রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

সিরিয়ায় আল কায়দার উত্থান

সাম্প্রতিক সময়ে রুশ-মার্কিন সমঝোতা সিরিয়ায় একটি যুদ্ধের সম্ভাবনা কমিয়ে আনলেও সিরিয়ায় আল কায়দার উত্থান একটি বড় ধরনের সংবাদের জন্ম দিয়েছে। সিরিয়ায় আল কায়দার উত্থান এখন আলোচনার একটি বিষয়। কোনো কোনো অনলাইন সংবাদপত্রে [ফ্রন্টপেজ ম্যাগ (২০ সেপ্টেম্বর)] এমন কথাও বলা হচ্ছে যে, প্রেসিডেন্ট ওবামা বাহ্যতা আল কায়দাকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছেন! সম্প্রতি লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় আল কায়দার উত্থান নিয়ে একটি উদ্বেগজনক সংবাদ ছাপা হয়েছে। পত্রিকাট আইএইচএস জেন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদৃব্দতি দিয়ে বলছে, সিরিয়ায় আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করছে (সংখ্যায় প্রায় এক লাখ) সেই বিদ্রোহী বাহিনীর প্রায় অর্ধেক জঙ্গি সংগঠন আল কায়দার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। যারা নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন, তাদের কাছে লন্ডনের জেন গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি কোনো অপরিচিত নাম নয়। জেনের পক্ষ থেকে গবেষণাটি পরিচালনা করেন চার্লস লিসটার। লিসটার তার গবেষণায় এটাও উল্লেখ করেছেন, বিদ্রোহী বাহিনীর সঙ্গে প্রায় ১০ হাজার যোদ্ধা রয়েছে, যারা আদৌ সিরিয়ার নাগরিক নয়। তারা জঙ্গিবাদী সংগঠন আল নুসরা ফ্রন্ট, ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়ার ব্যানারে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে যেসব অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে তার একটা বড় অংশ চলে গেছে জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলোর কাছে। এখন এমন ধারণাও পোষণ করা হচ্ছে যে, আগামীতে যদি আসাদ সরকারের পতন ঘটে, তাহলে আসাদ সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিপুল অস্ত্র ভাণ্ডার চলে যাবে এসব জঙ্গিবাদী সংগঠনের কাছে, যাদের প্রায় সবাই আল কায়দার সঙ্গে জড়িত। সিরিয়ায় আল কায়দার উত্থান নিয়ে খোদ ওবামা প্রশাসনও উৎকণ্ঠিত। সম্প্রতি ওয়াশিংটনে সিনেটের এক শুনানিতে (হোমল্যান্ড সিকিউরিটি) টম জোসেলিনও এ ব্যাপারে তার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। যারা নিয়মিত সিরিয়ার ঘটনাবলি মনিটরিং করেন তাদের নিশ্চয়ই স্মরণে আছে, কিছুদিন আগে ইসলামী জঙ্গিরা আলেপ্পো শহরের কাছাকাছি আস সাদ্দাদি (লোকসংখ্যা ৭০ হাজার) শহরটি দখল করে নিয়েছিল।
জেনের গবেষণা প্রতিবেদনে যে উদ্বেগজনক দিকটি রয়েছে তা হচ্ছে, সিরিয়ার আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে যারা \'যুদ্ধ\' করছে, তাদের মাঝে শতকরা মাত্র ২৫ ভাগ যোদ্ধা ধর্মনিরপেক্ষ ও লিবারেশনপন্থি। বাকি সবাই বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। যদিও এ ধরনের সংবাদের সত্যতা যাচাই করা সবসময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিবেদন, গবেষণা নিবন্ধ থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গি সংগঠনগুলোর অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী। ফলে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, আগামীতে যদি আসাদ সরকারের পতন ঘটে (?) তাহলে কোন শক্তি সিরিয়ায় রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে?
সিরিয়ায় বিদ্রোহী গ্রুপগুলো কোনো একক নেতৃত্বে পরিচালিত হয় না। তারা বিভিন্ন গ্রুপ, উপগ্রুপে বিভক্ত। এককভাবে কোনো বিরোধী দল বা গ্রুপ নেই, যারা আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ায় সরকার গঠন করতে পারে। এক সময় সিরিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিল গঠিত হয়েছিল। কিন্তু এই কাউন্সিল এখন বিলুপ্ত। এর পরিবর্তে গঠিত হয়েছে \'ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর সিরিয়ান রেভলিউশনারি অ্যান্ড অপজিশন ফোর্সেস\' (এনসিএসআরও)। এটি গঠিত হয় ২০১২ সালের নভেম্বরে দোহায়। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে আহমেদ জারবা এ সংগঠনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তাদের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে স্বাধীন ও ঐক্যবদ্ধ সিরিয়া এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, যেখানে সংসদের কর্তৃত্ব নিশ্চিত হবে। তারা আসাদ সরকারের সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনার পক্ষপাতী নয়। তাদের একটি প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল তাদের সমর্থন করে। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে মরক্কোর মারাকাসে আসাদবিরোধীদের যে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং প্রায় একশ\' দেশ সেখানে প্রতিনিধি প্রেরণ করেছিল, তাতে তাদের সমর্থন নিশ্চিত করা হয়। ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের সমর্থন করে। সিরিয়ার বামপন্থিরা \'ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেশন কমিটি\' ব্যানারে কাজ করে। মোট ১৩টি দল এ ব্যানারে রয়েছে। কুর্দিরাও এ ব্যানারের আওতায় কাজ করে। এর বাইরে রয়েছে ইসলামিক ফোর্সগুলো, যাদের সঙ্গে আল কায়দার সম্পর্ক রয়েছে। ইসলামী জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে জাবহাল উল নুসরা। মোট ১২টি ইসলামী জঙ্গি সংগঠন সিরিয়ান ইসলামিক ফ্রন্টের ব্যানারে একত্র হয়েছে। নুসরা ফ্রন্টের বাইরে ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া, আহরার আল শামের মতো সংগঠনের নাম পাওয়া যায়, যারা আলাদাভাবে ৫ থেকে ৬ হাজার জঙ্গি ইসলামিক সেনার নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। ধারণা করা হয়, কোনো কোনো গ্রুপের হাতে প্রায় ২৫ হাজার সেনা পর্যন্ত রয়েছে। যদিও তারা কেউই প্রশিক্ষিত যোদ্ধা নয়। তাদের মূল দর্শন হচ্ছে, সিরিয়াকে একটি ইসলামিক এমিরাতে পরিণত করা। ফ্রি সিরিয়ান আর্মি মূলত সিরিয়ান সেনাবাহিনী ত্যাগ করে বিদ্রোহী দলে যোগ দেওয়া সেনাসদস্য ও ঊর্ধ্বতন জেনারেলদের নিয়ে গঠিত হয়েছে। এই সেনাবাহিনী রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি দায়বদ্ধ থাকলেও আগামী দিনের রাজনীতিতে তাদের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে না। ইসলামী জঙ্গি সংগঠনগুলোর কাছে প্রচুর অস্ত্র চলে গেছে। এই অস্ত্র আগামী দিনের সিরিয়ার রাজনীতিতে একটা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমরা লক্ষ্য করেছি, এর আগে দুটি দেশে যেখানে মার্কিন সামরিক আগ্রাসন হয়েছে (ইরাক ও লিবিয়া), সেখানে ইসলামী জঙ্গিরা শক্তিশালী হয়েছে। ইরাকে (২০০৩) মার্কিন আগ্রাসন হয়েছে, সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতের পর একটি সরকার সেখানে গঠিত হয়েছে বটে, কিন্তু ইসলামী জঙ্গিরা সেখানে শক্তিশালী হয়েছে, যা সাদ্দামের জমানায় ছিল না। ইরাকে এখন আত্মঘাতী বোমা সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে। লিবিয়াও একই পরিস্থিতি বরণ করেছে। সেখানকার ইসলামিক জঙ্গিরা অত্যন্ত শক্তিশালী। তাদের হাতেই বেনগাজীর মার্কিন দূতাবাস আক্রান্ত হয়েছিল এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তারা হত্যা করেছিল। এখন সিরিয়ার পরিস্থিতিও অনেকটা সে রকম।
গত ২৯ মাস ধরে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে। ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে সিরিয়ায় যে আন্দোলনের সূত্রপাত তা মিসরের আন্দোলন দ্বারা বেশি মাত্রায় প্রভাবান্বিত ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সেখানে ইসলামিক জঙ্গিরা শক্তিশালী হয়েছে। ইসলামী জঙ্গিদের এই উত্থান নিঃসন্দেহে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক শক্তি, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি বড় ধরনের \'ডায়লামার\' মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। আসাদ-বিরোধিতাকে সার্থক করার অর্থ ইসলামী জঙ্গিদের উত্থানকে সমর্থন করা। আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে মার্কিন নীতি খুব সুখের হয়নি। এক সময় তালেবানদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিল মার্কিনিরা। পরে তালেবানদের বিরুদ্ধেই অস্ত্র ধরতে হয় মার্কিনিদের। সিরিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অনেক। উপরন্তু এ অঞ্চলের পাশাপাশি দেশগুলোতে রয়েছে পশ্চিমা শক্তিগুলোর সামরিক ঘাঁটি। বাহরাইন ও কাতারে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি। ফ্রান্স ও ব্রিটেনের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে আরব আমিরাত ও সাইপ্রাসে। সুতরাং একটি জঙ্গিগোষ্ঠী যদি সিরিয়ায় ক্ষমতা দখল করে (?), তা হুমকি হয়ে দেখা দেবে পশ্চিমা শক্তিগুলোর জন্য। সুতরাং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এটা চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক। একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সেখানে বিকশিত হবে, সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ। সুনি্নদের নেতৃত্বাধীন একটি জোট সেখানে আসাদের বিকল্প হতে পারে। কিন্তু ইরাকের অভিজ্ঞতা সে দেশটির জন্য আদৌ সুখের হয়নি। আপাতত বাশার আল আসাদ রয়ে যাচ্ছেন ২০১৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত। ২০১৪ সালেই সেখানে নির্বাচন। সেই নির্বাচনে আসাদের অংশগ্রহণ না করা (বিনিময়ে আসাদকে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের মুখোমুখি না করা), সিরিয়ার সব রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস করে দেওয়া (যাতে আসাদ নীতিগতভাবে রাজি হয়েছেন)_ এই দুটি বিষয়কে সামনে রেখেই রাজনীতি এখন আবর্তিত হতে পারে। তবে আসাদ আগামীতে থাকবেন না_ বাস্তবতা বোধকরি এটাই।

টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র
tsrahmanbd@yahoo.com
অধ্যাপক
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

নির্বাচন হবে, নির্বাচন হবে না

নির্বাচন হবে, কি নির্বাচন হবে না, এটা এখন আর শুধু বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনকেই আলোড়িত করেনি; বরং সুদূর আমেরিকাতে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের মাঝেও বেশ আলোড়ন তুলেছে। দুটি বড় দলের মাঝে সংলাপ সম্ভাবনার যখন ‘মৃত্যু’ ঘটেছিল, ঠিক তখনই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুই নেত্রীকে সংলাপে বসার আমন্ত্রণ জানালেন। এই আহ্বানে দুই দল আদৌ সাড়া দেবে, এটা মনে করারও তেমন কোনো কারণ নেই। এর মধ্যে এসেছে দুটি খবর। প্রথমত, বিএনপি বলছে তারা ২৫ অক্টোবরের পর সরকার পতনে লাগাতার কর্মসূচি দেবে। দ্বিতীয়ত, বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, খুব শিগগিরই দলের পক্ষ থেকে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা উপস্থাপন করা হবে। বিএনপির এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কেননা সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, বিএনপিকে সংসদে যেতে এবং সেখানে তাদের প্রস্তাব উপস্থাপন করতে। এখন বিএনপি যদি একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা উপস্থাপন করে, আমাদের বিশ্বাস তা আলোচনার পথ উন্মুক্ত করবে। এখানে বেশ কিছু সাংবিধানিক সমস্যা রয়েছে। এটা বিবেচনায় রেখেই বিএনপিকে এই প্রস্তাব দিতে হবে। প্রথম বিষয় হচ্ছে, বিএনপিকে সংবিধানের আলোকেই এই প্রস্তাব দিতে হবে। বর্তমানে সংবিধানের বাইরে গিয়ে বিএনপি যদি কোনো প্রস্তাব দেয়, তা সঙ্গত কারণেই সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। তবে একই সঙ্গে বিএনপি সংবিধান সংশোধনের দাবি অব্যাহত রাখতে পারে। এই দাবি অব্যাহত রেখেই সংলাপ হতে পারে। দ্বিতীয়ত, প্রস্তাবটা হবে তিন মাসের জন্য একটি সরকার, যে সরকার নীতি-নির্ধারণ সংক্রান্ত কোনো ‘কাজ’ করবে না, তাদের দায়িত্ব হবে শুধু নির্বাচন পরিচালনা করা। তৃতীয়ত, প্রধানমন্ত্রীকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখেও এই সরকার গঠন করা যায়। এ ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বটি দিতে হবে বিরোধী দলের প্রধান অথবা তাদের দলীয় একজন এমপিকে। প্রধানমন্ত্রী কোনো নির্বাহী দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। তিনি কোনো প্রটোকল পাবেন না। দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারবেন না। টিভি, বেতার, সরকারি মিডিয়া তিনি ব্যবহার করতে পারবেন না। তিনি দলীয় প্রধান হিসেবে যদি কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে চান, তাহলে তিনি অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকতে পারবেন না। চতুর্থত, বিকল্প হিসেবে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীকে নিয়ে একটি যৌথ সরকার গঠন করা যায়, যেখানে বিরোধীদলীয় নেত্রীর হাতে থাকবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যদিও সংবিধান এ ক্ষেত্রে বড় বাধা। তবে বিরোধী দলের হাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থাকলে সমস্যা কম। নির্বাচন-পূর্ববর্তী তিন মাস পুরো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। দু’দলের পক্ষ থেকে ৫ জন করে ১০ জন সহকর্মী থাকবেন, যারা অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় পরিচালনা করবেন। তবে কথা থাকে, এই ১০ জন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। পঞ্চমত, একটি ‘সাহাবুদ্দীন ফর্মুলা’ ব্যবহৃত হতে পারে। অর্থাৎ প্রধান বিচারপতি সাবেক সাহাবুদ্দীন আহমদকে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে নব্বইয়ের আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে সব দল নীতিগতভাবে রাজি হয়েছিল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বর্তমান প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন এই দায়িত্বটি পালন করতে পারেন। তবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের মতো তাকেও তিন মাস পর তার স্বপদে ফিরে আসার সুযোগ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে তিনি যদি দায়িত্ব নেন, তাহলে প্রশাসনিক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পরিবর্তনের দায়িত্বটি তাকে দিতে হবে। ষষ্ঠত, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থেই একটি নয়া নির্বাচন কমিশন দরকার। বর্তমান সিইসি ও কমিশনাররা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবেন এবং নয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান একটি সার্চ কমিটির মাধ্যমে নয়া সিইসি ও কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন। সার্চ কমিটির সদস্যদের কোনো ধরনের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারবে না। নয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধানকে এককভাবে সার্চ কমিটির সদস্যদের নিয়োগের এখতিয়ার দিতে হবে। তার সিদ্ধান্তে কোনো আপত্তি চলবে না। সপ্তম, একটি নির্বাচনকালীন ‘কোড অব কনডাক্ট’ প্রণয়ন করা জরুরি। নির্বাচনকালীন সহিংসতা এড়ানোর জন্য কোনো দলকে জনসভা করতে দেয়ার অনুমতি দেয়া হবে না। টিভি ও বেতারে তারা কর্মসূচি উপস্থাপন করবেন। কোনো নেত্রী, নেতা সম্পর্কে কটূক্তি করা যাবে না। অষ্টম, সাংবিধানিকভাবে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সংসদ বৈধ। তবে এর ৯০ দিন আগে প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভেঙে দেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করবেন। সংসদ ভেঙে যাওয়ার তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন হবে। এই সময়ে দুই নেত্রী সমান প্রটোকল পাবেন। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, সংসদ রেখেই দেশে নির্বাচন হবে। ‘সংসদ রেখে নির্বাচন’-এমন বক্তব্য সংবিধান সম্মত নয়। প্রধানমন্ত্রী সব সময় সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করার কথা বলেন। সংবিধানের প্রতিটি ধারা, উপধারা তিনি ভালো বোঝেন, এটা আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু ‘সংসদ রেখে নির্বাচন’ কোন ধারায় আছে, আমি তা খুঁজে পাইনি কোথাও। বরং সংবিধানের ১২৩ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, সংসদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যেই নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে রেখে যে নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে, তা বাস্তবায়ন করতে হলে বিএনপির সম্মতি যেমনি প্রয়োজন, ঠিক তেমনি প্রয়োজন ২৪ অক্টোবরের পর সংসদ ভেঙে দেয়া। ওই তিন মাস প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। তবে সংসদ থাকবে না।
সংসদ থাকলে কী ধরনের জটিলতা তৈরি হবে, তা ইতোমধ্যে আমরা একাধিকবার আলোচনা করছি। এখন যে বিষয়টি গুরুত্ব পেতে পারে তা হচ্ছে সংবিধানের আওতায় কীভাবে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায়। টিভি টক-শো আর সরকারি বুদ্ধিজীবীদের যুক্তিহীন বক্তব্যে এর সমাধান হবে না। ২৪ অক্টোবরের আগেই সরকার আর বিরোধী দলের সংবিধান বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সংলাপ করতে হবে। এখানে মহাসচিব পর্যায়ে বৈঠকের কোনো প্রয়োজন নেই। স্পিকারের সভাপতিত্বে দু’দলের সংবিধান বিশেষজ্ঞরা সংলাপ করতে পারেন। ওই সংলাপে একটা সমাধান বের হয়ে আসতে পারে। একটা বিষয় এখন স্পষ্ট, প্রধানমন্ত্রী নিজে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে যেতে চান এবং নির্বাচন পরিচালনা করতে চান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যা বুঝতে পারছেন না, তা হচ্ছে : ১. তিনি যদি অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও থেকে যান, তাহলে সুবিধাভোগীরা তাকে দিয়ে ক্ষমতা না ছাড়ার নানা ষড়যন্ত্র (?) করতে পারে; ২. তার আমলে প্রশাসনে নিয়োগপ্রাপ্তদের দিয়ে তিনি নির্বাচনে প্রভাব খাটাতে পারেন; ৩. নির্বাচন কমিশনাররা (সিইসি বাদে) তার আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত। নির্বাচন কমিশনাররা ‘অবৈধ কর্মকাণ্ডে’ জড়িয়ে পড়তে পারেন; ৪. নির্বাচনের সময় সেনা মোতায়েন না হলে স্থানীয় পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এসবই আশঙ্কার কথা। বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে এ ধরনের শংকার কথা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এখন যদি সরকার সত্যিকার অর্থেই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন এবং সংবিধানকে সমুন্নত রাখতে চায়, তাহলে বিরোধী দলের আস্থা সরকারকে অর্জন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীকে তার উপদেষ্টারা কিংবা নীতি-নির্ধারকরা সঠিক উপদেশটি দিচ্ছেন বলে মনে হয় না। প্রধানমন্ত্রীকে এটা উপলব্ধি করতে হবে যে, বাংলাদেশে গত ৪১ বছরের মধ্যে সংবিধানের ইতিহাসে এবারের মতো এত বড় সংকট অতীতে কখনো চোখে পড়েনি। এরশাদ জমানার শেষের দিকে কীভাবে এরশাদ ক্ষমতা সংবিধানের আওতায় হস্তান্তর করবেন এ প্রশ্ন উঠলেও বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান করে একটা সমাধান বের করা সম্ভব হয়েছিল। সাংবিধানিক সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছিল। সংকটের বৃত্ত মুক্ত হওয়া কঠিন কিছু নয়, তবে এজন্য চাই সবার সমান মনোভাব। বড় দলগুলোর আন্তরিকতার এবং সরকারের বড় উদ্যোগের প্রয়োজন। এবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। জাতিসংঘের মহাসচিব, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিশ্ব রাজনীতির ‘তিন অ্যাক্টর’ সবাই এক রকম বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ‘হস্তক্ষেপ’ করছে। এটা কোনো মতেই কাম্য নয়। এর মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হলো আমরা নিজেরা আমাদের সমস্যার সমাধান করতে পারছি না। আমাদের নীতি-নির্ধারকদের এটা বুঝতে হবে যে, পরিস্থিতির গভীরতা এত বেশি যে, বান কি মুন বা জন কেরির মতো বিশ্ব নেতাকে পর্যন্ত আহ্বান জানাতে হয়েছে একটি সমঝোতার। আর সমঝোতার কেন্দ্রবিন্দু একটি-নির্বাচনকালীন সরকার। এখানে নানা সাংবিধানিক তথা রাজনৈতিক সমস্যাও রয়েছে। এই সমস্যার সমাধান করা যায় শুধু পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করার মধ্য দিয়েই। এটা যে সম্ভব নয়, তা নয়। পাঠক স্মরণ করুন, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে পঞ্চম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দেশে ছিল তখন রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার। কিন্তু নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপি দলীয়ভাবে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারে বিশ্বাসী হলেও পঞ্চম সংসদে বিএনপিই সংসদীয় সরকারের বিল এনেছিল। সেদিন সংবিধানের ১২তম সংশোধনী (রাষ্ট্রপতি থেকে সংসদীয় পদ্ধতি) পাস করতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ এক হয়েছিল। বাংলাদেশে সংসদীয় সরকারের বিকাশ ও এর প্রাকটিস নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকলেও ১৯৯৬ সালে মাত্র ১৩ দিনের সংসদে (ষষ্ঠ সংসদ) তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংক্রান্ত সংবিধান সংশোধনের বিল (ত্রয়োদশ সংশোধনী) পাস হয়েছিল। ওই সংসদে (ষষ্ঠ) আওয়ামী লীগ না থাকলেও, আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছিল। এর পরের ইতিহাস আমাদের সবার জানা। সপ্তম, অষ্টম এবং নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায়। কিন্তু ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষিত হয়। যদিও উচ্চ আদালতের রায়ে আরো দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় আয়োজন করার পক্ষে মত দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সংসদ আদালতের এই অভিমতটি গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশ আজ এক কঠিন সাংবিধানিক সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ‘অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে যদি ‘প্রধান নির্বাহী’ হিসেবে থেকে যান এবং তার ঘোষণা অনুযায়ী যদি শেষ দিন পর্যন্ত সংসদ কার্যকর থাকে, তাহলে নানা সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হবে। সরকারের পক্ষে তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে কি-না বলা মুশকিল। সরকারকে একদলীয় নির্বাচনের ঝুঁকি গ্রহণ করতে হবে। এর মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই; বরং কৃতিত্ব আছে সমঝোতার। ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ গঠনকল্পে দুটি বিকল্প হতে পারে। ‘সাহাবুদ্দীন ফর্মুলা’ অথবা বিরোধীদলীয় নেত্রীকে সমমর্যাদায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের সমান সংখ্যক প্রতিনিধি (নির্বাচিত) নিয়ে একটি সরকার। প্রয়োজনে সংবিধানের আওতায় এটা কীভাবে সম্ভব, সে ব্যাপারে আপিল বিভাগে একটি রেফারেন্স চাওয়া যেতে পারে।
টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
দৈনিক মানবকন্ঠ ২৩ সেপ্টেম্বর।
- See more at: http://www.manobkantha.com/2013/09/23/139888.html#sthash.UzlMR3Mx.jU0cexGx.dpuf


