বিশেষ কমিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করার পক্ষেমত দেয়ার পরও সুযোগ রয়েছে বিকল্প একটি প্রস্তাব সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার। যেমন, সংসদ সিদ্ধান্ত নিতে পারে আগামী দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ একটি নির্দলীয় সরকারের (তত্ত্বাবধায়ক কথাটা ব্যবহার না করাই শ্রেয়) অধীনে অনুষ্ঠিত হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সম্পর্কে উচ্চ আদালতের রায়, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য এবং সর্বশেষ ৫ জুন চারদলীয় জোট কর্তৃক হরতাল পালনের পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, একটি বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হতে পারে কিনা। উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছেন। তবে এ রায় সর্বসম্মতিক্রমে হয়নি বলেই পত্রিকার ভাষ্যবলে আমরা জানতে পেরেছি। যদি সত্যি সত্যিই সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে এ রায় হয়ে থাকে, তাহলে একটা প্রশ্ন থাকবেই যে, বিচারপতিদের কেউ কেউ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুরোপুরিভাবে বাতিল করার পক্ষে ছিলেন না। প্রধানমন্ত্রী উচ্চ আদালতের রায়ের কথা বলেছেন। উচ্চ আদালত সংবিধান সংশোধন করতে পারেন না। সংবিধানের ১৪২(১) ধারা অনুযায়ী সংবিধানের কোন বিধান সংযোজন, পরিবর্তন কিংবা প্রতিস্থাপনের অধিকার রাখে জাতীয় সংসদ। উচ্চ আদালত শুধু মতামত দিতে পারেন, সংবিধানের কোন ধারার ব্যাখ্যা দিতে পারেন এবং কোন আইন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিনা, সে ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। এখন উচ্চ আদালত একটি রায় দিয়েছেন, তাতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী (তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা) বাতিল করা হয়েছে। এখন সংসদ ওই রায় বিবেচনায় নিতে পারে। সংসদের কাছে বিকল্প সুযোগও আছে। যেহেতু প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তথা চার দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার কথা বলছে, সেহেতু বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকট এড়াতে সংসদ একটি বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করতে পারে এবং সর্বসম্মতিক্রমে সংবিধানের ৫৮(খ), ৫৮(গ) ও ৫৮(ঘ) ধারাগুলো নতুন একটি ধারা দ্বারা প্রতিস্থাপন করতে পারে। এ জন্য সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। তাদের উদার হতে হবে। বিএনপিকেও আলোচনার ব্যাপারে আগ্রহী থাকতে হবে।
সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে বিশেষ কমিটি তাদের সুপারিশের খসড়া চূড়ান্ত করেছে। সুপারিশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের কথা বলা হয়েছে। তবে এই সুপারিশই চূড়ান্ত নয় নিয়মানুযায়ী বিষয়টি নিয়ে সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হবে, মন্ত্রিসভায় নীতিগত সিদ্ধান্ত হবে, বিল তৈরি হবে, আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংয়ের মধ্য দিয়ে টেকনিক্যালিটি যাচাই হবে, আবার মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর সংসদে বিল আকারে তুলতে হবে। এরপর সংসদে আইন আকারে পাস করার আগে আবার কমিটিতে যাবে। সেখান থেকে রিপোর্ট পাওয়ার পর সংসদে ভোটের মাধ্যমে পাস হবে। পথটা দীর্ঘ। পাস হতেও সময় লাগে। সুতরাং তড়িঘড়ি করে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। বিএনপি ও চারদলীয় জোট হরতাল আহ্বান করে তাদের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে। সরকারি দল এটাকে বিবেচনায় নিতে পারে। এককভাবে যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়, তাহলে সেটা হবে ভুল।
