রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

জঙ্গিবাদ আর পরাশক্তির দ্বন্দ্বের বছর

আরো একটি বছর আমরা পার করে এলাম। ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ঘটনাবলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মুসলিম বিশ্বে জঙ্গিবাদের উত্থান, দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং সেই সঙ্গে দীর্ঘ ৫৪ বছর পর কিউবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ। জঙ্গিবাদের ভয়াবহ রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি পাকিস্তানের সেনানিয়ন্ত্রিত এলাকা পেশোয়ারে একটি স্কুলে ইসলামি জঙ্গিদের হামলায় ১৩২টি শিশুর অকাল মৃত্যু। ঠা-া মাথায় এদের হত্যাকা- প্রমাণ করে জঙ্গিবাদ আজ পাকিস্তানের অস্তিত্বকে রীতিমতো একটি প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এক সময় যে এলাকায় বাম রাজনীতির প্রভাব ছিল, 'সীমান্ত গান্ধী' হিসেবে পরিচিত গাফফার খান যে অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জন্য জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কাজ করে গেছেন এবং অহিংস পদ্ধতিতে তার 'লড়াই' অব্যাহত রেখেছিলেন, সেই অঞ্চল আজ ধর্মীয় উগ্রবাদে আক্রান্ত। সেখানকার মানুষের মানসিকতা বদলে গেছে। ধর্মীয় কুপম-ুকতা এই একুশ শতকে এসেও সমাজ বিনির্মাণে প্রভাব খাটাচ্ছে। পাকিস্তানে ধর্মীয় উগ্রবাদের শেকড় যে কত গভীরে এটা আবারো প্রমাণিত হলো। তবে সেই সঙ্গে এটাও স্বীকার করতে হবে ২০১৪ সালে বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র এক ধরনের উগ্রবাদ। ওই উগ্রবাদ আজ সিরিয়া-ইরাকের অস্তিত্ব যেমন বিপন্ন করে তুলেছে, টিক তেমনি তা সম্প্রসারিত হয়েছে আফ্রিকাতে, বিশেষ করে সুদান ও নাইজেরিয়ায়। উগ্রবাদীগোষ্ঠী আল-শামা (সুদান) ও বোকো হারাম (নাইজেরিয়া) এর অনেক সহিংস কর্মকা- ২০১৪ সালে বারবার আলোচিত হয়েছে। ধর্মান্ধ একটি গোষ্ঠী বোকো হারাম যেভাবে শত শত কিশোরীদের ধরে নিয়ে গিয়ে তাদেরকে ধর্মান্তরিত করছে (খৃস্টান থেকে মুসলমান) এবং এক ধরনের 'যৌন দাসত্ব' গ্রহণ করতে বাধ্য করছে তা বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়ে গেছে। কিশোরীদের উদ্ধারে নাইজেরিয়ার সেনাবাহিনীকেও প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। বোকো হারামের কর্মকা-ের সঙ্গে সিরিয়ায় জুন মাসে (২০১৪) উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী 'ইসলামিক স্টেট অ্যান্ড লেভেন্টে'র উত্থানের এক অদ্ভুত মিল লক্ষ্য করা যায়। আরো অবাক করার বিষয় হচ্ছে, অন্তত ৬০টি মুসলিম বিশ্বের তথাকথিত 'জিহাদি'রা আজ সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধাদের সঙ্গে তথাকথিত একটি 'খিলাফত' প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে। এক চরম উগ্রবাদ এখন এ অঞ্চলের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ইসলামিক স্টেটের (আইএস) আবির্ভাব ও জনৈক আবু বকর বুগদাদির নিজেকে ইসলামি বিশ্বের 'খলিফা' হিসেবে ঘোষণা করা কিংবা কুর্দি অঞ্চলে ইয়াজদি সম্প্রদায়ের মহিলা তথা কিশোরীদের ধরে নিয়ে গিয়ে তাদের 'যৌন দাসত্বে' পরিণত করার কাহিনী একাধিকবার সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলেও বিশ্ব সম্প্রদায় এক্ষেত্রে ছিল অনেকটা নির্লিপ্ত। আইএসের উত্থান তথা অগ্রযাত্রা রোধ করা সম্ভব হয়নি। ইরাক ও সিরিয়ার মধ্যস্থল নিয়ে অলিখিত এক 'সুনি্নস্থানে'র জন্ম হয়েছে। সুনি্ন নিয়ন্ত্রিত এই বিশাল এলাকায় তথাকথিত 'ইসলামিক স্টেটে'র জঙ্গিদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কটি আরব রাষ্ট্র এই 'ইসলামিক স্টেটে'র জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা শুরু করলেও এদের অগ্রযাত্রা রোধ করা সম্ভব হয়নি। তাই ২০১৫ সালের বিশ্ব রাজনীতিতে এই ইসলামিক জঙ্গিরা বারবার আলোচনায় আসবে।
২০১৪ সালে দুটি বড় দেশ ভারত ও ইন্দোনেশিয়ায় 'গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা' অব্যাহত থাকলেও ইউক্রেন পরিস্থিতি সেখানে যে সঙ্কটের জন্ম দিয়েছিল তা ডিসেম্বরের শেষদিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ভারতে মোদির বিজয় ও ইন্দোনেশিয়ায় জোকো উইদোদোর প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্তি প্রমাণ করে বড় গণতান্ত্রিক সমাজে এক ধরনের 'পপুলিজমে'র জন্ম হয়েছে। অর্থাৎ সাধারণ একজন মানুষ শুধুমাত্র তার নিষ্ঠা, সততা আর 'কমিটমেন্টে'র কারণে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেন, মোদি ও উইদোদো এর বড় প্রমাণ। মোদি একসময় রেল স্টেশনে চা বিক্রি করতেন। আর অত্যন্ত জনপ্রিয় উইদোদো ছিলেন বস্তির ছেলে। শুধুমাত্র জনপ্রিয় নীতি আর সততার কারণে তারা আজ বিশ্ব নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। ভারতে কংগ্রেসের ব্যর্থতাই মোদিকে ক্ষমতায় বসিয়েছে এবং তিনি সেখানে এক ধরনের 'পপুলিজমে'র জন্ম দিয়েছেন। তবে উইদোদোর বিজয় অত সহজ ছিল না। সেনানিয়ন্ত্রিত ইন্দোনেশিয়ায় তিনি নিজেকে একজন 'যোগ্য নেতা' হিসেবে প্রমাণ করেছেন। তবে গণতন্ত্রের জন্যও 'অশনি সংকেত' ছিল থাইল্যান্ডে, হংকং এবং পাকিস্তানে। মে মাসে সেনাবাহিনী থাইল্যান্ডে ক্ষমতা দখল করে ও সেনাপ্রধান নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা দেন। থাই রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতাই সেখানে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারছে না। আর সেনাবাহিনী ওই সুযোগটাই গ্রহণ করেছে। পাকিস্তানে ইমরান খানের নেতৃত্বে ইসলামাবাদে একটি 'অক্যুপাই মুভমেন্টে'র জন্ম হলেও সরকারের পতন হয়নি। পাকিস্তানে গণতন্ত্রের জন্য সেটা ছিল খারাপ সংবাদ। একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে সেখানে সাধারণ নির্বাচন সম্পন্ন হয় এবং নওয়াজ শরীফের মুসলিম লীগ পুনরায় ক্ষমতা ফিরে পায়। পেশোয়ারে শিশু হত্যাকা-ের ঘটনায় নওয়াজ শরীফ ও ইমরান খানকে কাছাকাছি আনলেও তা কতদিন স্থায়ী হয় সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। ডিসেম্বরে জাপানে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আবেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে গেছেন। ২০১৪ সালে ইউক্রেন সঙ্কট এ অঞ্চলে একটি বড় ধরনের 'যুদ্ধে'র সম্ভাবনার জন্ম হলেও শেষ পর্যন্ত 'যুদ্ধ' হয়নি সত্য, কিন্তু ওই সঙ্কট ২০১৫ সালের বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। সঙ্কটের জন্ম ক্রিমিয়ায় মার্চে অনুষ্ঠিত একটি গণভোটের মধ্যদিয়ে। ভূ-রাজনৈতিকভাবে ক্রিমিয়ার অবস্থান রাশিয়ার কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিকভাবেই রুশ নাগরিকরা ক্রিমিয়ায় বসবাস করেন। গণভোটে তারা রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্তির পক্ষে রায় দেন। এর প্রভাব পড়ে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত দোনেৎসেক ও লুসাক অঞ্চলে। সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের জন্ম হয় এবং রাশিয়ার মদদে তা ব্যাপকতা পায়। ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই সঙ্কটের কোনো সমাধান হয়নি। বরং যুক্তরাষ্ট্র বারবার চেয়ে এসেছে ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিক। তাতে করে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে ন্যাটো তথা যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে রাশিয়া মনে করে তার সীমান্তে ন্যাটোর সেনাবাহিনীর উপস্থিতি তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। ফলে এই সঙ্কট থেকে গিয়েছে এবং ধারণা করছি ২০১৫ সালেও এই সঙ্কট থাকবে। ২০১৪ আরো একটি ভালো খবরের জন্ম হয়েছে। জলবায়ু বিষয়ক কপ-২০ সম্মেলন (লিমা, পেরু) একটি আংশিক সমঝোতা হয়েছে। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত হয়েছে বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে বিশ্বের প্রতিটি দেশ স্বউদ্যোগে কর্মসূচি গ্রহণ করবে এবং ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্যারিসে কপ-২১ চুক্তি স্বাক্ষর করবে। লিমায় বাহ্যত কোনো চুক্তি হয়নি। হয়েছে একটি সমঝোতা। চূড়ান্ত বিচারে মার্কিন কংগ্রেস এই আংশিক সমঝোতাটি মেনে নেবে কিনা এটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। ফলে প্যারিস কপ-২১ সম্মেলন নিয়ে প্রশ্ন থাকবে অনেক। ইবোলায় ১৮ হাজার মানুষের মৃত্যু নিয়ে চলতি বছর কম কথা হয়নি। পশ্চিম আফ্রিকার তিনটি দেশে ওই রোগের বিস্তার এবং খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজনের মৃত্যু সারাবিশ্বে আলোচিত হয়। তবে বছরের শেষদিন পর্যন্ত কোনো প্রতিরোধক আবিষ্কারের খবর আমাদের জানা নেই। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি বিমান (ফ্লাইট-৩৭০) উধাও হয়ে যাওয়া এবং এর কোনো হদিস না পাওয়ার ঘটনাও কম আলোচিত হয়নি। স্কটল্যান্ডে গণভোট অনুষ্ঠিত হয় জানুয়ারিতে। গণভোটে স্বাধীন হওয়ার পক্ষে রায় পড়েনি। স্কটিশরা যুক্তরাজ্যের সঙ্গে থাকতেই রায় দিয়েছে। এটা ইউরোপের রাজনীতির জন্য ছিল উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা। ইরান নিয়ে আলোচনা ছিল কম। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে 'গোপন সমঝোতা' ও সিরিয়ায় আইএসের উত্থান ঠেকাতে ইরানকে ব্যবহার করার বিষয়টিও গণমাধ্যমে আলোচিত হয়েছে। ইসরাইল দীর্ঘ ৭ সপ্তাহ ধরে গাজায় বোমাবর্ষণ করা এবং নারী ও শিশুদের হত্যা করার ঘটনায় বিশ্ব বিবেক জাগ্রত হলেও যুক্তরাষ্ট্র বা জাতিসংঘ ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা ২০১৪ সালে অন্তত একটি ঘটনায় উৎসাহিত হয়েছেন। আর তা হচ্ছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা কর্তৃক কিউবার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ। এই উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো দিক। কিন্তু এই উদ্যোগটি নানা জটিলতায় জড়িয়ে যেতে পারে। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের কনজারভেটিভরা ঠিক এ মুহূর্তেই কিউবার সঙ্গে 'ভালো' সম্পর্কে যেতে চান না। তাদের যুক্তি কিউবা এখনো তার অর্থনীতি ও রাজনীতি উন্মুক্ত করে দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের আইন পরিষদ (সিনেট ও হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ) এখন নিয়ন্ত্রণ করে কনজারভেটিভ রিপাবলিকানরা। তারা কখনই চাইবে না দীর্ঘ ৫৪ বছর আগে কিউবার বিরুদ্ধে যে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল তা তুলে নেয়া হোক। ইতোমধ্যে কিউবার একটি মিত্র দেশ ভেনিজুয়েলার বিরুদ্ধে 'বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা' আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। হুগো শ্যাভেজ পরবর্তী ভেনিজুয়েলার মাদুরো সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের উন্নতির একটা সম্ভাবনা জাগলেও ওই ঘটনা প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্র চায় সেখানে এমন একটি সরকার যেখানে হুগো শ্যাভেজের কোনো প্রভাব থাকবে না। বলা ভালো, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অবর্তমানে ভেনিজুয়েলাই এখন কিউবার অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখছে। প্রতিদিন ১ লাখ ব্যারেল তেল ভেনিজুয়েলা সরবরাহ করে কিউবাকে, যা কিউবার অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করছে। কিউবা এই ঋণ পরিশোধ করে ডাক্তার, নার্স, আর শিক্ষক দিয়ে। তবে ভেনিজুয়েলার অর্থনীতি আর আগের মতো নেই। ফলে কিউবায় তেল সরবরাহ যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে কিউবা বড় বিপদে পড়বে। দক্ষিণ আমেরিকায় বেশ কটি বামপন্থী সরকার রয়েছে। এদের ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্র কঠোর মনোভাব নিচ্ছে। চীন অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে ওঠার কারণে চীনের নেতৃত্বে 'আরেকটি বিশ্ব ব্যাংক' তৈরি হচ্ছে। ব্রিকসের নেতৃবৃন্দ ২০১৪ সালে এক সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা একটি 'ব্রিকস ব্যাংক' তৈরি করবে। এটা হবে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প। চীন ইতোমধ্যেই আইএমএফের আদলে একটি 'ইনফাস্ট্রাকচার' ব্যাংক গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। এই ব্যাংক ২০১৮ সাল থেকে কাজ শুরু করবে। বাংলাদেশ দুটো ব্যাংকেই যোগ দিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে দেখতে হবে এই ব্যাংক দুটো কিভাবে কাজ করে, তাদের ঋণের ধরন কী হয়, সুদের হার কী ইত্যাদি। তবে নিঃসন্দেহে উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য এটা একটি সুখবর। ২০১৪ সালে সারা বিশ্বব্যাপী উত্তেজনা ছিল। যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি বৃত্ত সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধ হয়নি, এটা একটি ভালো খবর। জঙ্গিবাদের উত্থান ও ইউক্রেনের পরিস্থিতি ২০১৫ সালকে প্রভাবিত করবে। সুতরাং ২০১৫ সালটি যে খুব ভালো যাবে, এটা মনে করারও কোনো কারণ নেই। Daily Jai Jai Din 01.01.15

