আরো
একটি বছর আমরা পার করে এলাম। ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ঘটনাবলির
মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মুসলিম বিশ্বে জঙ্গিবাদের উত্থান, দুই পরাশক্তি
যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং সেই সঙ্গে দীর্ঘ ৫৪ বছর পর
কিউবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ। জঙ্গিবাদের ভয়াবহ রূপ
আমরা প্রত্যক্ষ করেছি পাকিস্তানের সেনানিয়ন্ত্রিত এলাকা পেশোয়ারে একটি
স্কুলে ইসলামি জঙ্গিদের হামলায় ১৩২টি শিশুর অকাল মৃত্যু। ঠা-া মাথায় এদের
হত্যাকা- প্রমাণ করে জঙ্গিবাদ আজ পাকিস্তানের অস্তিত্বকে রীতিমতো একটি
প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এক সময় যে এলাকায় বাম রাজনীতির প্রভাব ছিল,
'সীমান্ত গান্ধী' হিসেবে পরিচিত গাফফার খান যে অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জন্য
জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কাজ করে গেছেন এবং অহিংস পদ্ধতিতে তার 'লড়াই'
অব্যাহত রেখেছিলেন, সেই অঞ্চল আজ ধর্মীয় উগ্রবাদে আক্রান্ত। সেখানকার
মানুষের মানসিকতা বদলে গেছে। ধর্মীয় কুপম-ুকতা এই একুশ শতকে এসেও সমাজ
বিনির্মাণে প্রভাব খাটাচ্ছে। পাকিস্তানে ধর্মীয় উগ্রবাদের শেকড় যে কত গভীরে
এটা আবারো প্রমাণিত হলো। তবে সেই সঙ্গে এটাও স্বীকার করতে হবে ২০১৪ সালে
বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র এক ধরনের উগ্রবাদ। ওই
উগ্রবাদ আজ সিরিয়া-ইরাকের অস্তিত্ব যেমন বিপন্ন করে তুলেছে, টিক তেমনি তা
সম্প্রসারিত হয়েছে আফ্রিকাতে, বিশেষ করে সুদান ও নাইজেরিয়ায়।
উগ্রবাদীগোষ্ঠী আল-শামা (সুদান) ও বোকো হারাম (নাইজেরিয়া) এর অনেক সহিংস
কর্মকা- ২০১৪ সালে বারবার আলোচিত হয়েছে। ধর্মান্ধ একটি গোষ্ঠী বোকো হারাম
যেভাবে শত শত কিশোরীদের ধরে নিয়ে গিয়ে তাদেরকে ধর্মান্তরিত করছে (খৃস্টান
থেকে মুসলমান) এবং এক ধরনের 'যৌন দাসত্ব' গ্রহণ করতে বাধ্য করছে তা বিশ্ব
বিবেককে নাড়া দিয়ে গেছে। কিশোরীদের উদ্ধারে নাইজেরিয়ার সেনাবাহিনীকেও
প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। বোকো হারামের কর্মকা-ের সঙ্গে সিরিয়ায় জুন মাসে
(২০১৪) উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী 'ইসলামিক স্টেট অ্যান্ড লেভেন্টে'র উত্থানের এক
অদ্ভুত মিল লক্ষ্য করা যায়। আরো অবাক করার বিষয় হচ্ছে, অন্তত ৬০টি মুসলিম
বিশ্বের তথাকথিত 'জিহাদি'রা আজ সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধাদের সঙ্গে
তথাকথিত একটি 'খিলাফত' প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে। এক চরম উগ্রবাদ এখন এ
অঞ্চলের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ইসলামিক স্টেটের (আইএস) আবির্ভাব ও জনৈক
আবু বকর বুগদাদির নিজেকে ইসলামি বিশ্বের 'খলিফা' হিসেবে ঘোষণা করা কিংবা
কুর্দি অঞ্চলে ইয়াজদি সম্প্রদায়ের মহিলা তথা কিশোরীদের ধরে নিয়ে গিয়ে তাদের
'যৌন দাসত্বে' পরিণত করার কাহিনী একাধিকবার সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলেও
বিশ্ব সম্প্রদায় এক্ষেত্রে ছিল অনেকটা নির্লিপ্ত। আইএসের উত্থান তথা
অগ্রযাত্রা রোধ করা সম্ভব হয়নি। ইরাক ও সিরিয়ার মধ্যস্থল নিয়ে অলিখিত এক
'সুনি্নস্থানে'র জন্ম হয়েছে। সুনি্ন নিয়ন্ত্রিত এই বিশাল এলাকায় তথাকথিত
'ইসলামিক স্টেটে'র জঙ্গিদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ
কটি আরব রাষ্ট্র এই 'ইসলামিক স্টেটে'র জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা শুরু
করলেও এদের অগ্রযাত্রা রোধ করা সম্ভব হয়নি। তাই ২০১৫ সালের বিশ্ব
রাজনীতিতে এই ইসলামিক জঙ্গিরা বারবার আলোচনায় আসবে।
