শেষ
পর্যন্ত বিরোধপূর্ণ ১৬২টি ছিটমহল বাংলাদেশ ও ভারতের মাঝে বিনিময় হতে
যাচ্ছে। ভারতের লোকসভার সংসদীয় কমিটি প্রস্তাবিত বিলটির অনুমোদন দিয়েছে। এর
অর্থ হচ্ছে, চলতি শীতকালীন অধিবেশনে বিলটি পাস হবে এবং সংবিধান সংশোধনের
বিষয়টি অনুমোদিত হবে। এর আগে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি নীতিগতভাবে ছিটমহল
বিনিময়ে তাদের আপত্তি প্রত্যাহার করে নিলে বিলটি সংসদে পাস হওয়ার সম্ভাবনা
উজ্জ্বল হয়। নিঃসন্দেহে এটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত
সম্পর্কের মাঝে আরও বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। তার যদি সমাধান না হয়, তাহলে
দু'দেশের সম্পর্ককে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যাবে না।
আমরা
দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ করেছি, সমস্যাগুলো জিইয়ে রেখে ভারত এ থেকে সুবিধা
নিচ্ছে। ভারতে কংগ্রেস সরকার দীর্ঘদিন সমস্যাগুলোর সমাধানের কোনো উদ্যোগ
নেয়নি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং কিংবা রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির
ঢাকা সফরের পরও সমস্যাগুলো যা ছিল, তা রয়ে গিয়েছিল। এক্ষেত্রে নরেন্দ্র
মোদি ক্ষমতাসীন হয়ে ছিটমহল সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নিলেন, নিঃসন্দেহে এটা
প্রশংসার যোগ্য। বাংলাদেশ বারবার প্রত্যাশা করেছে, সমস্যাগুলো সমাধানের
ব্যাপারে ভারত আরও আন্তরিক হোক। কিন্তু অতীতে কোনো সদিচ্ছা আমরা লক্ষ
করিনি। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর গেল সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ
থেকে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল ভারত সফর করেছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর
নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলটি জিসিসি বা ভারত-বাংলাদেশ যৌথ পরামর্শক কমিটির
তৃতীয় সভায় যোগ দিয়েছিল। জিসিসির সভায় কয়েকটি সিদ্ধান্ত হয়েছিল। চেন্নাই
হয়ে কলকাতা, অতঃপর বাংলাদেশের মংলা ও চট্টগ্রাম সমুদ্র উপকূল পথকে
সিঙ্গাপুর পর্যন্ত জাহাজ চলাচলের উপযোগী করা। এটা হয়তো ভালো। তাতে করে
বাংলাদেশ-ভারত সামুদ্রিক বাণিজ্য সম্প্রসারিত হবে। এতে করে বাংলাদেশ কতটুকু
লাভবান হবে, তা ভবিষ্যতের ব্যাপার। সিঙ্গাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারিত এ
বাণিজ্য রুট (?) বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের কতটুকু আকৃষ্ট করতে পারবে, এটাও
একটা প্রশ্ন। বাংলাদেশ ভারতীয় ব্যবসায়ীদের জন্য একাধিক রফতানি প্রক্রিয়াজাত
অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব দিয়েছিল। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এটা কি গ্রহণ
করবেন? মনে হয় না। কারণ তারা চান ব্যবসা করতে। সহজ-সরল কথায় জিনিস বিক্রি
করতে। পুঁজি বিনিয়োগ তারা করবেন না। ফলে বাংলাদেশের ওই প্রস্তাব কাগজ-কলমে
