রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

গণতন্ত্রের জন্য...


গণতন্ত্র নিয়ে এই ধরণের হাস্যরস কাম্য নয়

গণতন্ত্রের জন্য...

ড. তারেক শামসুর রেহমান

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৬তম প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্ট (১৯০১-১৯০৯) একবার বলেছিলেন, This country will not be a good place for aসচ of us to live in unless we make it a good place for all of us to live in| বাংলা করলে অনেকটা এ রকম দাঁড়ায়-'এ দেশকে যদি আমরা সবার বসবাসের জন্য ভালো জায়গা হিসেবে গড়ে না তুলি, তাহলে এটি আমাদের কারো বসবাসের জন্যই ভালো জায়গা হয়ে উঠবে না।' আজ বাংলাদেশের পরিস্থিতি দেখে কেন জানি প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্টের উক্তিটি মনে পড়ে গেল। এ দেশে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় না_এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন শেখ হাসিনা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে হরতাল পর্যন্ত হয়েছিল। আজ শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী। দ্বিতীয়বারের মতো তিনি এ দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। মানুষ তাঁর দলকে ভোট দিয়েছে। তাঁর কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। কিন্তু সেই তিনিই এখন চাচ্ছেন না, সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকুক। যুক্তি হচ্ছে আপিল বিভাগের একটি রায়। আপিল বিভাগের রায় মানতে আমরা বাধ্য। কিন্তু রায় মানলে তো পুরোটা (পর্যবেক্ষণসহ) মানাই শ্রেয়। রায়ের একটি অংশ মেনে, অপর অংশকে বাদ দিলে প্রশ্ন তো উঠবেই। রায়ে যেমনি বলা হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ, তেমনি বলা হয়েছে_'জনগণ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই যেহেতু সর্বোচ্চ আইন, সে কারণে প্রয়োজনের নিরিখে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনেই অনুষ্ঠিত হতে পারবে।' সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ সংসদীয় কমিটি সংবিধান সংশোধনের জন্য যে ৫১ দফা সুপারিশ করেছে, তাতে এই অংশটুকু না থাকায় বিতর্ক ও বিভ্রান্তি বেড়েছে। আজ জাতি এক বড় ধরনের সংকটের মুখোমুখি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময়ে শেখ হাসিনার আহ্বানে হরতাল হয়েছিল।

আজ প্রায় ১৭ বছর পর খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার দাবিতে হরতাল করলেন। ভয়ের কারণ যেটা তা হচ্ছে, এরপর ৩৬ ঘণ্টা নয়, লাগাতার ৪৮ ঘণ্টা কিংবা একটানা সাত দিনও হরতাল হতে পারে। এমন ধরনের একটি সম্ভাবনার কথা আমাদের জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এই যে পরিস্থিতি, এই পরিস্থিতিতে মনে পড়ে গেল রুজভেল্টের উক্তিটি, যেখানে তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন-দেশকে যদি সবাই মিলে গড়ে না তুলি, তাহলে দেশটি কারো জন্যই বসবাসের ভালো জায়গা হবে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই উক্তিটি কত সঠিক! দেশকে গড়ার দায়িত্ব তো রাজনীতিবিদদের। প্রধানমন্ত্রী বারবার বলছেন 'অদৃশ্য শক্তি'র কথা। কিন্তু নিজেরা মিলে সমস্যার যদি সমাধান করা না যায়, তাহলে 'অদৃশ্য শক্তি'কে কে রুখবে?