২০১৪ সালে দুটি বড় দেশ ভারত ও ইন্দোনেশিয়ায় 'গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা' অব্যাহত থাকলেও ইউক্রেন পরিস্থিতি সেখানে যে সঙ্কটের জন্ম দিয়েছিল তা ডিসেম্বরের শেষদিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ভারতে মোদির বিজয় ও ইন্দোনেশিয়ায় জোকো উইদোদোর প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্তি প্রমাণ করে বড় গণতান্ত্রিক সমাজে এক ধরনের 'পপুলিজমে'র জন্ম হয়েছে। অর্থাৎ সাধারণ একজন মানুষ শুধুমাত্র তার নিষ্ঠা, সততা আর 'কমিটমেন্টে'র কারণে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেন, মোদি ও উইদোদো এর বড় প্রমাণ। মোদি একসময় রেল স্টেশনে চা বিক্রি করতেন। আর অত্যন্ত জনপ্রিয় উইদোদো ছিলেন বস্তির ছেলে। শুধুমাত্র জনপ্রিয় নীতি আর সততার কারণে তারা আজ বিশ্ব নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। ভারতে কংগ্রেসের ব্যর্থতাই মোদিকে ক্ষমতায় বসিয়েছে এবং তিনি সেখানে এক ধরনের 'পপুলিজমে'র জন্ম দিয়েছেন। তবে উইদোদোর বিজয় অত সহজ ছিল না। সেনানিয়ন্ত্রিত ইন্দোনেশিয়ায় তিনি নিজেকে একজন 'যোগ্য নেতা' হিসেবে প্রমাণ করেছেন। তবে গণতন্ত্রের জন্যও 'অশনি সংকেত' ছিল থাইল্যান্ডে, হংকং এবং পাকিস্তানে। মে মাসে সেনাবাহিনী থাইল্যান্ডে ক্ষমতা দখল করে ও সেনাপ্রধান নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা দেন। থাই রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতাই সেখানে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারছে না। আর সেনাবাহিনী ওই সুযোগটাই গ্রহণ করেছে। পাকিস্তানে ইমরান খানের নেতৃত্বে ইসলামাবাদে একটি 'অক্যুপাই মুভমেন্টে'র জন্ম হলেও সরকারের পতন হয়নি। পাকিস্তানে গণতন্ত্রের জন্য সেটা ছিল খারাপ সংবাদ। একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে সেখানে সাধারণ নির্বাচন সম্পন্ন হয় এবং নওয়াজ শরীফের মুসলিম লীগ পুনরায় ক্ষমতা ফিরে পায়। পেশোয়ারে শিশু হত্যাকা-ের ঘটনায় নওয়াজ শরীফ ও ইমরান খানকে কাছাকাছি আনলেও তা কতদিন স্থায়ী হয় সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। ডিসেম্বরে জাপানে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আবেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে গেছেন। ২০১৪ সালে ইউক্রেন সঙ্কট এ অঞ্চলে একটি বড় ধরনের 'যুদ্ধে'র সম্ভাবনার জন্ম হলেও শেষ পর্যন্ত 'যুদ্ধ' হয়নি সত্য, কিন্তু ওই সঙ্কট ২০১৫ সালের বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। সঙ্কটের জন্ম ক্রিমিয়ায় মার্চে অনুষ্ঠিত একটি গণভোটের মধ্যদিয়ে। ভূ-রাজনৈতিকভাবে ক্রিমিয়ার অবস্থান রাশিয়ার কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিকভাবেই রুশ নাগরিকরা ক্রিমিয়ায় বসবাস করেন। গণভোটে তারা রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্তির পক্ষে রায় দেন। এর প্রভাব পড়ে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত দোনেৎসেক ও লুসাক অঞ্চলে। সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের জন্ম হয় এবং রাশিয়ার মদদে তা ব্যাপকতা পায়। ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই সঙ্কটের কোনো সমাধান হয়নি। বরং যুক্তরাষ্ট্র বারবার চেয়ে এসেছে ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিক। তাতে করে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে ন্যাটো তথা যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে রাশিয়া মনে করে তার সীমান্তে ন্যাটোর সেনাবাহিনীর উপস্থিতি তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। ফলে এই সঙ্কট থেকে গিয়েছে এবং ধারণা করছি ২০১৫ সালেও এই সঙ্কট থাকবে। ২০১৪ আরো একটি ভালো খবরের জন্ম হয়েছে। জলবায়ু বিষয়ক কপ-২০ সম্মেলন (লিমা, পেরু) একটি আংশিক সমঝোতা হয়েছে। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত হয়েছে বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে বিশ্বের প্রতিটি দেশ স্বউদ্যোগে কর্মসূচি গ্রহণ করবে এবং ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্যারিসে কপ-২১ চুক্তি স্বাক্ষর করবে। লিমায় বাহ্যত কোনো চুক্তি হয়নি। হয়েছে একটি সমঝোতা। চূড়ান্ত বিচারে মার্কিন কংগ্রেস এই আংশিক সমঝোতাটি মেনে নেবে কিনা এটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। ফলে প্যারিস কপ-২১ সম্মেলন নিয়ে প্রশ্ন থাকবে অনেক। ইবোলায় ১৮ হাজার মানুষের মৃত্যু নিয়ে চলতি বছর কম কথা হয়নি। পশ্চিম আফ্রিকার তিনটি দেশে ওই রোগের বিস্তার এবং খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজনের মৃত্যু সারাবিশ্বে আলোচিত হয়। তবে বছরের শেষদিন পর্যন্ত কোনো প্রতিরোধক আবিষ্কারের খবর আমাদের জানা নেই। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি বিমান (ফ্লাইট-৩৭০) উধাও হয়ে যাওয়া এবং এর কোনো হদিস না পাওয়ার ঘটনাও কম আলোচিত হয়নি। স্কটল্যান্ডে গণভোট অনুষ্ঠিত হয় জানুয়ারিতে। গণভোটে স্বাধীন হওয়ার পক্ষে রায় পড়েনি। স্কটিশরা যুক্তরাজ্যের সঙ্গে থাকতেই রায় দিয়েছে। এটা ইউরোপের রাজনীতির জন্য ছিল উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা। ইরান নিয়ে আলোচনা ছিল কম। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে 'গোপন সমঝোতা' ও সিরিয়ায় আইএসের উত্থান ঠেকাতে ইরানকে ব্যবহার করার বিষয়টিও গণমাধ্যমে আলোচিত হয়েছে। ইসরাইল দীর্ঘ ৭ সপ্তাহ ধরে গাজায় বোমাবর্ষণ করা এবং নারী ও শিশুদের হত্যা করার ঘটনায় বিশ্ব বিবেক জাগ্রত হলেও যুক্তরাষ্ট্র বা জাতিসংঘ ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা ২০১৪ সালে অন্তত একটি ঘটনায় উৎসাহিত হয়েছেন। আর তা হচ্ছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা কর্তৃক কিউবার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ। এই উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো দিক। কিন্তু এই উদ্যোগটি নানা জটিলতায় জড়িয়ে যেতে পারে। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের কনজারভেটিভরা ঠিক এ মুহূর্তেই কিউবার সঙ্গে 'ভালো' সম্পর্কে যেতে চান না। তাদের যুক্তি কিউবা এখনো তার অর্থনীতি ও রাজনীতি উন্মুক্ত করে দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের আইন পরিষদ (সিনেট ও হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ) এখন নিয়ন্ত্রণ করে কনজারভেটিভ রিপাবলিকানরা। তারা কখনই চাইবে না দীর্ঘ ৫৪ বছর আগে কিউবার বিরুদ্ধে যে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল তা তুলে নেয়া হোক। ইতোমধ্যে কিউবার একটি মিত্র দেশ ভেনিজুয়েলার বিরুদ্ধে 'বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা' আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। হুগো শ্যাভেজ পরবর্তী ভেনিজুয়েলার মাদুরো সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের উন্নতির একটা সম্ভাবনা জাগলেও ওই ঘটনা প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্র চায় সেখানে এমন একটি সরকার যেখানে হুগো শ্যাভেজের কোনো প্রভাব থাকবে না। বলা ভালো, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অবর্তমানে ভেনিজুয়েলাই এখন কিউবার অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখছে। প্রতিদিন ১ লাখ ব্যারেল তেল ভেনিজুয়েলা সরবরাহ করে কিউবাকে, যা কিউবার অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করছে। কিউবা এই ঋণ পরিশোধ করে ডাক্তার, নার্স, আর শিক্ষক দিয়ে। তবে ভেনিজুয়েলার অর্থনীতি আর আগের মতো নেই। ফলে কিউবায় তেল সরবরাহ যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে কিউবা বড় বিপদে পড়বে। দক্ষিণ আমেরিকায় বেশ কটি বামপন্থী সরকার রয়েছে। এদের ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্র কঠোর মনোভাব নিচ্ছে। চীন অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে ওঠার কারণে চীনের নেতৃত্বে 'আরেকটি বিশ্ব ব্যাংক' তৈরি হচ্ছে। ব্রিকসের নেতৃবৃন্দ ২০১৪ সালে এক সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা একটি 'ব্রিকস ব্যাংক' তৈরি করবে। এটা হবে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প। চীন ইতোমধ্যেই আইএমএফের আদলে একটি 'ইনফাস্ট্রাকচার' ব্যাংক গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। এই ব্যাংক ২০১৮ সাল থেকে কাজ শুরু করবে। বাংলাদেশ দুটো ব্যাংকেই যোগ দিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে দেখতে হবে এই ব্যাংক দুটো কিভাবে কাজ করে, তাদের ঋণের ধরন কী হয়, সুদের হার কী ইত্যাদি। তবে নিঃসন্দেহে উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য এটা একটি সুখবর। ২০১৪ সালে সারা বিশ্বব্যাপী উত্তেজনা ছিল। যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি বৃত্ত সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধ হয়নি, এটা একটি ভালো খবর। জঙ্গিবাদের উত্থান ও ইউক্রেনের পরিস্থিতি ২০১৫ সালকে প্রভাবিত করবে। সুতরাং ২০১৫ সালটি যে খুব ভালো যাবে, এটা মনে করারও কোনো কারণ নেই। Daily Jai Jai Din 01.01.15
২০১৪ সালে দুটি বড় দেশ ভারত ও ইন্দোনেশিয়ায় 'গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা' অব্যাহত থাকলেও ইউক্রেন পরিস্থিতি সেখানে যে সঙ্কটের জন্ম দিয়েছিল তা ডিসেম্বরের শেষদিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ভারতে মোদির বিজয় ও ইন্দোনেশিয়ায় জোকো উইদোদোর প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্তি প্রমাণ করে বড় গণতান্ত্রিক সমাজে এক ধরনের 'পপুলিজমে'র জন্ম হয়েছে। অর্থাৎ সাধারণ একজন মানুষ শুধুমাত্র তার নিষ্ঠা, সততা আর 'কমিটমেন্টে'র কারণে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেন, মোদি ও উইদোদো এর বড় প্রমাণ। মোদি একসময় রেল স্টেশনে চা বিক্রি করতেন। আর অত্যন্ত জনপ্রিয় উইদোদো ছিলেন বস্তির ছেলে। শুধুমাত্র জনপ্রিয় নীতি আর সততার কারণে তারা আজ বিশ্ব নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। ভারতে কংগ্রেসের ব্যর্থতাই মোদিকে ক্ষমতায় বসিয়েছে এবং তিনি সেখানে এক ধরনের 'পপুলিজমে'র জন্ম দিয়েছেন। তবে উইদোদোর বিজয় অত সহজ ছিল না। সেনানিয়ন্ত্রিত ইন্দোনেশিয়ায় তিনি নিজেকে একজন 'যোগ্য নেতা' হিসেবে প্রমাণ করেছেন। তবে গণতন্ত্রের জন্যও 'অশনি সংকেত' ছিল থাইল্যান্ডে, হংকং এবং পাকিস্তানে। মে মাসে সেনাবাহিনী থাইল্যান্ডে ক্ষমতা দখল করে ও সেনাপ্রধান নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা দেন। থাই রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতাই সেখানে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারছে না। আর সেনাবাহিনী ওই সুযোগটাই গ্রহণ করেছে। পাকিস্তানে ইমরান খানের নেতৃত্বে ইসলামাবাদে একটি 'অক্যুপাই মুভমেন্টে'র জন্ম হলেও সরকারের পতন হয়নি। পাকিস্তানে গণতন্ত্রের জন্য সেটা ছিল খারাপ সংবাদ। একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে সেখানে সাধারণ নির্বাচন সম্পন্ন হয় এবং নওয়াজ শরীফের মুসলিম লীগ পুনরায় ক্ষমতা ফিরে পায়। পেশোয়ারে শিশু হত্যাকা-ের ঘটনায় নওয়াজ শরীফ ও ইমরান খানকে কাছাকাছি আনলেও তা কতদিন স্থায়ী হয় সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। ডিসেম্বরে জাপানে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আবেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে গেছেন। ২০১৪ সালে ইউক্রেন সঙ্কট এ অঞ্চলে একটি বড় ধরনের 'যুদ্ধে'র সম্ভাবনার জন্ম হলেও শেষ পর্যন্ত 'যুদ্ধ' হয়নি সত্য, কিন্তু ওই সঙ্কট ২০১৫ সালের বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। সঙ্কটের জন্ম ক্রিমিয়ায় মার্চে অনুষ্ঠিত একটি গণভোটের মধ্যদিয়ে। ভূ-রাজনৈতিকভাবে ক্রিমিয়ার অবস্থান রাশিয়ার কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিকভাবেই রুশ নাগরিকরা ক্রিমিয়ায় বসবাস করেন। গণভোটে তারা রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্তির পক্ষে রায় দেন। এর প্রভাব পড়ে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত দোনেৎসেক ও লুসাক অঞ্চলে। সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের জন্ম হয় এবং রাশিয়ার মদদে তা ব্যাপকতা পায়। ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই সঙ্কটের কোনো সমাধান হয়নি। বরং যুক্তরাষ্ট্র বারবার চেয়ে এসেছে ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিক। তাতে করে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে ন্যাটো তথা যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে রাশিয়া মনে করে তার সীমান্তে ন্যাটোর সেনাবাহিনীর উপস্থিতি তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। ফলে এই সঙ্কট থেকে গিয়েছে এবং ধারণা করছি ২০১৫ সালেও এই সঙ্কট থাকবে। ২০১৪ আরো একটি ভালো খবরের জন্ম হয়েছে। জলবায়ু বিষয়ক কপ-২০ সম্মেলন (লিমা, পেরু) একটি আংশিক সমঝোতা হয়েছে। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত হয়েছে বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে বিশ্বের প্রতিটি দেশ স্বউদ্যোগে কর্মসূচি গ্রহণ করবে এবং ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্যারিসে কপ-২১ চুক্তি স্বাক্ষর করবে। লিমায় বাহ্যত কোনো চুক্তি হয়নি। হয়েছে একটি সমঝোতা। চূড়ান্ত বিচারে মার্কিন কংগ্রেস এই আংশিক সমঝোতাটি মেনে নেবে কিনা এটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। ফলে প্যারিস কপ-২১ সম্মেলন নিয়ে প্রশ্ন থাকবে অনেক। ইবোলায় ১৮ হাজার মানুষের মৃত্যু নিয়ে চলতি বছর কম কথা হয়নি। পশ্চিম আফ্রিকার তিনটি দেশে ওই রোগের বিস্তার এবং খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজনের মৃত্যু সারাবিশ্বে আলোচিত হয়। তবে বছরের শেষদিন পর্যন্ত কোনো প্রতিরোধক আবিষ্কারের খবর আমাদের জানা নেই। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি বিমান (ফ্লাইট-৩৭০) উধাও হয়ে যাওয়া এবং এর কোনো হদিস না পাওয়ার ঘটনাও কম আলোচিত হয়নি। স্কটল্যান্ডে গণভোট অনুষ্ঠিত হয় জানুয়ারিতে। গণভোটে স্বাধীন হওয়ার পক্ষে রায় পড়েনি। স্কটিশরা যুক্তরাজ্যের সঙ্গে থাকতেই রায় দিয়েছে। এটা ইউরোপের রাজনীতির জন্য ছিল উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা। ইরান নিয়ে আলোচনা ছিল কম। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে 'গোপন সমঝোতা' ও সিরিয়ায় আইএসের উত্থান ঠেকাতে ইরানকে ব্যবহার করার বিষয়টিও গণমাধ্যমে আলোচিত হয়েছে। ইসরাইল দীর্ঘ ৭ সপ্তাহ ধরে গাজায় বোমাবর্ষণ করা এবং নারী ও শিশুদের হত্যা করার ঘটনায় বিশ্ব বিবেক জাগ্রত হলেও যুক্তরাষ্ট্র বা জাতিসংঘ ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা ২০১৪ সালে অন্তত একটি ঘটনায় উৎসাহিত হয়েছেন। আর তা হচ্ছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা কর্তৃক কিউবার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ। এই উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো দিক। কিন্তু এই উদ্যোগটি নানা জটিলতায় জড়িয়ে যেতে পারে। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের কনজারভেটিভরা ঠিক এ মুহূর্তেই কিউবার সঙ্গে 'ভালো' সম্পর্কে যেতে চান না। তাদের যুক্তি কিউবা এখনো তার অর্থনীতি ও রাজনীতি উন্মুক্ত করে দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের আইন পরিষদ (সিনেট ও হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ) এখন নিয়ন্ত্রণ করে কনজারভেটিভ রিপাবলিকানরা। তারা কখনই চাইবে না দীর্ঘ ৫৪ বছর আগে কিউবার বিরুদ্ধে যে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল তা তুলে নেয়া হোক। ইতোমধ্যে কিউবার একটি মিত্র দেশ ভেনিজুয়েলার বিরুদ্ধে 'বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা' আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। হুগো শ্যাভেজ পরবর্তী ভেনিজুয়েলার মাদুরো সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের উন্নতির একটা সম্ভাবনা জাগলেও ওই ঘটনা প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্র চায় সেখানে এমন একটি সরকার যেখানে হুগো শ্যাভেজের কোনো প্রভাব থাকবে না। বলা ভালো, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অবর্তমানে ভেনিজুয়েলাই এখন কিউবার অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখছে। প্রতিদিন ১ লাখ ব্যারেল তেল ভেনিজুয়েলা সরবরাহ করে কিউবাকে, যা কিউবার অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করছে। কিউবা এই ঋণ পরিশোধ করে ডাক্তার, নার্স, আর শিক্ষক দিয়ে। তবে ভেনিজুয়েলার অর্থনীতি আর আগের মতো নেই। ফলে কিউবায় তেল সরবরাহ যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে কিউবা বড় বিপদে পড়বে। দক্ষিণ আমেরিকায় বেশ কটি বামপন্থী সরকার রয়েছে। এদের ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্র কঠোর মনোভাব নিচ্ছে। চীন অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে ওঠার কারণে চীনের নেতৃত্বে 'আরেকটি বিশ্ব ব্যাংক' তৈরি হচ্ছে। ব্রিকসের নেতৃবৃন্দ ২০১৪ সালে এক সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা একটি 'ব্রিকস ব্যাংক' তৈরি করবে। এটা হবে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প। চীন ইতোমধ্যেই আইএমএফের আদলে একটি 'ইনফাস্ট্রাকচার' ব্যাংক গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। এই ব্যাংক ২০১৮ সাল থেকে কাজ শুরু করবে। বাংলাদেশ দুটো ব্যাংকেই যোগ দিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে দেখতে হবে এই ব্যাংক দুটো কিভাবে কাজ করে, তাদের ঋণের ধরন কী হয়, সুদের হার কী ইত্যাদি। তবে নিঃসন্দেহে উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য এটা একটি সুখবর। ২০১৪ সালে সারা বিশ্বব্যাপী উত্তেজনা ছিল। যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি বৃত্ত সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধ হয়নি, এটা একটি ভালো খবর। জঙ্গিবাদের উত্থান ও ইউক্রেনের পরিস্থিতি ২০১৫ সালকে প্রভাবিত করবে। সুতরাং ২০১৫ সালটি যে খুব ভালো যাবে, এটা মনে করারও কোনো কারণ নেই। Daily Jai Jai Din 01.01.15