থেকে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। গুয়াহাটি-শিলং-ঢাকা বাস সার্ভিস চালুর বিষয়টি
কিংবা মৈত্রী ট্রেনের বগির সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়টি এর আগে আলোচিত হয়েছে। এটা
নতুন কিছু নয়। কিন্তু মৈত্রী ট্রেনে কেন যাত্রী বাড়ছে না, এ বিষয়টি তলিয়ে
দেখা হয়নি। বাংলাদেশী যাত্রীরা মৈত্রী ট্রেনের যাত্রা পছন্দ করেন। কিন্তু
'যাত্রী হয়রানি' বন্ধ না হলে বগির সংখ্যা বাড়িয়েও কোনো লাভ হবে না।
গুয়াহাটি-শিলং বাস সার্ভিস শুনতে ভালো শোনায়। কিন্তু এ রুটের অবকাঠামোগত
উন্নয়ন কে করবে? কবে হবে এসব কাজ- এসব ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ভাঙা
পথে এসি বাস চললে, তাতে যাত্রী পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট
বিষয় রয়েছে অনেক। যেমন- তিস্তার পানি বণ্টন, টিপাইমুখ বাঁধ, সীমান্ত হত্যা
বন্ধ, স্থলসীমানা নির্ধারণ, শুল্ক কমানো ও বাংলাদেশী পণ্যের পরিমাণ
বাড়ানো, ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প, বন্দি বিনিময় ইত্যাদি। কোনো একটি
বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট 'সিদ্ধান্ত' নেই। জিসিসির সভার পর যৌথ ইশতেহারে
বলা হয়েছিল, তিস্তার পানি ভাগাভাগির বিষয়ে আগের প্রতিশ্রুতিতে অটল থাকবে
ভারত। এটা কূটনীতির ভাষা। এটা আশ্বাস। এ আশ্বাসে আমাদের সন্তুষ্ট হওয়ার কথা
নয়। আমরা আমাদের ন্যায্য হিস্যা চাই। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্যা মমতা ব্যানার্জিকে নিয়ে। মমতার জন্য
তিস্তার পানি একটি 'রাজনৈতিক ইস্যু'। ২০১৬ সালে সেখানে বিধান সভার
নির্বাচন। লোকসভার নির্বাচনে তৃণমূলের পক্ষে বেশি ভোট পড়েছে। সুতরাং তিস্তা
তার জন্য একটা ইস্যু। এটা তিনি আবারও ব্যবহার করবেন। দিলি্লকে তিনি ছাড়
দেবেন না এতটুকুও। তবে সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে তিনি বেকায়দায় আছেন।
তৃণমূল-জামায়াত সম্পর্কের বিষয়টি মাহমুদ আলী-অজিত দোভালের আলোচনায় এসেছিল।
সিবিআই তদন্ত করছে। এখন এ সারদা কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র কীভাবে তাদের
স্বার্থে ব্যবহার করবে, সেটাই দেখার বিষয়। তবে ২০১৬-এর আগে তিস্তার পানি
বণ্টন নিয়ে কোনো সমঝোতার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ভারতীয় অনলাইন সংবাদ সংস্থা ২৪
ঘণ্টা ২১ সেপ্টেম্বর তারিখে আমাদের জানিয়ে দিয়েছিল, 'তিস্তার জল ও স্থল
সীমান্ত চুক্তি নিয়ে জটিলতার অবসান হয়নি।' সীমানা চিহ্নিত করার একটি উদ্যোগ
নিয়েছিল সাবেক মনমোহন সরকার। রাজ্যসভায় একটি বিলও উপস্থাপিত হয়েছিল। এখন
তা অনুমোদিত হলো। তবে এটাই শেষ কথা নয়। আর তিস্তা নিয়ে বলা হয়েছিল, 'সব
দলের (অর্থাৎ তৃণমূলের সঙ্গে!) সঙ্গে ঐকমত্যে পেঁৗছার চেষ্টা চলছে।' অর্থাৎ
আশ্বাস। চেষ্টা চলছে! এসবই কূটনীতির ভাষা। বলা ভালো বাংলাদেশের ভেতরে
রয়েছে ১১১টি ভারতীয় ছিটমহল, আর ভারতে রয়েছে ৫১টি বাংলাদেশী ছিটমহল। এরা কেউ
