আবারো হরতাল
ড. তারেক শামসুর রেহমান
আবারো আমরা হরতাল প্রত্যক্ষ করলাম গত ৫ জুন। চারদলীয় জোট এই হরতাল আহ্বান করেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৩১ মে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন উচ্চ আদালতের রায়ের পর সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার কোনো সুযোগ নেই। এর প্রতিবাদেই চারদলীয় জোট হরতাল পালন করলো। একটি সংবাদপত্র আমাদের জানাচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে এটা ছিল ১৭৪তম হরতাল। উচ্চ আদালতের রায় ও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কতগুলো প্রশ্ন এসে যায়। এক. উচ্চ আদালত সংবিধান সংশোধন করতে পারে কি না? দুই. প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কতটুকু গ্রহণযোগ্য?
সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। একটি জাতীয় কমিটিও গঠন করা হয়েছে। চলতি সেশনেই তারা তাদের মতামত দেবেন এবং সংসদ এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নেবে। ধারণা করছি, প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পর জাতীয় কমিটিও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের সুপারিশ করবে। সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা সংসদের। সংসদের ১৪২(১) ধারায় স্পষ্ট করে বলা আছে সংবিধানের কোনো বিধান সংযোজন, পরিবর্তন বা প্রতিস্থাপনের ক্ষমতা রাখে সংসদ এবং মোট সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশের সম্মতি নিয়েই সংবিধান সংশোধন করা যায়। এখন উচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছে (তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল), এখন সেই আলোকেই সংসদকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সংসদ রায়ের একটি অংশও (আরো দুটো টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকতে পারে) বিবেচনায় নিতে পারে। সুতরাং উচ্চ আদালতের রায়ই সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত, তা বলা যাবে না। দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের কথা বলেছেন। কিন্তু এটা বাস্তবতা বির্বজিত। বাস্তবতা হচ্ছে এখনো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকা দরকার। দলীয় সরকারের আওতায় নির্বাচন হলে, তাতে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ থাকে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমাদের সংবিধানের অংশ। সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে (সংবিধানের ৫৮খ, ৫৮গ, ৫৮ঘ ধারা)। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় তিন-তিনটি নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে এবং তিনটি নির্বাচনই বহির্বিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। ওই নির্বাচন আয়োজন করেছিল একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে অতীতে আওয়ামী লীগের ভূমিকা ছিল মুখ্য। ১৯৯৬ সালে বিএনপি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করেছিল বটে; কিন্তু আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচন বয়কট করেছিল। আওয়ামী লীগের চাপের মুখেই ষষ্ঠ সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল, যা কি না সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী নামে অভিহিত। সেদিন বিএনপির এই সিদ্ধান্তকে সবাই স্বাগত জানিয়েছিল। আওয়ামী লীগ সেদিন এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেনি। বরং সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল, যা কি না তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকারও গঠন করেছিল। গেল ১৪ বছরে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে কোনো বড় ধলনের বিতর্ক হয়নি। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে যে বিতর্ক, তার প্রেক্ষাপট ভিন্ন।
এ দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তিনটি নির্বাচন হয়েছে। সপ্তম, অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এসব নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতাও পেয়েছে। আজকে যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের কথা বলছেন, তারাই ১৯৯৪-৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়েক সরকার ব্যবস্থার স্বপক্ষে সোচ্চার ছিলেন সবচেয়ে বেশি। যদি উচ্চ আদালতের রায় অনুসরণ করেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করতে হয়, তাহলে উচ্চ আদালতের সুপারিশও গ্রহণ করা যেতে পারে। অর্থাৎ পরবর্তী দু-দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় আয়োজন করা। এই সুপারিশ গ্রহণ করা না হলে, সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। একাধিক কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মানসিকতায় পরিবর্তন আসেনি, যাতে করে দলীয় সরকারের আওতায় আমরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারি। ভোলার উপনির্বাচনের দৃষ্টান্ত আমাদের সম্মুখে আছে। গত ২৪ এপ্রিল ২০১০ এই উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। সরকারি দল প্রভাব বিস্তার করেছে। সংবাদপত্রগুলোর মন্তব্যেই এর বড় প্রমাণ। 