রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

প্রসঙ্গ মধ্যবর্তী নির্বাচন

সংসদ বর্জন, সংসদে দাঁড়িয়ে জাতীয় নেতাদের সম্পর্কে কটূক্তি করে কিংবা অশ্লীল বাক্য ব্যবহার করে আমরা সংসদকে অকার্যকর করে তুলেছি। এ ধারা অব্যাহত থাকলে অচিরেই রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার দাবি উঠবে। জনমত তাতে বাড়বে বৈ কমবে না। মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রশ্নে দুই দলের বিভক্তি জাতিকেও বিভক্ত করেছে। এই বিভক্তি কাম্য নয় এবং সংসদীয় রাজনীতির জন্য তা ভালোও নয়।

এখন রাজনীতিতে আলোচিত হচ্ছে মধ্যবর্তী নির্বাচন। প্রধান বিরোধী দলের পক্ষ থেকে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি করা হয়েছে। বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর এবং ব্যাপক আলোচনার দাবি রাখে। মধ্যবর্তী নির্বাচনের কোনো বিধান সংবিধানে নেই_ এটা সত্য। সেই সঙ্গে এটাও সত্য, সব সময় সবকিছু সাংবিধানিক নিয়ম মেনে হয় না। সরকার মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে পারে বা দেয়। এই মধ্যবর্তী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার তার জনপ্রিয়তা যাচাই করার সুযোগ পায়। পৃথিবীর অনেক দেশে মধ্যবর্তী নির্বাচন হয়েছে। অনেক সময় সরকার তার নিজের স্বার্থেই মধ্যবর্তী নির্বাচন দিয়ে থাকে। সরকার রাজি না হলে মধ্যবর্তী নির্বাচন দেওয়া যায় না। এটা সম্পূর্ণরূপে বর্তমান সরকারের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। সরকার না চাইলে নির্বাচন কমিশনও এককভাবে মধ্যবর্তী নির্বাচন আয়োজন করতে পারে না। মধ্যবর্তী নির্বাচনের বিষয়টি একটি রাজনৈতিক ইস্যু। বিরোধী দল এটা চাইবে, আর সরকার তাতে রাজি হবে না_ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটাই বাস্তবতা। কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক তথা রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অর্থনীতির অবস্থা যে খুব ভালো তা বলা যাবে না। পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে যাওয়াই চলতি বছরের মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতির হার ডাবল ডিজিটে পৌঁছার বড় একটি কারণ। বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক বড় অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি বেড়েছে ৪২ শতাংশ। এই ঘাটতির পরিমাণ ৫৫৭ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩৯২ কোটি ডলার।

অন্যদিকে সেবা খাতে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭৭ কোটি ডলার। বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা বা রেমিটেন্সে তেমন গতি না থাকায় চলতি হিসাবের ভারসাম্য বেশ চাপের মুখে পড়েছে। একদিকে বৈদেশিক ঋণ প্রাপ্তিতে যেমন সংকট তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে সরকারের ঋণও বাড়ছে (১১ হাজার কোটি টাকার ওপরে)। বিনিয়োগে দেখা দিয়েছে হতাশা। সংবাদপত্রে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের দশ মাসে এডিপির বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৬০ শতাংশ। বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। উপরন্তু সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের দুর্নীতি, ছাত্রলীগ নামধারীদের টেন্ডারবাজি দিন দিন বাড়ছেই। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের একটা অংশ সরকারি দল তথা সরকারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। সরকারি দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা সংসদেই এ অভিযোগ করেছেন। গত ২৬ মে পর্যন্ত শেয়ারবাজারে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছিল। তদন্ত কমিটি কিছু ব্যক্তিকে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি ঘটনায় চিহ্নিত করলেও সরকার লুট হয়ে যাওয়া কয়েক হাজার কোটি টাকা উদ্ধার কিংবা দোষীদের শাস্তির আওতায় আনার ব্যাপারে কোনো বড় ধরনের উদ্যোগ নেয়নি। ভরা মৌসুমেও চালের দাম কমেনি। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। অর্থনীতির এই যে সামগ্রিক চিহ্ন, তা কোনো আশার কথা বলে না। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি যত যুক্তিহীনই হোক না কেন, সরকারের জন্য এটা একটা অশনিসংকেত। নির্বাচিত সরকার পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবে_ এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সরকার যদি ব্যর্থতার পরিচয় দেয়, তাহলে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি শক্তিশালী হবে মাত্র।

আমরা পঞ্চম জাতীয় সংসদে দ্বাদশ সংশোধনী পাস করে সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে এসেছিলাম। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা সংসদীয় রাজনীতির স্পিরিটকে বুঝতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। সংসদ বর্জন, সংসদে দাঁড়িয়ে জাতীয় নেতাদের সম্পর্কে কটূক্তি করে কিংবা অশ্লীল বাক্য ব্যবহার করে আমরা সংসদকে অকার্যকর করে তুলেছি। এ ধারা অব্যাহত থাকলে অচিরেই রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার দাবি উঠবে। জনমত তাতে বাড়বে বৈ কমবে না। মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রশ্নে দুই দলের বিভক্তি জাতিকেও বিভক্ত করেছে। এই বিভক্তি কাম্য নয় এবং সংসদীয় রাজনীতির জন্য তা ভালোও নয়। পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের যে অভাব, তা চলমান রাজনৈতিক সংকটকে আরও গভীরতর
করবে মাত্র।
[সূত্রঃ সমকাল, ০২/০৬/১১]

0 comments:

Post a Comment