ভারতের সঙ্গে থাকতে চায়, কেউ চায় বাংলাদেশের সঙ্গে থাকতে। স্থানীয় বিজেপি
আবার এর বিরোধী। আসাম বিজেপিও স্থল সীমানা চিহ্নিতকরণের পক্ষে ছিল না।
তাদের আপত্তি ছিল প্রচুর। কেননা এতে করে ৬০০ একর জমি বাংলাদেশের কাছে চলে
যাবে। এতেই আপত্তি ছিল আসাম বিজেপির। কিন্তু এখন তারা তাদের আপত্তি তুলে
নিল। নরেন্দ্র মোদি আসামে এসেই ছিটমহল বিনিময়ের ঘোষণা দিলেন।
আন্তঃনদী
সংযোগ প্রকল্পের বিষয়ে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হয়, এমন কোনো পদক্ষেপ না
নেয়ারও আশ্বাস দিয়েছিল ভারত সরকার- এটা বাংলাদেশীদের জন্য সুখবর। আমরা এটা
জেনেছি একটি সংবাদ মাধ্যমের নয়াদিল্লি থেকে পাঠানো প্রতিবেদন থেকে। কিন্তু
যতদূর জানা যায়, মোদি ক্ষমতা গ্রহণ করে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের
নির্দেশ দিয়েছিলেন। ভারতের সুপ্রিমকোর্টের একটি রায়ও আছে মোদির পক্ষে।
বাংলাদেশ বারবার আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে যে ক্ষতি হবে, সে
কথা বলে আসছে। এখন প্রকাশিত বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। সত্যিকার অর্থেই
ভারত যদি এ প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে না যায়, তাহলে তাতে ভারতের পরিবেশবাদীরাই যে
খুশি হবেন, তা নয়। বরং বাংলাদেশ বড় ধরনের পানি-সঙ্কট থেকে রক্ষা পাবে। একই
কথা প্রযোজ্য টিপাইমুখ বাঁধের ক্ষেত্রেও। মোদি সরকার সাবেক মনমোহন সিং
সরকারের দেয়া বক্তব্যই উল্লেখ করেছে মাত্র। তাদের ভাষায়, ভারত এমন কিছু
করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভারতে এরই
মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে এবং ভারত সরকার ৯ হাজার কোটি রুপি খরচও
করে ফেলেছে। এ অর্থ তাহলে ব্যয় হলো কোথায়? গঙ্গা চুক্তি নিয়েও আলোচনার
প্রয়োজন আছে। কেননা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ পানি পাচ্ছে না। চুক্তির মেয়াদ
শেষ হবে ২০২৭ সালে। জনসংখ্যা তখন বাড়বে তিনগুণ। পানির চাহিদাও বাড়বে।
সুতরাং চুক্তিতে পর্যালোচনার যে সুযোগ রয়েছে, বাংলাদেশের উচিত এ ব্যাপারে
ভারতকে রাজি করানো। অনুপ চেটিয়াকে (উলফা নেতা ও বাংলাদেশে রাজনৈতিক
আশ্রয়প্রার্থী) ফেরত দেয়া ও নূর হোসেনকে (নারায়ণগঞ্জ ৭ খুনের আসামি) ফেরত
আনার বিষয়টিও আলোচনায় রয়েছে। নূর হোসেন কলকাতায় একটি অপরাধ করেছেন। সেই
অপরাধে তার বিচার হচ্ছে। এখন বিচার চলাকালীন তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো
যাবে কিনা- এটা একটা আইনগত প্রশ্ন। তবে অনুপ চেটিয়ার সঙ্গে এ বিষয়টিকে
মেলান যাবে না। অনুপ চেটিয়া নিজেই ভারতে যেতে চেয়েছেন! সীমান্ত হত্যা বন্ধ
হয়নি সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও। সিদ্ধান্ত
হয়েছে, সীমান্তবর্তী জেলার জেলা প্রশাসকরা আগামীতে দিলি্লতে মিলিত হবেন।
কিন্তু তাতে সীমান্ত হত্যা বন্ধ হবে কি? যেদিন জেসিসির বৈঠক চলছিল, সেদিনও