সিরীয় সমঝোতা ও অমীমাংসিত কিছু প্রশ্ন

জেনেভায় লেভারভ-কেরি সমঝোতা স্বাক্ষর এবং জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শকদের তদন্ত রিপোর্ট দাখিলের পরও সিরিয়া সংকটের সমাধান হয়েছে এটা বলা যাবে না। লেভারভ-কেরি সমঝোতায় আপাতত মধ্যপ্রাচ্যে একটি ‘যুদ্ধ’ এড়ানো গেছে সত্য, তবে বেশ কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন রয়ে গেছে, যার ওপর নির্ভর করছে সিরিয়ার ভবিষ্যৎ।
রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী একটি সমঝোতায় উপনীত হলেও যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নীতিনির্ধারককে দেখেছি তারা রাশিয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। উপরন্তু পুতিনের নিউইয়র্ক টাইমসে দেয়া একটি উন্মুক্ত আবেদনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে American Exceptionalism হিসেবে উল্লেখ করায় একটা প্রশ্ন থেকেই গেল যে, আগামীতে স্নায়ুযুদ্ধ সময়কার পরিস্থিতির জন্ম হতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা American Exceptionalism বা আমেরিকার রক্ষণশীলতাবাদ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখেন। মার্কসবাদীরা এ টার্ম এক সময় ব্যবহার করতেন, বিশেষ করে স্ট্যালিনের সময়কালে মার্কিন গবেষকরা অনেকেই এ বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের ২০ বছর পার হয়ে যাওয়ার পর আমেরিকার যুদ্ধবাজরা আবার তৎপর হয়ে উঠেছে। প্রেসিডেন্ট ওবামা নিজে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার (২০০৮) পেলেও লিবিয়ায় তিনি যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। এখন সিরিয়ায় আরেকটি যুদ্ধের জন্য সারাবিশ্ব অপেক্ষা করছে। সারাবিশ্ব জানে, ইসরাইলি লবি এবং ইসরাইল নিজেও সিরিয়ায় যুদ্ধ চায়। এখন ‘কূটনীতি’ যুদ্ধবাজদের পূর্ণ পরাস্ত করতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় না। এখনও যুদ্ধের সম্ভাবনা রয়েছে।

লেভারভ ও কেরির মধ্যে সমঝোতার পাশাপাশি আরও দুটি সংবাদ সম্প্রতি ছাপা হয়েছে, যা ওই অঞ্চল সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিতে পারে। এক. জাতিসংঘের একটি তদন্ত দল তাদের প্রতিবেদন নিরাপত্তা পরিষদের কাছে জমা দিয়েছে। ওই রিপোর্টে সরাসরি আসাদ সরকারকে রাসায়নিক অস্ত্র দিয়ে হামলার (২১ আগস্ট) ব্যাপারে অভিযুক্ত করা হয়নি। রিপোর্টে স্বীকার করা হয়েছে, সিরিয়ায় সাধারণ মানুষের ওপর রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কারা ওই অস্ত্র ব্যবহার করেছে, তা নিয়ে অস্পষ্টতা থাকলেও এ হামলার জন্য পরোক্ষভাবে আসাদ সরকারকেই দায়ী করা হয়েছে। দুই. লন্ডনের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফে’ আইএইচএস জেইন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, বর্তমানে সিরিয়ায় আসাদের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করছে (সংখ্যায় প্রায় এক লাখ), সেই বিদ্রোহী বাহিনীর প্রায় অর্ধেক জঙ্গি সংগঠন আল কায়দার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এটা একটা উদ্বেগজনক খবর। যারা নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন, তাদের কাছে জেইনের গবেষণা কোনো অপরিচিত বিষয় নয়। জেইনের পক্ষ থেকে গবেষণাটি পরিচালনা করেন চার্লস লিস্টার। তিনি তার গবেষণায় এটাও উল্লেখ করেছেন, বিদ্রোহী বাহিনীর সঙ্গে প্রায় ১০ হাজার লোক রয়েছেন, যারা আদৌ সিরিয়ার নাগরিক নন। এরা জঙ্গিবাদী সংগঠন আল নুসরা ফ্রন্ট, ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়ার ব্যানারে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। এখন যুক্তরাষ্ট্রে কোনো কোনো মহলে এমন ধারণাও জন্ম হয়েছে যে, সিরীয় যুদ্ধে লাভবান হচ্ছে নয়া আল কায়দা সংগঠনগুলো। সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতন হলে আসাদ সরকারের সব অস্ত্র চলে যাবে আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গি সংগঠনগুলোর হাতে। এমনকি রাসায়নিক অস্ত্র এদের হাতে পড়াও বিচিত্র কিছু নয়। চার্লস লিস্টার তার গবেষণায় উল্লেখ করেছেন, মাত্র ২৫ ভাগ যোদ্ধা ধর্মনিরপেক্ষ তথা লিবারেলপন্থী।

সিরিয়া সংকটে আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো যে শক্তিশালী হয়েছে, তা সম্প্রতি ওয়াশিংটনে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি কমিটির (সিনেটের) এক শুনানিতেও উল্লেখ করা হয়েছে। টম জোসেলিনের কমিটিতে সাক্ষ্যদানের খবর ইন্টারনেটে সার্চ দিলে পাওয়া যাবে। তাই একটা প্রশ্ন থেকেই গেল- রুশ-মার্কিন সমঝোতা সিরিয়া সংকটের কতটুকু সমাধান বয়ে আনবে? এটা সত্য, আপাতত যুদ্ধ হচ্ছে না। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়।

মার্কিন টিভি চ্যানেলগুলোয় এমনকি ফরিদ জাকারিয়ার মতো টিভি ব্যক্তিত্বও এ চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। অনেকেই বলেছেন, এ সমঝোতা কাজ করবে না। এখানে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। এক. সমঝোতা অনুযায়ী সিরিয়ায় পরিপূর্ণভাবে নিরস্ত্রীকরণের কাজ শেষ হবে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি। প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র এতদিন অপেক্ষা করবে কি-না? এখানে প্রশ্ন উঠেছে, বাশার আল আসাদকে স্বীকার করা নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি প্রণয়নকারী ও নীতিনির্ধারকরা এটা কি করবেন? দুই. এ অঞ্চলের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজি তাতে দেখা যায়, ক্ষমতায় একনায়কতান্ত্রিক সরকারগুলোকে রেখে কোনো সমঝোতায় জট খোলেনি। ইরাকে সাদ্দাম হোসেন ও লিবিয়ায় গাদ্দাফির ক্ষেত্রে কোনো জট খোলেনি। ফলে চূড়ান্ত বিচারে এদের উৎখাতের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের। এরা সাদ্দাম হোসেন, গাদ্দাফি আর বাশারকে এক কাতারেই দেখে। কোনো পার্থক্য করে না। তাই যুক্তরাষ্ট্র কি বাশারকে আরও প্রায় এক বছর ক্ষমতায় রাখবে? তিন. সমঝোতায় সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্রের হিসাব, অবস্থান, মজুদ, অস্ত্রের ধরন, গবেষণা ইত্যাদির কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। নভেম্বরের মধ্যে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়ার কথা। এখন যদি সিরীয় সরকার জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শকদের সঙ্গে সহযোগিতা না করে, তখন কী হবে? চার. রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের অনেকেই জানিয়েছেন, সিরিয়াকে পুরোপুরিভাবে রাসায়নিক অস্ত্রমুক্ত করার কাজটি অত সহজ নয়। কারণ ধারণা করা হয়, সিরিয়ায় মোট ৪০টি রাসায়নিক কারখানা অথবা এলাকা রয়েছে, যেখানে এসব অস্ত্র উৎপাদন করা হয় অথবা তা সংরক্ষণ করা হয়। প্রায় ১ হাজার মেট্রিক টন গ্যাস (সারিন ও মাস্টার্ড গ্যাস) সিরিয়া সংরক্ষণ করেছে। এসব গ্যাস ধ্বংস করা কঠিন কাজ। একজন গবেষক লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্র গত ২৮ বছর ধরেই তাদের কাছে রক্ষিত রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস করে আসছে। কিন্তু পুরোপুরি ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। এখানে সিরিয়া নিয়ে যে বড় সমস্যা হবে তা হচ্ছে, এসব অস্ত্র একটি নির্দিষ্ট প্লান্টে বা স্থানে ধ্বংস করতে হবে। সিরিয়ায় তা করা যাবে না। সিরিয়া থেকে সরিয়ে নিয়ে অন্য কোনো দেশে ধ্বংস করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের ১৩টি প্লান্টের মধ্যে ৯টি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ইউরোপে পরিবেশবাদীরা অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা যে কোনো পরিবহন ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা গড়ে তুলবে। স্থানীয় আইন ও আন্তর্জাতিক আইনও পরিবহন ব্যবস্থার বিপক্ষে। সুতরাং একটা প্রশ্ন থেকেই গেল। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া একটা সমাধান হতে পারে। কিন্তু সিরিয়ার আসাদ সরকারকে রাশিয়ার সমর্থন এবং রুশ-মার্কিন সম্পর্কের টানাপোড়েন ইত্যাদি নানা কারণে সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংসের বিষয়টি নিয়ে আগামীতে জটিলতা তৈরি হতে পারে। পাঁচ. সিরিয়ায় অস্ত্র পরিদর্শক হিসেবে কারা কারা থাকবেন, সেটা নিয়েও একটা জটিলতা তৈরি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে একটি সংস্থা রয়েছে- Organization for the Prohibition of Chemical Weapons (OPCW)। এ সংস্থাটি মূলত নিয়ন্ত্রণ করে আমেরিকানরা। এ ক্ষেত্রে পরিদর্শক টিমে যদি আমেরিকানদের সংখ্যা বেশি থাকে, তা সিরিয়ার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। ছয়. এ সমঝোতার ব্যাপারে সিরীয় বিদ্রোহীরা তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছে। বাশার সরকার বিদ্রোহীদের নিরস্ত্রীকরণের দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু সেই দাবি গ্রহণযোগ্য হয়নি। এখন বিদ্রোহীরা যদি তাদের আক্রমণ অব্যাহত রাখে, তাতে করে এ পরিদর্শন কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে। ভেঙে যেতে পারে সমঝোতা। সাত. এ সমঝোতার পেছনে মূল অ্যাক্টর দুই শক্তি- যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। অথচ সিরীয় সরকার ও বিদ্রোহী পক্ষের কোনো অংশগ্রহণ নেই। ফলে অনেকটা চাপিয়ে দেয়ার মতো হয়ে গেল বিষয়টা। আন্তর্জাতিক যে কোনো ইস্যু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মাঝে যদি বিরোধ দেখা দেয়, তাহলে তা এই সমঝোতার ওপর প্রভাব ফেলবে। সমঝোতা ভেঙেও যেতে পারে।

সিরিয়ায় একটি ‘সমঝোতার’ মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের ব্যাপারে মার্কিন নীতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসে কি-না, সে বিষয়ে লক্ষ্য থাকবে অনেকের। মিসরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ‘ব্যর্থ’ হয়েছে। বলা হচ্ছে, সেখানে যে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছিল, তার পেছনে ইসরাইলি লবি কাজ করেছিল। নিঃসন্দেহে মিসরে সামরিক অভ্যুত্থান মার্কিন নীতিনির্ধারকদের একটা দোটানায় ফেলে দিয়েছে। ইরানের নতুন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ওবামা প্রশাসনের সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেদিকেও লক্ষ্য থাকবে অনেকের। বিশেষ করে নতুন প্রেসিডেন্ট ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান, তা দেখতে চাইবে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের অনেকে। আর সিরিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশ লেবাননের দিকে দৃষ্টি এখন অনেকের। পর্যবেক্ষকদের কারও কারও ধারণা, সিরিয়ার পর এখন লেবাননে অস্থিরতা দেখা দেবে। লেবাননের হিজবুল্লাহদের ব্যাপারে ইসরাইলের আপত্তি দীর্ঘদিনের। তাই সিরিয়ায় একটি সমঝোতা আমাদের সব প্রশ্নের জবাব দেবে না। মধ্যপ্রাচ্য উত্তপ্ত থাকবেই আরও বেশ কিছুদিনের জন্য।
হিউস্টন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
(যুগান্তর, ২৩/০৯/২০১৩)

ওবামা এখন কী করবেন

সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র হামলা প্রমাণিত হওয়ার পর ওয়াশিংটনে আইন প্রণেতাদের মধ্যে একটা কথা উঠেছে যে, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) মাধ্যমে বিচার করা উচিত। আর এর মাধ্যমেই সিরিয়ায় সম্ভাব্য একটি 'যুদ্ধ' এড়ানো সম্ভব। এরই মধ্যে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন সিরিয়ার অভ্যন্তরে গৃহযুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র হামলাকে 'যুদ্ধাপরাধ' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অনেকেই জানেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য ২০০২ সালে রোম চুক্তি অনুযায়ী এই অপরাধ আদালত গঠিত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা আইসিসি এরই মধ্যে বসনিয়া, লাইবেরিয়া কিংবা কঙ্গো ও রুয়ান্ডা-বুরুন্ডির গণহত্যার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচার করছে। এরই মধ্যে কোনো কোনো বিচার সম্পন্ন হয়েছে ও কোনো কোনো বিচার সমাপ্তির পথে। রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরাও এই বিচারপ্রক্রিয়া থেকে বাদ যাচ্ছেন না। গত সপ্তাহে হেগে আইসিসির আদালতে কেনিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটোকে হাজির করা হয়েছিল। তিনি অভিযুক্ত হয়েছেন কেনিয়ায় ২০০৮ সালে নির্বাচনের প্রাক্কালে ব্যাপক হত্যা তথা গণহত্যা চালানোর জন্য। একই অভিযোগে কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট কেনিয়াত্তাও অভিযুক্ত। তাঁর বিচার হবে জানুয়ারিতে। এখন সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগে (যাতে প্রায় ১৪০০ ব্যক্তি মারা গিয়েছিল) আসাদের বিচার হতে পারে! তবে বিষয়টি খুব সহজ হবে না। কেননা জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনে সিরিয়ায় সারিন গ্যাস ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেলেও তদন্ত কমিটি সরাসরি বলেনি, এর জন্য সিরীয় সরকারই দায়ী। একই সঙ্গে জাতিসংঘে রাশিয়ার ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রমাণসহ বিদ্রোহী বাহিনীর গ্যাস ব্যবহারের অভিযোগ এনেছেন। ফলে জাতিসংঘে বিষয়টি নিয়ে একটা ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। তবে এখানে একটি জিনিস স্পষ্ট, আর তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে যুদ্ধবাজরা এখনো সক্রিয়। তারা চায় একটি 'যুদ্ধ'। প্রেসিডেন্ট ওবামা আপাতত 'যুদ্ধের' আশঙ্কা কিছুটা পিছিয়ে দিলেও কংগ্রেসে এমন অনেক আইন প্রণেতা আছেন, যাঁরা চাচ্ছেন এখনই সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার করা হোক। কংগ্রেস উইম্যান বারবারা লি (ডেমোক্র্যাট) প্রতিনিধি পরিষদে এই আইনের খসড়া উপস্থাপন করেছেন, যেখানে আইসিসির আওতাকে সম্প্রসারণ করে আসাদকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁকে হেগের আদালতে বিচারের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্য একজন কংগ্রেসম্যান ক্রিস স্মিথও (রিপাবলিকান) আসাদকে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন। ধারণা করছি, আগামী দিনগুলোতে এই দাবি আরো শক্তিশালী হবে। এখানে বলা ভালো, রোম চুক্তিটি (যাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠিত হয়েছে) ১২২টি দেশ 'রেটিফাই' করেছে, অর্থাৎ নিজ দেশের সংসদে তা অনুমোদিত হয়েছে। অন্যদিকে ৩১টি দেশ এই চুক্তি সমর্থন করলেও (স্বাক্ষর করেছে) নিজ দেশের সংসদ তা অনুমোদন করেনি। যুক্তরাষ্ট্র ও সিরিয়া রোম চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও সংসদে তা এখনো অনুমোদিত হয়নি। তিন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সাধারণত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হয়। প্রথমত, রোম চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী কোনো দেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য হেগে আইসিসির প্রসিকিউটরের কাছে তদন্তের জন্য আবেদন করবে। তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেলে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব। অথবা চুক্তি স্বাক্ষরকারী কোনো দেশ অন্য কোনো দেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আইসিসির কাছে আবেদন করতে পারবে। অথবা নিরাপত্তা পরিষদ তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আইসিসিকে যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি তদন্ত করে দেখার জন্য অনুরোধ করতে পারে।