রাজনীতিতে সহনশীলতা থাকতে হয়। বিরোধী দলের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে হয়। এর নামই গণতন্ত্র। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় বটে এবং তা সাংবিধানিকভাবে বৈধও বটে। কিন্তু তা গণতান্ত্রিক স্পিরিটের পরিপন্থী। গণতান্ত্রিক স্পিরিট হচ্ছে বিরোধী দলের মতামত নেয়া এবং বিরোধী দলের মতামতের ভিত্তিতেই আইন প্রণয়ন করা। এটি না হলে এদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। এবং অসাংবিধানিক শক্তিগুলো এ থেকে ফায়দা উঠাবে। বিশেষ কমিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করার পক্ষে মত দেয়ার পরও সুযোগ রয়েছে বিকল্প একটি প্রস্তাব সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার। যেমন, সংসদ সিদ্ধান্ত নিতে পারে আগামী দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ একটি নির্দলীয় সরকারের (তত্ত্বাবধায়ক কথাটা ব্যবহার না করাই শ্রেয়) অধীনে অনুষ্ঠিত হবে। একটি তিন সদস্যবিশিষ্ট ‘এলডার্স কাউন্সিল’ এই নির্বাচন পরিচালনা করবে। এই ‘এলডার্স কাউন্সিল’ গঠিত হবে সাবেক একজন প্রধান বিচারপতি, একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সুশীল সমাজের একজন প্রতিনিধির সমন্বয়ে। বিরোধী দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে এই ‘এলডার্স কাউন্সিল’ গঠন করা হবে। এরা ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করবে এবং কোন নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। তাদের সহযোগিতার জন্য একটি উপদেষ্টামণ্ডলী থাকতে পারে। রাষ্ট্রপতি তার পদে বহাল থাকবেন। কিন্তু তিনি কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। এই কাউন্সিল নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে পারবে। সেনাবাহিনীর সহযোগিতাও তারা নিতে পারবে। কোন অবস্থাতেই সদ্য অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতিকে কোন প্রক্রিয়ায় জড়িত করানো যাবে না। দ্বাদশ পার্লামেন্ট নির্বাচন আয়োজন করবে নির্বাচন কমিশন। এ জন্য সিইসি কিংবা নির্বাচন কমিশনারদের নিযুক্তিতে নিরপেক্ষতা যাতে নিশ্চিত হয়, সে ব্যাপারে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের দেশের আমলাদের মাঝে (সামরিক ও বেসামরিক) ‘রাজনীতি’ করার একটা প্রবণতা দেখা যায়। চাকরিজীবনের শেষের দিনগুলোতে তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং অবসরে যাওয়ার পরপরই তারা একেকজন ‘রাজনীতিক’ হয়ে যান। তাদের টার্গেট থাকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়া। এই প্রবণতা খারাপ। যাদের সঙ্গে এলাকার জনগণের কোন যোগাযোগ নেই, জনগণের দুঃখ-কষ্টের ভাগীদার যারা হননি, তারা হঠাৎ করে এমপি হয়ে যান। তারা সঠিক অর্থে জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন না। এ জন্য আমলাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ন্যূনতম ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করতে হবে। ফলে তারা সচিবালয়ে বসে কোন বিশেষ দলের পক্ষে কলকাঠি নাড়াতে পারবেন না। তারা যদি বুঝতে পারেন অবসরের সঙ্গে সঙ্গেই তারা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না, তাহলে তারা নিরপেক্ষ থেকেই প্রশাসন পরিচালনা করবেন। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে আরও শক্তিশালী করা যেতে পারে। প্রয়োজনে তাদের কর্মপরিধিও আরও বাড়ানো যেতে পারে। সাংবিধানিক পদে যারা নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন, তাদের নিয়োগের দায়িত্বটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ছেড়ে দেয়া যেতে পারে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল একটাই কারণেÑ আর তা হচ্ছে নিরপেক্ষ নির্বাচন। দলীয় সরকারের অধীনে যে নির্বাচন হয়, সেই নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে। অতীতে বারবার এমনটি হয়েছে। ‘মাগুরা সিনড্রম’ আমরা এখনও কাটিয়ে উঠতে পেরেছি বলে মনে হয় না। বর্তমান সরকারের সময় ভোলায় যে উপ-নির্বাচন হয়ে গেল (২৪ এপ্রিল, ২০১০), তাতে সরকারি দলের ভোট কেন্দ্র দখল, ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধা দেয়া, সন্ত্রাস, ইত্যাদি নানা কারণে উপ-নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের যতটুকু না ভূমিকা ছিল, তার চেয়ে বেশি ভূমিকা ছিল স্থানীয় নেতৃত্বের। স্থানীয় নেতৃত্ব এটাকে ‘প্রেস্টিজ ইস্যু’ হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছিল। ফলে তাদের প্রভাবে স্থানীয় প্রশাসন ছিল অসহায়। এটাই হচ্ছে মূল সমস্যা। আমরা গণতন্ত্রকে ধারণ করলেও আমাদের মানসিকতায় কোন পরিবর্তন আসেনি। গণতন্ত্রকে আমরা আমাদের নিজেদের মতো করে দেখাতে চাই। যে কারণে মাগুরা কিংবা ভোলার মতো ঘটনা ঘটে। এই একটি বা দুটি ঘটনার জন্য দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। তাই গণতন্ত্রের স্বার্থেই আরও দুই টার্ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সম্পন্ন করা প্রয়োজন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে প্রধান দুটি দলের অবস্থান পরস্পরবিরোধী। প্রধানমন্ত্রী, যিনি আওয়ামী লীগেরও প্রধান বটে, তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে বলছেন। অপরদিকে বিরোধী দল বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে কথা বলছে। এক্ষেত্রে বেগম জিয়ার বক্তব্যে একটি সমস্যার কথাও এসেছেÑ সেটি হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখা হলে ৫৮গ(৩) ধারা মতে সদ্য অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকই হবেন প্রধান উপদেষ্টা। কিন্তু এবিএম খায়রুল হকের ব্যাপারে বেগম জিয়া তথা বিএনপির রয়েছে প্রবল আপত্তি। তিনি দুই-দুইবার অপরকে ডিঙিয়ে প্রধান বিচারপতি হয়েছেন। উপরন্তু তার দেয়া সংবিধানের পঞ্চম, সপ্তম, ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত রায় এবং বেগম জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি সংক্রান্ত রায় তাকে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। এ জন্য বিএনপিকে সুস্পষ্ট ফর্মুলা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। বিএনপি দুই টার্মের নিরপেক্ষ সরকারের ফর্মুলা উপস্থাপন করতে পারে। সংসদের আলোচনায়ও এ প্রস্তাব উপস্থাপন করতে পারে বিএনপি। এমনকি বিএনপির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে তাদের বিকল্প মতামত জানিয়ে দেয়াও সম্ভব। মোট কথা, বিএনপিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের বিরোধিতা করলেই চলবে না, বরং দলটিকে একটি বিকল্প প্রস্তাব উপস্থাপন করতে হবে। সরকার তখন ওই প্রস্তাব বিবেচনায় না নিয়ে পারবে না।
হরতাল দিয়ে নতুন করে যে ‘রাজনীতি’ শুরু হল, তাতে করে আগামীতে সংকট আরও বাড়তে পারে। লাগাতার হরতালের হুমকি দিয়েছে বিএনপি। সরকারের বয়স রয়েছে আরও প্রায় ৩২ মাস। সময়টা অনেক লম্বা। এরই সঙ্গে বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকটের আশংকা করছি আমরা। দুটি বড় দলের মাঝে জাতীয় ইস্যুতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হলে তা সংকটকে আরও গভীরতর করবে মাত্র। ৫ মে’র হরতাল একটা দাবিকে উস্কে দিল। চাই সমঝোতা, চাই ন্যূনতম ঐক্য।
[পূর্বে প্রকাশ @ দৈনিক যুগান্তর -০৭ জুন ২০১১ ]
[পূর্বে প্রকাশ @ দৈনিক যুগান্তর -০৭ জুন ২০১১ ]
0 comments:
Post a Comment