রাজনীতি কোন পথে?
জ্বলন্ত এই বাসের ছবিটি এখন প্রতিকী দেশেও জ্বলছে অশান্তির আগুন |
ড. তা রে ক শা ম সু র রে হ মা ন
আজ রোববার ৩৬ ঘণ্টার হরতাল শুরু হচ্ছে। শেষ হবে আগামীকাল সন্ধ্যায়। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী আলাদাভাবে এই লাগাতার হরতাল আহ্বান করেছে। সমর্থন দিয়েছে ইসলামী ঐক্যজোট। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে ৫১ দফা সংশোধনী সংসদে উপস্থাপন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে সরকারের ব্যর্থতার প্রতিবাদে বিএনপি এ হরতাল ডেকেছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী হরতাল ডেকেছে সব রাজবন্দির মুক্তিসহ নানা দাবিতে। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত একটি বক্তব্যের প্রতিবাদে গেল সপ্তাহেও চারদলীয় জোটের উদ্যোগে হরতাল পালিত হয়েছে। গত ৫ জুনের ওই হরতাল ছিল সরকারের জন্য একটি হুশিয়ারি। যেখানে ৩৭ ভাগ জনগোষ্ঠীকে প্রতিনিধিত্বকারী চারদলীয় জোটের বক্তব্যকে গ্রহণযোগ্যতায় নেয়া উচিত ছিল, তা না করে সরকার এককভাবে সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে নতুন করে হরতাল আহ্বান করা অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। হরতালে জনগণের কষ্ট হয়। কিন্তু বৃহত্তর কষ্ট এড়ানোর জন্যই এ হরতাল। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ কথা স্বীকার করে ক্ষমাও চেয়েছেন।
স্পষ্টতই সংবিধান সংশোধনের নামে সরকার একটি জটিল পরিস্থিতির দিকে জাতিকে ঠেলে দিয়েছে। গত ১০ মাসে সংবিধান সংশোধনের জন্য গঠিত কমিটির কর্মকাণ্ড দেখে এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে কমিটি নিজের ইচ্ছায় নয়, বরং ‘অন্য কারো’ ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্যই ৫১ দফা সুপারিশ করেছে। কমিটি যাদের দাওয়াত দিয়ে তাদের কথা শুনেছিল, তাদের কারো সুপারিশই ৫১ দফায় নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে শরিকদের মতামতও প্রতিফলিত হয়নি ওই ৫১ দফায়। মজার ব্যাপার বিশেষ কমিটির সদস্যরা তাদের ২৭টি সভায়ও যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না, তখন তারা দেখা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী তখন বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করতে হবে। একটি কমিটি যখন গুরুত্বপূর্ণ কোনো ইস্যুতে কাজ করে, তখন ওই কমিটির সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা না করারই কথা। কেননা তাতে করে তারা প্রভাবান্বিত হতে পারেন। এ রকমটিই ঘটেছিল বিশেষ কমিটির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সময়। বিশেষ কমিটি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যই সুপারিশে রাখলেন। ফলে তারা তাদের নিরপেক্ষতা হারিয়েছিলেন। ফলে যা হওয়ার তাই হলো—৩৬ ঘণ্টার লাগাতার হরতাল আহ্বান করতে হলো বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে। চারদলীয় জোট তো আগেই হুশিয়ার করে দিয়েছিল যে বড় ধরনের কর্মসূচি আসতে পারে।
শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই নয়, বরং ইভিএম মেশিন নিয়েও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। প্রধানমন্ত্রী অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছেন যে আগামী নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটার মেশিন বা ইভিএম মেশিন ব্যবহৃত হবে। প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পরপরই নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছে। সংলাপের অন্যতম এজেন্ডা হচ্ছে নির্বাচনে ইভিএম মেশিন ব্যবহার। তাহলে কী দাঁড়াল ব্যাপারটা। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্যই নির্বাচন কমিশন উদ্যোগ নিচ্ছে। নির্বাচন কমিশন কি তার নিরপেক্ষতা হারাল না? নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তো সিইসি নিজেই বলেছিলেন, তিনি ১৯৭০ সালের মতো একটি নির্বাচন করতে চান। সেদিনই তিনি তার নিরপেক্ষতা হারিয়েছিলেন। আজ তিনি যখন ইভিএম মেশিনের কথা বলেন, তখন তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। এ দেশের জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ যেখানে অশিক্ষিত ও নিরক্ষর, তাদের কাছে কোন যুক্তিতে আমরা ইভিএম মেশিন নিয়ে যাব? বলা হচ্ছে ভোট কেন্দ্রে তাদের প্রশিক্ষণ বা ধারণা দেয়া হবে। এখানে কি ‘ম্যানিপুলেশন’ হবে না? ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত থাকা ব্যক্তিদের প্রভাব কি কাজ করবে না? ‘সূক্ষ্ম কারচুপির’ তত্ত্ব তো প্রধানমন্ত্রীই আমাদের শিখিয়েছিলেন। প্রযুক্তি মানুষকে অনেক দূর নিয়ে গেছে, এটা সত্য। কিন্তু এই প্রযুক্তি দিয়ে অনেক কিছু বদলে দেয়াও সম্ভব। যেখানে জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশই প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, সেখানে কোন উদ্দেশ্যে ইভিএম চালু করতে চায় নির্বাচন কমিশন? প্রশ্ন ওঠা তো খুবই স্বাভাবিক। এই ইভিএম মেশিনের সঙ্গে আমি পরিচিত হয়েছিলাম ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে Democracy and the American political process : Single country Project for Bangladesh-এর আওতায় আমরা ক’জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষল গিয়েছিলাম যুক্তরাষ্ট্রে। আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সাউথ ক্যারোলিনা রাজ্যের স্টেট ইলেকশন কমিশন অফিসে। সেখানে আমাদের সঙ্গে দীর্ঘ কথা হয়েছিল কমিশনের সহকারী পরিচালক মিস ডোনা রয়সনের সঙ্গে। আমরা অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছিলাম। ডোনা আমাদের বলেছিলেন, ভোটার মেশিন নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। সব রাজ্যে এটা এখনও গ্রহণযোগ্য হয়নি। রাজ্যগুলো তা চালুও করছে না। তখন প্রশ্ন উঠল আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট নিয়ে। অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী, একেবারেই সাধারণ, যাদের প্রযুক্তি সম্পর্কে এতটুকুও ধারণা নেই, এই বাংলাদেশে ভোটার মেশিনের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু? প্রশ্ন করেছিলাম ডোনাকে। আট বছর আগের কথা। ডোনা আমেরিকার রাজনৈতিক সংস্কৃতি আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি পর্যালোচনা করে বলেছিলেন, যেখানে খোদ আমেরিকাতেই এটা চালু হয়নি, বাংলাদেশের মতো একটি প্রযুক্তিগত অনেক পেছনে থাকা দেশে কীভাবে এটা চালু করা যায়? ডোনার এ প্রশ্নের কোনো জবাব আমার জানা ছিল না। পৃথিবীর অনেক দেশে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে এখনও ইভিএম চালু করা হয়নি। সেখানে আমরা কি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছি না? আমরা বারবার বলছি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ হতে হবে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন তার নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। সিইসি ও দুই নির্বাচন কমিশনারের কথাবার্তায় তারা তাদের নিরপেক্ষতা হারিয়েছিলেন। এই নির্বাচন কমিশনই বিএনপির মতো একটি বড় দলকে ভাঙতে চেয়েছিল। তারা বিএনপির সংস্কারবাদীদের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের দিয়ে একটা আলাদা দল করতে চেয়েছিল। আজ বিএনপি যখন নির্বাচন কমিশনের তথাকথিত সংলাপ বয়কট করে, তার একটা যুক্তি তো আছেই।
নবম জাতীয় সংসদের নির্বাচন হয়েছিল ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে। সরকার ইচ্ছে করলে তার আগেও নির্বাচন দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে আগামী মাসে। সরকার নতুন তিনজন কমিশনার (সিইসিসহ) নিয়োগ দেবে (সংবিধান সংশোধন হওয়ার পর এ সংখ্যা পাঁচে গিয়ে দাঁড়াবে)। তারাই তত্ত্বগতভাবে দশম সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করবেন। কারা আসছেন নির্বাচন কমিশনে? সরকার যদি তার বলয়ভুক্ত রাজনৈতিক অনুসারী আমলাদের (সিভিল ও মিলিটারি) নিয়োগ দেয় (যার সম্ভাবনা বেশি), তাহলে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই চারদলীয় জোটের সঙ্গে কথা বলতে হবে। সরকার প্রয়োজনে একটি নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করতে পারে, যারা নির্বাচন কমিশনকে ঢেলে সাজাবেন। সাবেক একজন প্রধান বিচারপতির (যিনি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য) নেতৃত্বে এই কমিশন গঠিত হতে পারে, যারা সিইসি তথা কমিশনারদের মনোনয়ন চূড়ান্ত করবেন। সরকার একতরফাভাবে যদি সিইসি ও কমিশনারদের নিয়োগ দেয়, তাতে বিতর্কের মাত্রা আরও বাড়বে।
দলীয়ভাবে (অর্থাত্ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়ে) নির্বাচন করলে যে সেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয় না এবং সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা যে ওই নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করে, তার বড় প্রমাণ বর্তমান সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়া ভোলার উপনির্বাচন (২৪ এপ্রিল ২০১০)। সংবাদপত্রগুলো সাক্ষী ওই নির্বাচনে কী হয়েছিল। এখন কী হচ্ছে? ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হচ্ছে দেশজুড়ে। ব্যালট ছিনতাই, আর জাল ভোটের ছড়াছড়ি। এমনকি ইউএনওর অফিস ঘেরাও করে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানানো হচ্ছে (আমার দেশ, ১০ জুন)। এই যখন পরিস্থিতি, তখন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের সুষ্ঠুতা ও নিরপেক্ষতা আমরা নিশ্চিত করব কীভাবে? না, দলীয় সরকারের আওতায় কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হবে না। এ জন্যই দরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
বিরোধী দলের হরতাল আহ্বান আবারও প্রমাণ করল বিরোধী দলের সঙ্গে কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা ছাড়া ‘রাজনৈতিক সমস্যা’র কোনো সমাধান সম্ভব নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি রাজনৈতিক। আদালত রাজনৈতিক বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। তারা একটি অভিমত দিয়েছেন। কিন্তু আদালত বলেননি দলীয় সরকারের আওতায় নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অবৈধ বলেছেন। আমরা এ প্রশ্নে যাব না। আমরা যাব সংবিধান সংশোধনের প্রশ্নে, যেখানে সংবিধানই আমাদের বলে দিচ্ছে (অনুচ্ছেদ ১৪২-১) সংসদই সংবিধান সংশোধন করবে। অতীতেও করেছে। বিশেষ কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এ কথাটিই বারবার বলে আসছেন—সংসদই সংবিধান সংশোধন করবে। সংবিধান সংশোধন হতে পারে। কিন্তু তা হতে হবে সংসদ এবং বিরোধী দলের সম্মতিসহ। এখন বিরোধী দলেকে বাদ দিয়ে সংবিধান সংশোধন করলে তা দেশকে আরও অস্থিরতার দিকে ঠেলে দেবে। ৩৬ ঘণ্টার টানা হরতাল আবারও প্রমাণ করল চারদলের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হোক, দুই টার্মের জন্য (আদালতের রায় অনুসরণ করে) একটি নিরপেক্ষ সরকারের আওতায় নির্বাচন (দশম ও এগারতম জাতীয় সংসদ) আয়োজন করতে সরকারকে নতুন ফর্মুলা’ উপস্থাপন করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, সরকারকে বিএনপির সঙ্গে সংলাপে উদ্যোগী হতে হবে। সরকার ও বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপের উদ্যোগ নিতে পারেন স্পিকার স্বয়ং। সরকার যদি নমনীয় না হয়, তাহলে দেশ আবারও এক চরম সঙ্কটের দিকে যাবে, যা আমরা কেউই চাই না। আমরা যদি ‘দেয়ালের লিখন’ থেকে কিছু না শিখি, সেটা হবে আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
www. tsrahmanbd. blogspot. com
0 comments:
Post a Comment