নাইন-ইলেভেনের ঘটনার পর (টুইন টাওয়ার হামলা) যুক্তরাষ্ট্র তিন-তিনটি যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। ২০০১ সালের অক্টোবরে আফগান যুদ্ধ, ২০০৩ সালের মার্চে ইরাক যুদ্ধ, আর ২০১১ সালে লিবীয় যুদ্ধ। এসব যুদ্ধের পেছনে কোটি কোটি ডলার খরচ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তাতে যে যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হয়েছে তা বলা যাবে না। ২০১১ সালে সিএনএনের জরিপে দেখা যায়, ৭৪ শতাংশ মানুষ বলেছিল, যুক্তরাষ্ট্র আক্রান্ত না হলে তাদের আক্রমণ করা উচিত নয় (অথচ লিবিয়া আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছিলেন ওবামা)। যুক্তরাষ্ট্র Operation Enduring Freedom দিয়ে আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালিয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় গত ১২ বছরে অনেক পরিবর্তন এসেছে। একের পর এক যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু তাতে জনমত প্রতিফলিত হয়নি।

আসলে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে জনমত জরিপের ফলাফল প্রতিফলিত হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের নিজেরই নানা সমস্যা। বেকার সমস্যার পাশাপাশি স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে চিন্তিত আছে হাজার হাজার মানুষ। অতিরিক্ত ট্যাক্সের কারণে অন্য আরেকটি দেশে (ইউরোপে) স্থায়ীভাবে থাকার চিন্তা করছে কেউ কেউ। যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করতেই এই অতিরিক্ত কর। স্বৈরাচারী সরকার উৎখাত করে সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে 'যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া' যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হলেও সাধারণ মানুষ তা চায় না। ২০১১ সালে সংবাদ সংস্থা এপিও একটি জনমত জরিপ পরিচালনা করেছিল। ওই জরিপেও প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, 'গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগী হওয়া উচিত কি না?' ৬৪ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছে উচিত নয়, আর ৩২ শতাংশ বলেছে উচিত। একই জনমত পাওয়া গেছে ২০১৩ সালে আরেকটি সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রাক্কালে। 'স্বৈরাচারের বদলে গণতন্ত্র' তাদের কাম্য নয়। ৭২ শতাংশের অভিমত তাই। এসব জনমত সমীক্ষা প্রমাণ করে, মার্কিনি নীতিনির্ধারকরা জনমত সমীক্ষাকে গুরুত্ব দেন না। যুদ্ধে যাওয়ার পেছনে তাঁদের স্বার্থ অনেক। এ ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে যদি তারা আসাদকে আইসিসির আদালতে বিচারের জন্য 'চাপ' দেয়, আমি অবাক হব না। সিরিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নয়; বরং আসাদকে উৎখাত করাই হবে তাদের এখন মূল টার্গেট।

দৈনিক কালেরকন্ঠ, 22 সেপ্টেম্বর ২০১৩, রবিবার।
হিউস্টন, যুক্তরাষ্ট্র, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৩
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

যুদ্ধ ও ওবামা প্রশাসন

শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০০৮ সালে। কিন্তু যুদ্ধের সঙ্গে তার নাম ওতপ্রোত জড়িয়ে আছে। লিবিয়া যুদ্ধের পর এখন দ্বিতীয় আরেকটি যুদ্ধের মুখোমুখি তিনি। সিরিয়া আক্রমণের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পরও তিনি শেষ মুহূর্তে কূটনীতির আশ্রয় নিয়েছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন রাশিয়ার সহযোগিতা নিয়ে সিরিয়া সঙ্কটের একটা সমাধান খুঁজে বের করতে। সেই সমাধান পাওয়া গেছে। কিন্তু এতে করে একটি যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত এড়ানো যাবে? মার্কিন প্রশাসনে কংগ্রেসি যুদ্ধবাজরা এখনো সক্রিয়। ইসরাইলও চাচ্ছে একটি যুদ্ধ। উপরন্তু সর্বশেষ জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনে সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এখন এ বিষয়টিই একটি ইস্যু হতে পারে এবং যুদ্ধবাজদের সিরিয়া আক্রমণে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে যুদ্ধবাজরা ২০০১ সালের পর থেকেই সক্রিয়। সেপ্টেম্বরে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংস হয়। এর এক সপ্তাহের মাথায় যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ করল আফগানিস্তানে। আর ঠিক দুই বছর পর ২০০৩ সালের ২০ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ করল ইরাকে। অভিযোগ, ইরাকের কাছে মানবজাতি ধ্বংসকারী মারাত্মক সব অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে! জাতিসংঘের তদন্তকারীরা সেসব অস্ত্র খুঁজে পাওয়ার আগেই বাগদাদ যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্রে আক্রান্ত হলো, আর ৯ এপ্রিল পতন ঘটল সাদ্দাম হোসেনের। একসময় আফগানিস্তানের মতো ইরাকও 'দখল' হয়ে গেল। কিন্তু কোনো দিনই আর পাওয়া গেল না সেসব মারণাস্ত্র। এরপর প্রায় ১০ বছর অপেক্ষা। ২০১১ সালের ১৯ মার্চ ইঙ্গ-মার্কিন বিমান হামলায় জ্বলে উঠল ত্রিপোলি। শুরু হলো যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় যুদ্ধ। এখানে হুট করে ইরাকের মতো সেনাবাহিনী পাঠায়নি যুক্তরাষ্ট্র। তবে সাদ্দাম হোসেনকে যেমনি জীবিত রাখা 'হুমকি' মনে করত যুক্তরাষ্ট্র, ঠিক তেমনি গাদ্দাফিও ছিল হুমকিস্বরূপ। তাই তাদের পৃথিবী থেকে চলে যেতে হয়েছিল। গাদ্দাফির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল মানবাধিকার লংঘনের। নতুন তত্ত্ব উপস্থাপিত হলো_ ঐঁসধহরঃধৎরধহ ওহঃবৎাবহঃরড়হ, অর্থাৎ মানবাধিকার রক্ষায় সামরিক হস্তক্ষেপ। ২০০৩ সালে জাতিসংঘ যেমনি অনুমোদন দেয়নি ইরাক আক্রমণের। তবে নিরাপত্তা পরিষদে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল_ তাতে বলা হয়েছিল_ 'প্রয়োজনীয় বিধি ব্যবস্থা' গ্রহণ করার। আর আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যায় এই 'প্রয়োজনীয় বিধি ব্যবস্থা' কোনো পর্যায়েই যুদ্ধকে সমর্থন করে না। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন লিবিয়া আক্রমণ করল, তখনো কোনো সমর্থন ছিল না নিরাপত্তা পরিষদের। জাতিসংঘ সনদের ৫১ নাম্বার ধারায় স্পষ্ট বলা আছে_ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়া যুদ্ধ শুরু করা যাবে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বাগদাদে 'দ্বিতীয় যুদ্ধ', আর ত্রিপোলিতে 'তৃতীয় যুদ্ধ' শুরু করেছিল। আর এর ধারাবাহিকতায় আরেকটি যুদ্ধ দরকার। যুক্তরাষ্ট্র আরব বিশ্বে আরেকটি যুদ্ধ শুরু করতে চায় যাকে কিনা বলা যায়, 'চতুর্থ যুদ্ধ'। ত্রিপোলিতে যেমনি ব্যবহৃত হয়েছিল একটি তত্ত্ব ঐঁসধহরঃধৎরধহ ওহঃবৎাবহঃরড়হ, সিরিয়ার ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হতে যাচ্ছে সে রকম একটি তত্ত্ব জবংঢ়ড়হংরনরষরঃু ঃড় চৎড়ঃবপঃ । অর্থাৎ বাংলা করলে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে_ মানবতা রক্ষায় আন্তর্জাতিক দায়িত্ব। এ 'দায়িত্বের' অংশ হিসেবেই সিরিয়ায় মিসাইল হামলা হতে পারে। তবে বাগদাদের যেমনি ডগউ বা কোনো মরণাস্ত্র জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শকরা খুঁজে পাননি, ঠিক তেমনি সিরিয়ায় কারা রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছিল, তাও খুঁজে পায়নি জাতিসংঘের টিম। তাদের রিপোর্টটি নিয়ে বিতর্ক আছে। কেননা সিরিয়াকে অভিযুক্ত করা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র এখন কত দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করবে আরেকটি যুদ্ধের জন্য?

চূড়ান্ত বিচারে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে যাবে কি যাবে না তা নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেক। এক. যুক্তরাষ্ট্রের জনমত যুদ্ধে যাওয়ার পক্ষে নয়। সর্বশেষ সিএনএনের জনমত জরিপে দেখলাম শতকরা ৫০ ভাগের ওপর মানুষ যুদ্ধের বিপক্ষে। তবে এটা সত্য, প্রেসিডেন্ট ওবামা কংগ্রেসের উভয় পক্ষের সমর্থন পাবেন। ৯ সেপ্টেম্বর কংগ্রেসের এ অধিবেশন বসার কথা ছিল, যা পিছিয়ে গেছে ওবামার অনুরোধে। তবে সিনেটের ফরেন রিলেশন্স কমিটি সিরিয়া আক্রমণের পক্ষে অভিমত দিয়েছিল। এর ফলে ওবামার হাত শক্তিশালী হয়েছিল। দুই. সিরিয়াকে 'শাস্তি' ও 'সীমিত' মিসাইল আক্রমণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ওবামা। ধারণা করা হচ্ছে, এ হামলায় সেনাবাহিনী ব্যবহৃত হবে না এবং মিসাইল হামলা দীর্ঘায়িত হবে মাত্র ৬০ দিন। কিন্তু এখানে অনেক অমীমাংসিত প্রসঙ্গ রয়েছে। এই হামলা কি চূড়ান্ত বিচারে বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করবে? এটাই কি যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেট? এতে করে কি বাশার সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস হবে? বিষয়টি যত সহজ মনে করা হচ্ছে অতটা সহজ নয়। তিন. এই যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে বড় ধরনের আঘাত করতে পারে। একজন শীর্ষস্থানীয় জেনারেল ও মার্কিন সেনাবাহিনীর জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ জেনারেল ডেমপাসের মতে, প্রতি মাসে ১ মিলিয়ন ডলার খরচ হবে সিরিয়ায় আক্রমণ শুরু হলে। অর্থের পরিমাণটা একেবারে কম নয়। এমনিতেই অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারছেন না ওবামা। ৪ সেপ্টেম্বর অনলাইনভিত্তিক সংবাদপত্র গপঈষধঃপযু-তে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। এতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি প্রাপ্তবয়স্ক সাতজন নাগরিকের মধ্যে একজন 'ফুড স্টাম্প' গ্রহণ করে থাকেন। অর্থাৎ ফেডারেল সরকারের কাছ থেকে খাদ্যসাহায্য পেয়ে থাকেন। ১৭ দশমিক ৬ মিলিয়ন পরিবার খাদ্য নিরাপত্তায় ভোগে। ৪৯ মিলিয়ন মানুষ জানে না পরের বেলার খাদ্য তারা কোত্থেকে জোগাড় করবে। ফেডারেল সরকার প্রতি বছর ৭৮ মিলিয়ন ডলার এই 'ফুড স্টাম্প'-এর পেছনে ব্যয় করে। অর্থাৎ গরিব জনগোষ্ঠী খাদ্যসহায়তা পায়। এখন যদি 'যুদ্ধ' শুরু হয় তাহলে নির্দ্বিধায় এই খাদ্যসহায়তা কার্যক্রম ব্যাহত হবে। এর ফলে গরিব মানুষের সংখ্যা আরো বাড়বে। শুধু খাদ্যসহায়তা নয়, বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা ব্যাহত হবে। পরিসংখ্যান বলে, যুক্তরাষ্ট্রে কর্মজীবী জনশক্তির শতকরা ৭ ভাগ এখন বেকার। আফ্রো-আমেরিকানদের মধ্যে এ হার ১৩ ভাগ। প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষের কোনো কাজ নেই। এখন যদি যুক্তরাষ্ট্র পুনরায় যুদ্ধে জড়িয়ে যায়, তাহলে উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ আর বাড়বে না। স্মরণ থাকার কথা, আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে প্রায় ৮ হাজার মার্কিন সৈন্য প্রাণ হারিয়েছিল। আর সাধারণ মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা ১০০ গুণ বেশি। একমাত্র ইরাকে ৪ থেকে ৯ লাখ মানুষ হয় মারা গেছে, নতুবা স্থানচ্যুত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এষড়নধষ ডধৎ ড়হ ঞবৎৎড়ৎ শুরু করে আফগানিস্তান ও ইরাকে যে যুদ্ধ শুরু করেছিল এতে ব্যয় হয়েছিল ৩ থেকে ৪ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার (১ ট্রিলিয়নে ১ হাজার মিলিয়ন ডলার)। এখন সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হলে ওবামাকে অর্থ বরাদ্দ করতে হবে এবং এর পরিমাণ কোথায় গিয়ে ঠেকবে কেউ বলতে পারে না। চার. যুক্তরাষ্ট্র তিনটি দেশে (আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া) যুদ্ধ শুরু করলেও সেখানে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারেনি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা তো স্বপ্নই থেকে গেছে। আফগানিস্তান এখন বাহ্যত তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে। ২০১৪ সালে সেখান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করা হলে কারজাইকেও দেশত্যাগ করতে হবে। আর টাইমসের খবর অনুযায়ী (৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩) গত কয়েক মাসে ইরাকে ৩ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ইরাকে এখন আত্মঘাতী বোমাবাজের জন্ম হয়েছে। ইরাক এখন শিয়া, সুনি্ন ও কুর্দি_ এ তিন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভক্ত হয়ে আছে। লিবিয়ায় কোনো স্থিতিশীল সরকার নেই। অস্ত্রবাজরা আজ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। এদের হাতেই প্রাণ হারিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত। সিরিয়ার ক্ষেত্রেও এমনটি হতে যাচ্ছে। পাঁচ. মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো শক্তিশালী হয়েছে। ইরাক ও লিবিয়ায় এরা শক্তিশালী হয়েছে। সিরিয়ায় আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আল-বুশরা ফ্রন্ট ও ইরাকের ইসলামিক স্টেট অব ইরাক সিরিয়া-ইরাক সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করে। যুদ্ধে আল-কায়েদার উৎখাত নয়, বরং আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করেছে। ছয়. এই 'যুদ্ধ' একটি আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হতে পারে। সিরিয়ার পাশের দেশ ইরান, লেবানন ও ইসরাইল এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে এবং সেই সঙ্গে বিশ্ব নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করতে পারে।

ইতিহাস তখন ওবামাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবে জানি না। তবে শেষ মুহূর্তে যুদ্ধে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি একটি দূরদর্শিতারই পরিচয় দিয়েছেন। তার এ সিদ্ধান্ত বিশ্বে উত্তেজনা হ্রাস করতে যেমনি সাহায্য করেছে, ঠিক তেমনি পেন্টাগনের যুদ্ধবাজদেরও তিনি একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। অভ্যন্তরীণভাবে তার সমস্যা অনেক। অর্থনীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। তার স্বাস্থ্যসেবা (ওবামাকেয়ার) বড় বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং তিনি যদি সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু করতেন, তা তাকে বিতর্কিতই করত।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে একজন কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট যুদ্ধবাজ হিসেবে পরিচিত হবেন, এটা অনেকেই চান না। তবে পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত তাকে যুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করে কি না, তাই দেখার বিষয়। আগামীতে সিরিয়া রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস করতে কীভাবে জাতিসংঘ টিমকে সহযোগিতা করে, সেটাই এখন উল্লেখযোগ্য দিক।

দৈনিক যায় যায় দিন, ২২ সেপ্টেম্বর রবিবার ২০১৩।
হিউস্টন, যুক্তরাষ্ট্র, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
ড. তারেক শামসুর রেহমান: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ওবামা কি শেষ কথাটা বলে ফেলেছেন?

