রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

রাজনীতিতে অশনি সংকেত

ড. তারেক শামসুর রেহমান


গত ৫ জুন চারদলীয় জোটের উদ্যোগে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করার পর বিএনপি ও জামায়াত আবারো ৩৬ ঘণ্টার টানা হরতাল পালন করলো। গত সোমবার সন্ধ্যায় হরতাল শেষ হওয়ার পর যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে এরপর কী? পরপর দু'সপ্তাহে দুটি হরতালের পরও সরকার যে একটু নমনীয় হবে, তার কোনো লক্ষণ নেই। এ ধরনের হরতালে সরকারের পতন হয় না। এটা আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের বলেছেন বটে; কিন্তু এটা বিএনপির নেতৃবৃন্দ যে জানেন না, তাও নয়। তারা জানেন; কিন্তু রাজনীতির স্বার্থেই তাদের হরতাল দিতে হয়। অতীতে আওয়ামী লীগও দিয়েছিল। আগামীতে, দশম সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ যদি বিরোধী দলে যায়, তাহলেও হরতাল হবে। এই হরতালের সংস্কৃতি থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারিনি। আগামীতেও পারবো না। তাহলে করণীয় কী? দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভালো তা বলা যাবে না। প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে কথা বলা হয়েছে, তা কতটুকু সঠিক, তা আগামী দিনেই বলা যাবে। এক ধরনের স্থবিরতা আছে অর্থনীতিতে। বিদ্যুৎ সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে। গত দু'বছরে মাত্র একটি কারখানায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। গ্যাস ফুরিয়ে আসছে। নতুন গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কারের কথাও আমরা শুনছি না। তবে শুনতে পাচ্ছি গ্যাসের রিজার্ভ বেড়েছে। তাতে করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়েনি। বিদ্যুৎ অর্থনীতির প্রাণ। চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু সাপ্লাই নেই। বেকার সমস্যা বাড়ছে। অর্থমন্ত্রী বেকার সংখ্যার যে পরিসংখ্যান দিয়েছেন, তার সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই। বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। ব্যর্থ বাণিজ্যমন্ত্রী তার ব্যর্থতা নিয়ে এখনো কেবিনেটে আছেন। প্রতিদিনই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ছে। রমজানে এই দাম কোথায় গিয়ে ঠেকবে আল্লাহমালুম। এমনি এক পরিস্থিতিতে হরতালের পর হরতাল হচ্ছে। এতে করে পরিস্থিতির যে আরো অবনতি হবে, তা বলাই বাহুল্য।
এই হরতালের প্রেক্ষাপট হচ্ছে জাতীয় কমিটি কর্তৃক সংসদে দাখিলকৃত ৫১ দফা সংবিধান সংশোধনী, যার মাঝে একটি হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, যা এখন পর্যন্ত সংবিধানের একটি অংশ। এটি বাতিলের সুপারিশ করেছে জাতীয় কমিটি। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের সুপারিশই চূড়ান্ত নয়। নিয়ম অনুযায়ী উক্ত রিপোর্ট নিয়ে সংসদীয় পার্টিতে আলোচনা হবে, মন্ত্রিসভায় নীতিগত সিদ্ধান্ত হবে, বিল তৈরি হবে, আইন মন্ত্রণালয়ের ভোটিংয়ের মধ্য দিয়ে টেকনিক্যালিটি যাচাই হবে, আবার মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর সংসদে বিল আকারে তুলতে হবে। এরপর সংসদে আইন আকারে পাস করার আগে আবার কমিটিতে যাবে। সেখান থেকে রিপোর্ট পাওয়ার পর সংসদে ভোটের মাধ্যমে পাস হবে। পথটা দীর্ঘ। পাস হতেও সময় লাগে। সুতরাং তড়িঘড়ি করে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। বিএনপি ও চারদলীয় জোট হরতাল আহ্বান করে তাদের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে। সরকারি দল এটাকে বিবেচনায় নিতে পারে। এককভাবে যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়, তাহলে সেটা হবে ভুল।
রাজনীতিতে সহনশীলতা থাকতে হয়। বিরোধী দলের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে হয়। এর নামই গণতন্ত্র। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় বটে এবং তা সাংবিধানিকভাবে বৈধও বটে; কিন্তু তা গণতান্ত্রিক স্পিরিটের পরিপন্থী। গণতান্ত্রিক স্পিরিট হচ্ছে বিরোধী দলের মতামত নেয়া এবং বিরোধী দলের মতামতের ভিত্তিতেই আইন প্রণয়ন করা। এটি না হলে এ দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র বিকশিত হবে না এবং অসাংবিধানিক শক্তিগুলো এ থেকে ফয়দা লুটবে। জাতীয় কমিটি তত্ত্বাধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার পক্ষে মত দিয়েছে, তারপরও সুযোগ রয়েছে বিকল্প একটি প্রস্তাব সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার। যেমন, সংসদ সিদ্ধান্ত নিতে পারে আাগমী দশম ও এগারোতম জাতীয় সংসদ একটি নির্দলীয় সরকারের (তত্ত্বাবধায়ক কথাটা ব্যবহার না করাই শ্রেয়) অধীনে অনুষ্ঠিত হবে। একটি তিন সদস্যবিশিষ্ট 'এলডার্স কাউন্সিল' এই নির্বাচন পরিচালনা করবেন। এই 'এলডার্স কাউন্সিল' গঠিত হবে সাবেক একজন প্রধান বিচারপতি, একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও একজন সুশীল সমাজের প্রতিনিধির সমন্বয়ে। বিরোধী দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে এই 'এলডার্স কাউন্সিল' গঠন করা হবে। এরা ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করবেন এবং কোনো নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। তাদের সহযোগিতা