বিশ্বের
উষ্ণতা রোধকল্পে জাতিসংঘ কর্তৃক আয়োজিত 'কপ' (কমিটি অব দ্য পার্টিস)
সম্মেলন শেষ হয়েছে ১৪ ডিসেম্বর। একটি আংশিক সমঝোতার কথা পত্রিকায় ছাপা
হয়েছে। ১৯৬টি রাষ্ট্রের অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে কপ-২০ সম্মেলনটি শেষ হয়েছে
বটে, কিন্তু অনেক প্রশ্ন রেখে গেছে। 'আংশিক সমঝোতা'র বিষয়টি নিঃসন্দেহে
ভালো। কিন্তু বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে এই 'সমঝোতা' কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে
না। এই সমঝোতার ফলে আগামী বছর, অর্থাৎ ২০১৫ সালে প্যারিস সম্মেলনে (কপ-২১)
একটি চুক্তি সামনের স্বাক্ষরের পথ প্রশস্ত হবে, এটা সত্য। কিন্তু এতে
বিশ্বের উষ্ণতা কতটুকু রোধ হবে, কিংবা গরিব দেশগুলো, বিশেষ করে সাগরপাড়ের
দেশগুলো যে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, সেই ঝুঁকি তারা কতটুকু কাটিয়ে উঠতে পারবে,
সে প্রশ্ন রয়েই গেল। অনেক নীতিগত প্রশ্নে, বিশেষ করে জলবায়ু সমস্যা
মোকাবেলায় উন্নত দেশগুলো কর্তৃক উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সাহায্য,
জলবায়ু সমস্যা মোকাবেলায় 'টেকনোলজি ট্রান্সপার' কিংবা উন্নত বিশ্ব কর্তৃক
সুনির্দিষ্টভাবে কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ হ্রাস_ এসব প্রশ্নে কোনো
সিদ্ধান্ত হয়নি। 'আংশিক সমঝোতা'য় বলা হয়েছে আগামী ৬ মাসের মধ্যে পরিবেশে
কার্বন নিঃসরণ কমাতে প্রতিটি দেশ নিজস্ব কর্মপদ্ধতি ও কাঠামো উপস্থাপন
করবে। এটা একটা বিভ্রান্তিকর বক্তব্য। প্রতিটি দেশকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে
নিজস্ব কর্মপদ্ধতি উদ্ভাবন করার। অর্থাৎ তারা নিজেরাই কার্বন নিঃসরণ কমানোর
পন্থা বের করবে। লিমা সম্মেলনে আবারো দেখা গেল ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে
মতপার্থক্য। গরিব দেশগুলোর দাবি ছিল আর্থিক সহযোগিতা বাড়ানোর। কেননা
বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য ধনী দেশগুলো দায়ী। সুতরাং দায়িত্ব তাদের নিতে
হবে। অন্যদিকে উন্নত বিশ্বের দাবি চীন ও ভারতের মত দেশ বিশ্বের শীর্ষ
কার্বন নিঃসরণকারী দেশে পরিণত হয়েছে। সুতরাং কার্বন নিঃসরণে এসব দেশের
দায়িত্ব অনেক বেশি। এ বিতর্ক অনেক পুরনো। অতীতের প্রতিটি সম্মেলনে এ ধরনের
বক্তব্য আমরা শুনেছি। কিন্তু কোনো সমঝোতা হয়নি। এবার লিমাতেও হলো না।
যে 'আংশিক সমঝোতা'র কথা আমরা জানতে পেরেছি, তা আমাদের কী মেসেজ দিয়ে গেল?