তালেবান খতম অভিযান কি শেষ সমাধান এনে দেবে

পেশোয়ারে ১৩২ জন স্কুলছাত্রের হত্যাকা-ের বদলা হিসেবে পাকিস্তান তালেবানবিরোধী এক অভিযান শুরু করেছে। উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে দুই দিনের অভিযানে খতম করা হয়েছে প্রায় ১১৯ জন তালেবান জঙ্গিকে। একই সঙ্গে শুরু হয়েছে দোষীদের ফাঁসিতে ঝোলানোর প্রক্রিয়া। কিন্তু এতে করে কি পাকিস্তানে তালেবানি উল্লম্ফনকে ঠেকানো যাবে? পাকিস্তানে এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগেও ২০১১ সালে পাকিস্তানের নেভাল এয়ার ফোর্স মেহরানে হামলা কিংবা ৮ জুন করাচির জিন্নাহ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে হামলা প্রমাণ করে জঙ্গিরা কত শক্তিশালী। পেশোয়ার হত্যাকা-ের পর এর দায়দায়িত্ব গ্রহণ করেছে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান বা টিটিপি নামে একটি জঙ্গি সংগঠন। টিটিপি জানিয়েছে, তারা আরো হামলা চালাবে। সুতরাং পাকিস্তান সরকার ওই হামলাকে যে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে, এটাই বড় প্রশ্ন এখন। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে যে, এ ধরনের একটি হত্যাকা-, বিশেষ করে সেনানিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে, অভ্যন্তরীণভাবে সমর্থন না পেলে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। এর অর্থ পরিষ্কার_ টিটিপির সমর্থন রয়েছে সেনাবাহিনীর ভেতরে। সেনাবাহিনীর একটি মহলের সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া সেনা ছাউনির ভেতরে অবস্থিত স্কুলে জঙ্গি হামলা চালানো সম্ভব নয়। সুতরাং সেনাবাহিনীর এই অংশকে যদি নিষ্ক্রিয় করা না যায়, তাহলে জঙ্গিদের দমন করা যাবে না। এরা বার বার হামলা চালাবে। রাজনীতিতে যারা 'ষড়যন্ত্রতত্ত্ব'-এ বিশ্বাস করেন, তারা এই হামলার সঙ্গে একটি 'ষড়যন্ত্র' খুঁজে পেতে পারেন। আর ষড়যন্ত্রটি হচ্ছে সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা বা আইএসআই সিভিল প্রশাসনের ওপর তাদের কর্তৃত্ব অব্যাহত রাখতে চাইছে। পাকিস্তানে জেনারেল পারভেজ মোশাররফের ক্ষমতা থেকে উৎখাত এবং রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে ক্ষমতা পরিচালনা আইএসআই কখনো ভালো চোখে দেখেনি। আইএসআই অনেক দিন থেকেই সরকারের ভেতরে আরেকটি সরকার হিসেবে কাজ করছে। এখন মোশাররফ-পরবর্তী সময়ে পিপিপির নেতৃত্বে একটি সরকার ও চলতি বছরে নওয়াজ শরিফের পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসার মধ্য দিয়ে আইএসআইর ক্ষমতা কিছুটা হলেও হ্রাস পেয়েছে। ফলে গোয়েন্দা সংস্থার ওপর নির্ভরতা বাড়াতেই আইএসআইর যোগসাজশে এ হত্যাকা- ঘটে থাকতে পারে। এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নওয়াজ শরিফকে এখন জঙ্গি দমনে বেশি মাত্রায় সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করতে হবে। আইএসআই এমনটিই চাচ্ছে, যাতে তারা সিভিল প্রশাসনের ওপর প্রভাব খাটাতে পারে। 'ষড়যন্ত্রতত্ত্ব'-এর বড় প্রমাণ কিছু দিন আগে ইমরান খানের নেতৃত্বে একটি আন্দোলন সরকার পতনে ব্যর্থ হয়েছিল। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, ইমরান খানের সমর্থকরা রাজধানী ইসলামাবাদের একটা অংশ দখল করে নিয়ে অবস্থান ধর্মঘট করলেও, সরকারের পতন ঘটেনি। অনেকেই ধারণা করেছিলেন সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলের দ্বন্দ্বের সুযোগে সেনাবাহিনী আবার ক্ষমতা দখল করতে পারে। ওই ঘটনার রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই পেশোয়ারে নৃশংস হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটল। এ ঘটনা নিঃসন্দেহে নওয়াজ শরিফকে আরো সেনাবাহিনী-মুখাপেক্ষী করবে। সিভিলিয়ান প্রশাসন আরো দুর্বল হবে এখন পাকিস্তানে। পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে জঙ্গিদের বার বার হামলা একটি আশঙ্কাকে উস্কে দিল যে, পাকিস্তান কি আগামী দিনে তার অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকতে পারবে? ঐতিহাসিকভাবেই বৃহত্তর খাইবার অঞ্চলের জনগণ কারোরই কর্তৃত্ব মানেনি। তারা ব্রিটিশদের কর্তৃত্ব মানেনি। পাকিস্তানি কর্তৃত্বও তারা মানে না। পাকিস্তানে এই অঞ্চল বিশেষ একটি অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে এটা দৃশ্যমান যে, এই অঞ্চল অদূর ভবিষ্যতে আফগানিস্তানের একটা অংশের সঙ্গে মিশে গিয়ে নতুন একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিতে পারে। বেলুচিস্তানও আলাদা হয়ে যেতে পারে। করাচিকে কেন্দ্র করে মোহাজিরদের আলাদা রাষ্ট্র গঠনের দাবিও কোনো কোনো মহল থেকে উচ্চারিত হচ্ছে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি যদি শুধু লাহোর আর ইসলামাবাদ ভিত্তিক হয়ে পড়ে, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। পেশোয়ারে শিশু হত্যার এই ঘটনা পাকিস্তানের সব রাজনৈতিক দলকে অন্তত একটি ইস্যুতে এক পতাকাতলে দাঁড়ানোর একটি সুযোগ করে দিয়েছে। পাকিস্তানে ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন তেহরিক-ই-ইনসাফ দলটি বর্তমান পাকিস্তানে প্রধান বিরোধী দল। তারা এ ঘটনায় তাদের সরকারবিরোধী আন্দোলন আপাতত স্থগিত করেছে। এটা একটা ভালো লক্ষণ। তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে যে সরকার রয়েছে, সেই সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছে ইমরান খানের দল। অনেকে অভিযোগ করেন, ইমরান খানের দলের সঙ্গে ইসলামি জঙ্গিদের সম্পর্ক রয়েছে। এর পেছনে সত্যতা যা-ই থাকুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে খাইবার-পাখতুনখোয়ায় জঙ্গিদের সঙ্গে সেখানে তেহরিক-ই-ইনসাফের একধরনের সহাবস্থান হয়েছে। না হলে দলটি ক্ষমতা পরিচালনা করতে পারত না। এ ক্ষেত্রে জঙ্গি দমনে ইমরান খানের ভূমিকাকে ফেলে দেয়া যাবে না। এখন পাকিস্তানে তালেবানি জঙ্গিদের যদি নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তাহলে তা পাকিস্তান ছাড়িয়ে ভারতে এবং বাংলাদেশেও প্রভাব বিস্তার করতে পারে এবং এ দেশ দুটির নিরাপত্তার হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। ভারতে জঙ্গিদের তৎপরতার খবর আমরা জানি। সর্বশেষ পশ্চিম বাংলার বর্ধমানে যে জঙ্গি তৎপরতার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, তা আমাদের উৎকণ্ঠার জন্য যথেষ্ট। বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা তেমন একটা নেই। কিন্তু এরা আছে। পাকিস্তানে এরা যদি 'উৎসাহিত' হয়, তাহলে তা আমাদের এ অঞ্চলের জঙ্গিদের উৎসাহ জোগাবে। পাকিস্তানে জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধি শুধু খোদ পাকিস্তানের নিরাপত্তাকেই ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেবে না, বরং বৈশ্বিক নিরাপত্তাও ঝুঁকির মুখে থাকবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, পাকিস্তান একটি পারমাণবিক রাষ্ট্র। পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনী। এখন এই কর্মসূচি যদি কোনোভাবে জঙ্গিদের হাতে চলে যায়, তাহলে তা স্থানান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বিশেষ করে ইরাক-সিরিয়া জুড়ে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা পারমাণবিক প্রযুক্তির ব্যাপারে উৎসাহিত হবে বেশি। সুতরাং জঙ্গি তৎপরতা রোধ করাটা জরুরি। এ ক্ষেত্রে সার্কের আওতায় একটি যৌথ কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানও জরুরি। মনে রাখতে হবে, জঙ্গিবাদ আজ শুধু পাকিস্তানের একার সমস্যা নয়। জঙ্গিবাদ আজ মানবতার শত্রু। সুতরাং একে দমন করা না গেলে সার্কের উন্নয়ন প্রক্রিয়া থমকে যাবে। এ ক্ষেত্রে দুটো বড় দেশ পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সব ধরনের বৈরিতা কমিয়ে আনা প্রয়োজন। দুটো দেশের গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধেই বড় অভিযোগ রয়েছে যে, তারা একে অন্যের দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় মদদ জোগায়। এ অভিযোগ কমিয়ে আনার জন্যই উভয় দেশের গোয়েন্দা সংস্থার জঙ্গি দমনে একসঙ্গে কাজ করা উচিত। জঙ্গি দমনে পাকিস্তানের 'বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে' (যা ঋঅঞঅ নামে পরিচিত) দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন ড্রোন হামলা পরিচালিত হয়ে আসছে। এতে বেশকিছু জঙ্গি নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষও সেখানে মারা যাচ্ছে। এ হামলা বন্ধ করা উচিত। ড্রোন হামলা চালিয়ে জঙ্গি দমন করা যাবে না। বরং তালেবানদের সঙ্গে যে 'সংলাপ' শুরু হয়েছিল, সেই 'সংলাপ' অব্যাহত রাখতে হবে। পাকিস্তানে ইসলামপন্থী দলগুলোকেও এ প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে একটি সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটি গঠন করে তালেবানদের সঙ্গে 'সংলাপ' শুরু করতে হবে। পাকিস্তান সরকার বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে সেনাপ্রধান ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানকে কাবুলে পাঠিয়েছিল। সেখানে নতুন আফগান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তারা কথা বলেছেন। এটা ভালো দিক। তালেবান দমনে আফগান সরকারের সহযোগিতা দরকার। পাকিস্তান তার জন্মের ৬৭ বছরে একাধিক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে অতীতে। ১৯৪৭-পরবর্তী পাকিস্তান মুখোমুখি হয়েছিল প্রথম সমস্যার_ ভারত যেখানে একটি গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক বিনির্মাণ করেছিল, সেখানে পাকিস্তানের ভূস্বামী আর সেনা জেনারেল ক্ষমতা অাঁকড়ে ধরে রেখে গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে। ১৯৭১-পরবর্তী নতুন এক পাকিস্তানের জন্ম হলেও সেনাবাহিনীর ভূমিকায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। পাকিস্তান দ্বিতীয় সমস্যার মুখোমুখি হয় বাংলাদেশে গণহত্যা ও বাঙালিদের ন্যায্য অধিকারের প্রতি চরম অনাস্থা প্রদর্শনের কারণে। প্রথমবারের মতো নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে সম্ভাবনার জন্ম হয়েছিল তা নষ্ট হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ তাদের রাষ্ট্র কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে। পাকিস্তান তৃতীয় সমস্যার মুখোমুখি হয়, যখন ১৯৭৯ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান দখল করে নেয়। আফগানিস্তানে সোভিয়েত সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সিআইএ পাকিস্তান-আফগান সীমান্তবর্তী অঞ্চলের (যা ঋঅঞঅ নামে পরিচিত) মাদ্রাসাগুলো বেছে নেয়। জন্ম হয় তালেবানি রাজনীতির। এ অঞ্চলের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। ধর্মকে ব্যবহার করা হয় হাতিয়ার হিসেবে। চতুর্থ সমস্যার মুখোমুখি হয় পাকিস্তান, যখন ২০০১ সালে মার্কিন সেনাবাহিনী তথাকথিত 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ'-এর নামে আফগানিস্তান দখল করে নেয়। শুরু হয় এক দীর্ঘ যুদ্ধ। অস্ত্র আর অর্থ আসতে থাকে পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোয়। ইতোমধ্যে সমগ্র সীমান্তবর্তী অঞ্চলের রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। সেখানে জন্ম হয় কট্টর ধর্মীয় গোষ্ঠীর, যারা উদ্যোগী হয় এ অঞ্চলে একটি 'জিহাদি রাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠার। অস্ত্র রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। সনাতন রাজনীতি এখান থেকে বিদায় নেয়। এই জঙ্গি ধর্মীয় রাজনীতির প্রতি মানুষের সমর্থন না থাকলেও, মানুষ অনেকটা 'জিম্মি' হয়ে পড়ে। দুঃখজনক হলেও সত্য, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা এ প্রক্রিয়ায় নিজেদের জড়িত করে। প্রথম দিকে তাদের টার্গেট ছিল আফগানিস্তানে তালেবান বাহিনী তৈরি করা। পরে খোদ পাকিস্তানে জন্ম নেয়া পাকিস্তানি তালেবানদের তারা 'প্রমোট' করতে শুরু করে, যাদের তারা 'ব্যবহার' করতে শুরু করে পাকিস্তানের সনাতন রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। এটাই এখন ফ্রাংকেনস্টাইন দানবে পরিণত হয়েছে। এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে_ এভাবে সেনা অভিযান পরিচালনা করে কি জঙ্গিবাদ উৎখাত করা যাবে? জঙ্গিবাদ এখন পাকিস্তানের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। সবচেয়ে জরুরি যা তা হচ্ছে সেনাবাহিনী তথা আইএসআইর ভেতরে যে জঙ্গিবাদের প্রভাব পড়েছে, তা কমাতে হবে। এজন্য সেনাবাহিনীতে ব্যাপক শুদ্ধি অভিযান চালানো দরকার। উপরন্তু গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ওপর সিভিলিয়ান কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করাও জরুরি। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নূ্যনতম ইস্যুতে 'ঐক্য' প্রয়োজন। আপাতত এ ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বটে। কিন্তু অচিরেই আমরা দেখব দলগুলোর মধ্যে জঙ্গি দমন প্রশ্নে বিভক্তি! বিশেষ করে ইসলামপছন্দ দলগুলো এবং ইমরান খানের দল, এদের কর্মকা-ের এবং পরোক্ষ সহযোগিতার কারণেই সীমান্ত প্রদেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটেছে। এই 'ঐক্যটা' জরুরি। এটা না হলে জঙ্গিবাদ আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। পাকিস্তান যদি জঙ্গিবাদ দমন করতে না পারে, তাহলে আমাদের আগামীতে নতুন করে পাকিস্তানের ইতিহাস লিখতে হবে। Daily Jai Jai Din 29.12.14

চিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর ও প্রসঙ্গ কথা

চিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং আই এখন ঢাকায়। তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ২৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তিনি ঢাকায় এসেছেন। গতকাল বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে তার দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হয়েছে। মূলত চিন-বাংলাদেশ সম্পর্কের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০১৫ সালে চিন বেশ কিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। আর এই পরিকল্পনাগুলো নিয়ে মতবিনিময় করার জন্যই তার ঢাকায় আসা। তবে বলাই বাহুল্য আঞ্চলিক যোগাযোগ, অর্থনৈতিক সাহায্য বৃদ্ধি ইত্যাদি প্রসঙ্গ নিয়েও আলোচনা হবে। এখানে বলা ভালো, ১৯৭৫ সালে চিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে চিন একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। চিন বাংলাদেশের নিকট-প্রতিবেশী। বাংলাদেশ এই সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়। চিনের পররাষ্ট্রনীতি এখন আর আগের মতো মতাদর্শ দ্বারা চালিত হয় না। বরং চিনের পররাষ্ট্রনীতি ব্যবসা ও বিনিয়োগনির্ভর। তাই সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী চিন সফর করেছেন। তার ওই সফরে বেশ কটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এরপরই চিনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে এলেন। প্রধানমন্ত্রীর চিন সফর একটা ব্যাপক প্রত্যাশার সৃষ্টি করলেও ওই সফর নিয়ে প্রশ্ন যে ছিল না, তা বলা যাবে না। কোনো কোনো মহল থেকে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের চিনের প্রতি ‘ঝুঁকে পড়ার’ এই প্রবণতাকে ভালো চোখে দেখেনি ভারতের নীতিনির্ধারকরা। ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক ‘দি হিন্দু’ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল শেখ হাসিনা চিনা প্রধানমন্ত্রী লি চেখিয়াংয়ের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ‘চিনা নেতৃত্বাধীন’ এ শতাব্দীতে বাংলাদেশের সক্রিয় অংশীদার হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে ভারতের নীতিনির্ধারকরা সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন। যদিও সরাসরি কোনো ভারতীয় নেতার মন্তব্য এতে পাওয়া যায়নি। গেল জুন মাসের ২৫ তারিখ ঢাকা সফর করে গেলেন নয়া ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। তার ঢাকা সফরের সময় ভারতীয় নেতা এ বিষয়ে বাংলাদেশের কাছ থেকে আরও ব্যাখ্যা চেয়েছেন কি না, আমরা জানি না। তবে একটা কথা বলা প্রয়োজন। ওই সময় বেশ কটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও বাংলাদেশের জন্য অগ্রাধিকার তালিকায় যে প্রকল্পটি প্রথমে ছিল, সেই সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ব্যাপারে কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। বিভিন্ন ইস্যুতে দুপক্ষের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল। বাংলাদেশ বন্দর পরিচালনার ভার অন্য কোনো বিদেশি কোম্পানির হাতে ছেড়ে দিতে চায় না। চিনা সরকার এটি পেতে চায়। উল্লেখ্য, চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানির পাশাপাশি ইউএই, নেদারল্যান্ডস ও ডেনমার্ক সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু একটি বাছাই কমিটি প্রথমে চায়না হারবারকে যোগ্য বলে অভিমত দিয়েছিল। চায়না হারবারের প্রস্তাব অনুযায়ী তিন ধাপে ১০ বছরের মধ্যে এই নির্মাণ সম্পন্ন হবে। ব্যয় হবে ৩ দশমকি ৫ বিলিয়ন ডলার। তবে প্রথম পর্যায়ে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। ৩ বছরে প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শেষ হবে। বড় জাহাজগুলো এখন এখানে নোঙর করতে পারবে (এখন চট্টগ্রাম বন্দরেব বড় জাহাজ ঢুকতে পারে না। সিঙ্গাপুর থেকে ছোট জাহাজে পণ্য আনতে হয়। এতে সময় নষ্ট হয় প্রচুর)। প্রথম পর্যায়ে বন্দরে ২০ লাখ টিইউইউস (কনটেইনার টার্মিনাল) কনটেইনার ধারণ করতে পারবে। আর সাধারণ কার্গোর (খোলা পণ্য) ধারণ ক্ষমতা হবে ৪৬ লাখ ৫০ হাজার টন। এখানে এখন অনেক কিছু দেখার বিষয় রয়েছে। আমার বিবেচনায় বাছাই কমিটির চায়না হারবারকে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল সঠিক। কেননা চিনারা এ বিষয়ে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছে। এ অঞ্চলে অন্তত তিনটি গভীর সমুদ্রবন্দরের খবর জানা যায়, যা চিনা অর্থে এবং চিনা বিশেষজ্ঞদের দ্বারা নির্মিত হয়েছে ও পরিচালিত হচ্ছে। শ্রীলংকায় দুটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে দিয়েছে চিন। একটি হামবানতোতায়, অপরটি কলম্বোতে। কিছুদিন আগ পর্যন্ত হামবানতোতায় ছিল গভীর জঙ্গল। ছোট্ট একটা শহর, যেখানে কোনো ভালো হোটেল ছিল না। প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষের জন্মস্থান এখানে। চিন এখানে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। ফলে পুরো হামবানতোতার দৃশ্যপট বদলে গেছে। হামবানতোতা আজ একটি আন্তর্জাতিক নগরীর মর্যাদা পেয়েছে। নামকরা ক্রিকেট স্টেডিয়াম রয়েছে এখানে। আগামী ২০১৮ সালে এখানে কমনওয়েলথ গেমস অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কলম্বোতে যে বন্দরটি নির্মিত হয়েছে, তাতে বছরে ৮ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডেলিং করা সম্ভব হবে। গভীর সমুদ্রবন্দরের সুবিধা একটাই এখানে ‘মেগাশিপ’ অর্থাৎ বড় জাহাজগুলো ভিড়তে পারে এবং পণ্য খালাস করতে পারে। বলা হচ্ছে বন্দর পরিচালনা কার হাতে থাকবেÑ এটা নিয়ে একটা জটিলতা তৈরি হয়েছে। যদি সর্বশেষ কলম্বোর সিআইসিটি অর্থাৎ কলম্বো ইন্টারন্যাশনাল কনটেইনার টার্মিনালের ব্যবস্থাপনা দেখি, তাহলে দেখতে পাব শতকরা ৮৫ ভাগ মালিকানা চিনের হাতে। ১৫ ভাগের মালিকানা শ্রীলংকা সরকারের হাতে। যদি পাকিস্তানের গাওদার গভীর সমুদ্রবন্দরের কথা বলি, তাহলে শতকরা একশ ভাগ মালিকানাই চিনাদের হাতে। এক সময় সিঙ্গাপুরের হাতে দায়িত্ব ছিল এর পরিচালনার। এখন চিনাদের হাতে রয়েছে পরিচালনার ভার। যেখানে তাদের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে, তাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে, সেখানে পরিচালনার ভার থাকলে আপত্তি কোথায়? সোনাদিয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিরাপত্তা যদি বিঘিœত না হয়, তাহলে চিনাদের হাতে বন্দর পরিচালনার ভার দেওয়া যেতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা এ ধরনের বন্দর পরিচালনায় যে অভিজ্ঞ জনশক্তি প্রয়োজন, তা আমাদের নেই। বরং চিনাদের সঙ্গে থেকে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারব। ডিজাইন তৈরিতেও অভিজ্ঞ চিনারা। তাই তাদের ওপর আস্থা রাখা যায়। সোনাদিয়ার গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ সংক্রান্ত চুক্তি না হওয়া ছিল নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। তবে যত দ্রুত আমরা একটা সমঝোতায় পৌঁছব, ততই আমাদের জন্য তা মঙ্গল। কেননা দেরি হলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাবে। শুধু তাই নয়, এ অঞ্চলের উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হবে। আমরা আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা, বিসিআইএমের কর্মকা-কে স্বাগত জানিয়েছি। বাংলাদেশ, চিন (ইউনান প্রদেশ), ভারত (উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য) ও মিয়ানমারের সমন্বয়ে যে অর্থনৈতিক করিডোর গড়ে উঠছে, তার উন্নয়ন ও বিকাশের স্বার্থেই এই সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরের গুরুত্ব অনেক বেশি। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো এই বন্দর দিয়েই তাদের পণ্য আমদানি-রপ্তানি করতে পারবে। সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরের গুরুত্ব থাকলেও তাহলে চুক্তিটি হলো না কেন? একটা ধারণা দেওয়া হয়েছে যে, চিনা ঋণের ধরন নিয়ে চূড়ান্ত সমঝোতা হয়নি। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ সহজ শর্তে ঋণ চেয়েছিল। এতদিন একটা ধারণা ছিল যে, এ প্রকল্পে চিন নমনীয় ঋণ দেয়। এই ঋণের সুদের হার কম, মাত্র ২ শতাংশ। কিন্তু পরে জানা গেল চিন এই ঋণকে বাণিজ্যিক ঋণে পরিণত করতে চায়। যেখানে সুদের হার ৩ দশমিক ৫ থেকে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। এখানে একটি বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। প্রথমত, বাংলাদেশ অতীতে বিভিন্ন চিনা প্রকল্পে যে ঋণ নিয়েছে, তার ধরন কী? তা কী বাণিজ্যিক ঋণ? দ্বিতীয়ত, এই প্রকল্প নিয়ে চিনের সঙ্গে দীর্ঘদিন আলোচনা চলে আসছিল। ওই আলোচনায় কী বাণিজ্যিক ঋণের প্রশ্নটি এসেছিল? তৃতীয়ত, কোনো সমঝোতা ছাড়াই, কেন বলা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর চিন সফরে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হবে। চতুর্থত, বাংলাদেশের আলোচনাকারীরা কী চিনা অর্থে নির্মিত ও পরিচালিত গাওদার, হামবানতোতা ও কলম্বো গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ এবং পরিচালনায় কী ধরনের চুক্তি হয়েছিল, তা পর্যালোচনা করেছিলেন? এমন কথাও বলা হয়েছিল যে, বাংলাদেশ মূলত গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চিনা অর্থায়নের বিষয়টি ভারত কীভাবে দেখছে, এটা বিবেচনায় নিতে চায়। এ জন্য বাংলাদেশ কিছুটা সময়ক্ষেপণ করছে। এটা যদি সত্য হয়, তাহলে সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরের পর এই ‘জটিলতা’ কেটে যাওয়ার কথা। গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মিত হলে তাতে ভারতেরও লাভ। কেননা ভারতের ‘সাতবোন’ রাজ্যগুলো এই বন্দরটি ব্যবহার করতে পারবে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের এ ব্যাপারে একটি সমঝোতা ইতোমধ্যেই হয়েছে। তবে ভারতের একটা উৎকণ্ঠা আছে। চিন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে তার ‘মুক্তার মালা’ বা ‘ঝঃৎরহম ড়ভ ঢ়বধৎষং’-এর যে নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে, তাকে ভারত খুব স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। এই মুক্তার মালা নীতির মাধ্যমে চিন ভারত মহাসাগরে তার নৌবাহিনীর উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে। চিন এ কাজটি করেছে শুধু তার জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার স্বার্থে। এটা এখন অনেকেই জানেন চীনে যে ব্যাপক শিল্প বিপ্লব ঘটেছে, তার জন্য তাকে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি আমদানি করতে হয়। আর জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার স্বার্থেই চিন ভারত মহাসাগর এলাকায় তার নৌবাহিনীর উপস্থিতি বাড়িয়েছে। গাওদার কিংবা হামবানতোতায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চিনাদের আগ্রহের পেছনে কাজ করছে এই ‘জ্বালানি ক্ষুধা’র চাহিদা। গাওদারের মাধ্যমে চিন প্যারিসীয় অঞ্চলের তেল তার পশ্চিমাঞ্চলের প্রদেশগুলোতে নিয়ে যেতে চায়। চিন দুবাই-গাওদার উরমকি দীর্ঘ পাইপলাইন নির্মাণ করছে। আর এ জন্য পাকিস্তানের কারাকোবারা পর্বতাঞ্চলের মধ্য দিয়ে চিন তেলের পাইপলাইন নির্মাণ করছে। উরমকি পর্যন্ত এই পাইপলাইনের দূরত্ব হবে মাত্র ৩৬০০ কিমি.। আগে চিনকে ১০ হাজার কিমি. দূরত্ব অতিক্রম করে (দুবাই-সাংহাই-উরমকি) পশ্চিমাঞ্চলে তেল নিতে হতো। এখন তারা সময় বাঁচাবে গাওদার বন্দর ব্যবহার করে। চিন তার জ্বালানি চাহিদা মেটাতে মধ্য এশিয়ার বিশাল গ্যাস রিজার্ভের দিকেও নজর দিয়েছে। জ্বালানিসম্পদসমৃদ্ধ মধ্য এশিয়ার কাসগার থেকে চিনের পশ্চিমাঞ্চলের শিল্পসমৃদ্ধ প্রদেশগুলোতে গ্যাস নিতে সময় ও অর্থের সাশ্রয় হবে (কাসগার থেকে গাওদারের দূরত্ব মাত্র ১৫০০ কিমি.। অথচ চিনের পূর্বাঞ্চলের শিল্পসমৃদ্ধ অঞ্চলে কাসগার থেকে দূরত্ব ৩৫০০ কিমি.)। চিনের সুদূরপ্রসারী আরেকটি পরিকল্পনা আছে মধ্য এশিয়ার এই গ্যাস ও তেল সোনাদিয়ার মাধ্যমে ইউনান প্রদেশে নিয়ে যাওয়ার। মিয়ানমারের গভীর সমুদ্র থেকে চিন গ্যাস উত্তোলন করছে। এই গ্যাস যাচ্ছে পাইপলাইনের মাধ্যমে কুনমিংয়ে। চিনের পরিকল্পনা হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে মিয়ানমার-কুনমিং পাইপলাইনকে সোনাদিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা, যাতে করে মধ্য এশিয়ার তেল/গ্যাসও আগামীতে এই লাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা যায়। তাই বোঝাই যাচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে চিনের আগ্রহ রয়েছে। এখন এই আগ্রহকে আমাদের স্বার্থে আমরা কতটুকু ব্যবহার করতে পারব, প্রশ্ন সেখানেই। আগামী বছরই চিনের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসবে। ধারণা করছি এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান আমরা নিশ্চিত করতে পারব। চিনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চলতি ঢাকা সফরে এই প্রসঙ্গটি আলোচনা নাও হতে পারে। তবে এটি যে তাদের অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। বিক্রমপুরের বৌদ্ধ মনীষী অতীশ দীপঙ্কর বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য অষ্টম শতকে তিব্বতে গিয়েছিলেন। একজন চিনা নাবিক, এডমিরাল ঝেং হে ১৪২১ থেকে ১৪৩১ সাল পর্যন্ত দুবার অধুনালুপ্ত বাংলার রাজধানী সোনারগাঁও ভ্রমণ করেন এবং ইউনান প্রদেশের সঙ্গে এই বাংলার সম্পর্ক স্থাপন করেন। আজ বিসিআইএম যদি প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে নতুন করে আবার চিনের ইউনান প্রদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্থাপিত হবে। তাই চিনের সঙ্গে সম্পর্ককে বাংলাদেশ গুরুত্ব দেয়। চিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সফর এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। Daily Amader Somoy 29.12.14