বিএসএফের গুলিতে তিনজন বাংলাদেশী আহত হয়েছিলেন। মোদি নেপাল, ভুটান, ভারতের
উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও বাংলাদেশকে নিয়ে উপআঞ্চলিক জোটের যে ধারণা দিয়েছেন,
তাতে মিয়ানমারের অন্তর্ভুক্তিও চাচ্ছেন। এতে করে নতুন একটা জোট গঠিত হতে
পারে। যদিও বিসিআইএম জোট (বাংলাদেশ, চীন, ভারত, মিয়ানমার) কাজ করছে এবং
বাংলাদেশ এ জোট কার্যকর করার জন্য বড় ভূমিকা পালন করছে। এখন মোদির
প্রস্তাবিত নয়া জোটের সঙ্গে বিসিআইএমের কী ভূমিকা থাকবে, সেটা একটা প্রশ্ন
হয়েই রইল। দু'দেশের বাণিজ্য ছয় বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার কথা বলা হচ্ছে;
কিন্তু ভারতে বাংলাদেশের পণ্যের সম্প্রসারণে কোনো উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে
না। ট্যারিফ ও প্যারা-ট্যারিফের কারণে বাংলাদেশী পণ্য ভারতে বাজার পাচ্ছে
না। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির ব্যাপারে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। আমরা ৫০০
মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছি। আরও ৫০০ মেগাওয়াটের প্রতিশ্রুতি মিলেছে। আসলে
বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করতে হবে আঞ্চলিক ভিত্তিতে। বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান
ও ভারত সম্মিলিতভাবে বিনিয়োগ করে হিমালয় অঞ্চলে বিপুল বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে
পারে; কিন্তু ভারত এটা করছে দ্বিপক্ষীয়ভাবে।
আজ ভারত ছিটমহল
বিনিময় চুক্তিটি কার্যকর করতে যাচ্ছে। দীর্ঘ ৪০ বছর পর এ চুক্তিটি কার্যকর
হলে, তা দু'দেশের সম্পর্ককে নতুন একটি মাত্রা দেবে। তবে অন্য সমস্যাগুলোর
সমাধান যদি না হয়, তাহলে ভারতের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। তাই শুধু
ছিটমহল বিনিময়ই যথেষ্ট নয়। ভারতকে আরও আন্তরিক হতে হবে। আমাদের তাকাতে হবে
সামনের দিকে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এ অঞ্চলের রাজনীতিকে পরিপূর্ণভাবে বদলে
দিতে পারে। এক্ষেত্রে ভারতকে দ্বিপাক্ষিকতার বেড়াজাল থেকে বের হয়ে আসতে
হবে। দ্বিপাক্ষিকতা নয়, দরকার বহুপাক্ষিকতা। বাংলাদেশ বহুপাক্ষিকতায়
বিশ্বাসী। কিন্তু ভারতের আদর্শ হচ্ছে দ্বিপাক্ষিকতা। অর্থাৎ দ্বিপাক্ষিকতার
আলোকেই ভারত সমস্যাগুলোর সমাধান চায়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার যে সমস্যা, তা
দ্বিপাক্ষিকতার চেয়ে বহুপাক্ষিকতার আলোকে সমাধান করা শ্রেয়। ভারতকে এ
বিষয়টি বোঝাতে হবে।
ভারত ছিটমহল সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে।
এটা ভালো। এখন যদি অন্যান্য সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নেয়, তাহলে এ অঞ্চলের
রাজনীতিতে একটি বড় ধরনের গুণগত পরিবর্তন আসবে। তাই মোদি সরকারের কাছে
বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি।
Daily Alokito Bangladesh
09.12.14
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment