রেফতার করা হয় 'স্বামী' নামের বর্বরটিকে।

রুমানার খবরটা যখন আমি পত্রিকায় পড়লাম, তখন আমি সিলেটে। সংবাদটা বারবার পড়েছি আর বোঝার চেষ্টা করেছি এই সমাজটা তাহলে কোথায় যাচ্ছে? এই সমাজ একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকাকে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ঘটনা হয়তো নয়, কিংবা এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ঘটেনি, কিন্তু তবুও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তো একটা দায়িত্ব ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি আহত, নিগৃহীত, অসম্মানিত একজন শিক্ষিকার ব্যাপারে তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা যখন ওই ঘটনার প্রতিবাদে 'মানববন্ধন' করেছিল, মৌন মিছিল করেছিল, আমি সেখানে উপাচার্যকে অংশ নিতে দেখিনি। নিদেনপক্ষে যে ছবি ছাপা হয়েছে সেখানে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য তাদের কারও ছবি আমি দেখিনি। এটা কি কোনো অপরাধ ছিল না? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক যখন হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন, যেখানে তার চিরদিনের জন্য দৃষ্টিহীন হয়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, সেখানে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনুপস্থিত। কেন? তারা তো হাজারটা 'প্রতিবাদী অনুষ্ঠানে' উপস্থিত থাকেন। রুমানার ঘটনায় তাদের প্রতিবাদটা কি আরও জোরালো হতে পারত না? শুনেছি অসুস্থ এবং প্রায় অন্ধ রুমানাকে যখন ঢাকা বিমানবন্দর থেকে চেন্নাই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেদিনও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কেউ যাননি। বিশেষ ব্যবস্থা করার জন্য বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকেও বলা হয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এটা কি শুধুই অবহেলা? মাননীয় রাষ্ট্রপতি বারবার শিক্ষার মানোন্নয়নের কথা বলেন। কিন্তু একজন শিক্ষিকা যেখানে নির্যাতনের শিকার হন, যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যায়, সেখানে শিক্ষকদের কাছ থেকে শিক্ষার মানোন্নয়ন আশা করি কীভাবে? আমাকে এ ঘটনা আরও পীড়া দেয়, যখন শুনি ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় (যেখানে রুমানা সর্বশেষ ছাত্রী ছিলেন। আছেন এখনও) রুমানার সব চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে নিজেরাই এগিয়ে এসেছে। শুধু তাই নয়, তারা রুমানার উচ্চশিক্ষার সব ব্যয়ভারও বহন করবে। কিন্তু যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন রুমানা, ছিলেন শিক্ষক, সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার দায় এড়িয়ে গেল! রুমানার উন্নত চিকিৎসা দরকার। দরকার প্রচুর অর্থের। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় যদি এগিয়ে আসত, আমি খুশি হতাম।


দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলা রুমানার এই ছবিটি কেবলই স্মৃতি
রুমানা আমার সহকর্মী। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশাল ভাণ্ডারে আমরা কাজ করি। আমি যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে যোগ দিতে পারতাম, তাহলে রুমানা আমার ছাত্রী হতে পারতেন। ওর অনেক বন্ধু কিংবা এক-দু'বছরের সিনিয়র আমার সহকর্মী। তাদের সবাইকে নিয়ে আমি গর্ব করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তরুণ শিক্ষকদের সবাই আমার প্রিয়। তারা সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল। সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক যখন নির্যাতনের শিকার হন, তখন এই দুঃখবোধ আমি রাখি কোথায়? একটি ঘটনা আরেকটি ঘটনার জন্ম দেয়। এর আগেও ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও একজন নারী শিক্ষক যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। যৌন নির্যাতনকারীকে আমরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারিনি। নারী নির্যাতন একটা অপরাধ। যারা অপরাধ করে, রাষ্ট্র যদি তাদের 'সুযোগ' করে দেয়, তাহলে অপরাধীর সংখ্যা এ দেশে বাড়বেই। আইন আছে। কিন্তু আইনের সঠিক প্রয়োগ হয় না। অনেক সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্লিপ্ততার সুযোগ নেয় অপরাধীরা। রুমানার নির্যাতনকারীর ক্ষেত্রেও এমনটি হতে যাচ্ছিল, যদি উচ্চ আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল ইস্যু না করতেন। আদালত রুল ইস্যু করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গ্রেফতার করা হয় 'স্বামী' নামের বর্বরটিকে। উচ্চ আদালতের ওই দুই বিচারপতিকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাদের ছোট করতে চাই না। কিন্তু উচ্চ আদালত ক'টি ঘটনায় এ ধরনের রুল ইস্যু করতে পেরেছেন? ক'টি ঘটনা আদালতের দৃষ্টিতে আসে? সংবাদপত্রে এ ধরনের 'স্ত্রী' নির্যাতনের খবর থাকে বটে, কিন্তু আদালতের দৃষ্টিতে সব আসে না। আর এটা উচ্চ আদালতের মুখ্য কাজও নয়। তবুও আদালতের এ ধরনের উদ্যোগে আমরা উৎসাহিত হই।