গণতন্ত্রের অভিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বিধান থাকতে পারে না_এটা সত্য। কিন্তু আমরা গুলিয়ে ফেলি এক জায়গায়_উন্নত বিশ্বের গণতন্ত্রচর্চার সঙ্গে উন্নয়নশীল বিশ্বের গণতন্ত্র চর্চাকে মেলানো যাবে না। ইউরোপের গণতন্ত্রচর্চার ইতিহাস অনেক পুরনো। আমরা সেই স্তরে এখনো পৌঁছতে পারিনি। আমাদের সমাজে গণতন্ত্রের বিকাশের স্বার্থেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মতো একটি ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। এ জন্য সংবিধান যে পরিবর্তন করতে হয়, সেটাও অমূলক নয়। জিম্বাবুয়েতে ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর সেখানে যে সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছিল, তার সমাধান হয়েছিল বিরোধী দলের নেতা সাভাঙ্গিরাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তির মধ্য দিয়ে। অথচ জিম্বাবুয়ের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর কোনো পদ ছিল না। এর আগে ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে একই ধরনের ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি কেনিয়ায়। প্রেসিডেন্ট কিবাকি ও বিরোধী দলের নেতা রাইলা ওডিঙ্গার মধ্যকার দ্বন্দ্বে সেখানে অনেক লোক মারা যায়। শেষ পর্যন্ত বিদেশিদের মধ্যস্থতায় ওডিঙ্গাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগের মধ্য দিয়ে কেনিয়ার গণতন্ত্র একটা সমাধান খুঁজে পায়। কেনিয়ার সংবিধানেও কোনো প্রধানমন্ত্রীর পদ ছিল না। প্রথমে কেনিয়া ও পরে জিম্বাবুয়ের ঘটনাবলি প্রমাণ করে, উন্নয়নশীল বিশ্বে গণতন্ত্রকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যেতে হলে কোনো কোনো রাষ্ট্রকে কখনো-সখনো সংবিধানবিরোধী সিদ্ধান্ত নিতে হয়। শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধপরবর্তী সময়ে এমন সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা গণতন্ত্রের পরিপন্থী; অথচ জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তা মেনে নেওয়া হয়েছে। আমি এ রকম অনেক দৃষ্টান্ত দিতে পারব, যেখানে গণতন্ত্রের স্বার্থেই রাষ্ট্র এমন সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা প্রকারান্তরে গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা ছিল এমন একটি সিদ্ধান্ত, যা বাংলাদেশের বিকাশমান গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করেছিল। এ ব্যবস্থা বিদেশে প্রশংসিতও হয়েছিল। তবে ব্যবস্থাটি ত্রুটিমুক্ত ছিল না। তিনটি নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পরই ত্রুটিগুলো আরো স্পষ্ট হলো। এখন যদি এই ত্রুটিগুলো দূর করা যায়, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি তাতে করে আরো শক্তিশালী হবে।

নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা যায়_এটা তত্ত্বের কথা। বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা হলেও, তা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প হতে পারে না। কেননা বর্তমান সরকারই সিইসি তথা নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেবে। ফলে প্রশ্ন উঠবে তাদের আনুগত্য নিয়ে। এখন তো শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই 'রাজনীতি' করেন না, আমলারাও রাজনীতি করেন। কেউ বিএনপির আমলা, কেউ আবার আওয়ামী লীগের আমলা। রাজনৈতিক বিবেচনায় সচিব নিয়োগ হচ্ছে। কেউবা আবার বঞ্চিত হচ্ছেন। বিএনপির আমলে প্রমোশন না হওয়া ব্যক্তিরা বর্তমান সরকারের আমলে হুট করে সচিব পর্যন্ত হয়ে গেছেন-এমন দৃষ্টান্তও আছে। তাই যাঁদেরই নিয়োগ দেওয়া হবে, তাঁদের নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। আর সরকার যে তাদের স্বার্থেই এসব পদে নিয়োগ দেবে, এটা বলাই বাহুল্য। তাহলে নিরপেক্ষতা থাকল কোথায়? নির্বাচন কমিশনকে অর্থের জন্য সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। তাদের নিজস্ব তেমন জনবল নেই। গ্রামপর্যায়ে তারা প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল। সেখানে 'ম্যানিপুলেশনের' আশঙ্কা বেশি। তাই নির্বাচন যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে_তার গ্যারান্টি কে দেবে? আমরা ভারতের দৃষ্টান্ত দিই বটে, কিন্তু সেখানকার রাজনীতিবিদরা আমলাদের নিয়ন্ত্রণ করেন। আর আমাদের এখানে আমলারা নিয়ন্ত্রণ করেন রাজনীতিবিদদের। ভারতের দৃষ্টান্ত আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়।