বারাক ওবামা কি সিরিয়া সম্পর্কে শেষ কথাটা বলে ফেলেছেন? ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে আপাতত ‘সিরিয়া আক্রমণে’ না যাওয়ার যে সিদ্ধান্তের কথা তিনি জানিয়েছেন, তাতে করে একটি প্রশ্ন ঘুরেফিরে যুক্তরাষ্ট্রে সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে আর তা হচ্ছে যুদ্ধ কি শেষ পর্যন্ত এড়ানো গেল সিরিয়ায়? এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে সিরিয়াসংক্রান্ত ভোটাভুটি পিছিয়ে গেছে এবং পররাষ্ট্র সচিব জন কেরি মিত্রদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্য ইউরোপ সফর করছেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা তার ভাষণে বেশ কিছু কথা বলেছেন। এক. তিনি রাশিয়ার প্রস্তাব মেনে নিয়েছেন এবং চাচ্ছেন সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্রের ভান্ডার আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে ছেড়ে দেয়া হোক। দুই. জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শকরা নিরাপত্তা পরিষদের কাছে তাদের চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করবেন। এ জন্য তিনি অপেক্ষা করবেন। তবে তিনি যে শেষ পর্যন্ত সিরিয়া আক্রমণ করবেন না, তা কিন্তু তিনি বলেননি। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছেন, সিরিয়ার কাছে যে রাসায়নিক অস্ত্র রয়েছে, তা তারা তাদের নাগরিকদের ওপর ব্যবহার করেছেন! যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে চুপ করে বসে থাকতে পারে না।

যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে গেল সপ্তাহে যুদ্ধের যে আবহ তৈরি হয়েছিল, তা এখন কিছুটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। সিরিয়া নিজে স্বীকার করেছে, তাদের কাছে রাসায়নিক অস্ত্র রয়েছে এবং দেশটি ওইসব অস্ত্র আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ তথা ধ্বংস করে দিতে রাজি! কিন্তু বিষয়টি খুব সহজ হবে না। সিরিয়ায় যে রাসায়নিক অস্ত্র রয়েছে, তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করা কিংবা জাতিসংঘের ওই পরিদর্শন টিমে কারা কারা থাকবেন, এসব নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। কেননা জাতিসংঘের রাসায়নিক অস্ত্র পরিদর্শনের যে টিম রয়েছে, তার সদস্যদের একটা বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। সুতরাং অস্ত্র পরিদর্শন নিয়ে ভবিষ্যতে সিরিয়ার সঙ্গে একটা বড় সমস্যা তৈরি হতে পারে।

রাশিয়ার ভূমিকাও স্পষ্ট নয়। সিরিয়ায় রাশিয়ার স্বার্থ রয়েছে। তবে ‘আপাতত যুদ্ধ এড়িয়ে’ ওবামা মার্কিন জনমনে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছেন। অবশ্য ‘যুদ্ধে’ যাওয়া তার জন্য অত সহজ ছিল না। জনমত তার বিপক্ষে ছিল। উপরন্তু কংগ্রেস ‘যুদ্ধে’ যাওয়ার অনুমতি দিত, এটাও ওবামা নিশ্চিত করতে পারেননি। মার্কিন সমাজে বেকারত্ব, ঋণ ইত্যাদি বেড়ে যাওয়ায় ‘যুদ্ধব্যয়’ বহন করার ক্ষমতা এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির নেই। উপরন্তু সব জনমত উপেক্ষা করে ওবামা যদি যুদ্ধ ঘোষণা করতেন, তাহলেও তিনি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করতেন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়া কোনো যুদ্ধ আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ। কেননা, অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, এ ধরনের একটি ‘চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ’ আরও বেশি মাত্রায় সহিংসতার জন্ম দেয়। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া এর বড় প্রমাণ।

অধ্যাপক স্টেফান জুনেস তার একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে যুদ্ধপরবর্তী দেশে একনায়কতন্ত্রের জন্ম হয়। সিরিয়ায় যদি ‘যুদ্ধ’ শুরু হয়ে যেত, তাহলে জাতীয়তাবাদী শক্তিকে সেখানে একত্রিত করত। তারা বাশার আসাদকে সমর্থন করতেন। তাতে প্রচ- এক মার্কিন বিরোধিতার জন্ম হবে, যা ছড়িয়ে যাবে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশে। পশ্চিমা গবেষকরা যুক্তি তুলে ধরে দেখিয়েছেন, এ ধরনের যুদ্ধ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতিই হয়েছে বেশি। যুদ্ধ শুরু হলে তা দীর্ঘায়িত হয় (আফগানিস্তান, ইরাক) এবং সামাজিক খাতে (শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিশু অধিকার) ব্যয় বরাদ্দ কমে যায়। মার্কিন গবেষকরা দেখিয়েছেন, বাশারের বিকল্প কোনো একক নেতৃত্ব সিরিয়ার বিদ্রোহীরা তৈরি করতে পারেননি। বর্তমানে প্রায় ৮০০ থেকে ১২০০ সশস্ত্র গ্রুপ বিচ্ছিন্নভাবে ‘যুদ্ধ’ করছে সরকারি সৈন্যদের বিরুদ্ধে। এদের এক কাতারে দাঁড় করানো হবে কঠিন কাজ। ফলে ‘দ্বিতীয় আরেকটি সোমালিয়া’র জন্ম হতে পারে আসাদপরবর্তী সিরিয়ায়। সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হলে আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গি সংগঠনগুলো আরও শক্তিশালী হবে। এরই মধ্যে ‘জাবহাত আল নুসরা’ নামে একটি সিরীয় সংগঠনের নাম পাওয়া গেছে, যাদের সঙ্গে আল কায়দার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এ সংগঠনকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কারণে এ সংগঠনটিও আর্থিক ও অস্ত্রশস্ত্র সাহায্য হিসেবে পেয়েছে। আফগানিস্তানের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, তালেবানদের আর্থিক ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। অথচ এক সময় এ তালেবানরাই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল। এর আগে ওবামা ও তার নীতিনির্ধারকরা যুদ্ধের কথা বললেও কীভাবে এখান থেকে বেরিয়ে আসবেন, তার কোনো পরিকল্পনার কথা বলেননি। এ যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ব নতুন করে এক ধরনের ‘প্রক্সিযুদ্ধ’ (যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া আর ইসরাইল বনাম ইরান) প্রত্যক্ষ করতে পারে।

বলা ভালো, যুক্তরাষ্ট্রের এ অঞ্চলে সামরিক হস্তক্ষেপের ইতিহাস রয়েছে। অতীতে ১৯৯১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি বহুজাতিক বাহিনী ইরাকি বাহিনীর কুয়েত দখল থেকে মুক্ত করেছিল। ২০০৩ সালে ইরাকের কাছে মানব বিধ্বংসী মারণাস্ত্র রয়েছে, এ অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন বাগদাদে মিসাইল হামলা চালিয়ে সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত করেছিল। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ২০১১ সালে লিবিয়ায়। তখন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ‘মানবতা রক্ষায়’ হস্তক্ষেপ করেছিল এবং গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। এ ক্ষেত্রে ১৯৯১ সালে কুয়েতকে ইরাকি দখলমুক্ত করতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত একটি সিদ্ধান্তের সাহায্য নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ২০০৩ ও ২০১১ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইরাক ও লিবিয়ায় সামরিক আগ্রাসন চালাতে কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। সিরিয়ার ক্ষেত্রেও তেমনটি হতে পারে। লিবিয়ায় গাদ্দাফিকে উৎখাতের ব্যাপারে ব্যবহৃত হয়েছিল ‘Humanitarian Intervention’-এর তত্ত্বটি। আর এবার ব্যবহৃত হতে পারে ‘Responsibility to Protect’ তত্ত্বটি। এর মূল কথা হচ্ছে, মানবতা রক্ষায় বিশ্বশক্তির দায়িত্ব। যেহেতু অভিযোগ, সিরিয়ায় সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে (?), সেহেতু সাধারণ মানুষকে রক্ষায় পশ্চিমা শক্তির দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবেই এ সামরিক হস্তক্ষেপ হতে পারে আগামীতে!

এখানে বলা ভালো, সিরিয়ার ঘটনাবলি সে দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনা। জাতিসংঘের চার্টারে উল্লেখ করা আছে, একটি দেশ অপর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। যদি এমন কোনো ঘটনার জন্ম হয় যে, সেখানে স্থিতিশীলতা ও গণহত্যা রোধে সামরিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে, তাহলে কাজটি করতে হবে নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত একটি সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে। ইরাকের ক্ষেত্রে (২০০৩) কিংবা লিবিয়ার ক্ষেত্রেও (২০১১) এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়নি নিরাপত্তা পরিষদ। সিরিয়ার ক্ষেত্রেও নিরাপত্তা পরিষদ এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে এটাও সত্য, আন্তর্জাতিক একটি সম্মেলনে ‘Responsibility to Protect’-এর একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। তবে এ ব্যাপারে কোনো চুক্তি হয়নি এবং এটা কোনো আন্তর্জাতিক আইনও নয়। এর অর্থ হচ্ছে সিরিয়ায় সম্ভাব্য সামরিক আগ্রাসন আন্তর্জাতিক আইন অনুমোদন করে না। যুদ্ধ, সামরিক হস্তক্ষেপ ও আন্তর্জাতিক আইন নিয়ে অধ্যাপক গ্লেন্ননের (Glennon) একটি বই রয়েছে Limits of Law, Prerogatives of Power। ওই গ্রন্থে গ্লেন্নন উল্লেখ করেছেন, এ ধরনের সামরিক হস্তক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ।

বিশ্বশক্তি, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে তার স্বার্থ রয়েছে, সেখানে সামরিক হস্তক্ষেপ করে। ‘মানবিক কারণে হস্তক্ষেপ’ কিংবা ‘মানবতা রক্ষায় দায়িত্বশীলতা’র যে যুক্তি সামরিক হস্তক্ষেপের প্রেক্ষাপট তৈরি করে, আফ্রিকায় বুরুন্ডি-রুয়ান্ডায় গণহত্যা বন্ধে কিংবা কসোভো ও ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধে যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডা-বুরুন্ডিতে হুতু-তুতসি দ্বন্দ্ব ও গণহত্যায় কয়েক লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। কসোভোতে ১৯১৯ সালে সার্বিয়ার জাতিগত উচ্ছেদ অভিযানের একপর্যায়ে শেষের দিকে ন্যাটোর বিমান বহর সার্বিয়ার সেনা ঘাঁটির ওপর বিমান হামলা চালালেও যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি এ সঙ্কটে হস্তক্ষেপ করেনি। আজ সিরিয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র তা করতে পারে। কেননা এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রয়েছে।

যারা আন্তর্জাতিক রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা ওয়াশিংটনে অবস্থিত একটি গবেষণা সংস্থা The Project for the New American Century কর্তৃক (১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত) প্রকাশিত গবেষণাপ্রবন্ধ Global US Empire : Rebuilding America’s Defence-Strategy, Forces Resources for a new Century পড়ে দেখতে পারেন।

ওবামা নিজে বলেছেন, সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য বিমান হামলা ‘সীমিত’ সময়ের জন্য পরিচালিত হবে। সমঝোতা ব্যর্থ হলে এ বিমান হামলা আগামীতে পরিচালিত হবে সিরিয়ার সেনা ঘাঁটিকে কেন্দ্র করে এবং তা সীমাবদ্ধ থাকবে কয়েকদিন মাত্র। এ হামলার উদ্দেশ্য হবে সিরিয়ার সরকারকে বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে ‘শাস্তি’ দেয়া। এতে করে বাশার কতটুকু ‘শাস্তি’ পাবেন, তা এক ভিন্ন প্রশ্ন। এ হামলা নিঃসন্দেহে বিদ্রোহী সেনাবাহিনীকে উৎসাহ জোগাবে। এমনকি এ বিমান হামলা যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে প্রেসিডেন্ট বাশারের ক্ষমতাচ্যুতিও বিচিত্র কিছু নয়। তবে এ হামলা সিরিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যে নানা জটিলতা ও সঙ্কট তৈরি করতে পারে। এ যুদ্ধ শুধু যে সিরিয়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে, তা নয়। বরং এ যুদ্ধে লেবানন ও তুরস্ক জড়িয়ে পড়তে পারে। এতে করে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে সিরিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয় আশ্রয় নেয়া হাজার হাজার শরণার্থীর মাঝে। বর্তমানে শরণার্থীদের যে সংখ্যা পাওয়া গেছে, তা অনেকটা এ রকমÑ তুরস্ক ৪ লাখ, লেবানন ৭ লাখ, বেক্কা উপত্যকায় ২ লাখ ৪০ হাজার, বৈরুত ১ লাখ ৬০ হাজার, ইরাক ১ লাখ ৫০ হাজার, জর্ডান ৫ লাখ ও মিসরে ১ লাখ ১০ হাজার। এ শরণার্থীরা একটা বড় সমস্যা তৈরি করবে আগামীতে। এরই সঙ্গে সিরিয়া জাতিগতভাবে ভাগ হয়ে যেতে পারে। সাবেক যুগোসøাভিয়ার মতো পরিস্থিতি বরণ করতে পারে সিরিয়া। তাই নয়, সিরিয়ায় আক্রমণ আগামীতে ইরানে সম্ভাব্য হামলায় মার্কিন নীতিনির্ধারকদের উৎসাহ জোগাতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ ধরনের একটি হামলায় ইসরাইল খুশি হবে সবচেয়ে বেশি। ইসরাইলের স্বার্থ এতে করে রক্ষিত হবে। বলা ভালো, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে ইসরাইল আতঙ্কিত। একই সঙ্গে সিরিয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো নয় ইসরাইলের। একটা ভয় হচ্ছে, এ হামলার কারণে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো। বাশারের অবর্তমানে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়বে বিদ্রোহীরা। আর তাতে করে সুবিধা নেবে আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আল বুসরা ফ্রন্ট ও ইসলামিক স্টেট অব ইরাক সংগঠন দুটি। এরা এরই মধ্যে সীমান্তের বিস্তীর্ণ এলাকায় তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। এ হামলা এ দুটি সংগঠনের অবস্থানকে শক্তিশালী করবে। গাদ্দাফিপরবর্তী লিবিয়া ও সাদ্দামপরবর্তী ইরাকে এরকমটি আমরা লক্ষ্য করেছি।

সিরিয়ায় হামলা না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিঃসন্দেহে একটি ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ওবামা। তবে এটাই তার শেষ কথা নয়। মার্কিন প্রশাসনে যুদ্ধবাজরা আছেন। তারা যুদ্ধ চান। ইসরাইলি লবিও একটি যুদ্ধ চায়। আজ তাই প্রেসিডেন্ট আসাদের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে থাকবে বিশ্ব। আসাদ যদি টালবাহানা করেন, যদি রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস করতে গড়িমসি করেন, তাহলে একটি অনিবার্য হামলাকে তিনি এড়াতে পারবেন না। ভূমধ্যসাগরে মার্কিন রণতরীগুলো এখনও আছে। জেনেভায় সিরিয়াসংক্রান্ত অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ আলোচনা শুরু হয়েছে। আসাদ সরকার শুভবুদ্ধির পরিচয় দেবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। তবে যুদ্ধ শুরু না করার ব্যাপারে শেষ কথাটি ওবামা বলে ফেলেছেন কিনা, তা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

হিউস্টন, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলাম লেখক
দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৩।
tsrahmanbd@yahoo.com - See more at: http://www.alokitobangladesh.com/editorial/2013/09/18/23177#sthash.85P86RJU.dpuf