এ করুণ দৃশ্য কখনই বাংলাদেশে কাম্য নয়
'স্বামী' নামের ক্রিমিনাল সাইদ তার দোষ কিছুটা হলেও স্বীকার করেছে। আইন তার নিজ গতিতেই চলবে। হয়তো তার শাস্তিও হবে, কিন্তু এটাই কি শেষ? এ সমাজে একজন শিক্ষিকা যদি তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হন, তাহলে সমাজের অন্যদের নিরাপত্তা কে দেবে? ক্যাম্পাসগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। সেখানেও শিক্ষিকারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আর দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব ক্ষেত্রে 'রাজনৈতিক বিবেচনা' প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন নির্যাতনের ঘটনা, যেখানে শিক্ষিকারাও আক্রান্ত হচ্ছেন, উচ্চশিক্ষার পথে প্রধান অন্তরায়। সবাই আমরা যদি সচেতন না হই, যদি প্রতিবাদমুখর না হই, তাহলে ভয়াবহ আকারে তা ছড়িয়ে পড়বে সব ক্যাম্পাসে। তাই আসুন, সবাই মিলে যৌন নির্যাতনকারীকে আমরা ঘৃণা করি।

রুমানা মঞ্জুর এখনও বিপদমুক্ত নন। চেন্নাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে এক মাস পর আবার যেতে বলেছে। রুমানার ভালো চিকিৎসা দরকার এবং তা বিদেশে। রুমানাকে বলি, আপনি ভেঙে পড়বেন না। আপনার বিভাগের আপনার শিক্ষক, আপনার ছাত্ররা যেমনি আপনার পাশে আছে, আমরাও আছি আপনার পাশে। এই সমাজের দুষ্ট কীটদের বিরুদ্ধে আপনাকে দাঁড়াতে হবে। আপনাকে হতে হবে প্রতিবাদী। দেশবাসীকে দেখাতে হবে আপনিও পারেন। আপনি ভেঙে পড়বেন না, প্লিজ। আমি জানি আপনার ওপর দিয়ে যে 'ঝড়' বয়ে গেছে, সেই ঝড়ে টিকে থাকা কঠিন। কিন্তু টিকে আপনাকে থাকতেই হবে। তা যে শুধু আপনার কন্যা অনুসূয়া, শুধু ওর জন্যই নয়, বরং এ দেশের নারী সমাজের জন্য, প্রতিবাদের 'প্রতীক' হয়ে থাকার জন্য। একজন বর্বর ক্রিমিনাল সাইদের 'হত্যা প্রচেষ্টায়' প্রতিবাদী হয়ে আপনি সাংবাদিকদের আপনার কথা জানিয়েছেন। আমি আপনার এ সাহসী উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। সাধারণত আমাদের সমাজের মেয়েরা এসব ঘটনা চেপে যান। মান-সম্মানের ভয়ে তারা কথা বলেন না। আপনি বলেছেন। আপনার এ 'সাহস' আমাদের সবাইকে আলোকিত করুক। আরও একটা কথা। নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১ নিয়ে তো অনেক কথাই হলো। একটি হরতালও হয়ে গেল। একজন রুমানা মঞ্জুর যখন আহত হন, যখন তার জীবন বিপন্ন, তখন নারী নীতিমালা-২০১১ কী কথা বলে? আমরা তো CEDAW-এর কথাও শুনেছিলাম। জাতিসংঘে ১৯৮১ সালে গৃহীত CEDAW সনদ বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালে অনুসমর্থন করে (চারটি ধারা)। এটা ছিল নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আইনের সংশোধন। কিন্তু CEDAW সনদ বাংলাদেশের রুমানা মঞ্জুরকেও তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাহায্য করেনি। যদিও বৈষম্যের কথা বলা হয়েছে, নিরাপত্তার কথা বলা হয়নি। কিন্তু নারী যখন আক্রান্ত হয়, তখন বৈষম্যের প্রশ্ন ওঠে বৈকি! আমাদের সংবিধানে (২৮-২) নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। আমি নারীকে সেভাবেই দেখি। তাই একজন রুমানা মঞ্জুর যখন নির্যাতনের শিকার হন, তখন একটা লজ্জা, দুঃখবোধ আমাকে তাড়িত করে। আমি সত্যিই দুঃখিত রুমানা।
প্রফেসর ড. তারেক শামসুর রেহমান : শিক্ষক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
[সূত্রঃ সমকাল, ২১/০৬/১১]

0 comments:

Post a Comment