২০১৪ : বিশ্বরাজনীতির চালচিত্র



চলতি বছর একাধিক ঘটনা বিশ্বরাজনীতিতে আলোড়ন তুলেছে। বছরের শেষ দিকে এসে কিউবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ কিংবা পেশোয়ারে স্কুলে হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি তালেবান জঙ্গিদের ১৩৮টি শিশু হত্যার ঘটনা বেশি আলোচিত হয়েছে, অন্য বিষয়গুলো এই দুটি ঘটনার নিচে চাপা পড়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট ওবামার কিউবার সঙ্গে আবার কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ঘোষণা বিভিন্ন মহল থেকে অভিনন্দিত হয়েছে। এই ঘোষণা অনেকটা হঠাৎ করেই এলো। তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্রদের কাছে এই ঘোষণার একটি তাৎপর্য রয়েছে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, ১৯৬০-৬১ সালের পর থেকেই পার্শ্ববর্তী এই দেশটির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এক ধরনের বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আসছে। একসময় কিউবায় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মিসাইল স্থাপনের সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে তৎকালীন দুই পরাশক্তি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধের একটি আশঙ্কার জন্ম দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্রদের কাছে ওই ঘটনা আজও আলোচিত হয়। দীর্ঘ ৫৪ বছরের অবরোধের কারণে কিউবার অর্থনীতি পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ১ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলার। পোপ ফ্রান্সিস দুই দেশের মধ্যে আবারও সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগটি নেন। তবে এই সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হবে, যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস এই ঘোষণাকে কিভাবে দেখবে কিংবা মার্কিন অর্থনীতিতে এর কোনো প্রভাব পড়বে কি না, এসব প্রশ্ন খুব সংগত কারণেই আলোচিত হতে থাকবে আগামী বছর। কেননা ওবামার নিয়ন্ত্রণে নেই কংগ্রেস। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা হেরে গেছেন। এর মাধ্যমে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ওবামা কংগ্রেসের সমর্থন পাবেন না। সুতরাং বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘোষণা নিয়ে কংগ্রেস সদস্যরা যে আগামী দিনে প্রশ্ন তুলবেন, তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ডেমোক্র্যাটদের অবস্থান খুব ভালো নয়। এই ইস্যু একটি নির্বাচনী এজেন্ডা হতে পারে ২০১৫ সালে। এখন দেখতে হবে ফিদেল কাস্ত্রো-পরবর্তী (১৯৫৯ সালের বিপ্লবের নায়ক, ২০০৮ সালে স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়া) যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব কিউবায় রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিচালনা করছে, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে তাদের আচরণগত কোনো পরিবর্তন আসে কি না।

ইসলামী জঙ্গিরা যে মানবতা ও স্থিতিশীলতার প্রতি কত বড় হুমকি, পেশোয়ারে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত স্কুলে পাকিস্তানি তালেবানের হামলা ও ১৩৮টি শিশুকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে তা প্রমাণিত হলো। নিরপরাধ এই শিশুদের ঠাণ্ডা মাথায় হত্যাকাণ্ড শুধু যে পাকিস্তানে একটি সিভিলিয়ান প্রশাসনের অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে তা নয়, বরং পাকিস্তানের অস্তিত্বই আজ প্রশ্নের মুখে। পাকিস্তানের সমাজব্যবস্থা যে আজ এক ধর্মীয় অপরাজনীতি দ্বারা চালিত হচ্ছে, এই হত্যাকাণ্ড এর বড় প্রমাণ। ধর্মীয় উগ্রবাদ সেখানে ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। ভাবতে অবাক লাগে, একসময় যে এলাকায় বাম রাজনীতির প্রভাব ছিল, 'সীমান্ত গান্ধী' হিসেবে পরিচিত গাফফার খান যে অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জন্য জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে গেছেন ও অহিংস পদ্ধতিতে তাঁর 'লড়াই' অব্যাহত রেখেছিলেন, সেই অঞ্চল আজ ধর্মীয় উগ্রবাদে আক্রান্ত। সেখানকার মানুষের মানসিকতা বদলে গেছে। ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতা এই একুশ শতকে এসেও সমাজ বিনির্মাণে প্রভাব খাটাচ্ছে। পাকিস্তানে ধর্মীয় উগ্রবাদের শিকড় যে কত গভীরে, এটা আবারও প্রমাণিত হলো। তবে সেই সঙ্গে এটাও স্বীকার করতে হবে ২০১৪ সালে বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে মুসলিম বিশ্বে এক ধরনের উগ্রবাদ। এই উগ্রবাদ আজ সিরিয়া-ইরাকের অস্তিত্ব যেমন বিপন্ন করে তুলেছে, ঠিক তেমনি তা সম্প্রসারিত হয়েছে আফ্রিকায়, বিশেষ করে সুদান ও নাইজেরিয়ায়। উগ্রবাদী গোষ্ঠী আল শাবা (সুদান) ও বোকো হারামের (নাইজেরিয়া) অনেক সহিংস কর্মকাণ্ড ২০১৪ সালে বারবার আলোচিত হয়েছে। ধর্মান্ধ একটি গোষ্ঠী বোকো হারাম যেভাবে শত শত বিরোধীকে ধরে নিয়ে গিয়ে তাদের ধর্মান্তর করছে (খ্রিস্টান থেকে মুসলমান) ও এক ধরনের 'যৌনদাসিত্ব' গ্রহণ করতে বাধ্য করছে, তা বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়ে গেছে। কিশোরীদের উদ্ধারে নাইজেরিয়ার সেনাবাহিনীকেও প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। বোকো হারামের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সিরিয়ায় জুন মাসে (২০১৪) উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী 'ইসলামিক স্টেট অ্যান্ড লেভেন্ট'-এর উত্থান এর এক অদ্ভুত মিল লক্ষ করা যায়। আরো অবাক করার বিষয় হচ্ছে, অন্তত ৬০টি দেশের মুসলমান নাগরিক বা তথাকথিত 'জিহাদি'রা আজ সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধাদের সঙ্গে তথাকথিত একটি 'খিলাফত' প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে! এক চরম উগ্রবাদ এখন এ অঞ্চলের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। 'ইসলামিক স্টেট'-এর (আইএস) আবির্ভাব ও জনৈক আবু বকর বুগদাদির নিজেকে ইসলামী বিশ্বের 'খলিফা' হিসেবে ঘোষণা করা কিংবা কুর্দি অঞ্চলে ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মহিলা তথা কিশোরীদের ধরে নিয়ে গিয়ে তাদের 'যৌনদাসী'তে পরিণত করার কাহিনী একাধিকবার সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলেও বিশ্ব সম্প্রদায় এ ক্ষেত্রে ছিল অনেকটা নির্লিপ্ত। আইএসের উত্থান তথা অগ্রযাত্রা রোধ করা সম্ভব হয়নি। ইরাক ও সিরিয়ার কিছু অঞ্চল নিয়ে অলিখিত এক 'সুন্নিস্থান'-এর জন্ম হয়েছে। সুন্নি নিয়ন্ত্রিত এই বিশাল এলাকায় তথাকথিত 'ইসলামিক স্টেট'-এর জঙ্গিদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি আরব রাষ্ট্র এই 'ইসলামিক স্টেট'-এর জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা শুরু করলেও তাদের অগ্রযাত্রা রোধ করা সম্ভব হয়নি। তাই ২০১৫ সালের বিশ্বরাজনীতিতে এই ইসলামী জঙ্গিরা বারবার আলোচনায় আসবে।

২০১৪ : বিশ্বরাজনীতির চালচিত্র

২০১৪ সালে দুটি বড় দেশ ভারত ও ইন্দোনেশিয়ায় 'গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা' অব্যাহত থাকলেও ইউক্রেন পরিস্থিতি সেখানে যে সংকটের জন্ম দিয়েছিল, তা ডিসেম্বরের শেষ দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ভারতে মোদির বিজয় ও ইন্দোনেশিয়ায় জোকো উইদোদোর প্রসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্তি প্রমাণ করে বড় গণতান্ত্রিক সমাজে এক ধরনের 'পপুলিজম'-এর জন্ম হয়েছে। অর্থাৎ সাধারণ একজন মানুষ শুধু তাঁর নিষ্ঠা, সততা আর 'কমিটমেন্ট'-এর কারণে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেন। মোদি ও উইদোদো এর বড় প্রমাণ। মোদি একসময় রেলস্টেশনে চা বিক্রি করতেন। আর অত্যন্ত জনপ্রিয় উইদোদো ছিলেন বস্তির ছেলে। শুধু জনপ্রিয় নীতি আর সততার কারণে তাঁরা আজ বিশ্বনেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। ভারতে কংগ্রেসের ব্যর্থতাই বিজেপিকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। আর মোদি সেখানে এক ধরনের 'পপুলিজম'-এর জন্ম দিয়েছেন।

তবে উইদোদোর বিজয় অতি সহজ ছিল না। সেনা নিয়ন্ত্রিত ইন্দোনেশিয়ায় তিনি নিজেকে একজন 'যোগ্য নেতা' হিসেবে প্রমাণ করেছেন। তবে গণতন্ত্রের জন্যও 'অশনিসংকেত' ছিল থাইল্যান্ড, হংকং ও পাকিস্তানে। মে মাসে সেনাবাহিনী থাইল্যান্ডে ক্ষমতা দখল করে ও সেনাপ্রধান নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা দেন। থাই রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতার কারণেই সেখানে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারছে না। আর সেনাবাহিনী এই সুযোগটাই গ্রহণ করেছে। পাকিস্তানে ইমরান খানের নেতৃত্বে ইসলামাবাদে একটি 'অক্যুপাই মুভমেন্ট'-এর জন্ম হলেও সরকারের পতন হয়নি। পাকিস্তানে গণতন্ত্রের জন্য সেটা ছিল খারাপ সংবাদ। একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে সেখানে সাধারণ নির্বাচন সম্পন্ন হয় এবং নওয়াজ শরিফের মুসলিম লীগ আবার ক্ষমতা ফিরে পায়। পেশোয়ারের শিশু হত্যাকাণ্ড ঘটনায় নওয়াজ শরিফ ও ইমরান খানকে কাছাকাছি আনলেও তা কত দিন স্থায়ী হয়, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। ডিসেম্বরে জাপানে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আবেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে গেছেন।

চলতি বছর ইউক্রেন সংকট এ অঞ্চলে একটি বড় ধরনের 'যুদ্ধের' আশঙ্কার জন্ম হলেও শেষ পর্যন্ত 'যুদ্ধ' হয়নি সত্য; কিন্তু এই সংকট ২০১৫ সালের বিশ্বরাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। সংকটের জন্ম ক্রিমিয়ায় মার্চে অনুষ্ঠিত একটি গণভোটের মধ্য দিয়ে। ভূ-রাজনৈতিকভাবে ক্রিমিয়ার অবস্থান রাশিয়ার কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিকভাবেই রুশ নাগরিকরা ক্রিমিয়ায় বসবাস করে। গণভোটে তারা রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্তির পক্ষে রায় দেয়। এর প্রভাব পড়ে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত দোনেতসক ও লুসাক অঞ্চলে। সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের জন্ম হয় এবং রাশিয়ার মদদে তা ব্যাপকতা পায়। ডিসেম্বর পর্যন্ত এই সংকটের কোনো সমাধান হয়নি। বরং যুক্তরাষ্ট্র বারবার চেয়ে এসেছে, ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিক। তাতে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে ন্যাটো তথা যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে রাশিয়া মনে করে, তার সীমান্তে ন্যাটোর সেনাবাহিনীর উপস্থিতি তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। ফলে এই সংকট থেকে গেছে এবং ধারণা করছি, ২০১৫ সালেও এই সংকট থাকবে।

চলতি বছর আরো একটি 'ভালো খবর'-এর জন্ম হয়েছে। জলবায়ুবিষয়ক কপ-২০ সম্মেলনে (লিমা, পেরু) একটি আংশিক সমঝোতা হয়েছে। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত হয়েছে, বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে বিশ্বের প্রতিটি দেশ স্ব-উদ্যোগে কর্মসূচি গ্রহণ করবে এবং ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্যারিসে কপ-২১ চুক্তি স্বাক্ষর করবে। লিমায় বাহ্যত কোনো চুক্তি হয়নি। হয়েছে একটি সমঝোতা। চূড়ান্ত বিচারে মার্কিন কংগ্রেস এই 'আংশিক সমঝোতা'টি মেনে নেবে কি না, এটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। ফলে প্যারিস কপ-২১ সম্মেলন নিয়েও প্রশ্ন থাকবে অনেক। এবোলায় ১৮ হাজার মানুষের মৃত্যু নিয়ে চলতি বছর কম কথা হয়নি। পশ্চিম আফ্রিকার তিনটি দেশে এই রোগের বিস্তার ও খোদ যুক্তরাষ্ট্রে একজনের মৃত্যু সারা বিশ্বে আলোচিত হয়। তবে বছরের শেষ দিন পর্যন্ত কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কারের খবর আমাদের জানা নেই। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের একটি বিমান (ফ্লাইট ৩৭০) উধাও হয়ে যাওয়া ও এর কোনো হদিস না পাওয়ার ঘটনাও কম আলোচিত হয়নি। স্কটল্যান্ডে গণভোট অনুষ্ঠিত হয় জানুয়ারিতে। গণভোটে স্বাধীন হওয়ার পক্ষে রায় পড়েনি। স্কটিশরা যুক্তরাজ্যের সঙ্গে থাকতেই রায় দিয়েছে। এটা ইউরোপের রাজনীতির জন্য ছিল উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা। ইরান নিয়ে আলোচনা ছিল কম। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে 'গোপন সমঝোতা' ও সিরিয়ায় আইএসের উত্থান ঠেকাতে ইরানকে ব্যবহার করার বিষয়টিও গণমাধ্যমে আলোচিত হয়েছে। ইসরায়েলের দীর্ঘ সাত সপ্তাহ ধরে গাজায় বোমা করা বর্ষণ এবং নারী ও শিশুদের হত্যা করার ঘটনায় বিশ্ববিবেক জাগ্রত হলেও যুক্তরাষ্ট্র বা জাতিসংঘ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
Daily kalerkontho
 28 December 2014, Sunday

লিমা সমঝোতা আমাদের কী মেসেজ দিয়ে গেল

বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে জাতিসংঘ কর্তৃক আয়োজিত 'কপ' (কমিটি অব দ্য পার্টিস) সম্মেলন শেষ হয়েছে ১৪ ডিসেম্বর। একটি আংশিক সমঝোতার কথা পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। ১৯৬টি রাষ্ট্রের অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে কপ-২০ সম্মেলনটি শেষ হয়েছে বটে, কিন্তু অনেক প্রশ্ন রেখে গেছে। 'আংশিক সমঝোতা'র বিষয়টি নিঃসন্দেহে ভালো। কিন্তু বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে এই 'সমঝোতা' কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না। এই সমঝোতার ফলে আগামী বছর, অর্থাৎ ২০১৫ সালে প্যারিস সম্মেলনে (কপ-২১) একটি চুক্তি সামনের স্বাক্ষরের পথ প্রশস্ত হবে, এটা সত্য। কিন্তু এতে বিশ্বের উষ্ণতা কতটুকু রোধ হবে, কিংবা গরিব দেশগুলো, বিশেষ করে সাগরপাড়ের দেশগুলো যে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, সেই ঝুঁকি তারা কতটুকু কাটিয়ে উঠতে পারবে, সে প্রশ্ন রয়েই গেল। অনেক নীতিগত প্রশ্নে, বিশেষ করে জলবায়ু সমস্যা মোকাবেলায় উন্নত দেশগুলো কর্তৃক উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সাহায্য, জলবায়ু সমস্যা মোকাবেলায় 'টেকনোলজি ট্রান্সপার' কিংবা উন্নত বিশ্ব কর্তৃক সুনির্দিষ্টভাবে কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ হ্রাস_ এসব প্রশ্নে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। 'আংশিক সমঝোতা'য় বলা হয়েছে আগামী ৬ মাসের মধ্যে পরিবেশে কার্বন নিঃসরণ কমাতে প্রতিটি দেশ নিজস্ব কর্মপদ্ধতি ও কাঠামো উপস্থাপন করবে। এটা একটা বিভ্রান্তিকর বক্তব্য। প্রতিটি দেশকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে নিজস্ব কর্মপদ্ধতি উদ্ভাবন করার। অর্থাৎ তারা নিজেরাই কার্বন নিঃসরণ কমানোর পন্থা বের করবে। লিমা সম্মেলনে আবারো দেখা গেল ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য। গরিব দেশগুলোর দাবি ছিল আর্থিক সহযোগিতা বাড়ানোর। কেননা বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য ধনী দেশগুলো দায়ী। সুতরাং দায়িত্ব তাদের নিতে হবে। অন্যদিকে উন্নত বিশ্বের দাবি চীন ও ভারতের মত দেশ বিশ্বের শীর্ষ কার্বন নিঃসরণকারী দেশে পরিণত হয়েছে। সুতরাং কার্বন নিঃসরণে এসব দেশের দায়িত্ব অনেক বেশি। এ বিতর্ক অনেক পুরনো। অতীতের প্রতিটি সম্মেলনে এ ধরনের বক্তব্য আমরা শুনেছি। কিন্তু কোনো সমঝোতা হয়নি। এবার লিমাতেও হলো না। যে 'আংশিক সমঝোতা'র কথা আমরা জানতে পেরেছি, তা আমাদের কী মেসেজ দিয়ে গেল? জলবায়ু পরিবর্তনে যে কটি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতিবছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। বাংলাদেশের ১৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রের গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে আগামীতে। আইপিসিসির রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশের কথা। অনেকের মনে থাকার কথা যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আলগোর পরিবেশের ব্যাপারে বিশ্ব জনমতের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ২০১২ সালের জানুয়ারিতে অ্যান্টার্কটিকায় গিয়েছিলেন। আমাদের তৎকালীন পরিবেশ মন্ত্রীকেও তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সেখানে। তা ঠিক আছে। কেননা বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে গেলে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ পর পর দুই বার বন্যা ও পরে 'সিডর'-এর আঘাতের সম্মুখীন হয়। এরপর ২০০৯ সালের মে মাসে আঘাত করে 'আইলা'। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশে খাদ্যদ্রব্যের ব্যাপক ঘাটতি দেখা দেয়। দেশে খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যায়। অর্থনীতিতে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। 'সিডর'-এর পর বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টি বার বার বিশ্ব সভায় আলোচিত হচ্ছে। সিডরের ক্ষতি ছিল গোর্কির চেয়েও বেশি। মানুষ কম মারা গেলেও সিডরের অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিল ব্যাপক। সিডরে ৩০ জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ছিল নটি জেলা। ২০০ উপজেলার ১ হাজার ৮৭১টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মোট ১৯ লাখ ২৮ হাজার ২৬৫ পরিবারের ৮৫ লাখ ৪৫ হাজার ৪৫৬ জন মানুষ সিডরের আঘাতপ্রাপ্ত ছিল। মারা গিয়েছিল ৩ হাজার ৩০০-এর বেশি। তবে অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিল ব্যাপক। সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা। 'সিডর' ও 'আইলা'র পর 'মেসেজ' বাংলাদেশে আঘাত করেছিল। যদিও এতে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তার হিসাব আমরা পাব না কোনোদিনই। 'সিডর' ও 'আইলা'র আঘাত আমরা এখনো পরিপূর্ণভাবে কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আইলার আঘাতের পর খুলনার দাকোপা, কয়রা ও পাইকগাছায় যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা দূর করা সম্ভব হয়নি। জলাবদ্ধতা কোথাও কোথাও ১ মিটার থেকে ৩ মিটার পর্যন্ত। আইলায় ৮০ ভাগ ফলদ ও বনজ গাছ মরে গিয়েছিল। দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে আজ লোনা পানির আগ্রাসন। সুপেয় পানির বড় অভাব ওইসব অঞ্চলে। এরপর 'মহাসেন' আমাদের আবারো ক্ষতিগ্রস্ত করে দিয়েছিল।
আমাদের মন্ত্রী, সচিব কিংবা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা বিদেশ সফর ও সম্মেলনে অংশ নিতে ভালোবাসেন। কানকুন, ডারবান, কাতার, কিংবা তারও আগে কোপেনহেগেনে (কপ সম্মেলন) আমাদের পরিবেশমন্ত্রী গেছেন। আমাদের কয়েকজন সংসদ সদস্য কোপেনহেগেনে প্লাকার্ড ও ফেস্টুন হাতে নিয়ে বিশ্বজনমত আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। আমরা পরিবেশ রক্ষায় তাতে বড় ধরনের আর্থিক সহায়তা পাইনি।
বলা ভালো বাংলাদেশ এককভাবে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনরোধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে না। বাংলাদেশ এককভাবে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ও তা সামগ্রিকভাবে বিশ্বের উষ্ণতা রোধ করতে খুব একটা প্রভাব রাখবে না। এ জন্য বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্তর্জাতিক আসরে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় বিদেশি সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। কিন্তু এই সাহায্যের ওপর নির্ভর করা ঠিক নয়। পরিবেশ বিপর্যয় পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বড় ভূমিকা রয়েছে। গেলবার যে বন্যা হলো আবার আমাদের সে কথাটাই স্মরণ করিয়ে দিল। বন্যার অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় এখন এ দেশে স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু 'সিডর' ও আইলার আঘাতে আমাদের যা ক্ষতি হয়েছিল সে ক্ষতি সারাতে সরকারের বড়সড় উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় ১ হাজার ২৬৮ কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হলেও এখানেও 'রাজনীতি' ঢুকে গেছে। দলীয় বিবেচনায় টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে (কালের কণ্ঠ ২৭ মে)। ভাবতে অবাক লাগে যেসব এনজিও জলবায়ু নিয়ে কাজ করেনি, যাদের কোনো অভিজ্ঞতাও নেই, শুধু দলীয় বিবেচনায় তাদের নামে টাকা বরাদ্দ ধরা হয়েছে। জলবায়ু তহবিলের অর্থ পাওয়া উচিত ওইসব অঞ্চলে যেখানে ঘূর্ণিঝড়, প্লাবনের আঘাত বেশি আর মানুষ 'যুদ্ধ' করে সেখানে বেঁচে থাকে। অথচ দেখা গেছে, জলবায়ুর জন্য বরাদ্দকৃত টাকা দেয়া হয়েছে ময়মনসিংহ পৌরসভাকে, মানিকগঞ্জের একটি প্রকল্পে কিংবা নীলফামারী তিস্তা বহুমুখী সমাজকল্যাণ সংস্থাকে। সিরাজগঞ্জের প্রগতি সংস্থাও পেয়েছে থোক বরাদ্দ। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের একটিরও জলবায়ুসংক্রান্ত কাজের কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। জলবায়ু তহবিলের টাকা বরাদ্দেও যদি 'রাজনীতি' ঢুকে যায় তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু থাকতে পারে না। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী দেখা যায়, বরাদ্দ পাওয়া এনজিওগুলোর সঙ্গে সরকারি দলের নেতা ও কর্মীরা জড়িত। জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু দুর্নীতি যদি এখানেও স্পর্শ করে তাহলে জলবায়ু ফান্ডে আর সাহায্য পাওয়া যাবে না। সচেতন হওয়ার সময় তাই এখনই। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারে সারা বিশ্বে একটা উদ্বিগ্নতা থাকলেও আমরা কতটুকু সচেতন তা নিশ্চিত নই। আমরা বার বার বিদেশ থেকে প্রাপ্ত সাহায্যের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। পরিবেশ দূষণ হয়, এমন কর্মকা-ের ওপর আমরা গুরুত্ব দিয়েছি কম। বিদেশ থেকে যে সাহায্য পাওয়া গেছে, তাতে দুর্নীতি রোধ করতে পারিনি। এমনকি সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রামপালে ভারতীয় কয়লায় একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছি। এ নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে বড় বিতর্ক থাকলেও সরকার ইতোমধ্যেই ১ হাজার ৮৪৭ একর জমি অধিগ্রহণ করেছে। এ কাজে ভারত থেকে বছরে ৪ মিলিয়ন টন কয়লা আমদানি করা হবে। অথচ বিশ্বব্যাপী এটা স্বীকৃত যে, কয়লা পোড়ালে বায়ুম-লে সবচেয়ে বেশি কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমন হয়। এখন লিমা সমঝোতায় বলা হয়েছে, প্রতিটি দেশকে 'নিজস্ব কর্মপদ্ধতি' নির্ধারণ করতে হবে। যেখানে কার্বন নিঃসরণ আমরা কমাতে চাই, সেখানে কি কয়লা পুড়িয়ে কার্বন নিঃসরণ বাড়াব? খুব সঙ্গত কারণেই 'লিমা সমঝোতার' পর রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। আমরা বার বার বলে আসছি, বাংলাদেশকে নিজস্ব উদ্যোগেই কার্বন নিঃসরণ রাখতে হবে। ইটের ভাটায় কয়লা পোড়ানো কমাতে হবে। এখানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। সোলার এনার্জি ও বায়ু বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতে হবে। সোলার প্রযুক্তির সম্ভাবনা থাকলেও এ সেক্টরটি অবহেলিত। একসময় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, বহুতল ভবনে বিদ্যুৎ সংযোগের শর্ত হিসেবে 'সোলার প্রযুক্তি' ব্যবহার করতে হবে। এই শর্ত এখন আর কেউ মানেন না। এটি দেখারও যেন কেউ নেই। 'লিমা সমঝোতা' আমাদের জন্য কোনো সুসংবাদ বয়ে আনেনি। আমরা যে ঝুঁকির মধ্যে ছিলাম, সেই ঝুঁকিতেই থেকে গেলাম। উন্নত বিশ্ব আমাদের সমস্যার সমাধান করে দিয়ে যাবে না। আমাদের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে হবে। আমাদেরই একটা কর্মপদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হবে। লিমা সম্মেলনে আমাদের এ মেসেজটিই দিয়ে গেল। সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে। Daily Jai Jai Din 22.12.14

কোন পথে পাকিস্তান

পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের রাজধানী পেশোয়ারে ইসলামি জঙ্গিদের হামলায় ১৩২ জন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে কোন পথে এখন পাকিস্তান! অনেকগুলো প্রশ্ন এখন ভিড় করেছে এই হত্যাকা-ের ঘটনায় এবং এসব প্রশ্ন যে আগামী দিনের পাকিস্তানের চলমান রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। প্রথমত, পাকিস্তানে ইসলামি জঙ্গিদের আক্রমণের ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগেও ২০১১ সালে পাকিস্তানের নেভাল এয়ারবেস মেহরানে হামলা কিংবা ৮ জুন করাচির জিন্নাহ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে হামলা প্রমাণ করে জঙ্গিরা কত শক্তিশালী। পেশোয়ার হত্যাকা-ের পর এর দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করেছে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান বা টিটিপি নামে একটি জঙ্গি সংগঠন। টিটিপি জানিয়েছে, তারা আরও হামলা চালাবে। তাই পাকিস্তান সরকার এই হামলাকে কত গুরুত্বের সঙ্গে নেবে, এটা বড় প্রশ্ন এখন। দ্বিতীয়ত, এ ধরনের একটি হত্যাকা-, বিশেষ করে সেনা নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে, অভ্যন্তরীণভাবে সমর্থন না পেলে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। এর অর্থ পরিষ্কার টিটিপির সমর্থন রয়েছে সেনাবাহিনীর ভেতরে। সেনাবাহিনীর একটি মহলের সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া সেনাছাউনির ভেতরে অবস্থিত স্কুলে জঙ্গি হামলা চালানো সম্ভব নয়। তাই সেনাবাহিনীর এই অংশকে যদি নিষ্ক্রিয় করা না যায়, তাহলে জঙ্গিদের দমন করা যাবে না। এরা বারবার হামলা চালাবে। তৃতীয়ত, যারা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’-এ বিশ্বাস করেন, তারা এই হামলার সঙ্গে একটি ‘ষড়যন্ত্র’ খুঁজে পেতে পারেন। আর ষড়যন্ত্রটি হচ্ছে সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা বা আইএসআই সিভিল প্রশাসনের ওপর তাদের কর্তৃত্ব অব্যাহত রাখতে চাইছে। পাকিস্তানে জেনারেল পারভেজ মোশাররফের ক্ষমতা থেকে উৎখাত এবং রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে ক্ষমতা পরিচালনা আইএসআই কোনো ভালো চোখে দেখছে না। আইএসআই অনেকদিন থেকেই সরকারের ভেতরে আরেকটি সরকার হিসেবে কাজ করছে। এখন মোশাররফ-পরবর্তী প্রথমে পিপিপির নেতৃত্বে একটি সরকার ও চলতি বছরে নওয়াজ শরিফের পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসার মধ্য দিয়ে আইএসআইর ক্ষমতা কিছুটা হলেও হ্রাস পেয়েছে। ফলে গোয়েন্দা সংস্থার ওপর নির্ভরতা বাড়াতেই আইএসআইর যোগসাজশে এই হত্যাকা- ঘটে থাকতে পারে! এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না, নওয়াজ শরিফকে এখন জঙ্গি দমনে বেশি মাত্রায় সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করতে হবে। আইএসআই এমনটিই চাচ্ছে, যাতে করে তারা সিভিল প্রশাসনের ওপর প্রভাব খাটাতে পারে। চতুর্থত, ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ এর বড় প্রমাণ কিছুদিন আগে ইমরান খানের নেতৃত্বে একটি আন্দোলন সরকার পতনে ব্যর্থ হয়েছিল। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, ইমরান খানের সমর্থকরা রাজধানী ইসলামাবাদের একটা অংশ দখল করে নিয়ে অবস্থান ধর্মঘট করলেও সরকারের পতন ঘটেনি। অনেকেই ধারণা করেছিলেন সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলের দ্বন্দ্বের সুযোগে সেনাবাহিনী আবার ক্ষমতা দখল করতে পারে। ওই ঘটনার রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই পেশোয়ারে নৃশংস হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটল। এই ঘটনা নিঃসন্দেহে নওয়াজ শরিফকে আরও সেনাবাহিনী মুখাপেক্ষী করবে। সিভিলিয়ান প্রশাসন আরও দুর্বল হবে এখন পাকিস্তানে। পঞ্চমত, জঙ্গিদের বারবার হামলা একটি সম্ভাবনাকে উসকে দিল যে, পাকিস্তান কি আগামী দিনে তার অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকতে পারবে? ঐতিহাসিকভাবেই বৃহত্তর খাইবার অঞ্চলের জনগণ কারোরই কর্তৃত্ব মানেনি। তারা ব্রিটিশদের কর্তৃত্ব মানেনি। পাকিস্তানি কর্তৃত্বও তারা মানেনি। পাকিস্তানের এই অঞ্চল বিশেষ একটি অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত। পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে, তাতে এটা দৃশ্যমান যে, এই অঞ্চল অদূর ভবিষ্যতে আফগানিস্তানের একটা অংশের সঙ্গে মিশে গিয়ে নতুন একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিতে পারে। বেলুচিস্তানও আলাদা হয়ে যেতে পারে। করাচিকে কেন্দ্র করে মোহাজিরদের আলাদা রাষ্ট্র গঠনের দাবিও কোনো কোনো মহল থেকে উচ্চারিত হচ্ছে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রটি যদি শুধু লাহোর আর ইসলামাবাদভিত্তিক হয়ে পড়ে, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ষষ্ঠত, শিশু হত্যার এই ঘটনা পাকিস্তানের সব রাজনৈতিক দলকে অন্তত একটি ইস্যুতে এক পতাকাতলে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে। পাকিস্তানে ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন তেহরিক-ই-ইনসাফ দলটি বর্তমান পাকিস্তানে প্রধান বিরোধী দল। তারা এই ঘটনায় তাদের সরকারবিরোধী আন্দোলন আপাতত স্থগিত করেছে। এটা একটা ভালো লক্ষণ। তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে যে সরকার রয়েছে, সেই সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছে ইমরান খানের দল। অনেকে অভিযোগ করেন, ইমরান খানের দলের সঙ্গে ইসলামি জঙ্গিদের সম্পর্ক রয়েছে। এর পেছনে সত্যতা যাই থাকুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে খাইবার পাখতুনখাওয়ায় জঙ্গিদের সঙ্গে সেখানে তেহরিক-ই-ইনসাফের এক ধরনের সহাবস্থান হয়েছে। না হলে দলটি ক্ষমতা পরিচালনা করতে পারত না। এ ক্ষেত্রে জঙ্গি দমনে ইমরান খানের ভূমিকাকে ফেলে দেওয়া যাবে না। সপ্তমত, পাকিস্তানে তালেবানি জঙ্গিদের যদি নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তাহলে তা পাকিস্তান ছাড়িয়ে ভারত ও বাংলাদেশেও প্রভাব বিস্তার করতে পারে এবং এই দেশ দুটির নিরাপত্তায় হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। ভারতে জঙ্গিদের তৎপরতার খবর আমরা জানি। সর্বশেষ পশ্চিম বাংলার বর্ধমানে যে জঙ্গি তৎপরতার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, তা আমাদের উৎকণ্ঠার জন্য যথেষ্ট। বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা তেমন একটা নেই। কিন্তু ওরা আছে। পাকিস্তানে ওরা যদি ‘উৎসাহিত’ হয়, তাহলে তা আমাদের এ অঞ্চলের জঙ্গিদের উৎসাহ জোগাবে। অষ্টমত, পাকিস্তানে জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধি শুধু পাকিস্তানের নিরাপত্তাকেই ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেবে না, বরং বৈশ্বিক নিরাপত্তাও ঝুঁকির মুখে থাকবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, পাকিস্তান একটি পারমাণবিক রাষ্ট্র। পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনী। এখন এই কর্মসূচি যদি কোনোভাবে জঙ্গিদের হাতে চলে যায় তাহলে তা বিশ্বের অন্যত্র স্থানান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বিশেষ করে ইরাক-সিরিয়াজুড়ে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা পারমাণবিক প্রযুক্তির ব্যাপারে উৎসাহিত হবে বেশি। তাই জঙ্গি তৎপরতা রোধ করাটা জরুরি। এ ক্ষেত্রে সার্কের আওতায় একটি যৌথ কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানও জরুরি। মনে রাখতে হবে, জঙ্গিবাদ আজ শুধু পাকিস্তানের একার সমস্যা নয়। জঙ্গিবাদ আজ মানবতার শত্রু। তাই এটাকে দমন করা না গেলে সার্কের উন্নয়ন প্রক্রিয়া থমকে যাবে। এ ক্ষেত্রে দুটি বড় দেশ পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সব ধরনের বৈরিতা কমিয়ে আনা প্রয়োজন। দুটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধেই বড় অভিযোগ রয়েছে যে, তারা একে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় মদদ জোগায়। এই অভিযোগ কমিয়ে আনার জন্যই উভয় দেশের গোয়েন্দা সংস্থার জঙ্গি দমনে একসঙ্গে কাজ করা উচিত। নবমত, জঙ্গি দমনে পাকিস্তানের ‘বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে’ (যা ঋঅঞঅ নামে পরিচিত) দীর্ঘদিন যাবৎ মার্কিন ড্রোন হামলা পরিচালিত হয়ে আসছে। এতে করে বেশ কিছু জঙ্গি নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষও সেখানে মারা যাচ্ছেন। এই হামলা বন্ধ করা উচিত। ড্রোন হামলা চালিয়ে জঙ্গি দমন করা যাবে না। বরং তালেবানদের সঙ্গে যে ‘সংলাপ’ শুরু হয়েছিল, সেই ‘সংলাপ’ অব্যাহত রাখতে হবে। পাকিস্তানে ইসলামপন্থী দলগুলোকেও এই প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে একটি সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটি গঠন করে তালেবানদের সঙ্গে ‘সংলাপ’ শুরু করতে হবে। দশমত, পাকিস্তান সরকার বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে সেনাপ্রধান ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানকে কাবুলে পাঠিয়েছিল। সেখানে নয়া আফগান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তারা কথা বলেছেন। এটা ভালো দিক। তালেবান দমনে আফগান সরকারের সহযোগিতা দরকার। নিরপরাধ শিশুদের হত্যা করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। তালেবানরা হত্যার নামে যে ইসলামি রাজনীতির কথা বলছে, তা কখনোই ইসলাম ধর্মসম্মত নয়। পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোকে আজ এই প্রশ্নে একমত হতে হবে যে, তালেবান রাজনীতি সনাতন রাজনীতির ধারাকে নষ্ট করে দেবে। এই হত্যার রাজনীতি কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি জঙ্গিদের উৎসাহ জোগাবে মাত্র। এই জঙ্গি হামলা দিয়ে টিটিপির কোনো বড় ধরনের অর্জন হবে না। সারা বিশ্ব এর ধিক্কার জানিয়েছে। একমাত্র সাধারণ মানুষের সচেতনতাই জঙ্গিদের রুখতে পারে। এক সময় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর অর্থায়নে এই ঋঅঞঅ অঞ্চলে ইসলামিক জঙ্গিদের তৈরি করা হয়েছিল। এদের পাঠানো হয়েছিল আফগানিস্তানে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। এটি আশির দশকের কথা। তারপর কেটে গেছে ৩৪ বছর। সেই জঙ্গিরাই এখন ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবে পরিণত হয়েছে। এদের রুখতে হলে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা আর মানুষের সচেতনতা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। Daily Amader omoy 22.12.14