সিরিয়া নিয়ে অনেক প্রশ্ন


যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে 'চতুর্থ যুদ্ধ' শুরু করতে যাচ্ছে? ১৯৯১ সালে ইরাক যখন কুয়েত দখল করে নিয়েছিল, তখন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে তথা আরব বিশ্বে প্রথম যুদ্ধ শুরু করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেদিন অবশ্য একটি বহুজাতিক বাহিনীকে যুক্তরাষ্ট্র তার সঙ্গে পেয়েছিল। কুয়েত দখলমুক্ত হয়েছিল। এরপর কেটে যায় ১০ বছর। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ঘটে গেছে ইতিহাসের ভয়ংকর ঘটনা। নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধসে পড়ল সন্ত্রাসী বিমান হামলায়। এর এক সপ্তাহের মাথায় যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ করল আফগানিস্তান। আর ঠিক দুই বছর পর ২০০৩ সালের ২০ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ করল ইরাক- অভিযোগ ইরাকের কাছে মানবজাতি ধ্বংসকারী মারাত্মক সব অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে! জাতিসংঘের তদন্তকারীরা সেই সব অস্ত্র খুঁজে পাওয়ার আগেই বাগদাদ যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্রে আক্রান্ত হলো, আর ৯ এপ্রিল পতন ঘটল সাদ্দাম হোসেনের। একসময় আফগানিস্তানের মতো ইরাকও 'দখল' হয়ে গেল। কিন্তু কোনোদিনই আর পাওয়া গেল না সেই সব মারণাস্ত্র। তারপর আবারও প্রায় ১০ বছর অপেক্ষা। ২০১১ সালের ১৯ মার্চ ইঙ্গ-মার্কিন বিমান হামলায় জ্বলে উঠল লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলি। শুরু হলো যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় যুদ্ধ। এখানে অবশ্য ইরাকের মতো সেনাবাহিনী পাঠায়নি যুক্তরাষ্ট্র। তবে সাদ্দাম হোসেনকে যেমন জীবিত রাখা 'হুমকি' মনে করত যুক্তরাষ্ট্র, ঠিক তেমনি গাদ্দাফিও ছিলেন হুমকিস্বরূপ। তাই তাঁদের পৃথিবী থেকে চলে যেতে হয়েছিল। গাদ্দাফির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনের। নতুন তত্ত্ব উপস্থাপিত হলো- Humanitarian Intervention. অর্থাৎ মানবাধিকার রক্ষায় সামরিক হস্তক্ষেপ। ২০০৩ সালে জাতিসংঘ যেমন অনুমোদন দেয়নি ইরাক আক্রমণের, তবে নিরাপত্তা পরিষদে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল- তাতে বলা হয়েছিল, 'প্রয়োজনীয় বিধি ব্যবস্থা' গ্রহণ করার। আর আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যায় এই 'প্রয়োজনীয় বিধি ব্যবস্থা' কোনো পর্যায়েই যুদ্ধকে সমর্থন করে না। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন লিবিয়া আক্রমণ করল, তখনো কোনো সমর্থন ছিল না নিরাপত্তা পরিষদের। জাতিসংঘ সনদের ৫১ নম্বর ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়া যুদ্ধ শুরু করা যাবে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বাগদাদে 'দ্বিতীয় যুদ্ধ' আর ত্রিপলিতে 'তৃতীয় যুদ্ধ' শুরু করেছিল। আর এই সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহেই যুক্তরাষ্ট্র আরব বিশ্বে আরেকটি যুদ্ধ শুরু করতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, যাকে কিনা বলা যায় 'চতুর্থ যুদ্ধ'। ত্রিপলিতে যেমনি ব্যবহৃত হয়েছিল একটি তত্ত্ব- Humanitarian Intervention. সিরিয়ার ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হতে যাচ্ছে সে রকম একটি তত্ত্ব- Responsibility to Protect. অর্থাৎ বাংলা করলে যা দাঁড়ায়, তা হচ্ছে মানবতা রক্ষায় আন্তর্জাতিক দায়িত্ব! এই 'দায়িত্বের' অংশ হিসেবেই সিরিয়ায় মিসাইল হামলা হতে যাচ্ছে। তবে বাগদাদে যেমনি WMD বা কোনো মারণাস্ত্র জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শকরা খুঁজে পাননি, ঠিক তেমনি এখন পর্যন্ত সিরিয়ায় কারা রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছিল, তাও খুঁজে পায়নি জাতিসংঘের টিম। তাদের রিপোর্টটি জমা দিতেও তিন সপ্তাহ লেগে যাবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কি তত দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করবে?
যে যুদ্ধ সিরিয়ায় শুরু হতে যাচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেক। এক. যুক্তরাষ্ট্রের জনমত যুদ্ধে যাওয়ার পক্ষে নয়। সর্বশেষ সিএনএনের জনমত জরিপে দেখলাম শতকরা ৫০ শতাংশের ওপর মানুষ যুদ্ধের বিপক্ষে। এরই মধ্যে সিনেটের ফরেন রিলেশনস কমিটি সিরিয়া আক্রমণের পক্ষে অভিমত দিয়েছে। এর ফলে ওবামার হাত শক্তিশালী হয়েছে। দুই. সিরিয়াকে 'শাস্তি' ও 'সীমিত' মিসাইল আক্রমণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ওবামা। ধারণা করা হচ্ছে, এই হামলায় সেনাবাহিনী ব্যবহৃত হবে না, মিসাইল হামলা দীর্ঘায়িত হবে মাত্র ৬০ দিন। কিন্তু এখানে অনেক অমীমাংসিত প্রশ্ন থেকে গেছে। এই হামলা কি চূড়ান্ত বিচারে বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করবে? এটাই কি যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেট? এতে করে কি বাশার সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস হবে? বিষয়টি যত সহজ মনে করা হচ্ছে, অতটা সহজ নয়। তিন. এই 'যুদ্ধ' যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে বড় ধরনের আঘাত করতে পারে। একজন শীর্ষস্থানীয় জেনারেল ও মার্কিন সেনাবাহিনীর জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ জেনারেল ডেমপসের মতে, প্রতি মাসে এক বিলিয়ন ডলার খরচ হবে সিরিয়ায় আক্রমণ শুরু হলে। অর্থের পরিমাণটা একেবারে কম নয়। এমনিতেই অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারছেন না ওবামা। গত ৪ সেপ্টেম্বর অনলাইনভিত্তিক সংবাদপত্র Meclatchy-তে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। তাতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি প্রাপ্তবয়স্ক সাতজন নাগরিকের মধ্যে একজন 'ফুড স্ট্যাম্প' গ্রহণ করে থাকেন। অর্থাৎ ফেডারেল সরকারের কাছ থেকে খাদ্য সাহায্য পেয়ে থাকেন। ১৭ দশমিক ৬ মিলিয়ন পরিবার খাদ্য নিরাপত্তায় ভোগে। ৪৯ মিলিয়ন মানুষ জানে না পরের বেলার খাদ্য তারা কোত্থেকে জোগাড় করবে। ফেডারেল সরকার প্রতিবছর ৭৮ বিলিয়ন ডলার এই 'ফুড স্ট্যাম্প'-এর পেছনে ব্যয় করে। অর্থাৎ গরিব জনগোষ্ঠী খাদ্য সহায়তা পায়। এখন যদি 'যুদ্ধ' শুরু হয়, তাহলে নির্দ্বিধায় এই খাদ্য সহায়তা কার্যক্রম ব্যাহত হবে। এর ফলে গরিব মানুষের সংখ্যা আরো বাড়বে। শুধু খাদ্য সহায়তা নয়, বরং শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা ব্যাহত হবে। পরিসংখ্যান বলে, যুক্তরাষ্ট্রে কর্মজীবী জনশক্তির ৭ শতাংশ এখন বেকার। আফ্রো-আমেরিকানদের মাঝে এই হার ১৩ শতাংশ। প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষের কোনো কাজ নেই। এখন যদি যুক্তরাষ্ট্র আবার যুদ্ধে জড়িয়ে যায়, তাহলে উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ আর বাড়বে না। স্মরণ থাকার কথা, আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে প্রায় আট হাজার মার্কিন সৈন্য প্রাণ হারিয়েছিল। আর সাধারণ মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা ১০০ জনেরও বেশি। একমাত্র ইরাকে চার থেকে ৯ লাখ মানুষ হয় মারা গেছে, নতুবা স্থানচ্যুত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র Global war on terror শুরু করে আফগানিস্তান ও ইরাকে। যে যুদ্ধ শুরু করেছিল তাতে ব্যয় হয়েছিল তিন থেকে চার দশমিক চার ট্রিলিয়ন ডলার (এক ট্রিলিয়ন = এক হাজার মিলিয়ন ডলার)। এখন সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হলে ওবামাকে অর্থ বরাদ্দ করতে হবে এবং এর পরিমাণ কোথায় গিয়ে ঠেকবে কেউ বলতে পারে না। চার. যুক্তরাষ্ট্র তিন-তিনটি দেশে (আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া) যুদ্ধ শুরু করলেও সেখানে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারেনি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা তো স্বপ্নই থেকে গেছে! আফগানিস্তান এখন বাহ্যত তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে। ২০১৪ সালে সেখান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করা হলে কারজাইকেও দেশ ত্যাগ করতে হবে। আর টাইমসের খবর অনুযায়ী (৯ সেপ্টেম্বর ২০১৩) গত কয়েক মাসে ইরাকে তিন হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ইরাকে এখন আত্মঘাতী বোমাবাজির জন্ম হয়েছে। ইরাক এখন শিয়া, সুন্নি ও কুর্দি- এই তিন সম্প্রদায়ের মাঝে বিভক্ত হয়ে আছে। লিবিয়ায়ও কোনো স্থিতিশীল সরকার নেই। অস্ত্রবাজরা আজ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। এদের হাতেই প্রাণ হারিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত। পাঁচ. মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো শক্তিশালী হয়েছে। ইরাক ও লিবিয়ায় এরা শক্তিশালী হয়েছে। সিরিয়ায় আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আল-নুসরা ফ্রন্ট ও ইরাকের ইসলামিক স্টেট অব ইরাক সিরিয়া-ইরাক সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করে। এই যুদ্ধ আল-কায়েদার উৎখাত নয়, বরং আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোকে শক্তিশালীই করবে। ছয়. এই 'যুদ্ধ' একটি আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হতে পারে। সিরিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশ ইরান, লেবানন ও ইসরায়েল এই যুদ্ধ হলে তাতে জড়িয়ে পড়তে পারে এবং সেই সঙ্গে বিশ্ব নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র যদি শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলি লবির কারণে এই যুদ্ধ শুরু করে, তাতে করে তাদের লাভের সম্ভাবনা ক্ষীণ। সদ্য সমাপ্ত জি-২০ সম্মেলনেও ওবামা বিশ্ব নেতাদের পূর্ণ সমর্থন পাননি। এমনকি রাশিয়া ১০০ পাতার যে ডকুমেন্ট শীর্ষ সম্মেলনে প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায় সিরিয়ার বিদ্রোহী সৈন্যরাই এই রাসায়নিক হামলা চালিয়েছিল। একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান Global Research তাদের এক প্রতিবেদনে (১ সেপ্টেম্বর ২০১৩) উল্লেখ করেছে, সিরীয় সরকার নয়; বরং বিদ্রোহীদের হাত রয়েছে এই রসায়নিক অস্ত্রের হামলার পেছনে। যুদ্ধবিরোধী বিশ্বজনমত শক্তিশালী ক্রমশ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন প্রশাসনের সুর এখন কিছুটা নরম হয়েছে। তা সত্ত্বেও সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কা এখনো শেষ হয়ে যায়নি।
দৈনিক কালের কন্ঠ, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৩
টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
 

৯/১১ ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১-এর মতো ভয়ংকর একটি ঘটনা ঘটেছিল আজ থেকে ১২ বছর আগে। আজ সেই ভয়ংকর ঘটনার এক যুগ পূর্ণ হল। সেদিন ছিল মঙ্গলবার। সন্ত্রাসীরা চার চারটি বিমান হাইজ্যাক করেছিল। প্রথম বিমানটি আঘাত করে নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রের ১১০ তলা ভবনের ৮০ তলায়। আমেরিকান এয়ারলাইন্সের সেই বিমানটিতে ছিল ২০ হাজার গ্যালন জেট ফুয়েল। গন্তব্য ক্যালিফোর্নিয়া। এর ঠিক ১৮ মিনিট পর আরও একটি বিমান (ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের) আঘাত করে বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রের দ্বিতীয় ভবনে, ৬০ তলায়। বিশ্ববাসী দেখেছিল, আরও দুটি বিমান একই সঙ্গে হাইজ্যাক হয়েছে। একটি পেন্টাগনে (ওয়াশিংটনে) হামলা চালাল। অপরটি হামলা চালানোর আগেই বিধ্বস্ত হল পেনসেলভেনিয়াতে। ধারণা করা হয়, ওই বিমানের টার্গেট ছিল প্রেসিডেন্ট ভবন হোয়াইট হাউস অথবা কংগ্রেস ভবন ‘ক্যাপিটল হিল’। ইতিহাসের এ জঘন্যতম হামলায় পুরো বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রটি ধসে পড়েছিল। মারা গিয়েছিলেন তিন হাজারের ওপর মানুষ- যারা ওই ভবনে কাজ করতেন এবং উদ্ধার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়ে ৪০০ পুলিশ অফিসারও (যাদের মাঝে ৩৪৩ জন ছিলেন ফায়ার ফাইটার) প্রাণ হারিয়েছিলেন।
৯/১১-এর এ হামলা নানাভাবে চিত্রিত হয়েছে এবং ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তবে এটা স্পষ্ট যে, এ হামলার কারণে মার্কিন সমাজে মুসলমানবিরোধী একটি জনমত তৈরি হয়েছিল এবং মুসলিম বিশ্বের প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতেও পরিবর্তন আসে। এ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে আল-কায়দা নামে একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে এবং এর পরিকল্পনাকারী হিসেবে ওসামা বিন লাদেনকে অভিযুক্ত করা হয়। মূল পরিকল্পনাকারী লাদেনকে আফগানিস্তানে আশ্রয় দেয়া হয়েছে- এটা ছিল যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আফগানিস্তান ‘দখল’ করার একমাত্র যুক্তি। ‘টুইন টাওয়ার’ ধ্বংস হওয়ার তিন সপ্তাহ পর ৭ অক্টোবর ইঙ্গ-মার্কিন বিমান হামলা চালানো হল আফগানিস্তানে (অপারেশন এনডুরিং ফ্রিডম)। দখল হয়ে গেল দেশটি। যুক্তরাষ্ট্র শুরু করল নতুন এক অধ্যায়ের- ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’। একের পর এক আক্রান্ত হল মুসলিম দেশগুলো। ২০০৩ সালের মার্চে আক্রান্ত হল ইরাক- অভিযোগ ইরাকের কাছে ডব্লিউএমডি বা মানবজাতি ধ্বংসকারী মারণাস্ত্র রয়েছে। ৪৩ দিনব্যাপী অনবরত বোমাবর্ষণে পতন ঘটল বাগদাদের। কী করুণ সেই ইতিহাস!
কাবুল দখল করার পর যেমন ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, ঠিক তেমনি বাগদাদেও পাওয়া যায়নি ডব্লিউএমডি বা মারণাস্ত্র। ২০০৪ সালের ৮ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট বুশ নিজে তা স্বীকারও করেন। আফগানিস্তানে হামলা করে যেমন মোল্লা ওমরের নেতৃত্বাধীন তালেবান সরকারকে উৎখাত করা হয়, ঠিক তেমনি বাগদাদে উৎখাত হন সাদ্দাম হোসেন। কিন্তু এ ‘যুদ্ধের’ পরিণতিতে, জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা অনুযায়ী, ইরাকে মারা যায় ৬ লাখ ৫০ হাজার মানুষ। আর যুদ্ধের জন্য খরচ হয়েছিল কত? আফগান সেনাদের প্রশিক্ষণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র বছরে খরচ করেছিল ৬ বিলিয়ন (৬০০ কোটি) ডলার। এর বাইরে আফগানিস্তানের যুদ্ধের জন্য ব্যয় করেছে ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার (১ হাজার বিলিয়নে ১ ট্রিলিয়ন)। আর ইরাক যুদ্ধে তাদের খরচ হয়েছিল ২ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলার। এ অর্থের জোগান দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের করদাতারা। এ বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগান দিতে গিয়ে সেখানে সামাজিক খাতে (শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিশু, ফুড স্টাম্প ইত্যাদি) ব্যয় বরাদ্দ কমেছে। কিন্তু তারপরও ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ থেমে থাকেনি। ২০১১ সালে আক্রান্ত হল লিবিয়া। ইঙ্গ-মার্কিন বিমান হামলা চালানো হল ত্রিপোলিতে। এক সময় পতন ঘটল গাদ্দাফির। সেখানে অবশ্য ইরাক ও আফগানিস্তানের মতো স্থলপথে সেনাবাহিনী পাঠায়নি যুক্তরাষ্ট্র। গাদ্দাফির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের’। সেই ‘অপরাধ’ জাতিসংঘ কর্তৃক প্রমাণিত হওয়ার আগেই বাগদাদের মতো বোমা হামলা চালিয়ে ধ্বংস করা হয় ত্রিপোলিকে। সাদ্দামের মতো গাদ্দাফিকেও হত্যা করা হয়।
আজ সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের ক্ষেত্রেও এমনটি হতে যাচ্ছে। গৃহযুদ্ধ সিরিয়ার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। সিরিয়া আক্রমণের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ অনুমোদন না দিলেও এ হামলা এখন সময়ের ব্যাপার। বাশারের পরিণতি যে গাদ্দাফি আর সাদ্দাম হোসেনের মতো হবে, সেটাও এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। বাশারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হচ্ছে- রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে মানুষ হত্যা- এর সত্যতাও কোনো দিন খুঁজে পাওয়া যাবে কি-না সন্দেহ। তবে বাস্তবতা এটাই, যুক্তরাষ্ট্র নিজ জনগোষ্ঠীর মতামত তথা বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করেই সিরিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
৯/১১-এর ঘটনার ১২ বছর পর যে প্রশ্নটি এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে তা হচ্ছে, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’র শেষ কোথায়? সাবেক প্রেসিডেন্ট বুশ এ ‘যুদ্ধ’ শুরু করলেও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া বারাক ওবামা দৃশ্যত এ ‘যুদ্ধ’ অব্যাহত রেখেছেন। আর এ যুদ্ধের পুরোটাই পরিচালিত হচ্ছে মুসলিম দেশগুলোর বিরুদ্ধে। একটি ‘মুসলিম বিদ্বেষী’ মনোভাবের যে জন্ম হয়েছিল তা কমেছে, এটি মনে করারও কোনো কারণ নেই। ২০০৯ সালের কায়রো ভাষণে বারাক ওবামা মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে ‘নতুন এক সম্পর্ক’ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু দেখা গেল, বাস্তব ক্ষেত্রে তিনি মুসলিম দেশগুলোর বিরুদ্ধেই এক ধরনের ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা করেছেন। নিঃসন্দেহে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সমর্থনযোগ্য নয়। ৯/১১-এর ঘটনা শুধু নিন্দনীয়ই নয়, বরং অপরাধযোগ্য। যারাই এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকুক না কেন, তাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার করা উচিত ছিল। সাদ্দাম হোসেন, গাদ্দাফি কিংবা বাশারের এ আদালতেই বিচার হতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। জাতিসংঘ সনদে কোনো দেশ অন্য কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। যদি কোনো দেশ মানবতাবিরোধী অপরাধ (যেমন অভিযোগ উঠেছে আসাদের বিরুদ্ধে) করে, তাহলে আন্তর্জাতিক আদালত ও আন্তর্জাতিক আইনে তার বিচার হতে পারে। যেমনটি হয়েছিল পানামার শাসক জেনারেল নরিয়েগার ক্ষেত্রে। কিংবা সার্ব যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রে। লাইবেরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট টেইলারেরও বিচার হয়েছে এ আদালতে। এখন হতে যাচ্ছে কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট কেনিয়াত্তার বিচার। যুক্তরাষ্ট্র এ আইন সবার ক্ষেত্রে একইভাবে প্রযোজ্য করল না। মুসলিম দেশগুলোর ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি হয়েছে। ওবামা তার কায়রো ভাষণে মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের যে প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন, তা এখন ‘মৃত’। বিশ্বের মুসলিম জনগোষ্ঠীর আস্থা তিনি অর্জন করতে পারেননি।
প্রশ্ন করা যেতে পারে, ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ পরিচালনা করে লাভ কার হল? ক্ষতি কার হল? প্রথমত, যুদ্ধের একটা বড় অংশের খরচ জোগাতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে। এতে করে সেখানকার সামাজিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার এখন ৭ শতাংশেরও ওপরে। ২০ মিলিয়ন (২ কোটি) মানুষের চাকরি নেই। ৪৯ মিলিয়ন জনগোষ্ঠী জানে না পরের বেলার খাদ্য কোত্থেকে আসবে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকারের ঋণের পরিমাণ এখন ৭০ ট্রিলিয়ন ডলার (সান্টিয়াগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেমস হেমিলটনের মতে), যা আগে ধারণা করা হতো ১৬.৯ ট্রিলিয়ন ডলার। আর ছাত্রদের ঋণ নেয়ার (গ্রাজুয়েশন করার ঋণ) পরিমাণ গত ১০ বছরে বেড়েছে ৪ গুণ। যুদ্ধের পেছনে এত খরচ না হলে সেই অর্থ সামাজিক খাতে ব্যয় করা যেত। দ্বিতীয়ত, বলা হচ্ছে ইসলামী জঙ্গি সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধেই এ যুদ্ধ। বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আরব বিশ্বের সরকার উৎখাত আন্দোলনে (ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া) আল-কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো তৎপর। আর দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যেমন সিরিয়ার জাবহাত উল নুসরা, ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া, আহরার আল শাম, লিওয়া আল তাওহিদ কিংবা লিবিয়ায় আল জামআ আল মুকাতিলা বি লিবিয়া ও লিবিয়ান ইসলামিক ফাইটিং গ্র“প- এরা সবাই অস্ত্র ও আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছে তুরস্ক তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। মনে থাকার কথা, এক সময় সোভিয়েত সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র তালেবানদের তৈরি করেছিল। তৃতীয়ত, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ পরিচালনা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ‘ড্রোন’ বিমান হামলা পরিচালনা করছে পাকিস্তান ও ইয়েমেনের মতো দেশে। এতে করে এসব দেশে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী একটা জনমত তৈরি হয়েছে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের মতে, পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর শতকরা ৭৫ ভাগ যুক্তরাষ্ট্রকে শত্র“ মনে করে। অব্যাহত ড্রোন হামলার কারণে পাকিস্তানে ‘লস্কর-ই তৈয়্যেবা’র মতো জঙ্গি সংগঠনের জন্ম হয়েছে। লিবিয়ায় এসব জঙ্গি সংগঠনের হাতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্রাণ হারিয়েছেন। ইরাকে এরা আত্মঘাতী বোমা সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। আর সিরিয়ায় বিদ্রোহী বাহিনী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত আলেপ্পো শহরের একটা বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে জাবহাত উল নুসরা ফ্রন্ট। অর্থাৎ মুসলিম বিশ্বে আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর তৎপরতা কমেনি, বরং বেড়েছে। চতুর্থত, এ ‘যুদ্ধ’ পরিচালনা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আইনে পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা মার্কিন নাগরিকদের অধিকার খর্ব করছে। যেমন উল্লেখ করা যেতে পারে ফরেন ইনটেলিজেন্স সারভাইলেন্স অ্যাক্ট, ইলেকট্রনিক কমিউনিকেশন অ্যাক্ট ইত্যাদির কথা। শত শত ই-মেল, ফ্যাক্স, ফোনালাপ এখন সরকারি নজরদারিতে রয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসা কঠিন।
সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ পরিচালনা করতে গিয়ে কোটি কোটি ডলার খরচ করছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যে কমেছে, বাস্তবতা তা বলে না। এতে করে একদিকে অবশ্য খুশি হয়েছে ব্যবসায়ীরা। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাক ও লিবিয়া পুনর্গঠনের নামে মার্কিন কোম্পানিগুলো এখন এসব দেশে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করছে। অতিরিক্ত তেল উত্তোলন করে পুনর্গঠনের বিল পরিশোধ করা হচ্ছে। তেলের দামও আর কমেনি। ব্যারেল প্রতি এখন মূল্য ১১২ ডলার, যুদ্ধের আগে এক সময় যা ছিল ৬০ ডলারের কাছাকাছি। তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ। তাদের জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। মার্কিন জনগণ যখন ৯/১১-এর যুগপূর্তি পালন করছে, ঠিক তার আগে আগস্টে আমি গিয়েছিলাম বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের ধসে যাওয়া ভবন দুটি দেখতে। ২০০২ সালে যখন একবার এখানে এসেছিলাম, তখন পুরো এলাকাটি কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছিল। আজ ১০ বছর পর গিয়ে দেখলাম সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ ভবন। এক সময় এর নামকরণ করা হয়েছিল ‘ফ্রিডম টাওয়ার’। এখন বলা হচ্ছে, ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার’। ৭২ ভেসেই স্ট্রিটে বিধ্বস্ত হওয়া ভবনের পাশেই এ নতুন বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে। নতুন ভবন তৈরিতে ব্যয় হবে ৩ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার। ১ হাজার ৭৭৬ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট এ ভবনে থাকবে ১০৪টি তলা। ফেব্র“য়ারিতে (২০১৪) এটি চালু হবে। এখানেও ব্যবসা! আমি ও আমার ছাত্র কালাম চাঁদা দিয়ে সেখানে ঢুকলাম। প্রবেশপত্রে লেখা আছে চাঁদা ছাড়াই প্রবেশ করা যাবে, অথচ চাঁদা দিতে বাধ্য করা হল পরোক্ষভাবে। এটা এখন দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। শত শত লোক প্রতিদিন এখানে আসে। নিউজার্সি ও ম্যানহাটন সরাসরি ট্রেনও চালু হতে যাচ্ছে। ব্যবসা আর কাকে বলে! অংক করে বলে দেয়া যায় কতদিন লাগবে এই ৩ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার তুলতে।
যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ৯/১১-এর যুগপূর্তি পালন করছে এমন এক সময় যখন যুক্তরাষ্ট্র আরও একটা ‘যুদ্ধের’ জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এবারের ‘যুদ্ধ’টাও একটি মুসলমান প্রধান দেশ সিরিয়ার বিরুদ্ধে। সিরিয়া সরকার অভিযুক্ত হয়েছে তার নিজ জনগণের ওপর রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগে। ৯/১১-এর ঘটনা মার্কিন জাতিকে একত্রিত করেছিল, ঐক্যবদ্ধ করেছিল- যা ক্ষমতাসীনদের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধে’ যাওয়ার জন্য প্ররোচিত করেছিল। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিশ্ব থেকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দূর করা সম্ভব হয়নি।
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৩, দৈনিক যুগান্তর।
হাইল্যান্ড ভিলেজ, টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক,
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com 
http://www.jugantor.com/window/2013/09/11/