জলবায়ু পরিবর্তনে যে কটি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
বাংলাদেশের উপকূলে প্রতিবছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত ২০
বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। বাংলাদেশের ১৭ ভাগ
এলাকা সমুদ্রের গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে আগামীতে। আইপিসিসির
রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশের কথা। অনেকের মনে থাকার কথা
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আলগোর পরিবেশের ব্যাপারে বিশ্ব
জনমতের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ২০১২ সালের জানুয়ারিতে অ্যান্টার্কটিকায়
গিয়েছিলেন। আমাদের তৎকালীন পরিবেশ মন্ত্রীকেও তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন
সেখানে। তা ঠিক আছে। কেননা বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে গেলে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত
হবে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ পর পর দুই বার
বন্যা ও পরে 'সিডর'-এর আঘাতের সম্মুখীন হয়। এরপর ২০০৯ সালের মে মাসে আঘাত
করে 'আইলা'। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশে খাদ্যদ্রব্যের ব্যাপক ঘাটতি দেখা দেয়।
দেশে খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যায়। অর্থনীতিতে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
'সিডর'-এর পর বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টি বার বার বিশ্ব সভায়
আলোচিত হচ্ছে। সিডরের ক্ষতি ছিল গোর্কির চেয়েও বেশি। মানুষ কম মারা গেলেও
সিডরের অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিল ব্যাপক। সিডরে ৩০ জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর
মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ছিল নটি জেলা। ২০০ উপজেলার ১ হাজার ৮৭১টি ইউনিয়ন
ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মোট ১৯ লাখ ২৮ হাজার ২৬৫ পরিবারের ৮৫ লাখ ৪৫ হাজার ৪৫৬ জন
মানুষ সিডরের আঘাতপ্রাপ্ত ছিল। মারা গিয়েছিল ৩ হাজার ৩০০-এর বেশি। তবে
অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিল ব্যাপক। সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছিল ১৬ হাজার
কোটি টাকা। 'সিডর' ও 'আইলা'র পর 'মেসেজ' বাংলাদেশে আঘাত করেছিল। যদিও এতে
কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তার হিসাব আমরা পাব না কোনোদিনই। 'সিডর' ও 'আইলা'র
আঘাত আমরা এখনো পরিপূর্ণভাবে কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আইলার আঘাতের পর খুলনার
দাকোপা, কয়রা ও পাইকগাছায় যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা দূর করা সম্ভব
হয়নি। জলাবদ্ধতা কোথাও কোথাও ১ মিটার থেকে ৩ মিটার পর্যন্ত। আইলায় ৮০ ভাগ
ফলদ ও বনজ গাছ মরে গিয়েছিল। দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে আজ লোনা পানির আগ্রাসন। সুপেয়
পানির বড় অভাব ওইসব অঞ্চলে। এরপর 'মহাসেন' আমাদের আবারো ক্ষতিগ্রস্ত করে
দিয়েছিল।
আমাদের মন্ত্রী, সচিব কিংবা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা বিদেশ সফর ও সম্মেলনে অংশ নিতে ভালোবাসেন। কানকুন, ডারবান, কাতার, কিংবা তারও আগে কোপেনহেগেনে (কপ সম্মেলন) আমাদের পরিবেশমন্ত্রী গেছেন। আমাদের কয়েকজন সংসদ সদস্য কোপেনহেগেনে প্লাকার্ড ও ফেস্টুন হাতে নিয়ে বিশ্বজনমত আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। আমরা পরিবেশ রক্ষায় তাতে বড় ধরনের আর্থিক সহায়তা পাইনি।
বলা ভালো বাংলাদেশ এককভাবে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনরোধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে না। বাংলাদেশ এককভাবে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ও তা সামগ্রিকভাবে বিশ্বের উষ্ণতা রোধ করতে খুব একটা প্রভাব রাখবে না। এ জন্য বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্তর্জাতিক আসরে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় বিদেশি সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। কিন্তু এই সাহায্যের ওপর নির্ভর করা ঠিক নয়। পরিবেশ বিপর্যয় পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বড় ভূমিকা রয়েছে। গেলবার যে বন্যা হলো আবার আমাদের সে কথাটাই স্মরণ করিয়ে দিল। বন্যার অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় এখন এ দেশে স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু 'সিডর' ও আইলার আঘাতে আমাদের যা ক্ষতি হয়েছিল সে ক্ষতি সারাতে সরকারের বড়সড় উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় ১ হাজার ২৬৮ কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হলেও এখানেও 'রাজনীতি' ঢুকে গেছে। দলীয় বিবেচনায় টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে (কালের কণ্ঠ ২৭ মে)। ভাবতে অবাক লাগে যেসব এনজিও জলবায়ু নিয়ে কাজ করেনি, যাদের কোনো অভিজ্ঞতাও নেই, শুধু দলীয় বিবেচনায় তাদের নামে টাকা বরাদ্দ ধরা হয়েছে। জলবায়ু তহবিলের অর্থ পাওয়া উচিত ওইসব অঞ্চলে যেখানে ঘূর্ণিঝড়, প্লাবনের আঘাত বেশি আর মানুষ 'যুদ্ধ' করে সেখানে বেঁচে থাকে। অথচ দেখা গেছে, জলবায়ুর জন্য বরাদ্দকৃত টাকা দেয়া হয়েছে ময়মনসিংহ পৌরসভাকে, মানিকগঞ্জের একটি প্রকল্পে কিংবা নীলফামারী তিস্তা বহুমুখী সমাজকল্যাণ সংস্থাকে। সিরাজগঞ্জের প্রগতি সংস্থাও পেয়েছে থোক বরাদ্দ। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের একটিরও জলবায়ুসংক্রান্ত কাজের কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। জলবায়ু তহবিলের টাকা বরাদ্দেও যদি 'রাজনীতি' ঢুকে যায় তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু থাকতে পারে না। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী দেখা যায়, বরাদ্দ পাওয়া এনজিওগুলোর সঙ্গে সরকারি দলের নেতা ও কর্মীরা জড়িত। জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু দুর্নীতি যদি এখানেও স্পর্শ করে তাহলে জলবায়ু ফান্ডে আর সাহায্য পাওয়া যাবে না। সচেতন হওয়ার সময় তাই এখনই। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারে সারা বিশ্বে একটা উদ্বিগ্নতা থাকলেও আমরা কতটুকু সচেতন তা নিশ্চিত নই। আমরা বার বার বিদেশ থেকে প্রাপ্ত সাহায্যের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। পরিবেশ দূষণ হয়, এমন কর্মকা-ের ওপর আমরা গুরুত্ব দিয়েছি কম। বিদেশ থেকে যে সাহায্য পাওয়া গেছে, তাতে দুর্নীতি রোধ করতে পারিনি। এমনকি সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রামপালে ভারতীয় কয়লায় একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছি। এ নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে বড় বিতর্ক থাকলেও সরকার ইতোমধ্যেই ১ হাজার ৮৪৭ একর জমি অধিগ্রহণ করেছে। এ কাজে ভারত থেকে বছরে ৪ মিলিয়ন টন কয়লা আমদানি করা হবে। অথচ বিশ্বব্যাপী এটা স্বীকৃত যে, কয়লা পোড়ালে বায়ুম-লে সবচেয়ে বেশি কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমন হয়। এখন লিমা সমঝোতায় বলা হয়েছে, প্রতিটি দেশকে 'নিজস্ব কর্মপদ্ধতি' নির্ধারণ করতে হবে। যেখানে কার্বন নিঃসরণ আমরা কমাতে চাই, সেখানে কি কয়লা পুড়িয়ে কার্বন নিঃসরণ বাড়াব? খুব সঙ্গত কারণেই 'লিমা সমঝোতার' পর রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। আমরা বার বার বলে আসছি, বাংলাদেশকে নিজস্ব উদ্যোগেই কার্বন নিঃসরণ রাখতে হবে। ইটের ভাটায় কয়লা পোড়ানো কমাতে হবে। এখানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। সোলার এনার্জি ও বায়ু বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতে হবে। সোলার প্রযুক্তির সম্ভাবনা থাকলেও এ সেক্টরটি অবহেলিত। একসময় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, বহুতল ভবনে বিদ্যুৎ সংযোগের শর্ত হিসেবে 'সোলার প্রযুক্তি' ব্যবহার করতে হবে। এই শর্ত এখন আর কেউ মানেন না। এটি দেখারও যেন কেউ নেই। 'লিমা সমঝোতা' আমাদের জন্য কোনো সুসংবাদ বয়ে আনেনি। আমরা যে ঝুঁকির মধ্যে ছিলাম, সেই ঝুঁকিতেই থেকে গেলাম। উন্নত বিশ্ব আমাদের সমস্যার সমাধান করে দিয়ে যাবে না। আমাদের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে হবে। আমাদেরই একটা কর্মপদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হবে। লিমা সম্মেলনে আমাদের এ মেসেজটিই দিয়ে গেল। সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে। Daily Jai Jai Din 22.12.14
আমাদের মন্ত্রী, সচিব কিংবা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা বিদেশ সফর ও সম্মেলনে অংশ নিতে ভালোবাসেন। কানকুন, ডারবান, কাতার, কিংবা তারও আগে কোপেনহেগেনে (কপ সম্মেলন) আমাদের পরিবেশমন্ত্রী গেছেন। আমাদের কয়েকজন সংসদ সদস্য কোপেনহেগেনে প্লাকার্ড ও ফেস্টুন হাতে নিয়ে বিশ্বজনমত আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। আমরা পরিবেশ রক্ষায় তাতে বড় ধরনের আর্থিক সহায়তা পাইনি।
