তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে রাজনীতি আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। চারদলীয় জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার দাবিতে আজ সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহ্বান করেছে। এর আগে গত ৩১ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, উচ্চ আদালতের রায়ের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার কোনো সুযোগ নেই। বিতর্কটা উঠেছে সেখান থেকেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে উচ্চ আদালত একটি রায় দিয়েছিলেন। ওই রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে রায়ে একথাও বলা হয়েছিল যে, প্রয়োজনে আরও দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে জাতীয় সংসদ। সংসদে এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার আগেই প্রধানমন্ত্রী এই মন্তব্যটি করলেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, উচ্চ আদালতের এই রায়টি সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় কমিটিকে বিপাকে ফেলে দিয়েছিল। জাতীয় কমিটি এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। শেষ পর্যায়ে তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখাও করেছিলেন। জাতীয় কমিটি এখনও তাদের রিপোর্ট সংসদে উপস্থাপন করেননি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে তারা কী সুপারিশ করবেন, আমরা জানিও না। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য দ্বারা তারা প্রভাবিত হবেন কিনা, সেটাও দেখার বিষয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী যে মন্তব্যটি করলেন, তা তার সরকারের বক্তব্য বলেই আমরা ধরে নেব। এক্ষেত্রে অবশ্যই প্রশ্ন আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিপন্থী এটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, উন্নয়নশীল দেশে যেভাবে গণতন্ত্র বিনির্মাণ হচ্ছে, তার সঙ্গে উন্নত বিশ্বের গণতন্ত্রকে মেলানো যাবে না। উন্নয়নশীল বিশ্বের গণতন্ত্রের ভিতকে আরও শক্তিশালী করার জন্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো একটি ব্যবস্থা থাকা উচিত, যার মাধ্যমে নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব। বাংলাদেশের মতো দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গণতন্ত্রের রক্ষাকবজ।
প্রধানমন্ত্রী আজ সংবাদ সম্মেলন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার কথা বললেন বটে, কিন্তু ১৯৯৪-৯৬ সালে তিনিই ছিলেন এর প্রবক্তা। ওই সময় আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে জনমত গড়ে তুলেছিল। সংবিধান অনুযায়ী ১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীন বিএনপি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করেছিল বটে, কিন্তু আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচন বয়কট করেছিল। প্রধানমন্ত্রীর নিশ্চয়ই এসব ভুলে যাওয়ার কথা নয়। আওয়ামী লীগের চাপের মুখেই ষষ্ঠ সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল, যা কিনা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী নামে অভিহিত। সেদিন বিএনপির এই সিদ্ধান্তকে সবাই স্বাগত জানিয়েছিল। আওয়ামী লীগ সেদিন এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেনি। বরং সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল, যা কিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকারও গঠন করেছিল। গেল ১৪ বছরে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে কোনো বড় ধরনের বিতর্ক হয়নি। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে যে বিতর্ক, তার প্রেক্ষাপট ভিন্ন।
এদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ৩টি নির্বাচন হয়েছে। সপ্তম, অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এসব নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতাও পেয়েছে। আজ যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের কথা বলছেন, তারাই ১৯৯৪-৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার সপক্ষে সোচ্চার ছিলেন সবচেয়ে বেশি। যদি উচ্চ আদালতের রায় অনুসরণ করেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করতে হয়, তাহলে উচ্চ আদালতের সুপারিশও গ্রহণ করা যেতে পারে। অর্থাত্ পরবর্তী দু-দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় আয়োজন করা। এই সুপারিশ গ্রহণ করা না হলে, সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। একাধিক কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। প্রথমত, আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের মানসিকতায় পরিবর্তন আসেনি, যাতে করে দলীয় সরকারের আওতায় আমরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারি। ভোলার উপনির্বাচনের দৃষ্টান্ত আমাদের সম্মুখে আছে। কী হয়েছিল ভোলার উপনির্বাচনে, একথা নিশ্চয়ই আমাদের সবার মনে আছে। গত ২৪ এপ্রিল, ২০১০ এই উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছিল কিনা আসুন সংবাদপত্রগুলোর মন্তব্যের দিকে চোখ বুলাই। ‘ভোলায় কেন্দ্র দখলের মহোত্সব’ এই মন্তব্য করেছিল নয়াদিগন্ত। প্রথম আলো লিখেছিল, ‘ভোটারদের পথে পথে বাধা। ভোটকেন্দ্রের বাইরে ও আশপাশে ভোটারদের বাধা দেয়া, হামলা এবং কেন্দ্র থেকে বিএনপির এজেন্টদের বের করে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে’। মানবজমিন বলেছে, ‘ব্যাপক সহিংসতা, জাল ভোট, এজেন্টদের পিটিয়ে বুথ থেকে বের করে দেয়া ও ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসতে বাধা দেয়ার মধ্য দিয়ে ভোলা-৩ আসনের ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে’। ইত্তেফাকের