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বারো বছর.

আগামী ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-এর ১২ বছর পার করবে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তথাকথিত এক সন্ত্রাসী হামলায় নিউইয়র্কের বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ‘টুইন টাওয়ার’ ধসে পড়েছিল। হাইজ্যাক করা দুটো বিমান আছড়ে পড়েছিল ভবন দুটোর ওপর। কয়েক মিনিটের মধ্যে ভবন দুটো গলে পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে। ওই ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন তিন হাজার মানুষ, যাদের মাঝে বাংলাদেশী ছিলেন ১৪ জন। ওই সন্ত্রাসী ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছিল আল কায়দা আর ওসামা বিন লাদেনের বিরুদ্ধে। তার পরের কাহিনী সবার জানা। লাদেনকে আফগানিস্তানের তালেবান সরকার আশ্রয় দিয়েছে, এই অভিযোগ তুলে আফগানিস্তানে ইঙ্গ-মার্কিন বিমান হামলা চালিয়ে উৎখাত করা হলো তালেবান সরকারকে। দখল করে নেয়া হলো দেশটি। তারপর ২০০৩ সালে ইরাকের কাছে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র রয়েছে, এই অভিযোগ তুলে দখল করা হলো ইরাক। এর ঠিক আট বছর পর একই প্রক্রিয়ায় সাদ্দাম হোসেনের মতো উৎখাত করা হলো লিবিয়ার গাদ্দাফিকে। কোনো একটি ক্ষেত্রেও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন নেয়া হয়নি। মূলত ‘টুইন টাওয়ার’-এর ঘটনাবলির পর মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোতে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-এর নামে এক ধরনের ‘যুদ্ধ’ পরিচালনা করছে যুক্তরাষ্ট্র! সাবেক প্রেসিডেন্ট বুশ এই ‘যুদ্ধ’ শুরু করলেও, বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও এই ‘যুদ্ধ’ অব্যাহত রাখছেন। বারাক ওবামাই লিবিয়ায় বিমান হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর আজ বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করে সিরিয়ায় হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এরই মধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। তিনি কংগ্রেসের সমর্থন চেয়েছেন এবং ধারণা করা হচ্ছে, এই সমর্থন তিনি পাবেন। তিনি লিবিয়ায় গাদ্দাফির বিরোধিতা করতে গিয়ে যাদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন, তাদের মাঝে আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনও রয়েছে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে সিরিয়ায়। যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো অস্ত্র ও অর্থ পৌঁছে যাচ্ছে আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর কাছে। যুক্তরাষ্ট্র আজও আল কায়দার বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’-এর কথা বলে। অথচ বাস্তবে সেই আল কায়দাকেই তারা প্রমোট করছে। সিরিয়ার ক্ষেত্রেও এ কথাটা প্রমাণিত হলো।

এটা সত্য, এখন অব্দি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সিরিয়া আক্রমণের নির্দেশ দেননি। আক্রমণের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিলেও নানা কারণে তিনি কিছুটা সময় নিচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের আইনে ‘যুদ্ধ’ শুরু করার একমাত্র অধিকার দেয়া হয়েছে কংগ্রেসকে। প্রেসিডেন্ট এককভাবে যুদ্ধ শুরু করতে পারেন না। তবে এটাও সত্য, ২০১১ সালে লিবিয়া আক্রমণের সময় ওবামা একাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কংগ্রেসের সমর্থন তিনি তখন নেননি। এবারে প্রস্তুতিটা চূড়ান্তই ছিল। সবাই যখন অপেক্ষা করছিল প্রেসিডেন্টের নির্দেশের, তখন প্রেসিডেন্ট কিছুটা সময় নিলেন। এর কারণ একাধিক। প্রথমত, কংগ্রেসের সদস্যদের একটি চিঠি। ১১৬ জন কংগ্রেস সদস্য প্রেসিডেন্টকে একটি চিঠি লিখে কংগ্রেসের সমর্থন ছাড়া যুদ্ধ শুরু না করার অনুরোধ করেছেন। একই সঙ্গে সিনেটের সভাপতিও একটি চিঠি দিয়েছিলেন যুদ্ধ শুরু না করার জন্য। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাজ্যের সমর্থন তিনি প্রত্যাশা করেছিলেন। শেষ মুহূর্তে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হাউস অব কমনসে সিরিয়া প্রশ্নে ভোটাভুটিতে হেরে গেছেন। ব্রিটেনের সমর্থন ওবামা পাবেন না। ব্রিটেনের বিরোধী দল সিরিয়া আক্রমণের বিপক্ষে। তৃতীয়ত, ওবামা চাচ্ছেন সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারের ব্যাপারে জাতিসংঘের তদন্ত কর্মকর্তারা কী সিদ্ধান্ত দেন, তা দেখার। একই সঙ্গে ওবামা চাচ্ছেন নিরাপত্তা পরিষদ সিরিয়া আক্রমণের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুক। ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি সিরিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। চুতর্থত, বিশ্ব আসরে দুটি বড় শক্তি রাশিয়া ও চীন সিরিয়া আক্রমণের বিরুদ্ধে। এমনিতেই বেশ ক’টি ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। সিরিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত দিয়ে ওবামা চাচ্ছেন না রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের আরও অবনতি হোক। পঞ্চমত, মার্কিন জনমত ও মার্কিন অর্থনীতিও যুদ্ধের পক্ষে নয়।

এমনিতেই আফগানিস্তানে এবং ইরাক-লিবিয়া যুদ্ধে মার্কিন অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। অর্থনীতি কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে সত্য, কিন্তু সিরিয়া যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত নয় মার্কিন অর্থনীতি। মার্কিন সেনাবাহিনীর জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল ডেমপসে স্বীকার করেছেন, প্রতি মাসে এক বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হবে সিরিয়া যুদ্ধ শুরু হলে। তাই ওবামা প্রশাসন কিছুটা পিছিয়ে এসেছে। কিন্তু যুদ্ধে তাকে যেতেই হবে। যুদ্ধ শুরু করা ও দীর্ঘস্থায়ী করার মধ্য দিয়েই মার্কিন অর্থনীতিতে চাঙ্গাভাব ফিরে আসে। যুদ্ধের সঙ্গে মার্কিন অর্থনীতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যুদ্ধ যদি শুরু না হয়, তাহলে মার্কিন অর্থনীতিতে চাঙ্গাভাব আসবে না। কেননা মার্কিনি তৈরি কোনো পণ্য এখন আর বিশ্ববাজারে দাঁড়াতে পারে না। সহজলভ্য চীনা পণ্যে খোদ মার্কিন বাজার এখন সয়লাব। এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সটাইল সারা বিশ্ব কর্তৃত্ব করত। এখন চীন, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ আর ল্যাতিন আমেরিকার তৈরি পোশাকের সহজলভ্যতার কারণে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই নিজেদের তৈরি পোশাক পাওয়া যায় না। তাই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে সচল রাখতে হলে চাই যুদ্ধ। যুদ্ধ মানেই ব্যবসা। যেমনটি আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম ইরাকে। ইরাক যুদ্ধের পর ইরাক পুনর্গঠনের নামে আমেরিকান কোম্পানিগুলো সেখানে এককভাবে কাজ পেয়েছে। আর ইরাকের মালিকি সরকার তেল বিক্রি করে মার্কিনি কোম্পানিগুলোর দেনা পরিশোধ করেছে। এতে করে একদিকে মার্কিনি কোম্পানিগুলোর অর্জিত অর্থ মার্কিন বাজারে প্রবেশ করেছে, যা অর্থনীতিতে বড় অবদান রেখেছিল। এখন ইরাকের পুনর্গঠন এক রকম শেষ। সেনাবাহিনী সেখান থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে অনেক আগেই। এমনকি ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকেও সব সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে। তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি সচল হবে কীভাবে? তাই একটি যুদ্ধ চাই।

সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলে আসছে প্রায় ২৯ মাস ধরে। সিরিয়ায় বাশারবিরোধী একটি রাজনৈতিক মোর্চা তথা প্রবাসী সরকার গঠন করা, বিদ্রোহী সেনাবাহিনী গঠন ও তাদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র স্বয়ং। এটা কোনো রাখঢাকের বিষয় ছিল না। কিন্তু এই যুদ্ধ সিরিয়ার অর্থনীতিকে পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে। যে সিরিয়া ছিল খাদ্যে ও উৎপাদিত পণ্যে স্বয়ংসম্পন্ন একটা দেশ, সেই দেশটি এখন খাদ্য ও পণ্য আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। বেকার সমস্যা যেখানে যুদ্ধের আগে তেমন একটা ছিল না, এখন তা শতকরা ৬০ ভাগে উন্নীত হয়েছে। যেখানে যুদ্ধের আগে তেল উৎপাদিত হতো দৈনিক ৩ লাখ ৮০ হাজার ব্যারেল প্রতি দিন, সেখানে এখন উৎপাদিত হয় মাত্র ২০ হাজার ব্যারেল। শুধু তেল উৎপাদনেই ক্ষতির পরিমাণ ১৩ বিলিয়ন ডলার। সিরিয়ার মুদ্রার (পাউন্ড) ব্যাপক দরপতন হয়েছে। আগে ডলারে পাওয়া যেত ৪৭ পাউন্ড, এখন ২৫০ পাউন্ডে পাওয়া যায় ১ ডলার। জনসংখ্যার শতকরা ৭৯ ভাগ গরিব হয়ে গেছে যুদ্ধের কারণে। অথচ যুদ্ধের আগে গরিব জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এক ভাগেরও কম ছিল। স্বাস্থ্যসেবা পরিপূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে। দেশের ৭৫টি হাসপাতালের মাঝে এখন চলছে মাত্র ৩০টি। এক সময় সরকার জ্বালানি তেল ও খাদ্যে সাবসিডি দিত, যার পরিমাণ ছিল বছরে ৬ মিলিয়ন ইউরো। এখন তা শূন্যের কোটায়। যুদ্ধের আগে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৮ মিলিয়ন ডলার। এখন তা এক রকম শূন্য (ইকোনমিস্ট, ১০ এপ্রিল, ২০১৩)। তাই যুদ্ধ না হলে, এখানে মার্কিন কনট্রাক্টররা আসবেন না, তেল উৎপাদন বাড়ানো যাবে না। ‘আরেকটি ইরাক’ও তৈরি হবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি বহুজাতিক বাহিনী ইরাকি বাহিনীর কুয়েত দখল থেকে মুক্ত করেছিল। ২০০৩ সালে ইরাকের কাছে মানব বিধ্বংসী মারণাস্ত্র রয়েছে, এই অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন বাগদাদে মিসাইল হামলা চালিয়ে সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত করেছিল। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ২০১১ সালে লিবিয়ায়। এবার যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ‘মানবতা রক্ষায়’ হস্তক্ষেপ করেছিল এবং গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। এক্ষেত্রে ১৯৯১ সালে কুয়েতকে ইরাকি দখলমুক্ত করতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত একটি সিদ্ধান্তের সাহায্য নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ২০০৩ ও ২০১১ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইরাক ও লিবিয়ায় সামরিক আগ্রাসন চালাতে কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। এবারের ক্ষেত্রেও তেমনটি হতে যাচ্ছে। লিবিয়ায় গাদ্দাফিকে উৎখাতের ব্যাপারে ব্যবহৃত হয়েছিল ‘ঐঁসধহঃধরধহ ওহঃবৎাবহঃরড়হ’-এর তত্ত্বটি। আর এবারে ব্যবহৃত হতে যাচ্ছে ‘জবংঢ়ড়হংরনরষরঃু ঃড় চৎড়ঃবপঃ’ তত্ত্বটি। এর মূল কথা হচ্ছে মানবতা রক্ষায় বিশ্বশক্তির দায়িত্ব।

যেহেতু সিরিয়ায় সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে(?), সেহেতু সাধারণ মানুষকে রক্ষায় পশ্চিমা শক্তি দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবেই এই সামরিক হস্তক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছে! এখানে বলা ভালো, সিরিয়ার ঘটনাবলি সে দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনা। জাতিসংঘের চার্টারে উল্লেখ করা আছে, একটি দেশ অপর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। যদি এমন কোনো ঘটনার জন্ম হয় যে, সেখানে স্থিতিশীলতা ও গণহত্যা রোধে সামরিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে, তাহলে কাজটি করতে হবে নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত একটি সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে। ইরাকের (২০০৩) ক্ষেত্রে কিংবা লিবিয়ার ক্ষেত্রেও (২০১১) এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়নি নিরাপত্তা পরিষদ। সিরিয়ার ক্ষেত্রেও নিরাপত্তা পরিষদ এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে এটাও সত্য, আন্তর্জাতিক একটি সম্মেলনে ‘জবংঢ়ড়হংরনরষরঃু ঃড় চৎড়ঃবপঃ’-এর একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। তবে এ ব্যাপারে কোনো চুক্তি হয়নি এবং এটা কোনো আন্তর্জাতিক আইনও নয়।

এর অর্থ হচ্ছে সিরিয়ায় সম্ভাব্য সামরিক আগ্রাসন আন্তর্জাতিক আইন অনুমোদন করে না। তবে ওবামাকে শেষ পর্যন্ত সিরিয়ায় আক্রমণ চালানোর নির্দেশ দিতে হবে! মার্কিন অস্ত্র ব্যবসায়ী, ইসরাইলি লবির চাপ রয়েছে। তবে পরিস্থিতি এবার ভিন্ন। এই যুদ্ধ শুধু আর সিরিয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। আঞ্চলিক শক্তিগুলো, এমনকি বৃহৎ শক্তিগুলোর জড়িয়ে পড়াও বিচিত্র কিছু নয়। তেলের জন্য ইরাকে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন প্রেসিডেন্ট বুশ। তিনি জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে ওয়াদা করেছিলেন, প্রতিটি ইরাকিকে তিনি খাদ্য, বাসস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেবেন। দীর্ঘ ১০ বছর পার হওয়ার পরও ইরাকিরা সেই নিরাপত্তা পায়নি। সেই তেলের কারণেই লিবিয়ায় বিমান আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছিলেন ওবামা। কিন্তু লিবিয়ায় মানবাধিকার নিশ্চিত করা যায়নি। বরং সেখানে মৃত্যুর হার বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র যেখানেই তথাকথিত সন্ত্রাস দমনের নামে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে, সেখানেই হস্তক্ষেপ পরবর্তী সময়ে মৃত্যুর হার বেড়েছে। সাধারণ মানুষ, যাদের মাঝে শিশু ও মহিলাদের সংখ্যা বেশি, তারাই বেশি মারা গেছেন। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া এর বড় প্রমাণ। আজ তাই সিরিয়ায় হামলা চালানোর যে নির্দেশ প্রেসিডেন্ট দিতে যাচ্ছেন, তাতে করে একটি বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হতে যাচ্ছে সিরিয়ায়। এরই মধ্যে প্রায় ২০ লাখ মানুষ দেশান্তরিত হয়েছে। তারা এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন সন্নিহিত বিভিন্ন দেশের শরণার্থী শিবিরে।

যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-এর নামে নিজেরাই সারা বিশ্বে এক ধরনের সন্ত্রাসকে উসকে দিচ্ছে। একটি দেশের সরকার উৎখাতের সিদ্ধান্ত সে দেশের জনগণকে না দিয়ে, নিজেরাই সামরিক শক্তি বলে ওই সরকারকে উৎখাত করছে। এক্ষেত্রে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করতেও তারা দ্বিধা করছে না। এটাই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নীতি। মুখে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-এর কথা বললেও, প্রকারান্তরে সন্ত্রাসকে তারাই জিইয়ে রাখছে। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-এর বর্ষপূর্তি ও সিরিয়া আক্রমণের পূর্বাহ্নে এ কথাটাই মনে পড়ে গেল আবার।
টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
ড. তারেক শামসুর রেহমান 
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলাম লেখক
tsrahmanbd@yahoo.com
দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
www.alokitobangladesh.com/editorial/2013/09/10