বলা ভালো বাংলাদেশ এককভাবে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনরোধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে না। বাংলাদেশ এককভাবে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ও তা সামগ্রিকভাবে বিশ্বের উষ্ণতা রোধ করতে খুব একটা প্রভাব রাখবে না। এ জন্য বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্তর্জাতিক আসরে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় বিদেশি সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। কিন্তু এই সাহায্যের ওপর নির্ভর করা ঠিক নয়। পরিবেশ বিপর্যয় পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বড় ভূমিকা রয়েছে। গেলবার যে বন্যা হলো আবার আমাদের সে কথাটাই স্মরণ করিয়ে দিল। বন্যার অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় এখন এ দেশে স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু 'সিডর' ও আইলার আঘাতে আমাদের যা ক্ষতি হয়েছিল সে ক্ষতি সারাতে সরকারের বড়সড় উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় ১ হাজার ২৬৮ কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হলেও এখানেও 'রাজনীতি' ঢুকে গেছে। দলীয় বিবেচনায় টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে (কালের কণ্ঠ ২৭ মে)। ভাবতে অবাক লাগে যেসব এনজিও জলবায়ু নিয়ে কাজ করেনি, যাদের কোনো অভিজ্ঞতাও নেই, শুধু দলীয় বিবেচনায় তাদের নামে টাকা বরাদ্দ ধরা হয়েছে। জলবায়ু তহবিলের অর্থ পাওয়া উচিত ওইসব অঞ্চলে যেখানে ঘূর্ণিঝড়, প্লাবনের আঘাত বেশি আর মানুষ 'যুদ্ধ' করে সেখানে বেঁচে থাকে। অথচ দেখা গেছে, জলবায়ুর জন্য বরাদ্দকৃত টাকা দেয়া হয়েছে ময়মনসিংহ পৌরসভাকে, মানিকগঞ্জের একটি প্রকল্পে কিংবা নীলফামারী তিস্তা বহুমুখী সমাজকল্যাণ সংস্থাকে। সিরাজগঞ্জের প্রগতি সংস্থাও পেয়েছে থোক বরাদ্দ। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের একটিরও জলবায়ুসংক্রান্ত কাজের কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। জলবায়ু তহবিলের টাকা বরাদ্দেও যদি 'রাজনীতি' ঢুকে যায় তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু থাকতে পারে না। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী দেখা যায়, বরাদ্দ পাওয়া এনজিওগুলোর সঙ্গে সরকারি দলের নেতা ও কর্মীরা জড়িত। জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু দুর্নীতি যদি এখানেও স্পর্শ করে তাহলে জলবায়ু ফান্ডে আর সাহায্য পাওয়া যাবে না। সচেতন হওয়ার সময় তাই এখনই। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারে সারা বিশ্বে একটা উদ্বিগ্নতা থাকলেও আমরা কতটুকু সচেতন তা নিশ্চিত নই। আমরা বার বার বিদেশ থেকে প্রাপ্ত সাহায্যের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। পরিবেশ দূষণ হয়, এমন কর্মকা-ের ওপর আমরা গুরুত্ব দিয়েছি কম। বিদেশ থেকে যে সাহায্য পাওয়া গেছে, তাতে দুর্নীতি রোধ করতে পারিনি। এমনকি সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রামপালে ভারতীয় কয়লায় একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছি। এ নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে বড় বিতর্ক থাকলেও সরকার ইতোমধ্যেই ১ হাজার ৮৪৭ একর জমি অধিগ্রহণ করেছে। এ কাজে ভারত থেকে বছরে ৪ মিলিয়ন টন কয়লা আমদানি করা হবে। অথচ বিশ্বব্যাপী এটা স্বীকৃত যে, কয়লা পোড়ালে বায়ুম-লে সবচেয়ে বেশি কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমন হয়। এখন লিমা সমঝোতায় বলা হয়েছে, প্রতিটি দেশকে 'নিজস্ব কর্মপদ্ধতি' নির্ধারণ করতে হবে। যেখানে কার্বন নিঃসরণ আমরা কমাতে চাই, সেখানে কি কয়লা পুড়িয়ে কার্বন নিঃসরণ বাড়াব? খুব সঙ্গত কারণেই 'লিমা সমঝোতার' পর রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। আমরা বার বার বলে আসছি, বাংলাদেশকে নিজস্ব উদ্যোগেই কার্বন নিঃসরণ রাখতে হবে। ইটের ভাটায় কয়লা পোড়ানো কমাতে হবে। এখানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। সোলার এনার্জি ও বায়ু বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতে হবে। সোলার প্রযুক্তির সম্ভাবনা থাকলেও এ সেক্টরটি অবহেলিত। একসময় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, বহুতল ভবনে বিদ্যুৎ সংযোগের শর্ত হিসেবে 'সোলার প্রযুক্তি' ব্যবহার করতে হবে। এই শর্ত এখন আর কেউ মানেন না। এটি দেখারও যেন কেউ নেই। 'লিমা সমঝোতা' আমাদের জন্য কোনো সুসংবাদ বয়ে আনেনি। আমরা যে ঝুঁকির মধ্যে ছিলাম, সেই ঝুঁকিতেই থেকে গেলাম। উন্নত বিশ্ব আমাদের সমস্যার সমাধান করে দিয়ে যাবে না। আমাদের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে হবে। আমাদেরই একটা কর্মপদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হবে। লিমা সম্মেলনে আমাদের এ মেসেজটিই দিয়ে গেল। সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে। Daily Jai Jai Din 22.12.14
0 comments:
Post a Comment