'ভোলায় কেন্দ্র দখলের মহোৎসব' এই মন্তব্য করেছিল নয়াদিগন্ত। প্রথম আলো লিখেছিল 'ভোটারদের পথে পথে বাধা। ভোট কেন্দ্রের বাইরে ও আশপাশে ভোটারদের বাধা দেয়া, হামলা এবং কেন্দ্র থেকে বিএনপির এজেন্টদের বের করে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে'। মানবজমিন বলেছে, 'ব্যাপক সহিংসতা, জাল ভোট, এজেন্টদের পিটিয়ে বুথ থেকে বের করে দেয়া ও ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আসতে বাধা দেয়ার মধ্য দিয়ে ভোলা-৩ আসনের ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে।' ইত্তেফাকের মন্তব্য ছিল এরকম_ 'কোন কোন কেন্দ্র থেকে বিএনপি এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়। বিএনপি কর্মীদের কুপিয়ে জখম করা হয়। জাল ভোট দেয়া হয়েছে'। অন্যান্য পত্রিকার মন্তব্যগুলো আর উল্লেখ করলাম না। এসব মন্তব্য আমাদের কী ইঙ্গিত দেয়? ইঙ্গিত দেয় একটাই_ আমাদের রাজনীতিবিদদের মনমানসিকতায় আদৌ কোনো পরিবর্তন আসেনি। যেখানে ভোলার উপনির্বাচন আমরা সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করতে পারলাম না, সেখানে দলীয় সরকারের আওতায় জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করি কীভাবে? গণতন্ত্রের স্বার্থে পৃথিবীর অনেক দেশে এমন সব সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে, যা সংবিধান পরিপন্থী। কিন্তু ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করা ও একটি গ্রহণযোগ্য সমাজ-ব্যবস্থা উপহার দেয়ার স্বার্থেই সংবিধান বহির্ভূত সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। দৃষ্টান্ত কেনিয়া ও জিম্বাবুয়ে। এ দুটো দেশের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর কোনো পদ ছিল না। কিন্তু ব্যাপক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধী দলের নেতাকে সরকারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ফলে সেখানে গণতন্ত্র নতুন একটি মাত্রা পেয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করে আমরা বাংলাদেশে বিকাশমান গণতন্ত্রকে নতুন একটি মাত্রা দিয়েছিলাম। জাতীয় সংসদেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবলিত সংবিধান সংশোধন করা হয়েছিল। সেই থেকে সংসদে দাঁড়িয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলেননি। প্রধানমন্ত্রী আকারে-ইঙ্গিতে বলছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প হচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে আরো শক্তিশালী করা। একটা দলীয় সরকার যখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) তথা কমিশনারদের মনোনয়ন দেয়, তখন ওই মনোনয়ন নিয়ে প্রশ্ন থাকেই। পাঠক, মনে করার চেষ্টা করুন নবম পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগে বর্তমান সিইসি কী বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ১৯৭০ সালের মতো একটি নির্বাচন করবেন। ওই মন্তব্যের মধ্য থেকে তিনি তার মনের কথাটি হঠাৎ করেই বলে ফেলেছিলেন। আর মনের কথাটি হচ্ছে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো! ১৯৭০ সালের নির্বাচনে (যুক্ত পাকিস্তানে) আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছিল। তাহলে এ ধরনের সিইসিদের দিয়ে কী সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায়! আমাদের দুজন নির্বাচন কমিশনারও কম যান না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তারা ঘন ঘন টিভি পর্দায় আসতে পছন্দ করতেন, অনেকটা টিভি তারকাদের মতো। দুজনই সাবেক আমলা এবং চাকরি জীবনে তাদের বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযোগ ছিল। তারা কী এই অভিযোগ অস্বীকার করতে পারবেন যে, তারা বিএনপিকে দ্বিখ-িত করার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি? নির্বাচন কমিশন বিএনপির সংস্কারবাদীদের সঙ্গে বৈঠক করে স্পষ্টতই বিএনপিকে ভাঙার উদ্যোগ নিয়েছিল। যেখানে নির্বাচন কমিশন তার নিরপেক্ষতা হারায়, সেখানে ওই নির্বাচন কমিশন দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে সম্ভব? নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে তাই প্রশ্ন থাকবেই।
হরতাল হয়ে গেল। এই হরতালে আওয়ামী লীগ মাঠে নামেনি, এটা একটা ভালো লক্ষণ। ইচ্ছে করলে আওয়ামী লীগ তার কর্মীদের মাঠে নামাতে পারতো। তা তারা করেনি। এই হরতালই প্রমাণ করে দেয় একটি সমঝোতা ছাড়া কোনো রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করা যাবে না। উচ্চ আদালতের রায় আর রাজনৈতিক বাস্তবতা এক নয়। রাজনৈতিক বাস্তবতা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকা উচিত। এটা নিয়ে সংসদে বিতর্ক হোক এবং বিএনপি সেই বির্তকে অংশ নিক। আমরা বারবার বলে আসছি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রয়োজন, তবে বর্তমান কাঠামোয় নয়। প্রধানমন্ত্রী সংসদে এসে কথা বলার জন্য বিএনপির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এক্ষেত্রে বিএনপি সংসদে না এলেও, সংসদ সদস্যরা নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর ওপর জোর দিতে পারেন। এক. সংবিধানের ৫৮(৩) ধারা পুরোপুরিভাবে বাদ দিয়ে একটা 'এলডার্স কাউন্সিল' গঠন, যারা একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টাসহ দশজন উপদেষ্টাকে নিয়োগ করবেন; দুই. ৫৮গ(৪) পুরোপুরিভাবে বাতিল করে বিচারপতিদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় জড়িত হতে নিরুৎসাহিত করা; তিন. ৫৮গ(৫), ৫৮গ(৬) পুরোপুরিভাবে বাতিল করা; চার. ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন বাধ্যতামূলক করা; পাঁচ. কোনো নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত না নিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করা। প্রধানমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি সংসদের উপর ছেড়ে দিতে পারেন। যদি দলীয়ভাবে প্রভাব খাটানো না হয়, তাহলে আমার বিশ্বাস আওয়ামী লীগের অনেক সংসদ সদস্য রয়েছেন, যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে তাদের মতামত দিতে পারেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পক্ষে জাতি আবারো বিভক্ত হয়েছে। হরতাল আহ্বান করে বিএনপি তথা চারদলীয় জোট কঠোর অবস্থানে গেছে। পরস্পর বিপরীত এই অবস্থান জাতির জন্য কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। হ
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আমাদের বাঙলাদেশ
সুত্র ঃ দৈনিক ডেসটিনি
0 comments:
Post a Comment