লিমা সম্মেলন থেকে কী পেল বিশ্ব

নির্ধারিত সময়ের অনেক পর দীর্ঘ আলোচনা শেষে লিমা কপ-২০ সম্মেলনে বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে একটি সমঝোতায় উপনীত হওয়া সম্ভব হয়েছে। বিশ্বের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো ১৯৬টি দেশ নিজ নিজ দেশে কার্বন নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারে একটি ঐকমত্যে উপনীত হয়েছে। আগামী বছরের ডিসেম্বরে প্যারিস কপ-২১ সম্মেলনে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে এ সমঝোতার আলোকেই। ২০২০ সালের মধ্যে চুক্তিটি কার্যকর হবে। ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত কিয়োটো প্রটোকলের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর দীর্ঘ সময় লেগেছে একটি সমঝোতায় উপনীত হতে। এর আগের প্রতিটি কপ সম্মেলনে (কানকুন থেকে ডারবান) কার্বন নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে বটে; কিন্তু কোনো সমঝোতা হয়নি। সমস্যা ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে নিয়ে। এ দুটি রাষ্ট্র বিশ্বের শীর্ষ কার্বন নিঃসরণকারী দেশ। এ দুটি দেশ যদি কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে রাজি না হতো, তাহলে কোনো সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব ছিল না। শেষ পর্যন্ত গেল নভেম্বরে ওবামার চীন সফরের সময় এ ব্যাপারে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে লিমা কপ-২০ সম্মেলনে একটি সমঝোতার পথ প্রশস্ত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি এখন বহুল আলোচিত। এ নিয়ে প্রতিবছরই পৃথিবীর কোথাও না কোথাও শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। জাতিসংঘ কর্তৃক আয়োজিত এসব সম্মেলনকে অভিহিত করা হচ্ছে কপ বা কমিটি অব দ্য পার্টিজ হিসেবে। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তই তারা নিতে পারছিলেন না শুধু শিল্পোন্নত দেশগুলোর অসহযোগিতার কারণে। জাতিসংঘের ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অব ক্লাইমেন্ট চেঞ্জ-এর রিপোর্টে বারবার একটি ভয়াবহতার কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে সাগর-মহাসাগরের পানি। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস বাড়ছে। এর কারণ হচ্ছে আমরা তথা মানব প্রজাতি অতিরিক্ত জ্বালানি পোড়াচ্ছি। জাতিসংঘের ওই বিশেষজ্ঞ প্যানেল বলছে, একুশ শতকের মধ্যভাগে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে (৩ দশমিক ৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট) সীমাবদ্ধ রাখার যে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। ফলে পৃথিবী এ শতাব্দীতেই বড় ধরনের দুর্যোগের মধ্যে পড়বে। পৃথিবীর তাপমাত্রা যদি ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায়, তাহলে গ্রিনল্যান্ড ও অ্যান্টারটিকার সব বরফ গলে যাবে। তখন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে ২৩ ফুট। চিন্তা করা যায়, কী ভয়াবহ বিপর্যয় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে!বিশ্বের নেতারা যে বিষয়টি জানেন না, তা নয়। তারা জানেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বড় বড় শিল্পগোষ্ঠীর চাপে কোনো সরকারই বায়ুমণ্ডলে যে গ্রিনহাউস গ্যাস উদ্গিরণ হচ্ছে, তা কমাতে পারছে না। এসব শিল্পগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিচ্ছে। বিশেষ করে শিল্পোন্নত দেশগুলো যেসব প্রতিনিধি ওখানে পাঠায়, তাতে তারা অংশ নেয়। লবিং করে। সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাব খাটায়।এদিকে বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে একটি শংকার কথা আমাদের জানিয়েছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)। বাংলাদেশ এ জলবায়ু পরিবর্তনে কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এডিবির রিপোর্টে সে কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এডিবি জানিয়েছে, ২০৫০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি গড়ে ১ দশমিক ৮ শতাংশ করে কম হতে পারে। আর চলতি শতাব্দী শেষে এ ক্ষতি হতে পারে প্রায় ৯ শতাংশ। আর বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়তে পারে ৪ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এডিবির ওই রিপোর্টে দক্ষিণ এশিয়ারঅপর দুটি দেশ নেপাল ও মালদ্বীপের ক্ষতির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হবে, তা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। শুধু এডিবির রিপোর্টেই নয়, জাতিসংঘের রিপোর্টেও এ ক্ষতির দিকটি উল্লেখ করা হয়েছে একাধিকবার। প্রতি বছরই জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত যে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, সেখানেও বাংলাদেশের পরিবেশগত সমস্যার কথা উঠে আসে। বাংলাদেশের পরিবেশমন্ত্রী ঘটা করে কপ সম্মেলনে যান। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ইতিমধ্যে নাসা আরও একটি আশংকার কথা জানিয়েছে। নাসা আশংকা করছে, গ্রিনল্যান্ডে যে বরফ জমা রয়েছে তা যদি উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে গলে যায়, তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৭ মিটার বৃদ্ধি পাবে। তাই কার্বন ডাই-অক্সাইড হ্রাসের কথা বলছে নাসা। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর তার একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন, পৃথিবীর বড় শহরগুলোয় ইতিমধ্যে ৪ কোটি মানুষ মারাত্মক প্লাবনের হুমকির মুখে আছে। আল গোর বিশ্বের ১০৭ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে (বাংলাদেশের সাবেক পরিবেশমন্ত্রী হাছান মাহমুদও ছিলেন ওই দলে) গিয়েছিলেন অ্যান্টার্কটিকায়। শুধু জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য। কিন্তু বিশ্ব সম্প্রদায় এখনও নীরব। প্রতিবছরই কপ সম্মেলনে ভালো ভালো কথা বলা হয়। বলা হয়েছিল, ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্ব কার্বন নিঃসরণ কমাতে একটি চুক্তি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। এ সংক্রান্ত আলোচনা শুরু হয়েছে অনেক আগে এবং ২০২০ সাল থেকে চুক্তিটি কার্যকর হবে। একটি গ্রিন ফান্ড গঠনের ব্যাপারে শিল্পোন্নত দেশগুলো রাজি হয়েছিল। এ ফান্ডের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার। ৪০ বিলিয়ন ডলার দিয়ে এ ফান্ড যাত্রা শুরু করছে। বিশ্বব্যাংক এ ফান্ডের ব্যবস্থাপনার তদারক করছে। বাংলাদেশ ওই ফান্ড থেকে অর্থ পেয়েছে।কপ-এর ডারবান সম্মেলনের পর (২০১১) যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, প্রতি বছর এ ধরনের সম্মেলন করে শেষ পর্যন্ত কি বিশ্বের উষ্ণতা রোধ করা সম্ভব হবে? বাংলাদেশের সাবেক পরিবেশমন্ত্রী ওই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। ঢাকায় ফিরে এসে তিনি কিছুটা হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন। তাই কপ সম্মেলন নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবেই। ইতিমধ্যে জাপান, কানাডা ও রাশিয়া কিয়োটো পরবর্তী আলোচনা নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছে। সুতরাং বোঝাই যায়, এ নিয়ে এক ধরনের হতাশা এসে গেছে। আসলে বিশ্বের দেশগুলো এখন বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে গেছে। বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে এক এক গ্রুপের এক এক এজেন্ডা। উন্নত বিশ্ব কিংবা উন্নয়নশীল বিশ্বের যে দাবি, তার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আবার উন্নয়নশীল বিশ্বও একাধিক গ্রুপে বিভক্ত। ধনী দেশগুলো এনেক্স-১-এ অন্তর্ভুক্ত। বিশ্ব জিডিপির শতকরা ৭৫ ভাগ এ দেশগুলোর। অথচ লোকসংখ্যা বিশ্বের ১৯ ভাগ মাত্র। কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে সবচেয়ে বেশি, শতকরা ৫১ ভাগ। অন্যদিকে গ্রুপ ৭৭-এর দেশগুলো (মোট ১৩০টি দেশ) বিশ্বের জনসংখ্যার ৭৬ ভাগ, জিডিপির মাত্র ১৯ ভাগ; কিন্তু কার্বন উদগিরণ করে ৪২ ভাগ। আবার সাগরপাড়ের দেশগুলো, যারা বিশ্বের জনসংখ্যা, জিডিপি ও কার্বন নিঃসরণে মাত্র ১ ভাগ; তাদের দাবি ২০২০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বর্তমান অবস্থার চেয়ে শতকরা ৮৫ ভাগ কমিয়ে আনার। বনাঞ্চলভুক্ত দেশগুলো, যারা রেইন ফরেস্ট কোয়ালিশন হিসেবে পরিচিত, তারা বিশ্ব জনগোষ্ঠীর ১৯ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। জিডিপির মাত্র ৩ ভাগ তাদের। আর কার্বন নিঃসরণ করে মাত্র ৪ ভাগ। যুক্তরাষ্ট্র একা কার্বন নিঃসরণ করে ২০ ভাগ। জিডিপির ৩০ ভাগ তাদের। অথচ জনসংখ্যা বিশ্বের মাত্র ৫ ভাগ। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বিশ্ব জিডিপির ২৫ ভাগ ও জনসংখ্যার ৮ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে ১৫ ভাগ। চীনকে নিয়ে সমস্যা এখন অনেক। চীন একা কার্বন নিঃসরণ করে ২১ ভাগ। বিশ্ব জনসংখ্যার ২০ ভাগই চীনা নাগরিক। জিডিপির ৬ ভাগ তাদের।প্রতিটি গ্রুপের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন। সবাই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে কার্বন নিঃসরণের হার কমাতে চায়। জাতিসংঘ এটাকে বলছে কার্বন ঘনত্ব। দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা মোট আয়ের (জিডিপি) অনুপাতে কার্বন ডাই-অক্সাইড উদ্গিরণের হারকে কার্বন ঘনত্ব বা গ্রিন হাউস গ্যাসের ঘনত্ব বলা হয়। উন্নয়নশীল বিশ্ব মনে করে, এ হার মাথাপিছু জনসংখ্যা ধরে করা উচিত। কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের হার কমানো উচিত এটা মোটামুটিভাবে সবাই মেনে নিয়েছে। কিন্তু কে কতটুকু কমাবে, সে প্রশ্নের কোনো সমাধান হয়নি। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ও চীন (এবং সেই সঙ্গে ভারতও) বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দূষণ ছড়ায়, সে কারণে এ দুটি দেশের কাছ থেকে কমিটমেন্ট আশা করেছিল বিশ্ব। কিন্তু তা হয়নি। চীন প্রস্তাব করেছিল ২০০৫ সালের কার্বন ঘনত্বের চেয়ে দেশটি ২০২০ সালে শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ কমাবে। আর যুক্তরাষ্ট্রের দাবি ছিল তারা ১৭ ভাগ কমাবে। কিন্তু চীন ও ভারত যুক্তরাষ্ট্রের এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এখানে বলা ভালো, চীনের কার্বন ঘনত্ব ২.৮৫ টন, আর ভারতের ১.৮ টন। চীন ও ভারত বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে এ শতাব্দীতেই। বিশ্বব্যাংকের উপদেষ্টা হরিন্দর কোহলির মতে আগামী ৩০ বছরে ভারত বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। তার মাথাপিছু আয় তখন ৯৪০ ডলার থেকে বেড়ে ২২ হাজার ডলারে উন্নীত হবে। ২০০৭ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত অবদান রাখত মাত্র ২ ভাগ, ৩০ বছর পর অবদান রাখবে ১৭ ভাগ। দেশটিকে এটা ধরে রাখতে হলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৮ থেকে ৯ ভাগ। এ কারণেই ভারতকে নিয়ে ভয়- তাদের কার্বন ঘনত্ব বাড়বে। কারণ প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু রাখতে হবে। ফলে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বাড়বে। পাঠকদের এখানে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ১৯৯৭ সালে কিয়োটো সম্মেলনে ১৬০টি দেশ অংশ নিয়েছিল এবং সেখানে যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে ১৯৯০ সালের কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রার চেয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৮ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রের ৭ শতাংশ, জাপানের ৬ শতাংশ হ্রাস করার কথা। তাছাড়া সার্বিকভাবে ৫.২ শতাংশ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের আইনগত বাধ্যবাধকতা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সিদ্ধান্ত হয়েছিল সব দেশকে ২০০৮-২০১২ সালের মধ্যে গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর কিয়োটো চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও পরে বুশ প্রশাসন ওই চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে কিয়োটো চুক্তি কাগজ-কলমে থেকে গিয়েছিল।বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে যে কটি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতি বছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বেড়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি বেড়ে যাওয়ায় উপকূলের মানুষ অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি ৭ জনে ১ জন মানুষ আগামীতে উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। ১৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। বাংলাদেশ কোপেনহেগেন কপ সম্মেলনে পরিবেশগত উদ্বাস্তুদের Universal Natural Person হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু তা গ্রহণ করা হয়নি।অর্থায়নের ব্যাপারটি নিয়েও নানা জটিলতা রয়েছে। ফাস্ট স্টার্ট ফান্ডে পাওয়া গিয়েছিল মাত্র আড়াই বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ সেখান থেকে পেয়েছিল ১৩০ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু এ অর্থ সাহায্য বিতরণ নিয়ে নানা অভিযোগ উঠেছে। স্বয়ং পরিবেশমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এক অনুষ্ঠানে প্রশ্ন তুলেছেন এর স্বচ্ছতা নিয়ে। বলেছেন, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ যাচ্ছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু এ অর্থ ঠিকমতো খরচ হচ্ছে কিনা, তা মনিটরের ব্যবস্থা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নেই (২০ আগস্ট ২০১৪)। দুর্নীতি এখানে ভর করছে। যারা সত্যিকার অর্থেই জলবায়ু উদবাস্তু, তারা সাহায্য পাচ্ছে না। লিমা সম্মেলনে অর্থ প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়নি। এমনকি প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়েও কোনো সমাধান হয়নি। অথচ এ বিষয়টি উন্নয়নশীল বিশ্ব তথা সাগরপাড়ের দেশগুলোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিবেশের যথেষ্ট ক্ষতি করে। উন্নত দেশগুলো এ বিষয়টিকে এড়িয়ে চলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, এমনকি ভারতে কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় (পাঠক, রামপালে প্রস্তাবিত কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কথা চিন্তা করতে পারেন)। বাংলাদেশ বা মালদ্বীপের মতো দেশে সোলার বিদ্যুৎ ও বাতাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকলেও এ ক্ষেত্র দুটি বারবার উপেক্ষিত থেকে গেছে। গরিব দেশগুলোর কাছে এ প্রযুক্তি সহজলভ্য নয়। প্রযুক্তি হস্তান্তরে উন্নত দেশগুলোর গড়িমসি চোখে লাগার মতো।লিমা সম্মেলনে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে, প্রতিটি দেশ আগামী ৬ মাসের মধ্যে নিজের দেশে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে আনার ব্যাপারে নিজস্ব কর্মপদ্ধতি উদ্ভাবন ও উপস্থাপন করবে। বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রামপালে ভারতীয় কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ প্লান্ট তৈরি করছে বাংলাদেশ। এতে পরিবেশ দূষণ তো হবেই, একই সঙ্গে কার্বন নিঃসরণের মাত্রাও বাড়বে। ইটের ভাটায় কয়লা ব্যবহৃত হয়, যা বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড ছড়ায়। এখন বাংলাদেশকে লিমা ঘোষণা বাস্তবায়ন করে একটি কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। দেখার বিষয় বাংলাদেশ এখন কী করে।নিঃসন্দেহে লিমা ঘোষণা একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। তবে প্রশ্ন থাকলই। উন্নত বিশ্ব শেষ পর্যন্ত প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষর করে কি-না, তা দেখার জন্য আমাদের আরও এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। বিশেষ করে কংগ্রেসের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের দ্বন্দ্বের আলোকে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত লিমা ঘোষণার ব্যাপারে কোনো আপত্তি তোলে কিনা, সেটাই দেখার বিষয় এখন। Daily Jugantor 2012.14