ফোন -সংলাপ ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি

বাংলাদেশের রাজনীতি যখন ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, তখন দুটি সংবাদ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মাঝে যথেষ্ট আলোড়ন তুলেছে। এর একটি হচ্ছে মোবাইল ফোনে এরশাদ ও বেগম জিয়ার মতবিনিময়। বান কি মুনের ফোনালাপের পরও নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে জট খুলেছে বলে মনে হয় না। সরকার এখনো আগের অবস্থানে আছে নির্বাচনকালীন একটি সরকার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত হবে। প্রয়োজনে বিএনপি সেই সরকারে যোগ দিতে পারে! প্রধানমন্ত্রী পুনরায় বিএনপিকে সংসদে যোগ দিয়ে কোনো প্রস্তাব দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। আর বিএনপি তার আগের অবস্থান ধরে রেখেছে নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকার গঠন করতে হবে, যারা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করবে। গত ২ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের যে রূপরেখা সচিব সভায় উপস্থাপন করেছেন তা বিরোধী জোট তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রধানমন্ত্রীর এই রূপরেখা সংকট আরো প্রকট করবে বলেই মনে হয়। বান কি মুনের ফোনালাপের পরও দুটি বড় দল তার অবস্থান পরিবর্তন করেনি। এমনি এক পরিস্থিতিতে বেগম জিয়া-এরশাদ ফোনালাপ সরকারের জন্য যে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বেগম জিয়ার সঙ্গে ফোনালাপে এরশাদ স্পষ্ট করেছেন যে, তিনি আর মহাজোটে থাকছেন না। তার দল এককভাবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। বেগম জিয়া এরশাদকে ১৮ দলীয় জোটে যোগ দেয়ারও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তবে এরশাদ তার প্রতিশ্রুতি কতটুকু রক্ষা করবেন, সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। অনেক দিন থেকেই তিনি বলে আসছেন যে, তিনি মহাজোট থেকে বেরিয়ে আসবেন। তার ‘সেই সময়’ এখনো আসেনি। আদৌ আসবেন কি-না সে প্রশ্ন থেকেই যায়। রাজনীতি সচেতনরা মনে করেন, এরশাদকে নিয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে তিনি দুটি বড় দলের কাছে শতকরা একশ’ ভাগ বিশ্বাসযোগ্য নন। তিনি একেক সময় একেক কথা বলেন। বেগম জিয়ার সঙ্গে যে কথা বলেছেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা হলে তার ঠিক উল্টো কথাটাও তিনি বলতে পারেন। তবে এটা ঠিক এরশাদকে নিয়ে আলোচনা চলতেই থাকবে। অক্টোবরের ২৫ তারিখ প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভেঙে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তার সর্বশেষ বক্তব্য থেকে এটা মনে করা স্বাভাবিক যে, তিনি তার আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। নির্বাচনের আগ পর্যন্ত সংসদ থাকবে, এমন কথাই তিনি বলেছেন। তার এই মন্তব্য সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়ার ওপর একটি কালো দাগ ফেলবে। এরশাদ নাকি এও বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিতে তিনি রাজি আছেন। এই বক্তব্য আরেকটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করল।
নিঃসন্দেহে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আওয়ামী লীগ এক কঠিন সময় পার করছে। দীর্ঘ ৬৫ বছর যে সংগঠনটির রাজনৈতিক বয়স, সেই সংগঠনটি এখন এক কঠিন সময় পার করছে। দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কি, হবে না, হলে কোন সরকার পদ্ধতির আওতায় অনুষ্ঠিত হবে, এ প্রশ্নের মুখোমুখি আজ দলটি। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বাংলাদেশের ওপর অসন্তুষ্ট। এর আগে তার প্রতিনিধি হয়ে বাংলাদেশ ঘুরে গিয়েছিলেন অস্কার ফার্নান্দেজ। দু-দুবার। কথা ছিল সরকার একটি চিঠি লিখবে। সে চিঠি আর লেখা হয়নি। এখন বান কি মুনও বললেন একটি সমঝোতার কথা। কিন্তু সেই সমঝোতা যে হবে অবস্থাদৃষ্টে তা মনে হচ্ছে না। ২ সেপ্টেম্বর সচিব সভায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য সমঝোতার পথে বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। সরকারে যখন কোনো দল থাকে, তখন দলটির দায়িত্ব থাকে অনেক বেশি। কিন্তু আওয়ামী লীগের অনমনীয় অবস্থান দলটিকে একটি বড় ধরনের প্রশ্নের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এমনকি মহাজোটের অন্যান্য শরিক দলও যে আওয়ামী লীগের ওপর সন্তুষ্ট তা বলা যাবে না। অনেক ইস্যুতে আওয়ামী লীগ নিজেদের বিতর্কিত করেছে। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু, ড. ইউনূস ইস্যু, হেফাজতে ইসলামের অবরোধ-জমায়াতে হামলা, মানবাধিকারকর্মী আদিলুর রহমানের গ্রেফতার, শেয়ারবাজার, হলমার্ক-ডেসটিনি কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি এ রকম অনেক দৃষ্টান্ত দেখা যায়, যেখানে আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকদের সিদ্ধান্ত দলের জন্য কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনেনি। এমনকি ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হয়ে যাওয়া, সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড, বিএনপি অফিসে হামলা চালানো কিংবা বিএনপি-জামায়াতের মিছিলে গুলি চালানো, র্যাবের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমালোচনাও দেশের অভ্যন্তরে ও বহির্বিশ্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বারবার বিতর্কিত করেছে। শেয়ারবাজার নিয়ে যে বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়া দরকার ছিল, সরকার তা পারেনি। অর্থ মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, গুরুত্বপূর্ণ তিনটি মন্ত্রণালয় পরিচালনায় আওয়ামী লীগ কোনো দক্ষ নেতৃত্ব আমাদের উপহার দিতে পারেনি। একাধিক মন্ত্রণালয়ে সুশাসনের অভাব ছিল লক্ষণীয়। দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে ‘কালো বিড়াল’খ্যাত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগ ও পুনরায় মন্ত্রিসভায় ফিরে আসা এবং দীর্ঘদিন দফতরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে থেকে যাওয়া জনমানুষে নানা প্রশ্নের জন্ম দিলেও সরকারপ্রধানের একক সিদ্ধান্ত, সরকারের ভাবমূর্তি উদ্ধারে কোনো সাহায্য করেনি। সরকার ‘এককভাবে’ একের পর এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংসদ হয়ে পড়েছে অনেকটা একদলীয়।
বান কি মুনের সর্বশেষ উদ্যোগও তাই যখন ব্যর্থ হওয়ার পথে (?), তখন এ প্রশ্নটাই সামনে চলে আসে যে, শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ যদি এককভাবে নির্বাচন করে (সংবিধান অনুযায়ী যা বাধ্যতামূলক), তাহলে ইতিহাস আওয়ামী লীগকে কিভাবে মূল্যায়ন করবে? ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল, যার কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। সংসদ বয়কটের ‘কালচার’ শুরু করেছিল আওয়ামী লীগ, যা আজ এক ‘সংসদীয় ব্যাধি’তে পরিণত হয়েছে। ‘এক-এগারো’র ঘটনার আগে ‘লগি-বৈঠার’ আন্দোলন কিংবা পরে ‘মইনউদ্দীন-ফখরুদ্দিনের’ সরকারের সব কর্মকাণ্ডকে সমর্থনের ঘোষণার পরও এদেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছিল। কেননা মানুষ একটি পরিবর্তন চেয়েছিল। আজ তাই প্রশ্নটা ওঠা স্বাভাবিক যে, আওয়ামী লীগ জনমানুষের সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে কতটুকু পেরেছে? সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন হোক, কিন্তু তা যেন হয় গ্রহণযোগ্য। একটি নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের আওতায় নির্বাচন আয়োজন করা এখনো সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী যদি জানিয়ে দেন তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানের দায়িত্ব নেবেন না, তাহলে জাতি বড় সংকট থেকে মুক্তি পাবে। কিন্তু সেটি হবে এ বিশ্বাসটা রাখতে পারছি না। প্রধানমন্ত্রী দুটি কথা প্রায়ই বলেন, একটি হচ্ছে তার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে তারা আজীবন থাকার চেষ্টা করবে?
প্রথম ক্ষেত্রে তিনি কথাটা মিথ্যা বলেননি। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে তিনি তার পরিবার সদস্যদের সবাইকে হারিয়েছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়। তারপরও সব কিছু ভুলে গিয়ে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন। দীর্ঘদিন তিনি দলীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছেন। রাজনীতি থেকে অবসরে যাবেন, এমন সম্ভাবনাও তার নেই। তিনি ভালো করেই জানেন মধ্য আশির দশকে তিনি নয়াদিল্লি থেকে ফিরে এসে যদি দলের দায়িত্ব গ্রহণ না করতেন, তাহলে দল একাধিক ভাগে বিভক্ত হয়ে যেত। বাহ্যত দল তো দু’ভাগে ভাগ হয়ে জাতীয় নির্বাচনে অংশও নিয়েছিল। এক ভাগ ছিল মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে আর অপর ভাগ ছিল আব্দুল মালেক উকিলের নেতৃত্বে। তিনি দলের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন বিধায় দলের ঐক্য টিকে আছে। জাতি তাকে সুযোগ দিয়েছে। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তাতে তিনি সফলও হয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ সংসদে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে সংযোজিত হয়েছিল। কিন্তু তিনি ক্ষমতাসীন হয়ে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের উদ্যোগ নিলেন, তা জনসমর্থন পায়নি। তার কাছে সুযোগ ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে। আর এটা করলে তিনি ইতিহাসে নাম লেখাতে পারতেন। জাতি তাকে দু’বার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে। তিনি বঙ্গবন্ধুর পরিবারের নামের ওপর কতটুকু বিচার করেছেন তার বিবেচিত হবে আগামী দিনগুলোতে। ‘আজীবন তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে’ বলে তিনি যা বলেন, তার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। আমাদের মতো দেশে কিছুদিনের জন্য আরো তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকা উচিত। বর্তমান যে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট, তাতে একটি অগণতান্ত্রিক সরকার কিংবা একটি অনির্বাচিত সরকারের ক্ষমতায় দীর্ঘদিন থাকার কোনো সুযোগ নেই। তারা থাকতে চাইলেও থাকতে পারবে না। তাই ভালো হতো যদি তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ত্রুটিগুলো সারিয়ে তুলে নতুন একটি নির্বাচনকালীন ব্যবস্থা আমাদের উপহার দিতেন। জাতি তো তার কাছ থেকে এটাই প্রত্যাশা করেছিল। তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। তার কাছ থেকে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। তিনিই পারতেন রাজনীতিতে সংস্কার আনতে।
নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার নামই গণতন্ত্র নয়। গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে এককভাবে নির্বাচন করা, বিরোধী দলের নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে দমননীতি অব্যাহত রাখা, দুর্নীতিগ্রস্তদের শাস্তি না দিয়ে পুরস্কৃত করা, তথাকথিত ‘তৃতীয় শক্তির ক্ষমতা গ্রহণের’ কথা বলে মূল সমস্যা এড়িয়ে যাওয়া এসব আর যাই হোক গণতন্ত্র হতে পারে না। গণতন্ত্রের অপর নাম হচ্ছে পরমতসহিষ্ণুতা। অপর পক্ষকে গ্রহণযোগ্যতায় নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার নামই হচ্ছে গণতন্ত্র। সম্ভবত এ কারণেই বলা হয় বিরোধী দল সরকারেরই একটা অংশ। কিন্তু বাংলাদেশে গণতন্ত্রের এই স্পিরিটকে প্রতিফলিত হতে দেখিনি আমরা। যেখানে বিরোধী দলকে নিয়ে সরকারের কাজ করার কথা, সেখানে সরকারকে বিরোধী দলকে ‘ধ্বংস’ করতে আমরা দেখেছি। সরকারের শেষ সময়ে এসে যে সংকটের মুখোমুখি, তার সমাধান সরকারকেই করতে হবে। আজকে এরশাদের মতো ব্যক্তিত্ব যদি ১৮ দলে যোগ দেন, তাতে আমি অবাক হব না। কেননা রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। যেখানে তার স্বার্থ রয়েছে, এরশাদ সাহেব সেখানে যাবেন, এটাই স্বাভাবিক। এরশাদের জাতীয় পার্টি আর বেগম জিয়ার বিএনপির মাঝে রাজনীতিগতভাবে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। উভয় দলই ইসলামিক মূল্যবোধ ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। সুতরাং ঐক্য হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে এই ঐক্য যদি আদৌ হয়ও তাতে রাজনীতিতে কতটুকু গুণগত পরিবর্তন আসবে বলা মুশকিল।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যে বিষয়টি মুখ্য হওয়া উচিত তা হচ্ছে সুশাসনের নিশ্চয়তা। রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুটপাট হবে অথচ এর সুষ্ঠু বিচার হবে না, এটা কোনো ভালো লক্ষণ নয়। মানুষ ভোট দিয়ে নয়া নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে একটা পরিবর্তন চেয়েছে। কিন্তু এই পরিবর্তনের নাম রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় নয়, লুটপাট নয়। হলমার্ক, শেয়ারবাজার, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দেয়ার ব্যর্থতা আমাদের দেশে সুশাসনের অভাবকেই প্রমাণ করে। আর একটা দেশে যদি সুশাসন না থাকে, তাহলে সেই দেশ এক সময় পরিণত হয় একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে। মুক্তিযুদ্ধ ও লাখ লাখ জীবনের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে যে রাষ্ট্রটির জন্ম, সেই রাষ্ট্রটি রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার কারণে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হবে তা আমরা কেউ চাই না। প্রধানমন্ত্রী আবারো জনগণের কাছে ভোট চেয়েছেন। এটাই হলো আসল কথা। জনগণের কাছেই যেতে হবে। জনগণই সরকারের মূল্যায়ন করবে। আর এ জন্য প্রয়োজন নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা। প্রধানমন্ত্রী যদি সেই নির্বাচনকালীন সরকারের নেতৃত্বে দেন, তাহলে সেই সরকার নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। আজ তাই সত্যিকার অর্থেই আওয়ামী লীগ একটি কঠিন সময় পার করছে। তাদের যে কোনো সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন জাতিকে একটি সংকট থেকে মুক্তি দেবে, অন্যদিকে সেই সিদ্ধান্তটি যদি সঠিক না হয়, তাহলে তা জাতিকে অনেক পিছিয়ে দেবে। মানুষের প্রত্যাশা এটাই শেখ হাসিনা চূড়ান্ত বিচারে সঠিক সিদ্ধান্তটিই নেবেন।
অস্ট্রিন, টেস্কাস, ৩০ আগস্ট, ২০১৩
 মানবকন্ঠ ০৭.০৯.২০১৩

মিসর কি আরেকটি আফগানিস্তানে পরিণত হবে?