খালেদা জিয়া ১৬ জুন সংবাদ সম্মেলন করে তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তিনি অন্য কোনো সিদ্ধান্ত মানবেন না এবং নির্বাচনে অংশও নেবেন না। পাঠক, ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনের আগের দিনগুলোর কথা স্মরণ করতে চেষ্টা করুন। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ১৯৯৬ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল। তাতে আওয়ামী লীগ অংশ নেয়নি। ফলে ওই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। এমনকি ১৯৮৬ সালে এরশাদ সাধারণ নির্বাচন দিয়ে আওয়ামী লীগকে ওই নির্বাচনে নিয়ে গেলেও তৃতীয় জাতীয় সংসদ স্থায়ী হয়নি বিএনপি অংশগ্রহণ না করার কারণে। পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, ও নবম জাতীয় সংসদ ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল একটাই কারণে_কারণ দুটি বড় দল ওইসব নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। দশম জাতীয় সংসদ নিয়ে আগাম মন্তব্য করা সঠিক নয়। নির্বাচন হবে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে। অনেক সময় বাকি। কিন্তু স্থিতিশীলতার স্বার্থে একটা সমঝোতা প্রয়োজন। বিএনপিকে সংসদে এসে নতুন করে প্রস্তাব দিতে বলেছে আওয়ামী লীগ, এর কি আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে? খালেদা জিয়া দুটো জিনিস পরিষ্কার করেছেন_এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে অন্তত আগামী দুটো সাধারণ নির্বাচনের জন্য, দুই. সংবিধানের ৫৮গ(৩) ধারায় সংশোধনী এনে সাবেক প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টার পদে নিযুক্তিতে পরিবর্তন আনতে হবে। সংসদে যে কেউ এ ব্যাপারে প্রস্তাব আনতে পারেন। সরকার যে কাউকে উৎসাহিত করতে পারে এ ধরনের প্রস্তাব আনতে। এমনকি একমাত্র নির্দলীয় সদস্যও এ প্রস্তাব আনতে পারেন। এ ক্ষেত্রে সরকারি এমপিরাও সেই প্রস্তাব সমর্থন করে একটি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন। উচ্চ আদালতের রায় ও অভিমতের অনুসরণ করেও এ ধরনের প্রস্তাব আনা যায়।

আওয়ামী লীগ যদি এককভাবে চলে, তাহলে আওয়ামী লীগ ভুল করবে। দেয়ালের লিখন বড় কঠিন, বড় বাস্তব। আর দেয়ালের লিখন থেকে আমরা কেউ শিখি না, কেউ শিক্ষাও নেই না। ১০ জুন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সংবাদ সম্মেলন করে যে বক্তব্য দিলেন, তা কোনো সমাধানের পথ নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই নির্বাচন হবে_এ ধরনের বক্তব্য জনমনে হতাশা বাড়াবে। বিএনপিকে বাধ্য করবে আরো কঠোর কর্মসূচি দিতে। হুঁশিয়ারি নয়, বরং একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য সংলাপের পথ খোঁজা এই মুহূর্তে জরুরি। গণতন্ত্রকে যদি আমরা সত্যিকারভাবে ধারণ করি, তাহলে হুমকি ও পাল্টা হুমকি পরিহার করতে হবে। গণতন্ত্রের স্বার্থেই সমঝোতা প্রয়োজন। আর গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী ও আরো উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে যদি আগামী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যায়, তা গণতন্ত্রের ভিতকে এ দেশে আরো শক্তিশালী করবে মাত্র।

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
[সূত্রঃ কালের কণ্ঠ, ১৯/০৬/১১]

0 comments:

Post a Comment