মন্তব্য ছিল এ রকম, ‘কোনো কোনো কেন্দ্র থেকে বিএনপি এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়। বিএনপি কর্মীদের কুপিয়ে জখম করা হয়। জালভোট দেয়া হয়েছে’। অন্যান্য পত্রিকার মন্তব্যগুলো আর উল্লেখ করলাম না। এসব মন্তব্য আমাদের কী ইঙ্গিত দেয়? ইঙ্গিত দেয় একটাই—আমাদের রাজনীতিবিদদের মনমানসিকতায় আদৌ কোনো পরিবর্তন আসেনি। যেখানে ভোলার উপনির্বাচন আমরা সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করতে পারলাম না, সেখানে দলীয় সরকারের আওতায় জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করি কীভাবে? দ্বিতীয়ত, গণতন্ত্রের স্বার্থে পৃথিবীর অনেক দেশে এমন সব সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে, যা সংবিধান পরিপন্থী। কিন্তু ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করা ও একটি গ্রহণযোগ্য সমাজব্যবস্থা উপহার দেয়ার স্বার্থেই সংবিধান বহির্ভূত সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। দৃষ্টান্ত কেনিয়া ও জিম্বাবুয়ে। এ দুটি দেশের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর কোনো পদ ছিল না। কিন্তু ব্যাপক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধী দলের নেতাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ফলে সেখানে গণতন্ত্র নতুন একটি মাত্রা পেয়েছে। বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করে আমরা বিকাশমান গণতন্ত্রকে নতুন একটি মাত্রা দিয়েছিলাম।
তৃতীয়ত, জাতীয় সংসদেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবলিত সংবিধান সংশোধন করা হয়েছিল। সেই থেকে সংসদে দাঁড়িয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলেননি। আজ যারা বলছেন, তাদের উদ্দেশ্য কী? কেন তারা বলছেন? চতুর্থত, প্রধানমন্ত্রী আকার-ইঙ্গিতে বলছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প হচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করা। একটা দলীয় সরকার যখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) তথা কমিশনারদের মনোনয়ন দেয়, তখন এই মনোনয়ন নিয়ে প্রশ্ন থাকেই। পাঠক, মনে করার চেষ্টা করুন নবম পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগে বর্তমান সিইসি কী বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘১৯৭০ সালের মতো একটি নির্বাচন করবেন।’ ওই মন্তব্যের মধ্য থেকে তিনি তার মনের কথাটি হঠাত্ করেই বলে ফেলেছিলেন। আর মনের কথাটি ছিল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো! ১৯৭০ সালের নির্বাচনে (যুক্ত পাকিস্তানে) আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছিল। তাহলে এ ধরনের সিইসিদের দিয়ে কি সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায়? আমাদের দুজন নির্বাচন কমিশনারও কম যান না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তারা ঘন ঘন টিভি পর্দায় আসতে পছন্দ করতেন, অনেকটা টিভি তারকাদের মতো। দুজনই সাবেক আমলা এবং চাকরি জীবনে তাদের বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযোগ ছিল। তারা কি ওই অভিযোগ অস্বীকার করতে পারবেন যে তারা বিএনপিকে দ্বিখণ্ডিত করার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি? তথাকথিত সংস্কারবাদীদের নিয়ে ইসি মিটিং করেছিল। তারা সেদিন তাদের নিরপেক্ষতা হারিয়েছিলেন। এখন দলীয় সরকার সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেবে। আমরা অতীতে দেখেছি ‘জনতার মঞ্চ’ করে আমলাদের রাজনীতিতে আমরা টেনে এনেছিলাম। সেই যে আমলাদের মধ্যে আমরা ‘রাজনীতির বীজ’ ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম তা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারিনি। রাজনীতিবিদরা খুঁজে বেড়ান দলীয় আদর্শে বিশ্বাসী আমলাদের। কোন কোন আমলা চাকরিরত অবস্থায় ‘কবিতা লিখে’, বঙ্গবন্ধুর গুণকীর্তন করে নিজের পথ প্রশস্ত করেন। আর তাদেরকেই বসান হয় গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে। তাই দলীয় সরকার যখন ইসিতে সিইসি কিংবা কমিশনারদের মনোনয়ন দেবে, তারা নিরপেক্ষ নন এবং তাদের দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন আশা করাও যায় না।
নির্বাচন হচ্ছে সরকার পরিবর্তনের মাপকাঠি। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্রকে শুধু শক্তিশালীই করে না, বরং অগণতান্ত্রিক শক্তিকে ক্ষমতা দখল করতে দেয় না। এখন তাই প্রশ্ন, আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করব কীভাবে? বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তাতে এখন দলীয় সরকারের আওতায় নির্বাচন হলে, সেই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তাই গোয়ার্তুমি নয়, প্রয়োজন শুভবুদ্ধির পরিচয় দেয়া। আমরা এই শুভবুদ্ধির পরিচয় দিতে যদি ব্যর্থ হই, তাহলে ‘ওয়ান ইলেভেন’র মতো ঘটনা বার বার ঘটবে। চারদলীয় জোট আজ সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহ্বান করেছে। এটা ছাড়া তাদের কোনো বিকল্প ছিল বলেও মনে হয় না। এই হরতাল সরকারকে একটা ‘মেসেজ’ পৌঁছে দিতে পারে। আর তা হচ্ছে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের একটি পরিবেশ তৈরি করা। বিএনপি এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি অংশ। চারদলীয় জোট এখনও প্রায় ৩৭ ভাগ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে। এদের বাদ দিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। তাই সরকার এককভাবে যদি সব রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে চায়, তাহলে তারা ভুল করবে। এতে করে সংঘাত বাড়বে, সৃষ্টি হবে অস্থিতিশীলতার। গণতন্ত্রের বিকাশ তাতে ঘটবে না। তাই সরকার শুভবুদ্ধির পরিচয় দিক—এটাই আশা করব।
0 comments:
Post a Comment