মিসর কি আরেকটি আফগানিস্তানে পরিণত হতে যাচ্ছে? এই সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছে মিসরে ইসলামী জঙ্গিবাদী সংগঠন 'আল গামা আল ইসলামিয়া' কর্তৃক প্রচারিত একটি বিবৃতির পর। সংগঠনটি অভিযোগ করেছে যে মিসরকে আরেকটি 'আফগানিস্তান' বানানোর লক্ষ্যে ষড়যন্ত্র করে একটি ইসলামপন্থী সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে। জঙ্গিবাদী আল গামা আল ইসলামিয়ার বিবৃতিটি যখন প্রচারিত হয়, ঠিক তখনই আল-কায়েদার নেতা জওয়াহিরির একটি বিবৃতিও ইন্টারনেটে প্রকাশিত হয়েছে। জাওয়াহিরি মুরসির উৎখাতের পেছনে সেনাবাহিনী, ইহুদিবাদ, খ্রিস্টান তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। স্পষ্টতই মিসর নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের শঙ্কা অনেক। কী হতে যাচ্ছে মিসরে, এ ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। বাস্তবতা হচ্ছে ৩ জুলাই সেনাবাহিনী মুরসিকে উৎখাত করার পর এখন পর্যন্ত সেখানে স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। এরই মধ্যে কায়রো সফর করেছেন মার্কিন দূত উইলিয়াম বার্নস, জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিশনার এসটন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, লেডি এসটন ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে বাস্তবতা ও নয়া প্রেসিডেন্টকে মেনে নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু মুরসি এতে রাজি হননি। মুরসির সমর্থকরা কায়রোর একটি মসজিদ দখল করে সেখানে অবস্থান করছেন। প্রতি শুক্রবার তারা বড় বিক্ষোভের আয়োজন করেন। এদিকে নয়া সরকারের পক্ষে জনসমর্থনও বাড়ছে। তারাও সেনাবাহিনীর সমর্থনে বিক্ষোভ করছে। সুতরাং মিসর নিয়ে একটা ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। নয়া সরকার ২০১৪ সালে একটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, এর আগে সংবিধান সংশোধনসহ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। একটি সাংবিধানিক পরিষদও গঠন করা হয়েছে, যারা সংবিধান সংশোধন করবে। একটি সমঝোতার উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র এই সমঝোতার উদ্যোক্তা। কিন্তু সামরিক অভ্যুত্থান মিসরের সমাজে যে বিভক্তি ডেকে এনেছে, তা অপসারিত হবে কীভাবে? একদিকে ইসলামপন্থী, অন্যদিকে সেক্যুলারপন্থী, যাদের সঙ্গে মিলেছে লিবারেল ও ডেমোক্রেটরা। এই পরস্পরবিরোধী দুই শক্তির মাঝে দ্বন্দ্বের অবসান আদৌ হবে কি?
মিসরে সেনা অভ্যুত্থানের প্রায় পাঁচ সপ্তাহ অতিক্রম হয়ে যাওয়ার পর যে প্রসঙ্গটি এখন উঠেছে তা হচ্ছে মিসর কি আদৌ গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত? সামরিক শাসকরা যে মিসরের সমাজে একটি বড় 'রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি' তার ইতিহাস তো শুধু মুরসিকে উৎখাত করার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো না। বলা যেতে পারে মিসরের সেনাবাহিনী গত ৬১ বছরে যেভাবে বিকশিত হয়েছে, তাতে করে রাষ্ট্রটি সামরিক বাহিনী নির্ভর একটি সমাজে পরিণত হয়েছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, বৈদেশিক নীতি, নিরাপত্তা প্রতিটি ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্তৃত্ব রয়েছে। সেনাবাহিনী প্রধান সে দেশের অলিখিতভাবে 'ছায়া রাষ্ট্রপতি' আর লিখিতভাবে দেশরক্ষামন্ত্রী। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন একটি পরিষদ 'কিচেন ক্যাবিনেট' হিসেবে কাজ করে। এটা তখনো ছিল। এখনো আছে। এমনকি জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে ও জনগণের ভোটে মুরসি সে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও তিনি সেনাবাহিনীর এই প্রভাব অস্বীকার করতে পারেননি। প্রেসিডেন্ট মুরসি নিজে জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ এল সিসিকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। সেনাপ্রধান হিসেবে দেশরক্ষামন্ত্রীও ছিলেন জেনারেল সিসি। মুরসির শাসনামলে যে নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করা হয়েছিল, সেখানে মুরসির কোনো কর্তৃত্ব ছিল না। সদস্যদের নিয়োগ দিয়েছিলেন জেনারেল সিসি। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের জুলাই মাত্র দুই বছর সময় নিয়েছিল সেনাবাহিনী। এ দুই বছরে তারা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুতির ব্যাপারে তারা যে যুক্তি দেখিয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাস, যাদের ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে মনে করে, তাদের সমর্থন দিয়েছিলেন মুরসি। এই যুক্তিতে তার 'বিচার' এবং ১৫ দিনের 'জেল' হয়েছে। স্পষ্টই বলা যায় জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ এল সিসি হতে পারেন মিসরের পরবর্তী 'নেতা'। ইতিহাস বলে, মিসরের ফারাওরা (অর্থাৎ শাসক, বাদশাহ, রাজা) যেভাবে সব ক্ষমতা নিজেদের করায়ত্ত করে রেখেছিলেন, আজকের যুগে মিসরে সেনাবাহিনী সেই ক্ষমতাই লালন করতে যাচ্ছে। মাঝখানে পাঁচ হাজার বছর চলে গেলেও মানসিকতায় কোনো পরিবর্তন আসেনি।
জেনারেল এল সিসির পূর্বসূরিরা দল গঠন করে ক্ষমতা করায়ত্ত করেছিলেন। ১৯৫৩-৫৬ সালে নাসের গঠন করেছিলেন 'লিবারেশন র‌্যালি'। ১৯৫৭-৭০ সময়সীমায় গঠিত হয়েছিল 'ন্যাশনাল ইউনিয়ন'। উভয় ক্ষেত্রেই লিবারেশন র‌্যালি ও ন্যাশনাল ইউনিয়ন একটি পরিপক্ব রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। ১৯৭১ সালে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট সাদাত গঠন করেছিলেন আরব সোশ্যালিস্ট ইউনিয়ন। ১৯৭৯ সালে সাদাত একে ভেঙে গঠন করেছিলেন 'নিউ ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন'। আর হোসনি মোবারকও একই পথ অনুসরণ করে গেছেন। সুতরাং জেনারেল সিসি যে ক্ষমতা একজন সম্ভাব্য প্রেসিডেন্টের হাতে তুলে দিয়ে ব্যারাকে ফিরে যাবেন, এটা আমার মনে হয় না। তাহলে কোন পথে যাচ্ছে মিসর? মিসর থেকে যেসব খবর আসছে তা কোনো আশার কথা বলছে না। মুরসির পক্ষে ও বিপক্ষে দুটি জনমত রয়েছে। মুরসির সমর্থক 'মুসলিম ব্রাদারহুড' লাখ লাখ লোকের জমায়েত করলে সেনাবাহিনী তাতে গুলি চালায়। এতে মারা যায় ১৫২ জন মানুষ। এতে করে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে_ সেনাবাহিনী কোনোমতেই আর মুরসিকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনছে না। যদিও মুরসির সমর্থকদের দাবি এটাই। এখানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা এখনো স্পষ্ট নয়। সেনাবাহিনী কি এককভাবে কোনো একটি দল গঠন কিংবা পুনর্গঠন করে নিজেরা ক্ষমতা পরিচালনা করবে, যেমনটি করেছিলেন আনোয়ার সাদাত কিংবা হোসনি মোবারক?
ক্ল্যাসিকাল সামরিক অভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনী যা করে, তা-ই করেছে মিসরের সেনাবাহিনী। হাজেম এল বেবলাওইকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে কিন্তু তার এই নিযুক্তি কিংবা মন্ত্রিসভায় যোগদানে মুসলিম ব্রাদারহুডের আপত্তি মিসরের এই সংকটকে আরো ঘনীভূত করবে। মিসরের সেনা অভ্যুত্থানের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। তখন তারা একে একটি সামরিক অভ্যুত্থান বলতেও রাজি ছিল না। কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন কোনো সেনা অভ্যুত্থানকে সমর্থন করে না। তাই তারা একে সামরিক অভ্যুত্থান হিসেবে চিহ্নিত না করে পরোক্ষভাবে সেনা অভ্যুত্থানকে সমর্থন জানিয়েছে। এটা তাদের রাজনীতির একটা বৈপরিত্য। আসলে বিশ্বব্যাপী মার্কিন নীতি সমালোচিত হচ্ছে। মিসরের ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে কেউ সমর্থন করেনি।
মূলত এখানে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে মিসরে এমন একটি সরকার দরকার, যে সরকার ইসরাইলের সঙ্গে একত্রে কাজ করবে। মুরসি তাদের জন্য একটা সমস্যা ছিলেন। তাই তাকে চলে যেতে হলো। আপাতদৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্র মিসরের জন্য চারটি এফ-১৬ বিমান সরবরাহ স্থগিত করেছে। এটা লোক দেখানো। এতে করে মিসরের ব্যাপারে তাদের স্ট্রাটেজিতে কোনো পরিবর্তন আনবে না। প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্র মিসরকে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সাহায্য দেয়। এতেও কোনো হেরফের হবে না।
মুরসির ব্যর্থতা আছে। কিন্তু যা সত্য তা হচ্ছে মিসরের সমাজ, সংস্কৃতি গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত নয়। মিসরের জনগণ সামরিকতন্ত্রেই অভ্যস্ত। ইসলামী শক্তিগুলো বিশেষ করে মুসলিম ব্রাদারহুড ও আন নুর পার্টির জনপ্রিয়তা রয়েছে। কিন্তু জনপ্রিয়তা ও দেশ শাসন এক নয়। যেখানে প্রয়োজন ছিল ব্যাপকভিত্তিক ঐকমত্যের তাতে মুরসি ব্যর্থ হয়েছিলেন। তার ব্যর্থতাই সামরিক বাহিনীকে সামনে নিয়ে এলো। ভুলে গেলে চলবে না, মিসরের অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে সেনাবাহিনী জড়িত। খাদ্য উৎপাদন, বণ্টন, বিশুদ্ধ পানি উৎপাদন ও সরবরাহ, রিয়েল এস্টেট_ এ ধরনের অনেক ব্যবসার সঙ্গে সেনাবাহিনী প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জড়িত। সুতরাং এই 'শক্তিকে' অস্বীকার করা যাবে না। এটা ঠিক, মুসলিম ব্রাদারহুডের সমাজে একটা ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এই প্রভাবই মুরসিকে নির্বাচনে বিজয়ী করেছিল। তিনি 'রিয়েল পলিটিকস'-এর স্পিরিট অনুসরণ করেননি। এটা সত্য, ইসলামী শক্তিগুলো এখনো সেনা সমর্থনকারী শক্তিকে সমর্থন করেনি। এখনো তারা তাদের প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু এতে করে সরকারের পতন ঘটবে না।
মিসর একটা সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল যে সেখানে গণতন্ত্র বিকশিত হবে। দীর্ঘদিন স্বৈরশাসনে আক্রান্ত যে দেশ, সে দেশে সত্যিকার অর্থেই একটি সাচ্ছা গণতন্ত্র বিকাশ লাভ করবে_ এমন সম্ভাবনা দেখেছিলেন পশ্চিমা বিশ্বের অনেকেই। কিন্তু এখন দেখা গেল মিসর সেই পুরনো বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। সামরিক বাহিনী ছিল 'ঘুমন্ত বাঘ', সেই বাঘ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। জেনারেল নাগিব, কর্নেল নাসের, আনোয়ার সাদাত কিংবা হোসনি মোবারকের মতো জেনারেল সিসি নাম লেখাতে যাচ্ছেন। এটা স্পষ্ট। এ ক্ষেত্রে ইসলামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে সরকারের যে আলোচনা হচ্ছে, তার সুর একটাই_ বর্তমান সরকারকে মেনে নিয়ে নির্বাচনে আসা। ব্রাদারহুড এটা করবে বলে মনে হয় না। মিসরের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র নয়, বরং জয়ী হলো সামরিকতন্ত্র। 'আরব বসন্ত'-এর জন্য এটা একটা বড় ধরনের ধাক্কা। মিসরে সামরিকতন্ত্র যদি বিজয়ী হয়, তাহলে এর প্রভাব পড়বে তিউনিসিয়া ও ইয়েমেনেও। ভয়টা এখানেই।
যায়যায়দিন ০৭.০৯.২০১৩

সিরিয়ায় যুদ্ধ কি আসন্ন?

৯ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস এক গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশনে মিলিত হচ্ছে। সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ চালাবে কি চালাবে না, এ ব্যাপারে কংগ্রেস একটি সিদ্ধান্ত দেবে। ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট ওবামা এটা নিশ্চিত করেছেন যে, তিনি কংগ্রেসের অনুমোদন নিয়েই সিরিয়ায় \\'সীমিত\\' ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে চান। এক্ষেত্রে যুদ্ধবিমানের চাইতে তিনি ভূমধ্যসাগরের অবস্থিত ডেস্ট্রয়ার থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাবেন। অবস্থাদৃষ্টে যা মনে হচ্ছে, তা হচ্ছে তিনি কংগ্রেসের সমর্থন পাবেন। টিভি টকশোগুলোতে কংগ্রেসের সদস্যরা অনেকেই সিরিয়ায় বিমান হামলা চালানোর পক্ষে। কিন্তু এই হামলা কি সিরিয়া সংকটের কোনো সমাধান বয়ে আনবে? অনেক প্রশ্ন ইতিমধ্যে উঠেছে, যা শুধু সংকটের মাত্রাকে বাড়াবেই না, বরং বিশ্বে নতুন করে উত্তেজনার জন্ম দেবে। প্রথমত, সিরিয়ায় যে কোনো ক্ষেপণাস্ত্র হামলা মধ্যপ্রাচ্যে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধের জন্ম দিতে পারে। এই \\'যুদ্ধ\\' আর শুধু সিরিয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং তা ইরান, লেবানন, তুরস্ক ও ইসরায়েলকে জড়িত করতে পারে। ইরান ও লেবাননের হিজবুল্লাহ ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে পারে। হামাসের পক্ষ থেকে ইসরায়েলে হামলা চালানোও বিচিত্র কিছু নয়। এমনি এক পরিস্থিতিতে ইসরায়েলকে রক্ষার তাগিদে যুক্তরাষ্ট্র একটি \\'পূর্ণ যুদ্ধ\\' শুরু করতে বাধ্য হতে পারে। দ্বিতীয়ত, এই \\'যুদ্ধ\\' নতুন করে বিশ্বে এক স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা করতে পারে। কেননা রাশিয়া ও চীন বারবার এই যুদ্ধের পরিণতির কথা বলে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের জনমত যুদ্ধের পক্ষে নয়। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট যুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট যুদ্ধের পক্ষে বললেও জনমত যুদ্ধের পক্ষে নয়। জার্মানিও যুদ্ধের পক্ষে নয়। ফলে প্রেসিডেন্ট ওবামার সিরিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক আসরে \\'বিচ্ছিন্ন\\' করে ফেলতে পারে। ভারত ও ব্রাজিলের মতো দেশও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এসে দাঁড়ায়নি। তৃতীয়ত, \\'ওয়ার পাওয়ার রেজ্যুলেশন\\'-এর ধারা ২প অনুযায়ী উল্লেখ করা হয়েছে যে, যদি যুক্তরাষ্ট্র আক্রান্ত হয়, শুধু তখনই ওই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে। এক্ষেত্রে তথাকথিত সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘি্নত হয়নি কোনোভাবেই। ফলে ওবামার সেই \\'যুদ্ধে যাওয়ার\\' সিদ্ধান্ত কংগ্রেসের সমর্থন পেলেও নৈতিকভাবে তিনি দুর্বল থাকবেন এবং তার সিদ্ধান্ত নানা বিতর্কের জন্ম দেবে। চতুর্থত, প্রেসিডেন্ট ওবামা যদি যুদ্ধ ঘোষণা করেনও, তা হলেও তিনি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করবেন। কেননা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়া কোনো যুদ্ধ আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ। পঞ্চমত, অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, এ ধরনের একটি \\'চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ\\' আরও বেশি মাত্রায় সহিংসতার জন্ম দেয়। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া এর বড় প্রমাণ। অধ্যাপক স্টেফান জুনেস তার একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন, কোন কোন ক্ষেত্রে যুদ্ধ-পরবর্তী দেশে একনায়কতন্ত্রের জন্ম হয়। ষষ্ঠত, যদি \\'যুদ্ধ\\' শুরু হয়ে যায়, তা হলে জাতীয়তাবাদী শক্তিকে সেখানে একত্রিত করবে। তারা বাশার আল আসাদকে সমর্থন করবেন এবং প্রচণ্ড এক মার্কিনবিরোধিতার জন্ম হবে, যা ছড়িয়ে যাবে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশে। সপ্তমত, গবেষকরা যুক্তি তুলে ধরে দেখিয়েছেন এ ধরনের যুদ্ধ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতিই হয়েছে বেশি। যুদ্ধ শুরু হলে তা দীর্ঘায়িত হয় (আফগানিস্তান, ইরাক) এবং সামাজিক খাতে (শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিশু অধিকার) ব্যয় বরাদ্দ কমে যায়। অষ্টমত, গবেষকরা দেখিয়েছেন, বাশারের বিকল্প কোনো একক নেতৃত্ব সিরিয়ার বিদ্রোহীরা তৈরি করতে পারেনি। বর্তমানে প্রায় ৮০০ থেকে ১২০০ সশস্ত্র গ্রুপ বিচ্ছিন্নভাবে \\'যুদ্ধ\\' করছে সরকারি সৈন্যদের বিরুদ্ধে। এদের এক কাতারে দাঁড় করানো হবে কঠিন কাজ। ফলে দ্বিতীয় আরেকটি সোমালিয়ার জন্ম হতে পারে আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ায়। নবমত, যুদ্ধ শুরু হলে আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গি সংগঠনগুলো আরও শক্তিশালী হবে। ইতিমধ্যে \\'জাবহাত আলনুসরা\\' নামে একটি সিরীয় সংগঠনের নাম পাওয়া গেছে, যাদের সঙ্গে আল কায়দার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এই সংগঠনকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে। কিন্তু আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কারণে এই সংগঠনটিও আর্থিক ও অস্ত্রশস্ত্র সাহায্য হিসেবে পেয়েছে। আফগানিস্তানের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, তালেবান যোদ্ধাদের আর্থিক ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। অথচ এক সময় এই তালেবানই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল। দশম, ওবামা ও তার নীতিনির্ধারকরা যুদ্ধের কথা বললেও কীভাবে এখান থেকে বেরিয়ে আসবেন তার কোনো পরিকল্পনার কথা বলেননি। এগার, এই যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ব নতুন করে এক ধরনের \\'প্রক্সি যুদ্ধ\\' (যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া, আর ইসরায়েল বনাম ইরান) প্রত্যক্ষ করতে পারে। বলা ভালো, যুক্তরাষ্ট্রের এ অঞ্চলে সামরিক হস্তক্ষেপের ইতিহাস রয়েছে। অতীতে ১৯৯১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি বহুজাতিক বাহিনী ইরাকি বাহিনীর কুয়েত দখল থেকে মুক্ত করেছিল। ২০০৩ সালে ইরাকের কাছে মানববিধ্বংসী মারণাস্ত্র রয়েছে এই অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন বাগদাদে মিসাইল হামলা চালিয়ে সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত করেছিল। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ২০১১ সালে লিবিয়ায়। এবারে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা \\'মানবতা রক্ষায়\\' হস্তক্ষেপ করেছিল এবং গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। এক্ষেত্রে ১৯৯১ সালে কুয়েতকে ইরাকি দখলমুক্ত করতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত একটি সিদ্ধান্তের সাহায্য নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ২০০৩ ও ২০১১ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইরাক ও লিবিয়ায় সামরিক আগ্রাসন চালাতে কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। এবারের ক্ষেত্রেও তেমনটি হতে যাচ্ছে। লিবিয়ায় গাদ্দাফিকে উৎখাতের ব্যাপারে ব্যবহৃত হয়েছিল Humanitaion InterventionÕ\\'-এর তত্ত্বটি। আর এবারে ব্যবহৃত হতে যাচ্ছে \\'ÔResponsibility to Protect \\' তত্ত্ব। এর মূল কথা হচ্ছে, মানবতা রক্ষায় বিশ্বশক্তির দায়িত্ব। যেহেতু সিরিয়ায় সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে(?) সেহেতু সাধারণ মানুষকে রক্ষায় পশ্চিমা শক্তি দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবেই এই সামরিক হস্তক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছে! এখানে বলা ভালো, সিরিয়ার ঘটনাবলি সে দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনা। জাতিসংঘের চার্টারে উল্লেখ করা আছে, একটি দেশ অপর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। যদি এসব কোনো ঘটনার জন্ম হয় যে সেখানে স্থিতিশীলতা ও গণহত্যা রোধে সামরিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে, তা হলে কাজটি করতে হবে নিরাপত্তা পরিষদের গৃহীত একটি সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে। ইরাকের (২০০৩) ক্ষেত্রে কিংবা লিবিয়ার ক্ষেত্রেও (২০১১) ও এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়নি নিরাপত্তা পরিষদ। সিরিয়ার ক্ষেত্রেও নিরাপত্তা পরিষদ এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে এটাও সত্য, আন্তর্জাতিক একটি সম্মেলনে ÔResponsibility to ProtectÕÕ\\'-এর একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। তবে এ ব্যাপারে কোনো চুক্তি হয়নি এবং এটা কোনো আন্তর্জাতিক আইনও নয়। এর অর্থ হচ্ছে, সিরিয়ায় সম্ভাব্য সামরিক আগ্রাসন আন্তর্জাতিক আইনে অনুমোদন করে না। তবে ওবামাকে শেষ পর্যন্ত সিরিয়ায় আক্রমণ চালাতেই হবে। ৩ সেপ্টেম্বর ওবামা হোয়াইট হাউসে হাউস স্পিকার বেহনার ও সংখ্যালঘু নেতা পেলোসির সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। বিকেলে সিনেটের এক কমিটিতে ওবামার নীতিনির্ধারকরা সিরিয়া আক্রমণের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। সিরিয়া আক্রমণের ছক কাটা হয়েছে। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার (২০০৯) বিজয়ী বারাক ওবামা শান্তি পুরস্কারের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছিলেন ২০১১ সালে লিবিয়া আক্রমণের নির্দেশ দিয়ে। আর এই সেপ্টেম্বরেই তিনি দ্বিতীয়বারের মতো আরেকটি যুদ্ধের সূচনা করতে যাচ্ছেন। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, লিবিয়া আর ইরাকের সঙ্গে সিরিয়াকে মেলানো যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের \\'যুদ্ধ অর্থনীতি\\' বারাক ওবামাকে যুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করলেও শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য তা হবে বড় একটি আঘাত।
টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র