করার জন্য একটি উপদেষ্টা ম-লী থাকতে পারে। রাষ্ট্রপতি তার পদে বহাল থাকবেন; কিন্তু তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। এই কাউন্সিল নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে পারবেন। সেনাবাহিনীর সহযোগিতাও তারা নিতে পারবেন। কোনো অবস্থাতেই সদ্য অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতিকে কোনো প্রক্রিয়ায় জড়িত করানো যাবে না। দ্বাদশ পার্লামেন্ট নির্বাচন আয়োজন করবে নির্বাচন কমিশন। এ জন্য সিইসি কিংবা নির্বাচন কমিশনারদের নিযুক্তিতে নিরপেক্ষতা যাতে নিশ্চিত হয়, সে ব্যাপারে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের দেশের আমলাদের মাঝে (সামরিক ও বেসামরিক) 'রাজনীতি' করার একটা প্রবণতার জন্ম হয়েছে। চাকরি জীবনের শেষের দিনগুলোতে তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং অবসরে যাওয়ার পর পরই তারা এক একজন 'রাজনীতিবিদ' হয়ে যান। তাদের টার্গেট থাকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়া। এই প্রবণতা খারাপ।
যাদের সঙ্গে এলাকার জনগণের কোনো যোগাযোগ নেই, এলাকার জনগণের দুঃখ-কষ্টের ভাগিদার যারা হননি, তারা হঠাৎ করে এমপি হয়ে যান। তারা সঠিক অর্থে জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন না। এ জন্য আমলাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ নূ্যনতম ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করতে হবে। ফলে তারা সচিবালয়ে বসে কোনো বিশেষ দলের পক্ষে কলকাঠি নাড়াতে পারবেন না। তারা যদি বুঝতে পারেন অবসরের সঙ্গে সঙ্গেই তারা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না, তাহলে তারা নিরপেক্ষ থেকেই প্রশাসন পরিচালনা করবেন। সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলকে আরো শক্তিশালী করা যেতে পারে। প্রয়োজনে তাদের কর্ম পরিধিও আরো বাড়ানো যেতে পারে। সাংবিধানিক পদে যারা নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন, তাদের নিয়োগের দায়িত্বটি সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের হাতে ছেড়ে দেয়া যেতে পারে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল একটাই কারণে_ আর তা হচ্ছে নিরপেক্ষ নির্বাচন। দলীয় সরকারের অধীনে যে নির্বাচন হয়, সেই নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে। অতীতে বারবার এমনটি হয়েছে। 'মাগুরা সিনড্রম' আমরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পেরেছি বলে মনে হয় না। বর্তমান সরকারের সময় ভোলায় যে উপনির্বাচন হয়ে গেল (২৪ এপ্রিল ২০১০), তাতে সরকারি দলের ভোটকেন্দ্র দখল, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেয়া, সন্ত্রাস, ইত্যাদি নানা কারণে উপনির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের যতটুকু না ভূমিকা ছিল, তার চাইতে বেশি ভূমিকা ছিল স্থানীয় নেতৃত্বের। স্থানীয় নেতৃত্ব এটাকে 'প্রেসটিজ ইস্যু' হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছিল। ফলে তাদের এভাবে স্থানীয় প্রশাসন ছিল অসহায়। এটাই হচ্ছে মূল সমস্যা। আমরা গণতন্ত্রকে ধারণ করলেও, আমাদের মানসিকতায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। গণতন্ত্রকে আমরা আমাদের নিজেদের মতো করে দেখতে চাই। যে কারণে মাগুরা কিংবা ভোলার মতো ঘটনা ঘটে। এই বৃত্ত আমরা ভাঙতে পারিনি। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো একটি নিরপেক্ষ সরকার দরকার, যারা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবে। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হলে, এটা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। এ ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক নাম ব্যবহার না করেও, বিকল্প একটি নাম ব্যবহার করে সরকারই পারে তাদের সৎ উদ্দেশ্য জাতির সম্মুখে উপস্থাপন করতে। না হলে সরকারের উদ্দেশ্য প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
ধারণা করছি এই হরতালই শেষ নয়। আরো হরতাল আসবে। আরো বড় কর্মসূচি গ্রহণ করবে বিএনপি তথা চারদল। ইসলামিক দলগুলোও তাদের সঙ্গে থাকবে। ফলে সৃষ্টি হবে নানা সংকটের। সরকার তো অভিভাবক। জনগণের ভোটে তারা নির্বাচিত হয়েছেন সত্য; কিন্তু তাদেরও সহনীয় হতে হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ একটি সংলাপ আহ্বান করতে পারে। স্পিকার মধ্যস্থতা করতে পারেন। ওই সংলাপে বিএনপি বিকল্প প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারে। পৃথিবীর অনেক বড় বড় সমস্যা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশে এটা সম্ভব হবে না, এটা আমি বিশ্বাস করি না। শুধু প্রয়োজন আন্তরিকতার। রাজনীতি হচ্ছে একটি প্রক্রিয়া, যেখানে সব সময় কমপ্রোমাইজ' করে চলতে হয়। আজ সরকার যদি বিএনপির ডাকে সারা দেয়, তাতে ক্ষতি কী? জাতীয় কমিটিও বলতে পারে তারা দশম ও এগারোতম সংসদ নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার স্বার্থে বিএনপির সঙ্গে কথা বলবে। এর মধ্য দিয়ে বরফ গলতে পারে। এতে কারোরই ক্ষতি নেই। বরং জাতি একটি মহা দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাবে। হ
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

0 comments:

Post a Comment