কেমন হবে ২০১৫ সালের বিশ্ব রাজনীতি

কেমন হবে ২০১৫ সালের বিশ্ব রাজনীতি? বিশ্ব রাজনীতিতে ২০১৪ সালে অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে, যার রেশ ২০১৫ সালে বিশ্ব রাজনীতিতেও অনুভূত হবে। ২০১৪ সালে বিশ্ব রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য ঘটনার একটি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে ইরাক-সিরিয়ায় কট্টরপন্থী ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্ট্রেটের উত্থান ও এদের সন্ত্রাসী কর্মকা-। এক সময় সারা বিশ্বে ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠী আল কায়েদা একটা ভয়ের আবহ সৃষ্টি করেছিল। আল কায়েদার সন্ত্রাসী কর্মকা-কে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে’ যুদ্ধের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে পাওয়া ও তাকে হত্যা করার পর যুক্তরাষ্ট্র তার ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ কর্মসূচি পরিত্যাগ করেনি। বরং নতুন করে ‘ইসলামিক স্টেট’র উত্থান যুক্তরাষ্ট্রকে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে আরও বেশি করে জড়িত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র সেখানে সরাসরি সেনাবাহিনী না পাঠালেও ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের ওপর বোমাবর্ষণ অব্যাহত রেখেছে। এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সেখানে বেশ কটি আরব দেশের সমন্বয়ে একটি কোয়ালিশন বাহিনী গঠন করেছে। ২০১৫ সালেও এদের তৎপরতা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিকে আরও উত্তপ্ত করবে। এটা বলা প্রয়োজন যে, জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের উত্থান পুরো মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিকে বদলে দিয়েছে। এক সময় মনে করা হয়েছিল সিরিয়ায় আসাদের দিন বোধহয় ফুরিয়ে আসছে। কিন্তু ইসলামিক স্টেটের উত্থানকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের এখন প্রয়োজন আসাদকে। শুধু তাই নয়, ইরানের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এক সময় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের আতঙ্ক ছিল বেশি। সেই ইরান এখন এদের ‘মিত্র’। ইরানি বিমান আইএস বা ইসলামিক স্টেটের ঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ করেছে, এমন সংবাদও পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এতে করে সরাসরিভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে ইরান আইএসবিরোধী জোটে নিজেদের শরিক করল। ফলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বিতর্ক আপাতত চাপা পড়ে গেল! তবে সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন আছে এবং এই প্রশ্নগুলো ২০১৫ সালে বারবার আলোচিত হতে থাকবে। বিশেষ করে সিরিয়া কী ‘আরেকটি লেবাননে’ পরিণত হবে, নাকি সিরিয়ার এক অংশ দখল করে নেবে আইএসের জঙ্গিরাÑ এ প্রশ্ন আলোচিত হবে। এ নিয়ে রাশিয়ার ভূমিকা কী হবে, সেদিকেও দৃষ্টি থাকবে অনেকের। আসাদ আপাতত টিকে গেছেন। কিন্তু কতদিনের জন্য সে প্রশ্ন থাকবেই। একটি প্রশ্ন পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, তা হচ্ছে যদি আসাদকে সরে যেতে হয় তাহলে আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ায় কারা ক্ষমতাসীন হচ্ছেন? সেখানে আদৌ জাতীয় ঐকমত্যের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে কি না, এদিকে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের চরিত্র পর্যবেক্ষণ করে দুটি মন্তব্য করা যায়। এক. সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ সিরিয়াকে আরেকটি লেবাননে পরিণত করতে পারে। দুই. সিরিয়ায় ইসলামি জঙ্গিদের প্রভাব বাড়তে পারে। তবে সিরিয়ার রাজনীতিতে আগামী দিনগুলোতে তুরস্কের একটি বড় ভূমিকা থাকবে। ২০১৫ সালের রাজনীতিতে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের দিকেও দৃষ্টি থাকবে অনেকের। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের উদ্বিগ্নতা ও একটি সমঝোতা প্রত্যাশিত হলেও ২০১৫ সালে বড় ধরনের একটি বিতর্কের মুখোমুখিও হতে পারে বিশ্ব। এই মুহূর্তে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পে ইসরায়েলি বিমান হামলার সম্ভাবনা না থাকলেও ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।
জানুয়ারি মাসে প্রেসিডেন্ট ওবামা দ্বিতীয়বারের মতো কংগ্রেসের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যেতে পারেন। তার প্রশাসন নতুন একজন দেশরক্ষা সচিব পাবে। তবে এতে করে মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। মার্কিন প্রশাসনে ব্যক্তির পরিবর্তন ঘটলেও নীতির কোনো পরিবর্তন হয় না। এ ক্ষেত্রে দেশরক্ষামন্ত্রী চাগেলের পরিবর্তে কার্টার দায়িত্ব পেলেও মার্কিন নীতিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম। তবে ২০১৫ সাল ওবামার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে। এই প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৩ সালের মাঝামাঝি থেকে। ওবামার জন্য তাই যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে সেখানে বিকল্প একটি বাহিনী রেখে যাওয়া। এটা অনেকটা নিশ্চিত আফগানিস্তান থেকে মার্কিন তথা ন্যাটোর সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা হলে আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চল তালেবানদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। নয়া প্রেসিডেন্ট আশরাফ আলী শুধু কাবুলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বেন। তালেবানের সঙ্গে আলোচনাও ফলপ্রসূ হয়নি। ওবামা প্রশাসন মুসলিম দেশগুলোর সমন্বয়ে বিকল্প একটি বাহিনী গঠন করার উদ্যোগ নিতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, আফগানিস্তানে এখনো যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। মধ্য এশিয়ায় তার উপস্থিতি নিশ্চিত করার স্বার্থে আফগানিস্তানে তাদের ‘টোকেন’ উপস্থিতিও থাকবে। ২০১৫-পরবর্তী আফগান রাজনীতিতে ভারতেরও একটা বড় ভূমিকা থাকবে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের যে ‘সামরিক ঐক্য’ গড়ে উঠেছে, তা ২০১৪-পরবর্তী আফগানিস্তানে একটা ভূমিকা পালন করতে পারে। দ্বিতীয়ত, ওবামা প্রশাসনের সঙ্গে রাশিয়ার পুতিন প্রশাসনের সম্পর্কের দিকেও অনেকের দৃষ্টি থাকবে। ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে নৌ উপস্থিতি বাড়ানোর কথা বলেছিল। এতে পরোক্ষভাবে চিনের ওপর ‘চাপ’ সৃষ্টি করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে রাশিয়ান স্ট্রিট বাড়ানোর কথা বলেছে রাশিয়া। ২০১৫ সালে দুই পরাশক্তির এই অঞ্চলে উপস্থিতি লক্ষ করা যাবে। তৃতীয়ত, চিনের সঙ্গে ওবামা প্রশাসনের সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, ২০১৫ সালে সে ব্যাপারেও পর্যবেক্ষকদের লক্ষ্য থাকবে। এটা বলা যায়, ক্রেমলিনে পুনরায় পুতিনের প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব আসরে রাশিয়ার তৎপরতা বেড়েছে। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে চ্যালেঞ্জ করেই ডিসেম্বরের (২০১৪) প্রথমদিকে পুতিন ভারত সফর করেছেন এবং কোটি কোটি ডলারের ১৬টি চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। এই চুক্তির আওতায় রাশিয়া ভারতে ১০টি পরমাণু চুল্লি নির্মাণ করবে। এছাড়া ভারত ৭১ এমআইএল এমআই-১৭ হেলিকপ্টার ও ৯৭০ যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন কিনবে। এর মধ্য দিয়ে রাশিয়া ভারতের সঙ্গে তাদের যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক ছিল, তা দৃঢ় করল। রাশিয়া সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত মধ্য এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে একটি ইউরো-এশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছে। অনেকটা ইইউ অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন মডেলে। ইতোমধ্যে কাজাকিস্তান ও বেলারুশকে নিয়ে রাশিয়া একটি কাস্টমস ইউনিয়ন গঠন করেছে। রাশিয়া চাচ্ছে এই কাস্টমস ইউনিয়নে ইউক্রেন, কিরঘিজস্তান ও তাজিকিস্তান যোগ দিক। ২০১৫ সালে রাশিয়া এ লক্ষ্যে কাজ করে যাবে। একই সঙ্গে সামরিক জোট ঈঝঞঙ (ঈড়ষষবপঃরাব ঝবপঁৎরঃু ঃরবধঃরু ড়ৎমধহরুধঃরড়হ)-এর ব্যাপারেও আগ্রহ থাকবে অনেকের। ঈঝঞঙ মূলত একটি সামরিক জোট। রাশিয়ার উদ্যোগে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোকে নিয়েই এই ঈঝঞঙ গঠিত হয়েছে। স্পষ্টতই রাশিয়া ঈঝঞঙ-এর মাধ্যমে ডধৎংযধি ঞৎবধঃু ড়ৎমধহধুধঃরড়হ (গঠিত ১৯৫৫)-এর পুনর্জীবন করতে চাচ্ছে। একই সঙ্গে ঝঈঙ বা সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের কথাও উল্লেখ করা যায়। চিন সামরিক জোট ঝঈঙ-এর সদস্য। একই সঙ্গে মধ্য এশিয়ার মুসলিমপ্রধান দেশগুলোও এর সদস্য। দুটো কারণে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ আছে এ অঞ্চলে। এক. মধ্য এশিয়ার জ্বালানিসম্পদ। দুই. এ অঞ্চলে আল কায়েদা তথা ইসলামিক জঙ্গিদের উত্থান। এ অঞ্চলজুড়ে রয়েছে চিনেরও ঐতিহাসিক সম্পর্ক। তাই চিনের স্বার্থ অনেক বেশি। এ অঞ্চল থেকে চিন গ্যাস আমদানি করছে। মধ্য এশিয়ার গ্যাস অন্যত্র রপ্তানি করতে মার্কিন কোম্পানিগুলোর বড় বিনিয়োগ রয়েছে এ অঞ্চলে। ফলে এ অঞ্চলজুড়ে ২০১৫ সালে ব্যাপক তৎপরতা লক্ষ করা যাবে। এখানে আরও একটা কথা উল্লেখ করা যায়। চিনে রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তন এসেছে। ২০১৩ সালের মার্চে শি জিনপিং রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন লিকে কিয়াং। শি জিনপিং বেশ কিছুদিন ক্ষমতায় থাকবেন। তিনি আগামী দশকে চিনকে নেতৃত্ব দেবেন। তিনি আধুনিকমনস্ক একজন নেতা। তিনি চিনে কতটুকু সংস্কার আনেন, সেটাও দেখার বিষয়। বিশ্ব রাজনীতির অনেক কিছুই এখন চিনা নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করছে। কেননা অর্থনৈতিক মন্দার কবল থেকে বিশ্ব এখনো বের হয়ে আসতে পারেনি। ইউরোপীয় ইউনিয়নে মন্দাভাবা এখনো বিরাজ করছে। গ্রিস তার সংকট থেকে পুরোপুরিভাবে বের হয়ে আসতে পারেনি।
ভারতে নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়ে মোদির নেতৃত্বে সেখানে একটি সরকার গঠিত হয়েছে। নয়া সরকারের কর্মকা- এখনো কোনো বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম না দিলেও এটা বোঝা যাচ্ছে, নয়া সরকার দুই পরাশক্তি রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক ধরনের ‘ব্যালান্স’ করে চলেছে। একই সঙ্গে চিনা প্রেসিডেন্টের ভারত সফরের মধ্য দিয়ে মোদি সরকারের ব্যাপারে বড় শক্তিগুলোর আগ্রহ যে বেশি তা আবারও প্রমাণিত হলো। মোদি গেল সেপ্টেম্বরে (২০১৪) ওয়াশিংটনে ওবামার সঙ্গে বৈঠক করেছেন আর ওবামা জানুয়ারিতে (২০১৫) ভারত আসছেন এবং ‘রিপাবলিকান ডে’র অনুষ্ঠানে (২৫ জানুয়ারি) প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। এটা নিঃসন্দেহে বহির্বিশ্বে মোদি সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবে। এখন দেখার বিষয়, দুই পরাশক্তির সঙ্গে ব্যালান্স করে মোদি সরকার কীভাবে তার পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করে।২০১৫ সালে ইউক্রেন-রাশিয়া পরিস্থিতির দিকে লক্ষ্য থাকবে অনেকের। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়ার রাশিয়ার অন্তর্ভুক্তি ও পূর্ব ইউক্রেনে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের যথেষ্ট অবনতি হয়েছে। এ ঘটনায় রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু তাতে এ অঞ্চলের উত্তেজনা থামানো যায়নি। ইউক্রেন এক ধরনের ‘রাশিয়ান আগ্রাসনের’ মুখোমুখি রয়েছে। এতে করে ২০১৫ সালে ইউক্রেন যদি ন্যাটোতে যোগ দেয়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। রাশিয়া এটাকে দেখবে তাদের নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ হিসেবে। ফলে ২০১৫ সালে ইউক্রেন পরিস্থিতির দিকে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। ২০১৪ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় ব্যাপক হারে ‘ইবোলা’ মহামারী ছড়িয়ে পড়ায় তা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোচিত হয়। একই সঙ্গে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে সিআইএ কর্তৃক ব্যাপক নির্যাতনের খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনেরও অভিযোগ ওঠে। এই দুটো ঘটনা ২০১৫ সালেও আলোচিত হতে থাকবে। গণতন্ত্রের জন্য ২০১৪ সাল তেমন সুখবর ছিল না। থাইল্যান্ডে গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়লেও পাকিস্তানে ইমরান খানের আন্দোলনের মুখে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের আশঙ্কা থাকলেও সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেয়নি। ২০১৫ সালে বেশ কয়েকটি দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ২০১৪ সালের মতো ২০১৫ সালেও উত্তেজনা থাকবে এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য ২০১৫ সালের জন্য কোনো ভালো সংবাদ অপেক্ষা করছে না। Daily Amader Somoy 15.12.14

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি এবং শঙ্কা

লিমায় গত ১ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে বিশ্বের উষ্ণতারোধ সংক্রান্ত কপ-২০ সম্মেলন। ‘কপ’ বা Conference of the Parties জাতিসংঘ কর্তৃক আয়োজিত পরিবেশ সংক্রান্ত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন। গত বেশ ক’বছর ধরে এই ‘কপ’ সম্মেলন নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে। এবারের কপ-২০ সম্মেলনের গুরুত্ব এ কারণে বেশি যে, এই সম্মেলনেই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই অক্সাইড নির্মাণের পরিমাণ কী পরিমাণে হ্রাস করবে। বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ছে। এর জন্য দায়ী করা হচ্ছে কার্বন-ডাই অক্সাইডসহ অন্যান্য গ্রিন হাউস গ্যাসের মাত্রাতিরিক্ত নির্মাণকে। ইতোমধ্যেই সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, ২০১৫ সালের জুনে প্যারিসে যে কপ-২১ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সেখানে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হবে। অর্থাৎ কিয়োটো প্রটোকলের পর প্যারিস কপ-২১ সম্মেলনটি হবে উষ্ণতা রোধের জন্য একটি যৌথ প্রয়াস। কিয়োটো প্রটোকলের বাধ্যবাধকতা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। আর এ জন্যই নতুন একটি চুক্তি দরকার। এ জন্যই লিমা সম্মেলনের গুরুত্ব অনেক বেশি। এখানেই সমঝোতায় উপনীত হতে হবে। বিশ্বের পরিবেশ দ্রুত বদলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মতো সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশগুলো বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে রয়েছে।বন্যা, ঘূর্ণিঝড় আর টর্নেডো এখন যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোর পাশাপাশি বড় শহরগুলোও আক্রান্ত হচ্ছে। সারা বিশ্বই আজ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে। বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাস, বিশেষ করে কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পৃথিবী। ফলে সাগর-মহাসাগরে জন্ম হচ্ছে ঘূর্ণিঝড়ের, যা এক সময় প্রবল বেগে আছড়ে পড়ছে উপকূলে। ধ্বংস করে দিচ্ছে জনপদ। ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে উপকূলবর্তী গ্যাস, ছোট ছোট শহর। ‘মহাসেন’ ছিল সে রকম একটি ঘূর্ণিঝড়। এর আগে আমরা ‘সিডর’ ও ‘আইলা’র সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সমুদ্রে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়গুলোর নাম আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে। ইংরেজি বর্ণমালার ক্রমানুসারে কার্যকরণের সুযোগ পায় ভারত উপমহাসাগরভুক্ত ৮টি দেশ। প্রতিটি দেশকে ৪টি করে নাম পাঠাতে হয়। এর মধ্য থেকে একটি নাম বেছে নেয়া হয়। এক সময়ের শ্রীলঙ্কার রাজা মহাসেন ধ্বংস করেছিলেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অনেক ঐতিহ্য। সে কারণে ধ্বংসাত্মক ঝড়ের নাম রাখা হয়েছিল ধ্বংসের প্রতীক সেই রাজা ‘মহাসেন’-এর নামে। এদিকে এ অঞ্চল পরবর্তী ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ হয়েছে থাইল্যান্ডের দেয়া নামে। আর এর নাম ছিল ফাইলিন। ‘মহাসেন’-এর পর এলো ‘ফাইলিন’। এখন পরবর্তী ঘূর্ণিঝড়ের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। ঘূর্ণিঝড়ের পাশাপাশি অতিবন্যা, অসময়ে বন্যা এখন নিত্যনৈমেত্তিক ব্যাপার। যারা নিয়মিত সংবাদপত্র পাঠ করেন, তারা জানেন গেল বছর সীমান্তের ওপার থেকে নেমে আসা বিপুল পানির স্রোত বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত করে দিয়েছিল। দেশের প্রায় ১৭টি জেলা ওই বন্যায় আক্রান্ত হয়েছিল। হাজার হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বন্যায়। অকাল বন্যার অন্যতম কারণ হচ্ছে এই জলবায়ু পরিবর্তন। বিশ্বে উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে হিমালয়ে। সেখানে বরফ গলছে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে। আমাদের দেশের আবহাওয়াতেও পরিবর্তন আসছে। অসময়ে বৃষ্টি প্রমাণ করে পরিবেশ কীভাবে বদলে যাচ্ছে। যে সময় বৃষ্টি হওয়ার কথা, সে সময় বৃষ্টি হচ্ছে না। শীতের ব্যাপ্তি কমছে। মনে আছে গেল শীত আসতে আসতেই চলে গিয়েছিল। এর ফলে কৃষিতে সমস্যা হচ্ছে। উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের মানুষ লড়াকু। ‘সিডর’ ও ‘আইলা’র পর তারা বুঝে গেছে এই ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গেই তাদের বসবাস করতে হবে। লোনা পানি তাদের জীবনযাত্রার মান হুমকির মুখে ঠেলে দিলেও এই লোনা পানির সঙ্গে ‘যুদ্ধ’ করেই তারা বেঁচে আছে। প্রকৃতিই তাদের শিখিয়েছে কীভাবে সব ধরনের প্রতিকূলতার সঙ্গে তাদের বেঁচে থাকতে হয়। আগের চেয়েও উপকূল এলাকার মানুষ আজ অনেক সচেতন।আজ সারা বিশ্ব জানে বিশ্বের উষ্ণতা যে হারে বাড়ছে তাতে আগামীদিনে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতি বছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে প্রতি ৭ জনে ১ জন উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। এরা হচ্ছে জলবায়ু উদ্বাস্তু। আগামীতে বাংলাদেশের ১৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। বিশ্ববাসী জলবায়ু উদ্বাস্তুর সঙ্গে প্রথম পরিচিত হয় ২০০৫ সালে, যখন বাংলাদেশে ভোলার চরাঞ্চল থেকে ৫ লাখ মানুষ অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। ক্রিশ্চিয়ান পেনেনটি (Christian Penenti) তার প্রকাশিত হওয়া গ্রন্থ Tropic of Chaos: Climate change and the new geography of violence (2011) এ উল্লেখ করেছেন সে কথা। পেনেনটি আরো উল্লেখ করেছেন ২০৫০ সালের মধ্যেই ২২ মিলিয়ন অর্থাৎ ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল থেকে অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য হবে। আইপিসিসির রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশের কথা। অনেকের মনে থাকার কথা যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আলগোর পরিবেশের ব্যাপারে বিশ্ব জনমতের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ২০১২ সালের জানুয়ারিতে এন্টার্কটিকায় গিয়েছিলেন। আমাদের তৎকালীন পরিবেশমন্ত্রীকেও তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সেখানে। সেটা ঠিক আছে। কেননা বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে গেলে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ পর পর দু’বার বন্যা ও পরবর্তীকালে ‘সিডর’-এর আঘাতের সম্মুখীন হয়। এরপর ২০০৯ সালের মে মাসে আঘাত করে ‘আইলা’। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশে ব্যাপক খাদ্যদ্রব্যের ঘাটতি দেখা দেয়। দেশে খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যায়। অর্থনীতিতে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ‘সিডর’-এর পর বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টি বারবার বিশ্বসভায় আলোচিত হচ্ছে! সিডরের ক্ষতি ছিল গোর্কির চেয়েও বেশি। মানুষ কম মারা গেলেও সিডরের অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিল ব্যাপক। সিডরে ৩০ জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ছিল ৯টি জেলা। ২০০ উপজেলার ১ হাজার ৮৭১টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মোট ১৯ লাখ ২৮ হাজার ২৬৫ পরিবারের মধ্যে ৮৫ লাখ ৪৫ হাজার ৪৫৬ জন মানুষ সিডরের আঘাতপ্রাপ্ত ছিল। মারা গিয়েছিল ৩ হাজার ৩শ’র বেশি। তবে অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিল ব্যাপক। সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা। ‘সিডর’ ও ‘আইলা’র পর ‘মহাসেন’ বাংলাদেশে আঘাত করেছিল। যদিও এতে কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তার হিসাব আমরা পাব না কোনো দিনই। ‘সিডর’ ও ‘আইলা’র আঘাত আমরা এখনো পরিপূর্ণভাবে কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আইলার আঘাতের পর খুলনার দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছায় যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল তা দূর করা সম্ভব হয়নি। জলাবদ্ধতা কোথাও কোথাও ১ মিটার থেকে ৩ মিটার পর্যন্ত। আইলায় ৮০ ভাগ ফলদ ও বনজ গাছ মরে গিয়েছিল। দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে আজ নোনা পানির আগ্রাসন। সুপেয় পানির বড় অভাব ওইসব অঞ্চলে। এরপর ‘মহাসেন’ আমাদের আবারো ক্ষতিগ্রস্ত করে দিয়ে গিয়েছিল। আমাদের মন্ত্রী, সচিব কিংবা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা বিদেশ সফর ও সম্মেলনে অংশ নিতে ভালোবাসেন। কানকুন, ডারবান, কাতার কিংবা তারও আগে কোপেনহেগেনে (কপ সম্মেলন) আমাদের পরিবেশমন্ত্রী গেছেন। আমাদের কয়েকজন সংসদ সদস্য কোপেনহেগেনে প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন হাতে নিয়ে বিশ্বজনমত আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। আমরা পরিবেশ রক্ষায় তাতে বড় ধরনের আর্থিক সহায়তা পাইনি।বলা ভালো বাংলাদেশ এককভাবে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারে না। বাংলাদেশ এককভাবে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ও, তা সামগ্রিকভাবে বিশ্বের উষ্ণতা রোধ করতে খুব একটা প্রভাব রাখবে না। এ জন্য বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্তর্জাতিক আসরে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় বিদেশি সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে, কিন্তু এই সাহায্যের ওপর নির্ভর করা ঠিক নয়। পরিবেশ বিপর্যয় পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বড় ভূমিকা রয়েছে। গেলবার যে বন্যা হলো আবার আমাদের সে কথাটাই স্মরণ করিয়ে দিল। বন্যা, অতিবৃষ্টি,ঘূর্ণিঝড় এখন এ দেশে স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু ‘সিডর’ ও ‘আইলা’র আঘাতে আমাদের যা ক্ষতি হয়েছিল, সেই ক্ষতি সারাতে সরকারের বড় বড় উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় ১ হাজার ২৬৮ কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হলেও এখানে ‘রাজনীতি’ ঢুকে গেছে। দলীয় বিবেচনায় টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে (কালের কণ্ঠ ২৭ মে)। ভাবতে অবাক লাগে যেসব এনজিও জলবায়ু নিয়ে কাজ করেনি, যাদের কোনো অভিজ্ঞতাও নেই, শুধু দলীয় বিবেচনায় তাদের নামে টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। জলবায়ু তহবিলের অর্থ যাওয়া উচিত ওইসব অঞ্চলে, যেখানে ঘূর্ণিঝড়, প্লাবনের আঘাত বেশি আর মানুষ ‘যুদ্ধ’ করে সেখানে বেঁচে থাকে। অথচ দেখা গেছে জলবায়ুর জন্য বরাদ্দকৃত টাকা দেয়া হয়েছে ময়মনসিংহ পৌরসভাকে, মানিকগঞ্জের একটি প্রকল্পে কিংবা নীলফামারী তিস্তা বহুমুখী সমাজকল্যাণ সংস্থাকে। সিরাজগঞ্জের প্রগতি সংস্থাও পেয়েছে থোক বরাদ্দ। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের একটিরও জলবায়ু সংক্রান্ত কাজের কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। জলবায়ু তহবিলের টাকা বরাদ্দেও যদি ‘রাজনীতি’ ঢুকে যায়, তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু থাকতে পারে না। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী দেখা যায়, বরাদ্দ পাওয়া এনজিওগুলোর সঙ্গে সরকারি দলের নেতা ও কর্মীরা জড়িত। জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু দুর্নীতি যদি এখানেও স্পর্শ করে, তাহলে জলবায়ু ফান্ডে আর সাহায্য পাওয়া যাবে না। সচেতন হওয়ার সময় তাই এখনই। লিমা কপ-২০ সম্মেলনটি তাই কারণেই গুরুত্বপূূর্ণ বাংলাদেশের জন্য। কিন্তু বাংলাদেশসহ সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশগুলোর জন্য কোনো সুসংবাদ অপেক্ষা করছে কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। ইউরোপীয় ইউনিয়নযুক্ত দেশগুলো চাচ্ছে একটি স্থায়ী চুক্তি, যা কিয়োটো প্রটোকল বা চুক্তির স্থলাভিষিক্ত হবে। যদিও কিয়োটাতে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পরও তা কার্যকর করা যায়নি শিল্পোন্নত দেশগুলোর অসহযোগিতার কারণে। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রেসিডেন্ট ওবামার চীন সফরের সময় চীনের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যেখানে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই অক্সাইড নিগর্মন হ্রাস করার একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা একটা বড় অগ্রগতি। কেননা যুক্তরাষ্ট্র বারবার বলে আসছিল চীন ও ভারত যদি কার্বন নিঃসরণ হ্রাস না করে, তাহলে কোনো চুক্তিই কার্যকর করা যাবে না। গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের ব্যাপারেও কথা আছে। ১০ বিলিয়ন ডলারের ফান্ড গঠন করার সিদ্ধান্ত হলেও যুক্তরাষ্ট্র যে ৩ বিলিয়ন ডলারের নিশ্চয়তা দিয়েছিল, তা নিশ্চিত করেনি। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া ওয়াদা নিয়েও প্রশ্ন আছে। কেননা কংগ্রেস এখন আর ওবামার নিয়ন্ত্রণে নেই। ফান্ড বরাদ্দের ব্যাপারে ওবামার প্রতিশ্রুতি কংগ্রেস নাও শুনতে পারে। কংগ্রেস সদস্যরা বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষা করে।চলতি ২০১৪ সালকে বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণতম বছর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন ইতোমধ্যে বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকাতেও ছাপা হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কপ-২০ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এখন একটি সিদ্ধান্ত হবে এবং প্যারিসে আগামী বছর কপ-২১ সম্মেলনে তা স্বাক্ষরিত হবে, সে আশা রাখতে পারছি না। গত দু’মাস যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম। মেক্সিকোও গিয়েছিলাম। পরিবেশ যে কীভাবে বদলে যাচ্ছে, তা নিজ চোখে দেখেছি। নিউইয়র্কে নভেম্বর মাসে কখনো তেমন শীত পড়ে না। কিন্তু গত বছর থেকে পড়তে শুরু করেছে। নভেম্বরেই নিউইয়র্কের আবার স্টেট বাফেলো সাত ফুট বরফের নিচে চলে গিয়েছিল। সুতরাং একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি ঠেকাতে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখনই Daily Manobkontho 11.12.14

বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কোন পথে

সম্প্রতি বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে একজন সিনিয়র মন্ত্রীর মন্তব্য ও প্রধানমন্ত্রীর উক্তি একটি প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে, যা হল- এ দুই দেশের সম্পর্ক কি তলানিতে গিয়ে পৌঁছল? এমন কথাও বলা হচ্ছে কোনো কোনো মহল থেকে যে, বাংলাদেশ কি আবারও ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের মানসিকতায় চলে গেল? যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছিল। তখন বাংলাদেশ তার মিত্র খুঁজেছিল ভারত ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে। আজ এত বছর পর প্রধানমন্ত্রীর সেই ১৯৭১ সালের কথা স্মরণ করা কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করা সেই সন্দেহকে আবার উসকে দিল যে, বাংলাদেশ বুঝি ভারত-রাশিয়া অক্ষে ফিরে যাচ্ছে! সাম্প্রতিককালে বেশ কিছু ইস্যুতে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। জিএসপি সুবিধা বাতিল হওয়ায় বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেছে। এরপর একজন সিনিয়র মন্ত্রী যখন বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে কাজের মেয়ে মর্জিনা হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা বিসওয়ালকে দুআনার মন্ত্রী হিসেবে সম্বোধন করেন, তখন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের মনোভাব বুঝতে কষ্ট হয় না। এরপর গত ৫ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে কয়েকটি নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র পাশে না থাকলে বাংলাদেশ শেষ হয়ে যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশটি বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু তাতে সার্বভৌম বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা থেমে থাকেনি। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের নির্দেশেই বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করেছিল। শুধু তাই নয়। যুক্তরাষ্ট্র ৫ জানুয়ারির নির্বাচন যাতে না হয়, সেজন্য সব রকম চেষ্টা করেছে বলেও দাবি করেছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী সরকারপ্রধান; ধরে নেয়া হয় তার মন্তব্য সরকারেরই বক্তব্য। সুতরাং পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন এবং ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যখন মন্তব্য করেন, তখন এটাকে গুরুত্ব না দিয়ে পারা যায় না। দুটি বিষয়ই বেশ স্পর্শকাতর। তবে নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীর কাছে তথ্য-উপাত্ত আছে বলেই তিনি ওই মন্তব্য করেছেন। না হলে এরকম কোনো মন্তব্য তিনি করতে পারতেন না। কিন্তু যুগান্তর আমাদের জানাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে যুগান্তর এ সংবাদটি পরিবেশন করে।প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগের পেছনে সত্যতা যাই থাকুক, এ ধরনের মন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা দিতে বাধ্য। দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে উভয়েরই স্বার্থ রয়েছে। বাংলাদেশের যেমন স্বার্থ রয়েছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রও এ সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়।বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক চুক্তি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে একটি চুক্তির কথা উল্লেখ করা যায়। এটি হচ্ছে টিকফা। গত ২৫ নভেম্বর (২০১৩) অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় এ চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এ নিয়ে তখন প্রশ্নও উঠেছিল। বলা হয়েছিল, নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে এ চুক্তিটি না করিয়ে সরকার ভুল করেছে। এমনকি সংসদেও পরে চুক্তি নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি এবং কোনো আলোচনাও কখনও হয়নি। তবে টিকফা নিয়ে এখনও প্রশ্ন আছে। টিকফা বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থীÑ এমন প্রশ্ন উঠেছিল বাম রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে। সিপিবি ও বাসদ ঢাকায় ওই চুক্তির প্রতিবাদে একটি বিক্ষোভ মিছিলও করেছিল। কিন্তু সরকারের শরিক দুটি বাম দল জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি টিকফার বিরোধিতা করেনি। তাদের কোনো মন্তব্য আমার চোখে পড়েনি। চুক্তিটি সম্পর্কে আমরা যা জানতে পেরেছি তা হচ্ছে, এতে ১৬টি অনুচ্ছেদ আর ৭টি আর্টিকেল রয়েছে। প্রায় ৪২টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের এরকম চুক্তি রয়েছে বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব আমাদের জানিয়েছেন। অন্যদিক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনা জানিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ৫০টি দেশের এ রকম চুক্তি রয়েছে। তবে চুক্তির নামকরণের ব্যাপারে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। শুরুতে চুক্তির সঙ্গে এগ্রিমেন্ট শব্দটি থাকলেও বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা উঠায়, ফ্রেমওয়ার্ক শব্দটি বদলে ফোরাম শব্দটি যুক্ত করা হয়। বিভিন্ন মহল থেকে চুক্তিটির সঙ্গে জিএসপির একটা যোগসূত্র আছে বলা হলেও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদের জানিয়েছিলেন, টিকফার সঙ্গে জিএসপি বা শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের কোনো যোগসূত্র নেই। বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধার দাবি অব্যাহত রাখবে, এমনটিই জানিয়েছেন বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তবে বিষয়টির যে খুব সহসাই সমাধান হবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। কারণ বেশ কজন সিনেটর এক চিঠিতে জিএসপি সুবিধা স্থগিত রাখার অনুরোধ করেছিলেন। তারা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেছেন এমনটি আমাদের জানা নেই। ইতিমধ্যে দুদেশের মাঝে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক ধরনের শীতলতা আসায় জিএসপির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র নমনীয় হবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। ফলে বাংলাদেশী পণ্য, বিশেষ করে আরএমজি পণ্য জিএসপি সুবিধা ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করবে।এখানে বলা ভালো, ২০১৩ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্র কিছু পণ্যের যে শুল্কমুক্ত সুবিধা (জিএসপি) বাংলাদেশকে দিত, তা স্থগিত করে। স্থগিত করার পেছনে মূল কারণটি ছিল বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমমান নিশ্চিত করায় ব্যর্থতা। আশুলিয়ায় শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে না পারা, তৈরি পোশাক শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা না করার ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্র অসন্তুষ্ট ছিল। ফলে এক পর্যায়ে কংগ্রেস সদস্যদের চাপের মুখে জিএসপি সুবিধা স্থগিত হয়ে যায়। এরপর বাংলাদেশ সরকারের একটা প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায় যে, টিকফা চুক্তির পর যুক্তরাষ্ট্র হয়তো বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা ফিরিয়ে দেবে। প্রকৃতপক্ষে এর সঙ্গে টিকফা চুক্তির কোনো যোগসূত্র নেই। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, জিএসপি সুবিধা ফিরে পেলেও তাতে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পণ্যের রফতানি বাড়বে না। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে তৈরি পোশাকে জিএসপি সুবিধা চেয়ে আসছে। কিন্তু তৈরি পোশাকে আমাদের কোনো জিএসপি সুবিধা নেই। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পণ্যের বাজার হচ্ছে ৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের। এর মাঝে মাত্র ০.৫ ভাগ পণ্য এ শুল্কমুক্ত সুবিধা পেত। এর পরিমাণ মাত্র ২৬ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ প্রায় ৭৫০ মিলিয়ন ডলার কর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এখনও তার পণ্য নিয়ে টিকে আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় যেসব বাংলাদেশী পণ্যে তার মধ্যে রয়েছে তামাক, সিরামিক, ফার্নিচার, প্লাস্টিক, খেলনা ইত্যাদি। এসব পণ্যের খুব কমই বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করে। তৈরি পোশাকে বাংলাদেশী রফতানিকারকরা শতকরা ১৫ ভাগ হারে শুল্ক পরিশোধ করে বাজার ধরে রেখেছে। অথচ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দোহা চুক্তি অনুযায়ী স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে তার পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা দিচ্ছে না। এ সুবিধা উন্নত রাষ্ট্রগুলো পায়। তৈরি পোশাকে শুল্কমুক্ত সুবিধা না দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দোহা চুক্তি লংঘন করেছে। সুতরাং তৈরি পোশাকে আমরা যদি শুল্কমুক্ত সুবিধা না পাই, তাহলে জিএসপি সুবিধা রফতানির ক্ষেত্রে কোনো বড় অবদান রাখতে পারবে না। আজ যদি জিএসপি সুবিধার আশ্বাসে আমরা টিকফা করে থাকি, তাতে আমাদের উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। টিকফার সঙ্গে তাই জিএসপি সুবিধাকে মেলানো যাবে না। জিএসপি সুবিধা একটি ভিন্ন বিষয়।এখন যে প্রশ্নটি অনেকে করার চেষ্টা করেন তা হচ্ছে, টিকফা স্বাক্ষর করে আমরা কতটুকু উপকৃত হলাম? টিকফা স্বাক্ষরিত হওয়ায় দেশে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়বে, এটা সত্য কথা। এতে করে আমাদের বাজার, সেবা খাত উন্মুক্ত হয়ে যাবে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের জন্য। ব্যাপক প্রাইভেটাইজেশন ঘটবে, তাতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্যক্তিগত খাত। টিকফার ৫ ও ১৯ ধারা মতে, উভয় দেশ (বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র) বাণিজ্যে বেশ নমনীয় নীতি গ্রহণ করবে এবং ব্যাপক বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করবে। ৮নং ধারায় ব্যাপক ব্যক্তিগত খাত প্রসারের কথা বলা হয়েছে। এ ধারায় একটি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিশন গঠন করার কথাও আছে। এদের কাজ হবে ব্যক্তিগত খাত কীভাবে আরও বিকশিত করা যায়, সে ব্যাপারে উভয় সরকারকে উপদেশ দেয়া। ৯নং ধারায় বলা আছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে; কিন্তু উৎপাদন খাতে জড়াবে না। অর্থাৎ কোনো পণ্য উৎপাদন করবে না। এখানে সমস্যা হবে অনেকগুলো। এক. যুক্তরাষ্ট্রের কম্পানিগুলো বিনিয়োগ করবে (বিশেষ করে সেবা খাতে) এবং ওই সব কোম্পানিকে ট্যাক্স সুবিধা দিতে হবে। আইনে যদি কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, তাহলে বাংলাদেশকে সেই আইন সংশোধন করতে হবে। ফলে স্থানীয় উদ্যোক্তারা মার খাবে। তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। দুই. চুক্তির ফলে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোকে নিরাপত্তা দিতে বাধ্য থাকবে। জ্বালানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দর ব্যবহার, টেলি কমিউনিকেশন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ খাতে বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়ায় এসব খাতে সরকারি বিনিয়োগ কমে যাবে। ফলে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শিক্ষা খাতে সরকারি বিনিয়োগ কমে গেলে এ খাত পণ্যে পরিণত হবে। বিনামূল্যের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হবে। উচ্চশিক্ষা ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। এতে করে শিক্ষা ক্ষেত্রে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হওয়ার আশংকা রয়েছে। যারা ধনী তারা শিক্ষা গ্রহণ করবে, আর যারা গরিব তারা শিক্ষা, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে। একই কথা প্রযোজ্য স্বাস্থ্যখাতের ক্ষেত্রেও। এ খাতে খরচ বেড়ে যাবে। এসব সেবামূলক খাত থেকে সাধারণ মানুষ যে সেবা পেত, তা ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসবে। সেবার জন্য সাধারণ মানুষকে তখন বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানির দাম বেড়ে যাবে। সাধারণ গ্রাহককে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিংবা গ্যাস কিনতে হবে। সরকারি ভর্তুকির কোনো সুযোগ থাকবে না। তবে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে থাকবে কৃষি ও আইটি সেক্টর। কৃষিতে যে সরকার ভর্তুকি দেয়, তা আর দিতে পারবে না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দোহা চুক্তিতে বলা হয়েছিল, স্বল্পোন্নত দেশগুলো কৃষিতে ৫ ভাগের বেশি ভর্তুকি দিতে পারবে না। টিকফার ১৮নং ধারায় বলা হয়েছে, কৃষিতে ভর্তুকির পরিমাণ কমাতে হবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র নিজে কৃষিতে ভর্তুকি দেয় ৯ ভাগ। এখন বাংলাদেশে কৃষি সেক্টরে ভর্তুকি কমানো হলে কৃষিতে মারাÍক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। কৃষক উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। ফলে কৃষি উৎপাদন, বিশেষ করে চাল উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে।সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ যে চুক্তি করেছে তাতে দেশের প্রাপ্তি খুব বেশি নয়। তারপরও বাংলাদেশ এ চুক্তি করেছে। ফলে যেহেতু বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন স্বার্থ রয়েছে, সেহেতু মন্ত্রী কিংবা প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের পর সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটবে, এটা আমি মনে করি না। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, এ ধরনের মন্তব্য অনাকাক্সিক্ষত। বিদায়ী রাষ্ট্রদূতকে কাজের মেয়ে মর্জিনা বলা কূটনৈতিক শিষ্টাচার পরিপন্থী। একজন সিনিয়র মন্ত্রী হলেন রোল মডেল; তিনি যদি কর্মীদের মতো আচরণ করেন, তাহলে তা মন্ত্রী পদের প্রতি অসম্মান করা হয় বৈকি। মজিনার বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। সেক্ষেত্রে কূটনৈতিক চ্যানেলেই এর প্রতিবাদ হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। সেটাই কূটনৈতিক শিষ্টাচার। ঠিক তেমনি নিশা দেশাইকে দুআনার মন্ত্রী বলাও দুঃখজনক। আমরা ভুলে যাই এ ধরনের মন্তব্য দূতাবাসগুলো খুব গুরুত্বের সঙ্গে নেয়। তবে সেই সঙ্গে এটাও ঠিক, বিদেশী দাতাগোষ্ঠী অকারণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে বারবার মন্তব্য করছে। এটা শোভন নয়। তবে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। আমরা নিশ্চয়ই তথাকথিত টুয়েস ডে গ্র“পের কথা মনে করতে পারি। আসলে আমরাই কি বিদেশীদের আমাদের রাজনীতিতে নাক গলানোর সুযোগ করে দিইনি? আমরা কি অতীতে চিঠি লিখে সাহায্য বন্ধ করতে বলিনি? দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা সুযোগ পায় বলেই বারবার মন্তব্য করে।আরও একটা কথা। প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের পর এটা ভাবা ঠিক হবে না যে, বাংলাদেশ সেই একাত্তর সালের মানসিকতায় ফিরে যাচ্ছে। সেই সুযোগও নেই। রাশিয়া এখনও বিশ্ব শক্তিতে পরিণত হতে পারেনি, যেমনটি পেরেছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। তার অর্থনৈতিক ভিত্তি দুর্বল। ফলে বাংলাদেশের উন্নয়নে রাশিয়ার মডেল হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বাংলাদেশ প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা দিয়ে রাশিয়া থেকে অস্ত্র কিনছে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, বাংলাদেশ রাশিয়ার ব্লকে চলে গেছে। প্রধানমন্ত্রী ও একজন মন্ত্রীর বক্তব্যের রেশ ধরে দুদেশের মাঝে সম্পর্কের ক্ষেত্রে উষ্ণতা কিছুটা হ্রাস পেলেও সম্পর্কের অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক স্বার্থ রয়েছে। দু-একটি মন্তব্যের কারণে যুক্তরাষ্ট্র সে স্বার্থ জলাঞ্জলি দেবে না। Daily Jugantor 11.12.14

শুধু ছিটমহল বিনিময়ই যথেষ্ট নয়

শেষ পর্যন্ত বিরোধপূর্ণ ১৬২টি ছিটমহল বাংলাদেশ ও ভারতের মাঝে বিনিময় হতে যাচ্ছে। ভারতের লোকসভার সংসদীয় কমিটি প্রস্তাবিত বিলটির অনুমোদন দিয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, চলতি শীতকালীন অধিবেশনে বিলটি পাস হবে এবং সংবিধান সংশোধনের বিষয়টি অনুমোদিত হবে। এর আগে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি নীতিগতভাবে ছিটমহল বিনিময়ে তাদের আপত্তি প্রত্যাহার করে নিলে বিলটি সংসদে পাস হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়। নিঃসন্দেহে এটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মাঝে আরও বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। তার যদি সমাধান না হয়, তাহলে দু'দেশের সম্পর্ককে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। আমরা দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ করেছি, সমস্যাগুলো জিইয়ে রেখে ভারত এ থেকে সুবিধা নিচ্ছে। ভারতে কংগ্রেস সরকার দীর্ঘদিন সমস্যাগুলোর সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং কিংবা রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির ঢাকা সফরের পরও সমস্যাগুলো যা ছিল, তা রয়ে গিয়েছিল। এক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতাসীন হয়ে ছিটমহল সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নিলেন, নিঃসন্দেহে এটা প্রশংসার যোগ্য। বাংলাদেশ বারবার প্রত্যাশা করেছে, সমস্যাগুলো সমাধানের ব্যাপারে ভারত আরও আন্তরিক হোক। কিন্তু অতীতে কোনো সদিচ্ছা আমরা লক্ষ করিনি। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর গেল সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ থেকে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল ভারত সফর করেছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলটি জিসিসি বা ভারত-বাংলাদেশ যৌথ পরামর্শক কমিটির তৃতীয় সভায় যোগ দিয়েছিল। জিসিসির সভায় কয়েকটি সিদ্ধান্ত হয়েছিল। চেন্নাই হয়ে কলকাতা, অতঃপর বাংলাদেশের মংলা ও চট্টগ্রাম সমুদ্র উপকূল পথকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত জাহাজ চলাচলের উপযোগী করা। এটা হয়তো ভালো। তাতে করে বাংলাদেশ-ভারত সামুদ্রিক বাণিজ্য সম্প্রসারিত হবে। এতে করে বাংলাদেশ কতটুকু লাভবান হবে, তা ভবিষ্যতের ব্যাপার। সিঙ্গাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারিত এ বাণিজ্য রুট (?) বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের কতটুকু আকৃষ্ট করতে পারবে, এটাও একটা প্রশ্ন। বাংলাদেশ ভারতীয় ব্যবসায়ীদের জন্য একাধিক রফতানি প্রক্রিয়াজাত অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব দিয়েছিল। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এটা কি গ্রহণ করবেন? মনে হয় না। কারণ তারা চান ব্যবসা করতে। সহজ-সরল কথায় জিনিস বিক্রি করতে। পুঁজি বিনিয়োগ তারা করবেন না। ফলে বাংলাদেশের ওই প্রস্তাব কাগজ-কলমে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। গুয়াহাটি-শিলং-ঢাকা বাস সার্ভিস চালুর বিষয়টি কিংবা মৈত্রী ট্রেনের বগির সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়টি এর আগে আলোচিত হয়েছে। এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু মৈত্রী ট্রেনে কেন যাত্রী বাড়ছে না, এ বিষয়টি তলিয়ে দেখা হয়নি। বাংলাদেশী যাত্রীরা মৈত্রী ট্রেনের যাত্রা পছন্দ করেন। কিন্তু 'যাত্রী হয়রানি' বন্ধ না হলে বগির সংখ্যা বাড়িয়েও কোনো লাভ হবে না। গুয়াহাটি-শিলং বাস সার্ভিস শুনতে ভালো শোনায়। কিন্তু এ রুটের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কে করবে? কবে হবে এসব কাজ- এসব ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ভাঙা পথে এসি বাস চললে, তাতে যাত্রী পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় রয়েছে অনেক। যেমন- তিস্তার পানি বণ্টন, টিপাইমুখ বাঁধ, সীমান্ত হত্যা বন্ধ, স্থলসীমানা নির্ধারণ, শুল্ক কমানো ও বাংলাদেশী পণ্যের পরিমাণ বাড়ানো, ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প, বন্দি বিনিময় ইত্যাদি। কোনো একটি বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট 'সিদ্ধান্ত' নেই। জিসিসির সভার পর যৌথ ইশতেহারে বলা হয়েছিল, তিস্তার পানি ভাগাভাগির বিষয়ে আগের প্রতিশ্রুতিতে অটল থাকবে ভারত। এটা কূটনীতির ভাষা। এটা আশ্বাস। এ আশ্বাসে আমাদের সন্তুষ্ট হওয়ার কথা নয়। আমরা আমাদের ন্যায্য হিস্যা চাই। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্যা মমতা ব্যানার্জিকে নিয়ে। মমতার জন্য তিস্তার পানি একটি 'রাজনৈতিক ইস্যু'। ২০১৬ সালে সেখানে বিধান সভার নির্বাচন। লোকসভার নির্বাচনে তৃণমূলের পক্ষে বেশি ভোট পড়েছে। সুতরাং তিস্তা তার জন্য একটা ইস্যু। এটা তিনি আবারও ব্যবহার করবেন। দিলি্লকে তিনি ছাড় দেবেন না এতটুকুও। তবে সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে তিনি বেকায়দায় আছেন। তৃণমূল-জামায়াত সম্পর্কের বিষয়টি মাহমুদ আলী-অজিত দোভালের আলোচনায় এসেছিল। সিবিআই তদন্ত করছে। এখন এ সারদা কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র কীভাবে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করবে, সেটাই দেখার বিষয়। তবে ২০১৬-এর আগে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে কোনো সমঝোতার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ভারতীয় অনলাইন সংবাদ সংস্থা ২৪ ঘণ্টা ২১ সেপ্টেম্বর তারিখে আমাদের জানিয়ে দিয়েছিল, 'তিস্তার জল ও স্থল সীমান্ত চুক্তি নিয়ে জটিলতার অবসান হয়নি।' সীমানা চিহ্নিত করার একটি উদ্যোগ নিয়েছিল সাবেক মনমোহন সরকার। রাজ্যসভায় একটি বিলও উপস্থাপিত হয়েছিল। এখন তা অনুমোদিত হলো। তবে এটাই শেষ কথা নয়। আর তিস্তা নিয়ে বলা হয়েছিল, 'সব দলের (অর্থাৎ তৃণমূলের সঙ্গে!) সঙ্গে ঐকমত্যে পেঁৗছার চেষ্টা চলছে।' অর্থাৎ আশ্বাস। চেষ্টা চলছে! এসবই কূটনীতির ভাষা। বলা ভালো বাংলাদেশের ভেতরে রয়েছে ১১১টি ভারতীয় ছিটমহল, আর ভারতে রয়েছে ৫১টি বাংলাদেশী ছিটমহল। এরা কেউ ভারতের সঙ্গে থাকতে চায়, কেউ চায় বাংলাদেশের সঙ্গে থাকতে। স্থানীয় বিজেপি আবার এর বিরোধী। আসাম বিজেপিও স্থল সীমানা চিহ্নিতকরণের পক্ষে ছিল না। তাদের আপত্তি ছিল প্রচুর। কেননা এতে করে ৬০০ একর জমি বাংলাদেশের কাছে চলে যাবে। এতেই আপত্তি ছিল আসাম বিজেপির। কিন্তু এখন তারা তাদের আপত্তি তুলে নিল। নরেন্দ্র মোদি আসামে এসেই ছিটমহল বিনিময়ের ঘোষণা দিলেন। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের বিষয়ে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হয়, এমন কোনো পদক্ষেপ না নেয়ারও আশ্বাস দিয়েছিল ভারত সরকার- এটা বাংলাদেশীদের জন্য সুখবর। আমরা এটা জেনেছি একটি সংবাদ মাধ্যমের নয়াদিল্লি থেকে পাঠানো প্রতিবেদন থেকে। কিন্তু যতদূর জানা যায়, মোদি ক্ষমতা গ্রহণ করে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ভারতের সুপ্রিমকোর্টের একটি রায়ও আছে মোদির পক্ষে। বাংলাদেশ বারবার আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে যে ক্ষতি হবে, সে কথা বলে আসছে। এখন প্রকাশিত বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। সত্যিকার অর্থেই ভারত যদি এ প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে না যায়, তাহলে তাতে ভারতের পরিবেশবাদীরাই যে খুশি হবেন, তা নয়। বরং বাংলাদেশ বড় ধরনের পানি-সঙ্কট থেকে রক্ষা পাবে। একই কথা প্রযোজ্য টিপাইমুখ বাঁধের ক্ষেত্রেও। মোদি সরকার সাবেক মনমোহন সিং সরকারের দেয়া বক্তব্যই উল্লেখ করেছে মাত্র। তাদের ভাষায়, ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভারতে এরই মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে এবং ভারত সরকার ৯ হাজার কোটি রুপি খরচও করে ফেলেছে। এ অর্থ তাহলে ব্যয় হলো কোথায়? গঙ্গা চুক্তি নিয়েও আলোচনার প্রয়োজন আছে। কেননা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ পানি পাচ্ছে না। চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালে। জনসংখ্যা তখন বাড়বে তিনগুণ। পানির চাহিদাও বাড়বে। সুতরাং চুক্তিতে পর্যালোচনার যে সুযোগ রয়েছে, বাংলাদেশের উচিত এ ব্যাপারে ভারতকে রাজি করানো। অনুপ চেটিয়াকে (উলফা নেতা ও বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী) ফেরত দেয়া ও নূর হোসেনকে (নারায়ণগঞ্জ ৭ খুনের আসামি) ফেরত আনার বিষয়টিও আলোচনায় রয়েছে। নূর হোসেন কলকাতায় একটি অপরাধ করেছেন। সেই অপরাধে তার বিচার হচ্ছে। এখন বিচার চলাকালীন তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো যাবে কিনা- এটা একটা আইনগত প্রশ্ন। তবে অনুপ চেটিয়ার সঙ্গে এ বিষয়টিকে মেলান যাবে না। অনুপ চেটিয়া নিজেই ভারতে যেতে চেয়েছেন! সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও। সিদ্ধান্ত হয়েছে, সীমান্তবর্তী জেলার জেলা প্রশাসকরা আগামীতে দিলি্লতে মিলিত হবেন। কিন্তু তাতে সীমান্ত হত্যা বন্ধ হবে কি? যেদিন জেসিসির বৈঠক চলছিল, সেদিনও বিএসএফের গুলিতে তিনজন বাংলাদেশী আহত হয়েছিলেন। মোদি নেপাল, ভুটান, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও বাংলাদেশকে নিয়ে উপআঞ্চলিক জোটের যে ধারণা দিয়েছেন, তাতে মিয়ানমারের অন্তর্ভুক্তিও চাচ্ছেন। এতে করে নতুন একটা জোট গঠিত হতে পারে। যদিও বিসিআইএম জোট (বাংলাদেশ, চীন, ভারত, মিয়ানমার) কাজ করছে এবং বাংলাদেশ এ জোট কার্যকর করার জন্য বড় ভূমিকা পালন করছে। এখন মোদির প্রস্তাবিত নয়া জোটের সঙ্গে বিসিআইএমের কী ভূমিকা থাকবে, সেটা একটা প্রশ্ন হয়েই রইল। দু'দেশের বাণিজ্য ছয় বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার কথা বলা হচ্ছে; কিন্তু ভারতে বাংলাদেশের পণ্যের সম্প্রসারণে কোনো উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে না। ট্যারিফ ও প্যারা-ট্যারিফের কারণে বাংলাদেশী পণ্য ভারতে বাজার পাচ্ছে না। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির ব্যাপারে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। আমরা ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছি। আরও ৫০০ মেগাওয়াটের প্রতিশ্রুতি মিলেছে। আসলে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করতে হবে আঞ্চলিক ভিত্তিতে। বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান ও ভারত সম্মিলিতভাবে বিনিয়োগ করে হিমালয় অঞ্চলে বিপুল বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে; কিন্তু ভারত এটা করছে দ্বিপক্ষীয়ভাবে। আজ ভারত ছিটমহল বিনিময় চুক্তিটি কার্যকর করতে যাচ্ছে। দীর্ঘ ৪০ বছর পর এ চুক্তিটি কার্যকর হলে, তা দু'দেশের সম্পর্ককে নতুন একটি মাত্রা দেবে। তবে অন্য সমস্যাগুলোর সমাধান যদি না হয়, তাহলে ভারতের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। তাই শুধু ছিটমহল বিনিময়ই যথেষ্ট নয়। ভারতকে আরও আন্তরিক হতে হবে। আমাদের তাকাতে হবে সামনের দিকে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এ অঞ্চলের রাজনীতিকে পরিপূর্ণভাবে বদলে দিতে পারে। এক্ষেত্রে ভারতকে দ্বিপাক্ষিকতার বেড়াজাল থেকে বের হয়ে আসতে হবে। দ্বিপাক্ষিকতা নয়, দরকার বহুপাক্ষিকতা। বাংলাদেশ বহুপাক্ষিকতায় বিশ্বাসী। কিন্তু ভারতের আদর্শ হচ্ছে দ্বিপাক্ষিকতা। অর্থাৎ দ্বিপাক্ষিকতার আলোকেই ভারত সমস্যাগুলোর সমাধান চায়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার যে সমস্যা, তা দ্বিপাক্ষিকতার চেয়ে বহুপাক্ষিকতার আলোকে সমাধান করা শ্রেয়। ভারতকে এ বিষয়টি বোঝাতে হবে। ভারত ছিটমহল সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে। এটা ভালো। এখন যদি অন্যান্য সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নেয়, তাহলে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে একটি বড় ধরনের গুণগত পরিবর্তন আসবে। তাই মোদি সরকারের কাছে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। Daily Alokito Bangladesh 09.12.14