বৈদেশিক নীতিতে সফলতার কথা যদি বলি, তাহলে বলতে হয়, জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি শুধু উজ্জ্বলই করেনি, বরং বলা যেতে পারে বাংলাদেশ যে একটি 'সফট পাওয়ার'-এর দেশ এ কথাটা প্রমাণ করেছে। একাধিক মার্কিন প্রেসিডেন্টের মুখ থেকে বাংলাদেশের প্রশংসা আমরা শুনতে পেয়েছি। বাংলাদেশ যে মধ্য আফ্রিকার দেশগুলোতে শুধু শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছে তেমনটি নয়, বরং সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়ও অবদান রেখেছে। নামিবিয়া কিংবা কম্পুচিয়ায় বিবদমান দলগুলোর মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে সেখানে সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন সম্পন্ন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে একটি অনন্য ভূমিকা রেখেছে সেনাবাহিনী।
সিয়েরা লিওনে বাংলা ভাষাকে পরিচিত করতে সেনাবাহিনীর অবদানকে স্বীকার করা যায় না। এ ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা এ জন্য যে মন্ত্রণালয় এটিকে পুঁজি করে মধ্য আফ্রিকায় বাংলাদেশের স্বার্থকে আরো সম্প্রসারিত করতে পারেনি। লাইবেরিয়া, সিয়েরা লিওনে আমাদের স্বার্থ রয়েছে। পণ্যের বাজার, কৃষি বিশেষজ্ঞদের কর্মক্ষেত্র তৈরি, ডাক্তার কিংবা আইটি প্রফেশনালদের জন্য একটি বিশাল ক্ষেত্র রয়েছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী আসনে দু-দুবার নির্বাচিত হয়েছে। এটা আমাদের জন্য সম্মানের। এ ছাড়া বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় নির্বাচিত হয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য সম্মান বয়ে এনেছে। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। কিন্তু এই রিজার্ভের সদ্ব্যবহার আমরা করতে পারিনি। বাংলাদেশ ব্যাংক এ ক্ষেত্রে কোনো দিকনির্দেশনা দিতে পারেনি। একটা আশার কথা- সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপসহ বিশ্বজুড়ে অর্থনীতিতে মন্দাভাব দেখা গেলেও বাংলাদেশ প্রায় ৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। এটা আমাদের জন্য প্লাস পয়েন্ট। রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকা সত্ত্বেও অর্থনীতির চাকা ঘুরেছে; যদিও এ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের অবদান সবচেয়ে বেশি। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশি অদক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। সেখানে দক্ষ শ্রমশক্তির একটা বাজার থাকলেও এ ক্ষেত্রে কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। বরং অদক্ষ শ্রমিকরা যে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন, তার প্রতিকারের ব্যাপারেও কোনো উদ্যোগ নেয়নি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
মহাজোট সরকারের সময় অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি উন্নত হয়েছে। ট্রানজিট (ট্রান্সশিপমেন্ট অথবা করিডর) নিয়ে বাংলাদেশে বড় বিতর্ক থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় এ-সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং এরই মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে তা কার্যকরও হয়েছে, যদিও ট্রানজিট ফি এখনো নির্ধারিত হয়নি। বলা হচ্ছে ট্রানজিটের বিষয়টি বহুপাক্ষিকতার আলোকে দেখা হবে। কিন্তু দেখা গেল ভারত একপক্ষীয়ভাবে তা ব্যবহার করছে, ভুটান বা নেপাল এখনো ট্রানজিট পায়নি। ভারতের এ দুটি দেশকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার কথা। কিন্তু এরই মধ্যে ওই সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে- এ তথ্য আমাদের জানা নেই। এমনকি ভারতের 'সাত বোন' রাজ্যগুলো কর্তৃক চট্টগ্রাম সামুদ্রিক বন্দর ব্যবহারের যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাও বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশি পণ্য খালাস করতেই হিমশিম খাবে। এ ক্ষেত্রে সাত বোন রাজ্যের পণ্য বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। ভারত অবকাঠামো খাতে যে ঋণ দিয়েছে, তাও বাংলাদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর ঋণের মতোই এই ঋণ দিয়ে ভারতীয় পণ্য ও সেবা কিনতে আমরা বাধ্য। মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় যে উন্নয়ন ও সহযোগিতা-সংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার গুরুত্ব অনেক বেশি। ওই চুক্তিতে যে 'ভাষা' ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে ভারতীয় স্বার্থই রক্ষিত হয়েছে বেশি করে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। গত প্রায় ছয় বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারে ভারতের পাল্লাটা ভারী, বাংলাদেশের প্রাপ্তি তুলনামূলক বিচারে কম। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। কিন্তু তিস্তা চুক্তি এখনো হয়নি। সীমান্তে বিএসএফ দিয়ে বাংলাদেশিদের হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও বন্ধ হয়নি।
বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১১টি ছিটমহল ও ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের ব্যাপারেও কোনো সমাধান হয়নি। ভারত আমাদের ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল। এতে ১৩টি প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু সমন্বয়হীনতার কারণে প্রকল্পগুলোর ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে। ভারতের সঙ্গে আমাদের রয়েছে বিশাল এক বাণিজ্য ঘাটতি। এই বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর কোনো উদ্যোগ ভারতের নেই। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির একটি চুক্তি হলেও তাতে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। মহাজোট সরকারের আমলে হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির আলোকে ওই সফর গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাংলাদেশের প্রাপ্তি ছিল কম। যৌথ অংশীদারি সংলাপ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তিতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই, সহিংস চরমপন্থা, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান এবং জলদস্যুতার মতো আন্তর্দেশীয় অপরাধবোধ ও নিরাপত্তা সহযোগিতার কথা বলা হয়েছিল। তবে ধারণা করা হচ্ছে এবং বিভিন্ন বিশ্লেষকের লেখনীতে এটা বেরিয়ে এসেছে যে এ ধরনের চুক্তি ভবিষ্যতে চীনের বিরুদ্ধে একটি জোট গড়ে তোলার কাজে ব্যবহৃত হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান মার্কিন প্রভাব, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ গড়ে ওঠার আলোকেই হিলারির সফরকে বিশ্লেষণ করা যায়। হিলারির ওই সফরেও বাংলাদেশের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বাংলাদেশের সব পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের যে দাবি, তা এখন বাতিল হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র 'টিফা'র বদলে এখন 'টিআইসিএফ' (ট্রেড অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন ফোরাম) চুক্তি করতে যাচ্ছে। এতে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশ 'মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন' (এমসিসি) থেকে ভবিষ্যতে সাহায্য পাবে- এমন কোনো প্রতিশ্রুতিও আমরা পাইনি। তবে হিলারি ক্লিনটনের বক্তব্যে আমি আশাবাদী। তরুণদের সঙ্গে এক আড্ডায় তিনি বাংলাদেশকে একটি Soft Power হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। যেকোনো বিবেচনায় এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য। বিশ্ব শান্তি রক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়ে কিংবা আরএমজি সেক্টরে বিশ্ব আসরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ এরই মধ্যে একটি 'শক্তি' হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। হিলারি ক্লিনটন সেটিই স্বীকার করে গিয়েছিলেন। যাঁরা পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের উচিত হবে বাংলাদেশের এই অর্জনকে ধরে রাখা। সমুদ্রসীমায় আমাদের অধিকার নিশ্চিত হওয়ায় এই সম্ভাবনা এখন আরো বাড়ল। তবে যেতে হবে অনেক দূর। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে এরই মধ্যে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। রানা প্লাজায় এক হাজার ১২৭ জন পোশাককর্মীর মৃত্যু, গার্মেন্টশিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন চালু, শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকাণ্ড, গার্মেন্টশিল্পে শ্রমমান বজায় রাখার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ড. ইউনূস ইস্যু। প্রতিটি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আমাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে।
অতি সম্প্রতি একজন সিনিয়র মন্ত্রীর নিশা দেশাই কিংবা মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনাকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করা কোনো অবস্থায়ই বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাবে না। যেকোনো বিদেশি রাষ্ট্রদূতের বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে মন্তব্য করা অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু আমরা সেই সুযোগটি করে দিয়েছি। তবে কোনো নীতিনির্ধারক শালীনতাবর্জিত কথা বলবেন, সেটাও কাম্য নয়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বিশ্বে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম হলেও প্রধানমন্ত্রীর চীন ও জাপান সফর এই নেতিবাচক ধারণা কাটিয়ে উঠতে কিছুটা হলেও সাহায্য করেছে। জাপান ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক মূলত আর্থিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট। জাপানের কাছ থেকে আমরা বড় ধরনের সাহায্য পেয়ে থাকি এবং প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের সময়ও এই সাহায্যের ধারা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। চীনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। চীনের পররাষ্ট্রনীতি এখন ব্যবসানির্ভর। 'আইডোলজি' এখানে প্রাধান্য পায় না। ফলে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ বাড়ানো কিংবা গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে আগ্রহ সব কিছুই আবর্তিত হচ্ছে চীনের ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণের আলোকে। বাংলাদেশ উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বিসিআইএমের (বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার) ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহী এবং এ লক্ষ্যে একটি টিম কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আরো এক ধাপ এগিয়ে যাবে এবং অদূর ভবিষ্যতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যে বিশাল মুক্ত বাণিজ্য এলাকা গড়ে উঠছে, সেই বাজারে প্রবেশ করতে পারবে।
৪৪ বছর একটি রাষ্ট্রের জন্য কম সময় নয়। এই সময়সীমায় বৈদেশিক নীতিতে যেমন সফলতা এসেছে, ঠিক তেমনি ব্যর্থতাও একেবারে কম নয়। তবে বাংলাদেশকে এখন তাকাতে হবে ২০৫০ সালের দিকে। সনাতন বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। অর্থনৈতিক কূটনীতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। দক্ষ কূটনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তি বাড়াতে হবে। একটি বিশেষ দেশ বা বিশেষ এলাকাকে কেন্দ্র করে বৈদেশিক নীতি পরিচালনা করলে আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থ আদায় করতে ব্যর্থ হব। মনে রাখতে হবে, বৈদেশিক নীতির সঙ্গে জাতীয় স্বার্থের বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একটি দেশ তার জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখেই বৈদেশিক নীতি পরিচালনা করে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে জাতীয় স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হয়েছে, এ প্রশ্ন উঠবেই।
Daily Kalerkontho
07 December 2014, Sunday
0 comments:
Post a Comment